শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

মহাসত্যের বিপরীতে, পর্ব ২৬

অংশকেও মানি, সমস্তকেও মানি; কিন্তু সমগ্রবিহীন অংশ ঘোর অন্ধকার এবং অংশবিহীন সমগ্র আরও ঘোর অন্ধকার।

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

# ছাব্বিশ

অনেক টানাপোড়েনের পর গরব মনে মনে পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনে।তাকে যে ওই সন্ন্যাসীরূপী শয়তানের রহস্যভেদ করতেই হবে, আর নিজেকে ও দেচমাকে পরবর্তী কোনও আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে হবে। এই অশরীরীর ভয়ে যত দূরেই পালিয়ে যাক না কেন, ওরা যে আবার আক্রান্ত হবে না তা কে বলতে পারে? গরবের সন্দেহ হয়। তার ধারণা , অশরীরীরা যাদের চায় শুধু তাদেরকেই অনুসরণ করে । এ ব্যাপারে সে কোনও প্রায় লামার পরামর্শ নিতে চায় , যিনি বুঝতে পারবেন হিন্দু সন্ন্যাসীর বেশে এ কোন অশরীরী তাদের পিছু নিয়েছে এবং কেন? প্রয়োজনে সে দেচমা এবং নিজের ভূত তাড়াতে চায়। বিশেষ করে দেচমাকে ঝাড়াতে চায়। কেননা সে ওই অশরীরীর আশ্লেষকে গরবের কাছে সজ্ঞানে গোপন রেখেছে।

যাযাবররা ওদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়, নিজেকে দূরবর্তী খাম অঞ্চলের ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দিয়ে গরব বলে, সে তার স্ত্রী ও দুই কর্মচারীকে নিয়ে খ্যাং তিসে তীর্থভ্রমণে গিয়েছিল। ওদের তাঁবুগুলির মাঝেই নিজেদের তাঁবু খাটিয়ে গরবরা ৎসাম্পার সঙ্গে ওদের দেওয়া গরম দুধ খায়। গরব খুশি হয়ে যাযাবরদের সর্দারকে ভাল বখশিশ দেয়।

সেরাতে দীর্ঘদিন পর গরব আবার দেচমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়। তার আগে দেচমা ওকে অনেকক্ষণ ধরে গা - হাত - পা টিপে দিয়েছে। গরবও দেচমার গা - হাত - পা টিপে দিয়েছে। দীর্ঘ পথচলার পর গরম দুধ ও ৎসাম্পা খেয়ে গা টিপতে টিপতে গরবের শরীর জেগে ওঠে। তার সেই উন্মাদনায় স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয় দেচমা। তবুও গরব অনুভব করে, আগের মতন বিশুদ্ধ ভালবাসা নয়, তার আশ্লেষে যেন মিশে আছে একটা তীব্র ঈর্ষাবোধ। চরম উত্তেজনার মুহুর্তেও গরব ভাবে, এমন তো নয় যে দেচমা এখন ওর বাহুপাশে থেকেও অশরীরী প্রেমিককে কল্পনা করছে। একথা মনে হওয়ায় সে আরও বেশি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে পড়ে। এই ঈর্ষা ওর কামনার আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়। সে তার উত্থিত শিশ্ন দেচমার মুখে পুরে দেয়। দেচমার মাথা চেপে ধরে ধীরে ধীরে কোমর দোলাতে থাকে। দেচমার চোখদুটি বিস্ফারিত। অবাক চোখে সে অচেনা গরবকে দেখে। গরবের গমন ক্রমে দ্রুত হয়। তারপর একসময় সে দেচমার মাথা আরও জোরে চেপে ধরে কাঁপতে থাকে। স্খলনের পরও ওর মাথা চেপে ধরে থাকে যতক্ষন না দেচমা সম্পূর্ণ বীর্যপানে বাধ্য হয়। তার চোখদুটি তখনও বিস্ফারিত। অবিশ্বাস্য চোখে সে গরবকে দেখে। সে যে তাকে খুব ভালবাসে। তাই গরবের এই আচরণকেও সে উপভোগ করার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুক্ষণ পাশে শুয়ে থেকে আবার উঠে গরব ওকে হামাগুড়ি দেওয়ার মতন আসনে রেখে কোন সম্ভবত প্রথমবার পশুর মতন দেচমার সঙ্গে দ্বিতীয় গমনে প্রবল হয়। দেচমার ব্যথা লাগে। সে সরে যেতে চায়। কিন্তু এই প্রথম গরব ওকে জোর করে। দেচমা কাঁদতে শুরু করে। কিন্তু এই আসন সে উপভোগ না করলেও গরব থামে না।

