শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

মহাসত্যের বিপরীতে তৃতীয় খণ্ড # ত্রয়োদশ অধ্যায়

‘ মঙ্গলপ্রেমী মরালেরা/থাকতে চেয়েছিল, তাঁদের পথে ছড়িয়ে গেছে/ বরফশীতল হতাশা!’ - ৎসাংইয়াং গ্যাৎসো( ৬ষ্ঠ দলাই লামা)

5ef5a102330b7.jpeg


মহাসত্যের বিপরীতে তৃতীয় খণ্ড # ত্রয়োদশ অধ্যায় ঃ

আমি ও আমার তিব্বতি ভাইবোনেরা নিজের দেশেই চিরকাল শান্তিতে থাকতে চেয়েছি, কোনোদিন কাউকে আক্রমণ করার কথা ভাবিনি, সেজন্যে আমরা কোনও শক্তিশালী সেনাবাহিনী কিম্বা অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের ভাণ্ডার গড়ে তুলিনি। এখন মনে হয়, দেশের মানুষকে শান্তিতে রাখতে হলে এসবের প্রয়োজন রয়েছে। ৬ষ্ঠ দলাই লামা ৎসাংইয়াং গ্যাৎসোও হয়তো একথা অনুভব করে এই পঙক্তিটি লিখে গেছেন। তাঁর এই ভাবনাকে সঠিকভাবে অনুধাবন করলে আজ হয়তো তিব্বতবাসীর এত দুর্দশা হতো না। এই বরফশীতল হতাশা বারবার গ্রাস করতো না।

একটা দেশের রাজকোষ সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এর সঙ্গে দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জড়িয়ে থাকে। তাই এসব প্রস্তুতির জন্য সময় নিতে হয়, যাতে আমরা কয়েক সপ্তাহ পরে চলে যেতে পারি। তবে সবকিছুই করতে হচ্ছিল অত্যন্ত গোপনে। আমার প্রধানমন্ত্রীরা ভয় পাচ্ছিলেন যে দালাই লামা রাজধানী ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে এই খবরে জনমনে ত্রাস ছড়িয়ে পড়বে! তাহলে চীনের গুপ্তচররাও জেনে যাবে! ত্রয়োদশ দালাই লামার সময়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে, আমার মনে হয়, অনেকেই অনুমান করতে পারছিলেন, কারণ অনেকগুলি গাড়ি ভরে জিনিস পাঠানো হয়ে গিয়েছিল - যার অনেকটা আমিও অবগত ছিলাম না, পঞ্চাশ – ষাটটি শক্তিশালী মজবুত ট্রাঙ্কে, পোটালা কোষাগারের সিন্ধুকগুলি থেকে সর্বাধিক সোনার বিস্কুট এবং রূপোর বারগুলি ভরে নেওয়া হয়েছিল। এই বুদ্ধিটা ছিল আমার পুরানো বস্ত্রাধিকারী কেনরাপ তেনজিংয়ের, যিনি এখন পদোন্নতি হয়ে চিকিয়াব কেনপো হয়েছেন। এই ব্যাপারটা জানতে পেরে আমার খুব রাগ হয়েছিল। তার মানে এই নয় যে আমি রাজকোষের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম না, আমার অল্পবয়সি মনের ক্ষোভ থেকে এই রাগ জন্ম নিয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল যে কেনারাপ তেনজিন তখনও আমাকে একটি শিশু হিসাবে বিবেচনা করছেন, তাই তিনি আমাকে বলেন নি।

অনেক দুশ্চিন্তা এবং আশা নিয়ে যাওয়ার দিনের অপেক্ষায় ছিলাম। একদিকে নিজের মানুষদের ছেড়ে যাওয়ার মতন পরিস্থিতি দেখে দুঃখিত, কারণ আমি ইতিমধ্যেই তাঁদের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করতে শুরু করেছিলাম। অন্য দিকে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণের সম্ভাবনা নিয়ে খুশি ছিলাম। প্রধান প্রতিহারী আমার পোশাক পরিবর্তন করে সাধারণ নাগরিকের পোশাক পরার পরামর্শ দিলে প্রধানমন্ত্রীরা সমর্থন করেন। তাঁরাও সাধারণ নাগরিকের পোশাক পরবেন। তাঁরা উদ্বিগ্ন ছিলেন, আমি যে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি - একথা জনসাধারণ জানতে পারলে, তাঁরা আমাকে থামানোর চেষ্টা করবে। এই পরামর্শ আমারও পছন্দ হয়েছে। এখন আমি শুধু দেশের অনেক জায়গা দেখবো না, দালাই লামা হিসাবে নয়, জনগণের একটি অংশ হয়ে তাঁদের জীবনকে হয়তো আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবো!

রাতের অন্ধকারে আমরা লাহসা ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম। সে রাতে খুব বেশি ঠান্ডা ছিল না। তারাভরা আকাশ মেঘহীন। তিব্বতের আকাশে তারাগুলি যত জ্বলজ্বল করে পৃথিবীর আর কোথাও এমন জ্বলজ্বল করতে দেখিনি। চারপাশে গভীর নিস্তব্ধ শহর। পোটালার পাদদেশ থেকে চুপচাপ ঘোড়ায় চড়ে নরবুলিংকা এবং দ্রেপং মঠের পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলার পথে আমাদের ঘোড়ার খুড়ের শব্দ আর হৃৎস্পন্দনের লয় যেন এক হয়ে গিয়েছিল। ঘোড়ার পা কোথাও এদিক ওদিক পড়ে ছন্দপতন হলে হৃদস্পন্দন যেন একমুহূর্তের জন্যে থমকে যাচ্ছিল।

আমাদের লক্ষ্য ছিল ২০০ মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে সিকিমের দ্রোমো, স্থানীয় উচ্চারণে যাকে ত্রোমো বলা হয়। এই যাত্রায় কোনও দুর্ঘটনার সম্মুখীন না হলে কমপক্ষে দশদিন লাগে। কিন্তু দিন দুয়েক পরেই জং গ্রামে পৌঁছুতেই আমাদের সামনে একটি বিপত্তি আসে। সেখানে গানদেন, দ্রেপং এবং সেরা মঠের অনেক ভিক্ষু শীতকালীন বার্ষিক বিতর্ক- শিবিরের জন্য জড়ো হয়েছিলেন। তাঁরা আমাদের দলের আকার দেখে বুঝে নেয় যে এটি সাধারণ দল নয়। একসঙ্গে প্রায় দু'শজন অশ্বারোহী - যার মধ্যে পঞ্চাশ জন মহা আধিকারিক এবং প্রায় পঞ্চাশটি খচ্চরের পিঠে বোঝাই মালপত্র। ভিক্ষুরা ঠিক অনুভব করেন যে এই দলের মধ্যে আমারও থাকা উচিত। ভাগ্যক্রমে আমি দলের সামনে থাকলেও ছদ্মবেশের কারণে কেউ আমাকে চিনতে পারেনি। তাই আমরা বিনা বাধায় এগিয়ে গেলাম। তবে সামান্য এগিয়ে পেছন ফিরে দেখি সন্ন্যাসীরা খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন এবং তাঁদের চোখে জলও রয়েছে। কয়েক মুহুর্ত পরে তাঁরা আমার পেছন পেছন ঘোড়া চালিয়ে আসা লিং রিনপোচেকে চিনতে পেরে আটকে দেন। পেছন ফিরে শুনি যে তারা আমাকে তাঁদের সঙ্গে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করছেন। উপস্থিত সকলেই তখন চরম উত্তেজনায় থরথর। পবিত্র রক্ষাকর্তা হিসাবে তাঁদের আমার প্রতি আমার গভীর বিশ্বাস ছিল যে তিনি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারেন না। লিং রিনপোচে তাঁদের বোঝাতে থাকেন যে আমরা অনেক দিনের জন্যে যাচ্ছি না, অবশেষে তাঁরা আমাদের যেতে দইতে রাজি হন। তাঁরা মাটিতে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়তে শুরু করেন এবং আমাদের কাছে প্রার্থনা করেন যাতে আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসি।

এই ঘটনার পরে, রাস্তায় আর কোনও বাধা আসে নি। আর আমি ছদ্মবেশে এগিয়ে যেতে থাকি, যেখানেই সুযোগ পেয়েছি একজন সাধারণ যাত্রীর মতন পথচারী মানুষের সঙ্গে কথা বলতে থাকি। বুঝতে পারছিলাম যে দেশের সাধারণ নারীপুরুষের জীবনের সত্য জানার মতন এর থেকে ভাল সুযোগ আর পাব না, তাই আমি যথাসম্ভব এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে থাকি। এভাবে আমার শাস্নে তাঁদের উপর হওয়া বেশকিছু ছোটখাটো অন্যায় সম্পর্কেও জানতে পারি। মনে মনে ভাবি, সময় পেলেই যত দ্রুত সম্ভব এই সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা করব।

প্রায় এক সপ্তাহ সফরের পর আমরা তিব্বতের চতুর্থ বড় শহর গ্যায়ান্তসে পৌঁছোই। এখানে ছদ্মবেশে থাকা সম্ভব ছিল না। শত শত মানুষ আমাদের স্বাগত জানায়। শীতে জবুথবু ভারতীয় বাণিজ্য মিশনের অপরিপাটি পোশাক পরিহিত কিন্তু উত্সাহী সৈন্যরা আমাকে সম্বর্ধনা জানান। কিন্তু আমাদের হাতে বেশি সময় ছিল না, তাই এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা এগিয়ে যাই। আর ঠিক পনের দিনের যাত্রা শেষে ১৯৫১ সালের জানুয়ারির গোড়ায় দ্রোমো পৌঁছে যাই।

আমরা সবাই খুব ক্লান্ত ছিলাম। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব উত্তেজিত ছিলাম। এই জায়গাটিকে শহর না বলে বেশ কিছু পাশাপাশি গ্রামের সমষ্ঠি বলা যায়। কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশ অসাধারণ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ন’হাজার ফুট উঁচুতে যেখানে আমো-চু উপত্যকা দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছে, দ্রোমো ঠিক সেই সমতল জুড়ে অবস্থিত। উপত্যকার বুক চিরে একেবেঁকে বয়ে গেছে একটি খরস্রোতা, দ্রোমোর গ্রামগুলি এই নদীর দুই তীরের সমতল ও পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। দ্রোমোর যে কোনও জায়গা থেকে দিন রাত এই খরস্রোতার কলকল শোনা যায়। কোথাও আবার নদীতীর থেকেই উপরে উঠে সোজা পাহাড়। কোথাও এত উঁচু উঁচু পাহাড়ের মতন পাথর রয়েছে, যেগুলি দেখলে মনে হয় উজ্জ্বল নীল আকাশে ঢুকে গেছে। তারপরই রয়েছে হিমালয়ের উত্তুংগ পর্বতশৃঙ্গগুলি, যেগুলির জন্য তিব্বত যুগ যুগ ধরে এত সম্মান এবং কষ্ট দুটোই পেয়ে আসছে।

দ্রোমোতে অসংখ্য দেবদারু আর অনেক নানারঙের ফুলগাছ রয়েছে যা চারপাশে দূর-দূরান্তে বাতাসে সুরভি ছড়াতে থাকে। পরে জেনেছি যে সেখানকার জলবায়ুঅত্যন্ত আর্দ্র। ভারতীয় সমভূমির সঙ্গে যুক্ত থাকায় এই অঞ্চলে বর্ষার বৃষ্টিপাতও হয়। তবে সেই দিনগুলিতে প্রায়ই রোদ উঠেছে আর প্রতিদিনই গভীর মেঘের মধ্যে দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে যাওয়ার সময় সূর্য একটি রহস্যময় আলো দিয়ে নিকটবর্তী উপত্যকাগুলিকে আলোকিত করে যায়। আমি ইচ্ছে করে যখন এই পাহাড়গুলি সবুজ রঙের গাছপালা এবং নানা রঙের ফুল দিয়ে ভরে উঠবে, তখন কোনও সহজেই আরোহণযোগ্য পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে হবে, কিন্তু এখন তো শীতের অনেক মাস বাকি, গ্রীষ্ম আসতে সময় লাগবে।

দ্রোমো পৌঁছানোর পরে আমি প্রথমে একজন স্থানীয় আধিকারিকের বাড়িতে থাকতে শুরু করি। লিং রিনপোচের কাছে জানতে পারি যে এতবছর ধরে এই ভদ্রলোক আমাকে নিয়মিত খেলনা এবং আপেল পাঠাতেন। কয়েকদিন পর আমরা দ্রোমোর কাছেই পাহাড়ের কোলে গড়ে তোলা টুংখার নামে একটি ছোট্ট মঠে থাকার জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়। এ যেন আমার অর্ধেক ইচ্ছাপূরণ। এখান থেকে পুরো দ্রোমো উপত্যকাটি দেখা যায়। যদিও এখন সেটি পুরোটাই বরফে ঢাকা। কিছুদিনের মধ্যেই আমরা এখানে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে যাই এবং আমার নিয়মিত দিনচর্যা যেমন - প্রার্থনা, ধ্যান, ভ্রমণ এবং অধ্যয়ন - শুরু হয়ে যায়। যদিও আমার মধ্যে তখনও আরও একান্ত নিজস্ব সময় পাওয়ার আকাঙ্খা ছিল, আর এখানে লাহসার মতন অনেক সুযোগ সুবিধা না পেয়ে প্রায়ই সেগুলির অভাব বোধ করতাম, কিন্তু ঐ দিনগুলিতে তার থেকেও অনেক বেশি করে অনুভব করতে শুরু করি যে আমার মধ্যে কিছু পরিবর্তন এসেছে। এর একটি কারণ হ'ল লাহসায় আমাকে প্রতিদিন অনেক আনুষ্ঠানিকতা অনুসরণ করতে হতো এখানে সেগুলি থেকে মুক্ত ছিলাম, যা আমাকে অনেকটা স্বাধীনতার অনুভব এনে দিয়েছিল। যদিও এখানে আমার বাল্যসঙ্গী সাফাইকর্মী বন্ধুদের অভাব কুড়ে কুড়ে খেত, কিন্তু আমার উপর যে নতুন নতুন দায়িত্ব বর্তায় সেগুলি ক্রমে সেই অভাব পূরণ করে দেয়। আমার উপর এই দক্ষিণযাত্রার আর একটি বড় প্রভাব হল আমার পড়াশুনায় মনোযোগ বৃদ্ধি, আরও বেশি পরিশ্রম করা এবং যতটা সম্ভব শেখার ইচ্ছা গড়ে ওঠে। এই কৃতিত্ব আমার প্রতি আমার দেশবাসীর অটল বিশ্বাসের, এই অনুভব থেকেই আমি আরও বেশি যোগ্য ব্যক্তি হয়ে উঠতে চেয়েছি।

