বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

ভারতবর্ষ,পর্ব- ২

দুই

ভারত শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে সমুদ্রজনিত বিচ্ছিন্নতার প্রভাব অতখানি নজরে পড়ে না। যে কারণে মনে হয় রামসেতু একটা ছিল সেই আদিমকালেও। যখন রাম বা রামাযন কোন কিছুরই উদ্ভব হয নি। মানব জাতি কিম্বা অমেরুদণ্ডী প্রাণী ও ছিল না পৃথিবীতে সে সময়।


রোজদিনকার ঐ নাবিক মৎস্যজীবিরা জানে কোথায পৌঁছালে সমুদ্র হযেযায় পাক স্ট্রেইট কোথায়ইবা সেটাহয গালফ অফ মান্নার! মানচিত্র খুঁটে খুঁড়ে যে একাকী নাবিক ডাঙা ছুঁয়ে ছুঁয়ে চষে বেড়াযভূমণ্ডলসেজানেসমুদ্রেরকোনসীমান্তথাকেনা।কেউবলতেপারবেনাকোথায়বঙ্গোপসাগরেরআরম্ভ, কোথায়ইবাভারতমহাসাগরেরশেষ।এমনিছোটছোটসমুদ্রেরছিটমহলেদাঁড়িয়েভারতমহাসাগরদেখা - সেদেখারবেশিটাইকল্পনায়।হ্রদ বা পাথরে ঘেরা সমুদ্র যেটাই দেখছি তা যদি দিগন্তবিস্তৃত হয তাহলে সেটার ভারত মহাসাগর হলেই বা কি। জলের বর্ণ সেও তো নীলই সর্বত্র। আকাশেরও বর্ণও তাই। এখানের বাতাসে বিকৃত ধোঁযা ছড়াবার কোন ভিলেন দাঁড়িয়ে নেই যাতে আকাশের নির্মল নীল নষ্ট হতে পারত।

এখানেপ্রথমআসারদিনটামনেআছে।ভোরবেলাট্রেনপৌঁছাচ্ছেরামনাড, রামেশ্বরম।আমি তখন পর্যন্ত শুধু জানি রামেশ্বরম মন্দিরের কথা। আর জানি ধনুষ্কোডি শহরের কথা। সেখানেও আছে একটা কিম্বা একাধিক মন্দির। ১৯৬৪ সালে এক বিধ্বংসী সাইক্লোনে ধনুষ্কোডি শহর তামিলনাড়ুর মৃল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আসার দিন মনে হয়েছিল রামনাড শহরও যেন ডাঙা হতে বিচ্ছিন্ন। ট্রেন চলছে জলের ওপর দিয়ে অতিশয় মন্থর গতিতে। জলের ঢেউ বলে দিচ্ছে আমরা সমুদ্রের ওপর দিযে এগোচ্ছি।

একটাসামন্তরাজ্যেদাঁড়িযেভারতবর্ষকেকল্পনাকরানাওসম্ভবহতেপারে - জমিরওপরনানাদেয়ালেরবাধা, নানাভাষাসংস্কৃতির বিস্তার। বিবিধতার রং ঢং দেখে ফুরয় না। ডাঙার মানুষেরা বলে বারো মাইলে নাকি ভাষাও বদলে যায়। কিন্তু একটা সমুদ্রের মুখোমুখি দাঁড়ালে গোটা সমুদ্রকেই দেখা হয়ে যায় যা আবৃত করে রেখেছে গোটা এই পৃথিবীকেই।

আমরা এবার এসেছিলাম মাদুরাই, হাসান হয়ে পীচবাঁধান রাস্তা ধরে। এবার মনে হয রামেশ্বরম এর অবস্থানটা কিছুটা পরিস্কার হোল। রামেশ্বরম ও ডাঙার মাঝে সমুদ্রের একটা strip পেরোতে হয। আমাদের পেরনোর রাস্তাটা অনেক উঁচু করে বেঁধেছে একটা সরলরেখায়। মাঝখানটায় গেলে সমুদ্র ঘিরে ফেলে চারদিক থেকে ঘূর্ণিঝড়েরই মত।

হোটেলে থিতু হওয়ার পর আবার সেই ধনুষ্কোডির রাস্তায়।জেনে আসতে গেলাম পরদিন ভোরবেলা ধীবরদের টেম্পো গাড়ী ধনুষ্কোডি যাবে কি না। কদিন ধরেই আকাশে মেঘ।
যেখানে পাকা রাস্তা শেষ হয়েছে সেখানেই একটা সিকিউরিটি পুলিশের ক্যাম্প। প্রথম বার এসেছি যখন তখনই একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ। প্রদীপ মণ্ডল। বাঁকুড়া জেলায় বাড়ি।আগে যখন এসেছি তখন এই চেকপোস্ট এতো জব্বর ছিল না।একটা হাত দিয়ে চলে এমন লেভেল ক্রসিং এর গেট, একটা গুমটি। আমি এসে ধনুষ্কোডি নিয়ে নানা প্রশ্ন করায আরো কযেকজন সিকিউরিটি গার্ড নেমে এসেছিল বালিয়াড়ির ওপর থেকে। প্রদীপ আমাকে নিয়ে গেছিল প্রায় আধ কিলোমিটার ভেতরে। আবার আসতে বলেছিল। মাছের কযেকটা টেম্পোই ধনুষ্কোডি যায়। সিজনে প্রায় রোজই। রাস্তা বা রোড তাকে যাই বলি সেটা সৈকতের বালিতে ঢাকা একটা সুঁডিপথ তার দুধারেই সমুদ্র। ক্রমাগতই ঢেউ এর ছিটে গাযে এসে লাগে। পা ডুবে যাচ্ছে বালিতে। আধ কিলোমীটার এগিয়ে আবার ফিরে আসায় দিনের অনেকটা সময় আমার খরচ হয়ে গেল তবুও প্রদীপ আমার ধনুষ্কোডি অ্যাডভেঞ্চারে সর্বক্ষণ ইন্ধন যুগিয়ে গেল। কিচ্ছু বুঝি নি তখন যে ধনুষ্কোডি যাত্রার অন্য কোন দিকও থাকতে পারে। গতবার যখন এলাম তখন জায়গাটা যেন কিছুটা থমথমে। চেক পোস্টএ একটা দুটো নিরস্ত্র, গার্ডের অলস পায়চারির বদলে অন্তত ছয়জন গার্ড পোস্ট আগলে। তাদের কাঁধে কলশনিকভ। আমার অতি ভরসার মাছের টেম্পো যা আমাকে দেশের থেকে কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া প্রাচীন একটা শহর দেখাবে সেগুলো্ কি সত্যিসত্যিই অতখানি নির্ভরশীল? ধনুষ্কোডি থেকে রোজদিনকার নিয়মে মাছের টেম্পোরা এলে গেলেও ভেতরে ভেতরে আরো কিছু চলে। জাযগাটা দুটো দেশের মাঝে একটা সীমান্তে রক্ষার চেকপোস্ট। মাছের টেম্পোর শুল্ক গোনার জন্য একা নয।

