শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

জমাট বাঁধা রক্ত, পর্ব -৭

সাত

পবিত্র মানসিকভাবে এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে মন্টু যাওয়ার পরে অনেকক্ষণ পর্যন্ত সে স্থির থাকতে পারল না। একবার ভাবছিল যোগেশ্বরদের সঙ্গে কথাটা আলোচনা করবে, কিন্তু পরের মুহূর্তে সে সেই চিন্তা থেকে সরে এল। তা করলে গ্রামে সন্দেহের বীজাণু আর ও বেশি করে ছড়াতে পারে।

কতক্ষণ পবিত্র এভাবেই ছিল সে বলতে পারেনা- সাবিত্রীর ডাকে তার সংজ্ঞা ফিরে এল। সাবিত্রী দৌড়ে এসে খবর দিল, তোমার খোঁজে একজন বন্ধু এসেছে, এখানকার নয় শহরের বলে মনে হচ্ছে…'

' এই সন্ধ্যা বেলা কোথা থেকে আমার বন্ধু আসবে?' পবিত্র মুখ ভেংচে বলে উঠল, তোকে নেবার জন্য কোনো রাজকুমার যদি এসেছে বলতে পারিনা…'

' রাজকুমারের কাছে না গেলেই পারি' চিৎকার করে সাবিত্রী বলল, কিন্তু আমাকে চা দে, তামোল দে বলে চিৎকার করিস না, আমি যাচ্ছি... সাবিত্রী দ্রুত বেরিয়ে গেল।

পবিত্র কৌতূহল বসেই শার্টটা পরে বৈঠকখানা ঘরে এসে একেবারে চিৎকার করে বলে উঠল, 'আরে অনিমেষ তুই?'

' চুপ' অনিমেষ বলল, চিৎকার করিস না, আমার নাম বিমল দত্ত। কৃষক সমস্যার বিষয়ে অধ্যয়ন করার জন্য আসা আমি একজন গবেষণার ছাত্র। এটাই আমার পরিচয়।'

অনিমেষ যে ধরনে ভাবলেশহীন ভাবে কথাটা বলল, পবিত্রের সমস্ত উৎসাহ হঠাৎ দমে গেল এবং তার মুখের দিকে অদ্ভুত কিছু একটা দেখার মতো দেখতে লাগল।

' কী হল? কিছুটা সহজ হবার চেষ্টা করে অনিমেষ বলল,' তুই আমার চিঠি পাসনি?'

' আজ পেয়েছি। কিন্তু তোর সঙ্গে যে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি' পবিত্র বলল,' আমি ভেবেছিলাম তুই চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলি…'

' হারিয়ে গিয়েছি বলেই ধরে নে' অনিমেষ বলল,' তোর যদি নিজের কোনো রুম থেকে থাকে তাহলে সেখানে চল, আমি বেশিক্ষণ থাকব না, শেষবারের জন্য তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি বলেই ধরে নে…'

' ভেতরে আয়' পবিত্র বলল। দুজনেই পবিত্রের ঘরে ঢুকে গেল ।

প্রথমে পবিত্র আরম্ভ করল,'তোর চিঠিটা আজ বিকেলে পেয়েছি কিন্তু তোর চিঠিটা পড়ে আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না ।'

' আমিতো তোর কাছে সব কথাই স্পষ্ট করে লিখেছি'- অনিমেষ বলল।

' তুই যে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিস সেটা আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু তুই কী করবি ?'

'কী করব সেটা এখন বলতে পারব না। পার্টি এবং আমার বিবেক দুটোরই নির্দেশ পেলাম। এভাবে বসে থেকে সময়ের অপচয় করার কোনো মানে নেই। আমাদের হাতে-কলমে সংগঠনের কাজে লাগতে হবে ।এই অঞ্চলে কাজ করার জন্য আমার কাছে নির্দেশ এল, আমারও ভালো লাগল, তাই চলে এলাম…'

' কিন্তু এই ধরনের গ্রামে তুই কীসের সংগঠন করবি?' পবিত্র বলল,' মানুষগুলি শিক্ষার আলো পায়নি। দু'বেলা দু'মুঠো খাবারের জন্য সংগ্রাম করতেই ওদের জীবন পার হয়ে যায়। এই গ্রামে কলেজের মুখ দেখা মানুষ একমাত্র আমি। এখানে তোর কথা কে শুনবে? তাছাড়া আমিই তোকে বুঝতে পারছিনা, ওরা তোকে কীভাবে বুঝবে?'

