শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

মহাসত্যের বিপরীতে - ২৮

এ অমোঘ অলীক নির্দেশ, পায়ের নিচুতে কী বিপুল ত্বরণ

ক্ষীণ সুতোর মতো আদি ও মলিন দিগন্ত ছিঁড়ে ডানা ঝাপটাতো/ শাদা, সাবলীল দিন/

-সৈয়দ হাসমত জালাল(আঁধার গোলক)

# আঠাশ

দল ভাগ করে খ্যাং তিসে যাওয়ার আগে গরব অন্য ডাকাতদের সংযত থাকার নির্দেশ দিয়ে বলছিল,

আমি যতদিন না ফিরব ততদিন তোমরা পরিবার পরিজনদের সঙ্গ দিও, শান্তিপূর্ণভাবে পশুপালকের জীবন কাটিও, নিজেরা ভালো থেকো, পশুগুলিকে ভালো রেখো। কোনওরকম অভিযানে যেও না, আমরা যে বিরাট লুঠ করেছি তা মানুষকে ভুলে যেতে দাও। এক মুসলমান মোংগল সেনাপতি আমাদের খোঁজে গোয়েন্দা লাগিয়েছে, সামান্য ছুতো পেলেই সে আমাদের গ্রামগুলিতে সেনা - আক্রমণ চালিয়ে সমস্ত মজুত রসদ এবং লুঠের মাল ছিনিয়ে নিয়ে যাবে, পরিবার পরিজনদেরও সর্বনাশ করে ছাড়বে। অন্যদেরও একথা বলে দিও। নিজেদের দুর্ভাগ্য ডেকে না আনতে চাইলে কয়েক মাস সংযত থাকতে হবে! লাহসা ছাড়ার আগে সঙ্গীদেরকে এই কথাই বলেছিল গরব। তারপর সে তার প্রেমিকা দেচমা আর দুই সঙ্গী ৎসোণ্ডু আর গোরিংকে নিয়ে পবিত্র সরোবর ৎসো মাকাম , ৎসোণ্ডু লাংগাক আর পবিত্র পর্বত খ্যাং তিসের পথে চলে যায়। লাহসা থেকে দক্ষিণমুখী রওনা হয়ে ওরা সাংপো বা ব্রহ্মপুত্রের পাড় ধরে দুর্গম পথে সীগাৎসে, ত্রাদুম, গীয়াবুনাক, সামসা হয়ে কতদিনে সাংপোর উৎস ৎসো মাকাম বা মানস সরোবরের তীরে পৌছবে কে জানে! তবে তার একদিন পর পৌছবে খ্যাং তিসে বা কৈলাস পর্বত এটা নিশ্চিত। সঙ্গীরা উত্তর - পশ্চিম পথে দীর্ঘযাত্রার পর হলুদ নদীর উৎসের কাছে নিজেদের গ্রামে ফিরে গিয়ে সেই গ্রামের বাসিন্দা ডাকাতদলের অন্যদের কাছে এই উপদেশ ও দলাই লামার আশীর্বাদ পৌছে দেয়।

ডাকাতরা সবাই দলপতির প্রজ্ঞার প্রশংসা করে আর তার কথামতন দীর্ঘদিন চুপচাপ পশুপালন আর ঘর গৃহস্থালি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু গ্রামে পৌঁছনোর কিছুদিন পরই ওরা সেই নিদারুণ খবর পায় মহামান্য রিম–পো-চে ত্রয়োদশ দলাই লামার মহাপ্রয়াণের খবর! সবাই জানে তিনি অমর, তিনি স্বয়ং বোধিসত্ত্ব, তাই তিনি প্রজাপালনের জন্য বারবার জন্ম নেন। তিনিই তিব্বতের প্রধান পুরোহিত এবং শাসক। তিনি গোটা তিব্বতের মালিক। প্রতিবার দেহত্যাগের পর তাঁর আত্মা যে কোনও একটি পবিত্র বংশে জন্মগ্রহণ করেন। এবার তিনি কোথায় জন্মগ্রহণ করেছেন সে খবর তখনও ওদের কাছে আসেনি। কিন্তু এই খবর নিয়ে তাদের কোনও দুশ্চিন্তা নেই। তাদের দুশ্চিন্তা হয় গরব ও তার সঙ্গীদের জন্য।

মাসের পর মাস পেরিয়ে যায় কিন্তু দলপতি আর সঙ্গীরা ফিরে না আসায় ওদের দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। এই দেরির কারণ ওরা বুঝতে পারে না। ওরা কি কোনও দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে? এই দুর্গম পথে সবই সম্ভব। কেউ কি অসুস্থ হয়েছে? . . . কিংবা মৃত্যু? গরব ওদের বলেছিল, যাত্রাপথে, ব্যবসার উপযোগী নতুন এলাকার খোঁজ করবে। এমনও তো হতে পারে, তেমন কোনও এলাকার খোঁজ পেয়েছে, নতুন দল গড়ে নিয়ে আরও ধনী হয়ে উঠেছে! আর ওরা এদিকে দলপতির কথা মেনে ঠুঁটো হয়ে বসে রয়েছে। ওদের নাকের ডগা দিয়ে একের পর এক ব্যবসায়ীদের কাফেলা হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছে মহার্ঘ সব সওদা নিয়ে, আর ওরা চুড়ি পরা মেয়েদের মতন দাঁড়িয়ে দেখছে।

