শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

করোনাকালের ডায়েরি, পর্ব ৪

শেখরবাবু মনে মনে হাসেন । তিনি জানেন সনৎ কথাটা বলছে অত্যন্ত আবেগে , তাঁর প্রতি ভালোবাসার টানে ।

--- চাইরপাশের যা অবস্থা দ্যাখ্তাছি হেতে কি লেখায় মন বসান যায় ক , রাইতে ঘুম আসে না , চ্যাষ্টা ত করি ...

--- হ ল্যাখ,প্যানিক হইস না , এই করোনা পরস্থিতিতে তুই যা দ্যাখ্তাছস , যা শুনতাছস হে নিয়াই ল্যাখ...তুই ত কইতি লেখার মূলে থাকে আনন্দ ,অখন ত হেই আনন্দ নাই , নিরানন্দরথিক্যাই তরে মালমসলা লইতে হইব ...

সনতের এই কথায় শেখরবাবু চমকে উঠলেন । এ কথাটা তো তাঁর আগে মাথায়আসেনি !

--- ঠিকই কইছস সনৎ, এই আইডিয়া টা আমার আগে মনে আহে নাই ,মেনি থ্যাংকস সনৎ...আমি লেখুম, আমার মনে হয় এতে কইরা একটু রিলিফ পামু ...কাঁটা দিয়া কাঁটা তুলন যাইব ....

--- হ ল্যাখ ল্যাখ শ্যাখর ল্যাখা , ভয় পাইয়া কি হইব , মরতে তো হইবই একদিন , তার আগে যে কামটা আমাগ করনের , হেইটা কইরা লওনেই ভাল , কী কছ ঠিক না ? তবে শ্যাস কথা হইল ভাল থাকবি , সাবধানে থাকবি হগ্গলরে লইয়া ...

বলতে বলতে সনৎ ওপারে মোবাইলটা বন্ধ করে দেয় ।

শেখরবাবু মনে মনে বলেন , আরে সনৎ তরে কী কইরা বোঝাই, আমি যদি চইল্যা যাই তো গেলাম , কিন্তু আমার উদ্বেগটা হইতাছে , আমার আতংকটা হইতাছে আমার পরিবার , আমার আত্মীয়স্বজন আর আমার বন্ধু-বান্ধব গোলইয়া ! আমার সারাদিন - সারারাইত চিন্তা একটাই হেরা কী ভাবে বাঁচব । আমার সইদ্য ইলেকট্রিকেলে এম-টেক পাশ করা নাতিটা, সইদ্য পিএইচ ডি পাওয়া নাতনিটা দিনকে দিন ডিপ্রেসেড হইয়া যাইতাছে। চাকরির রাস্তাগুলো বন্ধ হইয়া যাইতাছে এই করোনার লাইগ্যা ! হেগমতন আরো পোল-মাইয়া আছে যেগুলারএকই অবস্থা । প্রত্যেকদিনই আত্মীয়স্বজন -বন্ধুবান্ধবগো মইধ্যে কারোনা কারোর আক্রান্ত হওনের খবর পাইতাছি । প্রত্যেকদিনই যে এই শহরে আক্রান্তের ওমৃতের সংখ্যা বাইড়া যাইতাছে আর হাসপাতালগুলাতে যে বিছানা খালি থাকতাছে না হেই খবরও খবর -মাধ্যমগুলা দিতে ভুলে না ! এই চিন্তাও আমারে কূইরা কুইরা খায়...

তবুও শেখরবাবু মনে মনে বন্ধু সনৎকে আশ্বাস দেন এই বলে যে , লেখুম বন্ধু লেখুম , বর্তমানের এইকঠিন সময়ে যে অভিজ্ঞতা আমার হইছে আর হইব হে লইয়া আমি লেখুম , কলম বন্ধ করুম না...

ভাবতে ভাবতে শেখরবাবু যে লেখাটি নিয়ে বসেছিলেন সেটায় মনোযোগ দিলেন ।...শুরু করার আগেএকটু ঝালাতে থাকলেন অসম্পূর্ণ লেখাটিকে নিয়ে । ক্যামু ড : রিউ নামে যে মূল চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন সেটানিয়েই তোতিনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন। আজকের দিনের চিকিৎসকদের কাছে অত্যন্তশিক্ষনীয় এইচরিত্রটি । চরিত্রটি একেবারে কাল্পনিক নয়, ক্যামুর স্বচক্ষে দেখা । নিজের জীবন সংশয় হবে জেনেও স্ত্রী -পরিবারের কথা ভুলে গিয়ে প্লেগ রোগীদের দিনের পর শুশ্রুষা করে গেছেন এই ড : রিউ।... শেখরবাবু আবার কলম চালাতে শুরু করলেন ...

ক্যামুপেয় বসেছে শেখরবাবুকে । জেদ ধরলেন আজ তিনি লেখাটি শেষ করবেনই । মাঝখানে শ্যামলীর ডাকে লাঞ্চটা করে আবার বসলেন লিখতে । শেষ করতে করতে হয়ে গেল প্রায় সন্ধে।একটা বিরাট চাপ যেন মাথা থেকে নেমে গেল ।এরপর শ্যামলীর হাতে বানানো এক কাপ চা খেয়ে একটু হাল্কা হওয়ার জন্য আবাসনের দশ তলা শিখরের ছাতে উঠে এলেন শেখরবাবু । এই উঁচু শিখর থেকে চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখলেন তিনি, জীবন যেন ওখানে জ্বল জ্বল করছে ! সড়কে সড়কে বাহনে বাহনে ছয়লাপ ! চারদিকে এখন আনলক চলছে । কিন্তু যতই আনলকের আলোকমালা জ্বলে উঠুক না কেন তার নেপথ্যে যে নিয়ত চলছে আতংকের পাথরভাঙা কাঁপন আর নদীর পারভাঙা দীর্ঘশ্বাস সেটা শেখরবাবু ভালো মতোই জানেন । তবুও মনের অন্দরে একটু চাপ লাঘবের আশায় আনমনে ওদিকেই তাকিয়ে রইলেন তিনি । কিন্তু সদ্য যে লেখাটি শেষ করে এলেন সেটার হয়ে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে যে-প্রিয় মানুষটির ভরসা , যে-প্রশ্রয় সেগুলো অজান্তেই গুঞ্জরিত হয়ে ওঠে তাঁর মনের ভেতর । ... ভাস্কর বলেছিল , শেখর, আজকের এই প্রখর অতিমারীর দিনে ক্যামুর ' দ্য প্লেগ ' কিন্তু দারুণ প্রাসঙ্গিক । ও নিয়ে কিন্তু বিশেষ লেখালেখি হচ্ছে না বাংলায়। শুধু দিল্লির একটি ইংরেজি পত্রিকায় এ বিষয় নিয়ে একটি লেখা বেরিয়েছে দেখলাম । শেখর, বইটি পড়ে তুই কিছু লেখ । অনুবাদটা পরে করলেও চলবে । ওটা তো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার । হ্যাঁ ,ভাস্করের অনুপ্রেরণাতেই লেখাটা শুরু করেছিলেন শেখরবাবু। ' বার্তালাপ' পত্রিকার সংগে কথাও হয়ে গিয়েছিল ।মনে মনে ছক কষেছিলেন তিনি , লেখাটি ' বার্তালাপ'-এ বেরোনোর পর ভাস্করকে লিংক পাঠিয়ে তাক লাগিয়ে দেবেন । কিন্তু হলো না , মনের আকাঙক্ষা অসম্পূর্ণই রয়ে গেল । নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না শেখরবাবু । দু চোখ ফেঁটে জল বেরিয়ে এলো তাঁর ! ...

