শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

প্রসঙ্গ : ‘এন-আর-সি’ছুট ও ডিটেনশান ক্যাম্প : কিছু কথা, কিছু জিজ্ঞাসা...

এই ‘এন-আর-সি’ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জি নবায়ন করার ক্ষেত্রে আসুর (All Assam Students Union) দাবি সত্যই সঙ্গত। কিন্তু দাবিটা পেশ করেছে ওরা বড্ড দেরিতে। যে সমস্যা সমাধানের জন্য ওদের এই পদক্ষেপ সেই সমস্যা তো আরও বেড়েই গেল। অসমে প্রথম রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরি হয়েছিল ১৯৫১ সালে। আজ থেকে ৬৮ বছর আগে। আদমসুমারির মতো নাগরিকপঞ্জিও দশ বছর পর পর নবায়ন করতে হয়।এটাই আমরা জানি। অথচ নাগরিকপঞ্জির ক্ষেত্রে এ নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি। যারফলে এখন যে ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে সারা অসম সে-সমস্যা তখন থেকেই একটু একটু করে এই ভয়াবহতার দিকে এগিয়ে এসেছে। ২০১৮ তে যে নবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হল তাও আসুর চাপে পড়ে। আসু চেয়েছে অসম চুক্তিমেনে অর্থাৎ ২৫ মার্চ ১৯৭১ এর পর যারা বাংলাদেশ থেকে অসমে এসেছে তাদের নাম বাদ দিয়ে নাগরিকপঞ্জি নবায়ন করতে । এবং এই দাবিসহ নাগরিকপঞ্জি নবায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৭ বছর পর। এতোগুলো বছর সরকার ও এই ছাত্রসংস্থা জেগে ঘুমিয়ে ছিল কি?বর্ডার পুলিশও বা কোথায় ছিল তখন? যদি ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর পর আসা এধরনের কোনও প্রমাণ তাদের হাতে থেকেই থাকে তাহলে কী-ভাবেই বা এই বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে সেইমানুষগুলোর প্রব্রজন ঘটল? বাধা দেওয়া হয়নি কেন তাদের? এইসব প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে আসা ভিটেমাটি ছাড়া অথবা পেটের দায়ে আসা গরিবগুরবো অভাবী মানুষগুলোর প্রতি কি সত্যি সহানুভূতিশীল ছিলেন তৎকালীন ভারত সরকার? আসুর বক্তব্য যদি ধরা হয়, কী-ভাবেই বা ভোটার তালিকায় এদের নামও উঠে যায়? দীর্ঘ ৪৭ বছর পর , যে সময়ের ভেতর একটা নতুন প্রজন্মেরও সৃষ্টি হয়ে যায়, এতগুলো মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে না কি ? অমানবিকও। এতগুলো মানুষ যাবে কোথায়? যথা সময়ে সীমান্তে বাধা দিলে এ পরিস্থিতি কখনোই সৃষ্টি হতোনা।এখানেই তো ওরা শেকড় গেড়ে নিয়েছেন কোনও রকম বাধা পায়নি বলেই। সরকারই বা কোথায় ঠেলে দেবে ওদের আজ! এতগুলো বছর পর বাংলাদেশ সরকারও কি ফিরিয়ে নিতে রাজি হবে এদের? এইসব মানুষগুলোকে কেন কুকুর-বেড়াল, গরু-ছাগলের মতোই ভাবা হচ্ছে এখন?ইতিমধ্যে তো অনেককেই ভরা হয়েছে ডিটেনশান ক্যাম্পে! আরও প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে ভরার জন্যে ! মনুষ্যত্বের কী নির্মম অপমান আর অবমাননা!মানবাধিকার লঙ্ঘন! ভুল তো হয়েছে সরকারেরই!

