শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

বর্ষপূর্তি - পাঠকের চোখে ' মহাসত্যের বিপরীতে

অন্যদেশ ওয়েবজিনে কথাসাহিত্যিক শ্যামল ভট্টাচার্যের ধারাবাহিক উপন্যাস ‘মহাসত্যের বিপরীতে’ প্রকাশের একবছর পূর্ণ হল। এই একবছরে অগণন পাঠক-পাঠিকা ফেসবুকে উপন্যাসটি নিয়ে কিছু মূল্যবান কথা বলেছেন । তা থেকে বাছাই কিছু মন্তব্য নিয়ে এই নিবন্ধ। লিখেছেন ড. শম্পা রায় ।

৫ই এপ্রিল ২০২০তে সেলু বাসিত জানাচ্ছেনঃ “খুব ভালো লাগছে।নিয়মিত না পড়লে মনে হয় কিছু একটা থেকে গেল।চিনুয়া আচিবি আমাকে যেমন টানে তেমনি।গোত্র সংস্কৃতির Deconstruction প্রতীকায়িত হচ্ছে একটা Resistance এর প্রত্যয় নিয়ে।”

মহাসত্যের বিপরীতে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় সোশ্যাল স্টাডিজ চর্চার ক্ষেত্রে অসাধারণ ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড.সেলু বাসিতের পাঠভাবনা এমনটাই । ক্রমশ প্রকাশ্য একটি বাংলা উপন্যাস সম্পর্কে তাঁর এই মন্তব্য এবং তাতে বিশ্বখ্যাত নাইজেরিয়ান লেখক আচিবির প্রাসঙ্গিক উল্লেখ স্বাভাবিক ভাবেই বাড়তি কৌতূহল দাবি করে। বুখারি(১৯৯৭),লোদ্রভার কাছাকাছি(২০০৯),দ্বীপান্তরে ফুল ফুটেছে(শারদীয়া স্যন্দন,২০১৪), বাঞ্ছা কল্পতরু (মুখাবয়ব,২০১৬)র মতো শ্যামল ভট্টাচার্যের পঞ্চম উপন্যাস ''মহাসত্যের বিপরীতে' -ও প্রথমেই শ্রবণ ও মননকে ধরে টান দেয় এর নামের গুণে।ব্যাকরণের সাধারণ নিয়মে মহাসত্যের বিপরীত মহামিথ্যা হওয়াই সঙ্গত কিন্তু আদতে মহামিথ্যা বলে কিছু হওয়া সম্ভব নয়।তাই মহাসত্যের ভিন্ন মুখ হল চিরন্তন, শাশ্বত সত্য। সাইকোফিজিক্যাল,প্যারাফিজিক্যাল এবং মেটাফিজিক্যাল রিয়েলিটির এক অ-পূর্ব সুসমতায় গড়ে ওঠা এই সত্য এবং তার স্বরূপ সন্ধানই এই উপন্যাসে লেখকের অন্বিষ্ট।

একসময় গুলজার তাঁর একটি শের-এ লিখেছিলেনঃ

“ভাবনাকে ছুঁড়ে দিয়েছি নিরাশ্রয় গতির সাথে,দেখি/খোদা অব্দি পৌঁছে না কি তাঁকে ছেড়ে বেরিয়ে যায়/না কি তারপর আবার সে আমার কাছেই ফিরে আসে।”

