শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

মহাসত্যের বিপরীতে,পর্ব ১০

‘ ঝড় দাপটে/পাশাপাশি দুটি গাছ/ লড়ে চলে প্রতিক্ষণ/ আর, মাটিতে কান/ পেতে মরা পাতারা/ শোনে গোপন গভীরে/ চলে/ শেকড়ের আলিঙ্গন – মেঘমালা দে

দশ

অলোক আলেকজান্দ্রা ডেভিড নীলের লেখা বইটা পানচুককে দিয়ে দেয়। পড়া না হলেও দিয়ে দিতে হতো। পরদিন সকালেই পানচুক তার গ্রামে ফিরে যাবে। আবার হয়তো মাস তিনেক পর ফিরবে। আবহাওয়া ভাল থাকলে অলোকও দু’দিন পর হেলিকপ্টারে লেহ্ ফিরবে। সেখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অন্ততঃপক্ষে ২০-২২ দিনের ছুটিতে আগরতলা যেতে চায়। অনেকদিন হয়ে গেছে অন্তরা-তোড়া, বাবা-মা আর অঞ্জনাকে দেখেনি। এই বই পানচুকের পারিবারিক সম্পত্তি। তার ঠাকুর্দা আর ঠাকুরমার প্রেমকথা লেখা রয়েছে যে। আলেকজান্দ্রা ডেভিড নীলের নাতনি লবজাং স্টোকডানের সঙ্গে ওদের গ্রামে এসে বইটি দিয়ে গিয়েছিলেন। সঙ্গে কিছু টাকা। মায়ের লেখা উপন্যাসের চরিত্র সন্ধানে বেরিয়ে তাদের বংশধরদের খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে ছিলিং পানচুক জানবাককে পেয়েছেন ওই গবেষিকা। মহিলা চলে গেলে লবজাং স্টোকডান তাকে একদিন পড়ে পড়ে তর্জমা করে খানিকটা শুনিয়েছে। কিন্তু পুরোটাই আবার শুনিয়েছে ভারতীয় বিমানবাহিনীর আবহাওয়া আধিকারিক সার্জেন্ট অলোক মিত্র। সুযোগ পেলেই তিনি হাসপাতালে এসে তার বিছানার পাশে বসে তর্জমা করে শোনাতেন।এই কাহিনি তাকে দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করেছে। সেজন্যে মিত্রসাহেবের কাছে তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তার কাছে বর্ণনা শুনেই ছিলিং পানচুক জানবাক বুঝতে পারে যে উপন্যাসের শেষটার সঙ্গে ঠাকুর্দা ঠাকুমার জীবনের কোনও মিল নেই। আর আগের ঘটনাগুলির অধিকাংশ তো পানচুক জানতোই না। সেজন্যে ওই উপন্যাসের কতটা বাস্তব আর কতটা লেখিকার কল্পনা তা ঠাহর করতে পারছে না সে। তবুও বইটি তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। এই অপ্রত্যাশিত উপহার পুরো এলাকায় তাদের পারিবারিক সম্মান বৃদ্ধি করেছে। সে গিয়ে দেখে মিত্রসাহেব টেলিপ্রিন্টারের ব্যবহৃত কাগজ দিয়ে বইটিতে সুন্দর মলাট লাগিয়ে পরিপাটি করে রেখেছে। সে এখন নতুন একটি বই পড়ছে।

  • কী বই পড়ছেন সাহেব?
  • মিত্র মুচকি হেসে বলে, -এই চীন –ভারত সম্পর্ক নিয়ে পড়ছিলাম।

গতকালই গোমাঠ থেকে ফিরেছে সে। লাদাখের ডেমচক সেক্টরে ভারতীয় গ্রাম গোমাঠ বা গোম্বিতে কাশ্মীর সরকার ও কেন্দ্রীয় সীমান্ত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্পের যৌথ উদ্যোগে রাস্তা ও যাত্রীদের জন্য একটা পাকা ছাউনি তৈরির সময় সীমানা পার হয়ে এসে চীনা সেনারা ইশারায় ওই কাজ বন্ধ রাখার জন্য কর্মীদের শাসায়। ভয়ে ঠিকাদার ও শ্রমিকরা কাজ ছেড়ে পালিয়ে আসে। ঠিকাদার কাশ্মীর সরকারের গ্রামোন্নয়ন দফতর এবং ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানালে সেনাবাহিনী বিমানবাহিনীর কাছে একটি ক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ দাবি করে। ফলস্বরূপ দুটি হেলিকপ্টারের ডেমচক হয়ে গোমাঠ বা গোমবি যাত্রা।

চীনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত বিরোধের প্রধান ক্ষেত্র আক্সাই চীন এবং অরুণাচল প্রদেশ। চীন মনে করে, ইংরেজরা ওই দুটি অঞ্চল দখল করেছিল এবং সেগুলি এখন ভারত দাবি করছে। অথচ, তিব্বতের উপর তাদের দাবির পেছনেও যে ওই একই ধরণের যুক্তি রয়েছে চীন তা মানতে অস্বীকার করে। চীনের বক্তব্য, মাঞ্চু রাজবংশ থেকে উদ্ভূত চিঙ্গ রাজবংশের শাসনকালে তিব্বত চীনের অধিকারে আসে। অথচ অলোক পড়েছে যে, ১৯১১ খ্রিস্টাব্দেও চীনা জাতীয়তাবাদীরা চিঙ্গ রাজবংশকে বিদেশি বলেই মনে করতো। তাই সে মনে করে, আকসাই চীন ও অরুণাচল প্রদেশের উপর ভারতের দাবি অযৌক্তিক হলে, বিদেশি চিঙ্গ শাসকদের আমলে অধিকৃত তিব্বতের উপর চীনের দাবিও যুক্তিসঙ্গত নয়।

অলোক ভাবে, চীনের সুপরিকল্পিত নীতি নিশ্চয়ই সীমান্তে ভারতীয় ভূমির উপর অধিকার বিস্তার করা। গোমবির ঘটনা তারই নগ্নরূপ। অলোকরা হেলিকপ্টার রেকিতে দেখে এসেছে যে লাইন অফ কন্ট্রোলের ওপারে চীন কিন্তু রাস্তাঘাট তৈরি করছে। কোনও যুদ্ধ লাগলে যাতে সহজেই যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম আনা যায়, এটা তারই প্রস্তুতি। অথচ এপারে ভারতীয় শ্রমিকরা রাস্তা তৈরি করতে গেলেই তারা আপত্তি তুলছে এবং বাধা দিচ্ছে। এটাই তাদের সুপরিকল্পিত অনুপ্রবেশ নীতি। মনে হয় চীন তাদের একটি প্রাচীন প্রবাদ অনুসরণ করছে – ‘অন্য লোকের জমি দখল করতে গেলে গজ মেপে নয়, ইঞ্চি মেপে করা উচিত’, তাহলে হঠাৎ চোখে পড়বে না এবং বিষয়টি নিয়ে শোরগোল হবে না! এই চীনা প্রবাদ ভারত সরকারের জানা নেই কি?

পানচুক বলে, চীনের ভারতের মাটি দখলের ইচ্ছেটা আর কোনও অর্থেই গোপন নেই।

অলোক বলে, ঠিক বলেছ, ইদানীং অরুণাচল প্রদেশ ও কাশ্মীরকে চীনা মানচিত্রে ‘বিতর্কিত’ ভূমি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটাও চীনের একই ধরণের আগ্রাসী কৌশল।

পানচুক জিজ্ঞেস করে, এক্ষেত্রে ভারত কী করবে, লড়াই?

অলোক বলে, অবিলম্বে বিষয়টি নিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সতর্ক না হলে লাদাখে চীন ক্রমে ইঞ্চি মেপে দখলের পথ ধরবে।

পানচুক বলে, যখন সেটা দিল্লির বাবুদের নজরে আসবে, তখন হয়তো এই দেশের অনেকটাই চীনের দখলে চলে যাবে!

অলোক বলে, এত সহজ নয়, সীমান্তে ইন্দো-তিবেটান বর্ডার পুলিশ রয়েছে যে!

পানচুক বলে, কিন্তু তাদেরকে ভারতীয় হিন্দু সাধুরা ঠিকমতো কাজ করতে দেয় না!

অলোক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, মানে?

