শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

মহাসত্যের বিপরীতে, পর্ব ১৪

চৌদ্দ

চাঁদ চকোরে অধরে অধরে

পিয়ো সুধা প্রাণ ভরে

প্রেম সোহাগে প্রেম অনুরাগে

আদরে মন চোরে। - ক্ষিরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদ


একা থাকলেই এই আবেগঘন দিনগুলি হারানোর ভয় দেচমাকে কুড়ে কুড়ে খায়। গরব শহরে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর দেচমাও সেজেগুঁজে কোনও একজন ভালো জ্যোতিষীর খোঁজে বেরোয়। গরব তাকে যে অজানা স্থানে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইছে সেখানে তার জন্য কোন ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে কে জানে! না জানি কেন তার মনে সকালে দরজা খুলতেই সোনালি মথটার উড়ে এসে মাকড়সার জালে জড়িয়ে পড়া আর পবিত্র খ্যাং তিসে নিয়ে আলোচনা হতেই মুক্তি পাওয়ার দৃশ্যটা ভেসে ভেসে থাকে, আর একটা অভূতপূর্ব উত্তেজনায় অস্থির হতে থাকে।

সেজন্যেই দেচমা গরবের বাড়িতে ঘরকন্না করতে যাওয়ার আগে কোনও জ্যোতিষীর কাছে যেতে চায়। সে সরাইখানার মালিকের বউকে নিজের ইচ্ছের কথা জানায়। মহিলা তাকে এক মোপা লামার কাছে পাঠায় যার অধিকাংশ গ্রাহকই হলো লাহসাগামী গিরিপথের দুপাশে বসবাসকারী অগণিত মধ্যবিত্ত মানুষ।

দেচমাকে জ্যোতিষীর কাছে নিয়ে গেলে সে একটি উত্তরীয় ও প্রণামী ভেট করে কিছু বলতে গেলেই মোপা জ্যোতিষী ওকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে। দেচমা মনে মনে প্রশ্ন তৈরি করে। সে অন্য সমস্ত চিন্তা থেকে মনকে সরিয়ে এনে প্রশ্ন করার প্রস্তুতি নিতে থাকে।

মোপা একটি গদিবিছানো কাঠের চৌকির উপর বসে। তাঁর কাছে সামনে একটি কাঠের বেঞ্চিতে বসে দেচমা। ওদের মাঝে একটি সরু টেবিলে ছক আঁকা পুঁথি খোলা। ছকের উপর তিনটি ছোটো পাশার ঘুঁটি। আর পাশে একটি পুঁথি যা অতি ব্যবহারে তেলচিটে। দেচমা চুপচাপ বসে মনে মনে প্রশ্ন তৈরি করতে থাকে, . . . আমার প্রেমের পরিণতি কি? ভবিষ্যৎ থেকে কী আশা করতে পারি?

মোপা মন্ত্রজপ করতে থাকেন। তারপর একসময় টেবিলের উপর থেকে পাশার ঘুঁটি তিনটি দু'হাতের মধ্যে নিয়ে ঝাঁকাতে শুরু করেন। ঝাঁকাতেঝাঁকাতে ভিন্ন সুরে মন্ত্র জপেন। তারপর ঘুঁটি তিনটি টেবিলের উপর ফেলে দেন। এবার খোলা বইয়ের ছকে ওই ঘুঁটিগুলি যে সংখ্যা নির্দেশ করছে সেটাকে আঙুল দিয়ে দেখে গণৎকার চরম শঙ্কিত আওয়াজ টেনে টেনে উচ্চারণ করেন, প্রতিহিংসার হাসি--অ-ত-ল গহ্বর!

কিছুক্ষণ পর দেচমা নিজেকে পথের মধ্যে আবিষ্কার করে। সে থ হয়ে যায়। কখন এবং কেমন করে মোপার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে তা ওর স্মৃতিতে নেই। কিন্তু দৈববাণীটি ওর অস্তিত্বে থেকে থেকে ঝংকার তুলছে। সে কথাটির মানে বুঝতে চেষ্টা করে, কার ক্রোধের শিকার হয়ে সে, কিসের প্রতিহিংসা? কেমন অতল গহ্বর? তার সঙ্গে ওর ভবিষ্যতের সম্পর্ক কী? এই কথাগুলির মানে যেভাবেই উল্টেপাল্টে দেখা হোক না কেন মানেটা যে অশুভ ইঙ্গিতবাহী তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