দ্রোমো পৌঁছে যাওয়ার পরে একটি বিশেষ ঘটনা হ'ল সেখানে শ্রীলঙ্কা থেকে আসা একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী গৌতম বুদ্ধের একটি প্রাচীন অবশেষ আনুষ্ঠানিক ভাবে আমার হাতে তুলে দেন। সেটি গ্রহণ করে আমার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস আর বেড়ে যায়।

লুখাংগ্বা এবং লোবসাং তাশিকে লাহসায় ছেড়ে আসার পর, প্রধান প্রতিহারী, লিং রিনপোচে (বর্তমানে আমার বরিষ্ঠ শিক্ষক), এবং বরিষ্ঠ সেনশাপ ত্রিজাঙ রিনপোচে, যাকে আমার কনিষ্ঠ অধ্যাপক নিয়োগ করা হয়েছিল, তাঁদের নিয়েই গড়ে ওঠে নতুন কার্যকরী কাশাগ।আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা তাক্তসের রিনপোচেও এখানে চলে আসেন। তিনি কয়েক সপ্তাহ আগে ভারতে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে আমাদের এখানে আসার খবর পেয়ে দ্রোমোয় এসেছেন।

এখানে এসে তাঁর মাধ্যমেই আমরা প্রথম খারাপ সংবাদ পাই যে, আমি লাহসা ছাড়ার আগে যে সমস্ত প্রতিনিধিদের বিদেশে পাঠানো হয়েছিল তার মধ্যে শুধু যিনি চীনে গেছেন তিনিই গন্তব্যে পৌঁছেছেন। বাকি প্রতিনিধিদের গন্তব্য দেশগুলি ফেরত পাঠিয়েছে। এই খবরে কাশাগের সমস্ত সদস্য অবাক। তিব্বতের সর্বদাই ভারত ও নেপালের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। এই দুটি আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। ব্রিটেনের ক্ষেত্রে বলা যায়, কর্নেল ইয়ংহাজব্যান্ডের বিখ্যাত তিব্বত অভিযানের ফলে প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে ব্রিটিশ ট্রেড মিশন কার্যকর ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেও, প্রবীণ ব্রিটিশ আধিকারিক হিউ রিচার্ডসন দীর্ঘকাল এটি চালিয়ে যান। সুতরাং, এটা বিশ্বাস করা এখন কঠিন ছিল যে ব্রিটিশ সরকার তিব্বতের উপর চীনের কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে। মনে হয়, তাঁরা অতীতে ভুলে গিয়েছে, নাহলে ইয়ংহাজব্যান্ড যখন তিব্বত সরকারের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, তখন তিনি একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে মান্যতা দিয়েই স্বাক্ষর করেছিলেন। ১৯১৪ সালে যখন তিনি সিমলা সম্মেলন আয়োজন করেছিলেন, তখন তিব্বত এবং চীন উভয়েই স্বাধীন দেশ হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছিল। তাছাড়াও, ব্রিটিশ এবং তিব্বতের জনগণের মধ্যে সবসময় সুসম্পর্ক ছিল। আমার দেশের নারী-পুরুষের দৃষ্টিতে ব্রিটিশরা ছিলেন ভদ্র, বিনয়ী, ন্যায়পরায়ণ এবং বিনোদন-প্রেমী মানুষ, তিব্বতী সমাজে এই গুণাবলীর কদর সবচাইতে বেশি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দেখেছি, ১৯৪৮ সালে, ওয়াশিংটন আমাদের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের স্বাগত জানিয়েছিল এবং তাঁদের উপ-রাষ্ট্রপতিও তাঁদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। অর্থাৎ, এখন তাঁরাও নীতি পরিবর্তন করেছেন শুনে আমরা অবাক। এই নীতি পরিবর্তনের অর্থ কী, তা নিয়ে ভেবে আমি খুব দুঃখিত হই। এর অর্থ হল কম্যুনিস্ট চীনের সমস্ত আগ্রাসন আমাদের একাই প্রতিরোধ করতে হবে!

কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সমস্ত প্রতিনিধি দল ফিরে আসার পরে, পরবর্তী ঘটনা ঘটে, আমরা চামডোর গভর্নর নগাবংবাংগ জিগমের একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন পাই। সেই প্রতিবেদন অনুসারে, এখন চামডোর বেশিরভাগ এলাকাই চীনা সেনাবাহিনী দখল করে নিয়েছে। এই প্রতিবেদনটি তিনি একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর হাতে লাহসায় পাঠিয়েছেন। আমাদের দুই প্রধানমন্ত্রী লোবসং তাশি এবং লুখাংগ্বা নিজেদের মন্তব্য সহ এই প্রতিবেদনটি আমার কাছে পাঠিয়েছেন। এতে অত্যন্ত যন্ত্রণাক্লিষ্ট ভাষায় অসহায়তা ব্যক্ত করে চীনা হুমকিটিকে বিশদে ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে যে শীঘ্রই যদি কোনও চুক্তি না হয় তবে তাঁরা দ্রুত লাহসা আক্রমণ করবে।যদি এটি ঘটে, বিশাল সংখ্যক তিব্বতী মারা যাবে, আমি তা কোনভাবেই চাই না!

নগাবংবাংগ জিগমের মতে, উভয় দেশের মধ্যে দ্রুত কূটনৈতিক বার্তালাপ ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই।যদি তিব্বত সরকার এর জন্য প্রস্তুত থাকে এবং যদি তাঁরা কিছু অর্থ বরাদ্দ করে পাঠায় তাহলে তিনি নিজেই বেজিংয়ে যেতে এবং আলোচনা শুরু করতে প্রস্তুত।আমি লাহসায় লোবসং তাশি এবং লুখাংগ্বার সঙ্গে যোগাযোগ করেতাঁদের মতামত চাই।তাঁরা বলেন যে এই কূটনৈতিক বার্তালাপটি লাহসায় হওয়া উচিত। কিন্তু পরিস্থিতি খুব খারাপ বলে তাঁরা নগাবংবাংগ জিগমেকে বেজিংয়ে পাঠাতে রাজি হয়ে যান।

আমার সরকারের অন্যতম নামী প্রশাসক নগাবংবাংগ জিগমে দেশের স্বার্থে কোনও দ্বিধা প্রকাশ না করায় খুশি হই, কিন্তু তাঁকে একা চীনের রাজধানীতে পাঠাতে মন চায় না। তাই আমি তাঁর সঙ্গে যাওয়ার জন্য দ্রোমো থেকে দু'জন আর লাহসা থেকে দু'জন অভিজ্ঞ চীন বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাকে নিযুক্ত করি। আমি আশাবাদী যে তাঁরা চীনা সরকারকে স্পষ্ট করে বলবেন যে তিব্বত তথাকথিত 'মুক্তি' চায় না, তিব্বত মহান প্রতিবেশীর সঙ্গে স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়।

ইতিমধ্যে প্রকৃতির বুকে বসন্তের আগমন হয়, এবং প্রকৃতির রঙ ফুটতে শুরু করে।দ্রোমোর পাহাড়গুলি বুনো ফুল দিয়ে ভরে ওঠে, ঘাসের রঙ আগের চেয়ে আরও গভীর সবুজ হয়ে ওঠে এবং প্রতিদিন নতুন - নতুন আশ্চর্য সুরভি বাতাসকে সুগন্ধে ভরিয়ে দেয় - কখনও জুঁই, কখনও মধুমালতী, এবং কখনও কখনও ল্যাভেন্ডারের সুবাস শরীর ও মন সতেজ করে তোলে। আমার মঠের ঘরে বসে নীচে প্রবাহিত নদীর তীরে আমি রোজই কৃষকদের ভেড়া, ইয়াক এবং জোমো পশু চরাতে দেখি। প্রায় রোজই মানুষকে ছোটো ছোটো দলবেঁধে নদীতীরে আসতে আর আগুন জ্বেলেকিছু রান্না করে খেতে দেখে আমার ঈর্ষা হয়।

একদিন সকালে থাকতে না পেরে উত্তেজনার বশে আমি লিং রিনপোচের কাছে নদীতীরে যাওয়ার অনুমতি এবং ছুটি চাই।সম্ভবত তিনি আমার উত্তেজনার কারণ খুব ভালভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।তাই তক্ষুণি আমার ছুটি মঞ্জুর করেন।আমি মনের আনন্দে একরকম লাফাতে লাফাতে পাহাড় থেকে সমতলে নামি। আর তারপর নদীতীরে মুক্ত বিহঙ্গের মতন ঘুরে বেড়াই। এভাবে ছাড় পেয়ে কয়েকদিন ধরে যতক্ষণ খুশি নদীতীরে ঘুরে বেড়াই। এত ভাল লাগে যে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না! এমন আনন্দ সারা জীবনে আর কখনও পেয়েছি কিনা তা আমার মনে নেই।এভাবে হাঁটতে হাঁটতে একদিন এমনকি স্থানীয় বন মঠ দেখতে চলে গিয়েছিলাম।ওই নির্মল আনন্দের মুহূর্তগুলি ছড়ে দিলে দ্রোমোর দিনগুলিতে সবসময় একটি দুঃখবোধ মনকে কুরে কুরে খেত যে শীঘ্রই হয়তো খারাপ সময় আসছে।এখন যে কোনও সময় বেইজিং থেকে নগাবংবাংগ জিগমের বার্তা আসতে পারে।আমি অর্ধেক আশা করেছিলাম যে সংবাদটি খারাপ হবে, তবে সেটি যে এতটা খারাপ হবে, কখনই তা কল্পনাও করি নি।

দ্রোমোমঠে আমার কাছে একটি পুরাতন বুশ রেডিও ছিল যা ছয় ভোল্টের ব্যাটারিতে চলতো। আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় বেজিং রেডিওর তিব্বতি অনুষ্ঠানেরসম্প্রচার শুনতাম।মাঝে মাঝে কোনও আধিকারিক আমার সঙ্গেবসে শুনতেন, কিন্তু বেশিরভাগ সময় আমি একাই শুনতাম।বেশিরভাগ সম্প্রচারে 'মহান পিতৃভূমি' নিয়ে এত সুন্দরভাবে অনুষ্ঠান সম্প্রচার হতো যে আমি নিজেও তাঁদের কথায় প্রভাবিত হতাম। এর মধ্যে চীনের নিরন্তর শিল্পে অগ্রগতি এবং নাগরিকদের সমান অধিকারের কথা বলা হতো। এই সুফল আমার কাছে শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক উভয় অগ্রগতির সঠিক সমন্বয় বলে মনে হতো। কিন্তু একদিন সন্ধ্যায় আমি যখন একা বসে এই অনুষ্ঠানটি শুনছিলাম, পুরোপুরি ভিন্ন ধরণের একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার হল! একটি কঠোর বেদনাদায়ক কণ্ঠে ঘোষণা করা হল যে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকার এবং তিব্বতের 'স্থানীয় সরকার'-এর প্রতিনিধিরা তিব্বতের সম্পূর্ণ মুক্তির জন্য সতেরোটি সূত্রবিশিষ্ট একটি 'চুক্তি' স্বাক্ষর করেছে।

আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ইচ্ছে করে যে ছুটে বাইরে গিয়ে সবাইকে ডেকে এনে এই সংবাদটি শোনাই, কিন্তু বাস্তবে পাথরের মতন, একটি জড়পদার্থের মতন বসে থাকি। রেডিওর ঘোষক বলে যাচ্ছিলেন, বিগত একশো বছর বা তারও বেশি সময় ধরে 'আক্রমণাত্মক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি তিব্বতে প্রবেশ করেছে এবং বিভিন্ন ধোঁকাবাজি ও যন্ত্রণাদায়ক পদক্ষেপ নিয়েছে। …এই পরিস্থিতিতে তিব্বতের সাধারণ মানুষ ও দেশের স্বাধীনতা দাসত্ব ও দুর্ভোগের গভীরে ডুবে রয়েছে। এই ধরনের অবিশ্বাস্য এবং কাল্পনিক কথাবার্তা শুনে আমার শরীরে জ্বর আসতে শুরু করে।