পানচুক বলে, আপনি জানেন না? জড়ি পোকার ব্যবসা! আপনারা যে হিন্দিতে জড়িবুটি বলেন, আমার মনে হয় তার জড়ি হল এই জোঁকের মতো পোকা। এই পোকা থেকে হিন্দু সাধুরা যৌন শক্তিবর্ধক ঔষধ বানায়। চীন ও জাপানে এই ঔষধের খুব চাহিদা। চীনা সৈন্যরা ১৬-১৮ লক্ষ টাকা কেজি দরে কিনে নিয়ে যায়।

এর মধ্যে সর্বোচ্চ চাহিদা হল ইয়ারসাগামবু জড়ি পোকার। ঠিকেদারেরা হিমালয়ের পাদদেশের ভারত ও নেপালের গ্রামগুলি থেকে গরিব মানুষদের নিয়ে আসে এই পোকা সংগ্রহের জন্য। তাঁরা দিনে দেড় থেকে দু’হাজার টাকা মজুরি পায়।

এই পোকা সংগ্রহ খুবই কঠিন কাজ, কিন্তু টাকার লোভে এমনকি স্কুলের ছাত্ররাও বড়দের সঙ্গে যায়। তারা ফিরে গিয়ে স্কুলে মেডিকেল সার্টিফিকেট দেয়। ঠিকেদারেরা প্রতিদিন সংগ্রহ করা পোকা সাধুদের দিয়ে আসে, আর তারপর শক্তিবর্ধক ঔষধ তাদের মাধ্যমেই চীনে পাচার হয়। ইন্দো টিবেত সীমান্ত রক্ষীরা এই ব্যবসার রাশ টেনে ধরলে সাধুরা তাদের রাজনৈতিক যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে জড়ির ব্যবসাকে ইন্দো টিবেত সীমান্ত রক্ষীদের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করে। অবশ্য আমাদের আক্সাই চীন এলাকার পাহাড়ে এই পোকা হয় না –

অলোক বলে, আক্সাই চীনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল চীন দখল করেই রেখেছে! এবার তার দৃষ্টি অরুণাচল প্রদেশ এবং কাশ্মীর। কাশ্মীরে তার প্রধান সহায় অবশ্যই পাকিস্তান।

পানচুক বলে, আমরা তিব্বতিরা এই মহাশক্তির বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছি বিগত অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে, আমরা জানি যে এটা একটা ভীষণ অসম লড়াই ! তবু......! ভারত তার ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সতর্ক না হলে কাশ্মীরে ভারতকে ভবিষ্যতে কেবল পাকিস্তান নয়, চীনের সঙ্গেও যুঝতে হবে !

অলোক বলে, ভারতও যুঝছে, সেই ১৯৫৯ এর মার্চে দালাই লামা ভারতে আসার পর থেকেই ! ১৯৬২তে সীমান্ত বিবাদ থেকেই চীন ভারত যুদ্ধ। তারপর যুদ্ধ থামলেও সীমান্ত বিবাদ কিন্তু চলছেই। কার জমি, কার ভূখণ্ড, কার প্রদেশ, কার রাস্তা! অথচ অনেক হাজার বছর আগে একটি পথ তৈরির মাধ্যমেই এই দুই সম্পর্কের রেশমি বন্ধন তৈরি হয়েছিল ।

ওদের কথার মাঝেই ডাক্তার ক্যাপ্টেন নাম্বুদ্রিপাদ এসে পৌঁছায় বায়ুসেনার স্নো-হাটে। ওদের আলোচনার শেষটা শুনে বলে, চিন্তা করবেন না মিত্র, বাণিজ্য অর্থনীতিই এই দুই প্রাচীন দেশকে আবার কাছে আনবে। সম্প্রতি কয়েক সহস্রাব্দ প্রাচীন সেই সিল্ক রুটেরই পুনরুজ্জীবনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে চীন। অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সহযোগী হিসেবে চাইছে ভারতকে। আর তার মাধ্যমেই হয়তো আবার খুলতে চলেছে চীন–ভারত সহ দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় বাণিজ্য ও অর্থনীতির মূল সূত্র এই সিল্ক রুট। সেই পথ ও তার নানা শাখা–প্রশাখা বরাবর একাধিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক করিডরের পরিকল্পনা নিয়েছে চীন, যা দু’দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। হাজার হাজার বছর ধরে মধ্য এশিয়ার বাণিজ্যিক মানচিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করেছে বর্তমান চীন, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান-সহ বিস্তীর্ণ এলাকার বুক ছুঁয়ে বিস্তৃত এই রেশম পথ। আর এই পথের পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান চূড়ান্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু প্রাচীন জলপথ ও স্থলপথের সংযোগস্থল ছিল ভারতেই, আরও স্পষ্ট করলে তোমাদের ওয়েস্টবেঙ্গলের তমলুকে – প্রাচীন তাম্রলিপ্ত বন্দরে। এই সংযোগটিকে মাথায় রেখেই চীন পাশে চাইছে ভারতকে!

