মঙ্গলবার, এপ্রিল ১৬, ২০২৪

কথাগুলো বলা হলো না, পর্ব -১৬

১৬

এদিক ওদিক তাকিয়ে শুভ্রাকে কোথাও দেখলাম না, তার মানে শুভ্রা এখনো এসে পৌঁছায়নি !

আনোয়ারশাহ রোডের ওপর বছর দুয়েক হলো যে শপিং-মলটা তৈরি হয়েছে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, পাঁচটা বাজতে দশ, শুভ্রার সঙ্গে সকালে যখন ফোনে কথা হলো তখন ও বললো যে সাড়ে চারটের মধ্যেই মলের সামনে চলে আসবে, ট্যাক্সি থেকে নামতে নামতে ভাবছিলাম আমারই বোধ হয় দেরী হয়ে গেলো কিন্তু শুভ্রা দেখছি এখনও এসে পৌঁছায়নি।

মলের সামনে প্রচুর মানুষের ভিড়। প্রাইভেট কার, ট্যাক্সি, অটো, জায়গাটা যেন একদম থিকথিক করছে, মানুষের দল ঝাঁকে ঝাঁকে গাড়ি থেকে নেমে পিঁপড়ের মতন সারি সারি দিয়ে মলের মূল প্রবেশদ্বারটার দিকে এগিয়ে চলেছে, আসলে আগে কোলকাতার মানুষের কেনাকাটা করার জন্য বছরের কতগুলো নির্দিষ্ট সময় ছিল, এই যেমন দুর্গাপূজা, পয়লা বৈশাখ বা চৈত্র মাসের সেল, আর এখন সারাবছর ধরেই কেনাকাটা চলে আর দোকানগুলোও ক্রেতা আকর্ষণের জন্য সারা বছর ধরেই তাই নানা বাহানার সেল ঝুলিয়ে রাখে, সোজা কথায় পাবলিকের সামনে একটা না একটা কোনও ললিপপ ঝুলতেই থাকে যাতে তারা দোকানে এসে তাদের পকেটের রেস্ত খসিয়ে যান।

একটু ভাবলে বেশ বোঝা যায় যে গত কয়েক বছরে ভারতবর্ষের মানুষের জীবনযাত্রায় একটা বেশ বদল এসেছে আর এই বদলে ব্যবসা বাণিজ্যের গতিপথও যেন তীব্র একটা বাঁক নিয়েছে, আগে বাণিজ্য ছিল মূলত নিজের নিজের দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, কিন্তু আজ উন্মুক্ত অর্থনীতির জোরে এবং বিশ্বায়নের প্রভাবে এক দেশের পণ্য খুব সহজেই খুঁজে পেয়ে যাচ্ছে অন্য দেশের ক্রেতা, বাজার জুড়ে তাই তুল্যমূল্য প্রতিযোগিতা আর সেই প্রতিযোগিতায় নিজেদের নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে সবাই যেন একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, বাজার ছেয়ে যাচ্ছে পণ্যের বিজ্ঞাপনে, সেই বিজ্ঞাপনেরও আবার কত রকমের চমক, আগে পণ্যের বিজ্ঞাপন বলতে বোঝাতো শহরের ইতিউতি দেওয়াল জুড়ে লাগানো কিছু পোষ্টার আর জনবহুল রাস্তার মোড়ে দাঁড় করানো বড় বড় কোম্পানির কিছু হোর্ডিং, এখন ক্রেতার কাছে পৌঁছনর জন্য কোম্পানিগুলি মাধ্যম করছে টিভি, সংবাদপত্র বা রোড শো।

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে নিজের অজান্তেই কখন যেন দৃষ্টি চলে গেলো মলের সামনে লাগানো বিরাট ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে বোর্ডটার দিকে, একই ফ্রেমে সেখানে সময়ের ব্যবধানে ব্যবধানে ফুটে উঠছে আলাদা আলাদা কোম্পানির আলাদা আলাদা বিজ্ঞাপন, এই তো কিছুক্ষণ আগে বলিউডের শাহানশা এসে সেখানে ঘোষণা করে গেলেন যে নির্দিষ্ট একটা ব্রান্ডের সিমেন্টের বুনিয়াদী শক্তি কত মজবুত, শাহানশা মুছে যাওয়ার পর সেখানে এখন বলিউডের বাদশাহ, দুনিয়ার সব কালো কঠিন এবং কর্কশ মুখওয়ালা ছেলেদের ভরসা দিয়ে উনি বলছেন, কুছ পরোয়া নেহি, ওনার হাতে ধরা ক্রিমটা মুখে মাখলেই তাদের মুখও নাকি মেয়েদের মতই নরম আর পেলব হয়ে উঠবে, বাদশাহর অন্তর্ধান হতে না হতেই টুকরো টুকরো কিছু ছবি এদিক ওদিক থেকে ভেসে উঠলো আর মুহূর্তে তা জোড়া লেগে তৈরি হয়ে গেলো একটা গোটা গাড়ি, নিচে এক প্রাইভেট ব্যাঙ্কের আশ্বাসবাণী, স্বপ্ন আপনার, সাকার করব আমরা।

