বুধবার, এপ্রিল ২৪, ২০২৪

হলদে পাখি বাও ধান খায়, পর্ব -১২

(বারো)

স্ত্রীর কানপাশা বিক্রি করে পাওয়া পঁচিশটা টাকা যথাসময়ে রসেশ্বর নিয়ে পিয়নের হাতে দিল। পিয়ন তা থেকে পাঁচ টাকা নিজের জন্য রেখে বাকি কুড়িটা টাকা কেরানি বাবুকে দিল। কেরানিবাবু রসেশ্বরকে টেবিলের কাছে এক ঘন্টার মতো দাঁড় করিয়ে রেখে কপালে ভাঁজ ফেলে ফাইলের কাগজপ্ত্র উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল। তার মুখের ভাব ভঙ্গি দেখে রসেশ্বরের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না যে তাকে অনুগ্রহ করতে গিয়ে কেরানিবাবুকে সংসারে আগে পরে কখনো না করা একটা কঠিন কাজ করতে হচ্ছে। কেরানিবাবুর প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং সহানুভূতিতে তার মন উথলে উঠল কিন্তু এত চিন্তা করেও কেরানিবাবু একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারলেন না। প্রায় এক ঘণ্টা সময়ের নীরবতা ভঙ্গ করে তিনি রসেশ্বরের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন-‘ যাও, দৌড়ে গিয়ে সিগারেট আর তামোলপান নিয়ে এসো। আমি ইতিমধ্যে হাকিমের সঙ্গে পরামর্শ করে রাখি।‘ রসেশ্বর আশা করেছিল যে কেরানি বাবু মুখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে সে মামলার তারিখটা জানতে পারবে। সে স্পষ্টত কিছুটা হতাশ হল। অভিজ্ঞতা থেকে তার এই শিক্ষাই হল যে কেরানি বাবু যতবার মুখ খোলে ততবারই তার মুখে কিছু না কিছু একটা ভরিয়ে দিতে হয়। তবুও রক্ষা যে কোনো সিদ্ধান্ত আজ হবেনা বলে তিনি এখনও পর্যন্ত বলেননি। পান-সিগারেট কেনার জন্য রসেশ্বর বেরিয়ে গেল।

তামোলপান এবং সিগারেট নিয়ে রসেশ্বর ফিরে আসতে আসতে কেরানিবাবু হাকিমের সঙ্গে পরামর্শ করে তার রুমে ফিরে এসেছে। রসেশ্বরের হাত থেকে তামোলটা নিয়ে কেরানিবাবু মুখে দিলেন এবং চোখ বুজে পান চিবুতে চিবুতে তার রস আস্বাদন করার চেষ্টা করলেন। কেরানিবাবুর মুখের লাখ টাকা দামি কথাটা শোনার জন্য নীরবে অপেক্ষা করে থাকা ছাড়া রসেশ্বরের আর কিছুই করার ছিল না। ভাবার মতো কিছু নেই। কেরানি বাবু কি সিদ্ধান্ত দেন সেই চিন্তায় তার বুকটা ধান বানার মতো উঠানামা করতে লাগল। এই একটিমাত্র সিদ্ধান্ত তার জীবনের গতি অনেক পরিমাণে বদলে দিতে পারে। কিন্তু তার সামনে বসে নিশ্চিন্ত মনে গরুর মতো চোখ বুজে বুজে পান তামুলের আস্বাদন নেওয়া এই মানুষটা একবারও সে কথা চিন্তা করেছে কি যে এক ঘন্টার চেয়ে বেশি সময় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে থেকে রসেশ্বরের পা ব্যথা করতে পারে? সে কি একবারও চিন্তা করেছে যে পঁচিশ টাকা জোগাড় করতে গিয়ে রসেশ্বরের সংসারে কি সর্বনাশ ঘটে গেছে? হঠাৎ এবার রসেশ্বরের মনে হল যে কেরানিবাবু কোনোদিন তাকে মানুষ বলে ভাবেনি। এমনকি তার মুখের দিকে একবারও চোখ মেলে তাকিয়ে দেখার কোনো প্রয়োজন অনুভব করেনি।দুশ্চিন্তা, ক্ষুধা-তৃষ্ণা এবং দীর্ঘ প্রতীক্ষার ক্লান্তিতে রসেশ্বরের মাথাটা হঠাৎ ক্রোধে জ্বলে উঠল। সেই মুহূর্তে কেরানিবাবু চোখ মেলে তাকালে দেখতে পেতেন যে নরহত্যা করার জন্য উদ্যত হওয়া মানুষের মতো রসেশ্বরের মুখটা হিংস্র উত্তেজনায় বিকৃত হয়ে উঠেছে। কিন্তু রসেশ্বরের সেই উত্তেজনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। ক্ষণিকের মধ্যেই সে নিজেকে সামলে নিয়ে পুনরায় শান্তভাবে অপেক্ষা করতে লাগল- যেন সেভাবে অপেক্ষা করে থাকাই তার একমাত্র ভবিতব্য।