(অনু. শ্যামল ভট্টাচার্য) উপন্যাসে এই ভাবনার সরণি বেয়েই শ্যামল পৌঁছে যান ১৯৩৩ সালে। কাহিনির সূচনাকাল এটাই,প্রেক্ষাপট দলাই লামার শাসনাধীন স্বাধীন তিব্বত। সে বছরই মৃত্যু হয়েছে ত্রয়োদশ দলাই লামার। তাঁর যোগ্য উত্তরাধিকারীর অভাবে আপাতভাবে দেশ তখন সার্বিক এক বেসামাল অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।সুযোগের সদ্ব্যবহার করে অনুপ্রবেশকারী চীনা সৈন্যরা তিব্বতে নির্বিচারে চালাচ্ছে লুন্ঠন,ধর্ষণ,অগ্নিসংযোগ।রাষ্ট্রীয় জীবনে যেকোনো দুর্গতির প্রথম অভিঘাত পড়ে প্রাকৃত জনজীবনেই। ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে তিব্বতের সেই প্রান্তজনদের যাপিত জীবন ও মনোজগতের বিচিত্র অন্তর্দাহ এবং বহিরাঘাতের ছবি ধরা পড়েছে ইতিহাসাশ্রয়ী এই উপন্যাসে।রয়েছে ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র,পরিবার থেকে সমাজ।বড় যত্নের সঙ্গে শ্যামল ভট্টাচার্য লিখেছেন তিব্বতি ব্রাত্যজনদের কথা,অবশ্যই পরিবর্তিত সময়কে সঙ্গী করে। এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত কাহিনিতে ধারকচরিত্র গরব। লেখক দেখিয়েছেন,কীভাবে “প্রবল ইচ্ছাশক্তি দ্বারাই মানুষ নিজেকে জীবনের পরবর্তী ধাপে নিয়ে যায়।এভাবেই জীবনের প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে গেলে মানুষই হয়ে ওঠে ঈশ্বর...গরবের জীবন সংগ্রামী জীবন।এই সংগ্রামই তাকে সুপুরুষ বানিয়েছে।”(সোমেন চক্রবর্তী)ক্রমশ সে হয়ে ওঠে একক। নিজের অতীত,বর্তমান সবকিছু নতুনভাবে সাজিয়ে তুলতে থাকে।আর সেই সূত্রেই যেন তার অভিযানমুখর লড়াকু জীবন যেকোনো প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে,তাকে জয় করতে পাঠককে হাতছানি দেয়। তিব্বত এই আখ্যানের মূল কেন্দ্র হলেও ক্রমশ তা শিকড় ছড়াতে থাকে প্রতিবেশী দেশগুলোতেও।আর পাশাপাশি উন্মোচিত হতে থাকে জীবনের অজস্র জটিল হিসেব- নিকেশের গল্প।বেঁচে থাকার জন্য জন্মভূমির টানকে ছিঁড়ে ফেলতে হলে কোনো মানুষের সার্বিক অবস্থান কেমন দাঁড়ায়,সেই ডিসকোর্স এখানে ধরা দেয় সুদৃঢ়তায়।সেই সঙ্গে আছে মানুষ ও প্রকৃতির চিরকালীন মিথস্ক্রিয়া,সাব অলটার্ন জীবনপ্রবাহের ধীর লয়ের পারমুটেশন-কম্বিনেশন,অসংখ্য মিথ—প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যা প্রাগুক্ত সমাজজীবনে সুপ্রোথিত ও সুপ্রচলিত,লোকায়ত সমাজের চিন্তাভাবনার আধুনিকতা,মানসিকতার গভীরে অসাম্প্রদায়িক চেতনার লালন,আর্থ-সামাজিক বিবিধ উপাদানের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া। হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের বহু অজ্ঞাত তথ্যের পাশাপাশি রয়েছে থট ট্রান্সপোর্টেশন, হিপনোটিজম,মানুষের আয়ুবর্ধক জটিল বৈজ্ঞানিক কৌশল সহ প্রকৃতি থেকে পাওয়া প্রাচীন বিজ্ঞানশাস্ত্রের অনেক না-জানা বিষয়ের উপস্থিতি, ক্ষেত্রবিশেষে এসেছে ফ্রয়েডীয় ও দর্শনশাস্ত্রের জটিল তাত্ত্বিক জ্ঞান,মানব মনস্তত্ব সহ কখনো শূন্যতাবোধ,কখনো বা জাদুবাস্তবতার অমোঘ প্রয়োগ—সব কিছু মিলেমিশে সৃষ্টি হওয়া বর্ণিল এক একটি অপরূপ কোলাজের সমন্বয়ে ...

5ea53b967a4d3.jpg


“এ এক অদ্ভুত আখ্যান,যেখানে ইতিহাসের আলোয় ফুটে উঠতে চাইছে ভবিষ্যতের অজানা আকাশ।”(শান্তনু ভট্টাচার্য) কিন্তু ‘এহ বাহ্য।’ নিবিড় ক্ষেত্রসমীক্ষা সম্পন্ন এই উপন্যাসে লেখক অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ভাবে উপস্থাপিত করেছেন বৌদ্ধ তন্ত্রবিদ্যা—তার তত্ত্ব ও তথ্য; চীন,মঙ্গোলিয়া,তিব্বত ও ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রাচীন ধর্মের বিপরীতে বৌদ্ধদর্শনের প্রয়োগগত পার্থক্য ও জনমানসে এর প্রভাব।তিব্বতীয় সভ্যতার দেবদেবীরা কীভাবে হিন্দুধর্মের দেবতাদের দ্বারা প্রাণিত,সুন্দর সুযৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে তারও ।বৌদ্ধধর্মে জীবহত্যা মহাপাপ হলেও কীভাবে ধর্মগুরুরা অপার নির্মমতায় মানুষকে খুন করে,সেই অদেখা চিত্রের নিপুণ ভাষারূপ পাঠককে চমকে দেয়। লেখক নিজে অবশ্য বলেছেন যে--