বিজ্ঞাপনের সঙ্গে সঙ্গে এই ক'বছরে কমোডিটি প্রোডাক্টের বিপণন ব্যবস্থাতেও একটা বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে, বেচাকেনার যে সাবেকি প্রথাটা এতদিন ধরে চলছিল তা যেন শহরের বিশেষত এক শ্রেণীর মানুষের কাছে তার কৌলীন্য হারিয়ে ফেলেছে, আগে মানুষ চালের দোকান থেকে চাল কিনত, মুদি দোকান থেকে মাসের তেল-নুন-হলুদ নিত, বাড়ির বৌ-মেয়েরা বিকেলে বা সন্ধেবেলায় গা ধুয়ে পাড়ার ভ্যারাইটি স্টোর্সে এসে ভিড় করতেন গায়ে মাখার ক্রিম বা মাথায় দেওয়ার সুগন্ধি তেল কিনতে, এখন শহরের মানুষকে ঐ সব জিনিস কেনার জন্য আর আলাদা আলাদা দোকানে যাওয়ার দরকার পড়ে না, মুদি-কসমেটিকস-সবজি সব কিছুই এখন এক ছাদের নিচে, আর এই সবকিছু পাওয়ার চালাঘরটির পোশাকি নাম ডিপারমেন্টাল স্টোর। আলু, পেঁয়াজের পাশাপাশি সেখানে সেমি কুকড ভেজ বা নন-ভেজ খাওয়ার যেমন পাওয়া যায় তেমনি আবার ঘর ঝাড়ু দেওয়ার ঝাঁটার পাশেই হয়তো দেখবেন রাখা রয়েছে সুগন্ধি বডি স্প্রে বা বিস্কিট, এক কথায় দৈনন্দিন জীবনের সব কিছুই যেন আজ সহ অবস্থানে অবস্থান করছে এই ডিপারমেন্টাল স্টোরগুলিতে, দরজা ঠেলে শুধু একবার ভিতরে ঢুকলেই হলো, নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম পরা কর্মীরা অমনি আপনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে হাতে ধরিয়ে দেবে চাকা লাগানো লোহার বাস্কেট, এবার হাতের সামান্য ঠেলায় সেই বাস্কেট নিয়ে দোকানের এমাথা থেকে সে-মাথায় ঘুরতে থাকুন আর ঘোরার ফাকে ফাকে বাস্কেটে তুলে নিন প্রয়োজনীয় জিনিসের সম্ভার, বাস্কেট যখন জিনিসে টইটুম্বুর তখন ক্যাশ কাউন্টারের এসে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ুন, টিক দিয়ে দিয়ে এক-এককরে জিনিসের দাম মিলিয়ে লম্বা যোগ-বিয়োগ করার দিন সেই কবেই শেষ হয়ে গিয়েছে, বাস্কেট থেকে এখন জিনিস ক্যারি-ব্যাগে পৌঁছনর আগেই ডিজিটাল ব্যবস্থায় জিনিসের প্রাইসট্যাগ মুহূর্তে কপি হয়ে চলে যাচ্ছে কম্পিউটারের হার্ডডিস্কে, বিলের অঙ্কটা দেখে এবার পয়সা মেটালেই হলো, অমনি ব্যাগ-ভর্তি সামান আপনার, স্টোরের দরজায় দাঁড়ানো সিকিউরিটি গার্ড বিলটায় একবার চোখ বুলিয়ে সেলাম জানিয়ে আপনাকে দেখিয়ে দেবে বাইরে যাওয়ার রাস্তাটা।