কেরানিবাবু অবশেষে চোখ মেললেন। টেবিলে পড়ে থাকা সিগারেটটা বা-হাতে তুলে নিয়ে তিনি দিয়াশলাইয়ের একটাকাঠি দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁত খোঁচাতে লাগলেন। তারপরে সিগারেটটা জ্বালিয়ে নিয়ে পরম আরামে নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করে দিয়ে তিনি হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে ওঠার মতো বলে উঠলেন

-‘ও তোমার মামলাটা। তোমার কাজটা আমি করেদিলাম বুঝেছ। এমনিতে হলে মাঘ মাসের আগে দিন পরার আর কোনো আশাই ছিল না আমি হাকিমকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কার্তিক মাসের পাঁচ তারিখ দিন ফেলেছি। কার্তিক মাসের পাঁচ তারিখ বুঝেছ? তুমি এখন যাও। আমার অনেক কাজ আছে।‘

টেবিলের ফাইলগুলি নিজের কাছে টেনে টেনে নিয়ে কাজ করায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কার্তিকের পাঁচ তারিখ। রসেশ্বর প্রথমে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারলেন না। কার্তিকের পাঁচ তারিখ মামলার দিন পাওয়ার জন্য স্ত্রীর কানপাশা বিক্রি করে ঘরের লক্ষীকে বিতাড়িত করার কি দরকার ছিল? এমনিতেই মাঘ মাসের আগে দিন পাওয়ার আর কোনো আশা ছিল না। কেরানি বাবু পঁচিশটা টাকা দক্ষিণা নিয়ে অনুগ্রহ করার জন্য কার্তিক মাসের পাঁচ তারিখ কোনো মতে দিন পাওয়া গেল। কিন্তু কার্তিক মাসের পাঁচ তারিখ মামলার দিন পেয়ে তার কী লাভ হল। মামলার দিন যত পারে দ্রুত ফেলার জন্য সে যে পাগলের মতো উঠেপড়ে লেগেছিল,তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল পারলে কোনোমতে দেরিতে হলেও শালি ধানের চাষ করা। কিন্তু কার্তিকের পাঁচ তারিখ মামলার দিন পড়লে চাষ করার সময় আর কোথায় থাকবে? তখন তার কাছে মামলার দিন মাঘ মাসে পরা আর কার্তিক মাসে করা একই কথা।

কেরানিবাবুর কথা মগজে ভাল করে প্রবেশ করার জন্য কিছু সময় দিয়ে রসেশ্বর এবার হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠল-‘কেরানিবাবু,এভাবে আমার সর্বনাশ করবেন না কেরানিবাবু,কার্তিকের পাঁচ তারিখ মামলার দিন পড়লে আমার কী লাভ হবে? ভাদ্র মাসের ভেতরে আমার মামলাটার ফায়সালা করে দিন কেরানিবাবু। আমি আপনার পায়ে ধরছি-‘

কথাটা বলে রসেশ্বর টেবিলের নিচ দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে সত্যি সত্যি কেরানি বাবুর পা দুটি বুকের মধ্যে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলেন।