' এই গ্রামের অবস্থাই তো আমাদের দেশের সমগ্র গ্রামের অবস্থা। বরং অসমের বাইরে এরকম কিছু গ্রাম আছে যেখানে অবস্থা এর এর চেয়েও খারাপ। আমার মনে হয় তোর চেয়ে এদের বোঝাতে, সংগঠিত করতে আমার পক্ষে সুবিধা হবে...। অবশ্য বলতে পারিনা, এতদিনে আমরা সমস্ত কিছুর কেবল তাত্ত্বিক দিক নিয়ে আলোচনা করেছি। এই প্রথম কর্মক্ষেত্রে নেমেছি। পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্র, বিহার - এই সমস্ত জায়গায় আমরা যদি কৃষক-শ্রমিকদের সংগঠিত করতে পারি, অসমীয়া না পারার কোনো কারণ নেই…'

' সংগঠন করে কী করবি?' পবিত্র জিজ্ঞেস করল,' বিদ্রোহ করবি? কার বিরুদ্ধে? রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে? হালোয়ার লাঠি নিয়ে এরা রাইফেলের গুলির সামনে কি লড়াই করতে পারবে?'

' কার বিরুদ্ধে লড়াই করব, কী দিয়ে লড়াই করব সেটা এখন প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হল সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে এই মানুষগুলি যে শস্য উৎপাদন করে সেই শস্যের মালিক যে ওরাই সে কথা বুঝিয়ে দেওয়া, এতদিন যাকে তারা ভাগ্য বলে গ্রহণ করেছিল সেই ভাগ্যের মালিক যে ওরা নিজে সে কথা শিখিয়ে দেওয়া এবং ওদের শত্রু কে, মিত্র কে সে কথা যখন ওরা জানতে পারবে তখন নিজের ভাগ্য নিজে নিয়ন্ত্রন করার জন্য নিজেই বেরিয়ে আসবে, আমাদের কিছু করতে হবে না…'

' কিন্তু সশস্ত্র বিদ্রোহই কেবল তোদের একমাত্র বিপ্লবের পথ নয়?'

' আত্মরক্ষার জন্য আমাদের সশস্ত্র হতেই হবে, তথাকথিত সংসদীয় গণতন্ত্রের একমাত্র ভোটের অধিকার এই সমস্ত মানুষের ভাগ্যে পরিবর্তন নয় ,সে কথা তুইও দেখেছিস, বুঝেছিস। কাজ হবে মানুষদের এই সত্যটা বুঝিয়ে দেওয়া…'

সংসদীয় গণতন্ত্রের আমাদের দেশে কী পরিণতি তা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি শোন। এটা গল্প বলে মনে হলেও একেবারে সত্য কথা....' এই বলে পবিত্র গল্প বলতে আরম্ভ করল। ন-পাম গ্রামের ব্যাপারে যে সমস্ত মানুষ এসে বসতি স্থাপন করেছে তারা সব ওপার বাংলা থেকে এসে বসতি স্থাপন করা মানুষ এইসব মানুষের একটি ধারণা আছে যে যদি কোনোভাবে নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ না পায় ওদের পূর্ববঙ্গে ফিরে যেতে হবে। ভোট দেওয়া মানে কাকে ভোট দেওয়া তুইতো জানিস। ওদের মধ্যে ভোটের ক্যানভাস করার জন্য কোনো নেতা আসেনা, আসে থানার দারোগা এবং মৌজাদারের পেয়াদা। ভোটার লিস্টে সেইজন্য যেকোনো উপায়ে নামটি ঢুকিয়ে দেয়। এই ভোটের লিস্টে নাম ঢোকানোর জন্য ওদের জনপ্রতি পনেরো কুড়ি টাকা করে ঘুষ দিতে হয়। ভোটার লিস্টে নাম না থাকা মানুষ দুই তিন মাস পরে পরে থানার লকআপে থাকা, পঞ্চাশ একশো টাকা দিয়ে তাদের ছাড়িয়ে মানা - কিছুদিন পরে পরে ঘটে থাকা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়।