পরদিন সকালে মাখন কেনার অছিলায় গরব একা ওই যাযাবরদের সর্দারের তাঁবুতে গিয়ে বলে, তীর্থে আসার আগে সে এক সহযোগীর হাতে ব্যবসা সামলানোর দায়িত্ব দিয়ে এসেছিল। গতরাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে তার ব্যবসা নিয়ে চিন্তায় পড়েছে এখন একজন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা লামার পরামর্শ নিতে চায়।

সর্দার বলে, এখান থেকে উত্তরদিকে ঘোড়া চালিয়ে গেলে একদিন পর নিকটবর্তী বসতি পাওয়া যাবে। সেখানে একজন গ্যাঙসপা থাকেন, তিনি গুপ্তবিদ্যায় পারদর্শী একজন গণক। আশপাশের সমস্ত বসতির যাযাবর পশুপালকরা তার কাছেই ভবিষ্যৎ জানতে চায়।

গরব জানে অনেক গ্যাঙসপা বেশ চতুর হন। জাদুবিদ্যার ভেলকি দেখিয়ে লোক ঠকান। ওদের যত ভড়ং সেই তুলনায় জ্ঞান অনেক কম। কিন্তু এই পশুপালক সর্দার এই গাঙসপার প্রতি এতটাই সমীহ দেখায় যে গরব তাঁর কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সে দেচমা ও দুই সঙ্গীকে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই পথে বেরিয়ে পড়ে। পশুপালক সর্দারের নির্দেশ অনুযায়ী সারাদিন যথাসম্ভব দ্রুত ঘোড়া চালিয়ে সন্ধ্যার আগেই সেই গণকের কাছে পৌঁছে যায়। আর মানুষটিকে গরবের সত্যি সত্যি ভাল লাগে। গরব তাকে মোটা দক্ষিণা দেয়।

গ্যাঙসপা একা গরবকে ডেকে ভেতরের উঠোনে গিয়ে বসেন। মনোযোগ দিয়ে গরবের কথা শোনেন, তারপর চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসেন। অনেকক্ষণ পর চোখ খুলে বার্লি দিয়ে সামনের মাটিতে কে নকশা আঁকেন। তারপর গরবের হাতে প্রথমে একটা সাদা নুড়িপাথর তুলে দিয়ে ওই নকশার উপর ফেলতে বলেন, তারপর একটা কালো নুড়ি এবং অবশেষে একটা নানা রঙের পাথর ফেলতে বলেন। এবার গ্যাঙসপা উঠে ওই নকশার সামনে উঁচু হয়ে বসে গরবের ফেলা নুড়িগুলির অবস্থান জরিপ করেন। বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি আবার নিজের আসনে ফিরে গিয়ে বলেন, এক্ষেত্রে কোনও পিশাচ কিংবা জাদুকরের ভূমিকা নেই। কোনও সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছি না! এটি আগন্তুক শক্তি; এর ওপর আমার কোনও প্রভাব খাটবে না। তুমি কোনও হিন্দু তান্ত্রিকের খোঁজ করো। তিনিই তার দেশের গুপ্তবিদ্যা সম্পর্কে বলতে পারবেন। তোমাকে সঠিক উপদেশ দিতে পারেন। যাইহোক, তোমরা সাবধানে থেকো। যে কোনও সন্ন্যাসীর পরনে গেরুয়া পোশাক, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা আর হাতে ত্রিশূল দেখতে পেলেই আমাকে যা যা বলেছ, সব কথা বিশ্বাস করে বলতে যেও না। সামলে! ওদের মধ্যে অনেকেই যথেষ্ট দরিদ্র ও ভণ্ড। সদুপদেশ দেওয়ার অছিলায় ঠকাতে পারে। এমনকী, হীন জাদু প্রয়োগে কোনও দুষ্ট আত্মার শিকারও হতে পার।

– তাহলে আমি কী করব? তাছাড়া, আমি কোনও ভারতীয় ভাষা জানি না, হিন্দু তান্ত্রিকদের সঙ্গে কথা বলব কেমন করে?

