শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

​চলে গেলেন কবি ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ, অন্যদেশের শ্রদ্ধাঞ্জলি ',আমি বুক পেতে আছি' ...

( চলে গেলেন হাইলাকান্দি নিবাসী, উত্তরপূর্বের বরিষ্ঠ কবি ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ ।মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮১ বছর । বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরি সাহিত্যের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহের গ্রন্থ সংখ্যা ৪৫ । এর মধ্যে বাংলায় আছে একটি ছন্দের বই ও দুইটি কাব্যগ্রন্থ । )

“...আমি বুক পেতে আছি, নামো জ্যোৎস্না আকাশের কমণ্ডলু থেকে...”

এ প্রার্থনা একজন কবির । আর সেই কবি ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ । হাইলাকান্দি নিবাসী কবি শ্রী ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ আজ একাশী বসন্তে উপনীত ।

ষাটের দশকে যখন বাংলাসাহিত্য নবচেতনার বিপুল প্লাবন নিয়ে ঢুকে পড়ছে ড্রয়িংরুম থেকে রান্নাঘরে— বিমূর্ত সংকট থেকে শোণিত-ক্ষরিত ভাষাহীন ক্ষতের দিকে, এক ঝাঁক জীবনবাদী কবির সঙ্গলাভ আমাদের ঘটে যায় অনিবার্যভাবেই, যাঁরা বিভিন্ন প্রেক্ষিতের হলেও অবস্থান তাঁদের একই তরঙ্গদৈর্ঘ্যে । এর মধ্যে, শ্রী ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ অন্যতম একজন । এই সময়ের সামান্য আশেপাশে, এই অঞ্চলের অন্যান্য বিশিষ্টরা কবিরা হলেন প্রদীপ চৌধুরী, পীযূষ রাউত, স্বপন সেনগুপ্ত,কল্যাণব্রত চক্রবর্তী, অরুণ বণিক, শঙ্খপল্লব আদিত্য, বিজিতকুমার ভট্টাচার্য, এবং শক্তিপদ ব্রহ্মচারী । এঁদের সঙ্গেই আমাদের লৌকিক ও অলৌকিক পরিচয় সহসাই ঘটে যায় পৃথিবীর অন্যান্য নিয়মের মতোই । এঁরা ছাড়া আর যে কেউ ছিলেন না এই অঞ্চলে, এমন নয় । এই মুহূর্তে তাঁদের নাম মনে পড়ছে না ।

১৯৭৬ সালে কবি পীযূষ রাউত ত্রিপুরার কৈলাসহর ছেড়ে চলে এলেন পাশের শহর আমাদের ধর্মনগরে । যথারীতি আমরাও জমে গেলাম তাঁর চৌহদ্দি জুড়ে । আর এখানেই একদিন দেখা হয়ে গেল কবি ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহের সঙ্গে । দেখা হয়ে গেল কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর সঙ্গে । অবাক কাণ্ড, এর কিছুকাল পরেই দেখা হয়ে গেল কবি প্রদীপ চৌধুরীর সঙ্গেও । তিনিও বদলি হয়ে চলে এলেন ধর্মনগর বি.বি.আই. নামের স্কুলটিতে ।

এখানে আমরা বলতে, কবি দীপক চক্রবর্তী, কবি ও গল্পকার কিশোর রঞ্জন দে, গল্পকার দীপক দেব, কবি রত্নময় দে, নাট্যকার ও অভিনেতা মতিলাল দে, আমি এবং আরও কয়েকজন । সে সময়টা প্রকৃতই আমাদের কাছে স্বর্ণযুগ ছিল বলে মনে হয় আজ ।

প্রায় ৪০/৪১ বছর আগের কথা । ব্রজেনদা তখন গোঁফ-ওয়ালা আর্মি অফিসারের মতন কথায় ও কাজে এক দুর্দান্ত ব্যক্তিত্ব । আজ ৮১ বছরের হলেও, উদ্যমে সেই ৪০/৪১ বয়সের এর এক তরতাজা পুরুষ, আগের মতোই এক উজ্জ্বল ‘সিংহ’ । বর্তমান লেখক দ্বারা সম্পাদিত মাসিক কবিতাপত্র “পাখি সব করে রব”-এ আজও সমানে লিখে চলেছেন, প্রতি মাসে । এমন পারে কয়জনা ?

