শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

হলদে পাখি বাও ধান খায়, পর্ব -২০

২০

মাঘ বিহুর দুদিন আগে ধান কাটার কাজ শেষ হল। রসেশ্বরের চোখের সামনে সমস্ত পৃথিবী অন্ধকার হয়ে পড়ল। এরপর সে কী করে সংসার চালাবে? এদিকে-ওদিকে কিছুটা চেষ্টা করে দেখলে সে হয়তো কোনো ধনীচাষির বাড়িতে হালোয়া হিসেবে কাজ করতে পারে। গ্রামের চাষি মাসিক বেতন দিয়ে কাউকে হালোয়া হিসেবে রাখে না। ফসল উঠার পরে হালুয়া কে চাষের ভাগ দেওয়া হয়। তার মানে আষাঢ় শ্রাবণ মাসে আউশ ধান চাষ করার সময় রসেশ্বর তার প্রাপ্যটুকু পেতে পারে। কিন্তু ধান পাকতে পাকতে টুনির মরণ। আউশ ধানের ভাগ পাবার জন্য বসে থাকা মানে পাঁচ-ছয় মাস রসেশ্বর ছেলেমেয়েকে কী খাওয়াবে? অনেক চিন্তা করে দেখল হাজিরার কাজ করে খাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।

রসেশ্বরদের মতো জকাইচুকিয়া গ্রামে দিনমজুরের কাজ পাওয়া সহজ কথা নয়। প্রতিটি মানুষই নিজের কাজ করে খায়, অন্যের উপর খুব কম মানুষই নির্ভর করে। যে দুই-চারঘর ধনী মানুষ আছে তাদের বাড়িতে কখনও কাজের চাহিদা তৈরি হলেও দিনমজুরি দুই টাকার বেশি নয়। উপায় না পেয়ে রসেশ্বর এই অনিশ্চিত জীবনযাত্রা আরম্ভ করল। হাতে একটা দা নিয়ে ভোরবেলা সে কাজের খোঁজে বেরিয়ে যায়, কখন ও কাজের সন্ধানে পাঁচ ছয় মাইলদূরে যেতে হয়। ভাগ্য প্রসন্ন হলে কখনও কারও বাড়িতে কাজ পেয়ে যায়। সে দিন গৃহস্থের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে একবাটি চা খেয়ে পেটের ক্ষুধা মেটায়। সারাদিন অনাহারে কাজ করে। ছেলে পরিবার দুপুরবেলা কিছু খেতে পেল কিনা এই সমস্ত অর্থহীন চিন্তা সে মনের মধ্যে স্থান পেতে দেয় না। মজুরি হিসেবে পাওয়া টাকা দুটি দিয়ে বাইরে বাইরে চাল,নূন কিনে সন্ধ্যের পরে সে বাড়ি ফেরে। যেদিন সারাটাদিন টোটো করে ঘুরে কোনো কাজ না পেয়ে বিকেলে খালি হাতে বাড়ি ফিরে আসে, সেদিন রসেশ্বরের বাড়িতে শ্মশানের অন্ধকার এবং নীরবতা বিরাজ করে। কেরোসিন তেলের অভাবে প্রদীপ জ্বলে না, চালের অভাবে হাড়ি চড়ে না, সূর্যাস্তের পরে প্রতিটি প্রাণী বিছানায় আশ্রয় নেয়। জীবনের এই ভয়ঙ্কর রূপ দেখে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা একরকম বোবা হয়ে গেছে যে ওরাও কোনোদিন ক্ষুধা লেগেছে বলে আপত্তি করে না। ক্ষুধার আগুনে তিলে তিলে দগ্ধ হয়ে মা বাবা আর ছেলে মেয়ে প্রত্যেকে নীরব এবং নির্মম যন্ত্রণার মধ্যে ঘুমের জন্য ব্যাকুল ভাবে অপেক্ষা করে থাকে।