গ্যাঙসপা একটু ভেবে বলেন, তুমি এক নেপালি সাধুর কাছে যেতে পার, তিনি খ্যাং তিসের পূর্ব ঢালে এক নির্জন আশ্রমে গত দশবছর ধরে আছেন। তার আগে নেপাল সীমান্তের শেরপাদের গ্রামে থাকতেন। ভাল তিব্বতি জানেন। এ পথে যাওয়ার সময় তিনি কিছুদিন আমার অতিথি ছিলেন। তখন তাকে ঘনিষ্টভাবে দেখেছি। গতবছর আবার আমি ওই পুণ্যাত্মাকে প্রণাম করতে গিয়েছিলাম। অতীন্দ্রিয় শক্তি বিষয়েও তিনি মহাজ্ঞানী । আবার খ্যাং তিসের কাছাকাছি যেতে হবে শুনে গরব মনে মনে প্রমাদ গোনা। গ্যাঙসপা যেন তা বুঝতে পেরে বলেন, সঙ্গে একজনকে দিতে পারি যে তোমাদের ওই পূণ্যাত্মার বর্তমান আশ্রম যে উপত্যকা হয়ে যেতে হয় তার প্রবেশদ্বারে পৌঁছে দেবে। সেই উপত্যকায় পৌঁছে তুমি মনে মনে ওকে শ্রদ্ধা জানাবে, তোমার সমস্যার কথা মনে মনে বলে সমাধান চেয়ে প্রার্থনা জানাবে। তাহলেই তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, নির্ঘাত শুনতে পাবেন। তিনি যদি দেখা দিতে চান তাহলে কিছু প্রাকৃতিক সংকেতের মাধ্যমে তিনিই তোমাকে পরবর্তী যাত্রাপথের নির্দেশ দেবেন। চারপাশে তাকিয়ে সেই ইশারাকে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করো। সেই উপত্যকায় চড়াই ভাঙতে ভাঙতে তোমরা উত্তরদিকে তুষারাচ্ছাদিত পর্বতমালা দেখতে পাবে। তখন থেকেই সতর্ক থাকবে। সঙ্গীদের নিয়ে যেখানে বিশ্রাম নেবে, ভুল করেও কেউ ওখানকার ঘাস ছিঁড়ে দাঁতে ঠেকিও না। পশুগুলিকেও খেতে দিও না, ওই লোপাস এলাকায় দু'ধরনের ঘাস হয়, যেগুলি দেখতে সাধারণ ঘাসের মতন হলেও মুখে দেওয়ার পর মানুষ ও পশুরা আজব আচরণ শুরু করে। পাগল হয়ে যায়। কেউ কেউ বলে, পূর্বজন্মের পাপের ফল ভোগ করে। এর মধ্যে একটা ঘাস এতই বিষাক্ত যে সেটা খেলে শরীর এত দুর্বল হয়ে পড়ে যে কোনও প্রাণী চলার ক্ষমতা হারিয়ে যায়। ধমনি শুকিয়ে নরক যন্ত্রণার মতন কষ্টে ভুগে অবশেষে মৃত্যুও হতে পারে। একটি উদাহরণ দিই, একজন ভিক্ষু অন্য তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে খ্যাং তিসে থেকে ফিরছিলেন। এমনি এক জায়গায় বিশ্রাম নেওয়ার সময় খাওয়ার পর আনমনে একটা ঘাস ছিঁড়ে দাঁত দিয়ে চিবোতেই তিনি দেখেন যে, একটি অন্ধকার গুহার দরজা খুলছে। তিনি তক্ষুনি থু - থু করে ঘাসটি মুখ থেকে ফেলে দেন। মুহূর্তে তার চোখের সামনে থেকে ওই গুহা সরে যায়। এই ঘাসের কথা সেই ভিক্ষু আগেই লোকমুখে শুনেছিলেন। তিনি অনুভব করেন, এই ঘাসই তাকে নরকের দুয়ার দর্শন করিয়েছে। একথা তিনি তাঁর সঙ্গীদেরকে বলেন। তারপর তিনি আবার নরক দেখতে এই ঘাস খোঁজেন। কিন্তু হাতের কাছ পান না। এবার তিনি থু করে ফেলে দেওয়া ঘাসের টুকরোটা খোঁজেন। কিন্তু সেটাও পান না। ওর কেমন জেদ চেপে যায়। অন্য সঙ্গীরা বিশ্রাম শেষে ওখান থেকে রওয়ানা হলেও সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি সেখানে থেকে যান। বাঁশ আর গাছের ডালপালা জোগাড় করে ওই উপত্যকাতেই একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে নেন। তারপর থেকে সবসময় তিনি ওই ঘাস খুঁজে বেড়াতেন। পেয়েছিলেন কিনা কেউ জানে না। কিন্তু পরবর্তী তীর্থযাত্রীরা তাঁকে উন্মাদ অবস্থায় দেখেছেন। উম্মাদ অবস্থাতেই তিনি একদিন মারা যান। বলতে বলতে গ্যাঙসপার বাকরুদ্ধ হয়ে আসে। চোখ চকচক করে।