কিন্তু তারপর ঘোষক এর থেকেও খারাপ কথা বলা শুরু করেন। তিনি বলেন, প্রথম চুক্তিসূত্র অনুসারে তিব্বতের বাসিন্দারা সংগঠিত হয়ে আক্রমণাত্মক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিকে দেশ থেকে তাড়াবেন। তিব্বতের জনগণ মাতৃভূমির বিশাল পরিবার - গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সঙ্গে একসঙ্গে বসবাস শুরু করবে। একথার মানে কি? তিব্বতের ভূমিতে পা রাখা সর্বশেষ বিদেশী সেনাবাহিনী ছিল মাঞ্চু সেনা, যারা ১৯১২ সালে তিব্বতে এসেছিল। আমি যতদূর জানি, এখন নিশ্চিতভাবেই জানি - তিব্বতে তখন খুব কম ইউরোপীয় মানুষ ছিলেন। আর তিব্বতিরা 'তাঁদের মাতৃদেশে ফিরে' যাওয়ার ধারণাটি ছিল চীনের কমিউনিস্ট সরকারের নির্লজ্জ মিথ্যে প্রচারের একটি নমুনা। তিব্বত কখনও চীনের অঙ্গ ছিল না। সত্যটি, যা আমি আগেই বলেছি, তিব্বত প্রাচীন কাল থেকেই চীনের অনেক বড় অংশ নিজেদের বলে দাবি করে আসছে! এগুলি ছাড়াও উভয় দেশের মানুষ জাতিগত ও প্রজাতির দিক থেকে একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। আমরা উভয়ই সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত স্বতন্ত্র ভাষায় কথা বলি এবং তিব্বতি ভাষার স্ক্রিপ্টও চীনা লিপির সাথে একেবারেই মেলে না। পরবর্তী কালে আন্তর্জাতিক আইনজীবি কমিশন তার প্রতিবেদনে যেমন বলেছিল:

১৯১২ সালে চীনাদের তাদের দেশ থেকে বহিষ্কার নিয়ে তিব্বতের পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থে স্বতন্ত্র হিসাবে বিবেচিত হতে পারে ... সুতরাং এটা নিবেদন করা হচ্ছে যে ১৯১১-১২ সালের ঘটনা থেকে তিব্বতকে সম্পূর্ণরূপে সার্বভৌম এবং তথ্য ও আইন উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে চীনা নিয়ন্ত্রণ থেকে পুনঃ স্বতন্ত্র দেশ বলে বলে মেনে নেওয়া উচিত

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়টি হ'ল নগাবংবাংগ জিগমেকে আমার পক্ষে কোনও বিবৃতিতে স্বাক্ষর করার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। তাঁর কেবল আলোচনার অধিকার ছিল। আমার রাষ্ট্রীয় সিল আমার কাছে দ্রোমোতেই নিয়ে এসেছি। তার মানে হ'ল তিনি চাপে পরে সইসাবুদ করতে বাধ্য হয়েছেন। সত্যি ঘটনাটি আমরা আরও কয়েক মাস পরে জানতে পারি। এদিকে, বহুবার পুনরাবৃত্ত রেডিওর ঘোষণা ছাড়া – বাস্তবে কী হচ্ছে তা আমাদের জানার কোনও উপায় ছিল না। এই ঘোষণাপত্রের বহু পুনরাবৃত্তির পাশাপাশি কমিউনিজমের সুবিধাগুলি, চেয়ারম্যান মাওয়ের মহত্ত্ব, গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের বিস্ময় নিয়ে ঢাক পেটানোর পর এখন চীনের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সাথে সাথে তিব্বতের জনগণ এই সমস্ত স্বাচ্ছন্দ্য পেতে পারে, তাই তাঁদেরকে অত্যন্ত ভাগ্যবান বলেও ঘোষণা করা হচ্ছিলো। যে কোনও তিব্বতবাসীর কাছে এসব কথা তিব্বত সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচায়ক কিন্তু সন্ত্রস্থ করার জন্য যথেষ্ট।

সতের-সূত্রী তথাকথিত চুক্তির ধারাগুলি ছিল ভয়ানক। দ্বিতীয় সূত্রে ঘোষণা করা হয়েছিল যে 'তিব্বতের স্থানীয় সরকার পিপলস লিবারেশন আর্মিকে তিব্বতে ঢুকতে সাহায্য করবে তাঁরা তিব্বতে জাতীয় সুরক্ষা জোরদার করতে পারে’। তার মানে, আমার ধারণা অনুসারে, আমাদের বাহিনী অবিলম্বে আত্মসমর্পণ করবে। অষ্টম সূত্রে এই বিষয়টিকে আরও জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে তিব্বতি সেনাবাহিনীকে চীনা সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে - যেন এই অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করার পথে তাঁরা এগুতে পারে! তারপর, চৌদ্দতম সূত্রে আমাদের বলা হয়েছিল যে এরপর থেকে, তিব্বতের বিদেশ বিষয়ক অধিকারগুলি অস্বীকার করা হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ সূত্রগুলির মধ্যবর্তী ধারাগুলিতে তিব্বতকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে তিব্বতের ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় রাখা হবে। দালাই লামার অবস্থান এবং দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা অপরিবর্তিত ও নিরাপদ থাকবে। এই সমস্ত ঘোষণার মধ্যে একটি বিষয় খুব স্পষ্ট ছিল যে, এর পর থেকে বরফের দেশ তিব্বতকে চীন প্রজাতন্ত্রের আদেশে সমস্ত কাজ করতে হবে।

এই পরিস্থিতির বাস্তবতা আমাদের কাছে প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে অনেক শুভাকাংখী, বিশেষ করে কলিকাতা থেকে তক্তসার রিনপোচে আমাকে একটি চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন যে আর দেরি না করে আমাকে তিব্বত ছেড়ে ভারতে চলে যেতে হবে। তাঁর যুক্তি হল, চীনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মিত্রদের সাহায্য নিতে হবে। আমি যখন তাদের স্মরণ করাই যে ভারত, নেপাল, গ্রেট ব্রিটেন এবং আমেরিকাতে পাঠানো আমাদের প্রতিনিধিরা এই লক্ষ্যে ব্যর্থ হয়েছেন, তখন তাদের জবাব ছিল যে এই দেশগুলি আমাদের পরিস্থিতি কতটা গুরুতর তা অনুভব করেনি, এখন নিশ্চয়ই তাঁরা এটা বুঝতে পারবে। তাঁরা অবশ্যই আমাদের সাহায্য করতে প্রস্তুত হবে। তক্তসার রিনপোচে লেখেন, আমেরিকা কমিউনিস্ট সম্প্রসারণবাদের বিপক্ষে এবং এজন্যই তাঁরা কোরিয়ায় লড়াই করছে। আমি তাঁর যুক্তি বুঝতে পারি, তাঁরা একটি ফ্রন্টে লড়াই করছে, কিন্তু এটা বুঝতে পারিনা যে আমাদের জন্য তাঁরা কেন দ্বিতীয় ফ্রন্ট খুলতে চাইবে।

কিছুদিন পর আমরা আমাদের বেজিং প্রতিনিধিদল থেকে বেইজিংয়ে একটি দীর্ঘ টেলিগ্রাম পাই। এতে সেসব কথারই পুনরাবৃত্তি ছিল যেগুলি ইতিমধ্যেই আমরা রেডিওতে শুনেছি। আমরা অনুভব করেছি যে নগাবংবাংগ জিগমেকে সত্য বলতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। সেই ঘটনার অনেকদিন পর সম্প্রতি সেই প্রতিনিধি দলের কিছু সদস্য তাদের স্মৃতিচারণে লিখেছেন যে কীভাবে তাদের সাথে 'চুক্তি' স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়েছিল এবং তাঁরা যে তিব্বত সরকারের সীলমোহর ব্যবহার করেছিল সেটি চীন সরকারের দেওয়া জাল সীলমোহর ছিল। কিন্তু আমরা তখন এই সত্যটি নগাবংবাংগ জিগমের টেলিগ্রামের বয়ান থেকে কল্পনা করতে পারি। এই টেলিগ্রাম থেকেই জানতে পারি যে তিব্বতের নতুন গভর্নর - জেনারেল, জেনারেল চিয়াং চিন উ, শিগগিরই ভারত হয়ে দ্রোমো পৌঁছে আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন।

এখন অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই করা যাবে না। এদিকে গান্দেন, দ্রেপুং ও সেরা - এই তিনটি বড় বড় বিহারের সভাপতি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তাঁরা সতের-সূত্রী চুক্তি সম্পর্কে জানতে পেরে আর দেরি না করে আমাকে লাহসায় ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তাঁরা বলেন, তিব্বতের মানুষ এই বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। তাঁরা দ্রোমোয় আসার আগে লুখাংগ্বা এবং লোবসং তাশির বার্তা পেয়েছেন এবং তাঁরাও এটিও চান। কিছুদিন পর আমি আবার তক্তসার রিনপোচের কাছ থেকে একটি চিঠি পাই। তিনি কলকাতায় আমেরিকান বাণিজ্য মিশনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন এবং তাঁরা তাকে আমেরিকা যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। এই চিঠিতে তিনি আবার আমাকে ভারতে পৌঁছানোর অনুরোধ করেন এবং বলেন যে আমেরিকান কর্তৃপক্ষ তিব্বতের জন্য অত্যন্ত উদ্বিগ্ন এবং অবিলম্বে একটি সংযোগ স্থাপন করতে চায়। তিনি পরামর্শ দেন যে আমি সেখানে পৌঁছে গেলে দুই দেশের মধ্যে সহায়তার চুক্তি হবে। চিঠির শেষে, আমার দাদা আবার অনুরোধ করেন যে আমাকে শীঘ্রই ভারতে পৌঁছে দেওয়া উচিত। কারণ চিনা প্রতিনিধি দল দ্রোমোর পথে কলকাতায় পৌঁছেছে। এর স্পষ্ট অর্থ হ'ল আমি যদি তাত্ক্ষণিকভাবে না সরে যাই তাহলে খুব দেরী হয়ে যাবে।

প্রায় একই সময়ে, আমি হানরিক হেরারের কাছ থেকেো একটি চিঠি পাই, যাতে আমাকে একই কথা বলা হয়েছে। আমি লাহসা ছাড়ার কয়েকদিন আগে তিনি কালিম্পংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। তিনি আমাকে স্পষ্টভাবে পরামর্শ দেন যে আমার ভারতে আশ্রয় নেওয়া উচিত এবং সেখানে যেতে হবে এবং আমার কয়েকজন কর্মকর্তাও এই প্রস্তাব সমর্থন করেন। কিন্তু লিং রিনপোচে বিশ্বাস করেন যে আমার এমন করা উচিত হবে না।

এভাবে আমি তখন একটা দোটানায় পড়ে যাই। আমি যদি আমার দাদার চিঠিকে গুরুত্ব দিই তাহলে তার মতে, আমাদের বিদেশি সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে, কিন্তু আমার দেশবাসীর কাছে এর অর্থ কী হবে? আমি চীনা প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা না করেই চলে যাব? আর যদি আমি চীনাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য তৈরি থাকি তাহলে আমাদের নতুন বন্ধুরা কি আমাদের সঙ্গে দাঁড়াতে পুরোপুরি প্রস্তুত থাকবে? এই সমস্ত বিষয় বিবেচনা করে আমার সামনে দুটি প্রশ্ন প্রবল হয়। প্রথমটি হ'ল আমেরিকা বা অন্য কারও সাথে চুক্তির সুনিশ্চিত ফলাফল হবে যুদ্ধ - যার অর্থ রক্তপাত। দ্বিতীয়টি হ'ল আমেরিকা যদিও খুব শক্তিশালী দেশ কিন্তু সেটি কয়েক হাজার মাইল দূরে। এর বিপরীতে, চীন আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী এবং যদিও এটি সামরিক শক্তিতে আমেরিকার তুলনায় অনেক পিছিয়ে, কিন্তু এর জনসংখ্যা বিশাল। সুতরাং, সামরিক যুদ্ধের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে অনেক বছর সময় লাগতে পারে।

এ ছাড়া আমেরিকা একটি গণতান্ত্রিক দেশ এবং আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন ছিল যে সেখানকার মানুষ যুদ্ধে মৃত্যুর বিষয়টি মেনে নেবে। এটা সহজেই কল্পনা করা যায় যে এমন এক দিন আসবে যখন তিব্বতিরা আবার স্বাধীন হবে। তারপরেও ফলাফল একই হবে, চীন তার স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে যেতে পারবে, এবং এরই মধ্যে অগণিত মানুষ, তিব্বতি, চীনা এবং আমেরিকানরা নিরর্থক মৃত্যুর শিকার হবে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিই যে সেখানে থেকে চীনা জেনারেলের অপেক্ষা করবো! সে তো একজন মানুষই!

