শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

কথাসাহিত্য, উত্তরপূর্ব এবং শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ

আমিই একমাত্র উত্তর-জীবনানন্দ’ – এ রকম শত সংখ্যক/ কবিদের ভীড়ে কবি শঙ্খশুভ্র, অদ্বিতীয় এই দৈববর্ম সহ তোমার হাতে/ তুলে দিলুম অশ্বমেধের ঘোড়া / অগ্রজ এই কবি আর কোথাও যাবে না / যাও শঙ্খ/ রাজ্য কবিতা ভূবনের তরুণ আলেকজান্ডার তুমি/ যাও বিশ্ব বিজয়ে যাও/ জানি, কোনও লব কুশই তোমাকে/ ‘থামো’ বলতে পারবে না। --‘’ পীযূষ রাউত


সাহিত্য জীবন ও সমাজ যখন একই অবয়বের সামনে থাকে তখন স্মরণীয় কাজ ও মুহূর্ত তৈরির অন্তর যাপন চলতে থাকে। সাহিত্য প্রীতি থাকলেও সকলেই চর্চা ও চর্যাকে সফলতার সিংহাসন দিতে সমর্থ হন না। কখনো ফেলে আসা অধ্যায় তুল্যমূল্যে উঠে আসে; কখনো তুলে আনা যায় না। তবে জীবনের ধন তো কিছুই যায়না ফেলা। আমি যাঁর কথা বলবো তিনি রাজ পুরুষ শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ। সন্ধ্যা রাতের রজনীগন্ধার মতো সুরভিত তার শুভ্র রাজকীয় সৌন্দর্য! ত্রিপুরা - আসাম - পশ্চিমবঙ্গ - দিল্লি এবং বাংলাদেশ সহ বহু রাষ্ট্রের বিশিষ্ট জনের সান্নিধ্য লাভ তাঁর এক বিশাল প্রাপ্তি। মানুষটি কাজের প্রতি যেমন যত্নবান তেমনি তাঁর হৃদয় মন ও সকল উষ্ণতা জুড়ে আছে উত্তরপূর্ব। ককবরক,বাংলা, হিন্দি,অসমীয় ও ইংরেজি সহ বেশ কিছু ভাষায় তিনি পারদর্শী। রাজ বাড়ির যোগ্য উওরসূরী ও পিতা সলিল দেববর্মণের সুপুত্র তিনি। সম্ভবত ত্রিপুরার রাজ পরিবারের ঐতিহ্য সম্ভূত মিশ্র সংস্কৃতির শেষতম সাংস্কৃতিক প্রতিভু। শিক্ষা,শিল্প মনন ও চেতনায় ঋদ্ধ রাজ পুরুষ শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ। আদিবাসী জীবন, তাঁদের সংকট,সফলতার দিক ও ব্রাত্য জনজীবনের কথা তাঁর চোখে নিয়ত ভাসমান।

উত্তরপূর্বকে চেনার জন্য তার রূপ প্রকৃতি,পরিবেশ,পাহাড়ের বাঁকে আত্মভোলা ছোট নদী, আদিবাসী জনজীবন এবং তাঁদের আঞ্চলিক অর্থনীতি, অভাব অনটন, প্রেম ভালোবাসা, মন উদাসী পাহাড়ি সংগীত, উদ্বাস্তু সমস্যা এই সবই হতে পারে রাজ্যের বাংলা সাহিত্যের অপরূপ কথন। এই পার্বত্য রাজ্যের অনুপম কুটিরশিল্প, হজাগিরি, বিহু,মনিপুরী নৃত্য স্থানীয় শিল্প সংস্কৃতিকে করে তুলেছে বর্ণাঢ্য। খাদ্যাভাস ও জীবন শৈলীর এমন বৈচিত্র্যময় সম্ভারের সমাবেশ ঘটেছে বলেই উত্তরপূর্ব হয়ে উঠেছে অনন্যসাধারণ। কিন্তু এই অনন্যসাধারণ বৈচিত্র্য কী সত্যি তেমনভাবে কখনো উঠে এসেছে উত্তরপূর্ব ভারতের বাংলা সাহিত্যে। শুধু যদি উপন্যাসের কথাই বলি - তবে কিছু অপ্রিয় সত্য বলতেই হয়। রাজ্যের বাংলা উপন্যাস নিয়ে গবেষণা করতে গেলেই কিন্তু দেখা যায় অজ্ঞাত কারণ বশত বেশিরভাগ ঔপন্যাসিকই স্বভূমির প্রতি উদাসীন থেকেছেন। উপন্যাসে উপেক্ষিত থেকেছে জন্মভূমি ত্রিপুরা কিম্বা স্বভূমি এই উত্তর পূর্বাঞ্চল। এই নিদারুণ উদাসীনতার মাঝেও অল্প যে কয়েকজন স্বভূমিকেই উপজীব্য করে সাহিত্য রচনায় ব্রতী রয়েছেন - শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

