শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

​মহাসত্যের বিপরীতে, তৃতীয় খণ্ড # ৬ষ্ঠ অধ্যায়

‘ধ্যানের সময়, গুরুর মুখ দেখতে পেলেও ধরে রাখতে পারি না;/অন্য সময়, আমার মনে প্রিয়জনের স্মৃতি সংযত থাকে না’। - ৎসাংইয়াং গ্যাৎসো( ৬ষ্ঠ দলাই লামা)


অ্যামনে ম্যাৎচেনের গুহায় সেদিন একটি অদ্ভূত সমস্যা নিয়ে দর্দজি মিগ্যুরের পরামর্শ নিতে এসেছে দুই আদিবাসী ডোকপা। গুরুর কাছে বসে গরব তাদের কথা শুনছিল। ওরা বার্তাবাহক। হলুদ নদীর উৎসের কাছাকাছি একটি গ্রামের সর্দার তাদেরকে পাঠিয়েছে।

ওই এলাকায় একটি বিদেশি দল এসেছে। সেই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে দুজন বিদেশি। এদের মধ্যে একজনের চুলের রঙ হাল্কা বাদামি, গায়ের রঙ সাদা মুলোর মতন আর চোখের মণির রঙ নীল। অন্য সাহেবের মাথার চুল সোনালি আর গায়ের রঙ লালচে সাদা। দুজনেই দীর্ঘদেহী, তবে সোনালি চুল লোকটি অপেক্ষাকৃত কমবয়েসি।

এই পর্যটকদের সঙ্গে পাঁচজন মঙ্গোলিয়ান আর দুজন চীনা চাকর রয়েছে। এছাড়া রয়েছে তাঁদের ব্যবহারের উপযোগী বেশ কিছু ঘোড়া, খচ্চর, তাঁবু আর খাবারদাবার। সোনালি চুল সাহেবটি তিব্বতি ভাষায় ভালভাবেই কথা বলতে পারে, কিন্তু কুকুরের মতন চোখ লোকটি একজন চীনাকে দোভাষী হিসেবে ব্যবহার করে, কিন্তু নিজে ভালমতন চীনাভাষাও জানে না।

মঙ্গোলিয়ান চাকরদের মধ্যে দুজন ভাল তিব্বতি বলতে পারে। তাঁদের কাছে ডোকপারা শুনেছে যে, মাত্র কিছুদিন আগেই এই দুই বিদেশি সাহেব একসঙ্গে হয়েছে। ৎসাইদাম অঞ্চলের উত্তর-পশ্চিমে নীলচোখ সাহেবের সঙ্গে সোনালি চুল সাহেবের প্রথম দেখা। দ্বিতীয়জন একাই ছিল। সে বলেছিল, কয়েকদিন আগেই নাকি তার পুরনো সঙ্গী মারা গেছে। তখন সে ভীষণরকম বিধ্বস্ত ছিল। একটি তাঁবু, নিজের ঘোড়া ছাড়া মৃত সঙ্গীর ঘোড়া আর মালপত্র ও খাদ্যবহনকারী একটি খচ্চরের মালিক ওই সাহেব বিদেশি ভাষায় বাদামি চুলের সাহেবের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা হওয়ার পর - ওদের দলে যোগ দেয়।

কিন্তু এরা কোথা থেকে এসেছে, কার দেশ কোথায়,- এসব কিছু মঙ্গোলিয়ান ও চীনা চাকররা জানেনা। নীল চোখ সাহেব ওদেরকে উত্তরের সুদু অঞ্চল থেকে ভাড়া নিয়েছে।

অলক চীনা মানচিত্রে খুঁজে দেখে কান্সু প্রদেশের উত্তরে এই অঞ্চলকে ‘সুচৌ’ নামে ছাপা রয়েছে! সে এখান থেকে গরবের জীবনে একটি নতুন মোড় টের পেতে শুরু করে। অলক তটস্থ। আলেজাণ্ডার ডেভিড নীল স্বাভাবিক ভাবেই এতবছর আগে যা টের পাননি, অলক তার আঁচ পেয়ে নড়েচড়ে বসেছে। অলকের স্পন্দন তাঁর কলমে সঞ্চারিত হচ্ছে। সে বুঝতে পারে যে আজ রাতে আর ঘুম হবে না!