চোখে ঢাকনি বেঁধে দেওয়া ঘোড়া সামনের পথ ছাড়া যেভাবে আর কিছুই দেখতে পায় না রসেশ্বরও এখন তেমনই জীবনের এই একটি পরিচিত পথই চিনতে পারে। সকাল বেলা দিনহাজিরার খোঁজে বেরিয়ে যাওয়া আর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসা।পৃথিবীর অন্য কোনো কথা চোখে পড়েনাতো পড়েই না, তার কানে এসেও পৃথিবীর কোনো শব্দপ্রবেশ করে না। তার মগজের ভেতর ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তার একটা বিষাক্তপোকা বাসা বেঁধেছে। দিনরাতের প্রতিটি মুহূর্তে রসেশ্বরের কানে বাজতে থাকে সেই পোকাটির গুণগুণানির শব্দ।

একদিন কিন্তু সম্পূর্ণ একটি অপরিচিতশব্দ রসেশ্বরের কানে এসে পড়ল। আর সে চমকে উঠে কান খাড়া করে রইল। সেদিন সারাদিন কাজের খোঁজে ঘোরাঘুরি করেও কোথাও কাজ না পেয়ে দুঃখে ক্লান্তিতে সে বাজারের বট গাছের নিচে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। ঠিক তখনই কিছু দূর থেকে একটা অপরিচিত কণ্ঠস্বর এসে তার কানে বাজল।-- 'ভূমিহীন জমির কৃষকদের মাটি পেতেই হবে।' যে দিক থেকে কন্ঠস্বরটা ভেসে এল সে দিকে তাকিয়ে সে দেখল রবিবারের হাট বসা খোলা জায়গায় অনেক মানুষ জমা হয়েছে আর একজন যুবক ছেলে কিছু একটা যন্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে করে বক্তৃতা দিচ্ছে। এতদিন যে সমস্ত ধনী মহাজনরা চাষিদের রক্ত শোষণ করে বসে বসে খাচ্ছিল তাদের দিন শেষ হয়ে এসেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন…' রসেশ্বর ধীরে ধীরে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। জীবনে কোনো সভা সমিতিতে সে কখন ও যায়নি। আদার বেপারি জাহাজের খবর রাখার কোনো দরকার নেই। কিন্তু আজ হঠাৎ তার কানে এসে পড়া অপরিচিত যুবকের বক্তৃতার টুকরো টুকরো কথাগুলি গভীর কৌতুহলের সৃষ্টি করল। সমস্ত ভূমিহীন মানুষ মাটি পাবে। সে কানে ভুল শোনেনি তো? নাকি ক্ষুধা-তৃষ্ণায় জর্জরিত এবং আধা পাগল হয়ে সে জাগ্রত অবস্থায় কোনো স্বপ্ন দেখছে? এক পা দু পা করে এগিয়ে গিয়ে সে বক্তৃতা শুনতে থাকা মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াল। আর গ্রামের হলধর কে দেখে জিজ্ঞেস করল-' কীহে হলধর, কীসের সভা হচ্ছে? হলধর ঘুরে তাকিয়ে রসেশ্বরকে দেখে জিজ্ঞেস করল- 'তুমি এতদিন কোথায় ঘুমিয়ে ছিলে?' ইলেকশন এসেছে- জাননা কি? গতবার ইলেকশনে তুমি ভোট দাও নাকি ? আবার ভোটের সময় এসেছে। আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি । আমাদের এখানে আজকের এটাই প্রথম ইলেকশন মিটিং। রসেশ্বর জীবনে কোনোদিনই ভোট দেয়নি। তার সেই একই কথা -'আদার বেপারি জাহাজের খবর রেখে কী করবে?' কিন্তু আজকের কথা, আজকের কান্ড দেখে আর শুনে তার মনে প্রথম প্রশ্ন দেখা দিল- ইলেকশনে ভোট দিলেই মানুষ জমি পায় নাকি? এতদিন তো তাকে কেউ বলেনি। আজ তাহলে বক্তৃতার কথাগুলি ভালোভাবে শুনতে হবে। মানুষের ভিড় ঠেলে সে যতটা পারে সামনে এগিয়ে গেল। রসেশ্বর একেবারে সামনে যেতে পারল না। কিন্তু মানুষের কাঁধের উপর দিয়ে গলা বাড়িয়ে যে দৃশ্য দেখতে পেল, তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। বক্তৃতা দিতে থাকা যুবকটির কাছে একটি চেয়ারে মধুর মোলায়েম হাসি হেসে বসে আছে সনাতন শর্মা। তার গলায় একটি বড় ফুলের মালা। চারদিকে তাকিয়ে দেখল অন্য কারও গলায় ফুলের মালা নেই। সে বুঝতে পারল সনাতন শর্মা এই সভার সভাপতি। সনাতন শর্মা যে সমগ্র মৌজার মধ্যে সবচেয়ে বড় মানুষ নিশ্চয় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি নিশ্চয় সভাপতি হওয়ার যোগ্য। কিন্তু যে সভায় দুঃখীর রক্ত শোষণ করে খাওয়া মহাজনের বিরুদ্ধে এই ধরনের গরম বক্তৃতা দিচ্ছে সেই সভায় আবার শর্মা কীভাবে সভাপতি হতে পারে? সে কথা ভেবে রসেশ্বর হতভম্ব হয়ে গেল। এই সনাতন শর্মা তাকে তিন মাসের মধ্যে জাল জুয়াচুরি আর অন‍্যায় করে পিতৃপুরুষের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেনি কি? একে যদি দুঃখীর রক্ত শোষণ করে খাওয়া না বলে তাহলে আর কাকে বলবে। সমগ্র ব্যাপারটা রসেশ্বরের কাছে একটা ভীষণ দুর্বোধ্য রহস্য বলে মনে হল। সে ভাবল যে সভায় আলোচিত বক্তব্য মন দিয়ে শুনলে হয়তো সেই রহস্যের কিছুটা মর্ম ভেদ করতে পারবে। কানদুটি সম্পূর্ণ সজাগ রেখে সে পরম মনোযোগের সঙ্গে বক্তৃতার প্রতিটিশব্দ শুনতে লাগল। যুবক ছেলেটি বলতে লাগল -'জনগণ আপনারা জানেন আমাদের দেশের প্রধান সমস্যা হল দরিদ্রতা। সেই জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন এবার আমাদের দলের প্রধান লক্ষ্য হবে গরীবী হটাও অর্থাৎদরিদ্রতা কীভাবে দূর করা যায়। দরিদ্রতা দূর করার একমাত্র উপায় হল দেশে সমাজবাদ প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের পার্টি দেশে সমাজবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেছে।আপনারা জানেন অনেক বছর আগেই আমাদের পার্টি সমাজবাদ প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প গ্রহণ করেছিল। কিন্তু আমাদের পার্টির মধ্যে থাকা অনেক স্বার্থপর এবং প্রতিক্রিয়াশীল মানুষের ষড়যন্ত্রের ফলেই বারবার আমাদের সংকল্প ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই সমস্ত মানুষকে এখন পার্টি থেকে বহিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে। আজ আমাদের পার্টির প্রতিটি মানুষই সমাজবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যেতে দৃঢ়-সংকল্প গ্রহণ করেছে। আজ যে মানুষটি এই সভার সভাপতি আসন অলংকৃত করেছেন তাকে আপনাদের কাছে নতুন করে পরিচিত করে দেওয়ার নিশ্চয় কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রগতিশীল আদর্শ এবং সমাজবাদ প্রতিষ্ঠার আহ্বানের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে তিনি আমাদের পার্টিতে যোগদান করেছেন। আর পার্টিও তাকে আগন্তক নির্বাচনের জন্য প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করেছে। তাকে ভোট দেওয়া মানে প্রধানমন্ত্রীর প্রগতিশীল আদর্শের জন্য ভোট দেওয়া। আপনাদের প্রত্যেকের নিজের নতুন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য ভোট দিন। আমাদের পার্টির হয়ে আমি ঘোষণা করছি নির্বাচনে আমাদের জয়যুক্ত করে সরকার গঠন করার সুবিধা দিলে আমরা দেশের দরিদ্র জনতার অর্থনৈতিক মুক্তির নতুন আইন রচনা করব। আমাদের এই অঞ্চলের প্রধান সমস্যা হল মাটির সমস্যা। বেশিরভাগ চাষির নিজের বলতে মাটি নেই, সমস্ত মাটিগ্রাস করে নিয়েছে কয়েকজন মুষ্টিমেয় ধনী মহাজন। নির্বাচনের পরে ধনী মহাজনদের কাছ থেকে মাটি কেড়ে এনে সমস্ত দুঃখী ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে মাটি ভাগ করে দেওয়া হবে। প্রতিটি কৃষককেই নিজের সংসার চালাতে পারার মতো এক টুকরো মাটি দেওয়া হবে। আমি আর বেশি কিছু বলে আপনাদের বিরক্তি উৎপাদন করতে চাই না। এখন আমি আমার দলের প্রার্থী এবং আজকের সভার সভাপতি শ্রদ্ধেয় শ্রীযুক্ত সনাতন শর্মা মহাশয় কে দুই একটি কথা বলতে অনুরোধ করব।'