১৯৫১ সালের ১৬ জুলাই চীনা প্রতিনিধি দল দ্রোমোতে এসে পৌঁছোয়। একজন বার্তাবাহক ছুটে এসে মঠটিতে এসে জানান যে জেনারেল আসছেন। এই খবরটি শুনে আমি একসঙ্গে উত্তেজিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। এই মানুষগুলি দেখতে কেমন হবে? আমার মনে হয়, তাঁদের মাথায় নিশ্চয়ই শিং থাকবে। আমি বারান্দায় একটি টেলিস্কোপ নিয়ে দাঁড়িয়ে শহরের দিকের বড় দালানগুলির দিকে দেখতে থাকি। আমার মনে আছে, সেদিন আকাশ পরিষ্কার ছিল, যদিও বর্ষার মাঝামাঝি সময় ছিল, যেখানে যেখানে রোদ ছিল সেই জায়গা থেকে জলীয় বাষ্পের ধোঁয়া দেখতে পাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমি একদল মানুষকে মঠের দিকে আসতে দেখি। আমার আধিকারিকদের একটি দল মঠের দিকে আসছিলেন, তাদের সঙ্গে ছিলেন তিন জন খাকি স্যুট পরিহিত মানুষ। তিব্বতি আধিকারিকদের লাল এবং সোনালি সিল্কের জাঁকজমকপূর্ণ পোশাকের পাশে চীনা সেনা আধিকারিকদের পোশাক খুবই ম্লান দেখাচ্ছিল।

আমাদের আলোচনা অত্যন্ত আনুষ্ঠানিক এবং আবেগহীন ছিল। জেনারেল চিয়াং চিন-উ আমাকে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেন যে আমি সতের-সূত্রী চুক্তি সম্পর্কে শুনেছি কিনা! আমি ছোটো করে 'হ্যাঁ' বলি। তখন তিনি আমাকে এর একটি অনুলিপি দেন, এর সঙ্গে আরও দুটি নথি ছিল, তিনি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেন। আমি দেখতে পাই যে তাঁর হাতে একটি সোনার রোলিক্স ঘড়ি রয়েছে। এই সহায়ক নথির একটি ছিল তিব্বতি সেনাবাহিনী সম্পর্কে। দ্বিতীয়টিতে, আমাকে বলা হয়েছে যে আমি প্রবাসে যেতে চাইলে কী হবে! এটিতে লেখা আছে, আমি শীঘ্রই নিশ্চিত হব যে চীনারা আমাদের কাছে সত্যিকারের বন্ধুত্বের জন্য এসেছে। তারপর আমি আবার দেশে ফিরে যেতে চাইলে সেই পরিস্থিতিতেও আমাকে স্বাগত জানানো হবে। সুতরাং নির্বাসনের কোনও মানে নেই।

তারপর, জেনারেল চিয়াং আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, আমি কখন লাহসায় ফিরতে চাই। আমি উত্তর দিই, 'খুব শীঘ্রই', যার কোনও অর্থ নেই। এবং আমি যতটা সম্ভব বিরক্তি প্রদর্শন করে যাই। তাঁর প্রস্তাব থেকে এটা স্পষ্ট ছিল যে তিনি তাঁর সঙ্গেই আমাকে লাহসায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান। যাতে দুজনে একসঙ্গে শহরে প্রবেশ করা যায়, যাঁর প্রতীকী অর্থ একটি অন্যরকম ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে পারে। শেষ পর্যন্ত, আমার আধিকারিকরা এই পরিকল্পনা এড়াতে সক্ষম হন এবং আমি লাহসায় ফেরার এক-দু'দিন পরেই লাহসার উদ্দেশ্যে রওনা হন।

সুতরাং আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া প্রায় তেমনই ছিল যেমনটি আমার নিজের এবং কাশাগের প্রত্যাশা ছিল। আমাদের সমস্ত সন্দেহ ও উদ্বেগ সত্ত্বেও, আমাদের বৈঠকে এটা স্পষ্ট হয়, এই ব্যক্তিটি আমাদের শত্রু হলেও, আমার এবং অন্যদের মতো একজন মানুষ। এই অনুভব আমার উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে এবং এটি আমার জন্য একটি পাঠও ছিল।

জেনারেল চিয়াংয়ের সঙ্গে দেখা করার পরে একথা ভেবে খুশি হই যে আমি যখন খুশি লাহসায় ফিরে আসতে পারব। সেজন্যে দ্রুত আমার ফিরে আসার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। সমস্ত আধিকারিকরাই আমার সঙ্গে ফিরে যাবেন। মাসের শেষে আমরা রওয়ানা দিলাম। এবার কোনও ছদ্মবেশ এবং গোপনীয়তার প্রয়োজন ছিল না, তাই আগের তুলনায় অনেক বেশি মর্যাদা রক্ষা করে বিশাল কাফেলা এগিয়ে গেল। পথে, প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রামে, আমি সর্বসাধারণের সামনে প্রকাশ্যে কিছু বক্তব্য রেখে তাঁদের মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা করতাম। তিব্বতে কী ঘটছে, বিদেশীরা কীভাবে আমাদের উপর আক্রমণ করেছে, কিন্তু কীভাবে তাঁরা নিজেদেরকে আমাদের বন্ধু বলছে তা বলার সুযোগ পাই। পাশাপাশি, বড়ো জমায়েতগুলিতে আমি কিছু ধর্মগ্রন্থও পাঠ করতাম, যেগুলি বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত এবং তুলনামূলক ব্যাখ্যা করতাম। এই প্রক্রিয়ার সাফল্য এত হাতেনাতে পেয়েছিলাম যে আমার দুই শিক্ষক এবং কাশাগের সদস্যরা এতে খুব খুশি হয়েছিলেন। সর্বত্র একটি ইতিবাচক আবহ ফিরে আসে। এই অভিজ্ঞতা আমাকেও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। এই প্রত্যয় থেকেই আজ অবধি আমি এই নিয়মটি অনুসরণ করে চলেছি। এইভাবে ধর্মের আসল গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা যায়, পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, ধর্মের কাছে আম,আদেরকে দেওয়ার মতন অনেক কিছু আছে। তবে তখনকার চাইতে এখন আমি এই কাজে আরও দক্ষ হয়ে উঠেছি। শুরুতে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ছিল, সাফল্য আমার প্রত্যয় বাড়ায়, আর প্রতিবারই যে আগেরবারের থেকে ভাল কথা বলেছি – তা অনুভব করতাম। আর, অন্যান্য প্রচারকদের মতো আমিও শিখেছি যে লোকশিক্ষার জন্য উপযুক্ত ধর্মীয় উপদেশই শ্রেষ্ঠ।

আমি আনন্দিত যে এই যাত্রাপথে আমি অনেক কিছু করতে পেরেছি। আপামর জনগণের কাছ থেকে তেমনই সাড়া পেয়েছি। এমনটি না হলে আমি সারাজীবন অসন্তুষ্ট থাকতাম। আমার বারো বছর বয়সে জমদাতা পিতার মৃত্যু হয়েছিল। মা ও পরিবারের সমস্ত সদস্য তখন তিব্বতের বাইরে, শুধু লোবস্যাং সামতেন আমার সফরসঙ্গী। পরিবারের সদস্য না হলেও আমার অত্যন্ত প্রিয়জন তাথাগ রিনপোচেও আমার সফরসঙ্গী ছিলেন। তিনি আমাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার জন্য দ্রোমোতে এসেছিলেন এবং এখন লাহসার নিকটবর্তী নিজের মঠে ফিরে যাচ্ছিলেন। গত শীতে যখন তাঁকে দেখেছি, তখনকার তুলনায় এখন তাঁকে বেশি বুড়ো বুড়ো লাগছে, যেন তাঁর বয়স সত্তর বছর হয়ে গেছে। আমার তাঁকে খুব ভাল লাগতো, কারণ তিনি ছিলেন খুব দয়ালু আর আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত উন্নত ব্যক্তিত্ব। আমার জীবনে তাঁকেই শ্রেষ্ঠ গুরু হিসাবে পেয়েছি। তিনি আমাকে অনেক পরম্পরায় দীক্ষা দিয়েছিলেন এবং অনেক রহস্যময় বিদ্যা শিখিয়েছিলেন, এসব কিছু তিনি তাঁর সময়ের সেরা গুরুদের কাছ থেকে শিখেছেন।

দ্রোমো থেকে আমরা ধীরে ধীরে গ্যাৎসে পৌঁছোই, সেখানে শেষবারের মতন ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাকে প্রথাগত সেলামি জানায়। তবে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে আমরা সেখানে কিছুদিন থাকি। তারপর আমরা সামদিং মঠের লক্ষ্যে এগিয়ে যাই, এখানে বোধিসত্ত্বদের মধ্যে সবচাইতে প্রসিদ্ধ, দোরজে ফাগমোর বাড়ি। তিব্বতের সর্বাধিক সুন্দর মঠগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। এখান পর্যন্ত পথ ছিল খুবই সুন্দর: বেশ কয়েকটি গভীর নীল হ্রদের তীরে তীরে দিগন্তবিস্তৃত সবুজ তৃণভূমি, শিস দিয়ে গান গাইতে থাকা পশুপালকরা সেখানে হাজার হাজার ভেড়া চরাচ্ছিল। এত সুন্দর দৃশ্য আমি আর কখনও দেখিনি, যা গ্রীষ্মের রোদে মেঘহীন আকাশের নিচে ছবির মতো ঝলমল করছিল। মাঝে মাঝে নানা রঙের হরিণের ঝাঁকও দেখতে পেয়েছি, তৎকালীন তিব্বতে ঝাঁকে ঝাঁকে নানা প্রজাতির হরিণ ছিল। তারা স্থির দাঁড়িয়ে থেকে নিঃশব্দে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকতো, যেন ভয় পাচ্ছে, তারপর দ্রুত নিজেদের লম্বা লম্বা পায়ে ছুটে পালাচ্ছে। এই দৃশ্যটি আমার মনে গেঁথে আছে।

আমি এবার ঘোড়ায় চড়া উপভোগ করছিলাম, যদিও আমি সাধারণত ঘোড়ায় চড়তে ভয় পাই। কেন জানি না কারণ আমি, জোঁক ছাড়া প্রায় সমস্ত প্রাণীর ক্ষেত্রেই সহজ। বিনা দ্বিধায় মাকড়সা এবং বড়ো বড়ো সাপ হাতে তুলতে পারি, কিন্তু ঘোড়া আমার পছন্দ হয় না আর আমি যখন জোঁক দেখি তখন গা রি রি করে! কিন্তু এবার সমতল পথে খোলা মাঠে ঘোড়ায় চড়তে বেশ ভাল লাগছিলো। আর আমি একে দ্রুত ছোটানোর জন্য বারবার গোড়ালি দিয়ে পেটের দু পাশে চাপ দিতে থাকি। আসলে এটি ছিল একটি খচ্চর, নাম 'ধুসর চাকা' এবং এটি আগে রেটিং রিনপোচের বাহন ছিল। এটি বেশ শক্তিশালী এবং প্রয়োজনে দ্রুত ছুটতে পারতো, এর প্তঠে সওয়ার হয়ে আমি বেশ উপভোগ করেছি। কিন্তু আমার ঘোড়া আধিকারিকের একে পছন্দ ছিল না। তাঁর মতে এটি দালাই লামার পক্ষে উপযুক্ত বাহন নয়।

সামদিং মঠটি নাঙ্গাৎসে শহর থেকে কাছেই। এই শহরটি ইয়াম ড্রেক হ্রদের পাশে, এটি অত্যন্ত সুন্দর হ্রদ এবং তিব্বতের একটি বড়ো পানীয় জলের উত্স। এই হ্রদে বাইরে থেকে জল ঢোকা ও বেরুনোর কোনও উপায় নেই এবং চারিদিক থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে এর নীল জল এত বেশি চকচক করে যে এর থেকে চোখ সরানো যায় না। সম্প্রতি শুনেছি যে চীনারা এই হ্রদ থেকে জল নিয়ে একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করার কথা ভাবছে, আমাত মতে এতে সেখানকার অসাধারণ বাস্তুব্যবস্থা ভেঙে পড়বে এবং এই প্রকল্পের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ভালো হবে না!

সেই সময় সামদিং ছিল একটি সমৃদ্ধ বিহার, অনেক নামডাক ছিল। আর পারম্পরিক ভাবেই এই মঠের প্রধান ছিলেন একজন মহিলা। এটি তিব্বতের জন্য অবাক করার মতন বিষয় নয় কারণ এখানে মহিলাদের প্রতি কোনও বিশেষ বৈষম্য নেই। উদাহরণস্বরূপ, আমি যখন বালক ছিলাম, লাহসার উপকন্ঠে একটি আশ্রমে একজন ভিক্ষুণী থাকতেন, যিনি গোটা তিব্বতে খুব বিখ্যাত ছিলেন। যদিও তিনি 'তুলকু' ছিলেন না, তবু আজও সবাই তাঁকে অনেক শ্রদ্ধা সহকারে স্মরণ করে। ভিক্ষুণীদের জন্যেও অনেক মঠ ছিল, কিন্তু এই শুধু সামদিং বিহারের মঠাধক্ষ্যই ছিলেন একমাত্র মহিলা সন্ন্যাসী।

দেবী বজ্রবরাহী বা – হীরকসম কঠোর শুকরীর নামে এই মঠাধ্যক্ষার নামকরণ করা হয়েছে, 'দোরজে ফাগমো'। ভারতীয় পণ্ডিত শরৎ দাশ তাঁর প্রতিবেদনে এই মঠের বর্ণনা করেছেন। এখানেই তাঁর বসন্ত রোগের চিকিৎসা হয়েছিল। পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে, বজ্রবরাহী এমন একজন দেবী যার মুখটি শুয়োরের মতো। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মঙ্গোলিয় হানাদাররা যখন নাঙ্গারসে এসেছিল, তখন তাঁদের নেতা সামদিং বিহারের মঠাধক্ষ্যাকে তাঁর সামনে উপস্থিত হওয়ার হুকুম দিয়েছিল। মঠাধ্যক্ষা তাঁর তলব শুনে আসতে অস্বীকার করলে তিনি রেগেমেগে হানাদারদের নিয়ে মঠে হামলা করেন। কিন্তু যখন তাঁর সৈন্যদের নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন, তিনি দেখেন একটি বিশালাকায় বুনো শূকর সন্ন্যাসীদের সমাবেশে সভানেত্রীর জায়গায় বসে আছেন।