গরব নরমস্বরে জিঞ্জেস করে, তিনি কি আপনার কেউ হতেন?

কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলতে পারে না। তারপর গ্যাঙসপাই আবার নিস্তবদ্ধতা ভেঙে বলেন, ওই সাদা তুষারাবৃত পর্বতমালার পেছনে একটি গভীর খাদই নাকি সত্যিকারের নরকের দরজা, সেটা থেকে সতর্ক থাকতে হলে প্রয়োজন অতীন্দ্রিয় অনুভবের। তিব্বতি নালজোরপা সন্ন্যাসীরা ছাড়া অন্য কারওর জন্যে ওই এলাকা নিরাপদ নয়।

গ্যাঙসপা তার অনুচরদের ডেকে গরবদের আহার ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে বলেন। তারপর গরবকে বলেন, এখন খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়। আগামীকাল ভোরে রওয়ানা হবে। ওই প্রধান নেপালি সন্ন্যাসীর এলাকায় পৌঁছতে তোমাদের চারদিন লাগবে। দর্শন পেতেই মনে মনে তোমার শরীর ও মন তাঁকে উৎসর্গ করবে। সঙ্গীদের কাছে ফিরে গরব বলে, আগামীকাল আমরা এক মহাত্মার সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশে রওয়ানা হব, চারদিন লাগবে। আশা করি তাঁর আশীর্বাদ আমাদের পিশাচের শয়তানি থেকে রক্ষা করবে।

তিনদিন পথ চলার পর গরব সবাইকে বলে, আগামীকালই আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যাব, ওই উপত্যকায় পৌঁছে কেউ যেন ভুল করেও কোনও ঘাস মুখে দিও না, আর পশুগুলির মুখেও ঠুলি বেঁধে রেখ। ওই উপত্যকায় কিছু বিষাক্ত ঘাস রয়েছে। আমাদের এ ব্যাপারে গ্যাঙসপার সাবধানবাণী মেনে চলতে হবে।

পরদিন সকালে ওই উপত্যকার প্রবেশদ্বারে পৌঁছেই গ্যাঙসপার অনুচর তাঁর নিজস্ব পথে চলে যান। যাওয়ার আগে তিনি গরবকে মনে করিয়ে দেন যে উপত্যকায় ঢুকেই মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে মনে মনে ওই পুণ্যাত্মার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে হবে, তাহলেই তিনি টের পেয়ে যাবেন আর তাদের পথনির্দেশ করবেন। গরব মাথা নেড়ে সায় দেয়। গ্যাঙসপার অনুচরকে বখশিশ দেয়। তারপর আবার যাত্রা শুরু করে। কিছুক্ষণ বেশ প্রতিকূল চড়াইয়ের পরই ওরা আবার উতরাই নামে। সরু পথের দুপাশে আকাশছোঁয়া উত্তুঙ্গ পর্বতগাত্র। আবার চড়াই, আবার উতরাই। কয়েক ঘণ্টা পর দু’পাশের পর্বতমালা দূরে দূরে সরে যেতে থাকে। গরব বুঝতে পারে না যে, ওদের আরও এগিয়ে যাওয়া উচিত হবে কি না!

