শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

হলদে পাখি বাও ধান খায়,পর্ব --১৪

(১৪)

প্রায় সারারাত উজাগরে থেকে শেষ রাতের দিকে রসেশ্বরের ঘুম এল। জেগে উঠে চোখ মেলে সে দেখল ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো শোবার ঘরে প্রবেশ করে বিছানাও উঠোনের মতো আলোকিত করে তুলেছে। বিছানায় আর কেউ নেই, সে একা শুয়ে আছে। সে আজ এত দেরি করে কেন বিছানায় পড়ে আছে সে কথাটা রসেশ্বর প্রথমে বুঝতে পারল না। খুব ধীরে ধীরে তার চেতনা সজাগ হয়ে এল, আর পার হয়ে যাওয়া সমস্ত কথাগুলি এক এক করে তার মনে পড়তে লাগল। ঠিক তখনই তার কানে এল সামনের দিকের বারান্দায় বসে সোনা চিৎকার করে করে বই পড়ছে। সে কিছু একটা কবিতা মুখস্ত করছে। কিছুক্ষণ সোনার পদ্য পড়া শুনে শুনে এত ভালো লাগল যে পুনরায় একবার মধুর ঘুমে ঢলে পড়তে তার ইচ্ছে হল। কিন্তু হঠাৎ হোঁচট খেয়ে ব্যথা পাওয়ার মতো মনটা পুনরায় তীব্রভাবে জেগে উঠল। তার মনে পড়ল যে আজ থেকে সোনা আর কোনোদিন এভাবে পদ্য পড়তে পাবে না। কথাটা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রসেশ্বর এরকম একটি অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করল যেন হৃদয়ের মধ্য দিয়ে একটি বিষাক্ত শেল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। একটা বিকট চিৎকার করে সোনার পদ্য পড়া কণ্ঠস্বরটা বন্ধ করে দিতে রসেশ্বরের ইচ্ছা হল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেসব কিছুই না করে খুব কষ্ট করে বিছানায় উঠে বসল। নিজের শরীরটাকে অন্যের মৃতদেহ টেনে নিয়ে যাবার মতো করে বাইরে বেরিয়ে গেল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রসেশ্বর দেখল সামনে দিয়ে স্ত্রী ঘরের ভেতরে ঢুকছে। তার পরনে কিন্তু প্রতিদিন বাড়িতে পরা ছেঁড়া নোংরা কাপড় নয়, মানুষের বাড়িতে বেড়াতে গেলে যে ধরনের পরিষ্কার কাপড় পরে সেই ধরনের পরিষ্কার কাপড়। রসেশ্বর অবাক হল। এই সকাল বেলাতেই মানুষটা কোথায় গিয়েছিল? কথাটা ভাবতে ভাবতেই স্ত্রী বারান্দায় উঠে এল। স্বামীর দিকে সে একবারও মুখ তুলে তাকায় নি। তার ভাবভঙ্গি দেখে রসেশ্বরের মুখের প্রশ্ন মুখেই থেকে গেল । সোনা কিন্তু পড়া থেকে মুখ তুলে মাকে জিজ্ঞেস করল-‘তুমি কোথায় গিয়েছিলে মা?’ রসেশ্বরের স্ত্রী এক মুহূর্তের জন্য ছেলের মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার পরে মুখে কিছু না বলে হঠাৎ ভেতরে ঢুকে গেল। রসেশ্বর যা বোঝার বুঝে নিল। বজ্রাহত মানুষের মতো সে কিছুক্ষণ এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বুক ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাওয়া একটা দীর্ঘশ্বাস সে কোনোমতে মুখ চেপে সম্বরণ করল। তারপর দুর্বল পদক্ষেপে সে এক পা দু পা করে ভেতরে ঢুকে গেল। শোবার ঘরে ঢুকে সে দেখল স্ত্রী বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে একটা বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছে, স্ত্রীর সমস্ত শরীরটা ভূমিকম্পে কাঁপার মতো কেঁপে কেঁপে উঠছে। ‘আমার স্কুলে যাবার সময় হয়েছে মা, রাতের কর্করা ভাত কিছুটা রেখেছিলি? কথাটা বলতে বলতে সোনা ভেতরে চলে এল। মা-বাবাকে এরকম অদ্ভুত অবস্থায় দেখে সে হতভম্ব হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকাল। বাবা তার মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে অর্থহীনভাবে একবার বেড়ার দিকে তাকাল,তারপর মুখ ধোয়ার জন্য পেছনের কুয়োর উদ্দেশ্যে চলে গেল। মাকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করে করে কোনো উত্তর না পেয়ে সোনা শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এল এবং মুখের ভেতরে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে সে স্কুলে যাবার জন্য প্রস্তুত হল। রান্নাঘরে গিয়ে হাড়ি খুলে দেখে একমুঠো ঠান্ডা ভাত থাকা তো দূরের কথা, হাড়ির কোনায় পর্যন্ত সে একটা ভাতের চিহ্ন ও দেখতে পেল না। নিরাশা এবং মনের দুঃখে তার চোখ দুটি জলে ভরে উঠল। কিন্তু এই ধরনের অভিজ্ঞতায় সে এতটাই বেশি অভ্যস্ত যে ভাত কেন নেই সেই প্রশ্ন মাকে জিজ্ঞেস করার সে কোনো প্রয়োজন অনুভব করল না। বইপত্র হাতে নিয়ে এসে পুনরায় মায়ের কাছে এসে দাঁড়াল। এবং বলল ফিরে এসে যেন ভাত খেতে পারি। সোনা শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে বারান্দায় পৌঁছে গেল। মা বুঝতে পারল যে এখনই তাকে বাধা দেবার সময়। কিন্তু হৃদয় ছিড়ে গিয়ে মায়ের মুখটা বন্ধ করে দেবার মতো এরকম একটি অবস্থা হল যে মা কোনোভাবেই তার মুখ থেকে কথাটা বের করতে পারল না। মা বিছানা থেকেই বুঝতে পারল যে সোনা উঠোনে পা রেখেছে। মুখ থেকে বাধাটা সরানোর জন্য চেষ্টা করে তার সমস্ত শরীর ধড়ফড় করে উঠে। মুখ ধোয়া শেষ হয়েছে যদিও সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তটির মুখোমুখি হতে হবে বলে রসেশ্বর সাহস না পেয়ে তখনও কুয়োর পারে বসে আছে। ছেলে আরও কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ডালিম গাছটা পার হয়ে গেল। আর কয়েক মুহূর্ত পরে সে বাড়ির প্রবেশমুখে চলে যাবে তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে। এদিকে মুখের বাধাটা সে মুখ থেকে সরাতে পারেনি কিন্তু সরাতে তো হবেই। এমনকি তা করতে গিয়ে তার সমস্ত শরীর যদি ফেটে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তাও তাঁকে মুখ খুলতে হবে। ছেলেকে কথাটা বলতেই হবে। সে বোধহয় ইতিমধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। পেটে একটিও দানা না পড়লে ও স্কুলে যাবার সময় সে মনের আনন্দে গরুর বাচ্চার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে যায়। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সে লম্বোদরদের বাড়ির সামনেটা পার হয়ে যাবে।…রসেশ্বরের স্ত্রী শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে চিৎকার করে উঠল-‘সোনা, সোনা।’ সোনা লম্বোদরদের বাড়ির সামনেটা অতিক্রম করে যাচ্ছিল। হঠাৎ মায়ের চিৎকারে সে চট করে দাঁড়িয়ে পড়ল,পরের মুহূর্তেই সে দিক পরিবর্তন করে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। তার মনে হল যে মায়ের নিশ্চয় কোনো বিপদ ঘটেছে। একই সময়ে কুয়োর পার থেকে দৌড়ে রসেশ্বর দৌড়ে এল।বাপ-ছেলে প্রায় একই সঙ্গে সোনার মায়ের কাছে হাজির হল। সোনা হাতের বইপত্র গুলি মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মায়ের শরীরের উপরে উপুড় হয়ে পড়ল এবং আর্তস্বরে প্রশ্ন করল-‘তোমার কী হয়েছে মা? কেন এভাবে চিৎকার করছ?’

