বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ১৮, ২০২৪

​মহাসত্যের বিপরীতে দ্বিতীয় খণ্ড # পঞ্চম পর্ব

মুড়ো হয় বুড়ো গাছ, হাত গোন ভাত পাঁচ,/ দিক পাও ঠিক ঠিক জবাবে ! – সত্যজিৎ রায়

এই প্রথম মঠাধ্যক্ষের আওয়াজে স্বরের ওঠানামা টের পায় গরব। এই আওয়াজ একটু অন্যরকম। গরব আগেও অনেকবার লামাদের মুখে এমন কথা শুনেছে যে অনেক মানুষের মৃত্যুর অনেক আগেই নেমচেস তার দেহ ছেড়ে চলে যেতে পারে! কিন্তু একজন ডাকাতের ৬ষ্ঠ ইন্দ্রিয় মঠাধ্যক্ষের আওয়াজে স্বরের ওঠানামায় রহস্য অনুভব করে তটস্থ হয়ে ওঠে। এই একবছরেরও বেশি সময় ধরে রামপ্রসাদের অধীনে যোগশিক্ষা তাঁকে আরও অনেক বেশি ইন্দ্রিয়সচেতন করে তুলেছে।

অনেক মানুষের দৈহিক মৃত্যুর পর গ্রামীণ তিব্বতি লামারা এমন ঘোষণা করে যে কয়েকমাস বা কয়েক বছর আগেই নেমচেস তাকে ছেড়ে চলে গেছিল। একই কারণে অনেক অসুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রেও লামা চিকিৎসকরা কোনওরকম ওষুধ ও পুজো করতে চান না; যার শরীরে আত্মা নেই তার চিকিৎসা করে লাভ নেই। গরবও এতদিন এসব বিশ্বাস করেছে। কিন্তু তার নিজের ক্ষেত্রে মঠাধ্যক্ষের এই নিদান বিশ্বাস করতে মন চায় না। সে ত সম্পূর্ণ সুস্থ একজন মানুষ ! তার শরীরে আত্মা নেই?

তার এই দ্বিধা স্মভবতঃ মঠাধ্যক্ষও টের পায়। তিনি আবার আগের মতন ধাতব আওয়াজে বলতে শুরু করেন, তোমার বর্তমান ক্রিয়াকলাপ তোমার আত্মা যখন দেহে ছিল তখনকার নির্দেশ অনুযায়ী চলছে ! কুমোরের চাকা যেমন কুমোর নিজে ঘোরানো বন্ধ করে দেওয়ার পরও কিছুক্ষণ ঘোরে! নেমচেসহীন এই বেতাল জীবন দিয়ে কী করবে তুমি? তার চাইতে পরার্থে নিজেকে উৎসর্গ করে পরবর্তী জন্মের জন্যে অসীম পুণ্য অর্জন করো। এই পুণ্যফলের কিছুটা তুমি নিজের প্রিয়জনদেরও উৎসর্গ করতে পারো!

মঠাধ্যক্ষ কলের পুতুলের মতন হেঁটে ভারী কাপড়ের পর্দা সরিয়ে একটি দরজা খুলে দেন। এতক্ষণ যাবৎ গরব বুঝতেই পারেনি যে ওই পর্দার পেছনে একটি দরজা রয়েছে।

– ‘এসো!’ ওই পর্দা সরিয়ে দরজা খুলে ডাকেন মঠাধ্যক্ষ। তাঁর পেছন পেছন দরজা পেরিয়ে গরব দেখে একটা ছোট্ট উঠোন। এখানে প্রখর রোদ। কিন্তু বাতাসে শীতের ছোঁয়া থাকায় সেই রোদ বেশ উপভোগ্য। এক পলকে পাহাড়ের কোলে এই মনোরম উঠোনটিকে দেখে সে মঠাধ্যক্ষের দিকে মনোনিবেশ করে।

এবার মঠাধ্যক্ষ বলেন, তোমার ডানহাতটাকে সোজা সামনে মাটির সমান্তরালে এমনভাবে প্রসারিত করো যাতে তোমার কব্জিটা কাঁধ বরাবর থাকে। দেখতে পাচ্ছো তোমার কব্জিটা ক্রমে সরু হয়ে যাচ্ছে। সরু হতে হতে ক্রমে সুতলির মতন এবং তারপর ভাগ হয়ে ক্রমে হাত থেকে আলাদা হয়ে পড়েছে। এমনটি যে দেখতে পায় সেই ব্যক্তির শরীরে আর নেমচেস নেই, তার দেহ আর সীমিত সময় পর্যন্ত সক্রিয় থাকবে!