মঙ্গোলিয়ান ও চীনা চাকররা সাহেবের অতীত সম্পর্কে কিছুই জানে না। সবচাইতে বড় কথা হল, পাশাপাশি চললেও এই দুই সাহেবের মধ্যে তেমন বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। মাঝেমধ্যেই ওরা বিদেশি ভাষায় এমন আওয়াজে কথা বলে, তাঁদের অঙ্গভঙ্গি দেখে বোঝা যায় যে ওরা ঝগড়া করছে।

নীল চোখ সাহেব অ্যামনে ম্যাৎচেনের কাছাকাছি এসে মঙ্গোলিয়ান চাকরদের মাটিতে গোল গোল গর্ত খোঁড়ার আদেশ দেয়। সে হাতুড়ি দিয়ে পাহাড়ের গায়ে নানা জায়গায় আঘাত করে পাথর ভেঙে কী যেন পরীক্ষা করে। তাছাড়া সে একটা সুক্ষ জালির চালুনিতে বালি নিয়ে, শস্য চেলে বালিমাটি কাঁকড় আলাদা করার মতন চেলে চেলে কী যেন দেখে। এইসব ক্ষ্যাপামি দেখে স্থানীয় ডোকপারা প্রমাদ গোনে।

তাঁদের শিষ্টাচার অনুযায়ী, এভাবে পাহাড়ে আঘাত করে, পাথর ভেঙে সে এই পাহাড়ে বসবাসকারী প্রেতাত্মাদের বিরক্ত করছে। ফলস্বরূপ, প্রেতাত্মারা ওদের দেশে বৃষ্টি থামিয়ে অসুখবিসুখ পাঠিয়ে দিতে পারে! আর মাটিতে গর্ত করার শাস্তিস্বরূপ সমস্ত ফসলের চারাগাছ আর ঘাস শুকিয়ে যেতে পারে। তাহলে গবাদি পশুরা না খেতে পেয়ে মারা যাবে, মড়ক ও দুর্ভিক্ষে নিঃশেষ হবে মানবকূল। সেই ভয়েই এরা দর্দজি মিগ্যুরের কাছে এসেছে।

ওদের কথা শুনতে শুনতে দর্দজি মিগ্যুরের চেহারায় নানা পরিবর্তন লক্ষ্য করে গরব। সব শুনে সন্ন্যাসী বলেন, ওরা সোনা খুঁজছে ! আমি আগেও কান্সু প্রদেশ থেকে আসা কয়েকজন চীনাকে এভাবে চালুনি দিয়ে নদীর বালি চেলে তা থেকে সোনার গুড়ো আলাদা করতে দেখেছি। কিন্তু এই বিদেশি আগন্তুকরা মাটিতে গর্ত খুঁড়ছে আরও বেশি সোনা, বড় বড় স্বর্ণপিণ্ড, খাটি সোনার তাল পাওয়ার লোভে। অ্যামনে ম্যাৎচেনের গর্ভে ঈশ্বর যে সোনার ভাণ্ডার লুকিয়ে রেখেছেন তা পেতে চায়। এই সোনা রাজা গেসারের জন্য লুকোনো রয়েছে। তিনি যেদিন ফিরবেন - এই সম্পদ ব্যবহার করে মানবসভ্যতার শত্রু সমস্ত অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করবেন!

গরব উত্তেজিত কন্ঠে বলে, হে ঈশ্বর, ওরা যেন এই সোনার ভাণ্ডার খুঁজে না পায় ! ওর সঙ্গে গলা মিলিয়ে বার্তাবাহকরাও বলে ওঠে, ওরা যেন খুঁজে না পায় প্রভু!

সন্ন্যাসী ওদেরকে আশ্বস্ত করে বলেন, এই সোনার ভাণ্ডার খুঁজে পাওয়া কঠিন, দেবতারা সেগুলি পাহারা দিচ্ছেন !

ডোকপারা একথা শুনে সন্ন্যাসীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বলে, প্রভু জোওয়ো গামচেন, ওদেরকে আরও গর্ত খোঁড়া আর পাহাড়ের পাথর ভাঙ্গতে বাঁধা দেওয়ার উপায় বলুন ! ওরা তো কুকর্ম করে চলে যাবে, ফল ভুগবো আমরা! আমাদের দেবতার রোষ থেকে বাঁচান প্রভু !