কিন্তু যে দুঃসংবাদটি আমাদের বিষণ্ন রাখে, সেটা হল, তাঁর অধিকাংশ কবিতাই, যা ‘দেশ’ পত্রিকাসহ আরও বহু কাগজে সমানে প্রকাশিত হয়ে গেছে, তার অধিকাংশই তাঁর সংরক্ষণে নেই, বা হারিয়ে গেছে । ফলে, এপর্যন্ত মাত্র দুটি ক্ষীণকায় কাব্যগ্রন্থ তাঁর প্রকাশিত হয়েছে । একটি “ভিখারি বালকের গান” যার প্রথম প্রকাশ ১৯৯৪ সালে এবং দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০৯ সালে ত্রিপুরার ‘অক্ষর পাবলিকেশনস’ থেকে এবং দ্বিতীয়টি “ত্রাণশিবির” এই ২০০৯ সালেই গুয়াহাটির ‘ভিকি পাবলিশার্স’ থেকে প্রকাশিত হয় । অবশ্য “পাখি সব করে রব”-এ প্রকাশিত হয়েছে এমন আরও গোটা পঞ্চাশেক কবিতা তো আছেই এবং আরও কিছু কবিতা ও অন্যান্য লেখা তাঁর সংগ্রহে রয়েছে । আরও একটি কাব্যগ্রন্থ অনায়াসে করা যেতে পারে । এ ছাড়া মণিপুরি ভাষায় কিছু অপ্রকাশিত রচনা তো থাকারই কথা ।

বছর তিন/চারেক আগে তাঁর সঙ্গে ধর্মনগরে আমাদের আরেকবার দেখা হয়, যখন তিনি ধর্মনগর হয়ে কৈলাসহরের দিকে কোনো কাজে যাচ্ছিলেন । এখন বার্ধক্যহেতু বেশি চলাফেরা করতে না-পারলেও আমার সঙ্গে ফোনে মাঝে মাঝেই কথা হয় । বিভিন্ন সময়ে সাহিত্য সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যায় তাঁর দ্বারস্থ আমাকে হতেই হয় । তিনি কখনো ফেরান না । তিনি যতদিন বেঁচে থাকবেন, তাঁর স্নেহ থেকে বঞ্চিত হব না, এই বিশ্বাস আমার ও আমাদের অনেকেরই শক্তিস্থল । আমি হাইলাকান্দি কখনো যাইনি । যাওয়া হয়নি নানা কারণে । তাই আর বিশেষ কোনো তথ্য আমি এখানে রাখতে পারছি না । তিনি ভালো আছেন, ভালো থাকবেন, কারণ একজন কবিকে বিধ্বস্ত করতে পারে এমন শক্তির অস্তিত্ব পৃথিবীতে নেই !

তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থই আমার সংগ্রহে রয়েছে । রয়েছে ছন্দ বিষয়ে একটি গ্রন্থ “ছন্দের কারিগরি”, যা অত্যন্ত সহজ ভাষায় লেখা । আজ সেই দুটি কাব্যগ্রন্থ নিয়েই কবিকে আবার নতুন করে জানার চেষ্টা হবে আমার এই নিবন্ধের আগ্রহ ।

বারবার পড়তে হয় কবিতা । কবিতা প্রতিদিন নতুন করে নিয়ে আসে পৃথিবীর সকাল, প্রতিবার নিয়ে আসে এক নতুন পুরুষকে, যিনি প্রত্যাশা জাগিয়ে যান পরবর্তী সকালের । কবি প্রকৃতিরই দূত, সময়ের অগ্রপুরুষ । সময়ের দামামা তার বুকেই বাজে আগে । তাই, তাঁর এক হাতে সময়ের কলুষ, অন্য হাতে নিরাময় । জ্যোৎস্না নামে একমাত্র কবিরই বুকে...

—দুই—

“আয়নার অর্ধেকটা রেখেছিলাম পরির জন্য ।

বাকি অর্ধেক রইল খালি ।

কার জন্য জানতুম না । কেউ জানে না ।

মুখটি নিচু করে রইল মুকুর ।”... ...

(অর্ধেক কবিতা / ভি.বা.গা.)

কেউ জানে না । কবি নিজেও জানেন না । মুকুরও জানে না । মাঝের ফাঁকা জায়গায় খেলা করে অদৃশ্য তরঙ্গের লীলা । ‘উপমেয় আছে । উপমান নেই’ ।

কবিদেরও খেলা আছে । এই খেলা কেবলই এই ‘নেই’ নিয়ে ‘আছে’-র সন্ধান ।

“তোমার কাছে চেয়েছিলাম একটুখানি আড়াল,

চেয়াছিলাম তোমার কাছে বোধন ।

আঙুল তুলে বলেছ— ওই দিকে ।”... ...

