শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

বাংলা গানের সেকাল একাল - ১০

সিনেমা সঙ্গীতের দুই অগ্রপথিক কাননদেবী ও কুন্দনলাল সায়গল

বাংলা গানের পথচলায়,তার পণ্যমূল্য তৈরি হওয়ার পর চলচ্চিত্রের গানেরবিশেষ অবদান রয়েছে । শূন্য থেকে শুরু করে সিনেমা-সঙ্গীতের সূচনাপর্বে যারা গান গেয়েছিলেন তাঁরা চিরকাল স্মরণযোগ্য । তাঁরা সিনেমা-সঙ্গীতকে দৃঢ ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন । বাংলা সিনেমা-সঙ্গীতের এমনই দুই অগ্রপথিক – কানন দেবী ও কুন্দনলাল সায়গল, এই পর্বে তাদের কথা।

কাননবালা থেকে কানন দেবীতাঁর গান ও সেই সময়

(শিরোনামে ‘কাননবালা’ নামটাই ব্যবহার করেছি । ২৯২৯এ তাঁর প্রথম গানের রেকর্ডের লেবেলে শিল্পীর নাম লেখা ছিল ‘মিস কাননবালা’ । প্রথম যুগের সিনেমাতেও তাঁর পরিচিতি ছিল ‘কাননবালা’এই নামে । তারপর কাননবালা থেকে দীপ্তময়ী কানন দেবী – দীর্ঘ পথচলা আর অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার বিস্ময়কর অধ্যায় । আমি সেদিকে যাইনি । আমি শুধু কাননের গানের সূত্রে সেই সময়টাকে ফিরে দেখতে চেয়েছি )।

তখন নিতান্ত শৈশব আমার, সাত কি আট বছর বয়স । বাড়িতে রেডিও বা গ্রামফোন রাখার মত বিলাসিতা তখন আমাদের সংসারে ছিল না। একদিন পাশের এক ধনি পরিবারের বাড়ি থেকে ভেসে এসেছিল একটা গান,মাঝে মাঝেই শুনতে পেতাম,বোধয় কলের গান বাজতো, ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’। কার গান,কার কন্ঠস্বর এইসব তখন আমার জানার কথা নয়, জানতামও না। কিন্তু গানের সুর আর প্রথম কলিটি কিভাবে মনে গেঁথে গিয়েছিল জানি না । তারপর সেই দম দেওয়া কলের গান আর গ্রামফোন রেকর্ড কবেই অচল হয়ে গেছে। সময়ের স্রোতে কত কিইই বদলেছে । গানটা আর শোনা হয়নি । বছর কুড়ি আগে হঠাৎ একদিন ভোরের এফ এম রেডিওতে আধাঘুম চোখে আবার শুনতে পেলাম শৈশবে শোনা সেই গানটির রি-মেক ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’। শাপুড়ে ছায়াছবিতে নজরুল ইসলামের সুরে গেয়েছিলেন কানন দেবী - তখনকার কানন বালা । শৈশবের একটা খন্ড মুহুর্ত সময়ের সীমা পেরিয়ে ধরা দিল যেন । কাননবালা থেকে কানন দেবী ।

দশ বছরের এক বালিকা আর তার মা । পিতা বলে যাকে আশৈশব জেনে এসেছে, মা তার বিবাহিত স্ত্রী নন,রক্ষিতা । দশ বছর বয়সে, সেই জন্মদাতার মৃত্যুতে অতল অন্ধকারে পড়ে গেলো সেই মেয়ে । বুঝে গেল শূন্য থেকে শুরু করতে হবে । মাথার ওপর একটুকরো ছাদের সন্ধান পেতে মাকে নিয়ে আশ্রিতা হ’ল এক আত্মীয়ের, দুজনের শ্রমের বিনিময়ে । মা পাচিকা,মেয়ে বাসন মাজার কাজ । সেখানেও লাঞ্ছনা,অপমান,দৈহিক পীড়ন অসহনীয় হয়ে ওঠায় বাধ্য হ’ল, মাকে নিয়ে অনিশ্চিতের পথে পা বাড়াতে ।

