বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ১৮, ২০২৪

তিমির তীর্থ,ভাগ -৬

বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেবল দিবাস্বপ্ন দেখে থাকলেই বা নিজের সঙ্গে নিভৃত আলাপ করে থাকলে প্রহ্লাদের পেটের ভাত জোটে না।বিকেল হতেই তাকে কাজে বেরিয়ে যেতে হল।জগন্নাথ চৌধুরী আরও দুদিন পরে আসবে।কোনও একটা সিদ্ধান্ত নেবার জন্য তার হাতে এখনও অনেক সময় আছে।তার উপর তার ভাগ্য ভালো যে ললিতা কালকের প্রসঙ্গ এখনও উত্থাপন করে নি।বেচারি মনে হয় কথাটা ভুলেই গেছে।

অফিসে সম্পাদক বললেন,“ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের আগামী বছরের অধিবেশন গুয়াহাটিতে বসার কথা আছে। অভ্যর্থনা সমিতির সম্পাদক ড০অরুণ চৌধুরী আমাকে অল্প আগে ফোনে বললেন,সে সম্পর্কে বুঝি কি একটা খবর দেবার আছে কালকের কাগজে না গেলেই নয়।আমি আপনাকে তাঁর ওখানে পাঠিয়ে দেব কথা দিয়েছি।যান তো,চট করে ওঁর ওখান থেকে গিয়ে আসুন।

ড০চৌধুরী গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক।জালুকবাড়ি থাকেন।বিকেল চারটা নাগাদ প্রহ্লাদ গিয়ে ওর ঘরে পৌঁছল।তাকে বসতে দিয়ে ড০চৌধুরীর স্ত্রী বললেন,“আপনাকে অল্প বসতে হবে।উনি পুজোয় বসেছেন।”

“পুজোয় বসেছেন?” প্রহ্লাদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “এ বিকেল বেলা পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ল্যাবরেটরিতে না থেকে পুজোয় বসেছেন?”

ড০চৌধুরীর স্ত্রী অপ্রসন্ন হয়ে মুখে বললেন,“পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হলেও তিনি মানুষ,জানোয়ার তো নন।পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হলেন বলেই কি জীবন থেকে গুরু গোস্বামীদের বাদ দিতে হবে?আপনাকে ঘণ্টা খানিক বসতে হবে।না হলে ঘুরে ফিরে ঘণ্টা খানিক পরে আসতে পারেন।”

প্রহ্লাদের যাবার জায়গা ছিল না।সে বসে রইল।বসে বসে আধা ঘণ্টা খানিক পরে তার বেজার লেগে গেল।এক ঘণ্টা পরে যখন তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটার উপক্রম হয়েছিল,ঠিক সেই সময় ড০অরুণ চৌধুরী বেরিয়ে এলেন।তাঁর পরনে একটা ধুতি, খালি পা,খালি গায়ে একটা চাদর,আর কপালে ছাইয়ের এক মস্ত ফোঁটা।প্রশান্ত সহাস্য মুখে তিনি বললেন,“ক্ষমা করবেন, আপনাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম। আমি এসময় রোজই ‘বাবা’র পূজাতে বসি।”

প্রহ্লাদ কোনও কিছুই না জানার ভান করে বলল, “কোন বাবা?” ড০চৌধুরী চোখ দুটো মুদে বিড়বিড় করে কোনও এক নাম স্মরণ করলেন।তারপর বললেন,“গেল বছর হায়দ্রাবাদে বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশন বসেছিল।সেখানে গিয়েই ঘটনাচক্রে বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল।ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের সৌজন্যে।ভগবানের অপার করুণা প্রহ্লাদবাবু, সেই সাক্ষাৎ আমার জীবনের গতি একেবারে পালটে দিল।আজ আমি অন্তরে যে শান্তি অনুভব করছি তাকে আমি ভাষায় বোঝাতে পারি না।আপনাকে বলি,পারলে আপনিও একবার গিয়ে বাবার আশীর্বাদ নিয়ে আসবেন। জীবনে যে শান্তি পাবেন—এর কোনও তুলনা নেই।

প্রহ্লাদ বলল,“ড০চৌধুরী আপনি শান্তি পেয়েছেন শুনে ভালো লেগেছে।আমার যদি জীবনে কখনও শান্তির প্রয়োজন পড়ে তখন আপনার উপদেশ স্মরণ করব।কিন্তু আপাতত বাবার সম্বন্ধে আপনাকে দুটো প্রশ্ন করি,অবশ্য আমার কৌতূহলটা নেহাতই সাংবাদিক সুলভ।মূলত কী কী কারণে বাবা আপনাকে আকর্ষণ করলেন?তাঁর চরিত্র মাহাত্ম্য,ব্যক্তিত্ব,ধর্মজ্ঞান না আর কিছু?”