সে ঘোড়া থেকে নেমে মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে মনে মনে ওই অচেনা সাধুর উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। দেচমা এবং অন্য দুই সঙ্গীও তার দেখাদেখি ভূমিতে কপাল ঠেকায়। প্রণাম শেষে উঠে দাঁড়িয়ে গরব চারপাশে তাকায়। কিন্তু কোনও সংকেত উপলব্ধি করে না। ওরা আবার ঘোড়ায় চড়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে। ক্রমে দূরের পর্বতমালা আরও স্পষ্ট হয়। সেই পর্বতমালা সম্পূর্ণ সাদা। আর ওই সাদা তুষারাচ্ছাদিত ধবল পর্বতমালার থেকে একটু যেন আলাদা রঙের। এই অদ্ভুত অপার্থিব দৃশ্যে গরবের শিরদাঁড়া দিয়ে এক আশ্চর্য শিহরন বয়ে যায়। আর তখুনি হঠাৎ কোথা থেকে একটি নাম না জানা সাদা পায়রা জাতীয় পাখি অনেক নীচে দিয়ে উড়ে শিস দিয়ে উড়তে শুরু করে। সেই গিরিবাজ পায়রাটি উড়ে গিয়ে একটি বড় প্রস্তরখণ্ডের উপর বসে। তারপর ডানা ঝাপটাতে থাকে। ডানা ঝাপটে আবার তেমনি শিস দিতে শুরু করে। গিরিবাজটার এই অদ্ভুত আচরণে গরব তাকিয়ে দেখে ওই বড় পাথরটার পাশ দিয়েই একটা দু’পায়ে চলা রাস্তা উপরে মাঝারি আকারের পাহাড়টার দিকে উঠে গেছে। ওই চড়াই সহজেই পায়ে হেঁটে যাওয়া যাবে। গরব ভাবে, হতে পারে এই পাখিটাই ওই নেপালি সাধুর পাঠানো সংকেত জানাচ্ছে। সে সঙ্গীদের বলে, এখানেই তাঁবু খাটাও। তোমরা একটু বিশ্রাম নাও। আমি ওই গিরিবাজটাকে অনুসরণ করবো। দেখি, ভাগ্য আমাকে কোথায় নিয়ে যায়! সমস্ত পশুকে সঙ্গে আনা জল আর খাদ্য খাইয়ে ওদের মুখে ঠুলি বেঁধে দাও, আর সাবধানে থেক। ভুল করেও পরিবেশ থেকে কিছু মুখে দিও না!

গিরিবাজটা ততক্ষণে শিস দিয়ে আরেকটু উপরে আরেকটি পাথরের উপর গিয়ে বসেছে। গরব ওকে অনুসরণ করে। পাখিটা এবার উড়ে উড়ে একটা পাথর থেকে অন্যটায় গিয়ে বসতে থাকে, আর গরবও আঁকাবাঁকা সর্পিল পথে চড়াই উঠতে থাকে। দেচমা ও অন্য দুই সঙ্গী কিছুক্ষণ গরবকে দেখতে পায়, পাখিটার শিসও শুনতে পায়। নীচে থেকে কাউকে পাহাড়ে চড়তে দেখলে তবেই অনুভব করা যায় পাহাড়টা কত উঁচু!

গরব অবশেষে হাঁপাতে হাঁপাতে নেপালি সাধুর কাছে পৌছে যায়। তিনি অর্ধনগ্ন। শুধু কোমরে একখণ্ড গেরুয়া ধুতি কোচা দিয়ে পরা। ওকে দেখেই জিজ্ঞেস করেন, কেন এসেছ বেটা? কী চাই?

একটু থেমে আবার প্রশ্ন করেন, প্রথমে বলো তুমি কে?