সেদিনের সেই বালিকা তেইশ বছর পরে টালিগঞ্জের একটি বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে সমভ্রান্ত গুনিজনদের মধ্যে প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করলেন আর উদবোধক রাজ্যপাল কৈলাশনাথ কাটজুকে অভ্যর্থনা জানানোর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন । পীড়িত, নিঃসম্বল সেই কিশোরীই তার তন্ময় সাধনা, সততা আর সমাজ-মনস্কতায় হয়ে উঠলেন অতি সম্মানিত মহিয়সী নারী । অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক তুষারকান্তি ঘোষ যাকে বলেছিলেন ‘ফার্স্ট লেডি অফ ইন্ডিয়ান স্ক্রীণ’ । এ এক বিস্ময়কর ঘটনাক্রম । অবহেলার অন্ধকার থেকে দীপ্তিময়ী ব্যক্তিত্বে উত্তরণ । তিনি কানন দেবী,বাংলা চলচ্চিত্রের নির্বাক ও সবাক যুগের সন্ধি লগ্নের সাধারণ অভিনেত্রী থেকে চলচ্চিত্র শিল্পের অভিভাবিকা হয়ে ওঠা কানন দেবী ।

নিজের মেয়েবেলা সম্পর্কে তেমন কিছু লিখে যাননি কানন । তাঁর জন্মের তারিখটিও জানা যায় না (অনেকে বলেন ২২শে এপ্রিল) । সমাজের অন্ধকার স্তর থেকে উঠে আসা জন্ম পরিচয়হীন এক বালিকার মেয়েবেলার কথায় কারই বা আগ্রহ থাকে !কাননের জন্ম পরিচয় নিয়ে নানান গল্প ছড়িয়ে আছে মাত্র । সে সব গল্পে আমার আগ্রহ নেই ।

দশ বছর বয়সে বিনোদন জগতে আসার পর বহু গুনি সঙ্গীতজ্ঞের কাছে কানন গানের তালিম নিয়েছেন,পন্ডিত আল্লারাখা, কৃষ্ণ চন্দ্র দে, কাজী নজরুল, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়,পঙ্কজ কুমার মল্লিক প্রমুখের কাছে নানা ধরণের গানের তালিম নিয়েছেন । কিন্তু সিনেমায় আসার আগেসঙ্গীতের প্রাথমিক পাঠ নিয়েছিলেন কি না, এমন কোন লেখা-জোখা নেই, কানন নিজেও বলেন নি । সুতরাং এটা মনে করাই সঙ্গত যে গান ছিল কাননের সহজাত প্রতিভা । আত্মকথা ‘সবারে আমি নমি’তে কানন এক আধাবয়সী পৌঢ় ‘ভোলাদা’র কথা বলেছেন । তাদের পাড়াতেই থাকতেন তিনি । কানন লিখছেন – “গান শোনার লোভেই অবসর পেলেই তাঁর কাছে গিয়ে বসতাম । ওঁর কাছে দু-চারটি গানও শিখেছিলাম । নীরার ভজন, রবীন্দ্রনাথ অতুলপ্রসাদের কিছু গান কীর্তন ও ভাটিয়ালীর কয়েকটি গানই ছিল তাঁর সম্বল” । কানন তাঁর আত্মকথায় জানিয়েছেন “ ভালো করে জ্ঞান হবার আগেই গানকে ভালো বেসেছি ... যেখানেই গান হতো, মন্ত্রমুগ্ধের মত অজান্তেই কখন সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শুনতে শরু করেছি হুঁশই থাকত না । ...”

