বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

জমাট বাঁধা রক্ত, পর্ব -৩

(তিন)

‘সময় করতে পারলে তুমি মাঝে মাঝে এসো’। দরজাটা বন্ধ করে অঞ্জনা বলল, ‘আমি বড় নিঃসঙ্গ, কাউকে পেলে ভালো লাগে…’

‘তোমার কোনো সঙ্গী নেই?’ পবিত্র জিজ্ঞেস করল।

‘সঙ্গী যে নেই তা নয়,আছে, কিন্তু জীবনানন্দকে চিনতে পারার মতো কোনো বন্ধু নেই…’ ‘আমিও তো জীবনানন্দকে চিনিনা’ পবিত্র বলল, ‘আজকেই প্রথম আমি জীবনানন্দ পড়লাম।’ ‘তবুও তুমি নামটা শুনেছ’ অঞ্জনা বলল, অন্তত জীবনানন্দকে সম্মান করতে জান, জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’র মধ্যে হয়তো ‘রূপসী অসম’ খুঁজে নিতে পারবে। তুমি তখন যেভাবে জীবনানন্দ পড়ছিলে আমি বহুক্ষণ তোমার পাশে দাঁড়িয়ে তোমাকে দেখছিলাম। অন্তত আমার ভুল হতে পারে না। সেই বিশ্বাসটুকু আমার আছে…

পবিত্র কিছু বলল না। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে তার কান দুটি একটু গরম হয়ে গেল। সে নিজেকে একবার জিজ্ঞেস করল-সে কি সত্যি সত্যি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল নাকি? এই অন্যমনস্কতার কারণ জীবনানন্দের কবিতা নাকি অন্য কিছু। ঠিক উত্তরটা পবিত্র খুঁজে বের করতে পারল না।

পবিত্র দেখল- অঞ্জনার বাবা স্টেশনে যাবার জন্য কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে এসেছে। সেই জন্য পবিত্র বলল, ‘আমি যাই, এখন জীবনানন্দ প্রসঙ্গ থাকুক।’

‘যাও’, অঞ্জনা বলল, ‘কিন্তু কবে আসবে বল?’

‘আমি আগে বন্ধে বাড়িতে এলে এই স্টেশনে কেবল দুবারই আসি। এবার বাড়ি আসার দিন এবং এবার বাড়ি থেকে ফিরে যাবার দিন…’

‘এবার ?’

‘এবার নির্ভর করবে বাবা কোন দিন সাইকেলটা নিয়ে কোথাও না গিয়ে বাড়িতে থাকবে…’ ‘তারমানে হেঁটে আসবে না…?’

‘ওহো’ পবিত্র বলল, ‘এতটা আমি তোমার জন্য করতে পারব এখনই সেকথা দিতে পারছিনা…’

‘কীসের কথা বলছ পবিত্র’ বুড়ো মাস্টার অঞ্জনাকে বলা কথাটা কিছুটা শুনে বলল ‘আমি ভেবেছিলাম তুমি চলে গেছ…’

‘ উনি তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন…’

পবিত্র কিছু বলার আগেই অঞ্জনা বলল।

‘আমি তোমাকে অনেক সময় ডিটেন করে রাখলাম।’ স্টেশন মাস্টার বললেন, ‘তুমি কিছু মনে কর না…’

‘না না আপনি মিছামিছি ভাবছেন’ পবিত্র বলল, বেশি সময়…’

‘তুমি কিছু মনে কর না’ বাধা দিয়ে অঞ্জনা বলল, ‘এটা বাবার মুদ্রাদোষ, বুঝলে খোকা, ‘তুমি কিছু মনে কর না- আবার এসো…’ অঞ্জনার কথায় বুড়ো স্টেশন মাস্টার এবং পবিত্র সশব্দে হেসে উঠল এবং তারপরে পবিত্র অঞ্জনাকে বলল-‘এবার যাই।’

‘যাই না’ অঞ্জনা বলল, ‘এবার আসি,যাই বলতে নেই।’