ফ্ল্যাটে ফিরে এসে শেখরবাবু টের পেলেন ঘরের পরিবেশটা যেন কেমন অন্যরকম-অন্যরকম ঠেকছে এখন ...। এ সময় থেকে তো শ্যামলী টিভিতে মজে থাকে, একেবারে রাত দশটা তক। টিভির কোনো আওয়াজ নেই কেন ? শেখরবাবুশ্যামলীকে খুঁজে পেলেন বসার ঘরে । সংগে রয়েছে নাতনি সাগরিকা আর ছেলের বৌ মাধবী। ওদের তিন-জনেরই চোখমুখ থমথমে ! শেখরবাবুকে দেখে সাগরিকা বড়ো বড়ো চোখ করে বলে ওঠে , ঠাউদ্দা , ঢুইক্যা পড়ছে ...

--- মানে ! কী ঢুকছে !

--- করোনা ...

--- কৈ ?

--- নিচের তলায়...

এবার শ্যামলী মুখ খোলে , কৌশিক দাসের বড় পোলাটারে ধরছে ...

শেখরবাবু কৌতূহলী হয়ে ওঠেন , বিপুল , পোস্টাফিসে কাম করে ?

--- হ

--- আহা , ক্যামতে লাগল ?

--- কী জানি , ক্যামতে লাগল, হঠাৎ নাকি জ্বর উইঠ্যা পড়ছিল , কাশতাছিল ...

শ্যামলীরমুখে ' কাশি ' শব্দটা শুনে শেখরবাবুর মনে হলো তাঁরও কাশি পেয়ে যাচ্ছে !আজ সকাল থেকে মনে হচ্ছিল তাঁরও গলাটা যেন কেমন খুশখুশ করছে ...। বুকটা ধকধক করে লাফাতে শুরু করলোতাঁর । ওই অবস্থায় জানতে চাইলেন

--- অখন কৈ হে ?

--- সোজা অফিস থিক্যা হাসপাতালে লইয়া গেছে ...

--- ঘরের বাকিরা ?

--- বাকিরা মানে কৌশিকবাবু ,বানীদি আর বিপুলের বৌ ঝরনা , হেগ তিনজনেরই নিগেটিভ , তবুও ঘর সিল কইরা দিসে , হেরা ঘরের বাইরে যাইতে পারব না ...

--- এর মইধ্যে এত কান্ড হইয়া গেছে !

--- হইছে দুপুরে , আমরা অখন জানলাম , আমার দীপকটারে লইয়া বড় চিন্তা হয়, ব্যাংক থিক্যা এত্ত দেরি কৈরা আহে !

--- ওই রিকা শুভ কৈ ?

শেখরবাবু নাতনি সাগরিকার কাছে নাতির খবর জানতে চান। সাগরিকা জবাব দেয় , ভাই একটু চারালি গেছে, অর মোবাইলটার নেটের নেকি কি একটা প্রবলেম হইতাছে , ঠিক করাইব , অ মাস্ক পইরাই গেছে , পকেটে সেনিটাইজারও লইয়া গেছে ...

--- এত সাবধানে থাইক্যাও ত হয় , হে জানে না নেকি , পরে করাইলে কী হইত ?

নাতির উদ্দেশ্যে রাগটা শেখরবাবু ঝাড়লেন নাতনির ওপর । নাতনি জানায় , তুমি বুধয় জান না ঠাউদ্দা , শুভ কাউরে না কইয়া আবারকম্পিউটার সাইন্সনিয়া পড়তাছে দিল্লি আই আই টি তে , অন লাইনেই এডমিশন হইছে , ক্লাশওহইতাছে অন লাইনে , পরে কল্লে হইব না ...

বলতে বলতে সাগরিকা কেশে উঠে ।

শেখরবাবু আঁতকে উঠেন , কিরে রিকা তুই কাশস ক্য্যন !

--- এইটা আমার অ্যালারজির কাশি মাঝেমাঝেই হয় ...

--- ওই রকম কাশি আমারও হয় , আমার গলায় কফ আটকাইয়া থাকে ...

শ্যামলীও নাতনির পক্ষ অবলম্বন করে কথাটা বলে । শেখরবাবুর বুকের ধড়ফড়ানি আরো বেড়ে যায় , কও কি শ্যামলী তোমাগোও কাশি হয় , আমারও ত গলাটা ক্যামন চুলকায় ...কী হইল শ্যামলী আমাগও কি সোয়াব টেস্ট করান দরকার ?