যত দিন যায় এই চিন্তাগুলি ক্রমে ওদের মনে প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। পরস্পরের সঙ্গে দেখা হলে কথায় কথায় এই প্রসঙ্গ চলে আসে। সাদামাটা জীবনের একঘেয়েমি, রক্তে মিশে থাকা অভিযানের নেশা আর লোভ ওদের ভেতরে ভেতরে সক্রিয় করে তোলে। দাওয়া নামে এক উচ্চাকাঙক্ষী দুঃসাহসী ডাকাত গরবের দলে থাকলেও মন থেকে ওকে পছন্দ করত না। সে ছিল ওদের প্রয়াত দলপতির অনুগত। উড়ে এসে জুড়ে বসা নবীন দলপতির সাহস ও শৌর্যের সামনে আওয়াজ ওঠানোর সাহস না থাকলেও সে মনে মনে গরবকে ঈর্ষা করতো। সে-ই প্রথম খবর আনে যে অল্প কয়েক দিনের মধ্যে দুটো কাফেলা ওই পথ দিয়ে যাবে।

সেই খবরকে সম্বল করে সে ওদের দলের সবাইকে বুঝিয়ে আবার সংগঠিত করে অভিযানের জন্য প্ররোচিত করে। সে অবশ্য কারও সামনে গরবের বিরুদ্ধে একটিও শব্দ উচ্চারণ করে না। সে জানে, দলের প্রায় সবাই গরবের অনুগত ও বাধ্য। ওর প্রতিটি নির্দেশকে ওরা দেবতার আদেশের মতনই অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। দাওয়া শুধু গরবের অনুপস্থিতিতে সুকৌশলে ওদের মনের ষড়রিপু কাম ক্রোধ লোভ মোহ মদ ও মাৎসর্য্যকে প্রবল করে তোলে। বিশেষ করে লোভকে এত মহীয়ান করে তোলে যে বাকি রিপুগুলিও লোভের কবলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে হারে রে রে করে তেড়েফুড়ে ওঠে! দাওয়ার সূত্র অনুযায়ী গা প্রদেশের উদ্দেশে রওনা হওয়া প্রথম কাফেলাটিতে রয়েছে চীনা ব্যবসায়ীরা। ওরা যুগ্ম হ্রদ ওরিং এবং নোরিং এর নিকটবর্তী গিরিপথটি ধরে যাবে। অন্যটি আমদো অঞ্চলের তিবৃতি পশুপালকদের লাহসাগামী বার্ষিক কাফেলা। তিনশোরও বেশি পশু নিয়ে ওরা লাহসায় সওদা করতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই ওরা হয়তো ৎসাইদাম ও হর নাগচুকার বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে ঢুকে পড়েছে! ওই তৃণভূমিতে পশুগুলি ঘাস খেতে খেতে ধীরে ধীরে চলবে। ওই ঘাস ওদের হৃষ্টপুষ্ট করে তুললে পশুগুলির ভালো দাম পাওয়া যাবে। সেজন্যে পশুপালকদেরও কোনও তাড়া থাকবে না।

কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে গরবের দলের ডাকাতরা দুটো কাফেলার উপরই আক্রমণ চালায়। আমদোবাসী তিব্বতি পশুপালকরা সংখ্যায় বেশি থাকায় এত সহজে হার মানে না। ওদের কারও কারও হাতে অস্ত্র ছিল। ফলস্বরূপ এই অভিযানে ডাকাতরা অল্প কয়েকটি পশু হাতিয়ে পালাতে বাধ্য হয়। আমদোবাসী কয়েকজনের নিশানা এত অব্যর্থ যে এমনও হতে পারে কেউ কেউ কোনও ডাকাতদলের সদস্য। কেননা গুলির যুদ্ধে গরবের দলের দুজন ডাকাতের মুত্য হয়। আমদোবাসী পশুপালকদের পরাক্রমে ডাকাতরা অনেক বেশি সতর্ক হয়ে পড়ে এবং পরবের শেখানো গেরিলা পদ্ধতিতে বারবার অতর্কিত আক্রমণে ব্যবসায়ী দলটিকে পর্যুদস্ত করে। ডাকাতদলের হাতে অনেক মূল্যবান চীনাংশুক ও অন্যান্য বস্ত্র এবং ধনরত্ন আসে। গা গামী ব্যবসায়ীরা ত্রাসে পালাতে গিয়ে গভীর হ্রদের জলে ঝাপিয়ে পড়ে উঠতে না পেরে মারা যায়।