(আড়াল / ভি.বা.গা.)

এই লাঞ্ছনা কবিকে শরাহত করে ঠিকই, ধরাশায়ী করে । কিন্তু তারপরও একমাত্র কবিই জেগে থাকে পৃথিবীর ছায়ার গহীন উষ্ণতায়, রৌদ্রের অচেনা হিমের ভেতর । উপমান উপমেয় এসে গড়াগড়ি যায় কবির সঙ্গলাভের আশায় ।

“...সেই কাঠগোলাপের জন্য লেখা হবে

একটি কবিতা । তাতে বলা হবে—

এই ফুলটা জীবনে কিছুই পায়নি ।

কারণ তার ফোটাটাই হয়েছিল ভুল ।”

(ভুল / ভি.বা.গা.)

ভুলই ফুল । এই পৃথিবীতে কবিদের আসাটাই ভুল । আসাটাই ফুল । এই তত্ত্ব নিয়ে অন্যদের যন্ত্রণা নেই । যাঁরা দার্শনিক, তাঁরাই ভেবে আকুল হন— কবিকে নিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে গিয়ে ক্ষয়ে ফেলেন গোটা জীবন । দার্শনিক প্লেটো বলেন কবিরা সমাজের জন্য ক্ষতিকারক, এদের বাস্তবজ্ঞান নেই । অতএব...

না । এটাই শেষ কথা নয় । কবি যে নারীর চেয়েও দুর্জ্ঞেয় !

প্লেটো কবিতা ও কবিদের যেভাবে চিহ্নিত করেছিলেন সেটা ছিল তখনকার একমাত্র বিষয়, যা এখনও আছে এবং থাকবে চিরকাল, কিন্তু একমাত্র নয় । তার সঙ্গে জুড়েছে আরও নব নব কাব্যচেতনা । প্লেটো ভেবেছিলেন কবিতা যুক্তি বা বুদ্ধির সৃষ্টি বা কাজ নয়— যথার্থ আবেগের (Inspiration) সৃষ্টি । এই ভাবনা যথার্থ । কিন্তু শিল্পতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা এগোতে এগোতে আরও অনেক প্রকরণ বা ডিসকোর্স ক্রমাগত জুড়ে গেছে সময়ানুগ কাব্যচেতনায় । আগামীতে আরও নয়া রূপ আসবে, এতে কোন ভুল নেই । ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধেই প্রায় এসে যায় শিল্পতত্ত্বের এক বিশাল উল্লম্ফন, যাকে বলা যায় হেগেল থেকে মার্কস-এ এসে নবরূপ ধারণ এবং তৎপরবর্তী আরও আরও নয়া বিরামহীন সংযোজন । এসে গেল জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, বস্তুবিজ্ঞান, ছন্দোবিজ্ঞান, ধ্বনিবিজ্ঞান ইত্যাদি ইত্যাদি । কাব্যচেতনা ভূমিলগ্ন হবার প্রয়াস নিল বটে, কিন্তু তারপরও কাব্যে রয়ে গেল এক অধরা-মাধুরি-সংবাদ, রয়ে গেল মূর্ত আর বিমূর্তের ফাঁকে চিরন্তন এক যাদু-টোনা, রয়ে গেল ‘হয়ে-ওঠা’র এক রহস্য-ঘুম । কবিতা দাবি করে কবির পূর্ণ আত্মনিবেদন ।

আমরা ফিরে যাই ব্রজেনদার কবিতায় । দেখা যাক আমাদের জন্য কী কী রয়েছে সেখানে ।

‘তোমার সুবাস’ কবিতায় কবি প্রেম আর গম এসে যেভাবে মিলে যায়, তা তাঁর সমাজ-চেতনারই বিস্ফোরণ বলে চিহ্নিত হয়ে থাকে—

“গ্রাম গ্রামান্তরে থেকে ছড়িয়ে পড়েছে ওই তোমার সুবাস ।

গঞ্জের হাটবারে তিসির দর, গোমড়ক এবং পামরি পোকার মতো

জরুরী বিষয় ভুলে, লোকে বলছে—

‘কিসের সুগন্ধ এটা মোড়ল মশাই ?

যেন বুকের মধ্যে জ্যোৎস্না গিয়ে লাগছে ।

কণ্ঠ বেয়ে নামছে যেন তৃষ্ণার জল ।’

আমি জানি এ তোমার অন্তরঙ্গ আলো ।

তুমি জেগে ওঠো প্রেম, জেগে ওঠো ... ...