অলক জানে, মাটির নিচে ধনসম্পদ লুকিয়ে রাখার কথা তিব্বতিরা কত গভীরভাবে বিশ্বাস করেন! তিব্বত ছাড়ার কয়েক বছর আগে চতুর্দশ দলাই লামার সরকার কয়েকজন শিক্ষিত যুবককে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশুনা করতে ইংলন্ডে পাঠিয়েছিল। এদের মধ্যে দুজন ইঞ্জিনিয়ার হন। একজন খনি প্রযুক্তিতে আর অন্যজন সড়ক ও সেতু নির্মানে বিশেষজ্ঞ হয়ে ফিরে আসেন। কিন্তু তিব্বতে ফিরে প্রবল সামাজিক চাপে ওরা খনি প্রযুক্তির কোনোরকম প্রয়োগ কিম্বা সড়ক ও সেতু নির্মান করতে পারে না। অবশেষে বিফল মনোরথ ওই দুই ইঞ্জিনীয়ারই একে একে সন্ন্যাসী হয়ে যায়। তিব্বতিদের মতে ওদের যাতায়াতের জন্যে ঘোড়া ও খচ্চর চলার পথই যথেষ্ট। এদের মধ্যে অন্য একজন ছাত্র ইলেক্ট্রিশিয়ান, আর একজন বন্দুক নির্মাণের প্রযুক্তি শিখেছিল, আর একজন শিখেছিল ধাতু গলিয়ে ছাঁচে ফেলে মুদ্রা নির্মাণ। এই তিনজন কিন্তু তাঁদের পেশায় সফল হন এবং পসারও জমাতে পারেন।

সেদিন ওই ডোকপা বার্তাবাহকদের আশ্বস্ত করে সন্ন্যাসী বলেন, আমি দেখছি কি করতে পারি, আমি ঈশ্বর ও আত্মাদের কাছে আর্জি জানাবো! তাঁরা নিশ্চয়ই এই দুষ্টাত্মা বিদেশিদের প্রতিহত করবেন! তোমরা নিশ্চিন্ত হও, গ্রামে ফিরে সর্দার ও অন্য সবাইকে নিশ্চিন্ত কর। আমার কথা বলো !

ডোকপারা আশ্রম ছেড়ে চলে যায়। পরদিনই সন্ন্যাসী তাঁর গুহার দরজা বন্ধ করে সমাধিতে বসেন। গরব তাঁর গুহায় একরকম ছটফট করে দিন কাটায়। তার হাত ওই দুরাত্মা বিদেশিদের শাস্তি দেওয়ার কল্পনায় নিশপিশ করে। কিন্তু সে যে এখন অহিংসার পূজারী, এরকম ভাবাও যে পাপ! তিব্বতিরা ছোটবেলাতেই মা- ঠাকুমার কাছে শুনে শুনে মহান বীর গেসারের গল্প জানে। গরবের মা-ও তাকে এই বীর জাদুকর সম্রাটের গল্প শুনিয়েছেন, যিনি দুষ্ট রাক্ষসদের নিকেশ করেছিলেন। মায়ের মুখ মনে করে ওই ডোকপাদের মতন গরবও সন্ন্যাসীর বলা ঈশ্বর ও আত্মাদের দ্বারাই এই দুষ্টাত্মা বিদেশিদের প্রতিহত করার কথা বিশ্বাস করে, মহান সত্যনিষ্ঠ বীর রাজা গেসারের ফিরে আসার তত্ত্বে বিশ্বাস করে। কারণ তিনিই একমাত্র জীবন্ত মানুষ যিনি সশরীরে স্বর্গে যেতে পেরেছেন।

এতদূর লিখে অলক ভাবে, আচ্ছা, তিব্বতি বিশ্বাসের এই লিং সাম্রাজ্যের রাজা গেসারই কি মহাভারতের যুধিষ্ঠির, যিনি পাহাড়ে চড়ে সশরীরে স্বর্গে গিয়েছিলেন? অনেক পুরাতত্ত্ববিদই তো মনে করেন যে, পাণ্ডবরা তিব্বত থেকে ভারতে গিয়েছিল, মহাভারতে বর্ণিত দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীর মতন তিব্বতের অনেক উপজাতির মধ্যে এখনও বাড়ির সব ভাইয়ের এজমালি স্ত্রী থাকতে দেখা যায়। তাহলে পাণ্ডবদের স্বর্গারোহন কি হিমালয় পেরিয়ে আবার তিব্বতে ফেরার গল্প? গেসারই কি মহাভারতের যুধিষ্ঠির?