দেচমা ফেরার পথে জোওবো মন্দিরে যায়। রাজকুমার গৌতমের মূর্তির সামনে তখনও ১০৮টি প্রদীপ জ্বলছিলো। সকালে গরব ওই মন্দিরেই গিয়েছিল। জোওবো মন্দিরের সিঁড়িতেই হঠাৎ দেচমার মনে হয় সে দৈববাণীটি বুঝাতে পেরেছে; একটি সূক্ষ্ম আলোর রেখা দেখতে পায়।

তার মনে হয়, এই দৈববাণী অনুসারে ওদের প্রেমের পরিণতি হবে অতল গহ্বর বা নির্দ্বিধায় নরকবাস। আর প্রতিহিংসার হাসি হেসে ডাকিনী যোগিনীরা ওকে নরকে আহ্বান জানাবে। অতল গহ্বর তো শুধুমাত্র নরকেই থাকে বলে শুনেছে সে। সেখানে পৌছে আবার জন্ম নেওয়ার আগে হয়তো হাজার বছর নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হবে ওকে। কিন্তু কেন? গরবকে ভালোবেসে সে কোনও পাপ যে করেনি তা ওর কাছে স্পষ্ট। প্রেম তো পবিত্র অনুভূতি। এরজন্যে কারও পাপ হয় না। কিন্তু সে যেমনভাবে স্বার্থপরের মতন নিজের স্বপ্ন সফল করতে প্রিয়জনদের মনে কষ্ট দিয়ে ওদের বিপদে ফেলে পালিয়ে এসেছে হয়তো তার পরিণাম হিসেবেই এই নরকবাস করতে হবে।

মাত্র তিন বছর বয়সে বাবা - মা মারা গেছিল দেচমার। ওই ঠাকুর্দা-ঠাকুমা ওকে বুকে করে আদরে আহ্লাদে বড় করে তুলেছেন। দেচমার বাবা ছিল ওদের একমাত্র সন্তান। তারা সম্ভ্রান্ত কৃষক দম্পতি। তাঁদের লালন প[আলনে দেচমার শৈশব ছিল আনন্দঘন। তারপর একদিন ওর ঠাকুর্দা অসুস্থ হয়ে পড়েন। বছরের পর বছর শস্যক্ষেত্রে যেতে পারেন না। ধীরে ধীরে ওদের পরিবারে ঋণের বোঝা বাড়ে। দীর্ঘ চিকিৎসার ফলে ক্ষেত-খামার থেকে যে আয় হতো তা দিয়ে ভরণপোষণ চালিয়ে ঋণশোধ করা সম্ভব হয় না। ঋণ শোধ করতে গিয়ে ধীরে একের পর এক ক্ষেত বিক্রি করে দিতে হয়। তিনি নিঃস্ব হয়ে পড়েন।

একদিন দেচমা বান্ধবীদের সঙ্গে ধর্মীয় পালাগানে অংশ নিয়ে মঠে গেলে ওই প্রদেশের মুখ্য প্রশাসকের ছেলে তার অপরূপ সৌন্দর্য দেখে প্রেমে পড়ে যায়। সে তার বাবাকে নিজের পছন্দের কথা জানালে প্রশাসকের কোনও আপত্তি থাকে না। দেচমা সন্ত্রান্ত বংশের মেয়ে আর ওর ঠাকুর্দা-ঠাকুমার তেমন দাবি দাওয়া নেই। আর্থিক দিক থেকে সমকক্ষ কারও মেয়েকে পছন্দ হলে অনেক বেশি পণ দিতে হতো। তিব্বতে কনের বাবা-মা কিংবা অভিভাবককে পণ দিয়ে বিয়ে করানোই প্রথা। মেয়েকে ভরণপোষণের ক্ষতিপুরণ হিসেবেই এই পণ দেওয়া হয়!

অলোক হেসে ছিলিং পানচুক জানবাককে ভারতের সর্বত্র উল্টো প্রথার কথা বলে। পানচুক অবাক হয়ে বলে, ভারতীয় মেয়েরা কি দেখতে এত বাজে যে তাদেরকে পণ দিয়ে বিয়ে দিতে হয়?