অনাহার দুর্ভিক্ষ এবং মৃত্যুর তৃতীয় বিশ্ব জুড়ে

তোমার বিশ্বস্ত দৃষ্টি বলে দিক

গমের জাহাজ আসছে ঐশ্বর্যের তটভূমি থেকে ।”... ...

(তোমার সুবাস / ভি.বা.গা.)

কবি ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহের কবিতা তেমনভাবে পঠিত হয়নি, এমনকি, তাঁর নিজস্ব পরিচিতির বলয়েও । যদি এমন হত, হয়তো আমরা তাঁর প্রেরণালব্ধ আরও আরও কবিকে পেতাম ঐ অঞ্চল থেকে । আবার এও সত্য যে, যশাকাঙ্ক্ষী অনেক সরস্বতীনন্দনই গোটা কাছাড় পরিত্যাগ করে কোলকাতাবাসী হয়েছেন এবং আজও সেখানের বাসি হয়েই আছেন । ফলে ঐ সময়ের মাত্র কয়েকজনকেই আমরা এই এলাকা থেকে পাচ্ছি, যদিও সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে এলাকা কোনো বিষয় নয় । কিন্তু ঘুরে ফিরে আসে সেই বাতাসের সুবাস যা কবির বাড়ির ওপর দিয়ে বয়ে যায়—

“এ তুমি জাগালে কাকে এই ছাইমাখা রোদ্দুরের বিষণ্ন বেলায় !

জেগে উঠছে নীলমাছি । স্নেহভিক্ষু কুকুরছানারা খেলা করছে আঙিনায় !

কানাকানি করছে ছায়ারা । দর্পণ ও প্রতিধ্বনি,

চুল খোলা কুসুম কামিনি । নরম লবণ জল ঝরেছিল সুখস্বপ্নে ।

রাতের পাহারাদার হাওয়া

বাঁ হাতে বল্লম নিয়ে চলে যাচ্ছে ধীরে ।” ... ...

(এ তুমি জাগালে কাকে / ভি.বা.গা.)

কবিকে ঠিক দেখতে পাই আমরা । যে গ্রন্থটি থেকে পড়ছি এই কবিতাগুলো, তার নাম “ভিখারি বালকের গান” । নিজেকে দীন করে দেখার প্রবণতা আর বিষণ্নতা আত্মমগ্ন কবিদের ছেড়ে যায় না । মণিহার নয়, ময়াল সাপের মতো তা জড়িয়ে থাকে আষ্টেপৃষ্ঠে । বলেন—

“...আমি একা মুখোমুখি হতে ভয় পাই ।

কাঠকয়লায় আঁকা আত্মপ্রতিকৃতি...”... ... (ঐ)

শ্লেষ, প্রতিবাদ, কিছু বিরক্তি, এসবও কবিতারই অঙ্গ, যা সচেতন করে সময়কে, সমাজকে, শরীরকে, নিজের বোধকে । ধিক্কার দেন কবি নিজেকেও । সব কবিরই বক্তব্য মূলত নিজেরই প্রতি ।

“...সৌখিন সুগন্ধ মাখা আলো মরে যাচ্ছে

পুতুল দম্পতিদের দেয়ালে দেয়ালে ।

আমি এই মৃত আত্মা বিক্রি করে দেব ধৈর্যশীল শয়তানের কাছে

সাঙ্কেতিক চিহ্নগুলো দিয়ে যাব প্রৌঢ়া অপ্সরার হাতে... ।”

(বিস্মৃতির মতো / ভি.বা.গা.) ।

কৃষিপ্রধান স্বাধীন দেশের জনগণ আমরা । আমরা ভোটার মাত্র । দেশের প্রতি কর্তব্যের কথা বলা হয়, কিন্তু ভোটারের প্রতি সরকারের কর্তব্যের ব্যাপারটা থাকে যায় আলোচনার বাইরে । স্বাদহীন এই স্বাধীনতায় যখন এক ভোটার আরেক ভোটারের কাছে ক্ষমা যাচঞা করে তখন টের পাই ইনি আসলে কবি, সংবেদনশীল আত্মার এক বিশীর্ণ শরীর ।

“আমি তোমার কাছে হেরে যাচ্ছি করিম ভাই । তোমার লাঙলের ফলার

কাছে পরাজিত হচ্ছে আমার কলমের ডগা । তোমার ঘোলাটে দৃষ্টি

কুরে খাচ্ছে আমার কবিতার প্রতিটি শব্দ । তছনছ করে দিচ্ছে সাজানো সুন্দর

পঙক্তি ও স্তবক । তোমার হাড়-জিরজিরে বলদ-কুঁজো শরীর নিয়ে অসহায়

ধিক্কারের মতো ।... ...