এই গ্রামে বসির মিঞা নামে পূর্ববঙ্গ থেকে এসে বসতি স্থাপন করা একজন বুড়ো মানুষ ছিল। বুড়ো মেয়েকে সাত মাইল দূরের একটি গ্রামে বিয়ে দিয়েছিল । গতবার ভোটের আগের দিন রাতে বুড়ো জানতে পারল যে জামাইয়ের খুব শক্ত অসুখ, একেবারে এখন তখন অবস্থা। বুড়ো রাতের বেলা খবর পেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেল। যাবার আগে সবাইকে বলে গেল কেউ যেন ভোট দিতে ভুলে না যায়। ভোট মানে কোথায় মোহরটা মারতে হবে সেকথা থানার দারোগা এবং মৌজাদারের পেয়াদা এসে বুঝিয়ে গেছে। তাই কেউ যেন ভুল না করে, বুড়ো বলল, ভোট শেষ হওয়ার আগে আগে বুড়ো এসে যেভাবেই হোক ভোট দেবে।

সকালে বাড়ির প্রতিটি মানুষ জামাইয়ের আরোগ্য কামনা করে ভোট দিল । গ্রামের মানুষ প্রায় সবাই ভোট দিল একমাত্র বাদ পড়ে রইল বসির মিঞা। দিনের দুটো পর্যন্ত কেউ খুব একটা চিন্তা করেনি, কিন্তু বিকেল হয়ে গেল যখন বসির মিঞা এলনা তখন সবাই চিন্তিত হল। উৎকণ্ঠার সীমা নেই। সবাই যতটা সম্ভব গলা বাড়িয়ে বুড়ো ফিরে আসার গলিটার দিকে যতটা দৃষ্টি যায় তাকিয়ে রইল। মাঝখানে মৌজাদারের মুহুরী একবার এসে সমস্ত মানুষ ভোট দিয়েছে কিনা খবর নিয়ে গেল। কেউ বলে দিল,বসির মিঞা দেয়নি, মেয়ের কাছে গিয়ে ফিরে আসেনি। সঙ্গে সঙ্গে খবর দারোগার কাছে পৌঁছে গেল। দারোগা সাহেব এসে রাগে একেবারে অগ্নি শর্মা।'কী- বুড়োর এত সাহস, ভোটের দিন ভোট না দিয়ে মেয়ের বাড়িতে ভোজ খেতে গিয়েছে, দাঁড়া এবার, একেবারে আসল মেয়ের বাড়িতে ভোজ খেতে পাঠাব, পালাবে কোথায়?'

বাড়ির মানুষ অনেক কাকুতি-মিনতি করল, জামাইয়ের অসুখের কথা বলল এবং বুড়ো যে ভোট শেষ হওয়ার আগেই এসে পড়ার কথা ছিল সে কথাও বারবার বলল। কিন্তু দারোগা কোনো কথা শুনতে চায় না। দারোগার বক্তব্য হল সরকারের নির্দেশ অমান্য করে বুড়ো মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে। তাই বুড়োকে পাকিস্তানে পাঠাতেই হবে। অবশেষে বাড়ির মানুষ সঞ্চিত কিছু টাকা দেওয়ায়, দারোগা কিছুটা শান্ত হল। তথাপি সাবধান বাণী শোনাল যে ভোট দিতে না পারলে কিন্তু রক্ষা পাবে না। জেলের ভাত খেতে হবে না হলে পাকিস্তানের যেতে হবে।