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, অসমে যুগে যুগে প্রব্রজনকারীরা এসেছে,এই যেমন আহোম,মায়ামরিয়া,মোঘল,শিখ...।বিভিন্ন সঙ্গত কারণে, অর্থনৈতিক,সামাজিক, রাজনৈতিক...।এইভাবে বাঙালিদেরও আগমন ঘটেছিল আহোম যুগে আহূত হয়ে, ব্রিটিশ-ভারতের যুগে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির আমলে, ইংরেজ প্রশাসনের কাজ নিয়ে, অসমের চরগুলোতে চাষবাসের কাজে আহূত হয়ে,এরপর দেশ বিভাগ, দাঙ্গা, প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে উদ্বাস্তু হয়ে,তারপর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী কয়েকটা দিশেহারা বছর, অর্থনৈতিক দুর্দশা, পাকিস্থানপন্থী মৌলবাদীদের অত্যাচার ইত্যাদি কারণে ছিন্নমূল হয়ে...। সুতরাং এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, এতোগুলো মানুষেরকেউই সাত পুরুষের শ্যামলা-সুফলা ভিটেমাটি ছেড়ে নাচতে নাচতেচলে আসেনি এই অনিশ্চয়তার বিদেশ-বিভূঁইয়ে ।

এই ‘এন-আর-সি’র ডামাডোলে অসমের আকাশে-বাতাসে শোনা যাচ্ছে একটি শব্দ ‘খিলঞ্জিয়া’ অর্থাৎ ভূমিপুত্র। এই ‘খিলঞ্জিয়া’ কারা? শুধু অসমিয়ারাই কি, বাঙালিরা নয়? অসমের সব বাঙালিকেই কি দেশ ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল এখানে? যারা নিজেদের সুবিধা মতো ‘খিলঞ্জিয়া’র সংজ্ঞা তৈরি করছেন তাদের উচিত নিরপেক্ষ মানসিকতা নিয়ে অসমের প্রাচীন ইতিহাস ও ভূগোলটা খুঁটিয়ে পড়া।নয়তো অন্তর্নিহিত সমস্যা বাড়তেই থাকবে।

আশ্চর্য, সেই গত শতকের ষাটের দশক থেকে অসমিয়া সাধারণ সমাজেএকটা ফোবিয়ারটিয়ে আসা হচ্ছে এই বলে যে, বাঙালিরা অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতিকে গিলে খাবে! সেই রেওয়াজআজও চলছে! এবং এই রেওয়াজের পেছনে কাজ করে একটি ন্যস্ত স্বার্থ।ভোগবাদী রাজনৈতিক স্বার্থ। এই ফোবিয়া অনেকটা শিশুদের জুজুবুড়ির ভয়দেখানোর মতো।অসমিয়া সাধারণ সমাজের মধ্যে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে এই ভয়।এবং ওদের এই আশ্বাসও দেওয়া হয় এই বলে যে, তাদের(যারা ভয় দেখায়) মসনদে জিতিয়ে আনলে এই ভয় দূর হয়ে যাবে। আবার কখনো কখনো বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে বাঙালিদের মধ্যেও ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় এই বলে যে, তোমরা কিন্তু যখন–তখন বিদেশি আখ্যা পেয়ে যেতে পার । সুতরাং আমাদের দলকে মসনদে জিতিয়ে আনলে তোমরা নিশ্চিন্তে থাকবে। এইভাবে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়। সমস্যা যে কূলে ছিল সে কূলেই থেকে যায়। মজা লুটে ন্যস্ত স্বার্থ।বছরের পর বছর এই সমস্যাগুলোকেই ক্যাপিটেল করে ওরা।