কথাগুলি রসেশ্বরের কেমন যেন স্বপ্ন বলে মনে হতে লাগল। একটা মাতালকে সভাপতি করে কেউ যদি সেই সভায় মদ খাবার বিরুদ্ধে তর্জন গর্জন করে বক্তৃতা দেয় তাহলে সেটাকে একটা বিরাট ঠাট্টা ছাড়া আর কি ভাবা যেতে পারে। রক্ত চুষে খাওয়া ধনী মহাজনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য যে পক্ষ রণনীতি নির্ধারণ করছে সে পক্ষের প্রধান সেনাপতি হল সনাতন শর্মা। রসেশ্বরের মনে হঠাৎ একটা নতুন চিন্তার উদয় হল। গত তিন মাস সে কেবল নিজের মামলার চিন্তা এবং পেটের চিন্তায় পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সংসারে কত কী ঘটছে তার কোনো খবরই নেই। সনাতন মহাজন ইতিমধ্যেই হয়তো নিজের সমস্ত জমি দুঃখীদের দান করে সত্যি সত্যিই সাধু মহাত্মায় পরিণত হয়েছে। রসেশ্বর প্রশ্নটা ভেবে দেখার মতো সময় পেলনা, ইতিমধ্যে সনাতন শর্মা তার বক্তৃতা আরম্ভ করে দিয়েছে। সনাতন শর্মার বক্তৃতায় নতুন কথা কিছু নেই । ইতিমধ্যে যুবকটি বক্তৃতায় যে কথাগুলো বলেছে সনাতন শর্মা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পুনরায় সেই কথাগুলিই বললেন। কিন্তু সনাতন শর্মা কথা বলতে জানে। যুবক ছেলেটি মুখস্তের মতো বলে গিয়েছিল। সনাতন শর্মা সেই কথাগুলি রস লাগিয়ে, উপমা দিয়ে গ্রামীণ মানুষের বোঝার মতো করেবললেন। শর্মার কথায় যেন মধু বর্ষিত হতে লাগল। সমস্ত শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শর্মার কথা শুনল। সর্বশেষে যুবকটি স্লোগান দিতে লাগল- 'জয় প্রধানমন্ত্রীর জয়, জয় সনাতন শৰ্মার জয়।' সভায় উপস্থিত প্রতিটি মানুষ সমস্বরে আওয়াজ দিল 'জয় সনাতন শর্মার জয়।'

বাড়ি ফিরে আসার সময় পুরো পথটাই রসেশ্বরের নিজেকে নেশা গ্রস্ত মানুষের মতো মনে হতে লাগল। ব্যাঙেরপিঠে সত্যি সত্যি এবার লোম গজাবে নাকি? এত গুলি লোকের সামনে দাঁড়িয়েকোনো মানুষ এভাবে ক্রমাগত মিথ্যা কথা বলে যেতে পারে কি? কী ঠিক, দেশে সত্যিই হয়তো এবার নতুন আইন তৈরি হয়েছে। ঈশ্বরহয়তো অবশেষে তার মতো চিরদুর্ভাগা দুঃখী মানুষের দিকে সত্যিই মুখ তুলে চেয়েছেন। সেই পুরোনো দিনে সাদা সাহেবের বিরুদ্ধে ভলান্টিয়ারদের আন্দোলন করার সময় গ্রামের বুড়ো মানুষেরা ও বলেছিল এই কাজকর্মহীন অলস ভলেন্টিয়ারদের মুখের কথায় মহারানীর রাজপাটের অবসানঘটাতে পারবে বলে ভেবেছে নাকি? গাছে গরু চড়া, অবহেলায় কানফুটো করা কথায় আমাদের বিশ্বাস নেই। শেষপর্যন্ত ভলান্টিয়াররা সত্যি সত্যি মহারানী কে তাড়িয়ে নিজেই দেশের হর্তাকর্তা বিধাতা হল।