ভোট বন্ধ হতে মাত্র আধ ঘন্টা সময় বাকি আছে। ইতিমধ্যে ভোট নেওয়া অফিসাররা একথা জানিয়ে দিয়েছে। বসির মিঞার বাড়ির মানুষ এসে ভোট কেন্দ্রের সামনে অপেক্ষা করছে। বসির মিঞার বাড়ির মানুষগুলির ধীরে ধীরে কথাবার্তা বন্ধ হয়ে এল- সবারই একই উৎকণ্ঠা। গ্রামের মানুষ গুলি ইতিমধ্যে খবর নেওয়া শুরু করেছে। ওদের কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে রুদ্ধ হয়ে এল। ঠিক তখনই একটি ছোট ছেলে চিৎকার করে উঠল, দাদু এসেছে। সবাই একসঙ্গে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে দূরের রাস্তার দিকে তাকাল। অনেক দূরে বসির মিঞার মতো একজন বুড়ো মানুষ দ্রুত এগিয়ে আসছে। কেউ বলল ওটাই বসির মিঞা, কেউ বলল না। এত বুড়ো মানুষটা এভাবে দৌড়াতে পারে নাকি? কিছুক্ষণ পরে স্পষ্ট বুঝতে পারা গেল, বসির মিঞাই। সঙ্গে সঙ্গে সবাই চিৎকার করতে লাগল- আব্বাজান তাড়াতাড়ি এসো, বসির দাদা তাড়াতাড়ি এসো, ভোট বন্ধ হবে‌। বসির দাদা তাড়াতাড়ি এসো। বাবা তাড়াতাড়ি এসো।

বুড়ো যতটা সম্ভব দৌড়াতে শুরু করল। দৌড়াতে দৌড়াতে এসে যখন পুলিং বুথে ঢুকল তখন পুলিং বন্ধ হওয়ার মাত্র পনেরো মিনিট বাকি।

বুড়োর গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না, জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। অন্যদিকে বাইরের সবাই অপেক্ষা করছে বুড়োর বুথের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। বুড়ো বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের, গ্রামের সমস্ত মানুষের মুখে আনন্দের হাসি। কিন্তু বসির মিঞা থাকতে পারল না। সবাই জিজ্ঞেস করল, বসির মিঞার এত দেরি হল কেন? জামাইয়ের অসুখ বেশি নাকি? বুড়োর সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হল না, তার আগেই বুড়ো ঢলে পড়ল। সেই যে পড়ল বুড়ো আর উঠল না, চারপাশে হইচই শুরু হল।

এর দুদিন পরে সর্বভারতীয় খবরের কাগজে' গণতন্ত্রের প্রতি সম্মান' শীর্ষক একটি সংবাদ প্রতিষ্ঠান পরিবেশন করা খবর প্রকাশিত হলঃ অসমের গোলাঘাট মহাকুমার একটি পুলিং বুথে একজন আশি বছরের বুড়ো মানুষ ভোট দেওয়ার পরেই ঢলে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে ইহসংসার ত্যাগ করে। উল্লেখযোগ্য যে সেদিন মানুষটার জামাইয়ের মৃত্যু ঘটেছিল এবং কবরস্থান থেকে বাইরে বাইরে ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রতি শেষ সম্মান জানাবার জন্য ভোট দিতে এসেছিল। ডাক্তারের মতে বুড়ো মানুষটির মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল।

' ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রতি সম্মান জানিয়ে এভাবেই বসির মিঞার মৃত্যু হল বুঝেছিস অনিমেষ' পবিত্র বলল, তাই এই সমস্ত মানুষকে তুই কি বোঝাতে পারবি এই গণতন্ত্র ভুয়া, মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্যই কেবল চলছে।'

' আমাদের বুঝিয়ে দিতে হবে'- কিছুটা জোরের সঙ্গে অনিমেষ বলল।

' বোঝতে পারবি ঠিকই, কিন্তু যে সমস্ত মানুষের ভাগ্য বিধাতা থানার দারোগা এবং মৌজাদার ঠিক করে সেই সমস্ত মানুষ কি বিদ্রোহ করতে পারবে?বসির মিঞা ভোট না দেবার অপরাধে থানার দারোগা সেদিন যদি বসির মিঞার পরিবারকে বিদেশি নাগরিক বলে গ্রেপ্তার করত তুই কি তাদের রক্ষা করতে পারতিস?'