ড০চৌধুরী ভাবলেন প্রহ্লাদ বোধ হয় ‘বাবা’র প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করেছে।‘বাবা’র জন্য আরেকজন ভক্ত সংগ্রহ করতে পারার সম্ভাবনা দেখে তিনি হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন।পরম উৎসাহে বলতে শুরু করলেন,‘চরিত্র মাহাত্ম্য বা ব্যক্তিত্বটা নিশ্চয়ই আছে।কিন্তু আরও হাজারজন মানুষেরও সেটা থাকতে পারে।কিন্তু বাবার প্রধান আকর্ষণ এটাই যে ‘ভগবানে’র পূর্ণ অবতার।আজকের এ চরম সংশয়বাদ আর অবিশ্বাসের যুগে শুধু চরিত্র মাহাত্ম্যে মানুষকে ঈশ্বরের পথে আকর্ষণ করা যায় না। পৃথিবীর থেকে দিব্য শক্তি এখনও সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয় নি,এক একজন অবতারী পুরুষের মধ্যে তার পূর্ণ প্রকাশ ঘটে---মানুষকে সে কথা প্রমাণ করে দেখাতে হবে।এমনকি যিশুখ্রিস্টও মানুষকে ঈশ্বরের পথে টানতে মিরাকলের আশ্রয় নিয়েছিলেন।বাবার মধ্যে আমি সেই দিব্য-শক্তির পূর্ণ প্রকাশ দেখলাম।শূন্যে হাত মেলে তিনি যখন বিভূতি সৃষ্টি করে দেখালেন।আমরা সবাই তাকিয়ে থাকতে থাকতেই যখন বাবার উপর পুষ্পবৃষ্টি হল।শূন্য থেকেই দশটা হাতঘড়ি বের করে উপহার দিলেন।তখন এমন কোনও নরাধম থাকতে পারে কি---যার মাথা এ সাক্ষাৎ মানব দেবতার চরণে আভূমি নত না হবে?আমার মনের সমস্ত সন্দেহ আর অবিশ্বাস মুহূর্তে মিলিয়ে গেল,ঠিক যেমন করে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাতের অন্ধকার মিলিয়ে যায়।ঈশ্বরহীন হৃদয় মরুভূমির বাইরে আর কিছু নয় প্রহ্লাদবাবু।আপনি যদি ঈশ্বরকে পেতে চান,তবে অবিশ্বাসী আর সংশয়বাদী এই বিশ শতকেও মিরাকল খুঁজে পেতে চান তবে একদিনও দেরি না করে একবার বাবার দর্শন করে আসুন গে। আমার কথার হাতে হাতে প্রমাণ পাবেন।”

প্রহ্লাদ মুহূর্ত খানিক নীরব রইল।ড০চৌধুরী ভাবলেন,তাঁর কথাগুলো ইতিমধ্যে প্রহ্লাদের উপর মন্ত্রশক্তির মতো কাজ করতে আরম্ভ করেছে।অসমে বাবার ভক্তের সংখ্যা আরেকজন নিশ্চয়ই বাড়ল।প্রহ্লাদ হঠাৎ বলে উঠল,“ড০চৌধুরী আমিও মিরাকলে বিশ্বাস করি।আমি নিজের চোখে মিরাকল দেখেছি।আর সে মিরাকল যে মানুষ করেছে আমি তাঁকে সহস্রবার প্রণাম করি।”

