শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

সুনীলের হারিয়ে যাওয়া সেই সাক্ষাৎকার

আজ ৭ সেপ্টেম্বর কবি ও কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মজয়ন্তীতে অন্যদেশ পরিবারের বিনম্র শ্রদ্ধা।



সামনাসামনি দেখা হবে! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে! আনিসুল হক বললেন, ‘হ্যাঁ। কথাও হবে।’ মানে সাক্ষাৎকারও। বিশ্ববিদ্যালয়ে সবে পা রাখা বাংলাদেশের তরুণ কবিটির জন্য তা ছিল সাংঘাতিক এক বুক ধড়ফড় করে ওঠা ব্যাপার। আশির দশকের শেষের কোনো এক শীতে সুনীল সেবার বাংলাদেশে এসেছিলেন।
আনিসুল হক তখন সাপ্তাহিক ‘খবরের কাগজ’-এ কাজ করেন; আমিও তখন সাপ্তাহিক পত্রিকাটির মাঝেমধ্যে লেখক-সাংবাদিক। সুনীল উঠেছিলেন ধানমন্ডির একটি অতিথিশালায়। তাঁর সঙ্গে দেখা করার তীব্র ব্যক্তিগত আগ্রহের হাওয়া উসকে দিয়েছিল ওই পত্রিকার জন্য সাক্ষাৎকার নেওয়ার বিষয়টি।
শীত-সকালের নরম রোদের আলো-আঁধার মাখা একটি ঘরে সুনীল তখন মাত্রই প্রাতরাশ সেরেছেন। তাঁর ঘরে ঢোকার পর বিছানায় ধবধবে সাদা লেপে শরীরের আধখানা ঢেকে বসতে বললেন আমাদের। বরাবরই মৃদু ও প্রিয়ভাষী আনিসুল হক; তাঁকে ছাপিয়ে আমার অনর্গল প্রশ্নে সুনীল সম্ভবত একটু হকচকিয়েই গিয়েছিলেন।
প্রশ্নগুলোর অধিকাংশই আজ বিস্মৃত। সম্ভবত, এর বেশির ভাগই ছিল বাংলাদেশের কবিতা আর পশ্চিমবঙ্গের কবিতার তুলনামূলক আলোচনা, যেখান থেকে সুনীলের নিজস্ব একটা মতামত বা বক্তব্য মিলবে। এ দেশের কবিতার প্রশংসা সুনীল বরাবরই করেছেন। সেদিন স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, বাংলা কবিতার রাজধানীটির অবস্থান এ দেশেই। কথাবার্তার শুরুতে আনিসুল হক বিনয় দেখিয়ে বলেছিলেন, তিনি তাঁর লেখা খুব বেশি পড়েননি। এরপর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা কবিতার বইগুলোর নাম টানা বলতে শুরু করলে তিনি একগাল হেসে বলেছিলেন, ‘ব্যস, ব্যস, ওতেই হবে।’ আমি কথা বলছিলাম তাঁর গদ্যের বইগুলো নিয়ে। ‘একা এবং কয়েকজন’, ‘সুদূর ঝর্ণার জলে’, ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ থেকে তখন গড়গড় করে আউড়ে যেতে পারতাম কবিতার পঙক্তির মতো গদ্যের প্যারাগ্রাফ। সুনীল সম্ভবত এই অর্বাচীনের আবেগ আর হতবুদ্ধি সাক্ষাত্কার-গ্রহীতাদের সামলাতেই ঢাকার খবর, বাংলাদেশের সংবাদপত্রের বর্তমান নিয়ে কথার মোড় ঘুরিয়েছিলেন। তাঁর কথার সুরেও একসময় আবেগ ভর করছিল, যখন বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর নাড়ির টানের প্রসঙ্গটি আবার ফিরে এসেছিল। ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাসে সুনীল সেই দেশভাগ, মাটির টান আর নাড়ি ছেঁড়ার যন্ত্রণা অবিকল তুলে এনেছেন।
সাক্ষাত্কারের একপর্যায়ে প্রশ্ন আর কথাবার্তার তোড় কমলে আনিসুল হক ও আমি—দুজনই সম্ভবত একসঙ্গে—বলে উঠেছিলাম মার্গারিটার কথা। সুনীলের লেখা ‘সুদূর ঝর্ণার জলে’র মার্গারিটা, সুনীলের মার্গারিটা। সে সময় আমাদের দুজনের হূত্কমলের অধিষ্ঠাত্রী ছিল মার্গারিটা। ‘...শুধু কবিতার জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি’ একসময় যে কবি লিখেছিলেন, সব্যসাচী এ লেখক গদ্যে-পদ্যে মার্গারিটার মতো এমন মানসপ্রতিমায় আরও অসংখ্যবার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। কবিতার নীরা, নিখিলেশ থেকে শুরু করে একা এবং কয়েকজনের সূর্য, ট্রাভেলগ আর স্মৃতিকথনে মার্গারিটার স্মৃতিতর্পণে তখন আমরা তিনজনই একসময় কবি, কবির প্রেম ও সাহিত্যের বাগানের দরজা ডিঙিয়ে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ভেসে গিয়েছিলাম। মনে আছে, এর পরও সুনীলের বাংলাদেশে আসার অনুভূতি, বাংলাদেশের প্রতি তাঁর নাড়ির টান ছাপিয়ে আমাদের তিনজনের থমথমে বুকে স্পন্দিত হচ্ছিল মার্গারিটা...আহা, মার্গারিটা!
সুনীলের সাক্ষাৎকারটি খবরের কাগজে মুদ্রিত হয়েছিল। সম্পাদনার পর আকারে নাতিদীর্ঘ হয়ে মুদ্রিত সাক্ষাৎকারটি আজ কোথায় হারিয়ে গেছে! অবশেষে আজ সেই সব্যসাচী লেখক, সাক্ষাৎকারের সেই মানুষটিও হারিয়ে গেলেন।
বহু ক্লেশ সয়ে জীবনের অধিক বহুবর্ণিল, বহুমাত্রিক এক জীবন চিত্রিত করে বাংলা সাহিত্যকে পাঠকের হূৎপিণ্ডের খুব কাছে এনে দিয়েছিলেন সুনীল। সেখানে তাঁর অনায়াস বর্ণনা, লেখার উজ্জ্বলতায় এক ঝরনা বয়ে চলেছে। আজ তাঁর প্রস্থানের শোকে মনে পড়ছে সেই হারিয়ে যাওয়া সাক্ষাৎকারের কথা। দুই তরুণের মুখোমুখি হয়ে দেওয়া সে সাক্ষাৎকারের অসংখ্য প্রশ্নের উত্তরে কখনো তাঁর মুখে ছিল প্রশ্রয়মাখা হাসি, কখনো যুক্তি দিয়ে বোঝানো এক অগ্রজপ্রতিমেষু লেখকের অভিজ্ঞতাজাত জ্ঞান; একসময় বেদনায় খানিক মুখ লুকিয়ে দেশভাগের যন্ত্রণাও প্রকাশ করেছিলেন সুনীল। গভীর মন্দ্রকণ্ঠে একসময় বলে উঠেছিলেন, হাহাকার না থাকলে লেখক হওয়া যায় না। আজ লেখক সুনীলের জন্য আমরা হাহাকার করছি; হাহাকার করছে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ। তাঁর বুকের ভেতর থেকে উচ্চারিত সেদিনের সেই শব্দগুলো কবে দেশ-কালের সীমানা ছাড়িয়েছে! পরম সেই শব্দের খোঁজেই বোধহয় এবার সুনীলও পাড়ি জমালেন।