অসমিয়া সাহিত্য-সংস্কৃতির ভিত্তিভূমিটি যে ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছে, উন্নত হচ্ছে তার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা, এক্ষেত্রে পৃথিবীর ভাষার ইতিহাসে অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির অবস্থান যে ফুটন্ত ফুলের মতোই, অসমিয়া ভাষাসংস্কৃতি যে কখনোই হারিয়ে যাবার নয়, অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির পরিধি যে ক্রমশ বাড়ছে সমাজ-বিজ্ঞানের নিজস্ব নিয়মেই-- এই তথ্যগুলি সাধারণ অসমিয়া সমাজ জানে না, বা সেখানে প্রচারিত হয় না। কিন্তু যখনই তাদের জানানো হয় যে, তাদের অতি আদরের এই অসমিয়া ভাষাসংস্কৃতি বিপদের মুখে। এবং বিপদের কারণ বাঙালি। তখনই ওরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিশ্বাস করে ফেলে কথাটি। এবং বাঙালিদের প্রতি পুরানো অসহিষ্ণুতাবোধটি আবার কেঁচেগণ্ডূষ হয়ে ওঠে। ন্যস্ত স্বার্থের উদ্দেশ্য সিদ্ধি হয়। কিন্তু নীরবে যে অসমিয়া জাতিটিরক্রমশ বৃদ্ধি ঘটছিল তার বিঘ্ন ঘটে।এরকম বার বার বিঘ্ন ঘটেছে। বিঘ্ন ঘটছে ন্যস্ত স্বার্থে আচ্ছন্ন কুটিল এই রাজনীতির জন্যেই। এবং সব সময়েই এই রাজনীতির ট্রাম্পকার্ডহয় ও হচ্ছে বাঙালিরাই, বিশেষ করে ওপার থেকে আসা ছিন্নমূল বাঙালিরাই ।যদি উল্টোটা হতো তাহলে সুযোগ সুবিধে মতো অসমিয়া জাতিটা ‘গেলো গেলো’ রব তুলে রাজনীতি করা যেত না। আর সে-রাজনীতির মিঠে ফলও ভোগে আনা যেত না।যদি এই কুটিল রাজনীতি না করে সবদিক সঠিকভাবে নিরীক্ষণ করে, অত্যন্ত আবেগিক না হয়ে, সহানুভূতিশীল হয়ে ভাবা হতো যে,এতগুলো অসহায় মানুষ, যারানিষ্ঠুর রাজনীতির বলি, তারা যাবে কোথায়? বাঙালি বলে ওদের প্রতিবিদ্বেষ আর অসহিষ্ণুভাব যদি পোষণ না করা হত, এইসব বিপদগ্রস্ত বাঙালিদের আবার ছিন্নমূল করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত না নিয়ে যদি ভালোবেসে কাছে টেনে নেওয়া যায় তাহলে বুঝি সব সমস্যারই সমাধান হয়ে যায়। অসমিয়া জাতিটারও শ্রীবৃদ্ধি হয়।খিলঞ্জিয়া অখিলঞ্জিয়া ভেদাভেদ সৃষ্টি করতে হয় না। যেখানে আশ্রয় পাবে,যেখানে ভালোবাসা পাবে সেখানকার ভাষা-সংস্কৃতিগ্রহণ করতে তাদের অন্তর থেকে সততই সাড়া উঠবে ।(ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় গত শতকের শেষার্ধ থেকে এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি নিশ্চয় পরিলক্ষিত হবে)।জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। জোর করে চাপিয়ে দিলে প্রতিপক্ষ জেদি হয়ে ওঠে।