ড০চৌধুরী উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন,“আমি আপনাকে দেখেই বুঝেছি প্রহ্লাদবাবু,আপনি নিশ্চয়ই একজন আধ্যাত্মবাদী ভক্তি পরায়ণ মানুষ।আপনি সাধারণ মানুষ নন।বলুন তো বলুন,আপনার গুরু কে? কী কী মিরাকল আপনি দেখেছেন? এসব কথা শোনাও পুণ্যের কাজ।”

“আপনি ঠিকই বলেছেন ড০চৌধুরী।” প্রহ্লাদ শান্তভাবে বলল,“আমি অজস্র মিরাকল দেখেছি আর শুনেছি। আমরা যে দুজন মিরাকলের কথা বলে বলে এখন বসে আছি ঠিক এখন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশযান জুপিটার কোটি কোটি মেইল অতিক্রম করে বৃহস্পতির আকাশমার্গে গিয়ে প্রবেশ করছে।আর কবছরের মধ্যে সে সৌরজগৎ পার করে মহাকাশে যাত্রা করবে। আমাদের পৃথিবী এক বিশ্বের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গ্রহ; এই গ্রহের পিঠে বসে অণু পরিমাণ এই মানুষ নামের জীবটা কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের মহাকাশের স্বরূপ সন্ধান করছে---এর চে’ বড় মিরাকল কিছু আছে কি?ঠিক এই মুহূর্তে পৃথিবীর শ’ শ’ গবেষণাগারে জেনেটিক্স বা প্রজনন-তত্ত্বের বিষয়ে এমন কতকগুলো অবিশ্বাস্য গবেষণা হচ্ছে যার ফলে মানুষ প্রাণ সৃষ্টির প্রক্রিয়াতেও হস্তক্ষেপ করতে পারবে আর নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী নতুন নতুন জীব সৃষ্টি করতে পারবে। এর চেয়ে বড় মিরাকল কী আছে? পৃথিবীর শত শত গবেষণাগারে কৃষি বিজ্ঞানীরা আজ অধিক ফসল দিতে পারা বিচিত্র শস্যের বীজ উদ্ভাবন করছেন। যা না করলে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ ইতিমধ্যে দুর্ভিক্ষের মুখে পড়ত।হাজার হাজার বছর ধরে কত সব কালান্তক বীজাণুর হাতে মানুষ পরাজিত হয়ে আসছিল আর রোগ যন্ত্রণার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করে আসছিল। কোনও বাবার মন্ত্রের প্রভাবে সেসব রোগ এক এক করে পৃথিবী থেকে বিদেয় নেয় নি।মানুষের পরম শত্রু সে সব রোগ পরাজিত হয়েছে বিজ্ঞানীর গবেষণাগারে। এর চে’ বড় মিরাকল আর কিছু আছে কি?”

ড০চৌধুরীর মুখের প্রশান্তি হঠাৎ অন্তর্হিত হল।তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,“আপনার লেকচার ছাড়ুন প্রহ্লাদবাবু! কী বলতে চাইছেন,তাই বলুন।”

প্রহ্লাদ শান্তভাবে বলল,“ড০চৌধুরী আমি এটাই বলতে চাইছি যে আপনি দেখার চে’ বড় মিরাকল আমি দেখেছি। আর যে মানুষ এই মিরাকলটা সম্ভব করে তুলেছে,আমি তাকে হাজার বার প্রণাম করি। নবজাগরণের উজ্জ্বল প্রভাতে ইউরোপ এই মানুষকে আবিষ্কার করেছিল :What a piece of work is a man! How noble in reason! How infinite in faculty! In form, in moving, how express and admirable! In action, how like an angle! In apprehension, how like a god! The beauty of the world! The paragon of animals!” ত্রিশ হাজার বছর ধরে দেবতার সাহায্যে মানুষ যে কাজ করতে পারে নি,নিজের প্রকৃত মহত্ব আবিষ্কারের মাত্র তিনশ বছরের মধ্যে ইউরোপের লোক তারচেয়ে হাজারগুণ বেশি অসাধ্য সাধন করেছে।আজ মহাকাশের বুকে অনন্তের প্রান্তসীমাতে সে মানুষ দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছে : I am God! আর আপনি? যে মন্ত্রের বলে মানুষ একটা একটা করে প্রকৃতির সমস্ত রহস্য উন্মোচিত করে দেবতার মতো শক্তির অধিকারী হল সেই মন্ত্রই আপনাকে বিন্দু মাত্র বিস্মিত আর আকৃষ্ট করে না। সে মন্ত্রের সাধনায় জন্য আপনি মোটেও অনুপ্রাণিত বোধ করেন না। আপনি ল্যাবরেটরিতে বসে বসে গবেষণা করার বদলে ঘরে বসে জপ করছেন কিনা কেবলই ‘বাবা’র নাম। আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার জন্য প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বের ভার পড়েছে আপনার মতো মানুষের হাতে। দেশের জন্য এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের কথা আর কিছু হতে পারে কি?”