এই দুটি আক্রমণের ঘটনায় চীন ও তিব্বতে সাড়া পড়ে যায়। মান্দারিন ও তিব্বতি খবরের কাগজে লেখালেখি হয়। ব্যবসায়ী ও পশুপালক সম্প্রদায় যৌথভাবে সরকার ও প্রশাসনের কাছে এই ডাকাতদের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচানোর আবেদন জানায়। বুদ্ধিজীবী এবং সাংবাদিকরাও তাদের সমর্থন জানায়।

ত্রয়োদশ দলাই লামার মহাপ্রয়াণের পর তার কোথায় পুনর্জন্ম হয়েছে তা নিয়েই তখন লাহসা সরগরম। অনেকে চীন থেকে পাঞ্চেন লামাকে ফেরাতে চাইলেও অধিকাংশই এর বিরুদ্ধে। ত্রয়োদশ দলাই লামার মৃত্যুর পর পিকিং থেকে শোকবার্তা নিয়ে চিয়াংকাই - শেকের জাতীয় সরকারের প্রতিনিধিরা লাহসায় এসেছিলেন। নবজাত দলাই লামাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব পড়ে প্রধানতঃ রাজ্যের মন্ত্রী এবং দ্ৰেপুং, সেরা ও গাদেন্ দেন, গুম্ফার প্রধান পুরোহিতদের উপর। এই তিন গুম্ফার পুরোহিতরা একত্র মিলিত হয়ে রাজ্যের সেরা গণৎকারদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। ত্রয়োদশ দলাই লামার মহাপ্রয়াণলগ্ন ও আবহাওয়া বিচার করে গণকারেরা বিরাট পূজার্চনা করে ধ্যানে বসেন। সেই ধ্যানেই তারা দৈববাণীর স্বপ্নের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ দলাই লামার জন্মস্থান জানতে পারেন। মুখ্য গণৎকার নেচং সেই গুপ্ত সংবাদটি জানিয়েছেন মন্ত্রী ও তিন গুম্ফার প্রধানদের। মন্ত্রীপরিষদের পরামর্শ অনুযায়ী গঠিত হয়েছে অনুসন্ধান সমিতি। নির্দেশ অনুযায়ী রাজ্যের সেরা লামারা রয়েছে সমিতিতে। তাঁরা নানা দলে ভাগ হয়ে গণৎকারের নির্দেশ অনুযায়ী ছড়িয়ে পড়েছেন লাহসার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত অঞ্চলগুলিতে ; বিশেষ করে আমদো অঞ্চলে।

আর ওই আমদো অঞ্চলের পশুপালকরাই ডাকাতদলের হাতে আক্রান্ত হওয়ায় প্রশাসন তৎক্ষণাৎ নড়েচড়ে বসে। চীনের মুসলমান সেনাপতি দেখলেন, এটাই সুযোগ! তিনি দীর্ঘদিন ধরেই এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। দলাই লামার সিংহাসনকে উপলক্ষ করে তার প্রতিনিধি হয়ে মন্ত্রীপরিষদই এখন রাজ্য শাসন করছে। তারাই একদল লামাকে আমদো ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে নবজাতক চতুর্দশ দলাই লামাকে খুঁজতে পাঠিয়েছে। তখনই এই ডাকাতির খবর বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতন তাদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলে এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

চীনের মুসলমান সেনাপতি সেই সুযোগকে কাজে লাগান। তার সেনারা নিয়মিত ঠিক সময়ে বেতন পায় না । কাজেই এধরনের সম্পদশালী ডাকাতদলের বিরুদ্ধে অভিযানে চীন ও তিব্বতের সরকার, প্রশাসন এবং চীনা ও তিবৃতি জনগণকে খুশি করার পাশাপাশি যে ধনসম্পদ ও পশু ইত্যাদি ওদের হাতে লাগবে তা লুঠ করতে পেরে খুশি হবে। এই ভেবে তিনি দ্রুত আক্রমণের নির্দেশ দেন। আর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সাহসী তুর্কি ও চীনা সৈন্যরা অভিযান চালিয়ে অনায়াসেই ডাকাতদলের দুর্বল প্রতিরোধ নস্যাৎ করে ওদের অধিকাংশকেই মেরে ফেলে, ওদের সর্বম্ব লুঠ করে নেয়। ওদের মেয়ে-বউদের তুলে নিয়ে যায়, এমনকি বৃদ্ধাদেরও নিস্তার দেয় না। ওদের নিয়ে গিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করা, পশুপালক ও অন্যান্য ঘরের কাজের জন্য দাসী বানিয়ে নেয়।

গরব জানতেও পারে না যে তার অনুগত ডাকাতরা হঠাৎ ষড়রিপুর প্রাবল্যে তার আদেশ অমান্য করে এভাবে নিজেদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। মানুষ যত সাহসী এবং শৌর্যবানই হোক না কেন, রিপুর উপর না নিয়ন্ত্রণ না থাকলে, দূরদৃষ্টি না থাকলে তার পতন অনিবার্য — একথা ভেবে চীনা শিবিরে বন্দি দাওয়া কপাল চাপড়ায় আর ভাবে কীভাবে গরবদের ফিরতে বারণ করা যায়! গরবরা এখন কোথায়?