গরব মঠাধ্যক্ষের কথা মতন নিজের হাতটাকে সোজা সামনে মাটির সমান্তরালে প্রসারিত করে কব্জির দিকে তাকিয়েই চমকে ওঠে, শিউরে ওঠে! তাই তো, কব্জিটা কেমন ক্রমে সুতলির মতন সরু দেখা যাচ্ছে, কেমন স্বচ্ছ কিন্তু ভাগ হয়নি, বাহু থেকে হাত বা কব্জি আলাদাও হয়নি।

গরব খুশি হয়ে বলে ওঠে, কই, আমার হাত কিম্বা কব্জি বাহু থেকে আলাদা হয়নি!

– একদৃষ্টে তাকাও! স্বরহীন আওয়াজে আদেশ করেন মঠাধ্যক্ষ। তাঁর চোখ দুটি জুলজুল করছে। তিনি কি গরবকে সম্মোহনের চেষ্টা করছেন? গরব নিজেকে তটস্থ রাখতে দেচমার শরীর ভাবতে শুরু করে, দুটি স্বপ্নভরা চোখ, ক্মলার কোয়ার মতন ঠোঁটদুটি, তার কুচযোগ, সুডৌল নিতম্ব, তার রেশমি গোলাপি গুহাদ্বার! তার তীব্র আশ্লেষ ! গরব টের পার যে তার শিশ্ন দৃঢ় হতে শুরু করেছে। শরীর চনমনে হচ্ছে। সে এই আমন্ত্রিত যৌন ভাবনাকে খুব উপভোগ করে। আবার দেচমা বেঁচে নেই, একথা মনে হতেই মনের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে।

মঠাধ্যক্ষ গরবকে সম্মোহনে কিছুটা সফল হলেও পূর্ণ সাফল্য না পেয়ে অবাক। তিনি আবারও মন্ত্রের মতন উচ্চারণ করেন, –‘একদৃষ্টে তাকাও!’

গরব আবারও তাকায় তার প্রসারিত ডানহাতের কজির দিকে। কিন্তু সে একই রকম দেখে। বরঞ্চ কব্জিটা আগের থেকে আরও স্পষ্ট। সে কিছু পাখির কিচিরমিচির শুনতে পায়। পাখিগুলি কোথা থেকে ডাকছে? এবার গরব ইচ্ছে করেই কণ্ঠে উচ্ছাস এনে বলে ওঠে, আমার হাত ও কব্জি এখনও জুড়ে রয়েছে বাবা, বিভক্তও হয়নি! আমি বেঁচে আছি . . . আমার নেমচেস চলে যায়নি!

মঠাধ্যক্ষ একটু থেমে বলেন, মায়া! তোমার রিক্ত দেহের প্রতি, জীবনের প্রতি প্রবল আসক্তির ফলে তুমি মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে আছো, সেজন্যেই সত্যকে দেখতে পাচ্ছো না!

গরব আবার পাখির কিচিরমিচির শুনতে পায়। পাখিগুলি কোথা থেকে ডাকছে?

মঠাধ্যক্ষ জলদগম্ভীর কন্ঠে বলেন, তোমার কামরায় ফিরে যাও , বাইরে বেরিও না, ঘরে বসে এই পরীক্ষাটি করে দেখ, বাস্তবকে জানতে পারবে! সত্যকে উপলব্ধি করার পরও তুমি যদি আত্মাহীন শরীর ধারণ করে বাকি দিনগুলি কাটানোর সিদ্ধান্ত নাও, আমাকে জানিও! তখনই আবার দেখা হবে, যাও!

এই কার্যত গৃহবন্দি থাকার আদেশ আপাতত মানলেও দৈহিক মৃত্যুর আগে পরার্থে আত্মোৎসর্গ করার উপদেশ গরবের মনঃপূত হয়নি! সে কেন নিজেকে বলি দেবে? এত পুণ্য তার চাই না!

নিজের কামরায় যাওয়ার আগে সে রামপ্রসাদের কামরায় ঢোকে। ঘর ফাঁকা দেখে তার পেটে মোচড় দেয়। সে অনুভব করে, তার ও রামের বিরুদ্ধে নিঃসন্দেহে একটি শয়তানি যড়যন্ত্র রচিত হয়েছে। মঠাধ্যক্ষের সঙ্গে তার কী কথাবার্তা হয়েছে তা যেন রাম না জানতে পারে সেজন্যেই হয়তো ওকে গৃহবন্দি থাকতে বলা হয়েছে। একই কারণে হয়তো রামকে এখান থেকে সরানো হয়েছে। কিন্তু কেন? এখন রামের সঙ্গে কথা বলা খুব জরুরি। সে যখনই ঘরে ফিরুক না কেন গরবের সঙ্গে যাতে অবশ্যই দেখা করে এই বার্তা তাকে দিতে হবে। সমূহ বিপদ থেকে নিজেদেরকে বাঁচানোর কোনও উপায় হয়তো এখনও রয়েছে, সেটাই ভেবে ঠিক করতে হবে!