আসলে, অসমিয়া জাতিটাকে সততই ধাওয়া করে একটি যন্ত্রণাদায়ক অতীত ইতিহাস।কী সেই ইতিহাস? ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার(বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি)অধীনে এসে ১৮৩৬ থেকে ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত এই ৩৭ টা বছর অসমে সরকারি কাজকর্মে ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাধ্যতামূলকভাবেপ্রয়োগ করাহয়েছিল বাংলা ভাষাকে। এই সময়সীমাটি অসমিয়া ভাষা-সাহিত্যের ইতিহাসে কালো অধ্যায় বলে আজও বিবেচিত।তৎকালীন অসমিয়া সাহিত্যের ইতিহাসকাররা প্রচারও করেছেন এই বলে যে, ওই প্রয়োগের পেছনে রয়েছে বাঙালিদেরই ষড়যন্ত্র। তখন থেকেই পুরুষানুক্রমে বাঙালিদের প্রতি সাধারণ অসমিয়া সমাজের বিদ্বেষ ও সন্দেহ আজও বিরাজমান।প্রসেনজিৎ চৌধুরী ও শিবনাথ বর্মণের মতো অসমিয়া পণ্ডিতরা বিভিন্ন তথ্যাদিসহ প্রমাণ করেছেন যে, ওইসব উগ্র-জাতিয়তাবাদী ইতিহাসকারদের ধারণা অমূলক ও মিথ্যা।কিন্তু একদল শক্তিশালী ন্যস্ত স্বার্থান্বেষী থলুয়া ও ছলুয়া ওই মিথ্যেটাকেই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে পল্লবিত করে ঢুকিয়ে দিচ্ছে সাধারণ অসমিয়া সমাজের শঙ্কার জগতে যে,অসমিয়ারা সংখ্যালঘু হয়ে যাবে, বাঙালি আবার আগের মতো অসমটাকে অধিকার করে নেবে।

সম্প্রতি অসমিয়া সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে আরেকটি ফোবিয়া ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে এই বলে যে , অসমটা ত্রিপুরা হয়ে যাবে। এই ধারণা ঢুকিয়েদেওয়া হচ্ছে ইতিহাসকে জেনে অথবা না জেনে।ইতিহাস বলছে, ১২৮০ সালের আগেতৎকালীন বঙ্গদেশের পাল রাজবংশের অধীনে এই ত্রিপুরা রাজ্যটি শ্রীভূমি নামে পরিচিত ছিল।ত্রিপুরার বিখ্যাত ‘ঊনকোটি’র ভাস্কর্যসমূহ খোদিত হয়েছিল ওই পাল রাজত্বেরসময়েই।এরপর ৫৪৭ বছরেরত্রিপুরি রাজবংশের গতিধারায় বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে ওতপ্রোতভাবে,ঐতিহ্যানুসারেই। ত্রিপুরি মাণিক্য রাজবংশের প্রথম রাজা ( ত্রয়োদশ শতাব্দী) ধন্য মাণিক্যের সময়েইত্রিপুরা রাজ্যে বাংলা ভাষাচর্চার গতি অত্যন্ত বেগবান ছিল। রাজ পরিবারের অন্দরেই ব্যবহৃত হতো বাংলা। তখন থেকেই বাংলা ভাষাকে নিজস্ব মান্য ভাষা হিসেবেই গন্য করা হত সেখানে।ত্রিপুরি রাজবংশের ঘটনাপঞ্জি(ইতিহাস) ‘রাজমালা’ তো লেখা হয়েছিল বাংলা পদ্যে,পঞ্চদশ শতাব্দীতে ধর্ম মানিক্য ১-এর শাসনকালে। এই ধারা চলে এসেছে শেষ রাজা কিরীট প্রদ্যোত দেব বর্মণের যুগ পর্যন্ত (১৯৭৮-- )।(যদিও ১৯৪৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বরের পর থেকে ত্রিপুরা রাজ্য (রাজবংশ শাসিত) মিশে যায় স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে। সেই সময়ের শেষ রাজা অর্থাৎ মাণিক্য ছিলেন কিরীট বিক্রমকিশোর মাণিক্য বাহাদুর দেববর্মণ। ) তো, ওই ত্রয়োদশ শতাব্দীর বহু আগে থেকেই রাজানুকূল্যে বাঙালিরা বসবাস করে আসছেন এই ত্রিপুরায়।