এবার এসেছি যখন বেলা তিনটেতেই আকাশের ভারি গম্ভীর মেঘ অন্ধকার করে রেখেছে বাতাবরণ। প্রদীপ ওপর থেকে নেমে এল। আমার সঙ্গে হাঁটাহাটি করতে করতে জানাল ইতিমধ্যে একদিন এলটিটিই রা এসে তাণ্ডব করে গেছে এখানে। না হামলা করে নি তবে ঢুকতে চেষ্টা করেছিল এই রাস্তা দিয়ে।

এবার এলাম তখন বিকেল বিকেল। অন্ধকার নামার সময় হতে এখনো দেরি তাও আঁধার হয়ে রয়েছে চতুর্দিশা যার তিন দিশায় সমুদ্রআর পেছনের দিকটা খুলছে পশ্চিমে। আকাশ ভারি মেঘে গম্ভীর।

প্রদীপ দ্রুত নেমে এল বালিয়াড়ির পাহাড় থেকে - আজ কেন এসেছেন? কাল রাত থেকে ওযার্নিং দেওয়া আছে বিশাল সাইক্লোন আসছে। আজ মধ্যরাত পর্যন্ত আছড়ে পড়বে উপকূলে। এক্ষুনি ফিরে যান।

আজ অনেক ট্যুরিস্টদেরও ভীড় জমেছিল। সবাইকেইফেরানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল প্রদীপ।

আমরা গাড়ির মুখ ফেরাচ্ছি , ততক্ষণে দেখে নিচ্ছি কত উত্তাল হয়ে উঠেছে সমুদ্র।আমরা ফিরে আসব ততক্ষণে দৌড়ে এলো প্রদীপ। আর একটু থাকুন। হঠাত্ই কথাটা মাথায় এলো। প্রদীপ কেন বলেছিল আমাকে ধনুষ্কোডি নিয়ে যাবে যখন সে জানে জায়গাটায় এলটিটিইরা আড্ডা গেড়েছে। ওর জন্য তো ও জাযগাটা বিপজ্জনকই। কিন্তু পরে যখন থেকে এলটিটিই প্রদীপদের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স এর ক্যাম্পএ এসে তামিলনাড়ুতে ঢুকতে চেষ্টা করেছে ততক্ষণ প্রদীপও সম্ভবত অত সচেতন থাকে নি এলটিটিইর ব্যাপারে। এদিকে জীবনযাত্রা চলছে সহজভাবেই। প্রচুর মাছ চলে আসছে ধনুষ্কোডি থেকে তামিলনাড়ুর বাজারে। এই সব তটবর্তী শহরগুলিতে প্রচুর মাছ আসে কিন্তু বাজার এখানে নয। এই সামুদ্রিক পণ্য এখান থেকেই সত্বর চলে যায় মাদুরাই, ত্রিচি (তিরুচিরাপল্লী), হাযদ্রাবাদ, ভালো দাম পাবার তাগিদে। আমার এখানে প্রথম আসার দিন থেকে আজ পর্যন্ত প্রদীপের একটা স্বভাবে কোন হেরফের নেই। ওর কাছে এলেই ও আরোকিছুক্ষণ ধরে রাখতে চায়। আজ ওর আবদার - আমরা এসেই ফিরে যাচ্ছি, একটু কফি খেয়ে তারপর যাই। কিন্তু সাইক্লোন! সে তো এগিয়ে আসছে বেবাক তাড়ায়! সবাই ফিরছে আপন আপন আস্তানায়। আমরা আরো খানিকক্ষণ এখানে আটকে গেলে হোটেলে ফিরতে ফিরতেই সামুদ্রিক ঝঞ্ঝাবাত আমাদের ধরে ফেলবে মাঝরাস্তায়। প্রদীপ বলে সাইক্লোন তো আসবে মাঝরাতে এক কাপ কফিতে কি আর এমন হবে? আমরা দিনরাত এই সমুদ্রের সঙ্গে ঘর করছি। কিন্তু প্রদীপ ! ১৯৬৪ সালে এমনিই এক সাইক্লোনে তামিলনাড়ুর তট ছারখার হয়ে গেছিল। ধনুষ্কোডির মত তীর্থস্থল এই ডাঙার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, এই দেশের থেকেই মুছে গেল প্রাচীন একটা শহরের পরম্পরা ...


চলবে ...