এখানকার সাহিত্য তবে কোন পথে চলছে ? এই বিষয় নিয়ে একটা স্পষ্ট মতামত রয়েছে শঙ্খশুভ্র দেববর্মণের। এক সাক্ষাৎকারে তিনি যা বললেন -"দেখো সৌম্য এখানে যা লেখালেখি হয় তার মধ্যে অনেক লেখাই পশ্চিমবঙ্গের অনুকরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। উত্তরপূর্বই সত্যিকার অর্থেই একমাত্র আইডেনটিটি হয়ে এরকম লেখা মাত্র কয়েকজনই লেখেন। তবে ফর্ম বা জঁর'এ বঙ্গের অনুকরণ করতে গিয়ে তাঁদের লেখার মান ও গুরুত্ব কমেছে। ভাষা নয় - হারিয়েছে মৌলিক কথনের দ্যুতি। "

শিক্ষা জীবনে ছিলেন দিল্লির জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সফল ছাত্র। কিন্তু পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মোহ তাঁকে কখনো প্রলুদ্ধ করতে পারে নি আর এটাই আমাদের জন্য ভাবনার বিষয়হতে পারে। এতো বৈভবশালী বংশে জন্ম নিয়েও জীবন সমর্পণ করেছেন পিতৃভূমি উত্তরপূর্বের জন্য। কেন? তিনি চাইলেই বিদেশের সুখ ভোগে জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু তাঁর হৃদয় তৃষা বারংবার তাঁকে উত্তরপূর্বেই ধাবিত করেছে।

প্রতি ক্ষণে তিনি কিন্তু ভাবেন উত্তরপূর্বের নারী প্রগতি, শিক্ষা, সমাজ,সম্পর্কের রসায়ন, সমাধান ও আধুনিকতার বহুমুখী দিক নিয়ে। কর্মজীবনে তিনি প্রতিষ্ঠিত। কেন্দ্রীয় পর্যটন মন্ত্রণালয়ের পদস্থ আধিকারিক হিসাবে কাজ করে চলছেন আপন মনে ও প্রবল উৎসাহে। এখানেও তিনি এক ব্যতিক্রমী মানুষ। অন্য সকল আধিকারিকের সাথে তাঁর তফাৎ লক্ষ্য করার মতো। ব্যক্তি জীবনের সাথে কর্ম জীবনকেও তিনি রঙিন ভাবে সাজিয়ে রেখেছেন। নানা সময়ে যোগাযোগের সুবাদে অনেক তথ্যই জানা যায় বন্য প্রাণী - পর্যটন ও এই শিল্পকে তিনি অন্য মাত্রা দান করেছেন।

অর্থনীতিবিদ্ অমর্ত্য সেনের সহধর্মিণী তথা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রয়াতা লেখিকা নবনীতা দেবসেন উত্তরপূর্বের শঙ্খশুভ্রের লেখায় মুগ্ধ ছিলেন। বলেছিলেন এই ছেলে করে দেখাবে। সত্যিই দেখিয়েছেন। তাঁর লেখালেখির বিষয় অন্য এক ঘরানার। এই অব্দি প্রকাশিত গ্রন্থ ১৭ টি। এছাড়াও নানা পত্র - পত্রিকায় নিয়মিত লিখে চলেছেন তিনি। তাঁর রচিত উপন্যাস 'বনকুন্তলার উপাখ্যান' দূরদর্শনের ন্যাশনেল চ্যানেলে ছয় এপিসোড সফলতার সঙ্গে প্রদর্শিত হয়েছিলো। পেয়েছেন জাভেদ আখতার, গুলজার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়,অমর্ত্য সেনের মতো আরও বহু বিদগ্ধ জনের সান্নিধ্য। এখন অব্দি দিল্লি, কোলকাতা, হলদিয়া,বহরমপুর, শিলং,গুয়াহাটি,শিলচর,আজমের,জয়পুর প্রভৃতি শহরে সাহিত্য সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। গিয়েছেন বিদেশেও। নতুনের প্রতি প্রবল ভালোবাসা ও ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লেখক তিনি।