গরব দ্রুত রামের কামরার নিভে থাকা আগুন পোহানোর কড়াই থেকে একটি কয়লা নিয়ে কামরার দেওয়ালের এক কোণায় একটি ছোট্ট চতুর্ভুজ এঁকে তার ভেতরে একটি বৃত্ত আঁকে। এটা আঁকার সময় রামের শেখানো একটি জাদুমন্ত্র সে মৃদুস্বরে উচ্চারণ করে। এই চিহ্ন ও মন্ত্র তার বন্ধুকে রক্ষা করবে আর ফেরার পর তৎক্ষণাৎ তার সঙ্গে দেখা করার বার্তা দেবে। রামের ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে পা রাখতেই গরব একজন মঠবাসীকে দেখতে পায়। নির্ঘাত মঠাধ্যক্ষের গোয়েন্দা!

গরব শান্তকণ্ঠে লোকটিকে বলে, রামকে বলতে এসেছিলাম যে আগামী কয়কেদিন ঘরের মধ্যে নিভৃতে ধ্যান করবো। সে নেই, কোথায় গেছে জানেন? লোকটা বলে, মনে হচ্ছে চলে গেছে, অনেকক্ষণ আগে ওকে একজন চিকিৎসকের সঙ্গে হাসপাতালের দিকে যেতে দেখেছি, তারপর আর দেখিনি!

এই জবাব শুনে গরবের মনের আশঙ্কা আরও তীব্র হয়। যে বিপদের সম্ভাবনার কথা সে এতদিন ভেবেছে এবার চারপাশে কোথাও তার পদধ্বনি শুনতে পায় গরব। সেই বিপদের আকার ও প্রকার কেমন হবে কে জানে! বনরা নিশ্চিতভাবেই এই হিন্দুসাধুকে শত্রু ভেবে তাকে তুলে নিয়ে গেছে। অথচ সে তো ওদের সঙ্গে কোনও শত্রুতা চায়নি। সে তো কেবলই শিখতে চেয়েছিল, জানতে চেয়েছিল। গরবের খুব অসহায় লাগে।

সে ভাবে, বনরা এক্ষুণি হয়তো তাকে মেরে ফেলবে না। মঠাধ্যক্ষ যেমন গরবকে বুঝিয়েছেন যে তার আত্মা চলে গেছে, দেহটা যে কদিন টিকে থাকে তাকে পরার্থে উৎসর্গ করে পরজন্মের জন্য পুণ্য কামাতে। কিন্তু কেমন বলিদান তিনি প্রত্যাশা করেন তা গরবকে ভেঙে বলেননি। আবার তাকে কোনওভাবে মেরে ফেলার চেষ্টা না করে তার মানসিক পরিবর্তনের জন্য গৃহবন্দি থেকে বাহু থেকে হাত আর কব্জি আলাদা হয় কিনা বারবার তা দেখার পরীক্ষা চালাতে বলেছেন!

ওরা হয়তো রামপ্রসাদকেও এমনি বলিদানের পরামর্শ দেবে। কিন্তু দুম করে মেরে ফেলবে না। ওদের কাজের ধারা হয়তো এরকমই। এহেন অপরাধ না করার পেছনে নিশ্চয়ই কোনও গূঢ় কারণ রয়েছে। রাম হয়তো কিছুক্ষণ পরই ওর কামরায় ফিরে আসবে! তারপর দেওয়ালে ওর আঁকা নকশা দেখতে পেলে তখুনি গরবের সঙ্গে দেখা করতে আসবে! রাম এলেই গরব ওর সঙ্গে পরামর্শ করবে কিভাবে দ্রুত এই পিশাচসিদ্ধ জাদুকরের আখড়া ছেড়ে পালানো যায়! নিজের কামরার দরজা বন্ধ করে পাথরের উপর বিছানো ওর শক্ত বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশপাতাল ভাবতে থাকে।

এই প্রথম সে দিনের বেলায় নিজের কামরার দরজা বন্ধ করেছে। মঠাধ্যক্ষের আদেশ পালন? মনটাও ভাল নেই। সে যোগাসনে বসে একাগ্রচিত্তে ধীরে ধীরে নিজের চৈতন্যকে আরও সতেজ করার চেষ্টা করে যায়।