তোমার মেয়ে আমিনা লালা পান্তাভাত, নুন, লঙ্কা এবং অতৃপ্ত

লোভ নিয়ে শূন্যতার ওপার থেকে দুঃখে আলপথ বেয়ে হেঁটে আসে ।”... ...

(ক্ষমা করো / ভি.বা.গা.)

‘দায়বদ্ধতার প্রতি নিবেদন’ কবিতায় এমনি করে শরবিদ্ধ করেন তাবৎ কবিকুলকে তথা নিজেকেই ।

“... বন্যার জলের উপর বাঘিনির মতো

ঝাঁপিয়ে পড়ছে বৃষ্টি ।

এখন যত সব বুদ্ধিমান, ধুরন্ধর এবং টাউট

এবং টিভির পর্দা দায়বদ্ধ থাকুক ... ...

নিরন্নের প্রধান খাদ্য হোক আটা ও পোকার সুস্বাদ,

আরশোলার মৃত শরীর এবং চিঁড়ের

একত্র সহবাস চলুক ... ...

মাথার উপর ঘুরছেন মাননীয় হেলিকপ্টার ।

এই একটা সময় কবিরা মুক্ত হোক

সকল দায়বদ্ধতা থেকে ।

জাঁদরেল বক্তা হতাশ হয়ে বলবে

—এদের আর মানুষ করা গেল না । ... ...

মুক্তাঞ্চল থেকে আরাম করে

কান চুলকোতে চুলকোতে কবি

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়ে বলবে

মাঝে মাঝে বন্যা দিও প্রভু । ... ...

সেই বন্যার জলে বুক ডুবিয়ে

মাথায় সংসার চাপিয়ে

মা চলেছে আশ্রয়ের সন্ধানে

জ্বরের তেতো মুখে পেছনে বুড়ো... ...

তাদের সঙ্গে সতেরো বছরের ভরা যুবতি

দুই ঊরুতে লেপটে আছে ভেজা শাড়ি... ...

পেছনে সূর্য ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে ।

এই দৃশ্য দেখবার সময়

কেউ যেন কবিকে ধমকে না দেয় ।”

(দায়বদ্ধতার প্রতি নিবেদন / ভি.বা.গা.)

কিংবা

“...মেঘ ভাগ করে নাও, জল বণ্টনের জন্যে ধর্ণা দাও

ভাগ করে নাও রোদ

বুদ্ধিজীবী মানুষেরা চশমা মুছে প্রবন্ধ লিখছে ।”... ...

(সার্কাস / ভি.বা.গা.)

যদিও তাঁর সব কবিতা ছন্দে আবদ্ধ নয়, কিন্তু তিনি বিশিষ্ট ছন্দজ্ঞানী । বেশির ভাগ কবিতা মুক্তকে, কিছু স্বরবৃত্তে, কিছু মাত্রাবৃত্তে । তাঁর অসাধারণ বাকপ্রতিমাগুলি কবিতাকে জীবন্ত করে তোলে । শিল্পতত্ত্বের আলোচনায় ঢুকে পড়লে আমরা শিল্পে ‘রূপময়তা’র একটা বিরাট বা প্রধান ভূমিকা রয়েছে দেখতে পাই । সচরাচর কবিরা অনেকসময়ই ভুলে যান যে শিল্প নিজে কিছু বলে না, বরং উপস্থাপিত করে, এবং মোটেই জ্ঞান বিতরণ করে না, বরং রস ও ভাবের সঞ্চার ঘটায় । আর এ সবকিছুরই প্রধান বাহন প্রতিমা, যে প্রতিমা বাস্তব পরাবাস্তব যা খুশি হতে পারে কবির কলমের খোঁচায়, শব্দের আশ্লেষে । যখন কবি ব্রজেন্দ্রকুমার বলেন—

“... এ জীবন কাকের আহার ।” ... ... (হারানো অঙ্গুরী / ভি.বা.গা.)