শ্যামলী উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে , তুমার কি মাথা খারাপ হইছে ? যাও কি কাম আছে কর গিয়া অখন , এই নিয়া আর ভাবতে হইব না তুমারে ...

শেখরবাবু শ্যামলীর ধাতানিখেয়ে চলে যান লেখার ঘরে । কিন্তু দুশ্চিন্তা দূর হয় না মাথা থেকে । ভাস্করেরও কাশি হয়েছিল , ওর সংগে মোবাইলে শেষ কথায় ও কেশেছিল , বিপুলেরও কাশি , যারা কোভিডে আক্রান্ত হয় তাদের সবারইজ্বরের সংগে কাশি হয় শুনেছেন , শ্যামলী কাশলো , সাগরিকাও কাশলো, তাঁরও কাশি-কাশি ভাব কী হবে কে জানে , এরপর যাতে জ্বর না ওঠে ...

ভাবতে ভাবতে শেখরবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন ...।

এক সময় ছেলে দীপক ফিরে এলো ব্যাংক থেকে । নাতি শুভও ফিরে এলো নেট ঠিক করে । যে যার জামাকাপড় ধুইয়ে আর চান করে ঢুকে গেল নিজের নিজের ঘরে । এটা ওদের প্রতিদিনকার অভ্যেস । ছেলে ওর ঘরে ঢুকে চালিয়ে দেয় ন্যাশানেল ইংলিশ নিউজ প্রোগ্রামগুলি , বৌ মাধবীস্বামীর জন্য চা জলখাবারের ব্যবস্থা করে । নাতি শুভ দরজা বন্ধ করে অন লাইন স্টাডিতে মগ্ন হয়ে পড়ে ...। নাতনি সাগরিকাও ওর ঘরে চলে যায় । সেখানে অন লাইন গ্রুপে মেতে ওঠে , বিভিন্ন চাকরির প্রস্তুতি নেয় , গান গায় , আবৃত্তি করে । মাঝে মাঝে অন লাইনে ক্লাশও নিতে হয় । টিউশানির একটা বড় গ্রুপও আছে ওর ।ফিজিক্সের ।

শ্যামলী এবার শোবার ঘরে গিয়ে চালিয়ে দেয় ওর প্রিয় সিরিয়াল ...। শেখরবাবুও এ সময়টায় আর সিরিয়াস কিছুতে আটকে থাকতে চাননা । চলে যান শ্যামলীর সিরিয়ালের জগতে ...। থার্ড গ্রেড সিরিয়াল হলেও কিছুক্ষণের জন্য বাস্তবকে ভুলে থাকা যায় । এ সময়টায় শ্যামলীকে নিরিবিলিও পাওয়া যায় । ইচ্ছে করে শ্যামলীর সংগে একটু প্রেম করতে , যেভাবে প্রেম করতো বিয়ের আগে নেহেরু পার্কে ঝাউ গাছের আড়ালে । দু একবার চেষ্টা করেছিলেন শেখরবাবু শ্যামলীকে কাছে টেনে নিতে , শ্যামলী রে রে করে কোনদিনফিসফিসিয়ে বলে উঠেছিল , এই অখনই রিকা আইস্য্যপড়ব , রিকা কিন্তু এই সিরিয়ালটা মাজেমইধ্যে দ্যাখে । কোনদিন বলে , ইহ , এই বুড়া বয়সেও তুমার মনে রস আছে দেখতাছি...

--- ক্যান , তুমার কুন সন্দেহ আছে নেকি তুমারে দেখলে যে আগের মতন আমার মনে রস আইবো না ...

--- ধেত, এই বয়সে ভীমরতি ধরছে তুমারে ...