এই দ্বিতীয় বেষ্টনীতে ঢোকার দিন যেমন একজন মঠবাসী ওর জন্যে খাবার এনেছিল, এদিন সন্ধ্যায়ও তেমনি খাবার নিয়ে একজন ওর দরজায় টোকা দেয়। গরব বড় আশা নিয়ে দরজা খুলে ওকে দেখে একরকম হতাশ হয়। কিন্তু সে নীরবে হাত বাড়িয়ে খাবার নিয়ে আবার দরজা বন্ধ করে দেয়। প্রাক্তন দস্যুসর্দার এবার তার ৬ষ্ঠ ইন্দ্রিয় এবং অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে শুরু করে। এই খাবার থেকে কিছু শুকনো মাংস ও ৎসাম্পা সে একটা পুটলিতে বেঁধে অনাগত অভিযানের জন্য সঞ্চয় করে। এমনিতেও খুব একটা খিদে নেই। সে আবার কিছু যোগাসন করে। অনেকক্ষণ ধরেই করে দরদর করে ঘামতে থাকে। তারপর একসময় খিদে পেলে দুটো খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। রাম ফিরলে নিশ্চয়ই ওর কাছে আসবে।

কিন্তু পরদিনও রাম আসে না। গরবও মঠাধ্যক্ষের উপদেশ মেনে হাত ও কব্জির পরীক্ষা না করে ব্যায়াম, যোগাসন ও ধ্যান করে। পরবর্তী লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। কয়েকবার প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়া ছাড়া সে একটি বারের জন্যেও কামরা থেকে বেরোয় না। রামের খোঁজ নেওয়ার ইচ্ছেকে চেপে রেখে ব্যায়াম ও ধ্যান করতে থাকে। সেদিনকার দুপুর ও রাতের খাবার থেকেও কিছুটা সে সঞ্চয় করে। সারাদিনের পরিশ্রমে রাতে ভাল ঘুম হয়।

কিন্তু তৃতীয় দিনেও রাম না আসায় গরবের উচাটন বাড়ে। ধ্যানে মন বসে না। সে নিজের অজান্তেই একবার মঠাধ্যক্ষের পরামর্শ অনুযায়ী ভ্র বরাবর হাত প্রসারিত করে কব্জির দিকে তাকায়। হাতের অগ্রভাগ ধীরে ধীরে সরু হয়ে যেতে দেখে। কব্জিটা অস্পষ্ট দেখা যায়, কিন্তু অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়েও কব্জি কিম্বা হাতকে বাহু থেকে আলাদা হতে দেখে না। দুপুরে খাওয়ার পর বিছানায় শুয়েও হাতকে বাহু থেকে আলাদা হতে দেখে না। দুপুরে খাওয়ার পর বিছানায় শুয়েও ঘুম আসে না। সে আরও কয়েকবার পরীক্ষা করেও একই ফল পায়। এতে তার মনে একটা পুলক জাগে। এই পুলক থেকেই সে আরেকবার দেচমার কথা ভাবে। দুটি স্বপ্নভরা চোখের আকর্ষণ, কমলার কোয়ার মতন ঠোঁটদুটির তৃষ্ণা, তার কুচযোগের স্পন্দন, সুডৌল নিতম্বের দুলকি চাল, গরবের স্পর্শে তার সারা শরীরে শিহরণ, কাঁটা দেওয়া রোমকূপগুলি, গরবের আলিঙ্গনে তার পুলক, সক্রিয় সহবাসে প্রতিবারেই নতুন নতুন আবিষ্কার, অসাধারণ পূর্বরাগে তার রেশমি গোলাপি গুহাদ্বারে তরল মুক্তো ক্ষরণ! তীব্র আশ্লেষে গরবের বিস্ফারিত উত্থিত শিশ্ন তার দেহে প্রোথিত হলে তার শীৎকার। এসব ভাবনায় বুঁদ হয়ে থেকে সে বেশ কিছুক্ষণ চনমনে থাকে। কিন্তু এই আমন্ত্রিত যৌন ভাবনা, এই পুলক দীর্ঘস্থায়ী হয় না। রামের কথা ভেবে দুশ্চিন্তায় মন ভরে যায়। এই দুশ্চিন্তায় রাতে ভাল ঘুম হয় না। বারবার বিছানায় শোয়, ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে প্রায়, কিন্তু দুশ্চিন্তায় ঘুম চটে যায় বারবার। বারবার বিছানা থেকে উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে থাকে। তাছাড়া জেগে থাকলে বারবার পেচ্ছাব করতে যেতে হয়, জল খেতে হয়।

কিন্তু চতুর্থ দিনেও রামপ্রসাদ ফেরে না। গরব এবার একরকম আশা ছেড়ে দেয়। এই হতাশা তাকে আরও সচকিত করে তোলে। এই মঠে মৃত্যুর ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। ওর চোয়াল শক্ত হয়। সে মনে মনে ভাবে, রামপ্রসাদকে যে করেই হোক খুঁজে বের করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করতে হবে; নাহলে দেরি হয়ে যেতে পারে।