উত্তরপূর্বের যে কয়েকজন নানা ভাবে শীর্ষ স্থানে গেছেন তাঁদের মধ্যে শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ অন্যতম। তাঁর সম্পর্কে যে কথাটি অনেকেই বলেন তা হলো, উত্তর পূর্বের লেখকদের মধ্যে কম বয়সে এবং কম সময়ে জনপ্রিয়তা যদি কেউ পায় তবে তাঁর নাম শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ।এই পরিচিতির পেছনে হয়তো তাঁর উওর- পূর্ব প্রীতি ও কাজের জায়গা অনেক বড় সুযোগ করে দিয়েছে।

ত্রিপুরা রাজ্য সরকার কর্তৃক প্রদেয় গৌরবময় 'সলিল কৃষ্ণ স্মৃতি পুরস্কারে' তিনি ভূষিত। এছাড়াও তাঁর ঝুলিতে আছে বহু পুরস্কারের শিরোপা। সম্প্রতি গুয়াহাটি প্রেস ক্লাব তাঁকে সম্মানিত করেছে। তবে ব্যক্তি মানসে তাঁর কাছে সব থেকে বড় সম্মান হলো উওর- পূর্বের মানুষের ভালোবাসা। পর্যটন, লেখালেখির পাশে তাঁর অন্যতম ভালোলাগার কাজ হলো সমাজ সেবা। অত্যন্ত ধৈর্য ও স্থৈর্যের অধিকারী এই সুপুরুষ লেখক উওর - পূর্বকে বুকে করে বয়ে চলেছেন অনাদিকালের পথে।বাংলা তথা উত্তরপূর্বের সাহিত্য জগতে শঙ্খশভ্র দেববর্মণের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। তাঁর সৃষ্টি সম্ভার নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক -

#উপন্যাস - উপন্যাসে তিনি এক নতুন আবিষ্কারী ভাব গড়েছেন এবং পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয়না যে সেই লেখার মূলে আছে জন্মভূমি উত্তর -পূর্ব। 'আগরতলা আনলিমিটেড', 'জতুগৃহের পাখি', 'ত্যুই' , ' কোঠা নম্বর ৬৪ ' , ' বনকুন্তলার উপাখ্যান , 'মেঘবতি ' , ' রুদি জলার সারিগান ' এবং এখন পর্যন্ত তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত 'মিস প্রদুনোভা ত্রিপুরা' উত্তর- পূর্বের একমাত্র ক্রীড়া বিষয়ক উপন্যাস ।

#গল্প সংকলন - কথাসাহিত্যের বিশেষ একটা দিক ছোট গল্প। আর এই ধারায় তাঁর একের পর এক গল্প নানা পূজা সংখ্যা ও কাগজে প্রকাশ পেয়েছে। 'মৃগয়া ও অন্যান্য গল্প ', ' অরণ্যে প্রেম নেই ', বৈনারি ' অন্যতম। তাঁর 'বাংফাই ' গল্পটি এক ভিন্ন মাত্রার পরিচায়ক বলেই উপলব্ধি হয়।

# কবিতা গ্রন্থ - কথাসাহিত্যের পাশে তাঁর কবিতার ভুবন অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ' আমি অসভ্যনাবিক', 'ত্রিপুরা সুন্দরী এক্সপ্রেস ', 'সমাহিত মেঘধূলি' কাব্যগ্রন্থগুলি ইতিপূর্বেই পাঠক সমাদর লাভ করেছে।