আমি যখন সামদিং পৌঁছোই, এই মঠের মঠাধ্যক্ষা ছিলেন আমার বয়সী একজন তেজস্বিনী ভিক্ষুণী। আমি পৌঁছুতেই তিনি আমার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। আমি লক্ষ্য করি, তিনি অত্যন্ত মিতভাষিণী, লাজুক এবং তাঁর চুলে লম্বা লম্বা জটা। আমি ভারতে আসার পর তিনিও ভারতে এসেছিলেন, কিন্তু না জানি কেন কিছুদিন পরেই তিনি লাহসায় ফিরে যান। আমি শুনেছি লাহসায় চীনের নতুন শাসকরা বছরের পর বছর ধরে তাকে শোষণ করেছে। দুঃখজনক বিষয় হ'ল পঞ্চাশের দশকের শেষ বছরগুলিতে চীনারা তিব্বতের হাজার হাজার বিহার যেভাবে ধ্বংস করেছে, সেভাবে ঐতিহ্যশালী সামদিং বিহারটিও ধ্বংস করে ফেলেছে।

সামদিংয়ে দু-তিন দিন থাকার পরে লাহসা যাত্রার অন্তিম চরণে নোরবুলিংকার উদ্দেশ্যে রওনা হই। অবশ্য তার আগে আমি তাথাগ রিনপোচেকে তাঁর মঠে পৌঁছে দিতে যাই। লাহসা থেকে মাত্র কয়েক ঘন্টা সফর শেষে সেখানে পৌঁছে যাই। সেখানে ভিক্ষুরা আমার ও দলের সকলের থাকার জন্য তাদের ঘরগুলি খালি করে মূল ভবনের পেছনের মাঠে চলে যান। সেখানে তখন সন্ন্যাসীদের বিতর্কসভা চলছিলো। আমাদের দুই প্রধানমন্ত্রী আমাদের স্বাগত জানাতে সেখানে পৌঁছে গেলে পরবর্তী কয়েকদিন ধরে সেখানেই আমাদের বেশ কয়েকটি আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। তারপর আমার তাথাগ রিনপোচেকে বিদায় জানানোর পালা। এতে দুজনেরই মন খারাপ হয়ে যায়। আমি তো খুবই কষ্ট পাচ্ছিলাম। টের পাই, তাঁর প্রতি আমার মনে কত গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা রয়েছে। এটা ভেবে খারাপ লাগে যে তাঁর মতন মহাপণ্ডিতের শাসনকালে তাঁর সুনামে অপশাসনের দাগ লেগেছিল। এখনও ভেবে আশ্চর্য হই, তিনি যদি আজীবন ভিক্ষুই থেকে যেতেন, কোনোদিন যদি রাজনীতিতে না আসতেন তাহলে কত ভাল হত! সত্য কথাটি হ'ল, তিনি যত জ্ঞানীই হন না কেন, তাঁর কোনও প্রশাসনের জ্ঞান ছিল না, পরিচালনার অভিজ্ঞতাও ছিল না। আর যাঁর কোনও বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নেই, সেক্ষেত্রে তাঁর কাছ থেকে দক্ষতা এবং সাফল্য আশা করাই ভুল। তবে এটি সহজ সরল তিব্বত, এখানে ধরে নেওয়া হয়েছিল যেহেতু তাঁর আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে অনেক জ্ঞান, সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদের জন্যেও তিনিই সবচাইতে উপযুক্ত হবেন!

তাথাগ রিনপোচের সঙ্গে এটিই আমার শেষ দেখা ছিল। ফেরার আগে তিনি আমাকে বলেন যে শৈশবে আমার ভালোর জন্যে উপর যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন সেগুলির জন্যে মনের মধ্যে তাঁর সম্পর্কে কোনও খারাপ ভাবনা যেন না রাখি! এমন একজন বয়স্ক ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে এভাবে বিনীত উচ্চারণে বলতে শুনে আমার দুচোখ জলে ভরে ওঠে। আমি তাঁর মন জানতাম, তাঁর অন্তরের আবেগ ও স্নেহছায়া টের পাচ্ছিলাম।

আমরা নয় মাস বাইরে থাকার পরে আগস্টে লাহসায় ফিরেছি। তাই আমার সম্মানে একটি বড়ো অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এত ভিড় হয় যেন গোটা শহর খালি করে সবাই আমাকে দেখতে বেরিয়ে এসেছেন, আমার সামনে নিজেদের আনন্দ প্রকাশ করতে চেয়েছেন। আমার প্রতি তাঁদের এই অনুভূতি দেখে আমি দেশে ফিরে আসার আনন্দ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করি। এসেছি। আমি ভালভাবে জানতাম যে গত শীতকাল থেকে দেশে কতটা পরিবর্তন এসেছে এবং অনেক কিছুই আর আগের মতন নেই।

দেশের জনগণও এই সংকট বুঝতে পেরেছিল, তাই আমাকে পেয়ে তাঁদের অপরিসীম সুখে মিশে ছিল একটি তীব্র হতাশার তীক্ষ্ণতাও। আমি যখন বাইরে ছিলাম, রাজধানীতে খবর আসতে শুরু করে যে আমদো এবং খামে তিব্বতিরা নির্যাতিত। সেজন্যেই সবাই নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন। এবার আমাকে সামনে পেয়ে তাঁরা হয়তো এই ভেবে নিশ্চিন্ত হচ্ছিলেন যে এখন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে!

লাহসা ফিরে ব্যক্তিগত স্তরে, একটি অত্যন্ত দুঃখের খবর পাই, আমার প্রিয় সাফাইকর্মী নোরবু থোন্ডুপ কয়েক মাস আগেই মারা গেছেন – ছোটবেলায় আমার সঙ্গে যারা নিয়মিত খেলতো, তাঁদের মধ্যে সব খেলায় নোরবুই ছিল সেরা। আমার গোটা শৈশব তাঁর সঙ্গে লাফালাফি মারপিট হাসিমজায় কেটেছে। যখন খুব ছোট ছিলাম, নানা রকম মুখোশ পরে বা অদ্ভুতভাবে মুখে রংচং মেখে সে ভয় দেখাত, আর আমি ভয় পেলে আনন্দে হেসে লুটোপুটি হত। যত বড়ো হতে থাকি, আমার সমস্ত দৌড়ঝাঁপের কাজে সে ছিল আমার নিত্য সহচর। আমরা কৃত্রিম বক্সিং লড়াইয়ে পরস্পরকে ঘুষি মারতাম এবং মনে আছে, প্রায়ই খেলা যত গড়াত আমার আক্রমণ তীব্র হতো। তখন সে কোনও মতে আমাকে দুহাতে জাপ্টে ধরে শান্ত করতে গিয়েও অনেক মার খেত। অন্য দ্বন্দ্ব যুদ্ধেও এরকম হতো, তাঁর মার খাওয়া ছিল অবধারিত। নিজেকে বাঁচানোর জন্য সে যখন আমাকের শক্ত করে ধরে থাকতো, আমি এমনকি আমার খেলনা তরোয়ালের খোঁচায় তাঁকে রক্তাক্ত করে দিতাম। তারপরও, সে আমার ডাকে সাড়া দিয়ে খেলতে পিছপা হতো না! আক্রমণও করত এবং আমি যত উত্তেজিত হতাম যে ততো হাসত। কিন্তু শেষ সময়ে কাছে না থাকায় তাঁর জন্যে কিছুই করতে পারি নি, যদিও তাঁর স্ত্রী, একটি ছেলে এবং একটি মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য যতটা সম্ভব করেছি। বৌদ্ধ হওয়ার ফলে আমি জানতাম যে দুঃখ করে কোনও লাভ নেই। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর ঘটনাটি আমার মনে এত তীব্র প্রভাব ফেলে যে নোরবু থোন্ডুপের মৃত্যুর মাধ্যমে আমার শৈশবের প্রতীকী সমাপণ ঘটে। ার আমি সেই জীবনে ফিরে যেতে পারব না।

কিছুদিন পর আবারও চীনা প্রতিনিধি দলের সাথে দেখা করতে হয়। আমার দেশের জনগণের জন্য যা কিছু করতে পারি তা আমার করা উচিত, যদিও আমার সীমাবদ্ধতা ছিল, কারণ জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলির একটি হল শান্তিপূর্ণভাবে ধর্ম পালন। আমার বয়স তখন ষোল বছর।

পরম্পরা অনুসারে, আমি আমার দেহরক্ষীর কার্যালয়ে জেনারেল চিয়াং চিন-উয়ের সাথে দেখা করি। সেজন্যে তিনি খুব রেগে যান, এবং তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন যে কেন এই আলোচনাটি আরও আনুষ্ঠানিক জায়গায় করা হচ্ছে না। তিনি বলেন যে তিনি বিদেশি নন, সুতরাং এই আচরণটি উপযুক্ত নয়। তবে তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে তিনি তিব্বতি ভাষা জানেন না। প্রথমদিকে, আমি তার চোখগুলি গোল হতে দেখে, এবং গালগুলি লাল হতে দেখে অবাক হই। আর যেভাবে তিনি হঠাত চিৎকার করে টেবিল চাপড়ে কিছু বলতে থাকেন, তা দেখে কিছুটা আতঙ্কিত হই। পরে জেনেছি যে তিনি প্রায়শই নিজের মেজাজ হারিয়ে এভাবে কথা বলতে শুরু করেন। আমি কিন্তু সেইসময় নিজেকে বলতে থাকি যে, উপরে থেকে এর প্রকৃতি যাই হোক না কেন, ভেতর থেকে ভাল মানুষ হতেও পারেন - যা পরে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল,পাশাপাশি তিনি স্পষ্টবাদী মানুষও ছিলেন।

পরে অনুভব করেছি, এই যে দুম করে রেগে ওঠা, এটি চীনাদের একটি সাধারণ অভ্যাস। আমি দেখেছি যে তাঁদের এই প্রকৃতির কারণে অনেকেই, বিশেষ করে ইউরোপীয় এবং আমেরিকানরা তাদেরকে পছন্দ করে; যদিও তাঁরা নিজেরা অত্যন্ত সংযত এবং নিজেদের আচরণে নিয়ন্ত্রিত। সৌভাগ্যক্রমে, আশৈশব শ্রেষ্ঠ গুরুদের সান্নিধ্যে ধর্মীয় প্রশিক্ষণের কারণে, আমি তার আচরণ সহ্য করতে এবং বুঝতে পেরেছি – আমার মনে হয়, এরকম রাগের অভিব্যক্তি একদিকে ভাল। উপরে উপরে নম্রতা দেখিয়ে মনের ক্ষোভ এবং অভিযোগটি আড়াল করা থেকে এভবে জানিয়ে দেওয়া ভাল।

প্রথম কথা হল আমার সঙ্গে চিয়াংয়ের খুব একটা দেখাসাক্ষাৎ হতো না। চীনাদের জবরদখলের প্রথম এবং দ্বিতীয় বছরে, সম্ভবত মাসে একবার তাঁর সঙ্গে দেখা হতো। দুই প্রধানমন্ত্রী লুখাংগ্বা, লোবসাং তাশি এবং কাশাগের সদস্যদের সঙ্গে তাঁর বেশি দেখা হতো, কিন্তু কেউই তাঁর আচরণ পছন্দ করতেন না। তাঁরা আমাকে বলতেন যে লোকটা ভীষণ বদমেজাজি এবং আক্রমণাত্মক। আমাদের বিভিন্ন জীবনশৈলীর প্রতি তাঁর কোনও আগ্রহ কিম্বা সহানুভূতি নেই। আমি নিজের চোখেও দেখেছি, কীভাবে তিনি এবং তাঁর দেশবাসী সবসময় তিব্বতীদের অপমান করেন।

আমি দ্রোমো থেকে লাহসায় ফিরে আসার পরে প্রথম পাঁচ - ছয় সপ্তাহ চীনাদের ব্যবহার বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমার মতন ছিল। ১৯৫১ সালের ২৬শে অক্টোবর আঠারো রুট আর্মির তিন হাজার চীনা সৈন্য হঠাৎ লাহসায় প্রবেশ করলে এই মধুচন্দ্রিমা শেষ হয়। গতবছর যে সেনাবাহিনী চামদোতে আমাদের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেছিল, তাঁরাও সেই বাহিনীর সদস্য ছিল। তাঁদের নেতা দুই জেনারেল, তান কুয়ান-সেন আর চিয়াং কুয়ো হা যখন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন, তখন আমাদের জাতীয় পোশাকের উপর ফারে টুপি পরিহিত একজন তিব্বতিও তাঁদের সঙ্গে আসেন। তাঁরা যখন ঘরে ঢোকেন, তখন এই ব্যক্তিটি আমার সামনে এসে তিনবার অভিবাদন জানান। আমি এতে অবাক হই, ভেবেছিলাম, ইনিও চীনা প্রতিনিধি দলের অংশ। পরে জানতে পারি, তিনি তাঁদের দোভাষী এবং কমিউনিস্টদের দৃঢ় সমর্থক। পরে যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করি কেন তাঁর সহকর্মীদের মতো মাও স্যুটটি পরেন নি, তিনি খুব সহজেই বলেন, বিপ্লব মানে পোশাকের বিপ্লব বলে ভাবা ভুল, এটি ধারণার বিপ্লব।

এই দিনগুলিতে আমার দাদা গ্যালো থোন্ডুপও লাহসায় আসেন। তিনি বেশিদিন ছিলেন না, কিন্তু যতদিন ছিলেন, তিনি বেশ কয়েকবার চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমার প্রতিনিধি হয়ে দেখা করেন। তারপর একদিন তিনি ঘোষণা করেন যে তিনি দক্ষিণে যাবেন, যেখানে তিব্বত সরকার আমার সিংহাসন আরোহণের সময় তিব্বত সরকার প্রথা অনুসারে আমার পরিবারকে জমি দিয়েছিল সেখানেই থাকবেন। আসলে এটি ছিল একটি অজুহাত, কারণ শীঘ্রই জানতে পারি যে তিনি সেই খামারবাড়ি থেকে আসামের নেফার ( ভারতের তৎকালীন উত্তর-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চল) সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে গেছেন; যেখান থেকে তিনি বিদেশী সমর্থন এবং সহায়তা অর্জনের কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তিনি আমাকে এই পরিকল্পনাটি বলেননি, কারণ তিনি ভয় পেয়েছিলেন যে অল্পবয়স হওয়ার ফলে অজান্তেই যদি অন্য কাউকে বলে দিই!

কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের না জানিয়ে চীনা সেনাবাহিনীর আরও অনেক স্কোয়াড লাহসায় পৌঁছোয়। তাঁদের আসার দিনটি আমার খুব ভাল মনে আছে। উচ্চতার কারণে তিব্বতে যে কোনও আওয়াজ অনেক দূর থেকে শোনা যায়, সেজন্যে চীনা সেনাবাহিনী লাহসায় প্রবেশের অনেক আগেই আমি পোটালায় আমার ঘরে বসে চীনা সৈন্যদের বুটের মিলিত আওয়াজ আর মিলিটারি ব্যান্ডের আওয়াজ দূর থেকে শুনতে পেতাম। তাঁরা শহরের সীমায় পৌঁছোনোর সঙ্গে সঙ্গেই দূরবীনটি নিয়ে ছাদে উঠি আর দেখতে পাই, ধুলার মেঘ উড়িয়ে সাপের মতো তাঁদের দীর্ঘ সারি। সেখানে পৌঁছে তাঁরা চেয়ারম্যান মাও এবং তাঁর সহযোগী চু তেহ-র প্রতিকৃতিযুক্ত লাল পতাকা এবং পোস্টার বের করেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল উচ্চ আওয়াজের শিংগা এবং ব্যান্ডের বাদ্যযন্ত্রগুলি। দৃশ্যটি আমার জন্যে অত্যন্ত ভয়াবহ আর এই বিপুল সৈন্যদলকে মনে হচ্ছিল যেন দৈত্যদল।

কিছুদিন পরই যখন আমি লাল পতাকার এই দৃশ্য থেকে উৎপন্ন মনোবিকার থেকে মুক্তি পাই - প্রকৃতিতে লাল রঙ ভয় এবং বিপদের প্রতীক, যখন আমি দেখি যে চীনা সেনাদের অবস্থা সত্যিই খুব খারাপ, তাদের ইউনিফর্মগুলি শ্মশানের শকুনের মতন কাদামাখা এবং চোখমুখে দীর্ঘ অনাহারের ছাপ স্পষ্ট। প্রকৃতপক্ষে, তাঁদের বস্ত্র ও খাদ্য অপ্রতুল, তাদের চোখেমুখে উত্তর তিব্বতের দিগন্তবিস্তৃত মালভূমির ধূলিকণায় ভরা থাকায় তাঁদের দেখতে ভয়াবহ দেখাচ্ছে।

১৯৫১-৫২ এর শীতকালে, আমি যথারীতি আমার পড়াশোনা চালিয়ে গেছি, কিন্তু আগের থেকে অনেক বেশি পরিশ্রম ও যত্ন নিয়ে। সেই সময়কালে আমি বহু আকাঙ্ক্ষিত 'লামারিম' ধ্যানও শুরু করি। একটি প্রাচীন গ্রন্থ অনুসারে, ধ্যানের এই পদ্ধতি ধীরে ধীরে অনুশীলনের মাধ্যমে ‘প্রবোধ’ অবস্থা অর্জন করা যায়। আটবছর বয়স থেকে, ভিক্ষু জীবনের শিক্ষার অন্তর্গত এই জাতীয় তান্ত্রিক পদ্ধতি অনুশীলন শুরু করেছিলাম। এতে ধর্মগ্রন্থ পঠন-পাঠন ছাড়াও বিশেষজ্ঞরা এই পদ্ধতিগুলি শিখিয়েছিলেন। এবার নিয়মিত চর্চা ও একাগ্রতার ফলে কয়েক মাসের মধ্যেই খুব কম হলেও আধ্যাত্মিক অগ্রগতি টের পেতে শুরু করি।

সেই শীতেই আমার সাম্বৎসরিক নির্জনতার দিনগুলিতে, আমি তাথাগ রিনপোচের মৃত্যুর খবর পাই। আমি তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়াকলাপে উপস্থিত থাকতে চাই, কিন্তু এটি সম্ভব হয়নি, সেজন্যে আমি তাঁর জন্য বিশেষ প্রার্থনা করি।

আমার অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সেখানে যেতে আমার অন্তরায় হয়েছিল। সেটি হল হতাশায় ডুবতে থাকা আমার দুই প্রধানমন্ত্রী এবং কাশাগকে তাঁদের কাজে প্রতি পদক্ষেপে অনুপ্রেরণা এবং উত্সাহ প্রদান করা। আমি তাঁদেরকে বৌদ্ধ ধারণায় অস্থায়িত্বের ধারণার কথা মনে করিয়ে বলতাম, এই পরিস্থিতিও সর্বদা চলবে না, হয়তো পরিবর্তন আসতে আমাদের জীবন পেরিয়ে যাবে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করে যাচ্ছিলাম। আমার মনে নানা উদ্বেগ বাড়তে থাকে। ঠিক তখনই জানা যায় যে পাঞ্চেন লামা শীঘ্রই লাহসায় আসবেন। আমরা তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করি।

এদিকে, তিরিশ হাজার চীনা সৈন্যের শেষ পল্টন আসার পর লাহসায় খাদ্যাভাব অনুভূত হতে শুরু করে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে লাহসার জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে, তাই আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলি সংকটে পড়ে যায়। প্রথমে চীনারা কমবেশি সতেরোসূত্রী চুক্তির ধারা অনুসরণ করে চলে, সেখানে লেখা ছিল যে 'মুক্তি সেনা সকল প্রকারের কেনাকাটার ক্ষেত্রে যথাযথ আচরণ করবে এবং জনসাধারণের কাছ থেকে এমনকি সুই সুতোর মতো জিনিসও কিনে নেবে। তিব্বত সরকার তাঁদেরকে যে খাদ্যসামগ্রী দিত, তার দাম তাঁরা সরকারকে দিতেন এবং তাদের আধিকারিকরা যাদের বাড়িতে বাস করতেন সেই বাড়ির বাড়িওয়ালাদের যথোচিত ভাড়া দিতেন।

কিন্তু লাহসায় তাঁদের সংখ্যাবৃদ্ধির পর এই টাকা দিয়ে জিনিস কেনা কিম্বা ভাড়া দেওয়ার নিয়ম তাঁরা ভাঙতে শুরু করেন। এবার চীনারা অধিকার হিসাবে খাদ্য এবং বাসস্থান দাবি করতে শুরু করে। এর ফলে সংকট দেখা দেয়। এটি এমন চাপ যা লাহসার নাগরিকরা কখনও অনুভব করেনি। তাঁরা বুঝতে পারে না যে প্রত্যেক জিনিসের দাম এক দিনে কিভাবে দ্বিগুণ হয়! তাদের সহনশীলতা তলানিতে ঠেকে, আক্রমণকারীদের প্রতি তাঁদের ঘৃণা, যা এখনও অবধি চাপা ছিল, তা ক্রমে প্রকাশ হতে শুরু করে। অশুভকে দূরে তাড়িয়ে দেওয়ার প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে, তারা যখনই চীনা সৈন্য দেখত, তারা হাততালি দিয়ে থুতু ফেলতো। শিশুরা তাদের দিকে পাথর ছুঁড়তে শুরু করে, এমনকি ভিক্ষুরাও তাঁদেরকে দেখলেই তাঁদের কোমড়ের ফিতে খুলে দড়ি বানিয়ে তাঁদেরকে মারার চেষ্টা করতো।

একই সময়ে, চীন ও চীনা সৈন্য বিরোধী গান রচনা করে সেগুলি গাওয়া শুরু করেন। এমনকি জেনারেল চিয়াং চিন উয়ের সোনার ঘড়িটিকে নিয়েও উপহাস করা শুরু হয়। লোকেরা যখন জানতে পারল যে অনেক চীনা কর্মকর্তা তাদের মামুলি পোশাকের নীচে মূল্যবান পশম পরেন, তখন তাদের ঘৃণা আরও বেড়ে যায়। এই ব্যবহারগুলি চীনাদের ক্রোধকে বিস্ফোরণের ইন্ধন জোগাচ্ছিল। কারণ, আমার মনে হয়, তাঁরা বুঝতে পারছিলো যে তাঁদেরকে নিয়ে উপহাস ও মজা করা হচ্ছে, কিন্তু ভাষা না জানার ফলে ঠিক কী কারণে কে কী বলছেন তা বুঝতে পারছিলেন না। এতে তাঁদের আত্মমর্যাদা আহত হচ্ছিলো। চীনা সংস্কৃতিতে লজ্জিত হওয়াকে খুব খারাপ হিসাবে বিবেচনা করা হয় (একে ইংরেজিতে ‘লুজিং ফেস’ বলা হয়) এবং এই সার্বজনীন উপহাস ও মজা তাঁদের দৃষ্টিতে এরকমই কষ্টকর ছিল। জেনারেল চিয়াংয়ের সঙ্গে একটি বড় বিনোদনমূলক ঘটনার মাধ্যমে এই সার্বজনীন উপহাস ও মজার অবসান হয়েছিল। তিনি একদিন এসে আমার সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ করেন যে গান বা পোস্টার দিয়ে কোনওভাবেই চীনাদের সমালোচনা নিষিদ্ধ করা উচিত - কারণ এই সার্বজনীন উপহাস ও মজা 'প্রতিক্রিয়াশীল'।

তাঁর কথা শুনে আমি সার্বজনীন উপহাস ও মজার উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করার পরও, শহরের সর্বত্র পথের দু-ধারে চীনাদের উপস্থিতি নিয়ে সমালোচনামূলক পোস্টার লাগানো হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। শেষ অবধি, ছয়-সূত্রী দাবিপত্র প্রস্তুত করে সরাসরি জেনারেল চিয়াংয়ের কাছে পাঠিয়ে শহর থেকে সেনা প্রত্যাহার করার দাবি জানানো হয়। এটি তাঁর ক্ষোভকে উস্কে দেয়। তিনি বলেন যে এটি 'সাম্রাজ্যবাদীদের' কাজ এবং এর জন্য তিনি উভয় প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করে ষড়যন্ত্রের আরোপ লাগান। উত্তেজনা বাড়তে থাকে। তিনি ভেবেছিলেন যে এই দুজনকে এড়িয়ে আমার সঙ্গে কথা বলে সমস্যাটি সমাধান করতে পারবেন, তাই তিনি সরাসরি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমিও শুরুতে প্রধানমন্ত্রীদের উপস্থিতি ছাড়াই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করি। কিন্তু পরে ভাবি, একবার লোবসং তাশি এমন কিছু বলেছিলেন যা চিয়াং-এর খুব খারাপ লাগে, তখন চিয়াং তাঁর দিকে এমনভাবে এগিয়ে যান যেন তাঁকে আক্রমণ করবেন। তা দেখে আমি চিৎকার করে ছুটে উভয়কে থামতে বলেছিলাম। এই ঘটনাটি আমাকে আতঙ্কিত করে। দুজনকেই বলি, আপনারা আমার থেকে বয়সে বড়ো, বুঝতে পারছি না দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কীভাবে এরকম আচরণ করতে পারে!