নিজের গুহায় বসে গরব মনে মনে প্রজাবৎসল গেসারের সঙ্গে ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত সমস্ত চরিত্র ও রূপকথার গেসারের ঐতিহাসিক চরিত্রের মতন বাস্তব অতীতে বসবাস করতো, গেসারের প্রজাপ্রেম আর বোধিসত্ত্বদের সেবার ধর্ম তার কাছে মিলেমিশে একাকার। একজনের বীরত্ব ও শৌর্য আর অন্যদের অপরিসীম করুণা ও সেবার মধ্যে পার্থক্যটাও সে গুলিয়ে ফেলে। সেজন্যে অ্যামনে ম্যাৎচেনের পাদদেশে বসবাসকারী জনসাধারণকে আশু বিপত্তি থেকে রক্ষা করতে তার মনে আবারও বিদেশি শত্রুদের হত্যা করার ইচ্ছা জেগে ওঠে। তার হাত নিশপিশ করতে থাকে।

তার সঙ্গে এখন আগের মতন ডাকাতদল থাকলে এখুনি অভিযানে বেরিয়ে ওদেরকে ঝাঁঝরা করে দিত। কিন্তু সে বাস্তব বোঝে। আগের জীবনের সঙ্গে বর্তমান জীবনের অনেক পার্থক্য! তার হাত ওই দুরাত্মা বিদেশিদের শাস্তি দেওয়ার কল্পনায় নিশপিশ করলেও সে যে এখন অহিংসার পূজারী, - এরকম ভাবাও যে পাপ! ওই পরস্পরবিরোধী মনোভাব থেকে নিষ্কৃতি পেতে সে নিজেকে মহান সন্ন্যাসীর বাধ্য শিষ্য হিসেবে তাঁর আদেশ মেনে সমস্ত সত্তার রক্ষক হিসেবে গড়ে তুলবে এবং আপাততঃ এই সমস্যা সমাধানেও তারই নির্দেশিত পথে পা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

কিন্তু দেচমা? ... প্রশান্ত, অচঞ্চল সন্ন্যাসী দর্দজি মিগ্যুরের প্রভাব আর করুণার সাগর বোধিসত্ত্বদের বাণী নিয়ে চিন্তার মাঝে প্রায়ই অবচেতনে দেচমার কথা ভেবে স্মৃতিমেদুর হয়ে ওঠে গরব। কিন্তু এই স্মৃতিমেদুরতা টের পেতেই সে জোর করে নিজেকে আবার অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক অটল বিচারকের শৌর্য এবং দয়ার অবতারদের করুণার দ্বন্দ্বে ঠেলে দেয়, গুরুকে জিজ্ঞাস্য নানা প্রশ্ন মনে জাগে।

গরব এখন বিশ্বাস করে, যত দূরেই থাকুন না কেন, গুরু সবার মনের কথা পড়তে পারেন। তাঁকে উচ্চারণ করে কোনও প্রশ্ন করার প্রয়োজন নেই। তিনি নিজে থেকেই গরবের মনের জিজ্ঞাসা জানতে পেরে প্রয়োজন মনে করলে যথাসময়ে জবাব দেবেন।