বিগত প্রায় এক দশক ধরে রেশম পথের নানাস্থানে গরবের গেরিলা আক্রমণ ও সাফল্য তাকে চীন ও তিব্বতে কুখ্যাত করে তুলেছিল। এবার তার দলের অধিকাংশ ডাকাতকে মেরে ফেলার পর চীন সেনাপতি অভিযানের অধিনায়ক দাওয়াকেই সঙ্গে কয়েকজন চীনা সৈন্য দিয়ে গরবকে জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় ধরে আনার নির্দেশ দেয়। চীন - তিব্বত সীমান্তের সমস্ত গঞ্জ ও বাজারে গরবের নামে পুরস্কার ঘোষণা করে পোস্টার সাঁটা হয়। এতে বিভিন্ন সময়ে ওই ডাকাতদলের হাতে নিগৃহীত ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মানুষজন খুব খুশি হয়।

চীনা তুর্কি সেনারা ভেবেছিল ডাকাতদের বাসস্থানগুলিতে আক্রমণ হানলে গরবই বেরিয়ে এসে ডাকাতদলের নেতৃত্ব দেবে। তারা জানত যে, গরব গেরিলা যুদ্ধে পারদর্শী, চীনাভাষায় তুখোড়, অসাধারণ মেধাবী। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী গরব তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন এক ক্ষিপ্রগতির অধিনায়ক। সেজন্যে ওরা প্রয়োজনের তুলনায় দ্বিগুণ অশ্বারোহী সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছিল। কিন্তু গরব মাথার উপর না থাকায় চীনা তুর্কি বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা ডাকাতরা সামান্য লড়াইয়ের পরই পর্যুদস্ত ও নিহত হয়। এই জয়ে চীনা তুর্কি সেনানায়ক খুশি হলেও গরবকে ধরতে না পেরে অস্বস্তিতে থাকেন। তিনি ওদের গ্রামের কাছেই তাবু গেঁড়ে গরবের ফেরার অপেক্ষায় থাকেন। তার সৈন্যরা দাওয়াকে সঙ্গে নিয়ে আশপাশের সমস্ত সড়ক, গঞ্জ ও গ্রামে নিয়মিত টহলদারি চালিয়ে যেতে থাকে। দাওয়ার কাছেই ওরা শুনেছে গরব সম্ভবত ভারতীয় বংশোদ্ভূত। সে তার স্ত্রী ও দুই অনুচরকে নিয়ে খ্যাংতিসে তীর্থে গিয়েছে। যে কোনওদিন ফিরে আসবে। একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত হয়ে গরব তিব্বত ও সন্নিহিত চীনা এলাকায় যেরকম ত্রাস সঞ্চার করেছে, তাকে পেতে উদ্গ্রীব হয়ে থাকে চীনা সেনানায়ক।

এদিকে গরব ও তার সঙ্গীরা এসব কিছুই না জেনে নিশ্চিন্তে ফিরতে থাকে তাঁদের গ্রামের দিকে। গরব স্বপ্নেও ভাবেনি যে ঈর্ষাকাতর দাওয়ার প্ররোচনায় তার দলের ডাকাবুকো দস্যুরা প্রলুব্ধ হয়ে ওর নির্দেশ অমান্য করে এমন অনর্থ ঘটাতে পারে! দাওয়া নিজেও এখন কঠিন বন্দি জীবন কাটায় আর কপাল চাপড়ায়। সে এখন চীনা সৈন্যের পথপ্রদর্শক হয়েও মালবাহকের ভূমিকা পালন কেরে বাধ্য। তার চোখের সামনে চীনা সৈন্যরা তার নিজের ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের বাড়ির মেয়েদের উপর অত্যাচার করে। এমনকি সে নিজেও প্রতিরাতে পায়ুধর্ষণের শিকার। রোজ রক্ত গড়াতে গড়াতে মলদ্বারে ঘা হয়ে পচন ধরায় একদিন সে চলার ক্ষমতা হারায়। আর এভাবেই অসহ্য নরকযন্ত্রণা ভোগ করে একদিন সে মারা যায়।

লাহসা যাওয়ার পথে গরব তার অনুগামীদের নিয়ে হব নাগচুকা হ্রদের অনেক উত্তরে মরু অঞ্চল দিয়ে পিয়েছিল। মঙ্গোলিয়ান তীর্থযাত্রীদের উপর আক্রমণের পর ওই এলাকাতেই সে দেচমাকে পেয়েছে। অথবা দেচমা খুঁজে পেয়েছে তার আকৈশোর লালিত স্বপ্নের ঘোড়সওয়াকে। কিন্তু দীর্ঘ দুর্গম যাত্রা ও ঘটনাবহুল তীর্থভ্রমণের পর সে তুলনামূলক জনবসতি ঘন ৎচেরকু এলাকার পথে ফিরে আসছে। উত্তর তিব্বতের চীন সীমান্তবর্তী ৎচেরকুকে চীনারা বলে জাকয়েন্দো। ওখান থেকে গরবের বাসস্থান মাত্র দশদিন ঘোড়া চালিয়ে পৌছনো যাবে। গা প্রদেশের মুখ্য প্রশাসকের বসত নানৎচেনের পাশ দিয়ে ওই পথ।