তখন একটা মিথকাহিনি দৃশ্যরূপে এসে কবির জীবন দর্শনকে এমনভাবে ব্যক্ত করে যে, তা অতিদ্রুত পাঠকমনে সঞ্চারিত হয়ে শিহরণ তোলে ।

এখানে আমরা পেয়ে যাই কবির দর্শন, মিথের ব্যবহার, চিত্ররূপ গঠন, সংবেদন, ভাব ও রসের উৎসারণ ইত্যাদি ইত্যাদি । এ সবই তাঁর শিল্প তথা কবিতার, তাঁর কাব্যচেতনার বৈশিষ্ট্য । মাত্র চারটি শব্দ এখানে ব্যবহৃত হয়েছে । ‘জীবন’ আর ‘আহার’ কাকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট হয়েই একটা বিশাল ঘটনা ঘটিয়ে ফেললো, এবং এটা আমাদের অত্যন্ত পরিচিত, নিত্য দেখা একটি দৃশ্য ।

এমন ছোট ছোট দৃশ্যকল্প, প্রকৃতি থেকে তুলে এনে বসিয়ে দেন তিনি, আর তাই হয়ে ওঠে তাঁর কবিতা । এটা তাঁর আঙ্গিক, তাঁর Form । একই কবিতায়আরও সুন্দর একটি ছবি পাই—

“... নদী তুমি বৌদ্ধ ভিক্ষুনীর মতো ভরাট যুবতি...” (ঐ)

অতি আধুনিক সভ্যতার প্রগলভতাও তাঁর কবিতায় সুন্দর ছবি নিয়ে ব্যক্ত হয়—

“...নিয়ন সুন্দরী হেসে উঠল ভর সন্ধ্যাবেলা

সাইরেনের মতো । ... ...

সকাল বেলা কফির সঙ্গে, খবরের কাগজে

এই সব রিপোর্ট দেখে রোদ বলবে—

ডিজগাসটিং !”... ... (সময় / ভি.বা.গা.)

হ্যাঁ, সময় । সময়কে এভাবেই খামচে ধরেন এই কবি । আরও অজস্র চিত্রকল্প দৃশ্যকল্প ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর প্রতিটি কবিতায় । একাশী বছর বয়সে এই কাব্যচেতনা তাঁকে এমনভাবে সমকালীন করে রাখে যে, মনে হয় একাশী নয়, তিনি একুশেরইএক নবযুবক ।

যতিচিহ্ন ব্যবহারে এই কবি অত্যন্ত স্থিতধী । প্রায় প্রতি পংক্তিতে পূর্ণযতির ব্যবহার তাঁর কবিতায় এক ধরণের নির্লিপ্তি ছড়িয়ে রাখে । থামতে হয় । এই থামা-ও কবিতারই অঙ্গ যেন ।

খ্রিস্ট জন্মের ৫০ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে দার্শনিক প্লুতার্ক-এর আবির্ভাব । তাঁর বক্তব্য ছিল ‘যা সুব্যক্ত তা-ই সুন্দর’ । প্রাকৃতিকভাবে বা সামাজিকভাবে যা অসুন্দর বা গ্রহণযোগ্য নয়, তার সঙ্গে শিল্পের সৌন্দর্যের কোনো সম্পর্ক নেই, শিল্পের সৌন্দর্য তার পরিবেশনের দক্ষতার ওপর, বিষয়ের ওপর নয় ।

যৌনতা এমনই একটি স্পর্শকাতর বিষয়, ছয়ের দশকের হাংরি সাহিত্য আন্দোলনের পর যার আড়ষ্টতা বাঙালি পাঠকের মন থেকে কিছুটা দূর হয়েছে যদিওকিছু কিছু রয়ে গেছে এখনো । কবি ব্রজেন্দ্রকুমারের কবিতায় এর সুচারু ব্যবহার আমরা ইতিপূর্বে লক্ষ করেছি ।

তাঁর ‘ভিখারি বালকের গান’ অর্থাৎ গ্রন্থনামের কবিতাটি রোমাণ্টিকতায় মোড়া একটি অসাধারণ রচনা । তাঁর রচনাশৈলী, এখানেও পরিবেশনার উৎকর্ষ প্রকাশ করে ।

“...কবাটের এই পারে খোজা প্রহরীর বর্শার ডগায় রোদ

জহ্লাদের চোখের মতন ।

ভিতরে রয়েছে রেশমি পোশাক পরা মসৃণ কৌতুক ।

সহচরীদের কলহাস্য, লীলাপদ্ম, লোধ্ররেণু মাখা গান ।

ঘুম ভাঙা আলস্যে জড়ানো শ্রোণীভার ।

এই দেখো, আমি ভিখারি বালক ।

দ্বাররক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে ভিতরে এসেছি ... ...