এই ঘটনা মনে পড়তেই আমি এই সার্বজনীন উপহাস ও মজা নিয়ে দু’জনের সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করতে রাজি হই।

চীন থেকে যত নতুন নতুন কর্মকর্তা, আধিকারিক ও সৈন্য লাহসায় আসছিলো, চীনা নেতৃবৃন্দ এবং আমার দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত ছিল। এই কর্মকর্তারা চুক্তি অনুসারে তিব্বত সরকারের প্রশাসনিক স্বাধীনতার পরিবর্তে সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ শুরু করে। জেনারেল চিয়াং তার অফিসার এবং কাশাগের মধ্যে আলোচনার পরে বৈঠক শুরু করেন যার মূল উদ্দেশ্য ছিল এই অফিসারদের থাকার জায়গা, সেনাদল এবং হাজার হাজার উট ও অন্যান্য ভারবাহী পশুর থাকার সমস্ত ব্যবস্থা করা।

লোবস্যাং তাশি এবং লুখাংগ্বা তাঁদের বোঝাতে সক্ষম হন নি যে এই দাবিগুলি কেবল ভুল নয়, এগুলি মানা অসম্ভব।

তারপর, জেনারেল চিয়াং তাকে যখন দুই হাজার টন শস্যের দ্বিতীয় কিস্তি চান, তখন তাঁকে বোঝাতে হয় যে এত তিব্বত সরকারের গুদামে নেই। শহরে তিব্বতীদের জন্য শস্যের ঘাটতি রয়েছে, মাত্র দুই মাসের শস্য গুদামগুলিতে অবশিষ্ট ছিল। প্রধানমন্ত্রীরা বলেন, লাহসায় এতবড় সংখ্যক সেনা থাকার দরকার নেই। তাঁদের যদি শত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হয় তাহলে সেনাবাহিনীকে সীমান্তে প্রেরণ করা হোক; এই শহরে কয়েকজন কর্মকর্তা থাকুন আর তাঁদের প্রয়োজনে সৈন্যদের একটি স্কোয়াড থাকাই যথেষ্ট। তাঁরা ফিরে এসে আমাকে বলেন, জেনারেল সমস্ত বিষয় শান্তভাবে শুনেছেন এবং নম্রভাবে জবাব দিয়েছেন কিন্তু কিছুই করেন নি।

কিন্তু বাস্তবে এই পরামর্শ শোনার পরে জেনারেল চিয়াং দুই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করেন। প্রথমে তিনি ক্রোধ লোবসাং তাশির উপরে ক্রোধ প্রকাশ করেন, যিনি লুখাংগ্বার থেকে বয়সে বড়ো ছিলেন এবং কিছুটা চীনা ভাষাও জানেন। সেজন্যে তাকে নিয়ে জেনারেল বেকায়দায় পড়েন, এবং তাকে অকল্পনীয় অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করতে শুরু করেন, পাশাপাশি তিনি লুখাংগ্বার প্রশংসা করেন, তিনি তাঁর কাছে সহযোগিতা চান।

লুখাংগ্বার বয়স অল্প হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন আরও দৃঢ়প্রত্যয়ী হিসাবে প্রমাণিত হয়েছিল; তিনি কখনই, এমনকি জেনারেলের সামনেও তাঁর নিজের বাস্তব অনুভূতি আড়াল করেননি। যদিও তিনি ব্যক্তিগতভাবে জেনারেলদের ঘৃণাও করতেন। একবার, কেউ আমাকে বলেন, জেনারেল চিয়াং তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে তিনি কতটা চা পান করেন? লুখাংগ্বা হেসে জবাব দেন, এটা চায়ের স্বাদের উপর নির্ভর করে! আমি শুনে হাসি আর অনুভব করি যে দুজনের সম্পর্ক খারাপ।

এই নাটক চরমে পৌঁছোয়, যখন চিয়াং তাঁর সমস্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে উভয় প্রধানমন্ত্রী এবং কাশাগের সঙ্গে একটি বৈঠকে বসেন। স্বাগত ভাষণে জেনারেল বলেন যে এই বৈঠকটি তিব্বতী সেনাবাহিনীকে চীনা মুক্তিফৌজ এ যোগদানের জন্য আহ্বান করা হয়েছে। লুখাংগ্বা এই বৈঠকে কথা বলার সুযোগ পেতেই বলেন, এই প্রস্তাব মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, এটি সতেরোসূত্রী চুক্তির অংশ হলেও বাস্তবসম্মত নয়। অনেক শর্ত আপনারা গত এক বছরে এতবার লঙ্ঘন করেছেন যে এই চুক্তির এখন আর কোনও গুরুত্ব নেই। এখন তিব্বতি সেনাবাহিনী চীনা সেনাবাহিনীর বশ্যতা স্বীকার করবে এটা কল্পনাও করা যায় না!

একথা শুনে চিয়াং চেঁচিয়ে বলেন, এই পরিস্থিতিতে আমরা সবখান থেকে তিব্বতের পতাকা উপড়ে সেখানে চীনা পতাকা লাগিয়ে দেব!

লুখাংগ্বা একই স্বরে জবাব দেন, আমরা সেগুলি তুলে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দেব! তাতে আপনার অপমান হবে!

তিনি একবার শ্বাস নিয়ে বলেন, চীনারা তিব্বতের আত্মসম্মানে আঘাত করেছে, তাই এই বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করা আর সম্ভব নয়, আপনি একজন মানুষের মাথা ভেঙে দিলে তাঁর ক্ষতটি যতদিন নিরাময় না হবে, এত তাড়াতাড়ি সে আপনার বন্ধু হবে না!

একথা শুনে জেনারেল চিয়াং রাগে গরগর করতে করতে তখুনি সভা ছেড়ে চলে যান। পরের বৈঠকটি তিনদিন পর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।

আমি এই সভাগুলিতে অংশ নিতাম না, কিন্তু এগুলিতে কী কী হয়েছে সমগ্র কার্যবিবরণী আমাকে বিস্তারীত বলা হতো। এখন মনে হচ্ছে দ্রুত পরিস্থিতি উন্নত না হলে আমাকে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে হবে।

পরিকল্পনা অনুসারে তিন দিন পরে দ্বিতীয় সভা হয়। এবার দ্বিতীয় জেনারেল ফানমেং সভাপতিত্ব করেন। তিনি বৈঠক শুরু করে বলেন, আমি নিশ্চিত যে আগের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী লুখাংগ্বা যা বলেছেন, সে সম্পর্কে তিনি ক্ষমা চাইবেন! লুখাংগ্বা তত্ক্ষণাত্ এর প্রতিবাদ করে বলেন, না, আমার ক্ষমা চাওয়ার কোনও ইচ্ছা নেই! গতসভায় যা বলেছি তা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী এবং তিব্বতী দৃষ্টিকোণ থেকে আমার দায়িত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েই কথাগুলি চীনাদের সচেতন করতে বলেছি। এত বিপুল সংখ্যক চীনা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দেখে তিব্বতের জনগণ সন্ত্রস্থ। তাছাড়াও চীনারা এখনও তিব্বত সরকারকে চামডো ফিরিয়ে দেয়নি এবং তিব্বতের অন্য জায়গাগুলি থেকে চীনা সামরিক বাহিনী ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। এই পরিস্থিতিতে তিব্বতী সেনাবাহিনীর চীনা সেনাবাহিনীতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তা নিয়ে দেশে অবশ্যই একটি সংকট দেখা দেবে।

একথা শুনে ফানমেং রেগে ওঠেন। তিনি লুখাংগ্বার সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির আঁতাতের আরোপ লাগিয়ে বলেন, আমরা দালাই লামার কাছে দাবি জানাবো যাতে আপনাকে পদচ্যুত করা হয়!

লুখাংগ্বা বিনীতভাবে বলেন, দালাই লামা নির্দেশ দিলে শুধু আমার পদই নয়, নিজের জীবনও ত্যাগ করতে পারি!

বৈঠকটি শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমি চীনাদের কাছ থেকে একটি লিখিত প্রতিবেদন পাই। এতে লেখা ছিল, যে লুখাংগ্বার সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির আঁতাত রয়েছে। তাই তিনি চীন- তিব্বত পারম্পরিক সম্পর্কের উন্নতি চান না, সুতরাং তাকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত। এর পাশাপাশি, কাশাগের সদস্যরা এসে আমাকে মৌখিক পরামর্শ দেয় যে পরিস্থিতি সামলাতে উভয় প্রধানমন্ত্রীকেই সরিয়ে দেওয়া ভাল। এই পরামর্শ শুনে হতবাক হয়ে পড়ি। এই দু'জনেই তিব্বতের প্রতি সম্পূর্ণ নিষ্ঠা, সাহস এবং প্রজ্ঞা নিয়ে কাজ করছিলেন।

এক-দু'দিন পরে, দুজনেই যখন পদত্যাগপত্র নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন, তখন তাদের চোখে জল ছিল। আমার চোখেও জল চলে আসে। কিন্তু আমি অনুভব করি, এই পরিস্থিতি না মানলে তাঁদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। তাই ভারী হৃদয় দিয়ে আমি তাঁদের পদত্যাগ গ্রহণ করি, তারপর থেকে প্রতিমুহূর্তেই মনে মনে ভাবতে থাকি, কিভাবে চীনাদের সঙ্গে সম্পর্ক শুধরানো যায়! অবশেষে এরপর থেকে নিজেই এই দায়িত্ব নির্বাহের সিদ্ধান্ত নিই।

সেই সময় পাঞ্চেন লামা লাহসা সফরে আসেন। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তিনি চীনাদের সঙ্গে চীনা আবহে বড়ো হয়ে উঠেছেন এবং এখন প্রথমবারের মতো তাশিল হুনপো মঠে মঠাধ্যক্ষের দায়িত্ব সামলাতে যাচ্ছেন। তিনি যখন আমদো অঞ্চল দিয়ে লাহসায় আসেন, তখন তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং শিক্ষকদের সঙ্গে তাঁর 'দেহরক্ষী'র ভূমিকায় ছিলেন চীনা সেনাবাহিনীর অনেক বড় একটি স্কোয়াড।

যুবক পাঞ্চেন লামা লাহসা সফরে এসে সামান্য বিশ্রামের পর আমার সঙ্গে একটি সরকারী বৈঠকে মিলিত হন, তারপর পোটালায় আনিষ্ঠানিক ভোজনের কর্মসূচি ছিল। আমার মনে আছে, তাঁর সঙ্গে সবসময় একজন চালাক চতুর চীনা প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা ছিলেন। আমরা দুজনে একান্তে কথা বলতে গেলেও তিনি একরকম জোর করেই সেখানে চলে আসছিলেন। এতে আমার দেহরক্ষীরা বাঁধা দেন, এতে একটি নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয় – কারণ, সেই উত্তেজিত ব্যক্তিও সশস্ত্র ছিলেন। বেগতিক দেখে যুবক পাঞ্চেন লামা এগিয়ে গিয়ে ওই চীনা প্রতিরক্ষা কর্তাকে বিনীতভাবে আমাদের ধর্মে এই দুই প্রধানের একান্তে পারস্পরিক আধ্যাত্মিক আলোচনার দস্তুর ও প্রয়োজনের কথা বুঝিয়ে বলেন।

অবশেষে, আমি নির্জনে পাঞ্চেন লামার সঙ্গে একান্তে কথা বলার সুযোগ পাই। কথা বলে বুঝতে পারি যে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান এবং সৎ। তিনি বয়সে আমার থেকে তিন বছরের ছোট, এখন পর্যন্ত নিজের অধিকারগুলিও বুঝে নিতে পারেননি। তাই তিনি অত্যন্ত নিরীহ এবং সুখী বালকের মতো ছিলেন। কথা বলতে বলতে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা দুজনে পরস্পরকে খুব কাছের মানুষের মতন অনুভব করি। কথায় কথায় দুজনেই অশায়ের মতন বলে ফেলি, আমরা দু'জনই জানি না,আরও কতদিন আমাদের এই ধরনের কঠিন জীবনযাপন করতে হবে!

পাঞ্চেন লামার আগমনের পরে আমাকে আবার তাথাগ মঠে আমন্ত্রণ জানানো হয়, যেখানে আমি আমার গুরুর স্মৃতিতে উত্সর্গীকৃত একটি স্তূপের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করি। এই অনুষ্ঠান দীর্ঘ পনেরো দীর্ঘ ঘন্টা ধরে চলে। যখন আমি তাঁর স্তূপের সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করি, তখন নাজানি কেন সমস্ত অস্তিত্ব ছাপিয়ে কান্না বেরিয়ে আসে। এই গভীর দু:খ আমি কাকে জানাবো! এর পরে, কিছুক্ষণের জন্য তাত্ক্ষণিক চাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে তাথাগের পাহাড়ী নিসর্গে একা পায়ে হেঁটে ঘুরতে থাকি। এই অনুষ্ঠানের একটি আকর্ষণীয় দিক হ'ল, আমাকে তাথাগ রিনপোচের মাথার খুলির একটি অংশ দেখানো হয়েছিল যা চিতার আগুনে পোড়েনি। সেই খুলিতে তাঁর রক্ষক দেবতার নাম তিব্বতী লিপিতে খোদিত। বাস্তবে, তিব্বতের উচ্চকোটির লামাদের ক্ষেত্রে এমন অনেক রহস্যময় ঘটনা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কারও হাড়গুলি এমনভাবে গলে যায় যে তা থেকে নানা অক্ষর, এমনকি কখনও কখনও চিত্রও তৈরি হয়। আমার পূর্বসূরী দালাই লামার মতো অনেক সন্ন্যাসীর মৃত্যুর পর, কিম্বা দাহ করার পর তাঁদের দেহাবশেষে এ ধরণের চিহ্নগুলি দেখা যায়।

১৯৫২ সালের বসন্তে তিব্বতের প্রতি সম্পূর্ণ নিষ্ঠা, সাহস এবং প্রজ্ঞা নিয়ে কাজ করতে থাকা দুই প্রধানমন্ত্রী লুখাংগ্বা এবং লোবস্যাং তাশির বাধ্যতামূলক পদত্যাগের পরে কিছু সময়ের জন্য চীনা কর্তৃপক্ষের সাথে এই অনিশ্চিত চুক্তি চালু রাখা হয়।

আমি এই সুযোগে একটি সংস্কার কমিটি গঠন করি, যে কমিটি সম্পর্কে আমি এক বছর আগে দ্রোমো সফরের সময় থেকেই ভাবছিলাম। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশে একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। আমি আগেই রেটিং রিনপোচের কথা বলেছি, তখন নাবালক হওয়ার কারণে প্রশাসনের চোখে অধঃপতিত ব্যক্তিকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে আমি কিছুই করতে পারি নি। উদাহরণস্বরূপ, আমার প্রবন্ধনের সেই কর্মচারিটির কথা মনে পড়ে, যে থাঙ্কা চিত্রাবলিতে লাগানো সোনার কণা চুরি করার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েছিল, তাই তাকে গাধার উপর পিছনে ফিরে বসিয়ে শহর থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। আমি দূরবীণ দিয়ে এই দৃশ্যটি দেখেছিলাম। প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে, এই জাতীয় অপরাধের জন্য এই শাস্তি নির্ধারিত ছিল।