বলতে বলতে শ্যামলী শেখরবাবুর কাছ থেকে একটু দূরে সরে বসে । শেখরবাবু শ্যামলীর দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে ব্যঙ্গ হাসেন ।

রাত দশটারপর সব ঘরের টিভি বন্ধ হয়ে যায় । তখন সবাই গিয়ে বসে ডিনার টেবিলে । এক মাত্র বসে না শুভ। ও কম্পিউটার নিয়ে লেগেই থাকে । ওকে খাইয়ে দেয় মা মাধবী । ডিনারে সবাই চুপচাপ খায় । দীপকটা বেশি কথা বলে না । যা বলার বলে সাগরিকা । কিন্তু সে শুধু নিজের ক্যারিয়ার নিয়েই বাবার কাছে হা-হুতাশকরে । দীপক শুনেও না শোনার ভান করে । শেখরবাবু হঠাৎ বলে ওঠেন , শুনছস ত আমাগ বিল্ডিংয়ের বিপুলের কথা ?

--- ওগুলা শুইন্যা কুন লাব নাই বাবা , আমাগ বাইরে গিয়া কাম করতে হয় , কখন কার শরীরে গিয়া ঢুইক্যা পড়েঠিক নাই , যতটুকু পারন যায় সাবধানে থাকাটাই হককথা ...

বলতে বলতে দীপক খাওয়া শেষ করে বেসিনে চলে যায় । শেখরবাবু অবাক হয়ে ভাবতে বসেন , এই কি তাঁর ছেলে দীপক , যে কিনা ভার্সিটিতে পড়ার সময়েও রাতে একলা ঘরে থাকতে ভয় পেত !

ধীরে ধীরে রাত গভীর হচ্ছে বুঝতে পারছেন শেখরবাবু ।বিছানায় শুধুই এপাশ ওপাশ । বাড়ির সবাই ঘুমে ডুবে আছে । শ্যামলীর নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস ...।দূরে রেলস্টোরের পেটাঘন্টিতে বাজে রাত দুটো । তাঁর দুচোখে ঘুম নেই ।তিনি জানেন বয়েস বাড়ার সংগে সংগেঘুমটাও কমে এসেছে তাঁর । রাতে দু আড়াই ঘন্টার বেশি ঘুম হয় না ।তিনটে -সাড়েতিনটের সময় উঠে লেখার ঘরেগিয়ে বসেন , লেখেন পড়েন , কখনোধ্যান করেন ।কিন্তু আজ শুরু থেকেই দু চোখের পাতা এক করতে পারছেন না তিনি ! খালি ভাস্করের চেহারাটা চোখের ওপর ভেসে উঠছে বার বার। কি জানি ওর সৎকার হলো কিনা ? নাকি এখনো পড়ে রয়েছে মর্গে ! ওর কথাবার্তা , ওর বাচনভঙগি , ওর স্মিত হাসি সব যেন একটা চলমান ছবি হয়ে পর পর ভেসে যাচ্ছে ওর চোখের ওপর দিয়ে ...। বিপুলটা হাসপাতালে এখন কী করছে ? ঘুমুচ্ছে না কাশছে ? ডাক্তাররা কি ওকে কোনো অসুধপত্র দিল । অনেকেই তো শুনেছেন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে, ও-ও যেন সুস্থ হয়ে ফেরে ...। হঠাৎ শ্যামলী ঘুমের মধ্যে কেশে উঠলো । শেখরবাবুর বুকে যেন ছ্যাঁকা লাগলো ! একি শ্যামলী কাশছে ! শেখরবাবু ওই মুহূর্তে কী করবেন বুঝে উঠতে পারলেন না ...। বিছানা থেকে নেমে উত্তেজনায়পায়চারি শুরু করলেন ...বুঝলেন আজ রাতে ঘুম তাঁর বিদায় নিল ...রেলস্টোরের ঘন্টায় তিনটা বাজল ...ভোর হতে আর কতক্ষণ ? হঠাৎ ভেতরের ঘর থেকে আরেকটা কাশি ভেসে এলো ! শেখরবাবু সচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন । কে কাশলো ? ওটা তো মনে হলো পুরুষের গলার কাশি ! দীপক নয়তো শুভ ...! উত্তেজনার পারদ আরো চড়ে গেল তাঁর ...। আসছে যে সকালটা সেটা কি তাঁর এই পরিবারে অন্যদিনের মতোই স্বাভাবিক ভাবে ফুটবে নাকি খানখান হয়ে ভেঙে পড়বে ! ...দেখতে দেখতে আকাশ পরিস্কার হয়ে আসছে ...। কেউ যদি উঠে দেখে তিনি পায়চারি করছেন তাহলে উপায় নেই , প্রশ্নের পর প্রশ্নে জর্জরিত হতে হবে ...।শেখরবাবুর ইচ্ছে হলো লেখার ঘরে গিয়েবসেন । কিন্তু শরীরটা এতই ক্লান্ত হয়ে উঠেছে যে একটু শুতে পারলে ভালো হতো । ভাবা মাত্রই তিনি বিছানায় গিয়েশুয়ে পড়লেন । এবংশোয়ামাত্রইচোখ দুটো তাঁর ক্লান্তিতেলেগে আসে।