প্রহ্লাদ যাবার জন্য তৈরি হল।

ড০চৌধুরী রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,“আপনার ভাগ্য ভালো যে আজ আপনি আমার ঘরে অতিথি।না হলে আমি আপনার মদগর্বী কথার উপযুক্ত প্রত্যুত্তর দিতাম।আপনার মতো ব্লেকমেইলার জার্নালিস্ট অনেক দেখেছি।নিজে যে সব কথা বুঝেন না সেসব কথায় এরকম নাক গলাতে গেলে কখনও কিন্তু কোথাও আপনাকে অপমানিত হতে হবে।আপনার বিষয়ে লোকে কী ভাবে আপনি মনে হয় সেইসব কথা জানেন না।জানলে এরকম সাধুতা আর পাণ্ডিত্য জাহির করে ফিরতেন না।”

প্রহ্লাদ নম্র ভাবেই জিজ্ঞেস করল,“আমার সম্বন্ধে লোকে কী ভাবছে অনুগ্রহ করে বলবেন কি?”

ড০চৌধুরী বললেন,“নিশ্চয়ই বলে দেব।গুহায়াটিতে শুধু আপনারটাই খবরের কাগজ নয় বুঝলেন?বাকি খবরের কাগজ আপনার সম্পর্কে কী লেখে দেখেন নি?আপনি একজন টাইম সার্ভার আর ব্লেকমেইলার।এক সময়ে আপনি ছিলেন একজন মার্ক্সিস্ট বিপ্লবী।সেই মানুষটা এখন হল গিয়ে এক বুর্জুয়া কাগজের সাংবাদিক।খবরের কাগজে আপনি সারা রাজ্যের লোককে চোর বলে বেড়ান।কিন্তু তলায় তলায় কী করছেন?ব্লেকমেল করে টাকা যোগাড় করছেন।সরকার থেকে চুপি চুপি নানা অনুগ্রহ বাগাচ্ছেন। কিন্তু মানুষের চোখে আর কতদিন আপনি এভাবে ধূলি দেবেন? যান! যান! আর বেশি দিন নেই। আপনার আসল স্বরূপ সমানে বেরিয়ে যাবে।”

বজ্রাহত মানুষের মতো প্রহ্লাদ খানিকক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেল।তারপর প্রকৃতিস্থ হয়ে সে হাসি একটা ফুটিয়ে তুলে বলল,“নমস্কার ড০চৌধুরী আপনার অনেক সময় নষ্ট করল।এখন বিদায় নিই।” যে উদ্দেশ্যে সে ড০চৌধুরীর কাছে এসেছিল তা একেবারেই ভুলে গেল।