  • ,“আমি সভ্যতার ইতিহাসে শত পুষ্পের প্রস্ফুটন অনুভব করি ।সেদিক থেকে যে কোনও প্রাচীন ধর্ম ও সভ্যতার ঐতিহ্যকে আমার পূর্ব পুরুষদের অর্জন বলে মনে করি,আর যে কোনও বিতাড়নকে মূর্খতা।আবার অন্যভাবে ভাবলে মানুষের গণবিস্থাপনের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে সভ্যতার বিকাশ।এরকম অনেক ভাবনাই এই অন্বেষণের মূল প্রেরণা।”

অনুভবী মানবসত্তার অভিজ্ঞতা প্রসূত সৃষ্টি মহাসত্যের বিপরীতে উপন্যাসটি ঠিক কোন ধারার তা বলা অসম্ভব।রক্ত জল করা মেধাবী পরিশ্রম,নির্মোহ মনন এবং সভ্যতার পিলসুজ যে জনগণ,তাদের প্রতি আত্মিক ভালোবাসা থাকলেই বোধহয় এমন এক লেখা লিখতে পারা যায় যেখানে মহাকাব্য,সাব অলটার্ন স্টাডি,সামাজিক- নৃতাত্ত্বিক পাঠ ‘সব এক দেহে হল লীন।’ এক কথায়;গবেষণার সঙ্গে এই সৃজনে যুক্ত হয়েছে দরদ,তথ্যের সঙ্গে মিলেছে অন্তর্দৃষ্টি,মনোহর ভঙ্গির সঙ্গে মিলেছে অপূর্ব ভাষা। সমগ্র আখ্যানে সময় ও দৃশ্যান্তর প্রায় সিনেমার মতো করে ধরে দিয়েছেন লেখক, আর পরিপার্শ্ব এবং চরিত্রদের মানসিক অবস্থার বিবরণ চিত্রকল্প তুল্য।উপন্যাসটি জমিয়ে তুলতে মাইক্রো টেনশনের,ইতি ও নেতি উভয় অর্থেই, প্রচুর ব্যবহার দেখা গেছে। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ছোট ছোট উত্তেজনা তৈরি করেছেন কথাকার,যা পাঠক আকর্ষণে সহায়ক।কাহিনির কোনো অংশ,কোনো চরিত্র একটি বারের জন্যও অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয় না। বরং চাহিদা অনুযায়ী পরিবেশ গড়ে তুলে যথোচিত সংলাপের বুননে চরিত্রগুলোকে নিজ অবস্থান থেকে বেশ যুক্তিসঙ্গতভাবে গেঁথে তোলা হয়েছে।পাঠকালে এই অনুভব বেশ তৃপ্তিদায়ী। বিষয়কে ধরা,ধরে উপস্থাপন করা,তার জন্য ভাষা ও চরিত্র নির্মাণ এবং এই সব কিছুর মধ্যে দিয়ে একটি শিল্পিত উপন্যাস পাঠককে উপহার দেওয়া একজন লেখকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।মহাসত্যের বিপরীতে এ দায়িত্ব পালনে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন শ্যামল ভট্টাচার্য।তাই, বাংলা সাহিত্যে অসামান্য গুরুত্বপূর্ণ নতুন এক সংযোজন ঘটেছে,একথা নির্দ্বিধায় বলা চলে।

সংযোজন --

অনিরুদ্ধ আলি আক্তার , অঞ্জলি সেনগুপ্ত , অপাংশু দেবনাথ , বিশ্বজিৎ মজুমদার , ড. শ্যামলী রক্ষিত , গোবিন্দ ধর , মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় , পাপিয়া ভট্টাচার্য , পরমেশ্বর দাস , পার্থ চক্রবর্তী , প্রদ্যুত কুমার ভট্টাচার্য , প্রাণজি বসাক , শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ , শ্বাশত কুমার , সৌম্যজিত আচার্য ,শরিফুল হক , শুভ্রশংকর দাস , সুনীল মাঝি , তপন বন্দোপ্যাধায় , তৃষ্ণা বসাক এর মতো তন্নিষ্ঠ পাঠককে ধন্যবাদ জানাতে হয় , যাদের সুচিন্তিত অভিমত নানাভাবে উপন্যাসটিকে সমৃদ্ধ করেছে


কোলাজ , গ্রাফিক্স ঃ স্বপন মজুমদার