এরকম একটি নাটকীয় কাণ্ডের জন্য কেরানিবাবু মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। সুদীর্ঘ চাকরি জীবনে কত বিচিত্র মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে, প্রতিদিনই কত টাকা-পয়সার লেনদেন হয়েছে, কিন্তু পায়ে ধরব বলে সত্যি সত্যি পায়ে ধরে নেওয়া মানুষ এই প্রথম দেখতে পেল। পাদুটো জোর করে টেনে বের করে চেয়ারের উপর রেখে সে প্রায় চিৎকার করে উঠল-‘ আরে, আরে কী ধরনের মানুষ তুমি? সরকারি অফিসে তুমি কি এইসব ফাজলামি করতে এসেছ ?উঠ বলছি না,উঠ, তুমি এখনই আমার অফিস থেকে বেরিয়ে যাও।’টেবিলের নিচে মাথা বের করে ভিক্ষা প্রার্থী মানুষের মতো হাতজোড় করে রসেশ্বর কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে ক্রেধিত ভাবে কিছু একটা বলতে গিয়ে কেরানিবাবুর মুখ থেকে হাসি বেরিয়ে গেল। রসেশ্বরের মুখের এখানে-সেখানে মেঝের ধুলো লেগে সম্পূর্ণ মানুষটা যাত্রাপালার সং এর মত হয়ে পড়েছে। দেখলে সত্যিই না হেসে থাকা যায় না। এদিকে কেরানি বাবার মুখে হাসি দেখে মরা সাপকেও না ডিঙিয়ে যাওয়া ভয়াতুর রসেশ্বরের মাথাটা দপ করে জ্বলে উঠল।

স্থান কাল পাত্র ভুলে সে গর্জন করে উঠল-‘ কেরানি বাবু, আজ হয়ে এসপার নয়তো ওসপার। আমি মানুষটা মরছি প্রাণের জ্বালায়,আপনি এদিকে তামাশা করছেন। ভাদ্র মাসের মধ্যে মামলার দিন ফেলে মামলা নিষ্পত্তি করে দেবেন বলে ছিলেন বলেই স্ত্রীর যৌতুকে পাওয়া কানের কানপাশা বিক্রি করে আপনাকে পঁচিশ টাকা দিয়েছিলাম। আপনাকে মামলার দিন ভাদ্র মাসের ভেতরে ফেলতেই হবে। না হলে আমি আজ সহজে ছাড়ছি না।

অফিসের ভেতরে রসেশ্বরের চিৎকার শুনে এদিকে ওদিকে থাকা একদল মানুষ এসে অফিসের দরজার সামনে জমা হল। মানুষের ভিড় হতে দেখে রসেশ্বরের উত্তেজনা বেড়ে গেল। মানুষগুলির দিকে তাকিয়ে সে ভীষণ উত্তেজিত ভাবে বলতে লাগল-‘দেখুন তো আপনারা, কেরানিবাবু হয়েছে বলে কি এভাবে দুঃখী মানুষের রক্ত শুষে খাবে? একটি মামলার জন্য এরা সবাই আজ আমাকে একমাস ধরে ঘোরাচ্ছে। নানা জায়গা থেকে চেষ্টাচরিত্র করে টাকা পয়সা জোগাড় করে এনে ঢালতে ঢালতে আমার সংসারের অবস্থা শূ্ন্য হয়ে পড়েছে। এতগুলি টাকাপয়সা খেয়েও আমার মামলার দিন নাকি কার্তিক মাসের পাঁচ তারিখ পড়বে। কার্তিক মাসের পাঁচ তারিখ মামলার দিন পড়লে আমার কী লাভ হবে? আপনারা সাক্ষী রইলেন। আমার মামলা যদি ভাদ্র মাসের ভেতরে নিষ্পত্তি করে না দেয় তাহলে আজ আমি কী করি তাঁর কিন্তু ঠিক নেই।‘