কখনও কখনও আমি অনুভব করি যে এই জাতীয় বিষয়ে আমার হস্তক্ষেপ করা উচিত ছিল। একই রকম আরেকটি দৃশ্য পোটালায় দেখেছি। আমার পোটালাবাসের প্রথম দিন থেকেই, প্রাসাদের এমন অনেক জায়গা আবিষ্কার করেছি যেখানে বসে বা দাঁড়িয়ে জানালা, ঘুলঘুলি বা স্কাইলাইটের আলোয় চুপিচুপি ঘরগুলিতে উঁকি মেরে মেরে দেখতাম। এভাবেই একদিন রিজেন্টের কার্যালয়ে চুপিচুপি উঁকি মেরে একটি মামলার শুনানি চলতে দেখেছিলাম, যেখানে বাড়িওয়ালার বিরুদ্ধে ভাড়াটে ব্যক্তির অভিযোগ বিবেচনা করা হচ্ছিলো। আমার মনে আছে এই ব্যক্তিটি হতদরিদ্র, বয়স্ক, অনেকটা ঝুঁকে পড়া পিঠ, সাদা চুল এবং পাতলা গোঁফ ছিল। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য হ'ল বাড়িওয়ালার পরিবারটি রিজেন্টের আত্মীয় ছিল - রেটিং রিনপোচে তখন রিজেন্ট ছিলেন, তাই তাঁর অভিযোগ পত্রপাঠ খারিজ হয়ে যায়। আমার মনে তখন তাঁর জন্য কষ্ট হয়। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারি নি। সুতরাং, যখনই আমি কারও উপর অন্যায়ের কথা শুনতাম, আমার মনে সুনির্দিস্ট বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতো।

সকলের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার ব্যাপারেও আমি কিছু করতে চেয়েছিলাম। তখন দেশে জনশিক্ষার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। লাহসায় কয়েকটি স্কুল ছিল এবং গ্রামাঞ্চলেও কয়েকটি ছিল, এবং মঠগুলির বেশিরভাগই ছিল জ্ঞানের কেন্দ্র এবং সেখানে যে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল তা সন্ন্যাসীদের জন্যই ছিল। তাই আমি কাশাগকে একটি ভাল শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাব প্রস্তুত করার নির্দেশ দিই। আর একটি ক্ষেত্রের জরুরি উন্নতির প্রয়োজন ছিল, সেটি হল, পাকা সড়ক, মোটরগাড়ি আসাযাওয়ার পথ। সেই সময়ে তিব্বতে একটিও পাকা সড়ক ছিল না। সারা দেশে মাত্র তিনটি গাড়ি ছিল - ত্রয়োদশ দালাই লামার গ্যারেজে রাখা সেই তিনটি মোটরগাড়ির কথা আমি আগে লিখেছি। অতএব, পাকা রাস্তা ও পরিবহনের মাধ্যমগুলি উন্নয়নের মাধ্যমে জনগণ কতটা উপকৃত হবে তা কল্পনা করা কঠিন ছিল না। কিন্তু শিক্ষার মতন এটিও দীর্ঘকালীন প্রকল্প – নিয়মিত কাজ করলে দীর্ঘদিন পর এর সুফল পাওয়া যাবে।

কিন্তু কিছু কাজ এমন রয়েছে যেগুলি দ্রুত শুরু করতে হতো। প্রথমটি হল, বংশ পরম্পরায় ঋণশোধ প্রথা বাতিল করা। আমি নিজের সাফাইকর্মীদের সঙ্গে এবং দ্রোমো আসাযাওয়ার পথে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি এই পূর্বপুরুষের ঋণের বোঝা আর তার সুদ সাধারণ মানুষের আর্থিক উন্নতির পক্ষে সবচেয়ে বড় বাধা। তাঁর মানে হ'ল কৃষকরা সুদখোর ব্যবসায়ীদের থেকে, কিম্বা ভাগচাষীরা জমির মালিকদের থেকে, খরা বা অন্য কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর আবার চাষের কাজ শুরু করার জন্যে কারণে যে ঋণ নেয়, তা যদি তাঁরা সুদসহ নিজের জীবতকালে না শোধ করতে পারে, তাহলে তা পরবর্তী প্রজন্মকে সুদে-আসলে শোধ করতে হবে। নাহলে তারাও পূর্বজদের মতন মালিকের দাসত্ব করতে বাধ্য থাকবে। ফলস্বরূপ যে অনেক পরিবার সারাজীবন পরিশ্রম করেও নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। একইভাবে, ছোট জমিদাররা প্রয়োজনে সরকারের কাছ থেকে যে ঋণ নিয়েছে, তা তাঁদের নিজের জীবনে শোধ না করতে পারলে তার বোঝা পরবর্তী প্রজন্মের ঘাড়ে চাপতো। সেজন্যে আমি সিদ্ধান্ত নিই যে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ঋণ হস্তান্তর নিয়মটি বাতিল করি। এভাবে সমস্ত সরকারি ঋণও মকুব করি।

আমি জানতাম যে অভিজাত এবং স্বার্থান্বেষী লোকেরা এই সংস্কার পছন্দ করবে না, তাই আমি আধিকারিকদের বলি এই সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে এবং শহরে শহরে সকল জনপদ ও গ্রামে গ্রামে পোস্টার লাগিয়ে আমার সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষকে জানিয়ে দিতে। এই কাজের জন্য, তখন আমাদের ধর্মীয় পুঁথিগুলি যেভাবে ছাপানো হতো, সেভাবেই কাঠের ব্লক তৈরি করাই। যাঁরা এই সংস্কারে বাঁধা দিতে পারতেন, তাঁরা জানতেন না যে কী মুদ্রিত হচ্ছে, আর যখন জানলেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছিল। এভাবে দ্রুত একটি আর্থিক সংস্কার সারা দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই সংস্কার মানুষের মনে চীনা আগ্রাসন পরবর্তী হতাশা ও অবসাদ কাটাতে অনেকটা সাহায্য করে।

সতের সূত্রী চুক্তিতে এটা স্পষ্ট করে লেখা ছিল যে তিব্বতে স্থানীয় সরকার নিজেই সংস্কার কাজ করবে, এবং এক্ষেত্রে চীনা কর্মকর্তাদের কোনও চাপ আসবে না। ভূমি সংস্কারের এই প্রারম্ভিক প্রচেষ্টা থেকে হাজার হাজার মানুষ তাত্ক্ষণিকভাবে উপকৃত হন, তবে শীঘ্রই আমরা জানতে পারি যে কৃষি সংগঠন সম্পর্কে আমাদের চীনা ‘মুক্তিদাতা’দের মতামত ভিন্ন। এই সময়ের মধ্যে, আমদোতে যৌথ খামারে চাষ শুরু হয়ে গেছিল। তারপর, চীনারা গোটা তিব্বতে এই যৌথ খামার চালু করে, ফলে দেশে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে মারা যায়। তারপর, চীনা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর তাঁরা নীতি পরিবর্তন করেছিল, কিন্তু এর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া আজ অবধি শেষ হয়নি। চীনের দখলে থাকা তিব্বতে যারাই গেছেন, তাঁরা এসে বলেছেন যে তাঁদের বিশ্বাস, পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে নতুন প্রজন্মের গ্রামের মানুষ আকারে খুব ছোট আর দুর্বল প্রকৃতির হয়ে পড়েছেন।

যাই হোক, এসব তো পরের কথা, এগুলি লিখতে গেলে দীর্ঘশ্বাস ও চোখের জল আমার কলমকে বারবার থামিয়ে দেয়। হ্যাঁ, আমি সন্ন্যাসী হয়েও যে কাঁদি, একথা অস্বীকার করছি না!

আবার সেই সময়ে ফিরি। তখন আমি নিজের আধিকারিকদের উপর চাপ সৃষ্টি করি যাতে সমস্ত পুরনো এবং কালবাহ্য প্রথা চিহ্নিত করে বাতিল করার প্রস্তাব আনা হয়। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই, বিংশ শতাব্দীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সবকিছু সংস্কার করতে যথাসম্ভব চেষ্টা করে যাব। এই কাজে দৈনিক অগ্রগতির প্রতিবেদন পেশের আদেশ দিয়ে আধিকারিকদের উপর এই চাপ অব্যাহত রাখি।

আমার যতটা মনে আছে, ১৯৫৩ সালের গ্রীষ্মে আমি পুরনো সম্পর্ক ঝালিয়ে প্রথম গুরু লিঙ রিনপোচের কাছ থেকেই কালচক্র অনুষ্ঠানের দীক্ষা নিই। এটি তান্ত্রিক ঐতিহ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান, যার লক্ষ্য বিশ্বশান্তি। অন্যান্য তান্ত্রিক অনুষ্ঠানের বিপরীতে, এর আয়োজন বিশাল জনসমাগমের মধ্যেই হয়। অনেক বড়ো অনুষ্ঠান, প্রস্তুতি নিতেই সাত থেকে দশ দিন সময় নেয় এবং তিনদিন ধরে চলে। এতে নানা রঙের বালি দিয়ে সাজিয়ে একটি বিশাল মণ্ডল রচনা করা হয়, যা একটি ত্রিপক্ষীয় প্রতীকের দুটি পক্ষের দ্বারা প্রস্তুত করা হয়। আমি যখন প্রথমবার এরকম মণ্ডল দেখি, সেটির দিকে তাকাই, তখন ভারসাম্য হারাতে শুরু করি, সেটি এতই অনন্যসাধারণ বলে মনে হয়েছিল।

এক মাস সম্পূর্ণ বিশ্রামের পরে দীক্ষার কাজ শুরু হয়েছিল। সে এক অনন্য কার্যকর অভিজ্ঞতা, যা আমার এবং লিঙ রিনপোচে উভয়েরই হয়েছিল, আমার আজও ভাবলে গায়ে কাটা দেয়। গর্ব হয়, ভাগ্যিস, অত্যন্ত প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই বিশেষ অনুষ্ঠানে শরিক হতে পেরেছি। দীক্ষা - প্রার্থনার শেষ মন্ত্রটি উচ্চারণ করতে গিয়ে ভাবাতিরেকে গলা বুজে আসতে থাকে - যদিও এর গুরুত্ব জানতাম না, তবে পরে জানলাম যে এই ভাবাতিরেক এই অনুষ্ঠানে আমার পবিত্রতার প্রতীক। এখন আমি এটিকে এভাবে দেখি যে, আমার পূর্বসূরীদের চেয়ে বেশি এবং বিশ্বের সর্বত্র, কালচক্রের দীক্ষা দিতে পেরেছি।এই অনুষ্ঠানে সর্বাধিক যোগ্য ব্যক্তি না হলেও, এই অধিকার আমার আছে।

পরের বছর 'মোনলাম' উপলক্ষে জোখাং মন্দিরে চেনরেজির মূর্তির সামনে আমি বৌদ্ধ ভিক্ষুত্বের সম্পূর্ণ দীক্ষা অর্জন করি। আমার জন্য, এটিও অত্যন্ত কার্যকর অনুষ্ঠান ছিল এবং এটিও পরিচালনা করেন গুরু লিঙ রিনপোচে। পরে সেই গ্রীষ্মে, কিছু মহিলার অনুরোধে, আমি তাঁদের জীবনে প্রথমবার কালচক্রের দীক্ষা দিই।

এই সময়কালে, চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আবারও একটি চুক্তি হয়, যা থেকে আমি বুকভরে স্বস্তির প্রশ্বাস নিতে পারি। এই স্বস্তিকেও আমার ধর্মীয় কর্তব্য সম্পাদনের জন্য ব্যবহার করি। ছোটো-বড়ো নানারকম জনসমাবেশে নিয়মিত মানুষের সঙ্গে কথা বলতে থাকি। ফলে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হতে শুরু করে।

যদিও শুরুতে জনসমক্ষে কথা বলতে অস্বস্তি হতো। কিন্তু সাহস করে নিয়মিত বলতে থাকায় আত্মবিশ্বাস দ্রুত বৃদ্ধি পায়। আমার কাছে খবর আসছিল, লাহসার বাইরে চীনা সেনারা আমার লোকদের অনেক কষ্ট দিচ্ছে। একই সময়ে, নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারি, কেন আমার দুই জ্ঞানী ও নিষ্ঠাবান প্রধানমন্ত্রী এই চীনাদের বিরোধী ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, জেনারেল চিয়াং চিন - বু যখনই দেখা করতে আসত, তখন তার দেহরক্ষী সৈন্যরা আমার ঘরের চারপাশে পাহাড়া দিতো – যদিও তাঁকে আগেই বলা হয়েছিল যে জীবনের পবিত্রতাই বৌদ্ধ ধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি।

এই সময়ে আমার বুদ্ধের এই উপদেশটি নিয়ে ভাবি, এক অর্থে, বন্ধু থেকে একজন প্রতিষ্ঠিত শত্রু অধিক মূল্যবান, কারণ শত্রু আপনাকে কিছু শিক্ষা দেয় - যেমন সহনশীলতার শিক্ষা - যা আপনি কোনও বন্ধুর কাছ থেকে পেতে পারেন না। এই ভাবনায় আমার দৃঢ় বিশ্বাসটিও যোগ করি যে পরিস্থিতি যতই কঠিন হয়ে উঠুক না কেন, তা কখনও সত্যিই সহজ হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত, সর্বজনের সত্য, ন্যায়বিচার এবং মানবিক সম্প্রীতির জন্য আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা অবশ্যই অজ্ঞতা ও হতাশার উপরে জয়লাভ করবে। সুতরাং, চীনারা যদি দমন পীড়ন চালান, তাহলেও আমরা তাঁদের কাছ থেকে শক্তি অর্জন করবো।

চলবে ...।