টাইম সার্ভার! ব্ল্যাকমেইলার! প্রহ্লাদের মনের মধ্যে ড০চৌধুরীর সেই নিষ্ঠুর শব্দ ক’টি বার বার প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করল।মানুষের ঈর্ষা এবং ঘৃণার সঙ্গে সে ভালোই পরিচিত। গুয়াহাটি তথা অসমের পুরো বৌদ্ধিক পরিবেশটাই নানা কারণে এমনভাবে দূষিত হয়ে গেছে যে এখানে মানুষ প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ঈর্ষার বিষবাস্প সেবন করতে হয়।এর কারণও সে জানে না নয়।সমাজের মঙ্গলের জন্য চিন্তা করা অনেক শিক্ষিত আর চিন্তাশীল মানুষ এখন অসমেও অনেক বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু তারা কাজ করবার পথ খুঁজে পাচ্ছে না।তরঙ্গ মুখর কর্ম প্রবাহে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারলে তাদের মানসিক শক্তি আর প্রতিভা সমাজে যে কৃষ্টি-শীল বিপ্লবের সৃষ্টি করতে পারত তাই করার সুযোগ না পেয়ে তারা এখন সে শক্তিকে প্রয়োগ করছে পারস্পরিক চরিত্রহননের ধ্বংসলীলায়।এজন সেজনকে কল্পনা করেসামাজিক প্রগতির প্রতিবন্ধক বা শত্রু রূপে।গার্হাট হপটমান ঠিক এরকম চরিত্রগুলোকে নিয়েই রচনা করেছিলেন তাঁর ‘নির্জন জীবন’ নামের বিখ্যাত নাটক। সে সময়ের জার্মানিতে তিনি যেসব আদর্শবাদী অথচ স্পর্শকাতর আর দুর্বল চরিত্রের তরুণদের দেখা পেয়েছিলেন,এক করুণ বিচ্ছিন্নতাবোধ যে সব তরুণদের মনে এক গভীর আধ্যাত্মিক শূন্যতার সৃষ্টি করে তাদের নিঃসঙ্গ করে তুলেছিল অসমেও আজ তেমনি একদল আদর্শবাদী অথচ কর্ম বিমুখ তরুণের সৃষ্টি হয়েছে।তারা এজন সেজনকে পীড়ন করে খুব সম্ভব এই আত্মপ্রসাদ লাভ করছে যে তারা সমাজের শত্রু নিপাত করছে।মানুষের প্রগতির পথ সুগম করছে। ভলতেয়ার লিখেছিলেন,“ ঈশ্বর যদি নেই তবে মানুষের তাঁকে আবিষ্কার করে নিতে হবে।”এসব লোকেও বোধহয় ভাবে যে কারও বিরুদ্ধে যদি বদনাম রটাবার কোনও কারণ নেই তবে প্রয়োজনে তেমন এক কারণ আবিষ্কার করে নিতে হবে।প্রহ্লাদ সেসব কথা বোঝে না,সে জন্য সে কারও বিরুদ্ধে নিন্দা বা ঈর্ষায় বিচলিত হয় না।তবু সেও রক্ত মাংসের এক দুর্বল মানুষ।কখনও মানুষের নিন্দা বা ঈর্ষার বিষক্রিয়া এত তীব্র হয় যে সে দস্তুর মতো ভীষণ যন্ত্রণা অনুভব করে। এক প্রচণ্ড নিঃসঙ্গতা বোধ তাকে দুর্বল করে তুলে।

আজও তার এমনি এক অবস্থা হল।ড০চৌধুরীর কথাটাই তাকে শেলের মতো বিঁধতে থাকল।নিজের মানসিক যন্ত্রণার কারণ বিশ্লেষণ করে সে হঠাৎ একবার অনুভব করল যে তার মনেও হয়তো এক গোপন অপরাধ বোধ আছে।সে সত্যিই কি একদিক থেকে বলতে গেলে ‘টাইম সার্ভার’ই নয়?যৌবনের শুরুতে যে পতিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সে বিদ্রোহ করার সংকল্প নিয়েছিল,সমাজকে ভেঙে গুড়িয়ে সে এক নতুন সমাজ সৃষ্টি করার স্বপ্নে দেখেছিল,আজ জীবিকার তাড়নাতে সে বুঝি সেই সমাজ ব্যবস্থারই ক্রিতদাস হয়ে কাজ করে নি?আদর্শের জন্য সে বুঝি নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করতে পেরেছে?পারে নি।বরং একটু একটু করে সে শত্রুর সঙ্গে আপোস করেছে আর নিজের প্রতিটি স্খলনকে সে র‍্যাশনেলাইজ করার চেষ্টা করছে।নির্মল বিবেকের বর্মে সে নিজেকে সম্পূর্ণ আবৃত করতে পারে নি।ফলে তার অনাবৃত দুর্বল স্থানে এসে লেগেছে নিন্দুক আর সমালোচকের বিষাক্ত তীর।তার কলজে চিরে ফোয়ারার মতো রক্ত বেরোচ্ছে।প্রতি মুহূর্তে নীরব যন্ত্রণায় সে কাৎরাচ্ছে।কোনও নিন্দুক তার প্রকৃত শাস্তিদাতা নয়।তার যন্ত্রণার কারণ হল নিজের অপরাধী বিবেক।নিন্দুকের বিরুদ্ধে তার কোনও অভিযোগ নেই।তার মনে শুধু একটাই দুঃখ যে যে সব লোক তাকে সমালোচনার বিষবাণে ক্ষতবিক্ষত করছে,সেসব লোকেরও তাকে সমালোচনা করবার কোনও নৈতিক নেই।জীবিকার জন্য যেমন সে এই সমাজব্যবস্থার দাসত্ব করছে তারাও ঠিক তাই করছে। অথচ নিতান্ত মামুলি কারণে তারাও তাকে সমালোচনা করবার সুযোগ পেয়েছে যে সুযোগের থেকে সে বঞ্চিত।বেরিয়ে আসুক সেই সমালোচক বিবেক যার নির্মল।যে সর্বত্যাগী।বিপ্লবের দুর্গম পথে পথ চলতে পা দুটো রক্তাক্ত আর ক্ষতবিক্ষত।তার অভিশাপ বাণী সে আশীর্বাদ বলে মাথা পেতে নেবে।

