বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

বাংলা গানের সেকাল-একাল,প্রথম পর্ব


(প্রাককথন :

সম্পাদকের আদেশ, বাংলা গান নিয়ে একটা ধারাবাহিক লিখতে হবে । আমি সঙ্গীতবেত্তা নই, কিন্তু বাংলা গানের উৎপত্তি ও বিবর্তন এবং তার সেকাল থেকে একালে পৌছানো, তার প্রাচীণ ও মধ্যযুগ থেকে আধুনিক হয়ে ওঠা আমার কৌতুহলের জায়গা । এই অনুষঙ্গে বলি, বাংলা গানের একটা নিজস্বতা আছে । তার শিকড় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মধ্যে নেই । বাঙালির আদি গান কীর্তন থেকে দীর্ঘ প্রায় পাঁচ শত বছরের পথচলাকে বুঝতে চাইবো এই লেখায় । ]

গান তুমিকোথা হইতে আসিয়াছো ?

কৈশোরে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে পড়া আচার্য জগদীশচন্দ্রের ‘ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে’ রচনায় জগদীশচন্দ্র জানতে চেয়েছিলেন ‘নদী, তুমি কোথা হইতে আসিতেছো ? নদীর উত্তর ‘মহাদেবের জটা হইতে’ । সেই অনুকরণে যদি জিজ্ঞাসা করি, ‘গান, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ’ ? জবাব পাওয়া যাবে - “সৃষ্টির আদিমতম কালখণ্ডে মানুষের কর্মকালীন ঐকতানই আমার উৎস” । যুথবদ্ধ মানুষের শ্রম আর স্বতস্ফূর্ততার, প্রকৃতির নানান উপাদান আর তার সৃষ্টির বৈভবে, মানুষের এগিয়ে চলার ভঙ্গিমাতেই গানের জন্ম । এখনও তো ‘হেঁইও মারি হেঁইও’র সুর, ছাদ পেটানো শ্রমিকদের একতালে কোলাহল, কিংবা নলকূপ স্থাপনের সময় শ্রমিকদের তালবদ্ধ কোলাহল আমাদের পরিচিত সুর । যে ‘টপ্পা’ গান বাঙ্গালির কাব্য-সংগীতে বিশিষ্ট হয়ে আছে তার উৎপত্তি মরুভূমির উট চালকদের মুখ থেকে । জনহীন রুক্ষ-ঊষর মরুপ্রান্তর পেরনোর সময় তারা যে সম্মিলিত কোলাহল করতো তাইই ‘টপ্পা’ ।

এইভাবে প্রকৃতির সৃষ্টির মধ্য থেকে, নদীর তরঙ্গ থেকে, ঝড়ের গর্জন থেকে, পাখির কলতান থেকে, গাছের পাতার মর্মর ধ্বনি থেকে মানুষ তার নিজের সুর সৃষ্টি করেছে । শিক্ষিত সমাজ লিখিত সাহিত্য সাধনার মধ্য দিয়ে তার সাহিত্যের রূপ-বৈচিত্রের প্রকাশ ঘটিয়েছে একথা যেমন সত্য, তেমনই নিরক্ষর গ্রামীণ সমাজের মৌখিক সাহিত্য উৎসারিত হয়েছে লোকসঙ্গীত ধারার মধ্য দিয়ে যুগে যুগে । আধুনিক যুগের শিক্ষিত সমাজের পরিশীলিত গীতি-কাব্যের বীজ সেই মৌখিক সাহিত্য-সঙ্গীত ধারার মধ্যেই রয়েছে । মানব-জীবনের, পল্লী-মানুষের যাপনের সব বৃত্তান্তই রয়েছে আমাদের লোকসঙ্গীতে । জগৎ সম্পর্কে তাদের ভাবনা, তাদের লোকাচার, আধ্যাত্ম ভাবনা, তাদের বিশ্বাস, সংস্কার এবং জীবনযুদ্ধ আর তার চলার ছন্দ, সব কিছুরই আশ্রয় তার গানে – আমাদের লোকসঙ্গীতে । জীবনের এমন কোন পর্যায় নেই যা আমাদের লোকসঙ্গীতে ধরা পড়েনি ।