গরব কোনও রাখঢাক না করে তার মায়ের দাসীবৃত্তি, অজানা পিতার ঔরসের কথা জানিয়ে চুপ হয়ে যায়। আর কিছু বলে না।

বৃদ্ধ সন্ন্যাসী হেসে বলেন, এসব তো অনেক পুরনো কথা, তারপর ? কীসের টানে কৈলাসে গিয়েছিলে ? তীর্থ? তুমি তো একা নও, সঙ্গীরাও রয়েছে, ওরা উপত্যকায় অপেক্ষা করছে!

গরব বুঝতে পারে যে সন্ন্যাসী তার সততা পরখ করার জন্য, তাকে যাচাই করার জন্য এ ধরনের প্রশ্ন করছেন। সে হাতজোড় করে বলে, আপনি তো সবই জানেন জোওয়ো গমছেন (সন্ন্যাসী বাবা), আমি মহাপাপী!

সন্ন্যাসী বলেন, তোমাকে যিনি সঠিক পথ দেখাবেন সে আমি নই, পরবর্তী সময়ে তোমার দেশের এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা হবে, তিনি চেষ্টা করবেন, যখন সময় আসবে, তার নির্দেশ মেনে চললেই তোমার লাভ হবে। তুমি ভয়ানক কিছু দৃশ্য দেখে ভয় পেয়েছ, তাই না? আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো।

তোমার পিতা ছিলেন ভারতীয়, একজন প্রেতচর্চাকারী তান্ত্রিক। এরা অনির্দিষ্টকালের জন্য জরাকে দূরে হটিয়ে অমরত্ব পাওয়ার চেষ্টা করেন। এরা কালো জাদুর পূজা করেন। অন্যের মুখে মুখ দিয়ে প্রাণবায়ু শুষে নিজেদের যৌবনকে দীর্ঘায়িত করেন, জীবনীশক্তি বাড়ান। ওদের গুপ্তবিদ্যা অনুযায়ী যে কোনও পুরুষই সংগমের সময় সঙ্গিনীকে সুখ দিতে দিতে এমনি হঠাৎ তার প্রাণবায়ু শুষে নিজের পৌরুষকে দীর্ঘায়িত করতে পারেন। এই গুপ্তবিদ্যার চর্চা করে অনেক ভণ্ড সাধু মহাপাতক হয়ে ওঠেন। ওদের লালসার শিকার মহিলারা ক্ষণজীবী হন। কিন্তু ওই ভণ্ড সাধুদের অধিকাংশই এই ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেন না। কেননা এই জীবনীশক্তি ধরে রাখার জন্যে জরুরি ইন্দ্রিয়সুখের হাতছানিকে উপেক্ষা করা। ভণ্ড, নিষ্ঠুর ও স্বার্থান্বেষী সন্ন্যাসীরা সামান্য সুযোগ পেলেই আসক্তির ঝোঁকে সংযম হারান। আর তখনই তিনি কালো জাদুর প্রভাবে পাওয়া শক্তিও হারিয়ে ফেলেন। অন্যের শরীর থেকে শুষে নেওয়া জীবনীশক্তি শরীরের সমস্ত কোষ থেকে চলে গেলে ওদের যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু হয়।

তোমার বাবাও তোমার মাকে দেখে এমনি সংযম হারিয়েছিলেন। তাঁর সমস্ত জীবনীশক্তি দিয়ে তোমার সৃষ্টি, আর সেই শক্তি হারিয়ে তিনি মারা যান। মাতৃভূমি থেকে বহুদূরে মরে যাওয়া এই মানুষটির তুমি ছাড়া আর কোনও বংশধর নেই। তার বিদেহী আত্মাকে পিতৃলোকে পাঠাতে অন্ত্যেষ্টি বা পারলৌকিক ক্রিয়াদিও কেউ করেনি। এই ত্রিশঙ্কু অবস্থায় তার আত্মা প্রেত হয়ে জীবিতাবস্থায় থাকাকালীন যেসব পৈশাচিক চর্চায় রত ছিল সেই যৌন তৃষ্ণায় অতৃপ্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়।