শ্যামলীর ডাকে যখন ঘুম ভাঙলো শেখরবাবুর, তখন রোদ চড়ে গেছে।

--- কী হইল, আইজ এতক্ষণধইরা গুমাইতাছ , শরীর -টরীরখারাপ কল্ল নেকি !

শ্যামলীর গলায় উৎকন্ঠা ।

শেখরবাবু ধড়মড় করে উঠে বসে চারদিকে চোখ ঘুরাতে থাকেন । ঠিকই, সকালের প্রথমভাগ পেরিয়ে গেছে ।শেখরবাবু ঘুমভাঙা চোখে শ্যামলীকে শুধোয়, তুমি কখন উঠছ?

--- ক্যান , ছয়টার সময় ত আমার এমনিতেই ঘুম ভাইঙ্গা যায় ।আটটা বাজার লগে লগেই ত দীপক অফিস যায় গিয়া, ডাইল-ভাত-তরকারিটা ত রান্না কইরা দিতে হয়...

শেখরবাবু দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকান । সাড়ে-আটটা । হঠাৎ তিনি শ্যামলীকে জিজ্ঞেস করে বসেন , দীপক কি কাশছিল ?

শ্যামলী চমকে ওঠে , কও কি , আমি কি অত খেয়াল করছি নেকি দীপক কাশছে কি কাশে নাই ! তুমার মাথাটা খারাপই হইল বুজি ...। বৌমা তুমার লাইগা চা বানাইয়া রাখছে ফ্লাক্সে , মুখটুক ধুইয়া খাইয়া লও ...

বলতে বলতে শ্যামলী রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।

শেখরবাবুর সাহস হলো না শ্যামলীকেওজিজ্ঞেস করতেসে-ও কেশেছিল কিনা ?

এবার বাকি রইলো শুভ । ওরতো উঠতে উঠতে বেজেযায় এগারোটা । অনেক রাতে ঘুমুতে যায় ।

শেখরবাবু বিছানায় বসেকিছুক্ষণ ধ্যানে মগ্ন থাকতে চাইলেন কিন্তু মন নিবিষ্ট হলো না । এরপর চোখমুখ ধুয়ে , প্রাতরাশ সেরে লেখার ঘরে গিয়ে বসেন । তারপর একটু বাদে-বাদেই মোবাইলের ঘড়ি দেখেন আর তক্কে তক্কে থাকেন কখন শুভ দরজা খুলে বেরিয়ে আসবে ।

