শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

হলদে পাখি বাও ধান খায়, পর্ব -৫

পাঁচ

আধিব বোর্ড তিনজন সদস্য নিয়ে গঠিত। একজন হল সার্কেলের সাব-ডেপুটি কালেক্টর, অন্যজন মাটির মালিকদের প্রতিনিধি। তৃতীয়জন আধিয়ারদের প্রতিনিধি। ডেপুটি কালেক্টর বোর্ডের সভাপতি যে কোনো মামলায় দুজন সদস্য যেদিকে রায় দেয় সেই পক্ষকেই সাধারণত জয়ী বলে ঘোষণা করা হয়। মামলাটা যত তাড়াতাড়ি করা যায় রসেশ্বরের জন্য ততই মঙ্গল। কারণ তা না হলে চাষের সময়টা ক্ষতিগ্রস্থ হবে কিন্তু মামলা মানেই তো টাকার খেলা,হাতে কিছু টাকা না জোগাড় হলে সে মামলা করবে কীভাবে? শ্রাবণ মাসের ৪ তারিখ সকাল বেলা সে পুনরায় মামলা সংক্রান্ত আলোচনা করার জন্য ডিম্বেশ্বর মণ্ডলের বাড়িতে গেল। যাবার সময় অবশ্য মন্ডলের আশা অনুযায়ী পাত্রে করে দুধ নিয়ে যেতে ভুললনা।সম্প্রতি নতুন করে বাচ্চা দেওয়া গাভিটি প্রতিদিন ছয়পোয়া করে দুধ দেয়। তা থেকে ছেলে-মেয়েদের জন্য আধাসের রেখে বাকি এক সের স্ত্রী বিক্রি করে। সেই পয়সা দিয়ে ছেলের স্কুলের মাসুল এবং কাপড় চোপড় থেকে শুরু করে নূন এবং কেরোসিন তেলের খরচ বের করতে হয়। পারলে বাকি আধসের দুধও বিক্রি করে দিত কিন্তু সেটা সম্ভব নয় কারণ কোলের এক বছরের শিশুটিকে খাওয়ানোর মতো দুধ মায়ের বুকে নেই। হাতে দুধের পাত্র নিয়ে ডিম্বেশ্বর মণ্ডলের বাড়িতে যাবার পথে রসেশ্বর স্বগতোক্তি করল – ‘এই ধরনের কুলক্ষণা মহিলা, এখনই তার বুকের দুধ নাই হয়ে গেল। তাহলে কাল থেকে মেয়েকে কী খাওয়াবি? আমি মনে মনে কী মতলব করেছি তুই কি জানিস?... ইস ইস কানা বিধাতাও কোনো অংশে কম নয়। দুখিনির কপালে আর কিছু নেই তো নেই, শিশুর জন্য মায়ের বুকের দুধটুকুও রাখল না।’

মামলার জন্য কোথায় কী করতে হবে সেই বিষয়ে শলা পরামর্শ দিয়ে ডিম্বেশ্বর মন্ডল অবশেষে বললেন-‘ তবে একটা কথা চুতিয়া, তুমি যদি ভাব যে আধি বোর্ডে তুমি মামলাটা করে দিলেই সদস্যরা আইনের বই বের করে তার ধারা মতো কাম কাজ করে যাবে আর তুমি জমি পেয়ে যাবে তাহলে কিন্তু বিরাট ভুল করবে।কথাটা তোমাকে খোলাখুলি বলে দিচ্ছি শোনো। আধি বোর্ডের তিন সদস্য- ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর- এই তিনজনকে পুজো দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারলে তবেই তাদের কৃপা দৃষ্টি তোমার উপরে বর্ষিত হতে পারে। না হলে কিন্তু সবই মিথ্যা হবে। এই দেবতাদের কার কী প্রকৃতি তারকিছু আভাস আমি তোমাকে দিয়ে রাখছি। শোনো বোর্ডের সভাপতি অর্থাৎ আমাদের হাকিম, তার কাছে কিন্তু তুমি সোজাসুজি যেতে পারবেনা। তাকে যদি পুজোর জন্য কিছু দিতে চাও তাহলে তোমাকে আমার মাধ্যমে তা দিতে হবে। অবশ্য আমাকে তুমি বিশ্বাস না করলে দুর্যোধন কানুনগোর মাধ্যমেও দিতে পার। আমাদের হাকিম সমস্ত পুজো অর্চনা আমাদের দুজনের মাধ্যমেই নিয়ে থাকেন। অন্য কাউকে তিনি বিশ্বাস করেন । তিনি কি ধরনের পুজো বেশি পছন্দ করেন সেটাও বলে রাখছি। তুমি তো জানোই আমাদের হাকিম এখনও বিয়ে-শাদি করে নি, করার আশাও বোধহয় নেই। কারন বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে। মানুষটা বড় দয়ালু প্রকৃতির। টাকাপয়সা নিজে না খেয়ে অন্যকে দিতেই বেশি আগ্রহী। কিন্তু তার একটি বদ অভ্যাস হল মদ না খেয়ে তিনি এক মুহূর্ত থাকতে পারেন না। সারাটা দিন মানুষটা মদের নেশাতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকেন। তবে প্রতিদিন একটি করে বিলেতি মদের বোতল খাবার মতন এত টাকা তিনি কোথায় পাবেন? সেই জন্য কেউ তাকে একটা বিলেতি মদেরবোতল উপহার দিলে তিনি বড় খুশি হন। সঙ্গে যদি তরতাজা একটি মুরগি দেওয়া হয় তাহলে তো কথাই নেই। পুজোয় তুষ্ট হওয়া মহাদেবের মতোই তিনি তখন যেকোনো মানুষকে যে কোনো বর দিতে প্রস্তুত।এই হলআমাদের হাকিমের কথা। তুমি তার জন্য বিলেতি মদের বোতল এবং একটা মুরগি এনে আমার হাতে দেবে বাকিটা যা করার আমিই করব।