অলোক বুখারির উপর রাখা মেসটিনে জল গরম করে তাতে কন্ডেন্সড মিল্ক ও কফি পাউডার মিশিয়ে কফি বানিয়ে স্টিলের গ্লাসে করে ক্যাপ্টেনকে আর পানচুককে দেয়। নিজেও একগ্লাস নেয়। ক্যাপ্টেন নাম্বুদ্রিপাদ কফিতে চুমুক দিয়ে বলেন, প্রস্তাবিত এই নতুন সিল্ক রুটের তিনটি মূল শাখা। একটি চীন থেকে মঙ্গোলিয়া ও তাকলামাকান মরুভূমি হয়ে পাক-অধিকৃত কাশ্মীর, কাজাখস্তান, আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে কন্সতান্তিনোপল এলাকা পর্যন্ত । অন্যটি সিল্ক রুটের পূর্বাংশের শাখাপ্রশাখাগুলি নিয়ে, যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মায়ানমার। তৃতীয়টি হল বঙ্গোপসাগর থেকে ভূমধ্যসাগরে বিস্তৃত প্রাচীন জলপথটি। প্রথমটির ক্ষেত্রে ভারত সরাসরি যুক্ত নয়। যেহেতু পাকিস্তানের সঙ্গে কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া ভারতের বাণিজ্য প্রায় বন্ধই। দ্বিতীয় ও তৃতীয়টির ক্ষেত্রে ভারত সরাসরি যুক্ত হতে পারে।

অলোক জিজ্ঞেস করে, এ বিষয়ে ভারতের প্রতিক্রিয়া কী?

ক্যাপ্টেন নাম্বুদ্রিপাদ বলে, একটি ম্যাগাজিনে পড়লাম বি সি আই এম বা দ্বিতীয় প্রস্তাবিত রুটটি নিয়ে যথেষ্ট উৎসাহ দেখিয়েছে ভারত, কিন্তু অন্য দু’টি নিয়ে আপত্তি রয়েছে। স্থলপথটি যেহেতু পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ভিতর দিয়ে যাবে, ভারতের ক্ষেত্রে তা বিতর্কিত এলাকা, এ বিষয়ে নয়াদিল্লি তাই আরও বিস্তারীত জানতে চেয়েছে। অন্যদিকে জলপথটি পাকিস্তান ও শ্রীলংকার বিভিন্ন বন্দরকে যুক্ত করবে বলে প্রস্তাব, যা ভারতের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কৌশলগত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

অলোক বলে, স্যার, আমিও কোথাও পড়েছি যে, চীন ভারতের সহমতির অপেক্ষা না করেই যথারীতি কাজ শুরু করে দিয়েছে। শ্রীলংকার হাম্বানটোটা, পাকিস্তানের গদর, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম আর মালদ্বীপের মারাও বন্দরে উন্নতমানের বন্দর নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শুরু করে দিয়েছে। ভারতের উচিত চীন যাতে ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সমস্যা কাটিয়ে তবেই এগুতে পারে এটা সুনিশ্চিত করা। তাহলেই একাধিক অর্থনৈতিক করিডর চীন ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক যোগাযোগ বাড়াবে, আরও বড় লাভ হতে পারে পরিকাঠামো উন্নয়ণের ক্ষেত্রে।

নাম্বুদ্রিপাদ বলে, অবশ্যই, এই সিল্ক রুট প্রকল্প যেভাবে বলা হচ্ছে সেভাবে সফল হলে ভারতে রাস্তাঘাট, রেলপথ, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি নির্মাণে চীনা বিনিয়োগ ঢুকবে বিশাল পরিমাণে। আর ঐতিহ্যবাহী এই পথের পুনরুজ্জীবন চীন-ভারতের মধ্যে পর্যটক যোগাযোগও বাড়িয়ে দেবে কয়েক গুণ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তি ও সহযোগিতার বাতাবরণ গড়ে তুলতে এই প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ-

অলোক বলে, তা তো ঠিকই, দুই দেশের মধ্যে হাজার হাজার বছর ধরে এত সুন্দর সাংস্কৃতিক যোগাযোগ, একটা অনর্থক যুদ্ধের জন্য সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল –

হঠাৎ ছিলিঙ পানচুক জানবাক বলে ওঠে, আর তিব্বত? স্বাধীন তিব্বতের কী হবে?