পানবাজারে বাসের থেকে নেমে প্রহ্লাদ ঘরে না গিয়ে প্রভাত বরুআর ঘরের দিকে পা বাড়াল।প্রভাত আরেকটা কাগজের সাংবাদিক।প্রহ্লাদের একমাত্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু।প্রহ্লাদ আজ অনেকদিন তার দেখা পায় নি।প্রভাতপ্রহ্লাদকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,“কীরে প্রহ্লাদ!আজ দেখছি অমানিশায় চাঁদ উঠল।খবর কী?”

“খবর এটাই যে আমি এখন ব্ল্যাক মেইলার।” প্রহ্লাদ চেয়ার একটাতে ধপাস করে বসে বলল।

চেয়ারে বসতেই টেবিলে রাখা বইটার দিকে চোখ পড়ল।কভারে অত্যন্ত কামোদ্দীপক ভঙ্গির এক নগ্নিকার ছবি। ইংরাজি পর্ণগ্রাফি Sensuous Women । প্রভাত লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি বইটা সেলফে রেখে বলল,“তুমি এমন অতর্কিতে এসে পড়লে যে বইটা লুকোবার সময়ই পেলাম না।মিথ্যে বলে লাভ কী ভাই,আমি এই সব বই পড়ে বেশ আনন্দ পাই।”

“লুকোতে হবে কেন?” প্রহ্লাদ সহজে মুখে হাসি একটা এনে বলল,“আমি কি তোমার কথা জানি না নিকি?তুমি বাইরে মরুভূমি ভেতরে রসের ফল্গুধারা।তা তুমি এই বয়সেও অবিবাহিত মানুষ।এই সব বই পড়ে থাক।বেশ তো।কিন্তু তুমি অন্তত এই বাহাদুরি করতে পারবে না যে অসমে পর্ণগ্রাফির বিগেস্ট কালেকশনটা তোমারই আছে।”

“কার আছে?” প্রভাত মিকচার সিগারেট একটা পাকাতে শুরু করে প্রশ্ন করল।

“ড০ অরবিন্দ বরুআর।”নামটা উচ্চারণ করেই প্রভাতের মুখে ফুটে উঠা প্রতিক্রিয়া উপভোগ করে প্রহ্লাদ একটা মুচকি হাসি হেসে নীরব হয়ে রইল।

প্রভাত অবিশ্বাসের সুরে বলল,“কী বলছ?সেই ষাট বছরের বৃদ্ধ আমাদের সবার ‘স্যর’! রাতের গভীর নিদ্রাতে যে মানুষটি শিলালিপি,তাম্রলিপি আর প্রাচীন মুদ্রার বাইরে কিছু স্বপ্ন দেখেন না,যে মানুষটাকে... যে মানুষটাকে আমরা আদর্শ নৈতিক চরিত্রের জীবন্ত প্রতিমূর্তি বলে ভাবি!”প্রভাতের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে প্রহ্লাদ বলল,“ প্রাচীন গ্রিসে ইস্কাইলাসের নাটক অভিনীত হবার সময় নৈতিক সততার গুণ ব্যাখ্যা করে কোনও অভিনেতা কোনও একটা সংলাপ বললেই যেমন দর্শকের চোখ আপনা আপনি দর্শক আসনে বসা এরিস্টাইডিসের মুখের দিকে গেছিল ঠিক তেমনি আদর্শের প্রসঙ্গ উঠলেই প্রথমে যে মানুষটির কথা আমাদের মনে আসে...”