অলক বলে, তা নয়, ঋকবেদে মনুসংহিতা অনুসারে প্রথম জাতিভেদ প্রচলিত হয়। তখনই উচ্চ ও নিম্নবর্ণের মানুষদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি সমাজে নারীর মর্যাদা হ্রাস পায়। ধর্মীয় অধিকার এবং সম্পত্তির অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়, পণপ্রথা এবং পুরুষের বহুবিবাহও তখনই প্রচলিত হয়। আড়াই তিন হাজার বছর পরও ভারতে আমরা ওই রোগগুলির উত্তরাধিকার বহন করছি। ১৯৪৭-এ দেশ স্বাধীন হলে আমাদের সংবিধান প্রণেতারা এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নারীকে পুরুষের সমান নাগরিক অধিকার প্রদান করে। পণপ্রথাকেও অবৈধ ঘোষণা করে। কিন্তু বর ও কনেকে উপহার দেওয়ার আড়ালে সেই পণপ্রথা আজও চলছে!

পানচুক জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করে। সে অলোককে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলে, ঠিক আছে স্যর, তার কী হলো? অলক ইতোমধ্যেই গোটা বইটা পড়ে নিয়েছে। সে চায়ে চুমুক দিয়ে বলে, ছেলের ইচ্ছের সঙ্গে পারিবারিক সম্মান ও কম পণের ব্যাপারটা যুক্ত হওয়ায় মুখ্য প্রশাসক প্রথানুসারে তার এক ভাইকে দেচুমার ঠাকুর্দা-ঠাম্মার কাছে প্রস্তাবক হিসেবে পাঠান। সেদিনই বিয়ের শর্তাবলি ঠিক হয়ে যায়। ঠিক হয় যে, ছেলের বাড়ি থেকে বৃদ্ধ দম্পতির সমস্ত ঋণ শোধ করে দেওয়া হবে, মুখ্য প্রশাসক তাদের ক্ষেতখামার দেখাশোনা করার জন্যে একজন সক্ষম ব্যক্তিকে নিয়োগ করবেন। বাড়ি-ঘরগুলির অনেক বছর ধরে কোনও রকম সারাই হয়নি, জায়গায় জায়গায় ফাটল ধরেছে আর শ্যাওলা গজিয়েছে। সেগুলির পলেস্তারা খসিয়ে পুনর্নবীকরণ করে দেওয়া হবে। বৃদ্ধ দম্পতি। ওই বাড়িতেই থাকবেন। তাদেরকে আর কোনও কাজ করতে হবে। নিজেদের ক্ষেত খামারের আয় ছাড়াও প্রশাসক প্রতিমাসে হাতখরচের জন্য একটি ভাতার ব্যবস্থা করবেন যাতে ওদের কোনওরকম কষ্ট না হয়।

প্রশাসকের ভাই চলে গেলে, বৃদ্ধ দম্পতি পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানান । তাঁরা মনে মনে ভাবেন, ছোট্ট মা-বাপ মরা মেয়েটাকে আদরে-আহ্লাদে বড় করেছেন বলেই তাদের এই সৌভাগ্য এসেছে! নাতনিটিও এহেন অভিজাত উচ্চপদস্থ কর্মচারীর ঘরে মহাসুখে থাকবে!

কিন্তু ওরা একবারের জন্যেও দেচমাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করে না যে, ওরা যা ভাবছেন দেচমাও তা ভাবছে কিনা! তিব্বতে কনের পছন্দ জানার কোনও প্রথা নেই। ওরা একদিন স্রেফ দেচমাকে জানায় যে অমুক শুভদিনে সে মুখ্য প্রশাসকের পুত্রবধূ হবে আর তারপর থেকে মহাসুখে থাকবে!

কিন্তু দেচমা এই খবরে মোটেও খুশি হয় না। সে আশৈশব গ্রামের মাতালদের মতন দিবাস্বপ্ন দেখতো ঘোড়ায় চড়ে এসে এক রূপকথার রাজপুত্র কিংবা কোনও সাহসী যোদ্ধা ওকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে আর সে তার পাশাপাশি দিনের পর দিন ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াবে আজীবন। ছোটবেলায় যা ছিল নিছকই কল্পনা বড় হতে শুরু হওয়ার পর তা ক্রমে ওর কাছে বাস্তবের মতন রোমাঞ্চকর হয়ে উঠতে থাকে। নিজের অজান্তেই সে একটি নিজস্ব কল্পনার জগত তৈরি করে নেয়। তন্ত্রসাধকরা যেমন তাদের শিষ্যদের কল্পনাশক্তিকে প্রখর করার মাধ্যমে নিজেদের ইচ্ছেমতন অতীন্দ্রিয় জগত তৈরি করার অভ্যাস করে তার নিজস্ব জগতের রাজকন্যে, এক অশরীরী মানুষের প্রেমিকা হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে তার প্রেমিক স্বপ্নের পাঁচিল ডিঙিয়ে স্বপ্ন ও বাস্তবের সীমারেখাটিকে ভেঙে গুড়িয়ে দেয়। দেচমা তখন জাগ্রত অবস্থায়ও সেই ঘোড়ায় চড়া সুপুরুষ, ডাকাবুকো মানুষটিকে দেখতে শুরু করে। এমনকি দেচমা ওর কণ্ঠস্বরও শুনতে পায়, ওর বলিষ্ঠ হাতের স্পর্শ অনুভব করে। সে তাকে স্বপ্নে ও জাগরণে ঘোড়ার পিঠে তুলে নিয়ে তীব্রগতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়। টগবগ টগবগ...!