' আমি পারব না ঠিকই' অনিমেষ বলল,' আমরা প্রতিটি মানুষ যদি সংগঠিত হই তাহলে নিশ্চয় এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারব।'

' মানুষগুলি এত দুঃখী যে ওরা নিজের ওপরে সমস্ত বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। তাছাড়া ওরা থানার দারোগাকে যতটা ভয় করে ততটা ভয় আর কাউকে করে না। তুই যে সমস্ত কথা শিখেছিস সেইসব বই পড়ে, বিদেশে পাওয়া কিছু ঘটনার বিশ্লেষণ করে।... তোরা ভেবেছিস এখানেও এই সব সম্ভব। কিন্তু এখানে কেবল ধনী এবং দুঃখী শ্রেণীই নয়,তার উপরে রয়েছে ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্ত হওয়া মানুষ। আমরা যতই একত্রিত থাকি না কেন sensitive issueর ক্ষেত্রে আমরা পরস্পরকে সন্দেহ করি। এই যেমন এখানে থাকার কথাই ধর , আমাদের এখানে সমস্ত মানুষ অসমিয়া ভাষায় কথা বলে। এখানে কলেজের মুখ দেখা একমাত্র আমি। কিন্তু কলেজে কী ভাষায় পড়ানো হবে সেই কথা নিয়ে এখনও ইতিমধ্যে মানুষের মনে সন্দেহ এবং বিদ্বেষের ভাব সংক্রমিত হয়েছে। ধনী এবং দুঃখী- দুটি ভাগে আমাদের মানুষ বিভক্ত নয়, আমাদের মানুষ ধর্ম ভাষা এবং সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বিভক্ত হয়।'

' তোর বলা কথাগুলির মধ্যে যে যুক্তি নেই তা নয়', অনিমেষ বলল,' এই সমস্ত কথা ও আমি অনেকদিন চিন্তা করে দেখেছি কিন্তু সমস্যা আছে বলেই আমাদের হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে তা আমি মনে করি না। আমাদের সমাজে এক সম্পূর্ণ বিপ্লব আমার জীবনে হয়তো হবেনা, হয়তো জেলে যা্‌ব, পুলিশের গুলিতে মরব। আমাদের সঙ্গের অনেকেই পশ্চিমবঙ্গের জেলা আছে, পুলিশের গুলিতে মরেছে। তথাপি দিন দিন নতুন নতুন মানুষ এগিয়ে আসছে কেন?... আমি আশাবাদী। কতজনকে মারবে, কতজনকে জেলে রাখবে? একটা দিন আসবে যখন দেশের স্বেচ্ছাচারী শাসক বা শাসনতন্ত্রের হাতে গুলি শেষ হয়ে যাবে, জেলগুলিতেও আর জায়গা থাকবেনা।'

' তোর বলা কথাগুলি হয়তো একদিন সম্ভব হবে' পবিত্র বলল,' আমার মতো মানুষের সমস্যা হল এই অঞ্চলটির আমি হলাম একমাত্র কলেজে শিক্ষা লাভ করা মানুষ। গ্রামে একটি স্কুল স্থাপন করা, গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়া একমাত্র পথটি বর্ষায় যাতে কর্দমাক্ত না হয় সেই ব্যবস্থা করা ,মানুষকে সংক্রামক রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হতে শেখানোটা এখন আমাদের প্রথম কর্তব্য হবে না আমাদের শ্রেণি শত্রুকে ,শোষক কে সেটা শেখানোটা প্রথম কর্তব্য হবে আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা…'