ৎচেরকু থেকে নানৎচেনের পথে ওদের সঙ্গে এক দরিদ্র গ্রামবাসীর দেখা হয় যাকে কোনও একটি আক্রমণের সময় গরব দয়া করে ছেড়ে দিয়েছিল। সে ওই উপকার ভোলেনি। এবার উলটোদিক থেকে ওকে আসতে দেখে লোকটি চমকে উঠে বলে, পবিত্র লামারা আমাদের রক্ষা করুন, গরব না?

গরব শান্তকণ্ঠে জবাব দেয়, হ্যাঁ!

– তোমরা এ পথ দিয়ে কোথায় যাচ্ছ?

– খ্যাং তিসে তীর্থ থেকে ডেরায় ফিরছি!

– ডেরায়? তার মানে তোমরা কিছুই জানোনা দেখছি!

লোকটি তখন চারপাশে তাকিয়ে দেখে নেয় কেউ ওকে দেখছে কি না! তারপর সে তাদের ডাকাতদলের উপর্যুপরি অভিযান আর ফলস্বরূপ চীনা তুর্কি সৈন্যদের আক্রমণ ও সর্বনাশের কথা সংক্ষেপে জানিয়ে, আমদো অঞ্চলেইনতুন দলাই লামার সম্ভাব্য পুনর্জন্মের কথা জানিয়ে বলে, নানৎচেনের উপকণ্ঠেই তোমার জন্য চীনারা সৈন্য শিবির স্থাপন করে টহলদারি চালাচ্ছে। তা ছাড়া ওরা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। তোমার নামে পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে। ফলে সৈন্যরা ছাড়াও সাধারণ মানুষ জানে তোমার মাথার দাম আর তোমার সঙ্গে থাকা স্ত্রী ও দুই অনুগামীর কথা। এক্ষুনি তোমরা উল্টোপথে যাও। আর তারপর দুই বা তিন দলে ভাগ হয়ে যেখানে যাওয়ার যাও! নাহলে তোমাদের ওরা মেরে ফেলবে! আমি মরে গেলেও তােমাদের কথা কাউকে বলব না, নিশ্চিন্ত থেক!

একথা বলেই লোকটা আবার চারদিকে তাকিয়ে দেখে যে ওকে কেউ দেখছে কি না? তারপর দ্রুত ঘোড়া চালিয়ে গন্তব্যের দিকে চলে যায়। গরব ও তার সঙ্গীরা থ হয়ে যায়। এবার তারা কী করবে? কোথায় ফিরবে? কার কাছেই বা ফিরবে?

কোনও আক্রান্ত মানুষ, সামান্য দয়ার বিনিময়ে সাধারণ দরিদ্র মানুষ যে লোভ জয় করে এমনভাবে সতর্ক করতে পারে তা গরব স্বপ্নেও ভাবেনি। সে মনে মনে তথাগত বুদ্ধকে প্রণাম জানায়। ওরা পথের পাশে একটি ঝোপের আড়ালে বসে জিরিয়ে নেওয়ার অছিলায় ভবিষ্যৎ যাত্রাপথ ঠিক করার সিদ্ধান্ত নেয়। লোকটি দূরে চলে যেতেই গোরিং বলে, লোকটি ঠিকই বলেছে। আমাদের এবার আলাদা হয়ে এগুতে হবে!

তাকে ‘আলাদা’ শব্দটায় জোর দিতে শুনে গরব অবাক হয়।

ৎসোণ্ডু বলে, না, কিছুটা ফিরে গিয়ে অন্য পথে যেতে হবে!

গোরিং বলে, যেভাবেই যাও আর একসঙ্গে নয়, চারজন একসঙ্গে গেলে চীনা সৈন্যের কাছে খবর পৌছুতে দেরি হবে না। দেচমা আর আমাদের সঙ্গে থাকতে পারবে না!

ওর কথা শুনে দেচমার ভীষণ রাগ হয়। তার মনে হয় এক্ষুনি লোকটার গালে ঠাস করে একটা চড় কষায়। অভিমানে তার চোখে জল চলে আসে। সে গরবের দিকে তাকায়। তার চোয়াল শক্ত হতে দেখে।

ৎসোণ্ড বলে, কেন, ও যদি ছোটো করে চুল কেটে, গয়নাগাটি খুলে গরবকে দিয়ে একটু পুরনো পোশাক পরে নেয় তাহলেই কেউ চিনতে পারবে না! মনে হবে কোনও নবীন ভিক্ষু তীর্থ থেকে ফিরছেন!

