শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

তিমির তীর্থ,ভাগ -৪

পর্বতের এক দুর্গম অদৃশ্য উৎসের থেকে একদিন বেরিয়ে এসেছিল এক খরস্রোতা ঝরনা।তার স্রোতের বুকে খসে পড়ছিল এক অখ্যাত পার্বতী শিলা।পথে সে ঝরনা তার মতো করে আরও কত ঝরনার সঙ্গ পেল।আর সব ক’টা মিলে মিশে এক বিশাল নদীর রূপ নিয়ে বিস্তীর্ণ সমভূমি হয়ে সাগর অভিমুখে এগিয়ে গেল। সেই খসে পড়া পাথর টুকরোও সঙ্গে সঙ্গে এগুলো। সে আরও কত পাথরের সঙ্গ পেল।কিন্তু এ ওর গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে অবশেষে সে ক্ষীণকায় মিহি বালু-দানাতে পালটে গেল । সে এমনই পালটাল যে আদিরূপটা কল্পনা করাও দুষ্কর হল।

নিজের বর্তমান অবস্থা কল্পনা করে প্রহ্লাদের প্রায়ই এমনই এক উপমা মনে পড়ে। আজ থেকে পনেরো বিশ বছর আগে সে কী ছিল,আর আজ কী রূপ নিয়েছে? আজ থেকে বিশ বছর আগে যৌবনের গরীয়ান সূর্যোদয়ের শত-ক্লান্ত বর্ণচ্ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে সে নিজেকে অনুভব করেছিল একজন দেবতা বলে--- যে সে স্থূলবুদ্ধি ভোগ-সর্বস্ব আর স্বার্থপর সাধারণ দেবতা নয়। সে ছিল প্রমিথিউস! সেই দুর্বিনীত দেবতা---মানুষের দুঃখে যে দেবতার প্রাণ কেঁদে উঠেছিল,মানুষকে মুক্তি দেবার জন্যে যে দেবতা দেবরাজের অন্তহীন ভয়ঙ্কর রুদ্ররোষ বরণ করে নিয়েছিল।সেদিন তার এমন এক অভ্রংলেহি অহংকার ছিল যে সারা পৃথিবীকে শুনিয়ে সে চিৎকার করে বলতে পারত,‘In simple truth, I harbars hate against all the Gods.’সে বলতে পারত,‘For your vile slavery, be assured, never would I change my unhappy lot.’

কিন্তু আজ?মাত্র বিশ বছরের ব্যবধান! ইতিহাসের বিচারে এক চোখের পলকও নয়।কিন্তু আজ মাত্র পনেরোশো টাকার চাকরি একটার জন্য,এক গ্রাস বেশি ভাত খাবার লোভে,আর স্ত্রী-সন্তানের হায়ে কাপড় একটুকরো বেশি দেবার জন্যে লালায় তার জিহ্বা ভরে আসছে।শক্তিমানের কাছে নতজানু হয়ে হাতজোড় করতে সে প্রস্তুত হচ্ছে।প্রমিথিউসের কি অবিশ্বাস্য রূপান্তর! কী দুঃসহ করুণ পরিণতি!

ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরাজি পাঠ্যপুথিতে পড়া কথা একটা প্রহ্লাদের প্রায়ই মনে পড়ে : Two men looked through the prison bars,one saw the mud and the other stars.জীবনের প্রতি মুহূর্তে এমন ঘটনা ঘটে থাকে।একই ব্যাপার,একই ঘটনার প্রতি মানসিক প্রকৃতি আর অবস্থা ভেদে নানা মানুষের মনে নানা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।

গ্রামের সমৃদ্ধ চাষি গুণাভিরাম হাজরিকার দুজন ছেলে ছিল।প্রদ্যুৎ আর প্রহ্লাদ।গুণাভিরাম হাজরিকার নিজের শিক্ষা দীক্ষা বেশি ছিল না;কিন্তু শিক্ষার প্রতি ছিল তাঁর প্রবল অনুরাগ।দুই ছেলেকেই উচ্চশিক্ষিত করে তোলাই ছিল তাঁর জীবনের লক্ষ্য।তাঁর ভাগ্য ভালো যে প্রদ্যুৎ আর প্রহ্লাদও বর্ণপরিচয়ের দিন থেকে পড়াশোনায় অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিল।সে জন্য ছেলে দুটোকে পড়াশোনায় সবরকম সুবিধা দিতে গুণাভিরাম কখনও কোনও কার্পণ্যকরেন নি।দুই ছেলের জন্যই ভালো গৃহশিক্ষক রেখে দিয়েছিলেন আর সে শিক্ষকের পরামর্শ অনুসারেই তাদের জন্য এক ছোট্ট লাইব্রেরিও করে দেন।