ত্রিপুরি রাজবংশের সময়ে পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকে বাঙালির গমনাগমন বা প্রব্রজন স্বীকৃত ছিল । রাজপরিবার বা টিপরা জনগোষ্ঠী টিপরা-বাঙালি বিভেদ কখনো কল্পনাই করতে পারেনি।কারণ বাংলা ভাষাটি রাজভাষা(সরকারি) ও যোগাযোগকারী ভাষা হিসেবে প্রচলিত ছিল অনেক আগে থেকেই।পরবর্তী কালে ভারতে অন্তর্ভুক্তির পর প্রথম ইংরেজি,দ্বিতীয় বাংলা এবং তৃতীয় সরকারি ভাষা হিসেবে ধার্য করা হয়েছে টিপরা অর্থাৎ ককবরক ভাষাকেই ।তো, আদিকাল থেকেই রাজ্যটির বিভিন্ন ক্ষেত্রের উন্নয়নে জড়িয়ে পড়েছেন ও পড়ছেন টিপরা ও বাঙালি উভয়েই, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।হ্যাঁ, দেশভাগ ও বাংলাদেশ যুদ্ধজনিত কারণে ত্রিপুরায় কিছু পরিমাণে প্রব্রজন ঘটেছে সত্যি। এটি একটি জাতীয় সমস্যা। বিশ্ব-রাজনীতির নিরিখে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যাও বটে।তবে, এই প্রব্রজনে ত্রিপুরার উন্নয়নে কোনও ক্ষতি সাধন হয়নি। কিন্তু ন্যস্ত স্বার্থ এটিকে নিয়ে বিভেদের রাজনীতি করেছে।হানাহানিতেও প্ররোচিত করেছে।এই বিভেদ, এই হানাহানির রাজনীতি বাড়ায় সমস্যা, বাড়ায় অশান্তি, বাড়ায় রক্তপাত,যা কখনোই সুপথ দেখাতে সাহায্য করে না,অমঙ্গলকর। কিন্তু ওই একদল ভণ্ড মুখোশধারী, সর্ব যুগেই যাদের অবস্থান খুঁজে নিতে অসুবিধে হয় না, এই সমস্যা, এই বিভেদ, এই অশান্তি জিইয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর হয়, তাদের ক্ষমতা ভোগ করার যাবতীয় কায়েমি স্বার্থের খাতিরেই। আচ্ছা, অসমের (ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা) আসল খিলঞ্জিয়া যারা, এই যেমন মরান, বরাহি,কেওট,কছারি,মিছিং,আহোম ইত্যাদি , যাদের নিয়ে মিশ্র প্রক্রিয়ায়অসমিয়া জাতিটি গড়ে উঠেছে এবং উঠছে , তাদের অস্তিত্বকে দেখছি আবার চাগাড় দেওয়া হচ্ছে জনজাতি হিসেবে ঘোষণা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ! ভোট পাওয়ার আশায় কি? বোড়োরা তো ইতিমধ্যে ভাষা-সংস্কৃতি ও ভূমির ক্ষেত্রে আলাদা অস্তিত্ব নিয়েই ফেলেছে।কার্বি আর ডিমাসারাও ওই একই বিষয় নিয়ে ওদের আলাদা অস্তিত্বের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। এতে করে অসমিয়া জাতিটির পরিসর ক্রমশ কমে আসবে না কি? এ নিয়ে কেনই বা প্রতিবাদ উঠছে না !? যত দোষ নন্দ ঘোষ অর্থাৎ বাঙালিদের !?বাঙালিদের ওপরই চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে অসমিয়া হয়ে যাওয়ার জন্য! অথচ যেসব ছোটো ছোটো জাতি-উপজাতিগুলি দিয়ে বৃহত্তর অসমিয়া জাতিটি ইতিমধ্যে সম্প্রসারিত হয়ে উঠেছে ওগুলোই যে আবার নিজস্ব পরিচিতি পেতে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে সে দিকে দৃষ্টি নেই কেন!?কেনইবা ওরা নিজস্ব পরিচিতি পেতে চাইছে, এ-নিয়ে সরেজমিনে তদন্তের প্রয়োজন নেই কি?