তিব্বতের প্রায় সমস্ত মানুষের মতন দেচমাও ভীষণ রকম সংস্কারাচ্ছন্ন। সে অনেকের কাছে অনেক অলৌকিক গল্প শুনেছে। আর অধিকাংশ তিব্বতীর মতনই ‘সম্ভব ’ ও ‘ অসম্ভব ’ এবং বাস্তব ও কল্পনার জগতের মধ্যে সূক্ষ্মরেখা টেনে আলাদা করতে পারে না। সেজন্যে দেচমা শুধু সেই স্বপ্নপুরুষের অপেক্ষায় থাকে।

ঠাকুর্দা-ঠাম্মার হাসিমুখে শুভসংবাদ শুনে দেচমা থ হয়ে যায়। ওই প্রশাসকের ছেলেকে সে চেনে। তার মতন নাদুসনুদুস বরের বউ হওয়ার কথা যে সে ভাবতেই পারে না। এখন কী করবে সে? দেচমা আর তার হবু বরের মাঝে সেই স্বপ্নপুরুষ এসে বারবার ঢুকে পড়তে শুরু করে। অবশেষে তাকে যারা কোলেপিঠে করে তিলতিল করে বড় করে তুলেছেন, মুখ্য প্রশাসকের ছেলের সঙ্গে দেচমার বিয়ে হলে যাদের সমস্ত ঋণ শোধ হয়ে যাবে আর বৃদ্ধ বয়সে আরামে থাকতে পারবেন সেই ঠাকুর্দা-ঠাম্মার কথা না ভেবে স্বার্থপরের মতন নিজের স্বপ্ন সফল করতে ওদেরকে ঘুমের মধ্যে রেখে একরাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়, এবং আশ্চর্যজনকভাবে একদিন সে তার স্বপ্নের পুরুষকে পেয়ে যায়। আর তারপরই এমনি অদ্ভুত ঘটনাবলি তার জীবনকে সুখ ও রোমাঞ্চে ভরিয়ে দেয়।

এই সুখের পিঠে চড়ে এক অলৌকিক ঘোড়সওয়ারের পাশাপাশি টগবগ টগবগ ঘোড়া ছুটিয়ে তিব্বতের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটতে থাকে। ভুলে যেতে থাকে তার অতীত।

জোওবোর মূর্তির সামনে বার বার মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে করতে দেচমা তার কৃতঘ্নতাকে তীব্রভাবে অনুভব করে। ঠাম্মার কাছে সে গল্প শুনেছে, আড়াই হাজার বছর আগে এই রাজকুমার গৌতমও ঘর ছেড়ে বিবাগী হয়েছিলেন। তাঁর পিতা শুদ্বোধন ছিলেন দক্ষিণে হিমালয়ের ওপারে কপিলাবস্তু গণরাজ্যের নির্বাচিত অধিপতি। মাত্র ১৬ বছর বয়সে গোপা ও যশোধরার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হলেও তিনি কখনও দাম্পত্য জীবনে মনোনিবেশ করতে পারেননি, সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টে তাঁর হৃদয় সবসময়ই কাঁদত। তাঁদের দুঃখ দূর করার পথ খুঁজতেই সংসারের সমস্ত মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে মাত্র ২৯ বছর বয়সে তিনি ঘর ছাড়েন। আচ্ছা, সংসার নাহয় না-ই করলেন, তা বলে ১৩ বছরের দাম্পত্য জীবনে বাচ্চাকাচ্চা হলোনা কেন? সিদ্ধার্থ শারীরিকভাবে সক্ষম ছিলেন তো? বাচ্চাকাচ্চা হলে তিনি কি এভাবে গৃহত্যাগ করতে পারতেন?