ন-পাম গ্রামে যাওয়া রাস্তায় উঠে এবার পবিত্র ঘড়িটার দিকে তাকাল। সাতটা বেজে গেছে। তার মানে সে এসে স্টেশন পেয়েছে দু ঘন্টা হয়ে গেছে। দুই ঘন্টা। পবিত্র নিজেকে বিশ্বাস করতে পারল না। এত সময় স্টেশন মাস্টারের কোয়ার্টারে কাটিয়েছে? সে তো আগে বাড়িতে এলে পথে কোথাও দাঁড়ায় না। গ্রামে ঢোকার পরে প্রত্যেক বাড়ির সামনে তাকে কিছুটা দাঁড়াতে হয়,প্রত্যেকেই তার কুশল বার্তা জানার জন্য অপেক্ষা করে থাকে।অন্যান্যদের কুশলবার্তা নিতে হয়।এতটা করার পরেও তার গ্রামে প্রবেশ করার পরে বাড়ি পৌছাতে দুইঘন্টা সময় লেগে যায়। পথে দেখা হওয়া কেউ তাকে অনেকক্ষণ আটকে রেখে কথা বলতে থাকলে সে ছটফট করতে থাকে। সে জানে, মা গরুর গাড়ি স্টেশনে পাঠানোর পর থেকে বারবার রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। যত তাড়াতাড়িই সে গিয়ে পৌঁছাক না কেন মা গাড়ির গাড়োয়ান ধনাইদাকে সবসময় অভিযোগ করে-‘ তোর এত দেরি করা উচিত হয়েছে কি?’ ধনাই দাদা বলে-‘আমি কি দেরি করেছি,আপনার ছেলে নানা জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে দেরি করে ফেলে…’ তখন মা পবিত্রকে বলে-‘তুই এভাবে রাস্তায় সবার সঙ্গে কথা বলে বলে আসার কি প্রয়োজন? আমি তোর মা যে কতক্ষণ ধরে উতলা হয়ে তাকিয়ে রয়েছি সে কথা কি তোর মনে পড়ে না?’ তখন পবিত্র বলে, ‘আমি কি সত্যিই দাঁড়াব বলে দাঁড়াই নাকি? সবাই ডাকে, দুয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করে। কথার উত্তর না দিয়ে আমি কীভাবে চলে আসি?’ তখন মা রাস্তায় দেখা হওয়া মানুষগুলোর প্রতি অভিযোগ করে বলে-‘ছেলেটি তো দু'একদিন থাকবেই, কত কষ্টে ক্লান্তিতে এসেছে, এভাবে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে কথা বলাটা কি ঠিক? পরেও তো কথা বলতে পারবে।বিন্দুমাত্র কান্ডজ্ঞান নেই ওদের। ক্ষুধায় ক্লান্তিতে ছেলেটি এসেছে সে বিষয়ে কারও কোনো চিন্তা নেই, নিজের ছেলে হলে বুঝতে পারত…’ কথা বলতে বলতে মা তার জন্য জলখাবার তৈরি করতে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। ঠিক তখনই বাবা এসে পবিত্রের কুশল বার্তা জিজ্ঞেস করে। মায়ের জলখাবার তৈরি হওয়ার পরেও পবিত্রের সঙ্গে বাবাকে কথা বলতে থাকা দেখে মা এসে অভিযোগ করে-‘সেই সমস্ত কথা খেয়ে ওঠার পরেও জিজ্ঞেস করতে পারবেন। ও তো আর আজই চলে যাবে না? আপনি তো দেখছি গ্রামের মানুষের চেয়েও বেশি। নিজের ছেলেটি কত খানি ক্ষুধায় তৃষ্ণায় কাতর হয়ে এসেছে তার প্রতি কোনো খবর নেই, কেবল কথার মালা…’ তারপরে বাবা সেখানেই কথা শেষ করে বলে, যা পবিত্র, মুখ হাত ধুয়ে কিছু একটা খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নে’, সারারাত তোর ঘুম হয়নি বোধহয়।’তারপরে ধনাইদাকে বলে, কেউ এলে বলবি, পবিত্র শুয়েছে, কাউকে তার ঘরে যেতে দিবি না, সবাইকে বলবি বিকেলে আসার জন্য…’