“সেই ড০অরবিন্দ বরুআ এ বয়সে পর্ণগ্রাফি পড়েন? আমি বিশ্বাস করি না।”

“এমন কি বড় কথা হল?” নাটকীয় ভঙ্গি ছেলে প্রহ্লাদ বলল,“এই সহজ কথাটা তুমি কেন মেনে না নাও যে প্রতিটা মানুষই একই সময়ে দুটো আলাদা জগতে বাস করে?একটা বাইরের—যেখানে মানুষ সমাজের একজন হয়ে বাস করে; যেখানে তার প্রতিটা কাজ;প্রতিটা গতিবিধির উপর সহস্র মানুষের দৃষ্টির আলো পড়ে।যেখানে সে প্রতি পায়ে সমাজের অনুমোদন আর প্রশংসা চায়; যেখানে সে প্রতি মুহূর্তে আত্ম সচেতন আর ইতিহাস চেতন;যেখানে তার জীবন অন্য আরও অনেক জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে গাঁথা।আর অন্যটি হল তার অন্তরের জগৎ।প্রাইভেট ওয়ার্ল্ড বা অধিক শুদ্ধ করে বললে তার প্রাইভেট হেল।যেখানে তিনি ভয়ঙ্কর ভাবে নিঃসঙ্গ,দায়মুক্ত আর স্বাধীন।যেখানে নিষিদ্ধ্বতম ভাব-চিন্তা আর কামনাবাসনাগুলোও অরণ্যের হিংস্র পশুর মতো অবাধে বিচরণ করে।শেকল ছেড়ে মুক্ত হওয়া,মানুষকে কামড়াতে চাওটা কুকুরের মতো যেখানে মানুষের মনের অন্ধকার প্রবৃত্তিগুলো মুক্ত হয়ে বাইরে বেরোতে প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধ করে থাকে আর তাদের বেঁধে রাখার চেষ্টা করতেই মানুষের জীবনের বেশির ভাগ সময় যায়...।”

অবাক বিস্ময়ে প্রভাত কিছুক্ষণ প্রহ্লাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অন্যমনস্কভাবে সিগারেটে ঘন ঘন দু-বার টান দিয়ে শেষে বলল,“প্রহ্লাদ আজ নিশ্চয় কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে।কিন্তু আমি ধরতে পারি নি—সে গণ্ডগোলটা তোমার না আমার।”

“তার মানে?” প্রহ্লাদ একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।“দাঁড়াও! দাঁড়াও!আমাকে পুরো কথাটা ভালো করে বুঝতে দাও।”প্রভাত হতবুদ্ধি হওয়া মানুষের মত বলতে শুরু করল,“তুমি এসেই প্রথমে ঘোষণা করলে যে তুমি একটা ব্ল্যাক মেইলার। সে কথাটা ভালো করে যাচাই করবার আগেই তোমার চোখে পড়ল আমার Sensuous Woman-এর উপর। তারপর তুমি যে লেকচার আরম্ভ করলে--- একসঙ্গে তোমার মুখে এতগুলো কথা শোনা আমার পুরো জীবনে মনে পড়ে না। বলতে পারব না কেন,তোমাকে আজ বড় প্রকৃতিস্থ লাগছে না।নিশ্চয়ই আজ তোমার কোনও একটা কিছু হয়েছে।বল,প্রহ্লাদ কী হয়েছে আমাকে খুলে বল।আজ নিশ্চয়ই তোমার কিছু একটা বড় কিছু হয়েছে।”