সংগীতের উৎসের পৌরাণিক ব্যাখ্যায় গান বিনোদনের সামগ্রী রূপেই বর্ণিত । বলা হয়েছে যে বেদমন্ত্র গীতযোগ্য তাই ‘সামবেদ’। কিছু গানকে বলা হত ‘অরণ্য গেয়’ কিছু গানকে ‘গ্রাম গেয়’ । সঙ্গীত শাস্ত্রীরা বলেন এই “গ্রামগেয়’ গানগুলিই উত্তর কালের ভারতীয় সঙ্গীত। তাহলে ‘অরণ্যগেয়’ গানগুলি কি ? সম্ভবত অ-সংস্কৃত ও বৈদিক ব্রাহ্মণদের অ-গেয়, অনার্যদের কর্মকালীন গানগুলিই ছিল ‘অরণ্য গেয়’ গান । ভরতের নাট্যশাস্ত্রে সামবেদকেই গানের উৎস বলে বর্ণনা করা হয়েছে । ভরতের নাট্যশাস্ত্রে বলা হয়েছে যেহেতু নারীর বেদ চর্চার অধিকার ছিলনা তাই তাদের শিক্ষা ও তৃপ্তির জন্য ব্রহ্মা সৃষ্টি করলেন পঞ্চম বেদ – নাট্যবেদ । সমাজের সর্বজনের তৃপ্তির জন্য ঋকবেদ থেকে ‘আবৃত্তি’, সামবেদ থেকে ‘গান’, যযুর্বেদ থেকে ‘অভিনয়’ এবং অথর্ব বেদ থেকে ‘রস’ সমূহ নিয়ে ‘বেদ চর্চায় অনধিকারী নারী’দের শিক্ষা ও তৃপ্তির জন্য সৃষ্টি হল পঞ্চম বেদ । অথচ গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধেও মেয়েদের গান করাকে হীন বৃত্তি বলে মনে করা হত ।

পৌরানিক ব্যাখ্যায় গান হল দেবভোগ্য বিনোদনের সামগ্রী , গীত-বাদ্য ইত্যাদি গন্ধর্বদের বিদ্যা বা ‘গান্ধর্ব’ , তাদের পৃথক জগত । তারা দেবতা নন কিন্তু ‘দেবতুল্য’ । গন্ধর্বলোকের উল্লেখ বেদ-পুরাণে আছে , তারা ‘অনার্য’ নয় । অনার্যদের গান বেদ পুরাণ স্বীকৃত ছিলনা । আমাদের অতি পরিচিত লোকগাথা বেহুলা-লখীন্দরের কাহিনি আমরা জানি – সর্প দংশনে মৃত লখীন্দরের দেহে পুনরায় প্রাণ সঞ্চার করতে দেবতারা সম্মত হয়েছিলেন সদ্য বিধবা তরুণী বেহুলার দ্বারা তাঁদের নৃত্য-গীতের মাধ্যমে বিনোদিত করার শর্তে । সঙ্গীত যে দেবভোগ্য বিনোদন সামগ্রী এটা প্রতিষ্ঠিত করতেই মনুষ্য রচিত এই কল্প-কথা । তারপর যখন শ্রেণি বিভাজন হল গান হয়ে গেলো রাজসভায় বন্দি – রাজা-বাদশাদের বিনোদন সামগ্রী । তানসেন থেকে যদুভট্ট কিংবা আরো পরে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ সৃষ্ট নব্য জমিদার দের বাগান বাড়ির সঙ্গীত বিলাস তো সেই একই পরম্পরা । ‘জনপদের গান’ কিন্তু ছিল বাংলার পল্লীতে পল্লীতে লোক-আচার ও ধর্মীয় আবেগ ও আচারের মধ্যে ।

