বুধবার, এপ্রিল ২৪, ২০২৪

ভুবন-মনমোহিনী

রিমা দাস -- দিল্লি নিবাসিনী , যদিও পড়াশুনা শৈশব কেটেছে কলিকাতাতে । রিমা সুলেখিকা , সদাহাস্যময়ী , আত্মজা পত্রিকার সম্পাদক । শাড়ি নিয়ে অন্যদেশের সঙ্গে খোলা কথা বললেন রিমা ।

এখনকার খুকীদের কথা জানি না। আমার মতো যারা মধ্য পঞ্চাশ কিংবা দাঁড়িপাল্লার মান সূচকে কিছুটা উপরে কিংবা কিছুটা নীচে তাদের জীবনে শাড়ির প্রভাব বা ভূমিকা নিশ্চয়ই আলাদা।পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলাদের দেখছি কখনো সাধারনভাবে শাড়ি পরে আঁচলে মস্ত বড় একটা চাবির গোছা ঝুলিয়ে কখনোবা ঠাকুরবাড়ির জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর প্রবর্তিত ধারার আধুনিক সংস্করণে শাড়ি পরে বারো মাস তেরো পার্বনের আত্মীয়স্বজন লোক লৌকিকতার বাক্সপ্যাটরা সামলিয়ে পুরো সংসার সুচারুভাবে পরিচালনা করে চলেছে।তাদের ঐ বিশাল কর্মকান্ডের ক্ষিপ্রতায় অঙ্গে জড়ান বারো হাতের কাপড়টি কোন সময় বিন্দুমাত্র অসুবিধার উদ্রেক করেনি।আমিও কখন যেন সেইসময়ের আর দশটা বাচ্চা মেয়ের মতো ঐ বারো হাত বসনটিকে নিজের অজান্তে আপন করে নিয়েছিলাম।হাল্কা নীল বা লাল সবুজের চৌকো চৌকো নরম গামছা (পরে জেনেছিলাম ঐগুলো সব বিক্রী হতে বাজারে আসত বাঁকুড়া থেকে)গায়ে জড়িয়ে মা –মাসি-পিসির চটি পায়ে গলিয়ে ফটাস ফটাস শব্দ তুলে ছিল বড় হবার আপ্রাণ আকুলতা।

5f91a44ef0b52.jpg

প্রাকৃতিক নিয়মে একদিন বড় হয়েও গেলাম।ষোড়শী কন্যার স্কুলে সরস্বতী পুজো আর শাড়ি পরব না ! দূর তাই কখনো হয়?

পশ্চিমবঙ্গে ত আবার ঐদিনটা অলিখিত ভ্যালেনটাইনস ডে।কাজেই হাত বাড়ালেই বন্ধু টান দিলাম মায়ের শাড়িতে।আমার মায়ের মতো রূপসী বিশ্বদুনিয়ায় কেউ নয়। মেরলিন মনরো কিংবা ক্লিওপেট্রা সেও নয়।তার শাড়িতে আমিও ততোধিক রূপসী হব সেই বিশ্বাস মনের মধ্যে বট অশ্বত্থের শিকড়ের থেকেও গভীরে বপন।মার শাড়ি পরে আমার রমনী জীবনের যাত্রাপথের চলা শুরু।