এভাবেই দ্বন্দ্বের শিকার হয়ে অতীতের সুখ ও স্বপ্নের রানী দেচমা ক্রমে আবছা হয়ে আসতে থাকে। আবার মাঝেমধ্যেই শান্ত আকাশে হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতন সমস্ত শৌর্য ও করুণার অবতারকে সরিয়ে সে গরবের মনে প্রবলভাবে জেগে ওঠে! তার সেই নির্মল হাসি, সরল মুখভঙ্গী ও আদুরে কন্ঠস্বর এমনকি দর্দজি মিগ্যুরকেও ভুলিয়ে দেয়। গরব অনেক কষ্টে অর্জন করা আধ্যাত্মিক উচ্চতা থেকে নিমেষেই পতিত হয়। এক লহমায় মনে জেগে ওঠা রিরংসার তপ্ত ঠোঁটের ছোঁয়ায় দৃঢ় হয়ে ওঠে, তার সারা শরীর নিশপিশ করে, নিজের অজান্তেই ছটফট করতে করতে একসময় আত্মরতিতে মগ্ন হয়ে পড়ে।

এই গুহা, পাথরে বিছানো খরের ওপর তার বিছানার রুক্ষতাকে নস্যাৎ করে দিয়ে নরম ও পেলব নারী শরীরের স্মৃতি তার অস্তিত্বে আগুন ধরিয়ে দেয়। কল্পনায় দেচমাকে সামনে বসিয়ে সে ঘোড়া চালাতে থাকে-টগবগ টগবগ...টগবগ টগবগ ...দুপাশের পাহাড় ও রুক্ষ সমতল পেরিয়ে যায় বিশালাকায় চাঁদের আলোয়। তার চেতনায় তখন সবকিছু ছাপিয়ে শুধু দেচমা দেচমা দেচমা…তার ক্মলার কোয়ার মতন ঠোঁটদুটি, তার ইচ্ছায় পরিপূর্ণ যুবতি শরীরের স্পন্দন, তার পব্ল আশ্লেষ...অসাধারণ! ভাবতে ভাবতে নিজের অস্তিত্বে হারিয়ে যাওয়া নাগপোকেও প্রবলভাবে টের পায় ... টগবগ... টগবগ...টগবগ... টগবগ ...তারপর প্রবল হ্রেস্যাধ্বনিতে কেঁপে ওঠে অ্যামনে ম্যাৎচেনের আকাশ বাতাস! একসময় শীৎকার ও গমকে গমকে লাভা উদ্গীরণে তার শরীর ও সমস্ত অস্তিত্ব স্খলনের আরাম পেলেও এক অদ্ভূত রিক্ততা ও কুন্ঠিত পায়ে সে নিকটবর্তী উষ্ণ প্রস্রবনের দিকে পা বাড়ায়।

একটা পাপবোধ থেকে এই কুন্ঠা! কারণ সে বিশ্বাস করে যে, তার এই জান্তব চিত্তবৈকল্যও অন্তর্যামী গুরু দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু সে যে অসহায়! সেজন্যেই লজ্জায় অধোবদন হয়ে নিজের পরিধেয় এবং নিজেকে ভালমতন ধুয়ে পরিষ্কার করে।

এই কুন্ঠা থেকেই সে যথাসম্ভব নিজের চিন্তাপ্রক্রিয়া দিয়ে স্মৃতিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে। তবুও হঠাৎ ধুমকেতুর মতন তার মনের আকাশে দেচমা উদিত হলে গরব সশব্দে মন্ত্রোচ্চারণ করতে থাকে, ওম মণিপদ্মে হুম, ওম মণিপদ্মে হুম…!

গুরু বলেছিলেন, শেষের এই ‘হুম’টি অনুকার। এই হুঙ্কারনাদের দর্শন ভারত থেকে এসেছে। কেউ ভারতের নাম করলেই না জানি কেন গরব আনমনা হয়ে যায়! হিন্দুশাস্ত্রের বর্ণনা অনুসারে রাক্ষস মহিষাসুরের সঙ্গে নাকি এক দেবী দুর্গার যুদ্ধ হয়েছিল। আর সেই যুদ্ধে মহিষাসুরের সেনাপতি চামরাসুর দেবীকে লক্ষ্য করে অস্ত্র ছোঁড়ে। তখনই দুর্গা চণ্ডীরূপ ধারণ করে হুঙ্কার দেন; হুঙ্কারাভিহিতাং ভূমৌ পাতয়ামাস নিষ্প্রভাম। মানে, দেবী হুঙ্কারনাদে সেই অস্ত্র প্রতিহত ও নিস্প্রভ করে মাটিতে ফেলে দেন। তান্ত্রিক আরাধনায় যোগিনীরাও হুঙ্কার দিতেন। আজও হিন্দুদের কালীপুজোর তন্ত্র মন্ত্রঃ হ্রীং হ্রীং হুম হুম ক্রীং ক্রীং ক্রীং দক্ষিণে কালিকা...!!!