মন্ডলের কথা শুনে শুনে আতঙ্কে রসেশ্বরের গলা মুখ শুকিয়ে গেল, কোনোমতে জোর করে সে বলল-‘দাদা বিলেতি মদ চোখে দেখা তো দূরের কথা, নামই শুনিনি। কোথায় কিনতে পাওয়া যায় তাও জানিনা। তাছাড়া এর জন্য আমাকে শহরে যেতে হবে। তারমানে একদিনের কাজের ক্ষতি সঙ্গে আসা-যাওয়ার নামে অতিরিক্ত দশ-বারো টাকার খরচ।তার বদলে আমি যদি দামটা আপনাকে দিয়ে দিই আপনি কিনে আনার ব্যবস্থা করতে পারেন না? ‘কেন পারব না,-কেন পারবনা’- মন্ডল রসেশ্বরকে আশ্বস্ত করার জন্য প্রয়োজনের চেয়ে অধিক কোমল কন্ঠে বলল-‘তুমি সেই বিষয়ে কোনো চিন্তা কর না। আমাদের টুপিধর পিয়ন সপ্তাহে দুবার করে জেলায় যায়। আমাদের সাহেব তো তার মাধ্যমেই প্রতিদিন তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আনে। মদের বোতলের জন্য লাগবে ৩২ টাকা, মুরগির জন্য ধরে নাও ৫ টাকা, মোট.৩৭ টাকা। তুমি আমাকে ৩৫ টাকা দিলেই হয়ে যাবে।’

মন্ডলের কথা শুনে রসেশ্বর তার বুকের ভেতর কলজেটা একহাত চুপসে যাওয়া যেন অনুভব করল। সে মনে মনে ধরে নিয়েছিল যে মদ এবং মুরগি মিলিয়ে কুড়ি টাকার মধ্যে হয়ে যাবে। কিন্তু সে ভাবার চেয়ে দাম তো প্রায় দ্বিগুণ বেশি হল। কিছু একটা বলতে গিয়ে সে কিছুই বলতে পারল না। তার ঠোট দুটি বড় করুণ ভাবে কাঁপতে লাগল।