তুমি কিন্তু আশ্চর্য সুন্দর ।

তোমার গন্ধের মধ্যে প্রতিভাত বিভা ।

তামার পয়সার মতো স্তনবৃন্তে স্নেহময়ী আঠা ।

উত্তপ্ত ঊরুর তিল পূর্বজন্মে দেখা এক ফুলের মতন ...”

(ভিখারি বালকের গান / ভি.বা.গা)

দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “ত্রাণশিবির” তাঁর কাব্যচেতনাকে আরও উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করে । ভাষা আরও ঋজুকণ্ঠের ধ্বনি তোলে—

“অমলতাস গাছের ছায়ায় ঠিকাদারবাবু বসে আছেন ।

ওই দ্রাবিড় রমণীর চুলে লেগে আছে হরপ্পার মেঘ

বুকে স্নানাগারের ধ্বংসাবশেষ ।

এখানে আরেক সভ্যতার ইঁট বইছে উঁচু তলায় ।

কাজের শেষে টিপছাপ দিতে আসলে হাত ধরে

পদ্ধতিটা বুঝিয়ে দেন বাবু ।” ... ... (ইতিহাস / ত্রাণশিবির)

অদ্ভুতভাবে ইতিহাস এক অনন্য মাত্রা পেয়ে যায় এখানে, যেখানে সেই কামিন হরপ্পা থেকে আজ অবধি একই ‘পদ্ধতি’তে শ্রমদান করে যাচ্ছে । একই আছে পুরুষতন্ত্রের প্রতীক ঠিকাদারবাবুও । এই উচ্চারণই প্রতিবাদ, যা লোক দেখানো মিছিলের মুষ্টিবদ্ধ হাতের নয় । এ প্রতিবাদ জীবনের গাঢ় বেদনা থেকে উৎসারিত, অথচ নিদারুণ তীব্র !

এই তীব্রতা আজকের দিনের একজন নবীন কবির মধ্যেও দুর্লক্ষ্য ।

“...জন্মেই নর্দমার পাশে শুয়ে আছে যে শিশুটি

তাকে চক্ষুদান করো । অন্যদের অন্ধ করে দাও ।

ওর মা এখন শিবের মাথায় দুধ ঢালছে

উপবাস করে ।

পুড়ে দাও এই দুধের নির্লিজ্জ রঙ ।...”

(বাজো হে / ত্রাণশিবির)

আর দীর্ঘ করছি না লেখাটি । বস্তুত এ আমার এক শেষহীন শ্রদ্ধার্ঘ্য প্রিয়কবি ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহের প্রতি । বাংলাসাহিত্য তাঁকে এড়িয়ে এগিয়ে যেতে পারে না, এ কথাটাও মনে থাকুক আমাদের সকলেরই । অন্তিমে এসে আরও দুটি কথা বলে আপাতত শেষ করছি ।

গত বছর পাঁচেক ধরে ত্রিপুরার ধর্মনগর থেকে প্রকাশিত মাসিক কবিতাপত্র ‘পাখি সব করে রব’-এ আমরা তাঁর লেখা নিয়মিত পেয়ে যাচ্ছি । তাতে লেখার বিষয়, ভাব ও প্রকাশভঙ্গি আরও সরলতার অভিমুখ যেমন ধরেছে তেমনই নিজের জীবনকেই আশ্রয় করে আরও গভীর হয়ে উঠছে লক্ষ করা যায় । বার্ধক্যে উপনীত হলে সকলকেই ভর করে একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা । এঁর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হবার কথা নয় । কবি ব্রজেন্দ্রকুমারের বন্ধুব্যক্তি কবি প্রদীপ চৌধুরী একবার আমাকে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন নিঃসঙ্গতাই যেকোনো কবির জীবনের প্রথম ও শেষ কথা । এখানেও এক নীরবতার কথা বলেন আমাদের কবি, কিন্তু নিঃসঙ্গতার কাছে হেরে গিয়ে নয়, বরং তাকে আদেশ করছেন তাঁর কবি-ব্যক্তিত্ব দিয়ে—

“বিপুল রাত্রিকে বলো অশৃঙ্খলিত নক্ষত্রের মোজাইক করা নিস্তব্ধতা যেন কিছু বলে আমাদের ।/অর্থহীন প্রতিধ্বনিগুলো যেন নঞর্থক রব দিয়ে গ্রাস না করে ত্রিলোক ।/আলোক তরঙ্গের ছলাৎছল ফুরিয়ে গেছে শাপগ্রস্ত অপ্সরার কৃষ্ণমুখে ।/ এত নীরবতা, এত বিশাল নীরবতাকে সহ্য করি কী উপায়ে ।” (বিপুল রাত্রিকে / পাখি সব করে রব-১৪ )