পবিত্রের আসার খবরটা ইতিমধ্যে সমস্ত গ্রামে রাষ্ট্র হয়ে গেছে। যে পবিত্রকে পথে দেখতে পায়নি তারা পবিত্রের খবর নিতে আসে। ছোটদের বাড়ির সামনে থেকেই পবিত্র বিষয়ে যতখানি জানে তাবলে পবিত্র সারা দিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়েছে বলে তাদের বিদায় করে দেয়। যারা মনাইকে গুরুত্ব না দিয়ে একেবারে বৈঠকখানা ঘরের কাছে এসে পৌঁছায়, তাদের বাবা অথবা মা পবিত্র কতদিন থাকবে, পরীক্ষা কীরকম হল ইত্যাদি বিশেষ খবর দিয়ে সবাইকে এক কাপ চা এবং পবিত্র নগর থেকে নিয়ে আসা মিষ্টির দ্বারা আপ্যায়িত করে বিদায় দেয়। এভাবে পবিত্র আনা মিষ্টি শেষ হয়। তখন মা-বাবা দুঃখ করে বাকিদের বলে-‘পবিত্র এত কষ্ট করে এনেছে, তার জন্য এক টুকরো মিঠাই রাখতে পারলাম না। সকাল থেকে এতগুলো খবর নেওয়া মানুষ, কাকে না দিয়ে থাকব।’ যারা পবিত্রের আনা মিঠাই খেতে পেল না, তাদের ভেতরে মিষ্টির প্রতি লোভটা থেকে গেল যদিও মুখ ফুটে বলল, ‘মিষ্টি কীসের দরকার‌ সে যে ভালো মতো এসে পৌঁছেছে সেটাই যথেষ্ট। মিষ্টি খাবার দিন কি চলে যাচ্ছে? ওকে ঈশ্বর ভালো রাখুন, ভবিষ্যতে সে আনা মিষ্টি খেতে পাব’। এরপর অনেকক্ষন পবিত্রের প্রশংসায় মুখরিত আলোচনায় তাদের বৈঠকখানা ঘর উত্তপ্ত হয়ে থাকে। বাড়ি থেকে একটি ছোট ছেলেকে পাঠিয়ে ভাত খাওয়ার সময় হয়েছে বল না বলা পর্যন্ত কারও যেন যাবার সময় হয় না। মানুষগুলি যাবার সঙ্গে সঙ্গে মা এসে পবিত্রকে বলে-‘ওঠ তাড়াতাড়ি স্নান করে নিয়ে ভাতটা খেয়ে নে। পুনরায় কেউ আসবে মনে হয়।’ স্নান করে ভাত খেয়ে উঠতে না উঠতেই পবিত্র শুনতে পেল, ‘এই যে পবিত্রের মা,বাড়ি আছ?’অথবা খুড়ি,মাসি,পিসি সম্বন্ধের কেউ এসে একেবারে পেছেনের বারান্দায় পৌছানর খবর আসে। মা তাদের বসতে বলার জন্য বাইরে বেরিয়ে যায়। উঠোন থেকেই তারা পবিত্রের খবর করার জন্য আসার দেরি করার কারণ ব্যাখ্যা আরম্ভ করে। বলল, ‘কী আর বলব পবিত্রের মা, তিনি এখন থেকে যেতে দেরি করলেন,বললেন একবার দেখা করে পবিত্রের খবরটা নিয়ে আসি। এসে একেবারে আঠার মতো লেগে রইল। আসার সময় আমি বলেছিলাম দেরি কর না, আমিও একবার দেখতে যাব। তবে সে কথা মনে থাকলে তো। ওদিকে আমি দ্রুত ভাত রান্না করে ছেলেমেয়েদের খাওয়ালাম। তবুও স্বামীর দেখা নেই। শেষে ছোট ছেলেকে পাঠিয়ে ডাকিয়ে নিয়ে কোনো মতে ভাতটা দিয়েই সোজা চলে এসেছি।’