'খুমপুই' তাঁর এই অব্দি প্রকাশিত শেষ কবিতা সংকলন। শঙ্খশুভ্রের লেখা - 'মেঘলা দুপুর ', ' হায়েরো গ্ল্যাফিকস ', ' মন্দির কন্ঠ ', ' পরি-বৃত্ত' প্রভৃতি কবিতা গুলো অসম্ভব এক দূরদর্শিতার বার্তা বাহক যেন।

# প্রবন্ধ - অনেক লেখক সাহিত্যিক এমনও দেখা যায় গল্প, উপন্যাস বা কবিতা নিয়েই কাজ করেন। সকলে সচরাচর সমালোচনা সাহিত্যে যেতে চান না। এখানেও তিনি ব্যতিক্রম কেন না এখন অব্দি তাঁর তিনটি প্রবন্ধ সংকলন সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। যেমন ' নীল ডায়েরির পাতা ', ' ধর্ম - সমাজ ও বুদ্ধিজীবী ', ' বিশ্বায়ন ও সন্ত্রাসবাদ '। দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রতি রবিবারে কলাম হিসেবে প্রকাশিত হতো নীল ডায়েরির পাতা। অরণ্য ও পরিবেশ, ধর্মীয় মৌলবাদ, নারী এবং সামাজিক সমস্যাবলীর ওপর লিখিত তাঁর এই কলাম পাঠকমহলে প্রভূত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তীক্ষ্ণ ভাষায় প্রবন্ধ এখনও লিখছেন তিনি। গদ্য সাহিত্যের ভাষা নির্মাণে তিনিঅবশ্যই তাঁর সমসাময়িকদের চাইতে স্বতন্ত্রতায় উজ্জ্বল এবং ব্যতিক্রম।

তাছাড়াও তাঁর সম্পাদিত 'ত্রিপুরার কবিদের নির্বাচিত প্রেম ও প্রতিবাদ' বইটি রাজ্যের কবিতা বিষয়ক এক উল্লেখযোগ্য ডক্যুমেন্ট। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে নতুন কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন ত্রিপুরার মেয়েদের শিক্ষাদীক্ষা এবং সামাজিক নানা সমস্যা নিয়ে একটি কাজ করছেন। সেই সাথে ত্রিপুরায় বীরচন্দ্র মাণিক্যের আমলের ওপর এক বৃহৎ উপন্যাসে হাত দিয়েছেন।

উত্তরপূর্বের নবীন কবি লেখকেরা যারা এই সময়ে ভালো কাজ করছেন শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ তাঁদের হামেশা প্রশংসা করেন, উদ্বুদ্ধ করেন এবং উত্তরপূর্বকে নিজের চোখে ও নিজের হৃদয়ের আলোকে দেখতে সর্বদা প্রাণিত করেন - এটা তাঁর একটা বিশেষ প্রশংসনীয় দিক !


বিষয় নির্বাচন, চিন্তন চেতনা ও ব্যতিক্রমী ভাবনায় সৃজনশীল কবি লেখক হিসাবে পাঠক মহলে তিনি সমাদৃত। উত্তরপূর্বের পটভূমিকায় যে ভাবে তিনি কাজ করে চলেছেন তার প্রেক্ষিতে অবশ্যই বলতে হয় তাঁর প্রতিভা সত্যিই বৈচিত্র্যময় ও অনন্য। বিরল এক নিদর্শন স্বরূপ তিনি। উত্তরপূর্বে জন্ম নিয়ে যে সব বঙ্গভাষী আজ তাঁদের কাজ ও লেখনী দ্বারা অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁদের মধ্যে অবশ্যই শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ অন্যতম । উত্তরপূর্বের বর্ষীয়ান কবি শ্রদ্ধেয় পীযূষ রাউত যথার্থই জহুরীর মতো শঙ্খশভ্র দেববর্মণের প্রতিভাকে চিনতে পেরেছিলেন। তাই তিনি তাঁর অনুজ কবির প্রতি পরম আশ্বাসে লিখেছিলেন, ‘’যাও শঙ্খ/ রাজ্য কবিতা ভূবনের তরুণ আলেকজান্ডার তুমি/ যাও বিশ্ব বিজয়ে যাও !‘’