প্রদ্যুৎ তখন ক্লাস সেভেন আর প্রহ্লাদ সিক্সের ছাত্র।বাৎসরিক পরীক্ষা এক মাস থাকতে বাবা দুজনকে কাছে ডেকে বললেন,“তোরা দুজনেই ক্লাসে প্রথম হয়ে আসছিস।আর জানি যে এবারেও হবি।কিন্তু এবার যদি শতকরা আশির উপরে পেয়ে প্রথম হস,তবে আমি একটা করে পুরস্কার দেব।কী চাই তাই বল।”

প্রদ্যুৎ কিছু বলবার আগেই প্রহ্লাদ বলেছিল,“আমার বই চাই বাবা,আর কিছু চাই নে।কিন্তু যে বই আমি বলব,সেটি দিতে হবে।”

বাবার মুখে আনন্দ আর গর্বের হাসি ফুটে উঠল।প্রহ্লাদকে কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন।প্রদ্যুতের আর কিছু চাইবার ইচ্ছে ছিল যদিও ছোটো ভাইয়ের বাবার থেকে পাওয়া আদরের পরিমাণ দেখে বলল,“আমারও বই চাই।”

সেবার সেই পরীক্ষায় দুজনেই শতকরা নব্বুইর উপরে পেয়ে প্রথম হল।বাবা ডেকে বললেন,“তোদের কী কী বই চাই লিস্ট করে দে । ডাকে আনিয়ে নেব।”

দুজনেই ম্যাগাজিনের বইয়ের বিজ্ঞাপন দেখে তালিকা করতে বসে গেল।ওদের বাড়িতে ‘আবাহন’ পত্রিকাটা নিয়মিত আসত।প্রদ্যুৎ তাতে তার মনোমতো বইয়ের নাম পেল না। সে সময়কার নতুন প্রকাশিত ‘গোলাই সিরিজ’ নামের গোয়েন্দা কাহিনিগুলো ওর অতি প্রিয় ছিল।গ্রামের লাইব্রেরি থেকে সে বইগুলো এনে পড়েছিল।তারই একটার শেষ পৃষ্ঠাতে সিরিজের সব ক’টা বইয়ের নাম দেখে তালিকা একটা করে সে বাবাকে দিল।অর্ধ্বশিক্ষিত গুণাভিরামের কাছে বই মাত্রেই ছিল পবিত্র বস্তু। তিনি বিনা বাক্য ব্যয়ে প্রদ্যুতের তালিকা মঞ্জুর করলেন।