কানন যখন চলচ্চিত্রে আসেন তখন ভারতীয় সিনেমারই শৈশবকাল । কাননের জন্মের মাত্র তিন বছর আগে ভারতীয় সিনেমা তার পথচলা শুরু করেছে । দাদা সাহেব ফালকে ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ নামে প্রথম কাহিনী চিত্র নির্মাণের ছয় বছর পরে, ১৯১৯এ ম্যাডান থিয়েটার কোম্পানী নির্মাণ করেন প্রথম বাংলা কাহিনী চিত্র ‘বিল্বমঙ্গল’ । আর এর সাত বছর পরে ১৯২৬এ এই ম্যাডান থিয়েটার কোম্পানীর সিনেমা ‘জয়দেব’এ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে কানন পা রাখলেন চলচ্চিত্র জগতে । তখনও চলচ্চিত্র নির্বাক, কথা বলা শুরু করবে আরো পাঁচ বছর পরে ।বাংলা গানের ভুবনটিরও তখন শৈশব না হলেও বাল্যাবস্থায় । অগস্ট ১৯২৭এ কলকাতা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বেতার সম্প্রচার শুরু হয়েছে,নজরুল ইসলাম গ্রামফোন কোম্পানীর সঙ্গীত বিভাগের প্রধান হয়েছেন, বাংলা গানের ভুবনে উঠে এসেছেন পঙ্কজকুমার মল্লিক, দিলীপকুমার রায়, কমলা ঝরিয়া, ধীরেন দাস, হরিমতী, ইন্দুবালা, আঙ্গুরবালা, মৃণালকান্তি ঘোষ, জ্ঞাণেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী প্রমুখ । এই ইতিহাসটুকু বলে নেওয়া এইজন্য যে প্রায় সমকালে কাননের বাংলা গানের কাছে আসার আবহটুকু বোঝার জন্য ।

১৯৩১এ বাংলা চলচ্চিত্র কথা শুরু করলো আর ১৯৩৫এ নীতিন বসু পরিচালিত ‘ভাগ্যচক্র’ছবিতে সঙ্গীত পরিচালক রাইচাঁদ বড়াল প্রথম প্রয়োগ করলেন নেপথ্য সঙ্গীত বা ‘প্লে-ব্যাক’ কৃষ্ণচন্দ্র দের কন্ঠে । ১৯৩৩এ মুক্তিপ্রাপ্ত শ্রী গৌরাঙ্গ ছায়াছবিতে কাননের গান সিনেমার দর্শকদের আগ্রহের কেন্দ্রে চলে আসে তারপর ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ মুক্তি পাওয়ার পর কাননের খ্যাতি আরো প্রসারিত হয় । এই সময়য় থেকে কাননের কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হয় সিনেমা থেকেগ্রামফোন কোম্পানী পর্যন্ত। এই সময় থেকেই কাননের উথ্বানেরও শুরু । কাননের নিজের কথায় “...গান এসে আমার অভিনয়ের পাশে দাঁড়াতেই মনে হোল আমার জীবনের এক পরম পাওয়ার সঙ্গে শুভদৃষ্টি ঘটল । ...নিজেকে যেন নতুন করে চিনলাম” । সে কালের রুপোলি জগতের দস্তুর – অনেক ক্লেদ আর গ্লানি স্পর্শ করেছিল কিশোরী কাননকে । সেই ক্লেদ আর গ্লানি থেকে মুক্তির নিঃশ্বাস নিতেই যেন গানকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন কানন , তিনি তাঁর আত্মকথায় সে কথা বলেছেনও । বলেছেন “... নিজের কন্ঠে রেকর্ডে যখন প্রথম শুনি সে যে কি রোমাঞ্চ তা বলে বোঝাতে পারবো না । নিজেকে যেন নতুন করে চিনলাম ...এই ভয়াবহ জীবনের নাগপাশ যখন সকল আনন্দের টুঁটি চেপে জীবনকে দুঃসহ করে তুলত তখন গানের এই স্পর্শটুকুই আমায় যেন বাঁচিয়ে দিত । মনে হত এই ত আমার সত্যি করে বাঁচা” ।