এই যে মহিলাদের আসার স্রোত আরম্ভ হল সেটা দুপুর পর্যন্ত বজায় থাকে। তারপর বিকেল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পবিত্রের সঙ্গীদের মধ্যে একজন দুজন করে হাজির হতে থাকে। পবিত্রদের বাড়িতে কোনো ছোট ছেলেমেয়ে না থাকলেও ওদের বাড়ির উঠোনটা সেদিন ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে ডাং গুটি খেলার উঠোন অথবা ‘এম-আই-এস খেলার উঠোনে রূপান্তরিত হয়। যে অঞ্চলের সেই একমাত্র গুয়াহাটির কলেজে পড়া ছেলে, সেরকম একটি জায়গায়ও এম-আই-এস শব্দ তিনটি কীভাবে এসে প্রবেশ করল তা চিন্তা করে তার বড় অবাক লাগে। পবিত্রের সঙ্গে কর্ণধর, গোলাপ, অভয়রা এসে ওদের আসার দেরি হওয়ার জন্য ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়ার মতো করে বলে-‘তুই আসার খবর আমরা তখনই পেয়েছি। একবার এসে ঘরের সামনে দিয়ে ঘুরে গেছি। ধনাই দাদা বলল, বুড়োদের দেখাশোনা নাকি শেষ হয়নি। বাড়ির সামনে থেকে ফিরে গেলাম। দুপুরবেলা ভাবলাম, ‘ক্লান্ত হয়ে এসেছে, এখন গিয়ে কেন অসুবিধা করব। কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে নেবার পরে যাব।’ এর পরে পবিত্র ওরা এলেও যে তার কোনো অসুবিধা হত না…’সেকথা বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করে। ঠিক তখনই মা ওদের জন্য চা নিয়ে ঘরে ঢোকে।

এটাই হল পবিত্র কলেজে যাওয়ার দিন থেকে সে গুয়াহাটি থেকে ফিরে আসার দিনের কার্যবিবরণী। ঠিক যেন কিছু একটা বিরাট উৎসবের প্রস্তুতি।ঠিক এরকম এক পরিবেশে ওদের ঘরটা দুদিন উৎসবমুখর হয়ে থাকে। সেই কয়েকদিন ওদের বাড়িতে নিয়ম অনুসারে কাজ হয় না। শেষ পর্যন্ত এরকম হয় যে চা করার কাজটা প্রতিবেশীর মেয়ে দুটিকে বিয়ে বাড়িতে চা করার মতো ভাগ করে দিতে হয়।

পবিত্র কখন এসে গ্রামের কাছে পৌঁছাল তা নিজেই বলতে পারল না। রেল স্টেশন পার হয়ে একটা বিরাট জঙ্গল। রাস্তায় একটি মানুষ নেই। আগে এই জঙ্গল একা পার হয়ে আসতে পবিত্রের ঠিক ভয় না হলেও কেন জানি ভালো লাগত না। বাবার মুখে শোনা কথা, সেই জঙ্গলে কিছু বছর আগে পর্যন্ত বাঘ বের হত। এমনকি বেশি বন্যা হলে কাজিরাঙ্গা থেকে কখনও কখনও বাঘ যে বেরিয়ে আসে না তা নয়। বর্তমানে বাঘের ভয় নেই কিন্তু জঙ্গলটা বড় গভীর। গ্রামের মানুষ সাধারণত একা আসা-যাওয়া করে না। এমনকি ধনাই দাদাও তাকে গরুর গাড়িতে করে নিয়ে আসার সময় গ্রামের কোনো একজনকে সঙ্গে নিয়ে আসে। পবিত্রকে আনতে যাওয়ার জন্য যুবকদের অভাব হয়না। নিজেরাই উপযাচক হয়ে এসে হাজির হয়।

জঙ্গল পার হওয়ার পরে ধানের ক্ষেত। এবার বর্ষা দেরি করে এসেছে,তাই চাষের কাজে কিছুটা দেরি হয়েছে। তবু ধানক্ষেত দেখে পবিত্রের মনে হল এবার আগের চেয়ে ভালো ফসল হয়েছে।