তো, বাঙালিদের নিয়ে এই রাজনীতির খেলা কখনোই কাম্য নয়।(অসমিয়ারাও যদি মনে করেন তাঁদের নিয়েও রাজনীতি হয়, সেটাও কাম্য নয়।) শুধু রাজনীতি নয়, নির্মম রাজনীতি। হত্যার রাজনীতি। যে দলেরই পাল্লা ভারী থাকে ওরা অসহায় বাঙালিদের বলির পাঁঠা করে।সন্ত্রস্ত করে তোলে বাঙালি জনজীবনকে। সমস্যা সমাধান হয়ে গেলে তো ওদেরকে নিয়ে আর রাজনীতি (বলির পাঁঠা ) করা যাবে না। ধলায় যে পাঁচ বাঙালির হত্যা হল সেটা তো নির্মম রাজনৈতিক হত্যা। এঁরা তো সবাই ভারতীয়। অসমিয়া সাহিত্য-সংস্কৃতিকে ইতিমধ্যে এঁরা গ্রহণ করে ফেলেছেন।অথচ এঁদেরই মারা হলো! কেন ? সবই রাজনৈতিক রহস্য!এ-ভাবেই ‘এন-আর-সি’কে কেন্দ্র করে হয়েছে বাঙালিদের ওপর অমানবিক পীড়ন ও হয়রানি। শাসকদল তো একসময় বাঙালি হিন্দুদের পক্ষে শোরগোল তুলেছিল। অথচ, ‘এন-আর-সি’র ট্রাইব্যুনালে হেনস্তা হয়েছেন বাঙালি হিন্দুরাই বেশি, যোগ্য নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও। ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী হয়েছেন হিন্দুরাই বেশি। অপমানিত হয়ে আত্মহত্যা করেছেন হিন্দুরাই বেশি!

তো,অসমের এই এন-আর-সি প্রক্রিয়া তো প্রায় শেষ হলো।গত ১৪ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত তালিকাও বেরিয়ে গেল। ১৯ লক্ষেরও বেশি মানুষের নাম বাদ পড়ল। এর মধ্যে প্রায় ১২ লক্ষের মতো বাঙালি।(হিন্দু বাঙালিই বেশি। যার ফলে বর্তমান রাজ্য সরকার একটু বেকায়দায় পড়ল বুঝি।) ইতিমধ্যে ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে। অনেক বাঙালির বা ভারতীয়র উপযুক্ত নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও নাম ওঠেনি! তালিকায় প্রকাশিত ভুল নামের সংশোধনী আবেদন করা সত্ত্বেও চূড়ান্ত তালিকায় সে ভুলই থেকে গেছে। এ-ছাড়া আরও অনেক মারাত্মক ভুল উঠে আসছে। এইসব গাফিলতি যে হতে পারে এন-আর-সিকর্তৃপক্ষ বুঝি আগে থেকেই আঁচ করতে পেড়েছিল।তাই চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ পাওয়ার পরও আরেকটি সুযোগের রাস্তা খুলে দিয়েছে, ১২০ দিনের মধ্যে আবেদন করার।। এরপর,স্বাভাবিকভাবেই এন-আর-সি ছুটের সংখ্যা আরও কমে আসবে।তো,বাকি যারা থাকবেন তাঁদের কী দশা হবে?