সেই সময়ে সিনেমার গানে কাননের পাগলকরা লোকপ্রিয়তার পেছনে দু’জন মানুষের অবদান সম্ভবত সর্বাধিক তাঁরা এদেশের সঙ্গীত জগতের দুই কিংবদন্তী রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজকুমার মল্লিক । অভিজাত সাঙ্গীতিক পরিবারের সন্তান ছিলেন রাইচাঁদ । পিতা লালচাদ বড়াল ছিলেন এদেশের প্রথম অভিজাত পরিবারের সন্তান যিনি সর্বপ্রথম গ্রামফোন রেকর্ডে গান করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন আর রাইবাবু বাংলা সিনেমায় নেপথ্য সঙ্গীতের প্রথম প্রয়োগ করেন । এহেন রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজকুমারের মত সুরস্রষ্টার সংস্পর্শে এসে পরিণত হয়েছিলেন কানন । স্বীকারও করেছেন যে গায়িকা রূপে তাঁর বৈপ্লবিক প্রতিষ্ঠার মূলেযাদের অবদানের কথা মনে আসে তাঁদের মধ্যে প্রথমেই মনে আসে রাইচাঁদ বড়ালেরনাম ।

রাইচাঁদ বড়াল কাননকে গড়লেন, ‘বিদ্যাপতি’তে কাননের গান সারা ভারতে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিল । ‘বিদ্যাপতি’র পর ‘মুক্তি’ (১৯৩৭) । ‘মুক্তি’তে কাননের গানের ভুবন যেন পরিপূর্ণ হল ভারতীয় সংগীতের আর এক কিংবদন্তী পঙ্কজকুমার মল্লিকের ছোঁয়ায় । কানন-কন্ঠের ঐশ্বর্য ঠিকই চিনেছিলেন পঙ্কজকুমার । রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন নিয়ে কাননকে দিয়ে মুক্তি ছায়াচিত্রে গাওয়ালেন রবীন্দ্রনাথের গান ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে’ ও ‘তার বিদায় বেলার মালাখানি’ । কানন হয়ে গেলেন রবীন্দ্রকাহিনী নয় এমন চলচ্চিত্রে রবীন্দ্র-গানের প্রথম শিল্পী । কাননের সঙ্গেরবীন্দ্রনাথের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ । রবীন্দ্রনাথ আশির্বাদ করেছিলেন । বলেছিলেন শান্তিনিকেতনে এসে তাঁকে গান শোনাতে । সেই যাওয়া আর হয়নি কাননের । কাননের বিবাহ উপলক্ষে কবিগুরু তাঁকে শুভেচ্ছাবার্তা সহ একটি ছবি উপহার দিয়েছিলেন । ‘মুক্তি’ ছাড়াও ‘শেষ উত্তর’ ‘পরাজয়’ ‘অনন্যা’, ‘অনির্বাণ’ প্রভৃতি আরো অনেক ছবিতে রবীন্দ্রগান গেয়েছিলেন কানন ।

চলচ্চিত্রে নেপথ্য সঙ্গীত বা ‘প্লে-ব্যাক’প্রথা প্রবর্তনের পর ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ ছবিতে গায়িকা রূপে কাননের গৌরবময় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, ‘বিদ্যাপতি’ (১৯৩৮) তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে আসে ও সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠা দেয়, আর মুক্তি তাঁকে রবীন্দ্রগানের সার্থক শিল্পী রূপে প্রতিষ্ঠা দেয় । কিন্তু তার অনেক আগেই নিতান্ত বালিকা বয়সেই কাননের গান রসিকজনের নজর কেড়েছিল । ১৯২৬এ প্রথম ‘জয়দেব’ ছবিতে শিশুশিল্পী রূপে অভিনয়ের পর চারবছর আর সিনেমায় ডাক পাননি । এই সময় ১৯২৯ ও ৩০এ গ্রামফোন কোম্পানী কাননের ছটি গান এইচ এম ভি লেবেলএ প্রকাশ করে । (সূত্র –দি ওয়ার্ল্ড অফ কাননদেবী / ডঃ জ্যোতিপ্রকাশ গুহ ) । নজরুল ই্সলাম তখন গ্রামফোন কোম্পানীর মাস-মাইনের সঙ্গীত প্রশিক্ষক । সম্ভবত নজরুল ইসলামের আগ্রহে কাননের সঙ্গে যে জে এন ঘোষের সঙ্গে পরিচিত হন । জে এন ঘোষ তখন সবে মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানীর পত্তন করেছেন । পত্তনের পর তাদের ৫ নম্বর রেকর্ডটাই ছিল কাননের । তারপর দীর্ঘকাল কানন মেগাফোন রেকর্ডসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । এখানেই কানন রাগপ্রধান বাংলা গানের প্রখ্যাত সংগীত সাধক ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে সঙ্গীত শিক্ষা করেন । কানন দীর্ঘকাল মেগাফোন রেকর্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ।

চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতের সর্বোচ্চ সম্মাননা দাদাসাহেব ফালকে সম্মাননা, স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ থেকে বহু পুরস্কার পেয়েছেন কানন, তবু এক মহার্ঘ্য মুহুর্তের কথা নিশ্চিতভাবেই মনে রেখেছিলেন কানন, সেটি হল ১৯৪৭এর ১৫ই অগস্ট দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির দিনে লন্ডনে ভারতীয় হাই কমিশনার ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন হয়েছিল তাঁর কন্ঠে‘আমাদের যাত্রা হল শুরু, এখন ওগো কর্ণধার তোমারে করি নমস্কার’ গানটির সঙ্গে ।

অভিনেত্রী কানন না গানের কানন কাকে মনে রাখবে মহাকাল ? এ প্রশ্নের মিমাংশা হবার নয় । কানন নিজে যদিও আত্মকথায় লিখে গিয়েছেন “আজ আমার অভিনেত্রী পরিচয়টাই সকলের কাছে বড় । কিন্তু আমার নিজের কাছে সবচেয়ে দামী আমার গানের মহল ...আমার নিজের সঙ্গে গানের পরিচয়ের নিবিড় মুহুর্তটির যে মাধুর্য জীবনের অনেক তিক্ততাকে ভুলিয়ে দিতে পেরেছিল ... তার মধ্যেই যে আমার জীবনবিধাতার স্নেহস্পর্শের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি ঘটেছে” । আমরা বলি, এই দুইএ মিলিয়েই কানন । কাননবালা থেকে কানন দেবী ।

তেইশের তরুণী কানন চেয়েছিলেন জীবনকে শুদ্ধ, সুন্দর করে গড়ে তুলতে । তখনকার সমাজ নিদারুণ আঘাত করেছিল কাননের প্রথম প্রেমকে । সেই পরম পাওয়ার আনন্দসুধা অঞ্জলি ভরে পান করতে পারেননি তিনি । ১৯৩৯এ তেইশ বছরের তরুণী কানন বিবাহ করেন প্রখ্যাত ব্রাহ্মসমাজী শিক্ষাবিদ হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের পুত্র অশোক মৈত্রকে । কানন লিখেছেন “ সমাজ আমাদের মিলনকে স্বীকৃতি দিয়েছে । কিন্তু সম্ভ্রমের বরণডালা দিয়ে বরণ করেনি । ... আমাদের দুঃসাহসের সাক্ষী হয়েছে, কিন্তু উৎসবের আলো জ্বালিয়ে একে অভিনন্দিত করেনি ...। আজও মনে পড়ে,বারান্দায় দাঁড়াতে সাহস করতাম না,পাছে কারো কোন বিরূপ মন্তব্য কানে আসে । নানান কুরুচিপূর্ণ কদর্য ভাষার প্যামফ্লেট ছাপিয়ে উঁচু স্বরে হেঁকে বিক্রী হ’ত আমারই বাড়ির সামনে ...। নিঃসম্বল অসহায় একটা মেয়ে । কত ঝড় তুফান পেরিয়ে ছুটছে আর ছুটছে । কিন্তু তার সেই বিরামহীন চলা, গ্রন্থিহীন তপস্যার এতটুকু মূল্য কেউ কোনদিন দেয়নি । চেয়েছে তাকে ব্যর্থতার সমাধিতে নিশ্চিহ্ন করে দিতে” (‘সবারে আমি নমি’) । সে বিবাহ স্থায়ী হয়নি । সেকালীন রক্ষণশীল সমাজ প্রবল নিন্দাবাদ করেছিল বংশগৌরবহীন একজন চিত্রাভিনেত্রীর সঙ্গে এক সমভ্রান্ত পরিবারের বিবাহে । স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নাকি তাঁদের বিবাহে আশির্বাণী ও প্রীতি উপহার স্বরূপ একটি ছবি পাঠিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন । এক চিত্রভিনেত্রী রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরকরা ছবি পাবে কেন !