এই প্রশ্নে দুজনেই চুপ। কয়েকটি পিকা ইঁদুর নির্ভয়ে স্নো হাটের মেঝেতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। নাম্বুদ্রিপাদ কিম্বা অলোক জানে না তার প্রশ্নের কী জবাব দেবে! আপাততঃ ‘স্বাধীন তিব্বত’ ধারণার কোনও ভবিষ্যৎ নেই বলেই মনে করে অলোক। কিন্তু সে মুখ ফুটে বলতে পারছে না। তাহলে পানচুক কষ্ট পাবে!

নাম্বুদ্রিপাদ একটু কেশে বলে, তার জন্যে দূরদৃষ্টির প্রয়োজন; কয়েক হাজার বছরের বন্ধুত্ব, না কয়েক দশকের তিক্ততা –পাল্লা ভারী কার দিকে, সেই উত্তরের জন্য আপাততঃ অপেক্ষা করতেই হচ্ছে। তিব্বতের দাবি এড়িয়ে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হবে কিনা তা-ও সময় বলবে!

ডাক্তার সাহেবের কথার মানে বুঝতে পারে না ছিলিং পানচুক জানবাক। সে শুনেছে, ১৯৮৯ তে লহাসা ও তিব্বতের অন্য কয়েকটি এলাকায় আন্দোলনের পর পরিস্থিতি এখন অগ্নিগর্ভ। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।

অলক জানে, ‘হিন্দি-চীনী ভাই ভাই’-এর রোমান্টিকতা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছিল ১৯৬২-র যুদ্ধে। নেহেরুর কাছে তা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। কিন্তু সাউথ ব্লক বলছে, ১৯৯৩ আর ১৯৬২ এক নয়। পরমাণু যুগে শত্রুতা আর যুদ্ধের ঝুঁকি – নৈব নৈব চ!

নাম্বুদ্রিপাদ বলে, স্বাধীন তিব্বত নিয়ে তোমরা ছাড়া কেউ ভাবছে না পানচুক! হিমালয়ের দুই প্রান্তে দুই দেশ একজোট হয়ে শক্তিশালী এশীয় ইঞ্জিন গড়ে তোলার স্বপ্নকে রাখতে চাইছে চীন !

অলোক বলে, আপনি যাই বলুন না কেন, তিব্বত নিয়ে শেষকথা বলার সময় এখনও আসেনি ! চীনের সাম্প্রতিক কূটনীতিতে কিন্তু একটা ধারাবাহিক সম্প্রসারণবাদ দেখা যাচ্ছে। সেটি শুধু আর্থিক নয়, সামরিকও বটে! চীন এখন দাবি করছে, ভারতের সঙ্গে তাদের সীমান্ত হল দু’হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ। কিন্তু ভারতীয় সরকারি তথ্য অনুসারে এই সীমান্ত হল সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার। পাক অধিকৃত কাশ্মীর, নেপাল, ভূটান ও মায়ানমার সীমান্তে চীন যেভাবে সক্রিয়, তাতে বোঝা যাচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাহুবল প্রতিষ্ঠায় চীন তৎপর। আমার মনে হয় চীনের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কিছু ক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব দেখা দিয়েছে। তিব্বত ও জিয়ানজিয়াং – এই দুই স্বশাসিত এলাকা নিয়ে চীন বিব্রত।

নাম্বুদ্রিপাদ বলে, আমার মনে হয়, চীনের যে প্রজন্ম এখন ক্ষমতাসীন, ১৯৬২-র ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষের পরেই তাঁরা সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে। সীমান্ত বিরোধ নিয়ে প্রবীণদের তিক্ততার বোঝা তাঁরা নিজেদের কাঁধে নিতে চান না। হয়তো সেজন্যেই ছোটোখাটো উত্তেজনার উপলক্ষকে আঁকড়ে ধরার পরিবর্তে সেগুলিকে উপেক্ষার উদার নমনীয়তা তাঁদের আয়ত্ত।