‘আবাহনে’র বইয়ের তালিকা দেখে প্রথম যে বই গ্রামের হাইস্কুলের ক্লাস সিক্সের ছাত্র প্রহ্লাদ নির্বাচন করল,সেটি হল কার্ল মার্ক্সের ‘কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র অসমিয়া অনুবাদ।অনুবাদ করেছিলেন কেদারনাথ গোস্বামী।তখনই কেন প্রহ্লাদ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পরে সে বহুবার ভেবে দেখেছে।তার অশিক্ষিত বাড়িটিতে বা প্রত্যন্ত গ্রামটিতে কার্ল মার্ক্সের নাম সে এর আগে কখনও শুনেনি।দেশ তখনও স্বাধীন হয় নি,গ্রামের লোকের মুখে মুখে ফিরছিল কেবল গান্ধি নেহরু আর সুভাষের নাম। আলোচনার বিষয় ছিল শুধু স্বাধীনতার আন্দোলন।এও ঠিক নয় যে সমাজে চলতে থাকা দারিদ্র্য-শোষণ আর অন্যায় অবিচার তার মনকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল আর সে সচেতনভাবে দরিদ্র জনতার মুক্তির কোনও এক পথের সন্ধান করে অবশেষে মার্ক্সকে আবিষ্কার করেছিল।সমৃদ্ধ ঘরে লালিত প্রহ্লাদের পক্ষে সমাজের অন্ধকার দিকটা জানার তখনও সুযোগ হয়নি।তবুও কম্যুনিস্ট ইস্তাহারের প্রতি প্রহ্লাদের আকৃষ্ট হবার সহজ কারণ এটিই ছিল যে বইটার বিজ্ঞাপনের ভাষাতে তার কল্পনা প্রবণ মনটাতে অবোঝ আবেগের এক স্পন্দন তুলেছিল।তখন যে আবেগ ছিল তার কাছে দুর্বোধ্য,আজ সে তার স্বরূপ ভালো বুঝতে পারে।কিছু মানুষের মনে আদর্শের প্রতি এক সহজাত অনুরাগ থাকে।সবার নিশ্চয়ই থাকে না।খুবই ছেলেবেলার থেকে প্রহ্লাদের মনে এক আদর্শের মোহ ছিল;বয়স বাড়ার সঙ্গে যোগ হল ত্যাগ আর দুঃখ বরণের প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ,বিদ্রোহ বা বিপ্লবের প্রতি এক রোম্যান্টিক অনুরাগ।নিজের মনটা ভালো করে বিশ্লেষণ করে সে পরে আরও একটা কথা বুঝে উঠেছিল যে তার মনে ছিল সমাজের সংখ্যালঘিষ্ঠের প্রতি এক স্বাভাবিক আকর্ষণ।অর্থাৎ বেশির ভাগ লোকে যেটি ভাবছে বা করছে তা না করে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সংখ্যালঘিষ্ঠ দলে যোগ দিয়ে নিজের বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করার উগ্র আকাঙ্ক্ষা। সে সময় দেশের স্বাধীনতার জন্য হওয়া বিয়াল্লিশের বিপ্লব তিন বছর আগে শেষ হয়েছিল।দেশে তখন চলছিল স্বাধীনতার জন্য আপোস আর আলাপ আলোচনার চেষ্টা।যে করেই হোক স্বাধীনতা লাভ অবশ্যম্ভাবী বলে লোকে ভাবতে আরম্ভ করেছিল।‘আবাহনে’র পৃষ্ঠায় ‘কম্যুনিস্ট ইস্তাহারে’র বিজ্ঞাপন পড়ে প্রহ্লাদ অনুভব করল ঠিক এই মুহূর্তে কোনও এক বই যদি তাকে বিপ্লবের পথে আহ্বান জানাতে পারে,তার সামনে কারাগারের দ্বার মুক্ত করতে পারে,তার থেকে চরম ত্যাগ দাবি করতে পারে তবে সে বইটি এই। দেশ স্বাধীন হবার সঙ্গে সঙ্গে গান্ধির শিষ্যেরা হবেন শাসক,বিপ্লবের রক্তাক্ত পথে পথ চলবার অধিকার থাকবে কেবল মার্ক্সের শিষ্যদের।যৌবনের দূরাগত পদধ্বনি অনেকের মনে নিয়ে আসে ভোগ বিলাসের স্বপ্ন,কিন্তু আরও অনেকের মনে সে জাগিয়ে তুলে মৃত্যুর সঙ্গে খেলা করার কামনা।প্রহ্লাদ ছিল এই দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ।সে শুধু ‘কম্যুনিস্ট ইস্তাহারে’র নামটা লিখে বাবাকে দিল।

বইয়ের নামটা পড়ে বাবা জিজ্ঞেস করলেন,“এ কেমন বই রে ? বইয়ের এমন নাম তো আগে শুনিনি।খুব ভালো গল্পের বই বুঝি?”