কাননের কাছে সর্ত ছিল বিবাহের পর চিত্রাভিনয় ত্যাগ করতে হবে । ব্যক্তিত্বময়ী কানন সম্মত হননি । ১৯৪৫এ কানন তাঁর প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদ নেন । বিবাহ-বিচ্ছেদের যন্ত্রণা সত্বেও প্রথম স্বামীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা তাঁকে প্রথম সামাজিক মর্যাদা দেওয়ার জন্য । পরবর্তী কালে, অশোকের দিদি রানী মহলানবিশ,তাঁর স্বামী প্রখ্যাত প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ কিংবা অশোকের মা কুসুমকুমারী দেবীর সঙ্গে কাননের অন্তরঙ্গতা ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিন্দুমাত্র ঘাটতি ছিলনা ।

ইতিমধ্যে দশটা বছর কেটে গেছে । ১৯৪৯এ ততকালীন রাজ্যপালের সঙ্গে আলাপের সূত্রে পরিচয় হয় রাজ্যপালের নেভাল এ ডি সি হরিদাস ভট্টাচার্যর সঙ্গে । পরিচয় থেকে প্রণয় এবং বিবাহ ঐ বছরেই । ১৯৪৯এই চলচ্চিত্র প্রযোজনায় নামেন কানন, গঠন করেন শ্রীমতী পিকচার্স । প্রথম ছবি ‘অনন্যা’ । তারপর একের পর এক শরৎচন্দ্রের ‘মেজদিদি’, দর্পচূর্ণ’, নববিধান’, ‘দেবত্র’, ‘অন্নদা দিদি ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্ত’ প্রভৃতি, প্রযোজনা কানন দেবীর শ্রীমতী পিকচার্স আর পরিচালনায় স্বামী হরিদাস ভট্টাচার্য । অন্নদা দিদির ভূমিকায় অভিনয়ের পর কানন আর কোন ছায়াছবিতে অভিনয় করেননি ।

অভিনয় করেননি, কিন্তু সিনেমা শিল্পের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন আমৃত্যু । ১৯২৬ থেকে ১৯৯২ সুদীর্ঘ ছেষট্টি বছর এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে বিজড়িত ছিল একটা নাম কানন দেবী । বলতে গেলে ভারতে চলচ্চিত্র নির্মাণের একশো বছরের ইতিহাসের প্রথম পৃষ্ঠা থেকেই লেখা আছে তাঁর নাম । শুধু অভিনয় ও সঙ্গীত শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন এমন নয় প্রযোজনা, পরিচালনা, বিচারক মন্ডলী, ডিরেক্টর বোর্ড – সিনেমা শিল্পের প্রতিটি বিভাগের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন সুদীর্ঘ সময় । দুঃস্থ মহিলা শিল্পীদের সাহায্যার্থে গঠন করেছিলেন ‘মহিলা শিল্পীমহল’। যুক্ত ছিলেন সামাজিক নানায় কল্যানকর সংগঠনের সঙ্গে ।