ডিপারমেন্টাল স্টোরের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়েই বোধহয় একদিন মার্কেট-গুরুরা চিন্তা করতে শুরু করেছিলেন যে এরকম বেশ কয়েকটা স্টোরকে বা দোকানকে যদি এক ছাদের নিচে নিয়ে আসা যায় তাহলে কেমন হয়, ব্যাস বাজারে এসে গেলো শপিং-মল, মলের একতলা-দোতলা-তিনতলা-ফ্লোরগুলি সার-সার রকমারি জিনিসের দোকানে ভরা, জামা কাপড় থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিকস গ্যাজেট, প্রসাধন সামগ্রী থেকে বই-সিডি, মুদি সামগ্রী, দু চাকা – চার চাকা, কী পাওয়া যায় না এই মলগুলিতে, এর সঙ্গে রয়েছে আমোদ আহ্লাদেরও হাজারো উপকরণও, রয়েছে সিনেমাহল, স্পা বা রকমারি খাওয়ারের বিভিন্ন মাপের রেস্টুরেন্ট, অফুরন্ত এই আমোদ নগরীতে আপনার পকেটে শুধু টাকা থাকা দরকার, অবশ্য হার্ড ক্যাশ না হলেও চলবে, ব্যাঙ্কগুলি আজকাল মানুষের ওয়ালেটে ঢুকিয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড, কার্ড বের করে একবার সোয়াইপ করলেই হলো, দেখবেন মুহূর্তে আকাঙ্ক্ষিত বস্তুটি আপনার হয়ে গিয়েছে, ব্যাঙ্কের জমানো টাকা বা আপনার ঋণের পরিমাণ তাতে হয়তো একটু কমবে বা বাড়বে কিন্তু তাতে কী এসে যায়, ওসব পরে ভাবা যাবে'খন, এখন তো মনটা খুশীতে ভরপুর হয়ে উঠলো, এটাই বা কম কী!

শুভ্রা অটো থেকে নামছে, আর বলবেন না, যোধপুর পার্কে একটা মিনিবাস আর বাইকে এমন অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে যে পুরো রাস্তা জুড়ে জ্যাম, হাতের রুমালটায় মুখ পুঁছতে পুঁছতে শুভ্রা আমায় জিজ্ঞাসা করলো যে আমি কতক্ষণ এসেছি।

তা প্রায় আধঘণ্টার মত হলো।

ঈশ, তাহলে তো আপনাকে অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলাম, নিশ্চয়ই বোর হচ্ছিলেন?

না বোর হচ্ছিলাম কোথায়, আসলে মানুষের এত ভিড় এখানে যে তাদের দিকে নজর করতে করতেই সময়টা কখন যে কেটে গিয়েছে তা টেরও পাইনি, আর তাছাড়া একটা জিনিস ভাবছিলামও বটে।

এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আবার কী ভাবছিলেন, শুভ্রার চোখেমুখে কৌতূহল।

না ভাবছিলাম মানুষের অর্থনৈতিক ব্যালেন্সের মেরুকরণটা বিপণন ব্যবস্থার সঙ্গে দিন-দিন কেমন যেন বদলে যাচ্ছে, তাই না!

বাবা, খুঁজে খুঁজে আপনি ভাবনার টপিকও পান বটে।

জানো শুভ্রা, আমার বাবার না একটা রুলটানা খাতা ছিল, বাবাকে দেখতাম প্রতি মাসের মাইনে পাওয়ার পর ঐ খাতার একটা পৃষ্ঠায় লম্বালম্বি দুটো দাগ টেনে একদিকে লিখে রাখত মাস মাইনের পাওয়া টাকার অঙ্ক, অন্যদিকে প্রতিদিন আপডেট করতো দিনের খরচাপাতি। আর শেষ কলামে লেখা থাকতো যোগ-বিয়োগের শেষ অবস্থান। জানো শুভ্রা, বাবার খাতায় কিন্তু কখনো এই অবশিষ্ট নেগেটিভ হতো না, ইট ওয়াজ অলওয়েজ রিমেইনড পজিটিভ, অথচ আজ আমাদের চারপাশের মানুষগুলোকে দেখো, দেখবে তাদের অধিকাংশরই ব্যালান্সশীটেই কিন্তু শুধুই মাইনাস !