প্রহ্লাদ প্রভাতকে উদগ্রীব করে রেখে কিছু সময় নীরব হয়ে রইল।এক মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্বের ছায়া তার মুখটাকে গম্ভীর করে তুলল।কিছু সময় পর খুবই ক্লান্ত স্বরে সে বলতে শুরু করল,“প্রভাত,আজ বাড়ি গিয়ে আমি ভাত খেতে পাব কি না তার ঠিক নেই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় ললিতা চাল কেনার টাকার কথা বলেছিল। আমি না শোনার ভান করে চলে এলাম। সুতরাং ঘরে ফিরে যদি ভাত খেতে পাই তবে নির্ঘাৎ বুঝতে হবে যে হয় ললিতা বিপদে আপদে লাগতে পারে বলে জমিয়ে রাখা শেষ কপর্দকটা পর্যন্ত ব্যয় করেছে।অথবা লাজ লজ্জা ছেড়ে কাছের মজিদ উকিলের বাড়ি গিয়ে তাঁর থেকে ধার এনেছে গিয়ে। এই যার বাড়ির দশা সেই মানুষটা ইউনিভার্সিটির বিদগ্ধ পণ্ডিত ড০ চৌধুরীর ঘরে গিয়েছিলাম। গিয়ে তাঁর মুখে কী শুনে এলাম জান?আমি বুঝি একটা ব্ল্যাকমেইলার।অর্থাৎ ক্ষমতাশালী মানুষের বিষয়ে গোপন ক্ষতিকর খবর সংগ্রহ করে সেগুলো প্রকাশ করে ভয় দেখিয়ে তাঁদের থেকে টাকা সংগ্রহ করে থাকি।ড০ অরবিন্দ বরুআ আর Sensuous Woman -এর মধ্যে কি তুমি কোনো সংযোগ খুঁজে পেলে প্রহ্লাদ?

প্রভাত হতবুদ্ধি হয়ে শুধু মাথাটা নাড়ল। অর্থাৎ সে প্রহ্লাদের কথার মাথামুণ্ডু কিছু ধরতে পারে নি।

“অতি সহজ।” প্রহ্লাদ বলতে শুরু করল,“অসমের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবিত ঐতিহাসিক ড০ অরবিন্দ বরুআর সামনে কথা বলতে গিয়ে আমরা এক মুহূর্তের জন্যও কি কল্পনা করতে পারি যে অসমের বিগত ত্রিশটা শতাব্দীর স্মৃতি রোমন্থনের বাইরে এই ষাট বছরের প্রশান্ত মানুষটার মনে আর কোনও চিন্তা ঠাঁই পেতে পারে?কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সে তাঁর অবসর বিনোদনের একমাত্র পন্থা হল পর্ণগ্রাফি পড়া।নিশ্চয়ই তাঁর মনে এমন এক অনিবার্য তাগিদ আছে,তাড়না আছে—যার জন্য তাঁকে এই বৃদ্ধ বয়সেও পর্ণগ্রাফি পড়ে vicarious pleasure আদায় করতে হয়।অর্থাৎ মানুষ একজনকে বাইরে থেকে দেখেই তাঁকে যা বলে ভাবি,তিনি আসলে তাই নন।সম্পূর্ণ মানুষটাকে আমরা কখনও জানতে পারি না।আজকাল ইউরোপ আমেরিকাতে জীবনী রচনার এক নতুন পদ্ধতি বেরিয়েছে—যাকে বলা হয় Psychohistory।আমরা যদি ড০ অরবিন্দ বরুআর Psychohistory রচনা করতে পারতাম তবে হয়তো এই বৃদ্ধ বয়সেও তাঁর পর্ণগ্রাফিপ্রীতির আসল ব্যাখ্যা খুঁজে পেতাম।যাই হোক,আমি যে কথাটা তোমাকে বলতে চাইছিলাম,তার থেকে সরে এলাম।আমি তোমাকে বলতে চাইছিলাম,ড০ অরবিন্দ বরুআর পাবলিক ইমেজের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা আর একটা রূপ যেমন কোনও মানুষ কখনও দেখেনি,ঠিক তেমনি তোমার বন্ধু এই প্রহ্লাদ হাজরিকার আর একটা রূপও অন্যের কথা বাদ দাও---তুমি নিজেও কোনও দিন দেখ নি।”


ক্রমশ...