পবিত্রের জন্ম এই ন-পাম গ্রামে যদিও গ্রামটি খুব বেশি পুরোনো গ্রাম নয়। আগে এখানের মানুষ ছিল উত্তর পারে। কিন্তু পঞ্চাশের ভূমিকম্পের সঙ্গে হওয়া বন্যায় সমগ্র গ্রামটা উচ্ছন্নে যায়। তারপরে এসে জঙ্গল কেটে এই ন-পাম গ্রাম স্থাপিত হয়। মানুষ গুলি কীভাবে এসে এই গ্রামের সৃষ্টি করল পবিত্র ভালো করে তা জানে না। কারণ এটা তার জন্মের বহু আগের কথা। ওদের গ্রামের পাশে একটি নতুন পামে চাষ করা মানুষের গ্রাম। ওরাও একদিন পেটের তাড়নায় পূর্ববঙ্গ থেকে থেকে এসে এই মানুষগুলো এখানে বসতি স্থাপন করেছিল। পবিত্র জানে না এই সমস্ত মানুষ কবে এসে এখানে বসবাস স্থাপন করেছে। ওদের ভাষার বহু পরিবর্তন হয়েছে। তার মতো যুবকেরা শুদ্ধ অসমিয়াতে কথা বলে। বাড়িতে অবশ্য কথাবার্তা নিজেদের ভাষায় বলে। দুটি গ্রামের মাঝখানে যে এলপি স্কুল রয়েছে,যেখানকার হেড পন্ডিত তার পিতা, সেই স্কুলে দুটি গ্রামের ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করে। এই মানুষগুলি অসমিয়া সমাজের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলে মিশে গেছে যদিও তারা এই গ্রামে নিয়ে এল একটি নতুন জিনিস- দুর্গাপূজা। সাঙ্কার-।অসমের গ্রাম অঞ্চলে দুর্গাপূজা দেখা যায় না। সে দিক থেকে এই গ্রামটি হল ব্যতিক্রম। এই দুর্গাপূজায় যেভাবে ওদের গ্রামের মানুষ অংশগ্রহণ করে, ঠিক সেভাবেই ওদের গ্রামে যখন ভাওনা এবং বড় কোনো সভার আয়োজন করা হয় তখন সেই ভাওনা দেখার জন্য এই গ্রামের মানুষ দলে দলে এসে উপস্থিত হয়।

গ্রামের সামনে এসে পবিত্রকে এইবার থেমে যেতে হল।

‘এই যে, এটা পবিত্র নয়?’ পবিত্রকে দেখে ধর্মেশ্বর কাকা বাড়ি থেকে আওয়াজ দিল এবং একেবারে এক দৌড়ে এসে রাস্তায় হাজির হল। গতকাল তোমার বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন পুজোয় আসবি বলি। তুই দেখছি তার আগেই এসে হাজির হলি। কলেজ বন্ধ হয়ে গেল নাকি?’

‘হয়ে গেছে’, যতটা সম্ভব পবিত্র সংক্ষিপ্ত উত্তর দিতে চাইল। কারণ এর পরের প্রশ্ন যে তার জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর হবে সে কথা সে জানে। একদিকে অসমিয়া আন্দোলন, অন্যদিকে বাঙালি মানুষ ন-পাম গ্রামে মিলে মিশে থাকে। এখানে যে একটি এলপি স্কুল আছে সেই স্কুলের ভাষার মাধ্যম নিয়ে কেউ কোনোদিন প্রশ্ন করে নি। কিন্তু হঠাৎ যদি শহর থেকে এসে এই সংক্রামিত বিধি এই গ্রামকেও স্পর্শ করে যায় সেটা কম দুঃখের কথা হবে না। তার নিজেকে বীজাণু বহন করে আনা মাছির মতো মনে হল। কারণ সে কেন আগে চলে এল সেটা অন্তত ফাঁকি দিয়ে আটকানো যাবেনা।কিন্তু সত্যি কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ট একটি কথা সমগ্র গ্রাম অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশি সময় লাগবে না। সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের দু-পাশে থাকা দুই দল মানুষের মধ্যে একটা সন্দেহের ভাব চলে আসবে- বিশেষ করে যে সমস্ত মানুষ পূর্ববঙ্গ থেকে এসে একদিন এই জায়গায় বসবাস শুরু করেছিল। সেই মানুষগুলির মনে সৃষ্টি হবে এক নতুন আতঙ্ক।

‘এবার বন্ধ কিছু আগেই দিয়ে দিয়েছে কাকা’। পবিত্র বলল , ‘বাড়িতে আসার খবর দেওয়া হল না, সেইজন্য বাবা জানে না।’

‘তোর জিনিসপত্র কোথায়?’কাকা জিজ্ঞেস করলেন, মানুষটা দেখছি একা।’

‘রেল স্টেশন মাস্টারের হাতে সমঝে দিয়ে এসেছি। ধনাইদাকে পাঠিয়ে আনাতে হবে।’