টাকার হিসেবটা রসেশ্বরের মনে ভালোভাবে ঢোকানোর সময় দিয়ে মন্ডল আবার বলে উঠল-‘এখন বলছি বোর্ডের বাকি দুজন সদস্যের কথা। একজনকে তুমি হয়তো জান।আমাদের মৌজার এই গ্রামের বাপুরাম শইকীয়া। তিনি হলেন আধিয়ারের প্রতিনিধি। নামেই তিনি আধিয়ারের প্রতিনিধি।কিন্তু আসলে যে টাকা দেয় তারই প্রতিনিধি।মানুষটা লেখাপড়া, আইন-কানুন কিছুই জানেনা না। বোর্ডের মিটিংয়ে তিনি গাছের গুড়ির মতন বসে থাকেন। মামলার শুনানি শেষ হওয়ার পরে যখন সদস্য দুজনকে নিজেদের মতামত দিতে হয়, বাপুরাম যে পক্ষের টাকা খায় সেই পক্ষের হয়ে কথা বলে। ‘অমুকের জমিটা পাওয়া উচিত বা ধান তারই পাওয়া উচিত।’ সেই কথাটা বলবে বলে তিনি বাড়ি থেকে প্রস্তুত হয়ে আসেন। সারাটা রাস্তা সেই কথাটাই মুখস্ত করে থাকেন। তাই সভায় বসে তিনি আইনের পয়েন্ট বা উকিলের তর্ক বা সাক্ষীর কথাবার্তা কান পেতে শোনার কোনোরকম প্রয়োজন অনুভব করেন না। আমার মনে হয় হাকিমের কাছে মামলাটা দিয়েই এই বাপুরাম শইকীয়ার সঙ্গে তোমার একবার দেখা করা উচিত । আমার মনে হয় প্রথমবার দেখা করার সময় তুমি তাকে আড়াই কুড়ি টাকা দিলেই হবে।

একটি শব্দহীন আর্তনাদ রসেশ্বরের বুক ভেদ করে বেরিয়ে এল। মন্ডল নির্বিকার ভাবে বলে যেতে লাগল-‘বাকি থাকল ধর্মদত্ত কাকতী। তাকে তুমি চেন না। মধুপুর মৌজার মানুষ। আমার মনে হয় আপাতত তুমি তাকে বাদ দিতে পার। বোর্ডের তিনজন সদস্যের মধ্যে দুজন যে পক্ষে থাকে সেই পক্ষেরই জয় হয়। বর্তমানে তুমি এই দু'জনকে হাত করার চেষ্টা কর।

মণ্ডলকে নীরব হয়ে যেতে দেখে রসেশ্বর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল –‘আচ্ছা দাদা, আপনি যা যা বললেন সমস্ত কথাই বুঝতে পারলাম। কিন্তু এর মধ্যে একটি কথা বোঝার বাকি থেকে গেল। আমি না হয় বোর্ডের সদস্যদের পুজো দিয়ে সন্তুষ্ট করলাম কিন্তু সনাতন ঠিকাদার কি চুপ করে বসে থাকবে? তিনি আমার চেয়েও বেশি করবেন বলে মনে হয়। আমি যদি হাকিমকে একটি মদের বোতল দিই, তিনি দুটো দেবেন। আমি যদি বাপুরামকে ৫০ টাকা দিই তিনি ১০০ টাকা দেবেন। তাহলে শেষ পর্যন্ত কী হবে?

মন্ডল ভাবতেই পারেনি রসেশ্বর তাকে এভাবে উকিলের মতো জেরা করতে শুরু করবে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষনের জন্য সে কিছুই বলতে পারল না। তারপরে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল-‘একটা কথা না চুতীয়া, ঘুষ খাবার সময় সরকারি মানুষ সব সময় একটা কথা প্রথমে চিন্তা করে। আইন কার দিকে রয়েছে, আইন যেদিকে থাকে সাধারণত সেই পক্ষ থেকেই ঘুষ নেওয়া হয়। কখনও কেউ দুই পক্ষ থেকে ঘুষ নিলেও কাজটা করার সময় আইন যার পক্ষে থাকে সাধারণত সেই পক্ষেরই হয়ে কাজ করে দেয়। অবশ্য তার বিপরিত যে ঘটেনা তা নয়। কিন্তু তুমি যখন কিছু একটা কাজে হাত দাও তুমি নিশ্চয়ই আশা কর যে কাজটা তুমি ভাবা মতোই নিশ্চিত হয়ে উঠবে। সরকারি ঝামেলা বা মামলা-মোকদ্দমার ক্ষেত্রে সেই একই কথা। আশা করার বাইরে অন্য কিছু করার মতো তোমার হাতে নেই। দ্বিতীয়তঃ তুমি পাঁচ টাকা দিলে অপর পক্ষ যদি ১০ টাকা দেয় তাহলে দ্বিতীয়বার তোমাকেও ১৫ টাকা ধরিয়ে দিতে হবে। তা ছাড়া আর কোনো পথ আছে কি?