সোনার মা ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। তারপর একটা সময়ে কান্না বন্ধ করে মা বলল –‘সোনা তোকে স্কুলে যেতে হবে না।’

মায়ের বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে রেখেই সোনা প্রশ্ন করল-‘ কেন মা? তোমার কি কোনো অসুখ করেছে?

মায়ের চোখে নতুন করে কান্নার ঢল নামল। কাঁদতে কাঁদতে মা বলল-‘কেবল আজকেই নয় বাছা, আর কোনো দিনই তোকে স্কুলে যেতে হবে না। আমাদের মত গরিব ঘরের ছেলে মেয়েদের….'

মা বাক্যটা শেষ করতে পারল না। সোনা মায়ের বুক থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে বিছানায় বসে উত্তেজিত স্বরে প্রশ্ন করল-‘ কেন আমি স্কুলে যাব না? তুমি বললেই হবে নাকি? না খেয়ে মরলেও আমি স্কুলে যাবই যাব। ও এখন আমি বুঝতে পারছি এই কথাটা বলার জন্যই তুমি আমাকে রাস্তা থেকে চিৎকার করে ফিরিয়ে এনেছ। আমি স্কুলে যাই, ঘন্টা পড়ার সময় হয়ে গেছে। তুমি পেছন থেকে আর ডাকাডাকি করবে না।’

সোনা মাটিতে পড়ে থাকা বইপত্র গুলি তুলতে আরম্ভ করে দিল। রসেশ্বরের স্ত্রী স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল-‘ তুমি এখন চুপ করে দাড়িয়ে আছ কেন? ছেলেকে কেন আসল কথাটা বলছ না?’

রসেশ্বর অপরাধী মানুষের মতো মাথা নিচু করে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

সোনা মা-বাবার কথাবার্তায় গুরুত্ব না দিয়ে পুনরায় স্কুলে যাবার জন্য বেরিয়ে উঠোনে পৌঁছে গেল। মা তখনই বিকৃত কন্ঠে বলল-‘ সোনা তোকে আর কতবার বলতে হবে যে আজ থেকে তোর আর স্কুলে যাওয়া হবে না। শোন বাবা আমাদের সর্বনাশ হয়েছে। মা-বাবার বেঁচে থেকেও মৃত্যুর মতো অবস্থা হয়েছে। কোন উপায়ই বের করতে পারলাম না। এখন তোর মতো ছোট ছেলেকেই আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করতে হবে। মায়ের কণ্ঠস্বরে এরকম একটি কাতরতা ফুটে উঠল যে সোনা বুঝতে পারল ওদের বাড়িতে নিশ্চয় কোনো এক ভয়ঙ্কর বিপদ ঘটেছে। সে একপা দুপা করে মায়ের কাছে ফিরে এসে শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল-‘ স্কুলে যেন গেলাম না মা কিন্তু আমাকে কী করতে হবে সে কথা বলছ না কেন?’

তোকে সর্বেশ্বর গ্রামপ্রধানের ঘরে চাকর খাটতে হবে।সোনার মায়ের কন্ঠসুরে অস্বাভাবিক দৃঢ়তা ফিরে এল। ‘আজ সকালবেলা গিয়ে আমি সমস্ত বন্দোবস্ত করে এসেছি। তোর বাবা আজ দুপুর বেলা তোকে সর্বেশ্বর গ্রামপ্রধানের বাড়িতে রেখে আসবে।’ কথাটা বলেই সোনার মা মাথা পর্যন্ত কাপড় টেনে দিয়ে শুয়ে পড়ল। সোনা কিছুক্ষণ বজ্রাহত মানুষের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণের জন্য তার ঠোঁট দুটি একবার থর থর করে কেঁপে উঠল। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল। রসেশ্বর শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। সোনা রান্নাঘর থেকে একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠি খুঁজে আনল। সোনা উঠোনে বসে তার বইপত্র গুলিতে আগুন লাগিয়ে দিল। রসেশ্বর বারান্দায় পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে সমস্ত দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে রইল। বই খাতা পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার পরে সোনা উঠোন থেকে এসে বাবার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমাকে কখন রেখে আসবে বাবা?’