গোরিং ওকে থামিয়ে বলে, দেচমাকে একাই যেতে হবে। ওকে এই এলাকার কেউ চেনে না, কাজেই সে সবার অলক্ষ্যে সীমান্ত পেরিয়ে যেতে পারবে। আমাদের সঙ্গে না থাকলে কেউ ওকে গরবের স্ত্রী বলে ভাববে না। যদি চিনেও ফেলে, সে বলবে যে, গরব আমাকে ছেড়ে দিয়েছে! গরবের চরিত্র সবাই জানে। সে আগেও অনেক মহিলাকে ধরেছে ও ছেড়েছে। কাজেই দেচমাকে সৈন্যরা মারবে না, কিন্তু আমাদের দেখতে পেলে মেরে ফেলবে। একথা শুনে দেচমার দুচোখ থেকে অশ্রু গড়ায়।

এতক্ষণে গরব মুখ খোলে। সে বলে, তোমরা ঠিকই বলেছ, পরিস্থিতি অনুযায়ী আলাদা হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তবে দেচমাকে নিয়ে তোমাদের চিন্তা করতে হবে না! তার দায়িত্ব আমার। আমার সঙ্গেই থাকবে। তাকে আমি একা ছাড়ব না!

দেচমা চোখের জল মুছে আর্দ্রকণ্ঠে বলে, তোমার নিরাপত্তার স্বার্থে আমিও একা যেতে রাজি। তবে চুল কাটাব না। কোনও প্রয়োজন নেই। গয়নাগুলি খুলে আলখাল্লার ভেতর ঢুকিয়ে নেব। পায়ে হেঁটে অন্য পথ ধরে গয়নাগুলি খুলে আলখাল্লার ভেতর ঢুকিয়ে নেব। পায়ে হেঁটে অন্য পথ ধরে এগুবো। তারপর তোমরা যেখানে অপেক্ষা করবে সেখানে পৌঁছে যাব। আমার কাঁধে থাকবে একটা কম্বল আর পিঠের ব্যাগে শুকনো খাবার। লোকে ভাববে আমি আশপাশের কোনও গ্রামের মেয়ে, আত্মীয়বাড়ি থেকে ফিরছি। আমরা এখন যেহেতু সীমান্তের খুব কাছেই আছি, দিনদুয়েক হাঁটলেই সীমান্ত পেরিয়ে যাব। পথে কোনও সৈনিকের সঙ্গে দেখা না - ও হতে পারে! সতর্ক থাকব, দূর থেকে তেমন সন্দেহজনক কাউকে দেখলে লুকিয়ে পড়ব! আর যদি ধরা পড়েই যাই, গোরিঙের কথামতন ওদের বলব যে তুমি আমাকে ছেড়ে দিয়েছ। তাহলেই ওরা আমাকে কিছু বলবে না!

দেচমার মুখে এই প্রস্তাব শুনে গরব রেগে যায়। মুখ ভেংচে বলে, ওরা আমাকে কিছু বলবে না! ওরা তোকে শেয়াল কুকুরের মতন ছিঁড়ে খাবে! চীনা তুর্কি সেনাদের তো জানিস না তুই!

সে মনে মনে ভাবে, স্বাভাবিক জীবন ছেড়ে ডাকাত সর্দারকে বিয়ে করার ইচ্ছে থেকে শুরু করে বরাবরই অভিযানপ্রিয় বীভৎসকাম বোকামির ঝোঁক রয়েছে ওর, অশরীরী পিশাচের চুম্বন যেমন উপভোগ করত, গোপন রাখত, চীনা তুর্কি সেনারা ধর্ষণ করতে পারে একথা ভেবেও হয়তো রোমাঞ্চিত হচ্ছে বোকা মেয়েটি! সেজন্যেই সে মনে মনে ভয়ানক একটি শপথ নিয়ে বসে। শপথের উত্তেজনায় তার মাথা থেকে পা অব্দি সারা শরীর কাঁপতে থাকে। এই ব্যাপারটা সঙ্গীদের চোখ এড়ায় না। কিন্তু তারা বাস্তব পরিস্থিতি মোকাবিলার কথা ভাবে।

ৎসোণ্ডু দু’দিকে দু’হাত বাড়িয়ে বলে, আমাদের উচিত তাড়াতাড়ি এই পথ থেকে সরে যাওয়া। সবেমাত্র একজনের সঙ্গে দেখা হল আর সে আমাদের চেনে, এমন ঘটনা আর হতে দেওয়া যায় না! অন্ততপক্ষে সন্ধ্যা পর্যন্ত লুকিয়ে থাকা যাক। ততক্ষণে আমরা ভেবে নিতে পারব কী করা উচিত!