' দুটোই একসঙ্গে হতে হবে' অনিমেষ বলল, শিক্ষা মানুষের লাগবেই, শিক্ষা না হলে মানুষ অদৃষ্টকে ভাগ্য বিধাতা বলে মেনে নেবে। কিন্তু আমাদের তাদের এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করে দিতে হবে যে শিক্ষা ভারতে এখন চলতে থাকা অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ ছেড়ে যাওয়া সামন্তবাদী শিক্ষা নয়, সেই শিক্ষা হতে হবে মানুষগুলির বেঁচে থাকার অধিকার সাব্যস্ত করার শিক্ষা- এই দুটি কাজই হবে একটি টাকার দুটি পিঠের মতো। তুই এই মানুষগুলোকে শিক্ষিত করার কথা যেভাবে চিন্তা করছিস, ঠিক তার বিপরীতে এই মানুষগুলি যাতে শিক্ষার আলো না পায় সে কথা চিন্তা করার মতো মানুষও আছে। তারা জানে- এই মানুষগুলি যেদিন শিক্ষিত হয়ে উঠবে সেদিন তারা প্রতিবাদ করতে ও শিখবে। বর্তমানের মতো আর শোষণ করে যাওয়া সম্ভব হবে না।'

কথা বলার সময় কতটা সময় পার হয়ে গিয়েছিল সেই সম্পর্কে ওদের দুজনের খেয়াল ছিল না। সাবিত্রী দুইকাপ চা এবং দুটো বাটিতে দই চিড়া নিয়ে আসতেই ওদের খেয়াল হল-- বাইরে ইতিমধ্যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। কাজের ছেলেটি আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিল কেউ খেয়াল করেনি।

পবিত্র অনিমেষকে সাবিত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল তার বন্ধু বিমল দত্ত বলে।

পবিত্র বলল ,'তুই এসেছিস ভালোই হয়েছে ,আমার এখানে থেকেই কাজ করতে পারবি…'

পবিত্রের কথা শুনে অনিমেষ সশব্দে হেসে বলল,' তোর মা রেঁধে খাওয়াবে তোর বোন দেখাশোনা করবে বিছানায় বসে বসে আমরা বিপ্লবের পরিকল্পনা করব... এটাই তো?'

- তাহলে কোথায় থাকবি?

- তাহলে কোথায় থাকব,সেই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। এই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মোহ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি। তাছাড়া তোর এখানে থাকা মানে সরকারের ঘরে খবর পৌঁছাতে একদিনের ও কম সময় লাগবে। তুই দেখিস আমার খবরের খোঁজে তোর কাছে পুলিশের মানুষ দুই-একদিনের মধ্যে এসে যাবে... আচ্ছা বাদ দে সেইসব, আমি এখন উঠছি, অনেক দূর যেতে হবে…'

' এই রাতের বেলা কোথায় যাবি?' অবাক হয়ে পবিত্র জিজ্ঞেস করল, রাতটা থেকে যা…'

' মাঝেমধ্যে এভাবেই দেখাশোনা হবে, কিন্তু তোর এখানে আমি থাকতে পারব না... তুই যতই ঘনিষ্ঠ বন্ধু হোস না কেন ,আমি কোথায় থাকব সে খবর তোকে জানাতে পারব না...। আশা করি ভবিষ্যতেও আমার এই সমস্ত বিষয়ে কৌতুহলী না হলে তোর আর আমার দুজনের জন্যই মঙ্গল, বুঝতেই পারছিস।

অনিমেষ আর কথা বাড়াল না। সে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল। পবিত্র তাকে গ্রামের সীমানাটা পার করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সে বাধা দিল। পবিত্রের সঙ্গে একজন নতুন মানুষ দেখলে অন্য মানুষেরা কৌতুহলী হয়ে পড়বে। এই সমস্ত কাজে মানুষের কৌতূহল থেকে যত দূরে থাকতে পারা যায় ততই মঙ্গল।