লাহসায় গিয়ে তুমি নিজের জন্মবীজ সম্পর্কে বেশি করে ভাবতে থাক, সেই ভাবনা থেকে শেকড়ের খোঁজে ছুটে যাও কৈলাসে। সেখানেও তুমি পরিক্রমা ভুলে মনে মনে জন্মদাতাকে খুঁজতে থাক। এই প্রবল অন্বেষণ তোমার বাবার বিদেহী আত্মাকে আকর্ষণ করে। তার ধ্বংসের কারণকে তিনি ভুলতে পারেননি। রক্তের সম্পর্ক টের পান তিনি। যে জীবনীশক্তি তোমাকে দিয়ে তার বিনাশ হয়েছে, তিনি তা ফিরে পেতে চান। প্রেমিকার সঙ্গে তোমার যৌনতা তাকেও প্রলুব্ধ করে। তোমাকে খুব ভালবেসে তোমার থেকে যে মানসিক শক্তি তোমার সঙ্গিনী অর্জন করেছে সেই শক্তির সঙ্গেও তিনি যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন। এভাবে তোমরা দু'জনেই এখন ওর শিকার হয়ে পড়েছ।

গরব ওই ত্রিকালদর্শীর সামনে হাঁটুগেড়ে বসে তার পা জড়িয়ে ধরে। সাধু বলেন, ওঠ, আমি তোমাদের রক্ষা করব। একটু থেমে কী ভেবে বলেন, ভারতীয় আচার অনুযায়ী শ্রাদ্ধের পরিবেশ এখানে নেই, সমস্ত উপকরণ জোগাড় করা সম্ভব নয়। কিন্তু সংক্ষেপে প্রয়ওজনীয় ক্রিয়াকর্ম করা যাবে। জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ এবং সম্যাসী হওয়ায় হিন্দুধর্মের সমস্ত পারলৌকিক ক্রিয়া জানি। আগামীকাল ভোরে তোমার কাজ করিয়ে দেব।

বৃদ্ধ সন্ন্যাসী তাকে কয়েকটি ময়দার সঙ্গে গুড় মিশিয়ে তৈরি পিঠে খেতে দেন। এমন খাবার গরব কোনও দিন খায়নি। কী সুস্বাদু! খাওয়ার পর সন্ন্যাসী তাকে আশ্রমেই ঘুমিয়ে পড়তে বলেন। আশ্রমের বিছানায় শুয়ে দেচমার জন্যে খুব চিন্তা হয়। না জানি ও কী ভাবছে! দু'জনের দেখা হওয়ার পর থেকে এযাবৎ কোনওদিন ওরা আলাদা শোয়নি। আলাদা শোয়াকে বিলম্বিত করতেই দেচমা একের পর এক অভিযানে আগ্রহী। তাদের দুই সঙ্গীও খুব অনুগত এবং বিশ্বস্ত, দুজনেই বেশ সাহসী এবং গেরিলা যুদ্ধকৌশলে পারঙ্গম। দেচমার দেখভালে ওরা কোনও ত্রুটি রাখবে না। তার উপর রয়েছেন এই বৃদ্ধ সন্ন্যাসী, যিনি অন্তর্যামী! তিনিই তো তাকে আশ্রমে থেকে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন! এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনও কারণ রয়েছে! একথা ভেবে সে বেশ স্বস্তি পায়। দিনের পর দিন ঘোড়ায় চড়া আর সেদিন দুপুরে পায়ে হেঁটে এতটা পাহাড় চড়ার ক্লান্তি ওর চেতনাকে ক্ৰমে অবশ করে দেয়। সে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরদিন সকালে প্রাতঃকৃত্যাদির পর সন্ন্যাসীর নির্দেশে নিকটবর্তী একটি উষ্ণ প্রস্রবণে স্নান করে খুব আরাম পায় গরব। আশ্রমে ফিরে একটি বড় পাথরের আড়ালে খড়কুটো জড়ো করে তিনটে ছোটো পাথরের ফাঁকে আগুন ধরায়। সন্ন্যাসীর দেওয়া একটি মাটির হাঁড়িতে যথেষ্ট চাল ফুটিয়ে সেগুলি দিয়ে বেশ কিছু গোল গোল ভাতের মণ্ড বানায়। তারপর সন্ন্যাসী সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে প্রেত আহ্বান করে তাকে পিণ্ডদান করান। মন্ত্রের মাধ্যমে ওই বিদেহী আত্মাকে সমস্ত গিরিকন্দর পার করে সঠিক পথে তাঁর পূর্বপুরুষদের সঙ্গে মিলিত হতে বৈতরণী পার করানোর কথা বলেন। তারপর বলেন, বেটা, মন থেকে তোমার পিতাকে কিছু উৎসর্গ করো যাতে তিনি নিজে থেকে বেশি কিছু নিয়ে যেতে না পারেন। তোমার আলখাল্লা থেকে কয়েকটি সুতো বের করে দাও আর মাথা থেকে কয়েকটি চুল ছিঁড়ে উৎসর্গ করে বলো, এটা তোমার পঅশাক পিতা, তোমার প্রয়োজনে আমার কাছ থেকে আর কিছু নিও না!