5f91a4b7efefb.jpg

ধীরে ধীরে চিনতে শিখলাম জগত জোড়া শাড়ির বাহার। শান্তিপুরী তাঁতের শাড়ি নিজে একাই একশো।কত তার অভিনবত্ব।পাড়ের দু’দিকে বিশেষত উপরের অংশ লাল,নীচের অংশ কালো বা একেবারে বিপরীত ভিন্ন দুটো রঙের পারের সেই শাড়ির গংগা-যমুনা নামে প্রতিপত্তি।তাসের দেশের রুইতন একা মাতিয়ে রেখেছে “রাজমহল”নামে শান্তিপুরী শাড়ির পাড়টিকে। আঁশ পাড় ,চান্দমালা আরো না জানি কত কী। হাল্কা রঙের জমিতে আড়ে সরু সরু ডুরি কাটা জলচুড়ি শাড়ি। আহা, আলাদা একটা ডেলিক্যাসি সেই শাড়ির অঙ্গ জুড়ে।আমার দীর্ঘাকৃতি মা ও বড় মাসি ওই শাড়ি পরে ফিনফিনে সাদা ধুতি পাঞ্জাবিতে কাঠের পিড়ির উপর সরলরেখায় বসা মামাদের যখন ভাইফোঁটা দিত সেই দৃশ্য আজও অমলিন।একটু ঘন বুনোটের জমিতে নকশা করা শাড়ির আঁচলে একলাইন জুড়ে ধানের শিষ ধনেখালি শাড়ির পরিচয়।ভীষণ অহংকারী বড়োলোকি শাড়ি বালুচরী।

5f91a4ea91589.jpg


আঁচলে বিবিধ পৌরাণিক ও অন্যান্য নকশা তোলা এই শাড়ি সর্বকালীন আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে আজও শাড়ি প্রীতি মহিলা মহলে বাজার দাপিয়ে রেখেছে।ঢাকার ঢাকাই শাড়ি সেই বা কিসে কম যায় । আরো কত কী ফুলিয়ার ট্যাংগাইল,বাংলাদেশের মসলিন, বে গমবাহার,বেগমপুরী,কাস্তাপেড়ে,অপেক্ষাকৃত হাল্কা মুর্শিদাবাদী সিল্ক তার থেকে একটু ভারী বিষ্ণুপুরী সিল্ক,তসর,বেনারসী,গরদ ইত্যাদি ইত্যাদি। নাম লিখতে বসলে তা হবে সাপের মতো এঁকেবেঁকে লম্বা এক লিস্টি। সারা বছর নানা অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রকারের এই বারো হাত কাপড়টি মহিলাদের অঙ্গে শোভা বর্ধন করলেও দুগগা পুজোর সকালবেলাগুলো থাকত তাঁতের শাড়ির মনোপলি।আর বিজয়া দশমীর দিন বরণ ?সে তো লাল পাড় বা গরদের শাড়ি মাস্ট।পুজোর চারটে দিনের সেই অলিখিত নিয়ম আজও আমার কাছে বর্তমান।কারণ সেখানে নিজস্ব সংস্কৃতি ছাড়াও খুঁজে পাই চির ঘুমের দেশে চলে যাওয়া আমার রক্তমজ্জার ধমনীর শিরায় উপশিরায় বয়ে চলা সেই চিরন্তন স্নেহময়ী মহিলাদের।

5f91a50bd5815.jpg

একসময় নিরাপত্তার বলয় বাপের বাড়ির গন্ডী পেরিয়ে প্রবেশ করলাম বৃহত্তর জগতে।হলাম এক অচেনা পুরুষের ঘরনী।নিজের সংসারের সাথে শুরু হল প্রবাস জীবন।তখন নিজের আধিপত্যে বিয়েতে পাওয়া উপহারস্বরূপ কিছু শাড়ির সাথে মাতৃদেবীর বেশ কয়েকটা শাড়ি।সময় বয়ে চলে।গাছে নতুন পাতার আবির্ভাবে পুরনো পাতা ঢাকা পড়ে যায়। আলমারীতে জায়গা নিতে থাকে শিফন,ব্যাঙ্গালোর,মাইসোর সিল্ক,ক্রেপ,জর্জেট,নাইলন।তারপর আরেকটু পাশ্চাত্য হাওয়া এসে ঢুকে পড়ে জিন্স,টপ,সালোয়ার কামিজ,চুরিদার আরো ছাতার মাথা কত কী।সাংবৎসর নয় কোণঠাসা হতে থাকে শাড়ি।শুধু বছরের ঐ চাট্টে দিন যেন সূর্যের মুখ দেখা তাদের।সপ্তরথে সময় দৌড়িয়েছে আমি ভুলে গেছি কিংবা বলা ভালো ভুলে বসেছি অনেক কিছু।ভুলিনি শাড়ির সাথে প্রেম।