প্রহ্লাদ গর্বের সঙ্গে বলল,“গল্প না বাবা,প্রবন্ধের বই। আমার প্রবন্ধ পড়তে বেশি ভালো লাগে।”

যথা সময়ে বইটা ডালে এল,আর প্রহ্লাদ উত্তেজিত হয়ে পড়তে শুরু করল।সত্যি বলতে গেলে আদি অন্ত পড়েও সে বইটার বিন্দু বিসর্গ কিছু বুঝে পেল না।কিন্তু যেটি বুঝতে চাইছিল,তা বুঝতে পারল। বইটা তার উপরে মন্ত্রের মতো কাজ করল। এই ছোট্ট বইটার দুর্বোধ্য শব্দগুলোর মধ্যে মিশে আছে কোনও এক প্রচণ্ড শক্তি সারাজীবন ধরে সে সেই শক্তির সাধনা করবে। বইটার থেকে আর কিছু চায় নি,চাইছিল শুধু একটা স্বপ্ন।কৈশোরের সবচে’ মূল্যবান আর প্রার্থিত সম্পদ।সেই স্বপ্ন সে পেল। বইটা পড়ে শেষ করে নিজেকে নিজে সে বলল,“বড় হয়ে আমি কম্যুনিস্ট হব।”তারপর সে বইটাতে নিজের নাম লিখল : কমরেড প্রহ্লাদ হাজরিকা।

কলেজে গিয়েই সে বিপ্লবী কম্যুনিস্ট পার্টিতে নাম লেখাল।কিন্তু সে কথা পরে হবে।জীবনে সে কী হতে চেয়েছিল, আর কী হল গিয়ে ভেবে ভেবে অতীতের আরও অনেক কথা প্রহ্লাদের মনে আসে।লোকে কথায় বলে, “একই গাছের পান, কীই বা হবে আন।”কিন্তু একই গাছের পান যে কত ভিন্ন হতে পারে তা ভাবলেও অবাক হতে হয়।প্রদ্যুতের সঙ্গে সেই ছেলেবেলা থেকে একটা ব্যাপারে তার ভীষণ মিল ছিল।আর তা হল পড়াশোনায় দুজনেই দারুণ মেধাবী ছিল।কিন্তু আর সবেতেই এক সুমেরু তো অন্যে কুমেরু।প্রদ্যুৎ ছিল পড়াশোনা করে বড়লোক,অন্যদিকে প্রহ্লাদ ছিল ক্ষীণকায়,স্বল্পবাক আর অতিশয় লাজুক।মানুষের সঙ্গকে সে সব সময়েই ভীষণ ভয় পেত।তার একমাত্র সঙ্গী ছিল বই।বই পড়ে পড়ে তার অবস্থা হয়েছিল প্রায় ডন কুইক্সোটের মতো।সে সারাক্ষণ স্বপ্ন দেখত ---একদিন সে হবে জগতের সেরা বিপ্লবী।তার মেঘমন্দ্র উদাত্ত আহ্বান শুনে হাজার হাজার মানুষ ঘরের বাঁধন আরাম শয্যা ছেড়ে বিপ্লবের রক্তাক্ত রাজপথে বেরিয়ে আসবে।তার নাম শুনেই পৃথিবীর অত্যাচারী আর নিষ্ঠুর শাসকবর্গের চোখের ঘুম উড়ে যাবে।কিন্তু যে মানুষটি একদিন সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে,তার বিদ্রোহের প্রথম রেওয়াজ নিজের ঘরেই আরম্ভ হয়।প্রহ্লাদেরও হয়েছিল।জীবনের প্রথম বয়সের সেই এক ঘটনা প্রহ্লাদের মনে মুছতে না পারা দাগ বসিয়ে রেখে গেছে।

প্রহ্লাদের ঘরে রমেশ নামের এক চাকর ছিল।প্রায় পাঁচ বছর তাদের ঘরে থাকার পর একদিন সে দশটা টাকা চুরি করে পালাল।প্রদ্যুৎ তখন ক্লাস নাইনে পড়ে।প্রহ্লাদ এইটে।প্রদ্যুৎ ঘোষণা করল যে সে তাকে ধরে এনে কঠোর শাস্তি দেবে। সামান্য একটা চাকরের এমন স্পর্ধা সে কখনও সহ্য করবে না।কাজের অতি প্রয়োজনের সময় চাকরটা পালিয়ে যাওয়াতে বাবারও ভীষণ রাগ উঠল।তিনি প্রদ্যুতকে পুরো সমর্থন দিলেন।