অলোক বলে, ঠিক স্যর, এই নমনীয়তা একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রচনার ভিত্তি হওয়া উচিত। সীমান্ত বিরোধ জিইয়ে রেখে চীনের সঙ্গে সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক স্থাপন করা যে অসম্ভব, তা নিশ্চিত। আমার বাবা-মায়ের বদলির চাকরি ছিল, ত্রিপুরার নানা প্রান্তে থেকেছি আমরা। সেই সুযোগে আমাদের আগরতলা বাড়ির পেছনদিকে যাদের বাড়ি, তারা আমাদের কিছুটা জমি দখল করে টয়লেট ও স্নানঘর বানিয়ে ফেলে। তাঁদের লোকবল ছিল, শাসক দলের সমর্থক পাড়ার ক্লাবের মস্তানদের হাত করে রেখেছিল। বাবা দীর্ঘকাল আদালতে কেস লড়েও সেই সমস্যার সমাধান করতে পারে নি। এখন বাবাও নেই, সেই প্রতিবেশীও বেঁচে নেই। আমি ও ভাই ঐ লোকটার ছেলে মাখনের সঙ্গে একটা রফায় এসে মামলা তুলে নিয়েছি। দু’বাড়ির মধ্যে দেওয়াল তোলার খরচ মাখন দিয়েছে। ফলে সব বিবাদ শেষ!

নাম্বুদ্রিপাদ বলে, ঠিক, চীন-ভারতের বিরোধটিও আসলে উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদের উত্তরাধিকার। তিব্বতের তৎকালীন শাসকদের সঙ্গে ব্রিটিশ উপনিবেশ-এর প্রতিনিধিদের সম্পাদিত সীমান্তরেখা ‘ম্যাকমোহন লাইন’ চীন কখনও মেনে নেয়নি, আফগানিস্তান যেমন মানে নি পাকিস্তানের সঙ্গে তার সীমান্ত ‘ডুরান্ড লাইন’ এর বৈধতা, একথা মাথায় রেখেই বিরোধটির মীমাংসা করা প্রয়োজন। স্থায়ী নিষ্পত্তির জন্য দু’দেশেরই উচিত প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখাকে সীমান্ত হিসেবে মেনে নেওয়া!

অলোক বলে, অবশ্যই, কাশ্মীরের ক্ষেত্রেও আমি তাই ভাবি স্যর! শুধু শুধু আমরা পূর্বপুরুষদের ভুল ও কাপুরুষতার ঐতিহ্যকে কেন বহন করবো? ভবিষ্যত প্রজন্মকে ভুল মানচিত্র শিখিয়ে তাদেরকেও হীনমণ্যতার দিকে কেন ঠেলে দেব?

নাম্বুদ্রিপাদ ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে অলোককে বলে, ধীরে বলুন, আর ঘুণাক্ষরেও অন্য কোনও অফিসারের সামনে এই মতামত রাখবেন না, তাহলে –

অলোক হেসে বলে, জানি স্যার, শুধু আপনাকেই বলছি, আর পানচুক আমার অত্যন্ত বিশ্বস্ত, আর আমরা তো –

নাম্বুদ্রিপাদ বলে, আপনি ঠিকই বলেছেন, ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্ত বিরোধ এখনও নিস্পত্তি না হওয়ার মূলে অংশত র‍য়েছে ১৯৬২-র স্মৃতিচারিত উগ্র জাতীয়তাবাদ, দু’দেশের বর্তমান রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে যা আদৌ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিছুদিন আগে একটা কাজে চীন দূতাবাসে গিয়ে কয়েকটি চীনা ম্যাগাজিন পড়ার সুযোগ হয়েছিল, কয়েকজন চীনার সঙ্গে আড্ডাও হয়েছে। চীনের বর্তমান শাসক গোষ্ঠী কিম্বা চীনের তরুণ প্রজন্মের মনে কিন্তু সীমান্ত – সংঘর্ষ বা সেই সূত্রে ধূমায়িত উগ্র ভারতবিরোধী মনোভাবের লেশমাত্র দেখিনি। আমি মনে করি, এখন বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলে দু’দেশের মানুষই লাভবান হবে। একবার সীমান্ত বিরোধের নিষ্পত্তি হলে তার জেরে দীর্ঘ সীমান্ত বরাবর বিপুল সামরিক প্রস্তুতি ও ব্যয়ভার অনেকটাই কমে যাবে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে যে জোয়ার আসবে, দু’দেশের অর্থনীতি, সমাজ, প্রযুক্তি ও পরিকাঠামোর উন্নয়নে হাতে–নাতে তার সুফল মিলবে!