না, তাঁদের ঠেলে বাংলাদেশ পাঠাবে নাসরকার,আগেই বলে রেখেছে।তাঁদের দেখভাল নাকি সরকারই করবে। তাই গোয়ালপাড়ায় কোটি কোটি টাকা খরচ করে তৈরি হচ্ছে দেশের মধ্যেসবচেয়ে বড়(বিশাল) ডিটেনশান ক্যাম্প।(মজার ব্যাপার হলো, ওই ডিটেনশান ক্যাম্প তৈরিতে যুক্ত আছেন যে-সব শ্রমিক তাঁদের কারোরই এন-আর-সিতে নাম নেই।)সেখানেই পোরা হবে ওঁদের।স্বাভাবিকভাবে ওঁদের ভরণ-পোষণেরও দায় এসে পড়ে সরকারেরই ঘাড়ে।অতিরিক্ত আরও খরচা।এই পোড়া দেশে যেখানে এখনো মানুষ দু’বেলা পেট ভরে খেতে পায় না, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই যেচে আনা ব্যয় গোদের ওপর ডেকে আনা বিষফোঁড়া ছাড়া আর কি হতে পারে বলুন তো? এন-আর-সিকে কেন্দ্রকরেই তো পাহাড়সম খরচা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।এই এন-আর-সি করে অসমিয়া জাতি ও সাহিত্য-সংস্কৃতির কি কোনো বাড়তি উন্নতি হলো নাকি উন্নতিটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই হলো বা উদ্বাস্তু হয়ে আসা সাধারণ অসহায় মানুষগুলোর (বাঙালি) প্রতিঅমানবিক আচরণ করে এই অসমে কার কী ইষ্টসাধন হলো সেটার সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে,এখনই নয়, আরও ক’টা দশক পরে। গত তিন/চারটা বছর তো সারা অসমের চোখ-মগজ আচ্ছন্ন ছিল এই এন-আর-সিকে কেন্দ্র করেই।বাকি সমস্যাগুলোকে নিয়ে মাথা ঘামাবারও অবসর হয়নি। ওদিকে স্বঘোষিত উন্নয়নমুখী সরকারও নিয়ত থেকেছেউদ্বেগহীন, নিষ্কণ্টক।

হ্যাঁ,দেখেশুনে তো মনে হচ্ছে,ওদের ভাগ্য বেঁধে দেওয়া হয়েছে ডিটেনশান ক্যাম্পের কালো কুঠুরিতেই।তাই এতো ঘটা করে আয়োজন করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা খরচা করে। এ-বিষয়ে এই প্রতিবেদকের একটি বিনম্র জিজ্ঞাসা-- ডিটেনশান ক্যাম্পে না রেখে যদি ওদের নিজস্ব স্ব স্ব স্থানে রেখে প্রত্যেককে ভারত সরকারের রেসিডেন্সি পারমিট রেগুলেশান অনুযায়ী টেম্পোরারি রেসিডেন্স পারমিট দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় তাহলে কি ওইসব উটকো অপব্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না? এইভাবেই তো তিব্বতী উদ্বাস্তুদের ভারতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওরা ভারতের নাগরিক বলে চিহ্নিত নয়। ওদের ভোটাধিকার নেই।জমি বাড়ি করারও কোনও অধিকার নেই।নেই সরকারি চাকরির সুযোগ। আছে শুধু বেসরকারি ক্ষেত্রে কায়িক শ্রম,ব্যবসা ও শিক্ষাদীক্ষার অধিকার।ওই পারমিটটিকে ওদের শুধু প্রতি বছর নবায়ন করতে হয়।তো, এন-আর-সি ছুট হয়ে যারা বিদেশি বলে আখ্যায়িত হবেন তাদেরও এই সুযোগটি দিলে বোধ হয় সব দিক দিয়ে উত্তম হয়।যারা চূড়ান্তভাবে এন-আর-সিছুট হবেন তাঁদের অন্যত্র কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকবে না, এটা ঠিক।এঁরা বেশির ভাগই সরল,নিরক্ষর, গরিবগুরবো দলের।এঁরা বোঝে না এন-আর-সির মর্ম, বোঝে না ভাষা-সংস্কৃতির মর্মও।এঁদের কাছে থাকে না কোনো দলিল-দস্তাবেজ বা নথিপত্র।এঁরা দক্ষ শুধু কায়িক শ্রম করে দিন গুজরানোতে।