এই হুঙ্কারনাদ সবাই দিতে পারে না। আত্মিক শক্তি না থাকলে চেঁচানিই সার, গলা দিয়ে জীবনেও হুঙ্কার বেরুবে না। সংস্কৃত থেকে পালি হয়ে এই হুঙ্কার বাঙালি অতীশ দীপঙ্কর ও তাঁর শিষ্যদের মাধ্যমে তিব্বতি লামাদের মননেও পৌঁছে দিয়েছে সেই জাগৃতির ধারণা। তারপর আমাদের তিব্বতই পৃথিবীকে শুনিয়েছে এই মহা শক্তিশালী মন্ত্রঃ ওম মণিপদ্মে হুম!

এই হুমের কোনও আভিধানিক অর্থ নেই, কিন্তু তাৎপর্য বিপুল! হুম উচ্চারণে ভিতরের শত্রুতা এবং আগ্রাসী মনোভাব পরিশুদ্ধ হয়। হুম-ই এই মন্ত্রের প্রাণশক্তি। ভারতীয় দর্শনের মণিপদ্মে প্রাণসঞ্চার করেছে এই তিব্বতি ‘হুম’। বোধি এবং প্রজ্ঞার যখন পূর্ণ বিকাশ ঘটে, চেতনায় সেই মুহূর্তে তারা অবিচ্ছেদ্যভাবে সংহত, সেই সময়েই মনে সকলের জন্য ‘করুণা’ জাগবে। উচ্চারণ করা যাবে যথার্থ ‘হুম’!

গরব মনে মনে ভাবে, আমাদের বৌদ্ধতন্ত্রের এই ব্যাখ্যা যদি বন্ধু রামের হিন্দু ধর্মের পরিপূরক হয়, হিন্দুদের দেবী নিশ্চয়ই নিছক শত্রুতা এবং আগ্রাসী মনোভাব থেকে হুঙ্কার দিতেন না! দেচমার স্মৃতিকে দূরে হটাতে অসহায়ের মতন গরব যে হুঙ্কার দেয়, দেবী দুর্গার মনেও তেমনি নিশ্চয়ই তথাকথিত চামরাসুর, মহিষাসুরদের জন্যেও মায়া থেকে যায়। এই মঙ্গলকামীতা না থাকলে হুঙ্কার অর্থহীন।

দর্দজি মিগ্যুরের কাছে মহাযান করণ্ডব্যুহ সূত্রে গরব পড়েছে, গৌতম বুদ্ধ বলছেন, সমস্ত জীবের মঙ্গলের জন্য তিনি বহুবার ‘মণিপদ্মে হুম’ উচ্চারণ করেছেন। শাক্যসিংহও একাধিক হুঙ্কার দিয়েছেন! এভাবেই হুঙ্কার দিয়ে অতীতকে হটিয়ে বর্তমানে ভবিষ্যতের স্বপ্নকে রোপণ করে মনে প্রশান্তি নামিয়ে আনার চেষ্টা করতে করতে গরব অনেকটা সফলতা পায়।

এভাবে প্রিয়তমা দেচমার অস্তিত্বও ক্রমশঃ ওর স্মৃতিতে আরও আবছা, ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে। আর এক আরোপিত প্রশান্তি তাকে গর্ব ও সন্তুষ্টিতে ভরিয়ে দিতে থাকে।

এতটা লিখে অলক মিটি মিটি হাসে। - দাঁড়াও সন্ন্যাসী, দেখাচ্ছি মজা!

আপাততঃ আমি ঘুমাতে যাই। ঘুমচোখে বৌদ্ধ মগজাতির কথক ঠাকুমা দিদিমার মতন বলতে ইচ্ছে করে, পাছন হালা থুম, তুমি জাগথুম !

সে নিশ্চিত, এই গল্প এখন তার নিজের স্বপ্নেও ঢুকে পড়বে।


চলবে ...