এই উপদেশ সবার পছন্দ হয়। দ্রুত চার অশ্বারোহী পথ ছেড়ে পাহাড়ের দিকে সরে যায়। একটা সংকীর্ণ গিরিখাত ধরে চড়াই উঠতে থাকে। কেউ কোনও কথা বলে না। আর চারপাশের প্রতিটি শব্দের প্রতি উৎকর্ণ থাকে। একসময় চড়াই এত বেশি যে ওরা খচ্চর ও ঘোড়াগুলিকে গাছের গায়ে বেঁধে নিজেরা হেঁটে চড়তে থাকে। তারপর গিরিখাতের একটি বাঁকে আগুন ধরিয়ে চা ও ৎসাম্পা বানাতে বানাতে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করে।

যত সাহসী ডাকাতই হোক না কেন, এই দুর্গম পথে এহেন অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে, মাথা ঠান্ডা রেখে সমাধানের পথ বের করা সহজ কথা নয়। গরব হঠাৎ করে অনুভব করছে যে, ওরা আজ প্রায় নিঃস্ব, পরিবার পরিজনহারা এবং পরবাসে দ্রুত নিজেদের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু গোরিং আর ৎসোণ্ডু আপাততঃ এসব কিছু নিয়ে ভাবছে না! ওরা ভাবছে, কেমন করে ওদের দলপতি নিরাপদ থাকবে! যে মানুষটি এতগুলি অভিযানের সফল নেতৃত্ব দিয়েছে বিন্দুমাত্র রক্তক্ষয় ছাড়াই, যে তাদের জীবনকে করে তুলেছিল প্রাচুর্যময়, তার জীবনই এখন সংকটের মুখে! ওরা আলাদা আলাদা পথ ধরে তিব্বতে ঢুকে পড়তে পারলেই কোথাও না কোথাও লুকিয়ে অন্নসংস্থান করা কঠিন হবে না। কিন্তু গরব যেভাবে দেচমার সঙ্গ না ছাড়ার গোঁ ধরেছে, তিব্বতে পৌঁছে গেলেও ওর জীবন সংকটমুক্ত হবে বলে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না ওরা। কিন্তু গরব নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল। সে চারজনের জন্যে শুকনো খাবার ও টাকা ভাগ করে। ওরা দুজন যেহেতু একা একা যাবে, ওদের ভাগে একটু বেশি করেই দেয়। কারও কোনও আপত্তি শোনে না গরব। সে চিরকালই এমনি একগুঁয়ে । সঙ্গীদের স্বার্থকে সবসময় নিজের উপরে স্থান দেয় বলেই সে এত জনপ্রিয় দলপতি।

গোরিং আর ৎসোণ্ড তখন কাঠি দিয়ে মাটিতে এঁকে তিনটি আলাদা পথের কথা বলে। এর মধ্যে দুটি পর্বর্তসংকুল ও দীর্ঘ, আর একটি অপেক্ষাকৃত সমতল অঞ্চল দিয়ে গিয়ে একটি পাহাড়ি নদী পায়ে হেঁটে পার হওয়া যায় এমন পথ। তৃতীয় এবং সহজতর পথটি ওরা গরব ও দেচমার জন্য বেছে দেয় আর প্রথম দুটি পথ নিজেদের জন্য। গরব গোড়ায় মৃদু আপত্তি করলেও পরে দেচমার নিরাপত্তার কথা ভেবে তা মেনে নেয়। একা থাকলে সে কখনওই এই ব্যবস্থা মেনে নিতো না। কিন্তু দেচমা সঙ্গে থাকায় সে নিজেদের জন্যে এই সংক্ষিপ্ত ও সুগম পথই মেনে নেয়। অবশ্য সেই পথ যতটা সুগম ততটাই ধরা পড়ার ভয় রয়েছে। সেজন্যে ওদের প্রতিরাতে যাত্রা করে সারাদিন কোথাও লুকিয়ে বিশ্রাম নিতে হবে। গরব অবশ্য ওই পথটা ভালভাবে চেনে, আগেও ওখান দিয়ে যাওয়া আসা করেছে। পায়ে হেঁটে নদী পার হওয়ার স্থানটাও সে রাতের আঁধারে পার হতে পারবে। অন্যসময় গরব নিজের জানের মায়া না করেই যে কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। কিন্তু এদিন মনে হয়, তার অবর্তমানে দেচমার কী দশা হবে? অভিযানপ্রিয় বোকা মেয়েটিকে চীনা তুর্কি সৈন্যরা ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে। একথা ভেবেই সে এখন যে কোনও মূল্যে প্রবলভাবে বাঁচতে চায়।