এটা তো দেখছি মৌজাদারের কাছে খাজনার অনাদায়ে ঘটিবাটি নিলাম করার মতো কথা হল। সংসদের কোনো কথায়পাত্তা না পাওয়া রসেশ্বর অকৃত্রিম বিস্ময়ের সঙ্গে বলে উঠল- ‘ঘটি-বাটি, গরু নিলাম হওয়ার মতোই আইনের বিচারও নিলাম হয় নাকি?’

রসেশ্বরের এই মন্তব্যের পরে বলার মতো কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে মন্ডল কেবল মাথা নেড়ে নেড়ে বলল ‘যুগ-ধর্ম চুতীয়া, যুগ-ধর্ম।যে যুগের যে ধর্ম আমাদের তা মেনে চলতেই হবে।’

কিছুক্ষণ দুজনেই নিজের নিজের চিন্তায় তন্ময় হয়ে সম্পূর্ণ নীরব হয়ে রইল। রসেশ্বরই প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করে বলে উঠল- ‘আচ্ছা দাদা,আপনার সমস্ত কথা বুঝতে পারলাম। কিন্তু এখন আপনাকেও আমার কিছু কথা বুঝতে হবে। সরোবরে কচ্ছপের গ্রাসে পড়া গজেন্দ্র শুঁড় দিয়ে পদ্মফুল তুলে এনে গোবিন্দকে স্তুতি করার মতো আমি আপনাকে আশ্রয় করেছি, আপনার চরন ধরেই স্তুতি করছি- আপনি এই মহা বিপদ থেকে আমাকে উদ্ধার করুন। মামলা করার জন্য আপনি যে টাকা পয়সার হিসেব দিলেন তত টাকা আমার মতো ভিখারি কোথা থেকে পাবে? আপনি আপাতত আমাকে পাঁচ কুড়ির মতো টাকা দিয়ে সাহায্য করুন-‘

টাকার নাম শুনে আতঙ্কিত হয়ে মন্ডল কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলতেই রসেশ্বর মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল-‘দাঁড়ান দাঁড়ান দাদা, আমার কথা শেষ করতে দিন। আপনার কাছ থেকে ১০০ টাকা আমি এমনি এমনি চাইছি না। এই নিঃস্ব মানুষটাকে আপনি কী বিশ্বাসে ১০০ টাকা এমনিতেই দেবেন? আমার নতুন বাচ্চা দেওয়া একটা গাভি আছে। ভালো জাতের গাভি।মঙলা চকের ভীম বাহাদুর নেপালির কাছ থেকে ওর মাকে কিনেছিলাম। প্রথম বাচ্চা দিয়েছে আজ থেকে দু মাস আগে।একবেলা দুধ দুইলে ছয় পোয়া দুধ দেয়। এই গাভিটাকে ঘরের লক্ষী বলে ভেবেছিলাম। সে আমার মায়ের এবং বড় ছেলের বুকের ধন। কিন্তু আমার মতো দুঃখী মানুষ স্নেহ ভালোবাসার কথা ভাবলে সংসার কীভাবে চলবে? সেই দুগ্ধবতী গাভিকে এনে আজ বিকেলে আমি আপনার গোয়ালে নিজের হাতে বেঁধে রেখে যাব। আপনি আমাকে ১০০ টাকা দিতেই হবে দাদা। এত আদরের গাভিটাকে যাকে তাকে বিক্রি করতে বা বন্ধকে দিতে মন চায় না।’

শেষের কথাগুলো বলার সময় রসেশ্বরের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এল।

রসেশ্বরের কথা শুনে মন্ডল খুব দ্রুত মনে মনে একটা হিসেব করে ফেলল। তারপরে সে বলল- ‘বড় মুশকিলে ফেললে চুতীয়া, হাতে আমার নগদ টাকা একেবারেই নেই। কিন্তু এমন একটি বিপদের সময় তোমাকে কীভাবেই বা বিমুখ করি। তুমি একবার বিকেলের দিকে এসো। আমিও সারাটা দিন ঘোরাঘুরি করে দেখি ১০০ টাকা জোগাড় করতে পারি কিনা।’ 'আমাকে প্রাণে বাঁচালেন দাদা, আমাকে প্রাণে বাঁচলেন।' মন্ডলের পায়ের দিকে হাত দুটো এগিয়ে দিয়ে রসেশ্বর দুবার প্রণাম করল,তারপর উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল-' আমি তাহলে এখন উঠছি দাদা, সন্ধ্যে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি গাভিটা নিয়ে এখানে চলে আসব।’ মন্ডলের কথার অপেক্ষা না করে সে দ্রুত রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল।


ক্রমশ