আজ দশটা না বাজতেই শুভর ঘরে দরজা খোলার শব্দ কানে এলো শেখরবাবুর ।তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি! শুভর এত তাড়াতাড়ি ওঠার কারণ কী ? নিশ্চয় শরীরে কোনো অসুবিধে হচ্ছেওর । কাশিটা কি বাড়লো ? শেখরবাবু এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে গিয়ে দাঁড়ালেন শুভর দরজার কাছে । ততক্ষণে শুভ ঘর থেকে বেরিয়ে মুখ ধোয়ার বেসিনের দিকে ক্ষীপ্রপায়ে হাঁটা ধরেছে আর চেঁচিয়ে বলছে , আমারে অখ্খনি বাইর হইতে হইব , চা হইলে দিয়া যাও ...। মুহূর্তের মধ্যে বাড়িতে শোরগোল পড়ে গেল যেন। সবার আগে গলাটা শোনা গেল শ্যামলীর , ক্যান ,কৈ যাবি অখন ! শেখরবাবু স্বরেঅনেকটা চাড় দিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন , সোয়াব টেস্ট করাইতে নেকি ?

--- ধেৎ তেরিনা, গুলি মার তুমার সোয়াব টেস্ট , আমি অখন যামু আনন্দনগর , গৌতমের ঘরে ...

ততক্ষণে মাধবী , সাগরিকা ওরাও কৌতূহলী চোখ নিয়ে এসে হাজির হয়ে গেছে ।

শেখরবাবু রে রে করে বলে ওঠেন , কস কি শুভ এই সিচুয়েশনে যে কারো ঘরে যাইতে নাই তুই জানস না ! !

সাগরিকাও ঠসুদ্দাকে সমর্থন করে ।

শুভ দাঁত ব্রাশ শেষ করে কুলকুচি করতে করতে বলে ওঠে , গৌতম কানদো কানদো গলায় ফোন করছে ...

--- ক্যান ?

--- অর বাবা মারা গেছে ...

সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে ওঠে ! শ্যামলী আঁতকে ওঠে , কস কি ?

---- করোনায নেকি !

শেখরবাবুর গলায় উৎকন্ঠা ।

--- না না কিডনির ট্রাবল আছিল । হাসপাতালেই মারা গেছেন ।

--- ত , তুই কি করবি ?

--- শ্মশানেযাইতে হইব ...

--- ক্যান অর পাড়ায় মানুষ নাই নেকি , এত দূর থিক্যা তরে ডাকল , তর যাইতেই ত এক ঘন্টা লাইগ্যা যাইব ...

--- পাড়ার মানুষ যাইতে চাইতাছে না ...

--- ক্যা-ন ? ?

সবার চোখেমুখে এই লম্বা প্রশ্ন ।

--- হেরা ভাবতাছে গৌতমের বাবা করোনায় মারা গেছে ...

--- বডি কৈ ?

--- বডি ঘরেই আনছে । হাসপাতাল থিক্যা ছাইড়্যা দিছে । সার্টিফিকেটও দিছে নেগেটিভ বইলা, তবুও হেরা বিশ্বাস করে না ...

--- কস কি , মানুষ সোস্যাল ডিসট্যান্স হইতে হইতে এতই সেলফফবিয়ায় ভুগতাছে যে , করোনায় মরা ছাড়া আর কুনো মরারে বিশ্বাস করে না !

--- তুমি ঠিক কইছো ঠাউদ্দা , শুধু ভয় না , মানুষ অমানবিকও হইয়া উঠতাছে । আমি ত হেইটা হইতে পারুম না , আমারে যাইতেই হইব , আমি না গেলে নাকি হে অর বাবার বডি লইয়া বইস্যাই থাকব ...

শেষের এই কথাটা অত্যন্ত কাঁদো কাঁদো স্বরে বলতে বলতে শুভ ওর ঘরে চলে গেল । সংগে সংগে শেখরবাবুও শোবার ঘরে চলে গেলেন ।

একটু বাদে মুখে মাস্ক পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো শুভ। ওই মুহূর্তে অন্য পোশাকে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন শেখরবাবুও । তাঁরও মুখে মাস্ক । তিনি বলে উঠলেন , শুভ আমিও তর লগে যামু চল ...

শুভ হা করে তাকিয়ে রইল শেখরবাবুর দিকে , কও কি ঠাউদ্দা ? ধামালি করতাছ নেকি !

--- না না ধামালি করতাছি না , হছা কইতাছি , আমি তর লগে যামু -যামু -যামুই ...


ক্রমশ