একথা মনে হতেই দেচমা নিজের কান টেনে নিজেকে শাসন করে। তারপর আবার মেঝেতে কপাল ঠুকতে ঠুকতে বলে, ক্ষমা করো অবলোকিতেশ্বর, আমি একটি সাধারণ মেয়ে, আমার মনে এসব চিন্তা আসাও পাপ!

দেচমা ভাবে, তাঁর ঘর ছাড়ার সঙ্গে দেচমার স্বপ্নপুরুষের হাতছানিতে ঘর ছাড়ার রোমাঞ্চকে তুলনা করা যায় না। গরবও নাকি তেমনি একদিন ঘর ছেড়ে পথে নেমেছিল! কিন্তু তিনজনের গৃহত্যাগই যে নিয়তি-নির্দিষ্ট তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

তবু রাজকুমার গেীতমের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে দেচমা তীব্র অনুশোচনায় জর্জরিত হয়। তার দুচোখ উপচে অশ্রুধারা গালে নেমে আসে। যারা তাকে এত আদর ভালোবাসা দিয়ে বড় করে তুলেছে মুখ্য প্রশাসকের কোপে তাদের কী দুর্দশা হতে পারে তা সে কল্পনাও করতে পারে না। মুখ্য প্রশাসক নিশ্চয়ই ওদেরকেই দোষী সাব্যস্ত করে প্রতিশ্রুত সহায়তার বদলে জরিমানা আদায় করে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে! ও ঠা-ম্মা, ক্ষমা করো, ও দাদু ক্ষমা করো! কাঁদতে কাঁদতে জোওবা মন্দিরের থামে কপাল ঠোকে দেচমা। সে শক্তমনের মানুষ নয়। নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত এবং জীবনে কখনও সুযোগ পেলে প্রায়শ্চিত্য করতে রাজি। একটি ঢোক গিলে সে হঠাৎ ভাবে, প্রয়োজনে গরবকেও ছেড়ে দেবে! তার ধর্মপ্রাণ ঠাকুর্দা-ঠাম্মা আর এক দস্যুসর্দার গরবের মধ্যে কোনও সম্পর্ক স্থাপন করার কথা সে কল্পনাও করতে পারে না! মনে মনে ঠিক করে যে অনেক হয়েছে, সে এবার গ্রামে ফিরে যাবে, বৃদ্ধ দম্পতি যদি সমস্ত যাতনা সহ্য করে এতদিন বেঁচে থাকে তাহলে গায়ে খেটে পরিশ্রম করে তাদের দেখাশোনা করবে!

তার প্রায়শ্চিত্তের ওই একটাই পথ খোলা রয়েছে! তাহলে যদি দৈববাণী অনুযায়ী তার জন্যে নির্ধারিত নরকবাসের পরিমাণ কিছুটা কমে! আজ গরবের কাছে ফিরেই সে নিজের অপরাধ স্বীকার করবে। আর তাকে বলবে যে সে এবার ঠাকুর্দা-ঠাম্মার কাছে গ্রামে ফিরতে চায়। একজন সেবাইতকে আসতে দেখে দেচমা তাকে মুর্তির পদতলে একশো আটটা প্রদীপ জ্বালানোর অর্থ দেয়। বৃদ্ধ-দম্পতির সুস্বাস্থ্য কামনা করে প্রদীপগুলিকে তথাগতের পায়ে নিবেদন করে। সে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে যাতে সে ভবিষ্যতে বৃদ্ধ দম্পতির সেবা করতে পারে, তাদের শান্তি দিতে পারে!

মন্দির থেকে বেরিয়ে দেচমা সরাইখানার ঘরে ফিরে দেখে গরব তখনও ফেরেনি। সে ফেরে দুপুরে খাওয়ার সময় এবং সরাসরি অন্য ডাকাতদের সঙ্গে নিয়ে ভোজনালয়ে যায়। দেচমার খাবার তাকে ঘরের মধ্যেই দিয়ে যায় গোরিং। তার কাছেই দেচমা গরবের ফেরার কথা জানতে পারে। সে ঢকঢক করে এক বাটি জল খায়। তারপর গরম গরম ৎসাম্পা খাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তার গলা দিয়ে ৎসাম্পা কিম্বা মাংসের টুকরো ঢুকতে চায় না। সবকিছু বিস্বাদ লাগে।

সে ঠিক করে যে একটু পরে গরব দোতলার ঘরে উঠে এলেই মনের কথা খুলে বলবে! তাকে যে আজ বলতেই হবে!


চলবে ...