সেদিন রাত পর্যন্ত রসেশ্বর অনাহারে বিছানায় পড়ে রইল।কিন্তু ক্ষুধার জ্বালা অন্যদিনের মতো তাকে বেশি যন্ত্রণা দিতে পারল না। আধো ঘুম আধো জাগরণে সে একটা মধুর স্বপ্ন দেখতে লাগল। দেখতে দেবীর মতো একটি মহিলা এসে তার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। কল্পনার মহারানীর চেয়ে বেশী সুন্দর এবং বেশ ক্ষমতাশালী। রসেশ্বর ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়ানোয় মহিলাটি সুন্দর হাসি হেসে রসেশ্বরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল- 'এই কাগজটি নাও। তোমার মাটি আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিলাম। এর পরে কেউ কোনোদিন মিথ্যা মামলা করে তোমার মাটি কেড়ে নিতে পারবে না। আমি গরিবদের সবসময় রক্ষা করব এবং যে সমস্ত মানুষ গরিবদের সঙ্গে শত্রুতা করে তাদেরকে কালাপানিতে পাঠিয়ে দেব।'

পরের দিন সকালবেলা রসেশ্বর কাজের সন্ধানে বাড়ির বাইরে বের হয়ে প্রথমে পা রেখেছে মাত্র তখনই দুইজন যুবক এসে তার বাড়ির ভেতর ঢুকল। এই ধরনের ভালো ভদ্র মানুষ এর আগে কোনোদিন তার বাড়িতে আসেনি। অভিভূত হয়ে সে জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল। যুবকদের একজন কাছে এসে বলল -'কোথাও বের হচ্ছেন বোধহয়?একটু সময় বিরক্ত করব। কিছু মনে করবেন না। শুনতে পারছেন ইলেকশন এসে গেছে। আপনার ভোটটা কাকে দেবেন বলে ভাবছেন?'

রসেশ্বর নম্র ভাবে উত্তর দিল, 'ভোট যে কী জিনিস তাই জানিনা বাবারা ।আমাদের কাছে ভোট চাওয়ার জন্য এখন পর্যন্ত কেউ আসেনি।কেবল গতকাল হাটের মধ্যে মিটিং-এ শুনে এলাম সনাতন শর্মা নাকি আমাদের এখানে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছে। সেই মিটিং-এ আর ও একটি আশ্চর্যের কথা শুনলাম। সনাতনকে ভোট দিলে নাকি এবার সরকার জমিদার এবং ধনী চাষিদের কাছ থেকে মাটি কেড়ে এনে দেশের সমস্ত গরিব দুঃখীদের মধ্যে ভাগ করে দেবে, নিজে চাষ না করা কোনো মানুষ এই জমি রাখতে পারবেনা। কথাটা সত্যি কি?'

রসেশ্বরের কথা শুনে যুবক দুটি একসঙ্গে অট্টহাস‍্য করে উঠল। অনেক কষ্ট করে হাসি সামলে একজন রসেশ্বরকে জিজ্ঞেস করল 'আপনাকে ঘুরিয়ে একটা প্রশ্ন করছি সনাতন মহাজনের কত মাটি আছে আপনি জানেন ?'

' জানি।একশো পুরার মতো হবে। রসেশ্বর অনিশ্চিতভাবে জবাব দিল।'