গরব সন্ন্যাসীর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। তারপরই সন্ন্যাসী ওই তিনটি চালের মণ্ড, গরবের আলখার সুতো আর মাথার চুল আগুনে নিক্ষেপ করে বলেন, এগুলির কিছুই যেন আমার ডেরার ধারে - কাছে না থাকে!

সন্ন্যাসীর কথা মতন গরব ঘাস দিয়ে একটা ঝাড়ু বানিয়ে সযত্নে শ্রাদ্ধের ফুল, বেলপাতা ও ছাই হয়ে যাওয়া ভাতের মণ্ড এবং কাঠকয়লা ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে দেয়। বিদেহী আত্মা যাতে কোনওভাবেই আর ফিরে না এসে সোজা পিতৃলোকে চলে যান! যেখানে তিনি আরেকবার জন্ম নেওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত বিশ্রাম নেবেন। পরের জন্মে তিনি কোন যোনীতে জন্ম নেবেন, মনুষ্যযোনীতে জন্ম নেওয়ার সৌভাগ্য হলে ধনী দরিদ্র না মধ্যবিত্ত ঘরে জন্ম নেবেন, কতটা সুখে শান্তিতে থাকবেন, কতটা দুঃখ পাবেন - সবই পূর্বজন্মের কর্মফল নির্ভর!

এসব কথা বলে বৃদ্ধ সন্ন্যাসী গরবকে বিদায়ের সময় বলেন, পিতার প্রেত থেকে তোর আর কোনও ভয় নেই বেটা। কিন্তু নিজের পাপের ফলে তোকে ভুগতেই হবে, এ জন্মেও, পরের জন্মেও। অবশ্য একদিন তোর সামনে প্রায়শ্চিত্ত ও মোক্ষলাভের সুযোগ আসবে, তখন সেটাকে নিতে হবে আর সেই সুযোগ হেলায় হারাস না!

গরব বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর পায়ে কপাল ঠেকিয়ে গড় করে প্রণাম করে। তারপর ঢাল বেয়ে ধীরে ধীরে উপত্যকায় নেমে আসে। তার মন এখন শঙ্কামুক্ত। শরীর নির্ভার। নীচে নামার আগেই দেখতে পায় দেচমা ও দুই সঙ্গী তেমনি পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেভাবে ওদেরকে গতকাল দেখে গিয়েছিল। গরব ওদের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে হাত নাড়ে। দেচমা, ৎসোণ্ডু আর গোরিং তাকে দেখতে পেয়ে সোৎসাহে হাত নাড়ে। গরব নীচে নেমে এলে প্রথমে গোরিংকে, তারপর ৎসোণ্ডুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, আর ভয় নেই!

ওদের চোখে জল।

দেচমাকেও জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে ইচ্ছে করে গরবের। কিন্তু অনুগামীদের সামনে সে সংযত থাকে। দেচমার পিঠে আলতো হাত রেখে কোমরে ধরে ওকে ঘোড়ার পিঠে তুলে দেয়। তারপর তিনজনে দ্রুত তাঁবু গুটিয়ে ভাঁজ করে খচ্চরগুলির পিঠে বেঁধে যার যাযর ঘোড়ার পিঠে চেপে চলতে শুরু করে।