বাবা আর দাদার এ আলোচনায় ঢুলে প্রহ্লাদ বলল,“বাবা, তোমাদের একটা কথা আমার ভালো লাগে নি।রমেশের বাবা খুব বিপদে পড়ে তাকে আমাদের ঘরে এনে রেখেছিল।তাদের দারিদ্র্যের সুযোগে তুমি মাত্র দশ টাকা মাইনেতে তাকে চাকর করে রাখলে।সে খুবই ছোট্ট ছিল তখন।কিন্তু এখন বড় হবার পরেও এতদিনে তার একটাকাও মাইনে বাড়ালে না।সে অন্যত্র বিশ পঁচিশ টাকার চাকরি পেয়ে ভালোয় ভালোয় আমাদের থেকে যেতে চাইছিল। কিন্তু তোমরা নানা ভয় দেখিয়ে সেটাও তাকে করতে দিলে না।প্রতিটা লোকের বুঝি নিজের উন্নতির জন্য চেষ্টা করা আর নিজের পছন্দ মতো কাজ খুঁজে নেবার অধিকার নেই?সে সম্পূর্ণ নিরুপায় হয়ে আমাদের ঘরের থেকে পালিয়ে গেছে।এখন তাকে খুঁজে এনে শাস্তি দেবার কথা ভেবো না।সে বড় অন্যায় হবে।”

প্রহ্লাদের কথা শেষ হবার জন্যে প্রদ্যুৎ কোনোক্রমে ধৈর্য ধরে রাখছিল।শেষ হওয়া মাত্র অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলল,“বাহ! বাহ! আজই জানলাম,আমাদের ঘরে একজন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের অবতার আছেন।দেখ,তোর শরীর যেমন রোগা ---হাঁটতে নুয়ে পড়ে,তোর মনটাও মেয়েদের মতো দুর্বল।আসলে তুই মেয়ে হয়ে জন্মালে বেশি ভালো ছিল।এমন দুর্বল মন নিয়ে আজকের সংসারে করে খেতে পারবিনে,বুঝলি?বইয়ের পোকা তুই যা তোর বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে থাক গে যা! আমাদের কথাতে তুই কথা বলতে আসবি নে।”

দৈহিক স্বাস্থ্য আর রূপের দিক থেকে প্রদ্যুতের কাছে এত নিষ্প্রভ ছিল যে তার মনে এক হীনমন্যতার ভাব গড়ে উঠেছিল। এখন প্রদ্যুৎ নির্মম ভাষাতে তার স্বাস্থ্যের প্রতি কটাক্ষ করাতে অন্তরে সে মরণান্তিক আঘাত পেল।উদ্গত ক্রন্দনটুকু জোর করে সংবরণ করে সে বাবার প্রতি আবেদন জানাল,“বাবা, তুমি কিছু বল না কেন? তুমিও দাদার কথাই কি সমর্থন কর?”

বাবা বললেন,“আমার আবার বলার কী আছে?প্রদ্যুৎ যা বলছে,ঠিকই বলছে।তুই যে আজ রমেশের হয়ে ওকালতি করতে এসেছিস,ওর করাটা তুই সমর্থন করিস না কি?একদিকে ন্যায় অন্যায়ের কথা বলছিস,আর দিকে চুরির সমর্থনে বলছিস যে বড়? প্রদ্যুৎ ঠিকই বলছে।সংসারে তুই যে করে খাবি,সে লক্ষণ দেখছি নে।”

প্রহ্লাদ আজ কিছু দিন থেকে লক্ষ্য করছে যে প্রায় সব কথাতে বাবা আজকাল প্রদ্যুতের প্রতি পক্ষপাত দেখাচ্ছেন। হয়তো তার সুন্দর স্বাস্থ্য,সপ্রতিভ আচরণ আর প্রখর বুদ্ধিবৃত্তি তার এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়;সংসারের যে কোনও কাজে কৃতকার্য হবার জন্য যেন তাঁর জন্ম হয়েছে।বাবার মনে স্বাভাবিকভাবেই একটা আশার সঞ্চার হয়েছে যে প্রদ্যুতই তাঁর জীবনের স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে পারবে।সে জন্য আজ কাল তিনি প্রহ্লাদের তুলনায় স্পষ্টতই প্রদ্যুতের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখান।এখন সে কথাটা এত বেশি স্পষ্ট হয়ে পড়ল যে তার মনে হল যেন বুকের মধ্যি দিয়ে একটা শেল এফোঁড় ওফোঁড় করে চলে গেল।