রসেশ্বরের কথার মধ্যে কেরানি বাবু তর্জন গর্জন করে উঠলেন-‘ এই তুই চুপ করে থাক হারামজাদা। আপনারা দেখেছেন- এই পাগলের কান্ড? এই অফিসে এ ধরনের অভূতপূর্ব ঘটনা আপনারা আগে কখনো দেখেছেন কি? নিশ্চয় কোথাও গাঁজা খেয়ে পাগল হয়ে এসেছে। আমি কিন্তু সরকারি অফিসে এই ধরনের পাগলামি সহ্য করব না। এই কানুরাম, কী দেখছিস এই পাগলটা কে ঘাড় ধরে অফিসের কম্পাউন্ডের বাইরে বার করে দে।‘

কানুরাম পিয়ন কেরানিবাবুর দালালি করে রসেশ্বরের কাছ থেকে টাকা আদায় করেছিল। সে ভাবল যে রসেশ্বর বেশি কথার সুযোগ পেলে তার কথাও হয়তো বের হয়ে যাবে।কেরানিবাবুর হুকুম পাওয়া মাত্র সে সে দুইহাতে রসেশ্বরের গলায় ধরে তাকে বাইরে বের করে নিয়ে গেল। রসেশ্বর চিৎকার করে কিছু একটা বলতে চেষ্টা করেছিল। পিয়ন জোর করে চড় থাপ্পড় মেরে তার মুখ থেকে ভালো করে কথা বের হতে দিল না। অফিসের দরজার সামনে ভিড় করা মানুষগুলির মধ্যে বেশিরভাগই ছিল মন্ডল কানুনগো সবাই পাপের ধনের অংশীদার।বাইরের মানুষ যে দুই চারজন ছিল,তারা ছিল মণ্ডল কানুনগো এবং কেরানি বাবুর কৃপাপ্রার্থী। কেরানি বাবুর কানে পড়ার মতো করে প্রত্যেকেই রসেশ্বরের বিরুদ্ধে কিছু না কিছু মন্তব্য করে যে যার নিজের কাজে চলে গেল।

অফিস থেকে বাড়ি পর্যন্ত দীর্ঘ পথ কীভাবে এল সে কথা রসেশ্বর বলতে পারেনা। পিয়নের চড়-থাপ্পড়ের যন্ত্রণা এবং অপমানটুকু সে পরের মুহূর্তে ভুলে গেল। প্রতি মুহূর্তে সে কেবল এটাই অনুভব করতে লাগল যে আজ তার চরম সর্বনাশ ঘটল। নিজে সর্বস্বান্ত হয়ে সে এতদিনে যে টাকা-পয়সা খরচ করল তা পুরোপুরি বৃথা হল। এই বছরে শালি ধান চাষ করার আশা পুরোপুরি মিথ্যা হয়ে গেল। তাছাড়া আজ অফিসের কেরানি পিয়ন প্রত্যেকের সঙ্গে তার যে শত্রুতা সৃষ্টি হল- ওরা তার ওপরে প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়বে না। মামলায় ভালো হওয়ার যদি কোনোও আশা ছিল সেটাও সমূলে নষ্ট হল। এদের ছাড়া তার চলবে না জেনেও সে কেন কেরানিবাবুর সঙ্গে ঝগড়ার পথ বেছে নিল।দুঃখী মানুষের যে রাগ করার অধিকার নেই সে কথা কি সে জানে না? হেলতে দুলতে আসার সময় সে পাগলের মতো মাঝেমধ্যে নিজের কপাল চাপড়াতে লাগল। যখন গিয়ে বাড়ি পৌঁছালেন, ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে। স্ত্রী বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তার ফেরার অপেক্ষা করছে। স্ত্রীর অস্তিত্বকে গ্রাহ্য না করে রসেশ্বর টলোমলো পদক্ষেপে ঘরের দিকে ঢুকে গেল। দুজনের মধ্যে যদিও কোন বাক্য বিনিময় হল না স্ত্রী যা বোঝার বুঝে নিল। তার বুক ভেদ করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। বেড়া ধরে সে কাঁপতে কাঁপতে সেখানেই বসে পড়ল। আর মুখ দিয়ে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে পরিচিত দেবদেবীর উদ্দেশ্যে কীসব প্রার্থনা করতে লাগল।