সকালে সে শবাসনে শুয়ে বেশ খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়। তারপর স্নানঘরে গিয়ে ভালমতন স্নান করে। দুপুরে খাওয়ার সময় সে ভাবে, রামের না ফেরার আরেকটি কারণ হতে পারে, সে কোথাও যায়নি। তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যত সময় যায় এই ধারণাটাই তার মনে পোক্ত হতে থাকে। তাহলে সে এখন কোথায়? তার বন্ধুকে নির্ঘাত এই মঠেরই কোনও গোপন স্থানে বন্দি করা হয়েছে। হাসপাতালে সবার যাতায়াত থাকায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায় তাকে সেখানে রাখা হয়নি। দ্বিতীয় বেষ্টনীতেও অনেক শিক্ষানবিশরা রয়েছে তাই এই এলাকায়ও কাউকে বন্দি করে রাখার ঝুঁকি ওরা নেবেনা। বাকি রইলো মঠাধ্যক্ষের বাসস্থান আর মন্দিরের পেছনে যদি কোনও চোরাকুঠুরি থাকে! রামের অন্তর্ধানের সময় মঠাধ্যক্ষের বাসস্থানে গরব ছিল। রামকে হয়তো পরে অন্য পথে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু এই তত্ত্বেও গরবের মন সায় দেয় না। ওর ধারণা গুপ্তবিদ্যার ক্ষেত্রে রাম কোনওভাবেই মঠাধ্যক্ষের থেকে কম নয়, কাজেই ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ ওকে কিছু করতে পারবে না! নাকি গরব যাকে দেখেছে সেই মঠাধ্যক্ষ থেকেও গুপ্তবিদ্যায় শক্তিশালী কেউ এই মঠে রয়েছেন? রাম একটি রহস্যের কথা বারবার বলতো, সেই রহস্যটা আবিষ্কার করার জন্যেইএখানে থেকে গেছে ।

রাম মানবতার স্বার্থে বন চিকিৎসা শাস্ত্রের সঙ্গে হিন্দু ও বৌদ্ধ চিকিৎসা শাস্ত্রের সমন্বয় চেয়েছিল। কিন্তু বনরা স্বাতন্ত্রকামী। তারা কোনও সমন্বয় চায় না।

রামের কাছে বন - বৌদ্ধ বিবাদ ও সহাবস্থানের ইতিহাস জেনেছে গরব। তিব্বতে আসার আগেই অনেক পড়াশুনা করেছে রাম। তিব্বতের রাজা স্রেং - সান - গাম্পোর সুযোগ্য উত্তরাধিকারী রাজা থ্রি - স্রোন - ইদে - সান ( ৭৫৫ - ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ) সিংহাসনে বসেই তিব্বতে ভারসাম্য আনতে বন ও বৌদ্ধধর্মের বিবাদ মেটাতে চেয়েছিলেন। অনেক খোঁজাখুঁজি, বাক - বিতণ্ডা ও যুক্তির ঝড় পেরিয়ে একজন অসাধারণ গুরুর সন্ধান পান কাশ্মীরে। সেই মহাপণ্ডিত গুরু পদ্মসম্ভবকে রাজ্যের আচার্য হিসেবে গ্রহণ করেন তিনি। তাকে তিব্বতে রিম্পোচে বা মহাগুরু এবং উরগীয়ান লামা বলা হয়। কাশ্মীরের উরগীয়ন গ্রামে তার জন্ম। তন্ত্র ও বেদ উভয় শাস্ত্রেই অসাধারণ পণ্ডিত। তিনি জানতেন যে হঠাৎ যদি বনদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করেন তাহলে বৌদ্ধধর্মই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই খুব সাবধানে তাদের মনে প্রভাব বিস্তার করতে নিজের তত্ত্বজ্ঞান কাজে লাগিয়ে তাদেরকে শেখান, ভূতপ্রেত ও দৈত্য দানবকে শ্রদ্ধা সহকারে ধীরে ধীরে বশে এনে শান্তির পথ খুঁজে বের করতে হবে। শান্তি লাভের পর ক্রমে মুক্তি - মোক্ষ ও নির্বাণলাভের পথও খুঁজে বের করতে হবে!