আলোহীন জগৎ থেকে উঠে আসা এক নারী আপন প্রতিভা ও তন্ময় সাধনায়, অনেক অবহেলা,লাঞ্ছনা,চিত্র জগতের ক্লেদ,আর গ্লানি অতিক্রম করে দীপ্তিময়ী হয়ে উঠেছিলেন । সে এক বিস্ময়কর আলোয় ফেরার কাহিনী । আ-মৃত্যু নিজেকে বিজড়িত রেখেছিলেন চলচ্চিত্র শিল্পে তার অভিভাবকের মর্যাদায় । ১৯৯২এর ১৭ই জুলাই কলকাতায় মৃত্যু হয় ভারতীয় সিনেমার প্রথম মহানায়িকা কানন দেবীর ৭৬ বছর বয়সে ।

সায়গল : তাঁর কন্ঠ ও গায়নশৈলী আজও অননুকরণীয়

প্রথাগত সংগীত শিক্ষার তালিম তিনি নেননি কোনদিন,ছিলনা কোন সঙ্গীত গুরু। সেই তিনিই তাঁর অননুকরণীয় কন্ঠ ও গায়নশৈলীতে ১৯৩০এর দশকে বাংলা ও হিন্দি গানের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন । তিনি ছিলেন হিন্দি ছায়াছবির প্রথম ‘মহা তারকা’। কুন্দনলাল সায়গল । মাত্র ১৫ বছরের শিল্পী-জীবন ছিল তাঁর। কিন্তু এখনো প্রবাদের মত হয়ে আছে ‘সায়গল কন্ঠ’ ।

জন্ম ১৯০৪এ, জম্মু প্রদেশের মস্তগড় শহরে । পিতা অমরচাঁদ ছিলেন জম্মুর এক তহশীলদার, ধর্মপ্রাণা মা কেশর কাউরের হাত ধরে নানান ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যেতেন, শুনতেন কুন্দন ভজন, কীর্তন । পিতার সঙ্গে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে রাখাল বালকদের মুখে শুনতেন পাঞ্জাব ও কাশ্মিরের লোক সুর । বালক কুন্দন নিজেও রামলীলায় গান গাইতেন ।

কম বয়স থেকেই কুন্দন স্কুল ছেড়ে দিয়ে রোজগারের সন্ধানে নানান কাজ করেছেন । প্রথমে রেলওয়ের টাইম কিপারের কাজ, পরে রেমিংটন টাইপরাইটারের সেলসম্যানের কাজের সুবাদে ঘুরেছেন ভারতের নানান প্রান্ত । গান গাওয়ার প্রবল টান অবশেষে কুন্দনকে নিয়ে আসে কলকাতায় তাঁর ভাগ্যান্বেষণে । বোম্বের ফিল্মসাম্রাজ্য তখনও গড়ে ওঠেনি, কলকাতাই তখন হিন্দি সিনেমার প্রধান কেন্দ্র । কলকাতায় কুন্দন নজরে পড়েন প্রবাদপ্রতীম সঙ্গীত পরিচালক রাইচাঁদ বড়ালের । রাইচাঁদ বড়াল কুন্দনলালকে নিয়ে এলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথিকৃত সংস্থা ‘নিউ থিয়েটার্স’-এর কর্তা বি এন সরকারের কাছে। তিনি তার প্রতিষ্ঠানে ২০০টাকা বেতনের এক চাকরিতে কুন্দনলালকে বহাল করেছিলেন। এর পরে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। সেখানে তখন পঙ্কজকুমার মল্লিক, কৃষ্ণচন্দ্র দে,পাহাড়ী সান্যালের মত বড় মাপের মানুষ নিউ থিয়েটার্স আলোকিত করছেন ।