5f91a532b1e1e.jpg

পক্ক কেশে এখন বর্তমানের সাথে স্মৃতির পালে দোল খেতে যেন বেশী ভাল লাগে।তাইতো জীবনের প্রথম প্রাপ্তি লাল-কালোর নক্সায় মুর্শিদাবাদী সিল্কের শাড়ির থেকে উঁকি মারে দুই বিনুনী ঝুলিয়ে এক ষোড়শী। সঙ্গোপনে সেই শাড়ির ভাগীদার করে রেখেছি প্রথম নাতনী যে হবে তার উদ্দেশ্যে।শাড়ির ভিড়ে লুকিয়ে থাকা প্রেমিকের প্রথম উপহার নীলাম্বরি শাড়িকে বলি ‘কি কেমন আছ’?

আর সেই ঢাকাই জামদানি শাড়িটায় পড়ন্ত বিকেলে নরম চোখে একান্ত ভালোবাসায় হাত বুলিয়ে ছুঁয়ে থাকি তাকে যিনি আমায় জন্ম না দিলে অজানা থেকে যেত পৃথিবীর এত রূপ রস সৌন্দর্য।হারিয়ে যায়নি হাল্কা সবুজ জমিতে সাদা নক্সার ছাপা শাড়িটি।মাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক যেই শাড়ি আমার কাছে ছিল এক গর্ববোধের অনুভব,আমার স্কুল ইউনিফর্ম।আমার ধীরে ধীরে প্রাপ্তবয়স্ক হবার প্রতিটা দিনের সাক্ষ্মী।

5f91a55b117e6.jpg

প্রিয় সুপর্ণাদির সঙ্গে

তাকে কি যেখানে সেখানে ফেলে রাখা যায়?তার দিকে তাকিয়ে স্কুলের বন্ধুদের খুঁজি।কাবুলিওয়ালার মিনিরা এখন আমার মত মধ্য পঞ্চাশ।চোখ খুঁজে পায় না তাদের।আমার দৃষ্টিরই দোষ। আইনত প্রথম পুরুষের সঙ্গে রাত্রিবাস।সেই কাঞ্জিভরম শাড়িটিও পক্ক কেশের মহিলাকে দেখে ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে রাখে গূঢ এক রসিকতার হাসি।

ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাই।পুজো যেন কবে থেকে শুরু…।

তাহলে ষষ্ঠীর দিন চান্দেরী।সপ্তমীর দিন সকালে ফুলিয়ার হাজার বুটি।রাতে কোষা বেনারসী।অষ্টমীর অঞ্জলি বাংলাদেশী ঢাকাই জামদানি।রাতে লিনেন।নবমী মধ্যপ্রদেশের তসর,রাতে জর্জেট।

5f91a58b2cd41.jpg


দশমীতে মর্তবাসীর চোখের জলে পতিগৃহে ফিরে যাবে শিবের শিবানী।গরদের শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে প্রতিবারের মতো মনে মনে বলব ‘আসছে বছর আবার এসো মা’। স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়।

এবছর পৃথিবীর বড় অসুখ।শাড়িগুলো পরে দুর্গা পুজোয় মেতে ওঠা হয়ে উঠবে না। তাই নীলকন্ঠ পাখিটা যখন দশমীর দিন আবার হিমালয়ে উড়ে যাবে তার কানে কানে বলব ‘তোমার জাদুকরীতে পৃথিবীর যাবতীয় অসুখ দূর করে তাকে রোগ মুক্ত করে দাও। যেন আগামীবছর প্রজাপতির পাখার মতো মায়াবী শাড়ির আঁচল উড়িয়ে সবার সাথে গলা মেলাতে পারি …আসছে বছর আবার হবে’।