পবিত্র আর দাঁড়াল না।

পবিত্র জানে এরপরে বুড়ো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করবে। ছোট একটি ব্যাপার কে বাড়িয়ে বলা ধর্মেশ্বর কাকার অভ্যাস। এখন যদি বলা হয় যে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো গণ্ডগোল হওয়ার আশঙ্কায় কলেজ আগে থেকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে- কথাটা রঙ মাখিয়ে সমস্ত গ্রামে ছড়িয়ে দেবার জন্য ধর্মেশ্বরের মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে।

‘তুই চলে যাবি? একটু জল খেয়ে যাবি না?’- ধর্মেশ্বর কাকা জিজ্ঞেস করলেন,‘খুড়িকে না বলে গেলে খারাপ পাবে।’

‘লাগবেনা কাকা’, পবিত্র বলল, ‘আমি কিছুদিন থাকব যখন চলে আসব। দেরি করলে মা খারাপ পাবে।খুড়িমাকে বলবেন আমি একদিন বিকেলে এসে দেখা করে যাব।’

‘যা যা’ ধর্মেশ্বর কাকা বললেন,‘রাস্তায় দেরি করলে মা আবার আমাদের উপর রাগ করবে। আমি স্নান করে নিয়েই তোদের দিকেই যাচ্ছি।’

ধর্মেশ্বর কাকার শুরু। এরপর একের পর এক বাড়ি না পৌঁছানো পর্যন্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। পবিত্র কিন্তু এগোতে লাগল, কোথাও দাঁড়াল না। সে জানে থামলেই বিপদ। সে কোনোখানে দাঁড়ানো মানে তাকে ঘিরে মানুষের ভিড়ের সৃষ্টি হবে।

ঘরের কাছে পৌঁছে পবিত্র দেখল বাবা বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছে। এই অঞ্চলে মাত্র দুটি কাগজ আসে। একটি পবিত্রদের বাড়িতে আর অন্যটি গ্রাম থেকে তিনমাইল দূরে থাকা পাকা রাস্তার কাছে মৌজাদারের বাড়িতে। ডাকে আসা কাগজ গ্রামে পৌঁছাতে যে কতদিন লাগে তার ঠিক নেই। তবুও দশ পনেরো দিনের পুরোনো কাগজ পড়ার জন্য বাবা আশা করে বসে থাকেন। গ্রামে পিয়ন প্রতিদিন আসে না, সাপ্তাহে একবার আসে। সেই দিনটিতে পবিত্রের চিঠি এবং এক সপ্তাহ পর্যন্ত জমা হওয়া কাগজ নিয়ে দূরে থাকা ডাকঘরের পিয়ন এসে উপস্থিত হয়। গ্রামের অন্য মানুষের তেমন কোনো চিঠিপত্র আসে না। সেইজন্য পিয়ন এসে পবিত্রদের বাড়িতে ঢুকে দুপুরের খাবারটা পবিত্রতার বাড়িতে খেয়ে দেয়ে যাওয়ার সময় বাড়ির লাউ কুমড়ো অথবা বরা চাল,জুহা চাল যা হাতের কাছে পায় তাই নিয়ে যায়। বাবাও বড় আনন্দের সঙ্গে এগুলো বেঁধে দেয়। কখনও ঘরে নানা ধরনের জিনিস থাকলে সাইকেলের ক্যারিয়ারে পোস্টমাস্টারের জন্য একটা ব্যাগ দিয়ে দেন।

‘ও, পবিত্র দেখছি।’ অবাক হওয়ার মতো পবিত্রের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। তার পরে পবিত্রের উত্তরের পথ না চেয়ে ভেতরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করলেন, ‘এই যে পবিত্রের মা, দেখ পবিত্র এসেছে। পিতার চিৎকার শুনে মায়ের চেয়েও আগে পড়ার টেবিলে থাকা সাবিত্রী অবাক হওয়ার মত চিৎকার করলঃ ‘ও মা দাদা।’ তার চিৎকারে রান্নাঘর থেকে মা দ্রুত বেরিয়ে এল।

‘তোর কথা আমি কাল থেকেই চিন্তা করছিলাম’… বাবা বললেন, ‘কাল হিরণ্য পিয়ন এসে বলে যাবার পর থেকেই বড় দুশ্চিন্তায় ছিলাম। এসে ভালোই করলি বাবা। মা চিন্তা করবে বলে আমি কিছুই বলিনি। জিনিসপত্র কিছুই আনতে পারিসনি নাকি?