যেখানে ওঁদের প্রাণের সংশয় কম সেখানেই ওঁরা বাসা বাঁধেন।তাই, এই মুহূর্তে ওঁদের আশ্রয়স্থল একমাত্র এই ভারতবর্ষই। ধরেই নেওয়া যেতে পারে ওঁরা ভারত সরকার তথা অসম সরকারের কাছে আশ্রয়প্রার্থী ।ওঁরা কিন্তু কখনোই বসে বসে ভারত তথা অসমের অন্ন ধ্বংস করছেন না। দেশ ও রাজ্যের বিভিন্ন উন্নয়নের ক্ষেত্রে ওঁরা ওঁদের কায়িক শ্রম ও মেধা বিলিয়ে দিচ্ছেন দিনের পর দিন।দিচ্ছেন ভালোবাসাও। যে-কারণে, ওঁদের বিদেশি বলে গন্য করা হলেও,শত্রু বলেকখনোই বিবেচনা করা যায় না।একমাত্র শত্রুভাবাপন্ন বিদেশিদেরই তো ডিটেনশান ক্যাম্পে ভরা হয়।সেটাই তো সঙ্গত। অবশ্য বিষয়টা যদি যুক্তি ও মানবিকতার দিক দিয়ে ভাবা যায়।ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় যুক্তি ও মানবিক দিকটিও জড়িত থাকে বলে জানি।

তবে,পরিশেষে, এটা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে, পেছনে প্রাচীন কাল থেকে হয়ে হয়ে আসা বিদ্বেষ আর অসহিষ্ণুতার চাপ থাকলেও এঁরা মূলত কূট রাজনীতিরই বলি হচ্ছেন বা হবেন । এখন দেখছি রা তোলা হচ্ছেসারা দেশে এন-আর-সি করার। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠীর অনুগামী কয়েকটি রাজ্য (উত্তর ও পশ্চিম ভারতে) সমর্থন জানিয়েছে এন-আর-সির। কী আর করা, উন্নয়ন আর পরিমার্জনের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলেও পরিণামে বহুলাংশেই ব্যর্থতা।সুতরাং এ-ক্ষেত্রে ভারতীয় জনগণের চোখ আর মগজ তো অন্য দিকে ঘোরাতেই হয়।তাই ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে কাশ্মীর নিয়ে হুল্লোড়। ক্যাব(নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল) নিয়েও চলছে তোড়জোড়। এখন চলছেসারা দেশে এন-আর-সি চালু করার হুমকি। হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা অনৈক্যের ভেতর ঐক্যের যে আদর্শের ভিত, রবীন্দ্রনাথের ‘মহামানবে’র ভিত, তাতে চলছে ফাটলধরাবার প্রাণান্তকর চেষ্টা। আর, আরও ডিটেনশান ক্যাম্প তৈরিরপ্রস্তাব দিলে তো সোনায় সোহাগা।তার ওপর তো রয়েছে মাননীয় প্রধান মন্ত্রী মোদিজির ক্রমশ বেড়ে যাওয়া মোহনীয় বাকচাতুর্যের প্রতাপ।হ্যাঁ,সবই কিন্তু আগামী নির্বাচনগুলোর প্রতি লক্ষ্য রেখে, খুব সন্তর্পণে, পথ প্রশস্থ করে রাখার কুটিল ধান্দা।সহজ সরল মানুষগুলোর দৈনন্দিন যাপন ভরে উঠুক সন্ত্রস্ততায় আর অজানা আশংকায় ,বলি হোক তাঁরা অসহিষ্ণুতা আর বিদ্বেষের, আত্মহত্যা করুক, তাতে কার কি এসে যায়।আর উত্তরপূর্বের অন্যান্য রাজ্যগুলো (ত্রিপুরা ছাড়া) যে অসমের পোঁ ধরবে সেটা তো জানা কথা।তবে এটা ঠিক, যে-দেশের আকাশে-বাতাসে অসহিষ্ণুতা আর বিদ্বেষের বিষবাষ্প যত বেশি ছড়ায় সে দেশের অধঃপতন তত বেশি ত্বরান্বিত হয়। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে একটি শ্লোগান আজ বড় বেশি করে প্রচারিত হচ্ছে, Hate Never Made Any Nation Great. তো , এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকাই ভালো।

...........................................................................