একটি বিশেষ লক্ষণ আমরা তাঁর রচনায় পেয়ে যাই, যা শিল্পতত্ত্বের আলোচনার ক্ষেত্রে অনেক মাপদণ্ডের একটি হতেও পারে । শিল্প, তা সে যে রূপেরই হোক, তা বিশেষ ধরণের এক অনুকরণ, যা অনন্য মৌলিকতা নিয়ে অর্থাৎ শিল্পীর নিজস্বতা নিয়ে এক পূর্ণতায় বিকশিত হয় । সেখানে একটি আগামীর স্বপ্নও যেন জড়িয়ে থাকে । শিল্প যখন ‘What has happened’ এর গণ্ডী ছাড়িয়ে ‘What may happen’-এর স্তরে পৌঁছায় তখন অনুকরণ ও কল্পনার মিলনে এক তৃতীয় ভাব জেগে ওঠে, যা কাব্যের ক্ষেত্রে পাঠককে নিয়ে যায় অন্য এক ভুবনে ।

বস্তুবিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, জীবনতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, ইতিহাস তথা সময়, সবই ব্রজেন্দ্রকুমারের কাব্যকে জড়িয়ে আছে, আছে এক স্বপ্নের এবং জীবনের পরিণতির দিশাও—

“...উড়ে গেছে সাপের খোলস । আমার প্রেম ও চুম্বন

গ্রাস করবে মেদিনী শেষ বিকেলবেলা ।”(শেষ চুম্বন / ভি.বা.গা )

“...দোল পূর্ণিমার রাতে ভেসে যায় রবীন্দ্রনাথের পোড়োবাড়ি ।”

(অলৌকিক/ ভি.বা.গা)

“একদিন নীহারিকা থেকে আগত তরঙ্গদৈর্ঘ্য

ছুঁয়ে যাবে তৃণগুল্ম আচ্ছাদিত আমাদের জীবন যাপন ।”

(চূর্ণ কবিতাগুচ্ছ-১০ / ত্রাণশিবির)

“...আমাদের সময় বড়ো কম

তবু

মৃত কবিরা, মৃত কবিতারা

তোমাদের জন্য একমিনিট দেবো নিশ্চয়ই ।

ভোজালি পিস্তল বোমাতঙ্ক এবং আর ডি এক্স

এরই মধ্যে শোকসভার জন্য সময় করে নেবো ।”(ত্রাণশিবির)

—তিন—

ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ এই একাশীর প্রান্তে এসেও এই সময়ের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র । জীবন ও সময়ের, কাব্যচেতনা ও শিল্পতত্ত্বের সবকটি লগ্নতা তাঁর রচনায় অত্যন্ত দক্ষতায় বয়ন করা রয়েছে । এই কবিকন্ঠ চিরনবীন ।

শুধু আলোচনা করে একজন কবিকে চট করে চেনা কঠিন । শিল্পীকে জানতে হলে তাঁর শিল্পের ভেতর দিয়েই পথ করে নিতে হয় তাঁর চৌকাঠ পর্যন্ত । আমি বিশ্বাস করি কবি ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহের কাব্যকৃতিকে জানতে হবে আমাদের নিজের প্রয়োজনেই, নিজের তাগিদেই । এমনকি কোনো স্থানের ঐতিহ্য আর বিশিষ্টতা নির্দিষ্ট হয় একজন শিল্পীর দ্বারাই । একজন কবির পরিচিতি একজন জননেতার চেয়েও বেশি । কবির হাত একা একাই উঠে যায় আকাশের দিকে, উঠে থাকে । তাঁকে চিহ্নিত করতে না পারা আমাদেরই পরাজয়, আমাদেরই দুর্ভাগ্য ।

তাঁর সব কবিতা নিয়ে একটি সুবিশাল কাব্যসমগ্র প্রকাশ করার এখনই উপযুক্ত সময় । যেকোনো সুপ্রকাশক এই উদ্যোগ নিতেই পারেন ।

কবি ব্রজেন্দ্র; কুমার সিংহের দীর্ঘজীবন কামনা করি । আমরা তাঁকে আরও কাছে চাই, আরও বহুদিন চাই !

ঋণ স্বীকার ; প্রবাহ