রাজসভার গান এখানে আলোচ্য নয় , বিষয় বাংলা গানের বিবর্তন - সেকাল থেকে একালে পৌঁছানোর জন্য তার পথ-পরিক্রমাটিকে বোঝা, কারণ বাংলা গানের শিকড় কোনদিনই রাজসভার গান বা ওস্তাদি গানের মধ্যে ছিলনা । মুঘল বাদশাহ আকবরের দরবারে মিয়া তানসেন যখন রাগসঙ্গীতের প্রবাদ পুরুষ হয়ে উঠেছেন তখন কিন্তু সেই সুর বাংলার পল্লীতে এসে পৌছায়নি । বাঙালি তার গান তৈরি করেছে তার আপন জীবন-ছন্দ দিয়ে, নিজস্ব ধারায় কাব্যের আশ্রয়ে । পন্ডিত দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, পল্লীবাংলার নিজস্ব সুরকে হিন্দি মনসা মঙ্গলে ‘বাঙ্গাল রাগ’ বলে উল্লিখিত হয়েছে । পন্ডিত দীনেশচন্দ্র লিখেছেন “ইহা আমাদের চির পরিচিত ‘ভাটিয়াল রাগ’। এই সুর কোন প্রচলিত ধার ধারে না, উহা পল্লীহৃদয়ের সমস্ত করুণ রস নিংড়াইয়া লইয়া আত্মপ্রকাশ করিত । এই নদীমাতৃক দেশের ইহা নিজস্ব সুর” । গান কেন বাঙালির এতো কাঙ্খিত প্রাণের জিনিস তা রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সংগীত চিন্তা’ গ্রন্থে জানিয়েছেন “আত্ম প্রকাশের জন্য বাঙালি স্বভাবতই গানকে অত্যন্ত আপন করে চেয়েছে...গানকে ভালোবেসেছে বলেই সে গানকে আপন হাতে,আপন মনের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করতে চেয়েছে” । শুরুর লগ্ন থেকেই বাংলা গান ছিল জনপদের গান এবং কাব্য আশ্রিত । সমাজের রূপান্তর বা এগিয়ে চলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে গান নানান রূপে, নানান ধারায় প্রবহমান থেকেছে, সমৃদ্ধ হয়েছে ।

বাংলায় শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের সময় কালে বাংলা যে ভক্তি রসের প্রবল ধারায় মথিত হয়েছিল, সেটাই বাংলার প্রথম নবজাগরণ কাল । সেই সময়কাল বাংলাগানেরও প্রথম নব জাগরণ কাল । তারও প্রায় পাঁচশ বছর আগে চর্যাপদ কালে মঙ্গল কাব্য সমূহে যে গান তাও নিশ্চিত ভাবেই জনপদের গান । কিন্তু সে গানের গায়ন রীতি বা ধারাবাহিকতা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়না । কেন যায়না তার একটা কারণ হতে পারে – প্রায় সমসাময়িক কালেই ঘটে গিয়েছিল মুসলমান আক্রমণ ও ইসলামের প্রবেশ । তবুও সুফি ও ভক্তি আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে, ঘটে গিয়েছিল শ্রী চৈতন্য দেবের আবির্ভাবে বাংলার প্রথম নব জাগরণ – বাংলা গানেরও নবজাগরণ । চন্ডীদাস, বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস প্রমুখের কীর্তনকে বলা হত মহাজন পদাবলী । ‘কীর্তন’ই বাংলার প্রথম সঙ্গীত ধারা । ১৫৮২ খৃস্টাব্দে নরোত্তম দাস ঠাকুর প্রবর্তন করেন ‘কীর্তন’ গানের । সমকালে মুঘল সম্রাট আকবর বাদশার দরবারে, মিয়া তানসেন উজ্বলতম রত্ন রূপে বিরাজমান । সুতরাং আর একবার বলতে হয় বাংলা গান তার জন্মলগ্ন থেকেই জনপদের গান, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তার কোন শিকড় কোনদিন ছিলনা । সেই জন্যই প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীত শাস্ত্রে কীর্তন গানের কোন উল্লেখ পাওয়া যায়না । কীর্তন গানেরও নানান ঘরাণা বা গায়ন । যেমন নরোত্তম দাস ঠাকুর প্রবর্তিত ‘গরাণহাটি ঘরাণা’, মনোহর দাস সৃষ্ট ‘মনোহরশাহী ঘরাণা , পদকর্তা বিপ্রদাস ঘোষ প্রবর্তিত ‘রেনেটি ঘরাণা’ , গোকুলানন্দ প্রবর্তিত ‘ঝাড়খন্ডী ধারা’ ইত্যাদি । কীর্তন বাঙ্গালির আদি গান । সে কথা বলবো পরের পর্বে ।

চলবে ...