উত্তেজিত হয়ে সে বলল,“বাবা,তুমি যে চুরি করার কথা বলছ,চুরি আসলে করছে কে?আমি বলতে চাইছি,চুরি যদি কেউ করেছে তবে সে তুমি করেছ।একটা ছেলেমানুষকে তার দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে আজকের দিনে মাত্র দশটাকা মাইনেতে তুমি খাটিয়ে নিয়েছ।রমেশকে তার প্রাপ্যের থেকে বঞ্চিত করে তুমি তার জীবনের সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্নকে চুরি করেছ।চুরি নয়, ডাকাতি করেছ।জীবনে দু-টাকা বেশি রোজগারের জন্যে অন্যত্র সে যেতে চাইছিল।তুমি নানা ভীতি দেখিয়ে তাকে যেতে দিলে না।সে অবস্থাতে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর কী উপায় ছিল?ভেবেছিলাম পৃথিবীতে ক্রীতদাসের যুগ কবে শেষ হল।কিন্তু সে আমার ভুল।আমাদের নিজেদের ঘরেই ক্রীতদাস আছে।তুমি নিজে চোর হয়ে এখন এক অসহায় ছেলের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ আনাটা তোমার মুখে শোভা পায় না বাবা।বইতে ধনির দ্বারা দরিদ্রের শোষণের যে কথাগুলো লেখা আছে,তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ হলে তুমি নিজে।যাই হোক,এখন কিন্তু তোমরা রমেশকে খুঁজে এনে তাকে কোনও শাস্তি দিতে পারবে না।কথা খারাপ হবে,আমি তোমাকে বলে রাখলাম।”

প্রহ্লাদ কথাগুলো বলেছিল।আর রাগে কাঁপতে কাঁপতে বাবা তার কথাগুলো শুনছিলেন।এখন তার কথাগুলো শেষ হতে না হতে তিনি তার গালে এক প্রকাণ্ড চড় মেরে বললেন,“দৈত্য কুলে তুমি বেশ,প্রহ্লাদ হয়ে দেখা দিয়েছ,না? আমার ধন সম্পত্তি যদি চুরি করে করা জিনিস হল,তবে তুই তার উপরে বসে বসে খাচ্ছিস কেন?আজই তুই আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যা। ... প্রদ্যুৎ দেখছিস কী?এখনই গিয়ে ঐ খেতে না পাওয়া কুকুরটাকে খুঁজে পেতে বেঁধে নিয়ে আয়।সুপুরি গাছে বেঁধে চাবুক পেটা করে আমি ওর পিঠের ছাল-বাকল তুলব।কী খারাপ কথা হয়,দেখব।ঠোঁট চাপলে এখনও দুধ বেরোয় সে তার বাবাকে কিনা শোনায় সতর্কবাণী।”

প্রহ্লাদদের ঘরে একটা বড় ঘোড়া ছিল। প্রদ্যুৎ ঘোড়ায় চড়তে খুবই পাকা।সুন্দর পোশাক আসাক পরে সে যখন ঘোড়া ছুটিয়ে যায় দেখে মনে হয় বুঝিবা রাজকুমার যাচ্ছে।পথের পথিকরা ফিরে ফিরে চায়।বাবার কথাগুলো মাত্র সে ভেতরে গিয়ে সাজ পোশাক পরে হাতে চাবুক একটা নিয়ে বেরিয়ে এল।উঠোনে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে প্রহ্লাদের দিকে বাঁকা চোখে চেয়ে কটাক্ষ-বাণ ছুঁড়ল। তারপরেই ঘোড়ার পিঠে এক লাফে উঠে পলাতক ক্রীতদাসের সন্ধানে বিদ্যুৎ বেগে ছুটে চলল।