তখন ছায়াছবি সবে মাত্র নির্বাক থেকে সবাক হয়েছে ১৯৩১এর গোড়ায় । সায়গল অভিনীত প্রথম ছায়াছবি ‘মহব্বত কি আঁসু মুক্তি পায় ১৯৩২এ । এই বছরে সায়গলের আরো দুটি ছবি মুক্তি পায় কিন্তু তিনটি ছবিই উল্লেখযোগ্য ব্যবসায়িক সাফল্য পায়নি । এরপর ‘পুরাণ ভগত’, ‘ইহুদি কি লড়কি’, ‘চন্ডীদাশ’, ‘রূপলেখা’ ছবিতে তাঁর অভিনয় ও গানে সায়গলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে । এরপর সায়গল খ্যাতির শীর্ষ স্পর্শ করেন ১৯৩৫এ মুক্তিপ্রাপ্ত,প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত হিন্দি ‘দেবদাস’ ছবির অভিনয়ের সূত্রে । সায়গলকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি । রাইচাঁদ বড়ালের সুরে ‘সাথী’ (হিন্দি -‘স্ট্রীট সিঙ্গার’) ছবিতে রাগাশ্রয়ী ‘বাবুল মোরা নৈহর ছুটল যায়’গানটি তো এখনো অমর হয়ে আছে । কিংবা প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘শেষ উত্তর’ ছবিতে গাওয়া সায়গল কন্ঠের দুটি রবীন্দ্রগান ‘আমি তোমায় যত’ ও ‘তোমার বীনায় সুর ছিল’ শুনে মুগ্ধতার সীমা থাকে না । সায়গলই ছিলেন রবীন্দ্রগানের প্রথম অ-বাঙ্গালী কন্ঠশিল্পী । রবীন্দ্রনাথ নিজে সায়গলের গান শুনে সিনেমায় তাঁর গান গাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন ।

কেমন ছিল সায়গলের গান ? কাননন দেবী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন ... “ আজও স্পষ্টই মনে পড়ে সায়গলের গান টেক করবার সময় আমি মেকআপ রুমে থাকলেও ছুটে গিয়ে সব কাজ ফেলে মুগ্ধ হয়ে ওঁর গান শুনতাম । মিষ্টি গলা বলতে যা বোঝায় সায়গলের গলা কিন্তু ঠিক তা ছিল না । ভড়াট গলা, দরদভরা মীড়, অতুলনীয় গাইবার ভঙ্গী যেন চুম্বকের মত মনকে টানত । মানুষটিও ছিলেন ভারি চমৎকার । অবসর সময়ে বসে,দাঁড়িয়ে থাকলেই এই আত্মভোলা মানুষটিকে সব সময়ে গুনগুন করে সুর ভাঁজতে দেখা যেত”(‘সবারে আমি নমি’/কানন দেবী) । আজও যখন শুনি সেই কবে, নব্বই বছর আগে তাঁর গাওয়া রবি-গান ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান’কিংবা ‘তোমার বীণায় সুর ছিল’এখনো মোহাবিষ্ট করে । সারা জীবনে তিনি ২৮টি হিন্দি ছবি, আটটি বাংলা ও একটি তামিল ছবিতে অভিনয় করেছিলেন।

ডিসেম্বর ১৯৪১এ সায়গল মুম্বাই চলে গেলেন এবং একাধিক হিট ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। এই সময় সায়গল অত্যধিক সুরাশক্ত হয়ে পড়েন এবং অনিয়ন্ত্রিত মদ্যপান তাঁর জীবনকেও সংক্ষিপ্ত করে দেয় । ১৯৪৭এর ১৮ জানুয়ারি,মাত্র ৪২ বছর বয়সে গানের ভুবন থেকে চির বিদায় নেন কুন্দনলাল সায়গল ।

গত শতকের চল্লিশের দশক থেকে পরবর্তী চল্লিশ বছরের সময়কালকে বলি বাংলা গানের স্বর্ণ সময়, তিরিশের দশকে তারই প্রস্তুতি । এই পর্বে একজন মানুষের কথা না বললে বাংলা গানের পথচলাকে জানা সম্ভব নয় । তিনি কাজী নজরুল ইসলাম । তাঁর কথা,তাঁর গানের কথা আগামী পর্বে ।


(আগামী পর্বে বাংলা গানের স্বর্ণসময় : নজরুল ইসলামের অবদান )