ওদের কথা শুনতে শুনতে অলোকের কেরোসিন স্টোভ জ্বালিয়ে বাইরে থেকে আনা বরফ গলিয়ে পানচুক তিন গ্লাস চা বানায় আর কিছু কাজু ও কাঠবাদাম ভাজে ঘি দিয়ে। ওদের সামনে সেগুলি পরিবেশিত হলে চায়ে চুমুক দিয়ে নাম্বুদ্রিপাদ বলে, ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে গঠিত আর্থ সামাজিক জোট ‘ব্রিকস’ গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার সুবাদে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে যে ঘনিষ্টতা ইতিমধ্যেই নানা ক্ষেত্রে দুই দেশকে বাণিজ্যিক বন্ধনে বেঁধেছে, তা আরও নিবিড় হবে বলে মনে করি!

কাগজের প্লেটে রাখা কাজু ও কাঠবাদাম ভাজা মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে নাম্বুদ্রিপাদ বলে, একটু বিটনুন আর গোলমরিচের গুড়ো ছিটিয়ে দাও পানচুক!

অলোক বলে, আমিও সেটাই বলতে যাচ্ছিলাম, দাঁড়ান, ও জানবে না কোথায় বিটনুন আর কোথায় গোলমরিচ!

অলোক উঠে মশলার প্যাকেটগুলি বের করে। নাম্বুদ্রিপাদ গলা খাকারি দিয়ে একটু নিচুস্বরে বলে, এরকম হলে এমনকি পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সমীকরণেও নববিন্যাস দেখা দেবে। চীন –পাকিস্তান মৈত্রীকে আর ভারতের স্বার্থবিরোধী কোনও বন্দোবস্ত বলে মনে হবে না, বরং গোটা মহাদেশেই এই তিন দেশের পারস্পরিক বন্ধুত্ব সামাজিক বিকাশের অনুঘটক হয়ে উঠবে। হাসছেন কেন?

অলোক মুচকি হেসে বলে, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে দিবাস্বপ্ন দেখছি বুঝি!

  • এখন তো তাই মনে হবে! কিন্তু প্রাচীন সিল্ক রুটের আধুনিক সংস্করণ কারাকোরাম হাইওয়ে দিয়ে তখন ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাকও চীন ও পাকিস্তানে চলাচল করতে পারবে! কল্পনা করুন তো, লেহ থেকে খরদুংলা হয়ে তিরিত–সাসোমার পর সিয়াচেন হিমবাহের বেসক্যাম্প থেকে নির্মীয়মান টেরাং টকপো রোড ধরে ভারতীয় ট্রাকগুলি কারাকোরাম হাইওয়ে পৌঁছে যাবে। এই পথে অগ্রগতিই চীন–ভারত সম্পর্ক এবং উপমহাদেশে শান্তি ও উন্নয়ণের সুপথ। কিন্তু আমার মতে এখনই সীমান্ত সমস্যা সমাধান করে ফেলার চেষ্টা বাস্তবোচিত নয়। বরঞ্চ সমাধানের ইচ্ছেটা মাথায় রেখে অন্যান্য ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রসার ঘটানোই বাঞ্ছনীয়। পাশাপাশি বেজিং না চাইলেও আমেরিকা–জাপান ও ভিয়েতনামের সঙ্গে ভারতের রণনৈতিক সম্পর্ক রাখতেই হবে কেননা তিব্বতের চীনা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভারত নিজের অবস্থান পরিষ্কার করলেও পাক অধিকৃত কাশ্মীরের প্রশ্নে চীন এখনও তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। ভারতের বাজার চীনের জন্যে খুলে দিলেও চীন এখনও সেই পথে হাঁটেনি। ফলে বাণিজ্যে ঘাটতি চার কোটি ডলারের উপর চলে গিয়েছে – এই দ্বিচারিতা নিয়ে ভারত এবার কঠোর মনোভাব দেখিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী সোজাসাপ্টা কথা বলেছেন। দেখা যাক কী হয় !

বলতে বলতে নাম্বুদ্রিপাদ চা শেষ করে উঠে দাঁড়ায়। পানচুক বলে আজ আমাকে ঠাকুর্দা আর ঠাকুরমার লাহসা যাত্রার অংশটা শোনাবেন বলেছিলেন স্যার !


চলবে ...