প্রহ্লাদ দুপুরে ভাতটাত না খেয়ে শুয়ে থাকল।

বেলা পড়ে গেলেও প্রহ্লাদ শুয়েই রইল।বাইরে হঠাৎ হুলুস্থূলু শুনে কী হয়েছে দেখবার জন্য সে বেরিয়ে এল।বেরিয়ে দেখে প্রদ্যুৎ তার অভিযানে সফল হয়েছে।রমেশকে সে ধরে এনেছে আর তাই দেখবার জন্যে উঠোনে লোকজন ভিড় করেছে। প্রদ্যুৎ ইতিমধ্যে রমেশকে উত্তমমধ্যম শাস্তি নিশ্চয়ই দিয়েছে।তার সারা গায়ে এর দাগ পড়েছে।কিন্তু এর পরেও বাবা তাকে সুপারি গাছে বাঁধার হুকুম দিলেন।রমেশ বলির পাঠার মতো ভয়ে কাঁপছিল।প্রহ্লাদের চোখের সামনে সত্যি তাকে সুপারি গাছে বাঁধা হল।সে আর ধৈর্য ধরতে পারল না।বাবার কাছে গিয়ে বলল,“বাবা রমেশ দোষ একটা করেছে মানছি।কিন্তু সে পাঁচ বছর আমাদের ঘরে থেকে মানুষের মতো হয়ে গেছে।তোমার কি হৃদয় বলে কিছু নেই? যদি তুমি রমেশকে এখন কোনও শাস্তি দাও তবে জেনে নিও,আজ থেকে আমি আর তোমার ছেলে নই। এ ঘরে আর জল এক ফোঁটাও আর আমি ছোঁব না। না খেয়ে মরে যাব, তবু।

বাবার হুকুম পাওয়া মাত্র প্রদ্যুৎ চাবুকের কোপটা বসিয়েই দিল।সঙ্গে সঙ্গে রমেশ পশুর মতো আর্তনাদ করে উঠল। প্রহ্লাদ দৌড়ে ভেতরে গিয়ে আবার বিছানায় পড়ল।

পুরো তিনদিন কিচ্ছুটি না খেয়ে সে বিছানায় পড়ে রইল।অবশেষে সে অবশ্য অনশন ভাঙতে বাধ্য হল,কেননা সাথে করে মা-ও জল স্পর্শ বাদ দিয়েছেন।কিন্তু সেই ঘটনার পর বাবা আর দাদার সঙ্গে তার যে মনোমালিন্যের সূচনা হল জীবনে কখনো এর অন্ত পড়েনি।

কলেজে গিয়ে কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে সে আরও একটা কাণ্ড করল।একবার বন্ধে ঘরে এসে সে বাবাকে বলল, “তুমি বেঁচে থাকতে জমি বাড়ি আমার আর দাদার মধ্যে ভাগ করে দেবে কি?”

সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বাবা বললেন,“কেন? নিজের ঘর সংসার না হতেই তুই আলাদা হতে চাস নিকি? তোর মতলবটা কী?”

বাস্তববুদ্ধিহীন প্রহ্লাদ বলল,“আমি ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে বিশ্বাস করি না।আমার ভাগের জমি বাড়ি আমি আধিয়ারদের মধ্যে ভাগ করে দিতে চাই।”

অট্টহাস্য করে বাবা বললেন,“পাগল আর কি ! কেউ এসে কি গৃহস্থকে বলে কখনও,আপনি আমাকে সিন্দুকের চাবিটা দিয়ে খানিকক্ষণ চোখ বোজে থাকুন তো,আমি আপনার ঘর থেকে সোনাদানা চুরি করে নিয়ে যেতে চাইছি।এই বুদ্ধিতে তুই সংসারে করে খেতে চাইছিস,হ্যাঁ?যা করলি ভালোই করলি।আমার জমিজমার এক কণাও তুই পাবি না।সব আমি প্রদ্যুতের নামে লিখে রেখে যাব।

অবশ্য গুণাভিরাম হাজরিকা এই এক ব্যাপারে নিজের কথা মতো কাজ করেন নি।তাঁর মৃত্যুর পর দেখা গেল জমি জমা তিনি সবই দুই ছেলের নামে সমানে লিখে রেখে গেছেন।

প্রদ্যুৎ তখন পুলিশ সুপার।আর প্রহ্লাদ শিবসাগর জেলার কোনও এক ভেঞ্চার স্কুলের শিক্ষক।বাবার মৃত্যুর পরে পরেই সে নিজের ভাগের জমিজমা আধিয়ারদের মধ্যে ভাগ করে দিল।প্রদ্যুৎ তার ভাগের মাটি বিক্রি করে ডিব্রুগড়ে পাকা বাড়ি একটি সাজিয়ে তুলল।

(ক্রমশ...)