তাঁর এই ঐক্যবাদ বেশ জনপ্রিয় হয়। যারা তাঁর কথায় অবিশ্বাস বা অশ্রদ্ধা দেখাতো, পদ্ম - সম্ভব তাদের নানারকম অলৌকিক শক্তির ব্যাপার স্যাপার দেখিয়ে বশে আনতেন। দেখতে দেখতে এই গুরু রিমপোচের নাম সারা তিব্বতে ছড়িয়ে পড়ে। বনপন্থীরাও তাঁর কাছে এসে দীক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করে, পাশাপাশি রাজধর্ম বৌদ্ধধর্মেরও প্রসার ঘটতে থাকে। রাজা থ্রি - স্রোন - ইদে - সান পদ্ম - সম্ভবের গুণ ও অলৌকিক শক্তির প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে ধর্ম প্রচারের জন্য রাজকোষ উন্মুক্ত করে দেন। সেই সময় বহু তিব্বতি পণ্ডিত ভারতে যান ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃত চর্চার জন্য। বিখ্যাত পণ্ডিত শান্তরক্ষিত ও কমলাশীল সেই সময়েই ভারত থেকে তিব্বতে আসেন। চীন থেকেও অনেক পণ্ডিত আসেন। রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় চীন ও ভারত থেকে আসা ওই পণ্ডিতরা ধর্ম ও দর্শন নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা এবং বিতর্কে অংশ নিতেন।

লাহসার রাজপ্রাসাদে তেমনি একটি বিতর্কে ভারতীয় পণ্ডিত কমলাশীল চীনা পণ্ডিতদের পরাস্ত করেন। পণ্ডিত কমলাশীলের অসাধারণ পাণ্ডিত্যের পরিচয় পেয়ে রাজা খুব খুশি হন। কিন্তু চীনা পণ্ডিতরা লজ্জায় ও অপমানে বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে ষড়যন্ত্র করে কিছুদিন পরই আততায়ীর হাতে পন্ডিত কমলাশীলকে হত্যা করান। কিন্তু পন্ডিত কমলাশীলের হত্যা তিব্বতের মাটিতে ভারতীয় ভাবমূর্তির জয়জয়কার দ্বিগুণ করে দেয়। তিব্বতে ভারতীয় দর্শন চর্চায় জোয়ার আসে। হয়তো তখনই তিব্বতি ভাষায় অনেক ভারতীয় দর্শন ও আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের অনুবাদ হয়। গুরু পদ্মসম্ভবের জয়জয়কারও আরও ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনটাও ছিল অদ্ভুত। গুরু পদ্মসম্ভব সংসারী মানুষ; চার প্রধান স্ত্রী ছাড়াও অনেক উপপত্নী। কিন্তু সেজন্যে তাঁর সম্মান বা প্রতিপত্তি এতটুকু কমেনি। তিনিই তন্ত্র ও বৌদ্ধ শাস্ত্রের সমন্বয় ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন তিব্বতের বৌদ্ধতন্ত্র মার্গ। এই বৌদ্ধতন্ত্র একটি এমন আবিষ্কার যা অচিরেই বনধর্মের প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠে। পাশাপাশি রাজ আনুকুল্যে গুরু রিম্পোচে গোটা তিব্বতে প্রচুর মঠ ও বিহার স্থাপন করেন। বুদ্ধের বাণী ও উপদেশ প্রচারের জন্য মঠের শিক্ষিত ছাত্রদের প্রতিটি গ্রামে অন্তত একজন করে লামা হিসেবে মোতায়েন করেন। এই লামা একাধারে রাজা ও ধর্মের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করবেন।তিব্বতে লামাপূজাতখন থেকেই শুরু হয়।

শেষ বয়সে গুরু রিম্পোচে তন্ত্র থেকে সরে আসেন মোক্ষ ও নির্বাণের আদর্শে। ফলে তাঁরই এক বনপন্থী শিষ্যের হাতে তিনি নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর সেই তান্ত্রিক পুরোহিত বহুমূল্য তিব্বতী ভাষায় অনুদিত ভারতীয় দর্শন ও আয়ুর্বেদ গ্রন্থ নষ্ট করে দেয়। সেসব গ্রন্থের অনুবাদ আর পাওয়া যায়নি। অবশ্য রাজার আদেশে সৈনিকরা গুরু পদ্মসম্ভবের হত্যাকারীকে ধরতে পেরে তার মুণ্ডচ্ছেদ করে।

তিব্বতে গুরু রিম্পোচে বুদ্ধাবতার হিসেবে আজও পূজিত। বিশেষ করে নী - ইংমা - পা সম্প্রদায়ের মানুষ তাকে সর্বাধিক সম্মানিত গুরু বা দেবতা বলে পুজো করেন। পাশাপাশি গুরু রিম্পোচের দুই স্ত্রীর মূর্তিও তাদের মন্দিরে স্থান পেয়েছে।

গরব বলে, তাহলে বনরা এখনও কেমন করে থেকে গেছে?