'আপনি ভালো করে জানেন না। আমরা জানি। তার মোট মাটি ছয়শো বিঘা অর্থাৎ ১৪০ পুরা। ৫৬ সনেরসিলিং আইন মতে তার বেশির ভাগটাই সরকারের ঘরে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু গেল না। বিধানসভায় সিলিং আইন পাশ করা একজন এম এল এ এবং সিলিং আইন কার্যকরী করার জন্য নিযুক্ত হওয়া একজন অফিসার তাকে বুদ্ধি দিয়েছে। সেই বুদ্ধি মতে সনাতন শর্মা আজ জন্মানো শিশু থেকে শুরু করে এক যুগ আগে মরে যাওয়া প্রথম পক্ষের পত্নীর নামে-বেনামে পাট্টা করে সিলিং আইনকে ফাঁকি দিয়েছে। এত কিছুর পরেও কি সনাতনের মাটির ক্ষুধা মরেছে? কেন আজ থেকে তিন মাস আগে দলিল জাল করে তিনি আপনার জমিটা ও গ্রাস করে নি কি? এখন ও মামলা চলছে না কি ?রসেশ্বর খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল- 'আমার বিষয়ে এতগুলি কথা আপনারা কীভাবে জানলেন? যুবকটি রহস্য ভেদ না করে বলল- 'আপনার ভোট প্রার্থনা করার জন্য এসেছি, আপনার বিষয়ে কিছুই না জেনে সম্পূর্ণ অপরিচিত ভাবে এলে আপনি কি খুশি হতেন? কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।সনাতন দলিল জাল করে আপনার মাটি আত্মসাৎ করার কথা সত্যি নয়?

কেন নয়? জীবনে প্রথমবারের জন্য তার কথা সহানুভূতির সঙ্গে শোনার মতো মানুষের খোঁজ পেয়ে রসেশ্বরের কান্না উথলে উঠল- সনাতন আমাকে একদিনে পথের ভিখারী করেছে। মামলা শুরুর দিন থেকে আমার দুঃখের কথা আর কত বলব? কান্নায় রসেশ্বরের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গেল। -'জানি, জানি।আমরা সমস্ত কথা জানি।যুবকটি বলে উঠল। মামলায় আপনি মন্ডল হাকিমদের ঘুষ দিতে দিতে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। আপনার নিজের বংশের মানুষও সনাতনের টাকা নিয়ে আপনার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে। আজকে সনাতনরা বলছে, দুঃখীর উপকারের জন্য নাকি নতুন আইন তৈরি করবে। আরে কেবল কাগজের আইন তৈরি করলেই হবে? তোদের আইন থেকে দুঃখীরা কী সুবিচার পেয়েছে এটাই তার নমুনা। এই একই অফিসাররা তোদের নতুন আইন কার্যকরী করবে।এই সমস্ত আইনের কথা একটা বিরাট ধাপ্পাবাজি। ছোট ছোট পুঁঠি খলসে ধরা পড়ে মারা পড়ে। বড় মাছ গুলি জাল কেটে পালিয়ে যায়। আচ্ছা আরেকটি কথা বলুন তো, সনাতন যে বলেছে এম এল এহতে পারলেই নতুন আইন তৈরি করে ধনী মহাজনদের মাটি কেড়ে নিয়ে গরিব-দুঃখীদের বিতরণ করবে, সে নিজেও কি একজন ধনী মহাজন' নন?'

'কেন নয়? রসেশ্বর সায় দিল।আমাদের এই মৌজায় তার মতো ধনী মহাজন' আর কে আছে? তাহলে তিনি নিজেই নিজের গলায় আইনের ফাঁস লাগাবে?'

রসেশ্বর এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারল না। যুবকটি রসেশ্বরের উত্তরের অপেক্ষা না করে পুনরায় বলতে লাগলঃ ধরে নিলাম সনাতন এম এল এ হওয়ার লোভে নিজের মাটিটুকু ছেড়ে দিল।কিন্তু তার পরে তিনি নিজে কী করে খাবেন? রসেশ্বর এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারল না। রসেশ্বরকে নিরুত্তর দেখে যুবকটি উল্লসিত হয়ে বলল- 'এর চেয়েজীবন্ত ফাঁকি আপনি কল্পনা করতে পারেন? যে মানুষটি এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় রক্তপিপাসুশোষক, যে মানুষ মাত্র তিন মাস আগে আপনার মতো একজন সহজ সরল চাষিকে নির্মমভাবে প্রতারণা করে আপনার জীবন ধারণের একমাত্র অবলম্বন জমি গ্রাস করেছে সেই মানুষটাই হল কিনা আজ দরিদ্রের বন্ধু।