বাবা যেভাবে বললেন পবিত্রের মনে হল যে সমস্ত জিনিসপত্র ফেলে রেখে সে মাত্র প্রাণটা নিয়ে কোনোমতে বাড়ি এসে পৌঁছেছে।

‘হিরণ্য পিয়ন কি বলে গেল?’ অবাক হওয়ার মত মা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কালকেই জানতে পেরেছিলেন যদি আমাকে কেন বলেননি,ধনাইকে দিয়ে গাড়িটা স্টেশনে পাঠালে না,এতটা রাস্তা হেঁটে একা একা আসতে হল।’

‘দাঁড়াও, তুমি এসব কী বলছ’ বাবা মাকে বললেন, আমি আসবে জানলে তোমাকে জানাতাম না?তুমি এইসব কিছুই বুঝবে না, তুমি তাড়াতাড়ি ওকে হাত মুখ ধুয়ে কিছু একটা খেতে দাও, এতটা রাস্তা, কোথাও কিছু খেতে পেয়েছে কিনা কে জানে।’

‘আমি আপনি বললেই কিছু খেতে দেব?রাগ করে মা ভেতরে ঢুকে গেল। তোকে বাবার সঙ্গে আড্ডা মারতে হবে না। মুখ-হাত ধুয়ে রান্না ঘরে আয়…’

মা আর দাঁড়াল না। বাবার কথায় মায়ের যে অভিমান হয়েছে পবিত্র বুঝতে পারল। কিন্তু অন্যদিন হলে মায়ের এই অভিমানে যতটা আনন্দ পেত সেরকম আনন্দ আজ পেল না। সে ভেবেছিল সংক্রামক ব্যাধির বীজানু বহন করে আনা সে একটা মাছি, কিন্তু সে দেখল তার চেয়েও আগেই শহরের এই সমস্ত খবর এসে তার গ্রামে পৌঁছে গেছে । পদার্থ বিজ্ঞানের বইয়ে সে পড়েছিল আলোর বেগ শব্দের চেয়ে বেশি, কিন্তু তার এরকম মনে হল সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের গতি যেন আলোর চেয়েও বেশি। পবিত্র কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। সেই জন্য বাবা তাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হল তুই দেখছি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লি? পথে কোনো অসুবিধা হয়েছিল কি?’

‘ না না, কোনো অসুবিধা হয়নি’,পবিত্র বলল, ‘মানুষের মধ্যে এখন পর্যন্ত খুব আলোচনা হয়নি’,বাবা বললেন,‘গতকাল হিরণ্য পিয়ন কাগজগুলি দিতে এসে আমাকে বলল। সে ও ভালো করে জানে না। এই সমস্ত পুরোনো কাগজ, তার মধ্যে তেমন কোনো খবর নেই। মাধ্যম নিয়ে কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে গুয়াহাটিতে সেটা বুঝতে পারছি। বেশি করে কিছু হয়েছে নাকি?তুই দেখছি একটা ব্যাগ পর্যন্ত সঙ্গে নিয়ে আসিস নি,কিছুই আনতে পারিসনি বুঝি?’

‘না না,সেরকম কিছুই হয়নি’,পবিত্র বলল, ‘ স্টেশনে রেখে এসেছি,ধনাইকে পাঠিয়ে আনাতে হবে।’

‘ভালোই করেছিস’,বাবা বললেন,‘ মাস্টার ভালো আছে তো? বহুদিন সেদিকে যেতে পারিনি।’ ‘ভালোই।আমি তাদের বাড়িতে চা-টা খেয়ে এসেছি। তিনি কিছুতেই ছাড়লেন না।’

ভালোই করেছিস, ভালোই করেছিস…

ঠিক তখনই বোন সাবিত্রী ভেতর থেকে এসে বলল, দাদা মা ডেকেছে…’

‘যা যা বাবা’ বাবা বললেন, ‘মায়ের রাগ হবে, আমি ধনাইকে খুঁজতে থাকি, গাড়ি পাঠিয়ে জিনিসগুলো আনার ব্যবস্থা করতে হবে।


ক্রমশ