রাম বলে, নবম শতকের শেষের দিকে সম্রাট হিরালপাচানকে হত্যা করেলাং দারমা সম্রাট হলেন। তাঁর শাসনের সময়, মধ্য তিব্বত থেকে বৌদ্ধধর্ম প্রায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল বলা যায়। গোটা সাম্রাজ্য একশোরও বেশি ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পূর্ব ও পশ্চিম তিব্বতের কিছু রাজ্যে বৌদ্ধধর্ম থাকলেও বৌদ্ধধর্মের নামে বন প্রভাবিত আচার অনুষ্ঠান চলতে থাকে।

একাদশ শতাব্দীতে এই অবক্ষয়ে চিন্তিত হয়ে পশ্চিম তিব্বতের গুজ রাজ্যের রাজা, লালামা ইয়েশে ওদ তিব্বতে বৌদ্ধধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর আদেশে একদল তিব্বতি যুবক বৌদ্ধধর্মের আচার আচরণ শিখতে ভারতে যান। কথিত আছে, ভারত থেকে বৌদ্ধ পণ্ডিতদের তিব্বতে আমন্ত্রণ করে আনবেন বলে তিনি নাকি সোনার সন্ধানে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু পাশের রাজ্যের রাজা তাকে বন্দি করে মুক্তিপণ হিসেবে তার শরীরের সমান ওজনে সোনা দাবি করে। রাজার ভাই লালামা জাংচুব ওদ অনেক চেষ্টা করেও সেই পরিমাণ সোনা জোগাড় করতে পারেননি।

ইয়েশে ওদ তখন তার ভাইকে বলেন, আমি তো বুড়ো হয়েই গেছি, শরীরও ভেঙে পড়ছে আস্তে আস্তে। তাই আমাকে উদ্ধার করতে যত সোনা জোগাড় করেছ, সেই সোনা দিয়ে পূর্ব ভারত থেকে আচার্য অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসো। দাদার কথা শুনে জাংচুব পণ্ডিত নাগশো লোৎসাওয়াকে ভারতে পাঠান। নাগশো লোৎসাওয়ার মাধ্যমে গুজের রাজার বার্তা পেয়ে অতীশ বলেন, লালামা ইয়েশে ওদ-এর ত্যাগ ও পরিণামের কথা আমি জানি, তিনি প্রকৃতপক্ষে একজন বোধিসত্ত্ব!

নাগশো এবং বিক্রমশীলা মহাবিহারের পণ্ডিত অনুবাদক গিয়া সোঁনডু সেঙে - র অনুরোধে অতীশ তিব্বতে পৌঁছে দেখেন চারদিকে ভুল তান্ত্রিক আচার - অনুষ্ঠানের রমরমায় বৌদ্ধধর্ম কত স্তিমিত ও ক্ষীয়মাণ।

অতীশ তখন তাঁর অনুগামীদের কর্ম ও তাঁর ফল বিষয়ে শিক্ষা দিতে লেখেন তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘বোধিপথপ্রদীপ’, এতে প্রজ্ঞান পারমিতা ও তন্ত্র, উভয় দর্শনের ব্যাখ্যা রয়েছে। এই গ্রন্থটি আসলে প্রামাণ্য বৌদ্ধ আচারপালনের নির্দেশিকা। মানুষ দুঃখকে কোন দৃষ্টিতে দেখে, আর তার নিবারণের জন্য কী কী করে, তার ভিত্তিতে বুদ্ধের বাণীর আলোয় আচার্য অতীশ মানুষকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, চাই সর্বকল্যাণকামী এক হৃদয়, বোধিচিত্ত। এই বোধিচিত্ত দু ’ প্রকার - ঊর্ধ্বমুখী বোধিচিত্ত ও নিবিষ্ট বোধিচিত্ত। কেউ হয়তো এ জন্মের তুলনায় আরও ভাল এক পুনর্জন্মের প্রত্যাশী, আবার কেউ চান আত্মমুক্তি। যা সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা, সেই ‘মহাযান ’ - এর পথেই এর দিকনির্দেশ - সমস্ত জীবিত প্রাণের কল্যাণকল্পে বোধ অর্জন করা।

জীবনের সহজ সরল ব্যাখ্যা ও বাণী অতীশকে দ্রুত তিব্বতের সর্বস্তরের মানুষের প্রিয় করে তোলে। তার মহাপ্রয়াণের পর ‘বোধিপথপ্রদীপ’ পরিবাহিত হয় অনুগামীদের মারফৎ । চতুর্দশ শতাব্দীর সোংখাপা থেকে শুরু করে আজকের দলাই লামা এই গ্রন্থের প্রচার করে চলেছেন। এখনও এই গ্রন্থ অত্যন্ত জনপ্রিয়। সোংখাপা ‘বোধিপথপ্রদীপ’ অনুসরণে লেখেন ‘রিয়াংচুব লাম রিম চেনসো’। এতে বোধিলাভের পবিত্র ধাপগুলির ব্যাখ্যা রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে নানা তিববতী পণ্ডিতের লেখা ‘বোধিপথপ্রদীপ' - এর প্রায় ২০টি ভাষ্য পাওয়া যায়।

পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর তার সুযোগ্য শিষ্য ব্রম-টন- এর সাহায্যে কদম-পা সম্প্রদায়ের প্রবর্তন করেন। পরবর্তীকালে এই কদম–পা সম্প্রদায়ই গেলুক-পা নামে স্বীকৃতি পায়। দলাই লামা এই গেলুক-পা সম্প্রদায়েরই প্রধান পুরওহিত। একাদশ শতাব্দীতে তিব্বতে সবাই দলাই লামার একাধিপত্য মেনে নিয়েছিল। তখন গেলুক-পা ছাড়া আর কোনও সম্প্রদায় তিব্বতে ছিল না।

কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দীতে গৌতম বুদ্ধের শাক্য বংশের নামে একটি সম্প্রদায় নী-ইংমা-পা ও গেলুক পা র মাঝামাঝি একটি পথ অবলম্বন করতে শুরু করে। মোঙ্গল সম্রাট কুবলাই খানের পৃষ্ঠপোষকতায় সেই শাক্য সম্প্রদায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রবল পরাক্রান্ত চীন সম্রাটও প্রয়োজনে তাদের সৈন্য পাঠিয়ে সাহায্য করার প্রস্তুতি নেন। তাশী লামা বা পাঞ্চেন লামা শাক্য সম্প্রদায়ের নেতা বলে স্বীকৃতি পান। গরব বলে, তার মানে পদ্মসম্ভবের নী - ইয়াংমা, গুরু অতীশের কদম-পা, দলাই লামার গেলুক-পা আর পাঞ্চেন লামার শাক্য সম্প্রদায়, এই বিবর্তনকে পেছনে ফেলে আবার গেলুক-পারা কেমন করে –

রাম ওর প্রশ্ন থামিয়ে বলে, পঞ্চদশ শতাব্দীতেই তিব্বতে আবির্ভূত হন সোং-কা-পা নামে এক প্রতিভাবান লামা। তিনিই গেলুক-পাদের আবার জাগিয়ে তোলেন। এই ধর্মীয় নেতা সমাজ সংস্কারকও ছিলেন। সমস্ত দলীয় কোন্দল মিটিয়ে তিনি দলাইলামার একনায়কত্ব স্থাপন করেন। তিনিই গানদেন গুম্ফার প্রতিষ্ঠাতা। জনপ্রিয়তার চাপে ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দ থেকে গোটা তিব্বত দলাই লামাকেই প্রধান লামা ও শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়!

গরব জানে যে সোং-কা-পাই বারবার দলাই লামার রূপ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার কাছে বিশ্বাসটাই সব থেকে বড়। সে কখনও কোনও সুক্ষ্ম আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায়নি। বন্ধুর বক্তব্যের সব কথা সে ভালভাবে বুঝতো না, তার উদ্দেশ্যও গরবের কাছে সম্পূর্ণ ছিল না। কিন্তু ওই হিন্দু সাধুর মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত ভাললাগাআকর্ষণ ক্ষমতা। এই ক্ষমতা কোনও বন-এর মধ্যে দেখেনি গরব। রামপ্রসাদের আত্মিক শক্তি ও তার গুঢ় তত্ত্বজ্ঞান সম্পর্কে সমীহ ও শ্রদ্ধাই গরবকে এসব ভাবতে বাধ্য করে। সে একবার রামের কাছে দর্শন শিখতে চাইলে সে হেসে বলে, দর্শন তো অসীম অনন্ত, তুমি বরং সেই সারসত্যের ধ্যান করো।

– কীভাবে?

– অতীশ দীপঙ্কর বলেছিলেন, ষড়রাজ্যের সমস্ত অনুভবী জীবের প্রতি করুণা রাখো। তাদের অসহনীয় দুঃখ দেখে যেন তোমাদের বোধিচিত্ত জেগে ওঠে। বাইরে যা ঘটছে , আর মনে যাহচ্ছে - সবকিছুকে মায়া ভেবে ধ্যান করো। জগতের সকল প্রাণের সঙ্গে একচিত্ত হয়ে সমস্ত কাজ করো । এভাবেই মন সারসত্যে কেন্দ্রীভূত হবে !

আজ রামপ্রসাদের অবর্তমানে গরব মনকে সারসত্যে কেন্দ্রীভূত করে ভাবতে থাকে, রাম এখন কোথায়? সে কোথাও ধ্যানমগ্ন, নাকি অপহৃত, মৃত্যুর প্রহর গুনছে? নিজের মনে জেগে ওঠা প্রশ্নগুলির ঠিক ঠিক জবাব দিতে পারলেই হয়তো এই ধাঁধার রহস্যভেদ করতে পারবে।


চলবে ...