আর প্রগতিবাদী দরিদ্রের বন্ধু বলে নিজেকে পরিচয় দেওয়া এই দলটি এই মানুষটাকে নিজের দলের সদস্য করে নেবার আগে এক বারও জানার চেষ্টা করেছে কি তার অতীত কার্যকলাপ কী? টাকা দিয়ে একটা কাগজে সই করলেই সাপ মুহূর্তের মধ্যে ব‍্যাঙ হয়ে যায়? আপনি কি সত্যি বিশ্বাস করেন যে এই মানুষটা আপনার ভোট পেয়ে এম এল এ হতে পারলেই পরের দিন আপনার জমিটা আপনাকে ফিরিয়ে ফিরিয়ে দেবে? এতদিন দিনে ডাকাতি করে যতগুলি মানুষ থেকে তিনি মাটি আত্মসাৎ করেছেন সেই সমস্ত মানুষকে জমি ফিরিয়ে দেবেন? যদি ফিরিয়ে দেয় তাহলে এটা বুঝতে হবে যে মাটির ব্যবসা করে তার যত লাভ হয়েছে এম এল এ হতে পারলে তার চেয়ে হাজার গুন বেশি লাভ হবে বলে তিনি আশা করছেন। অর্থাৎ গ্রামের মাটির ব্যবসা করা মহাজন' হয়ে যদি তিনি ১০০ জন মানুষকে ঠকাতে পেরে থাকেন, রাজধানীতে এম এল এ হয়ে তিনি হাজার মানুষকে ঠকানোর জন্য ফন্দি আঁটবেন। আপনি এরকম একটি মানুষকে যদি এম এল এ করবেন বলে ঠিক করে থাকেন তাহলে অবশ্য আমার বলার কিছু নেই। আপনি নিজেই ভেবে দেখুন।'

অচিন দেশে পথ চিনতে না পারা মানুষের মতো রসেশ্বর প্রশ্ন করলেন -' তাহলে আপনারাই বলুন আমাকে কী করতে হবে?' রসেশ্বরের প্রশ্ন শুনে যুবকটি উৎফুল্ল হয়ে বলল-' আমরা বলব আমাদের প্রার্থীকে ভোট দিন। কৃষক সভা নামে আমরা একটা নতুন দল খুলেছি। আমরা সরকার গঠন করতে পারলে পুরোনো আইনের বই গুলোতে আগুন ধরিয়ে দেব। আমাদের দলে একজনও ধনী মানুষ নেই। আপনার মতো দেশের লক্ষ লক্ষ সর্বহারা কৃষকরাই আমাদের দলের সদস্য।তাই আমাদের কাজে বাধা বিঘ্ন সৃষ্টি করার জন্য বা গোপনে ষড়যন্ত্র করে আমাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করার জন্য কোনো ঘর শত্রু বিভীষণ নেই। আপনি যদি সত্যিই ধনী মহাজনের নির্মম শোষণ থেকে মুক্তি পেতে আগ্ৰহী তাহলে আমাদের দলের প্রার্থী প্রাণেশ্বর হাজারিকাকে ভোট দিন।আমাদের ভোটের চিহ্ন হল কুঠার, মনে রাখবেন। দরিদ্র জনতার সমস্ত শত্রুকে আমরাকুঠারের আঘাতে শেষ করব। আমরা কেবল বুঝি কাজ। কথায় আমাদের মোটেই আস্থা নেই।এই কাগজটা ধরুন-' রসেশ্বরের হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে যুবক দুজন নিজের পথে চলে গেল।

রসেশ্বর এক জায়গায় অনেক সময় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার মাথার ভেতরে যুবক দুজনের কথাগুলি প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। তাদের একটা কথাও তো মিথ্যা বলা যায় না। বাঘ মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়ে ঘাস খাওয়াটাও যদি একদিন সম্ভব হতে পারে তথাপি সনাতনের মতো মানুষ নিজের জমি দুঃখীদের মুখের কথায় ছেড়ে দেওয়াটা কখন ও সম্ভব নয়। রসেশ্বর এবার ভোট দিতে যদি যায় তাহলে তার প্রাণের কথা বলা এই প্রাণেশ্বর চুতিয়া নামে মানুষটাকেই ভোট দেবে।

যুবকদের কথাগুলি মনের ভেতর আলোচনা করতে করতে রসেশ্বর এক পা দুপা করে পথের দিকে এগিয়ে গেল।


ক্রমশ