গিরিখাতে সন্ধ্যা নেমে আসার সামান্য আগে ওরা ওখান থেকে বেরিয়ে এসে যে যার ঘোড়ার পিঠে চাপার আগে পরস্পরকে চোখের জলে বিদায় জানায়। তারপর গোরিং আর ৎসোণ্ড চোখ মুছতে মুছতে নিজেদের পরিকল্পিত পথে ঘোড়া চালায়। খচ্চরটিকে ৎসোণ্ড নিয়ে যায়। আগামীকাল সকালেই তার পথে একটি পশুর হাটে সে খচ্চরটি বিক্রি করে দেবে। গরব আর দেচমা সমতলভূমির দিকে নৈশযাত্রা শুরু করে। সারারাত ধরে অবিরাম ঘোড়া চালিয়ে ওই সমতলভূমি পেরিয়ে ভোরের দিকে ওরা একটি অরণ্যে ঢুকে পড়ে। গরব হিসেব করে বলে , সূর্যাস্তের পর এখান থেকে বেরিয়ে যাত্রা শুরু করলে অন্ধকার হওয়ার আগেই ওরা পায়ে হেঁটে নদী পেরোনোর জায়গাটায় পৌঁছে যাবে। পিকিং ও লাহসার সরকারের এলাকার সীমান্ত নির্ধারণ করা ওই খরস্রোতা, ওই একটি জায়গা ছাড়া উজানে ও ভাটিতে অনেকদূর পর্যন্ত গভীর ও অগম্য। শুধু এই একটি জায়গাতেই নদীর বুক প্রশস্ত। অগভীর নদীবক্ষে কোথাও গোড়ালি ছোঁয়া জল তো কোথাও হাঁটু ছোঁয়া। তারা নির্বিঘ্নে ওখানে পৌছুতে পারলে সহজেই তিব্বতে ঢুকে পড়তে পারবে। কিন্তু সূর্যোদয়ের পরেই সেদিন আবার আকাশ মেঘে ঢেকে যায়। আর একটু পরেই শুরু হয় প্রবল বর্ষণ। গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে শুরুতে লাভ হলেও একটু পর থেকেই ওরা মুষলধারে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। ভিজতে ভিজতে এক সময় দেচমা ' হ্যাচ্চো ’ দিতে শুরু করে। জামাকাপড় ঘোড়া সব ভিজে এক সা। তবে ওদের মাথার চুপি, পরণের আলখাল্লা আর ব্যাগগুলি সব ত্রিপলের কাপড়ের তৈরি বলে গায়ে জল লাগেনি। কিন্তু ঠাণ্ডা বাড়ছে। এই প্রবল বর্ষণে আগুন জ্বালানোর কোনও উপায় নেই দেখে ওরা বাটিতে বৃষ্টির জলেই ৎসাম্পা গুলে কোনওভাবে গলাধঃকরণ করে। প্রবল বর্ষণে পাহাড় থেকে অবিরাম জলধারা নেমে এসে সমস্ত নদীনালা প্লাবিত হতে শুরু করে । দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। কী হবে এখন? বিকেলে বৃষ্টি থামলে সন্ধ্যার আগেই ওরা নদীর কাছে পৌছে যায় । নদী তখন দুকুল প্লাবিত করে খরবেগে বয়ে চলেছে। ঘোলা জল, সশব্দে দুপারের বড় বড় পাথরের বুকে আছড়ে পড়ছে।

নদীর অগভীর অংশটি অবশ্য তখনও অনেকটা । ওরা সেদিকে ঘোড়া ছোটায়। হাঁটুজলের জায়গায় বুকজল হলেও ওরা হেঁটে পার হয়ে যাবে। এই জল নামতে অর্ধেক রাত লেগে যাবে। ততক্ষণ ওখানে অপেক্ষাও করতে হতে পারে। অবশ্য যদি এই বন্যার পর নদীর ওই অংশের জলতল হঠাৎ আরও অনেক গভীর না হয়ে থাকে! সেজন্যে ভোর হওয়ার আগে নদী পার করার চেষ্টা করা মূখর্তা। এই বিষয়টা ওদেরকে খুব ভাবায়। তার উপর দেচমার ক্রমাগত ‘ হাচ্চো ’ যেভাবে নিস্তব্ধতাকে খানখান করে দিচ্ছে!

দেচমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য গরব বলে, চীনা তুর্কি সৈন্যদের আক্রমণের পর কয়েকমাস পেরিয়ে গেছে। দাওয়া হয়তো ওদেরকে বলেছে যে গরবরা তীর্থ সেরে ফিরে আসবে। কিন্তু ওরা যে ফিরবেই সে সম্পর্কে সেনাপতি নিশ্চিত না-ও হতে পারে। সে ভাবতে পারে, চীনা সৈন্যের আক্রমণের খবর গরবরা নিশ্চয়ই গোয়েন্দা মারফৎ পেয়েছে, তাহলে সে বোকার মতন তিব্বতে ফিরবে কেন? সেজন্যে ওরা গরব ও দেচমার প্রত্যাবর্তনের কথা কল্পনায়ও আনবে না!

এসব কথা বলে গরব সন্ত্রস্ত দেচমাকে নিশ্চিন্ত করার চেষ্টা করে। সে বলে, আমাদের আর বেশিক্ষণ এমনি খোলা জায়গায় থাকা উচিত নয়। চল, আমরা আবার গিয়ে জঙ্গলে লুকাই আর নদীর জল কমার অপেক্ষায় থাকি। আর যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে সারারাতে জল অনেকটাই কমে যাবে। রাতের আঁধার আমরা পায়ে হেঁটে পেরুনোর জায়গাটায় পৌছে যাবো। কাকভোরে কতটা জল রয়েছে পরীক্ষা করে তবেই নদী পার হবো!


চলবে ...