আমার মুখের দিকে শুভ্রা তাকিয়ে আছে, বুঝতে পারছি না যে সত্যিই ব্যালেন্সশীটের এই নেগেটিভ রহস্য জানতে ও আদৌ আগ্রহী কি না, নাকি ও অপেক্ষা করছে কখন আমার আধাপোড়া সিগারেটটা ফিল্টারে এসে ঠেকবে, সিগারেটে একটা লম্বা টান দেই, তুমি হয়তো ভাববে যে এর পিছনে রয়েছে কোনও জটিল অংক, না শুভ্রা, এর পিছনে কোনও জটিল অঙ্ক নেই, এর পিছনে রয়েছে আমাদের অফুরন্ত চাহিদা বা লোভ যার ইলাস্টিসিটি চূড়ান্ত সীমা পার করে আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে প্রতি নিয়ত এক অতল গহ্বরের দিকে, মুখে আমরা যতই চরিতামৃত আওড়াই না কেন আসলে আমরা ভিতরে ভিতরে সবাই যেন এক-একটা লোভের আগ্নেয়গিরি আর এই পুঁজিবাদী সমাজ বা সমাজের একটা বিশেষ গোষ্ঠী আমাদের সেই লোভকে উস্কে দিয়ে নিজেদের নিজেদের পকেট ভরাচ্ছে আর পয়সা শেষ হলে আমাদেরকে ঠেলে দিচ্ছে ঋণের অতল সাগরে, সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে ফিল্টারটা মলের সামনে রাখা বালি ভর্তি লাল টবটায় গুঁজে দেই, আমার কী মনে হয় জানো, আরো একটু ভালো থাকার নেশায় আসলে আমরা দিন-দিন অন্ধকারের দিকে ক্রমশ এগিয়ে চলেছি।

কুশলদা প্লিজ থামুন! সত্যি বলছি আপনার কথা শুনে মাঝে মাঝে মনে হয় সদগুরুর ক্লাসে এসেছি, এখন তাড়াতাড়ি ভিতরে চলুন তো, ভীষণ খিধে পেয়েছে, খেতে খেতে না হয় আপনার জ্ঞানের বাকি পর্বটা শোনা যাবে, শুভ্রার ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি।



বয় এসে চিকেন স্যান্ডউইচ আর কফি রেখে গিয়েছে, স্যান্ডউইচে কামড় দিয়ে শুভ্রাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে উজান জানালো কি না যে ও কবে কোলকাতায় আসছে, শুভ্রার ছেলে এখন দেরাদুনে, ওখানকার একটা কলেজের হোস্টেলে থেকে গ্রাজুয়েশন করছে, এটা ওর সেকেন্ড ইয়ার, শুভ্রা সেদিন বলছিল যে উজান নাকি ফোর্থ সেমিস্টারের পর কিছুদিনের জন্য কোলকাতায় আসবে।

প্রথমে তো বলেছিল যে সামনের সপ্তাহের শেষের দিকে আসবে, এখন আবার বলছে যে পরীক্ষা শেষে বন্ধুরা মিলে ট্রেকিংয়ে যাবে, সেখান থেকে ফিরে তবে আসবে, জানি না বাবা, আজকালকার ছেলে-পিলেরা যে কখন কী বলে তার কোনও মাথামুণ্ডু বুঝে উঠতে পারি না।

আরে বাবা ওদের বয়সটাই তো এখন এরকম অস্থির ভাবনার, ভেবে দেখো তো তুমি-আমিও এই বয়সে কিন্তু এরকমই ছিলাম! চিন্তা করো না, সময়ে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।

সেটা হলেই ভালো, তবে মাঝে মাঝে বড় ভয় করে জানেন।

কিসের ভয়?

জানি না মাঝে মাঝেই মনে হয় উজান যদি কখনো আমায় ছেড়ে চলে যায় তাহলে...

হঠাৎ তোমার মনে এরকম উদ্ভট ভাবনার কারণ !

কারণ কিছু নেই, তবু কেন জানি মাঝে মাঝে মনে হয়, আচ্ছা কুশলদা একটা কথা বলুন তো, সত্যিই যদি উজান কোনোদিন আমায় ছেড়ে চলে যায় তবে সেদিন আমি কী নিয়ে বাঁচব।

ধুর বাবা, কথা হচ্ছিল উজানের কোলকাতা আসা নিয়ে, আর সেখান থেকে আলোচনাটাকে তুমি কোথায় নিয়ে গেলে ! আজকাল মাঝে মাঝেই শুভ্রার এরকম হচ্ছে, হঠাৎ হঠাৎ করে যেন ডিপ্রেশনে চলে যায় মেয়েটা, উজানকে নিয়ে আজকাল একটু বেশীই যেন কনসার্নড হয়ে পড়েছে শুভ্রা, না ওর সঙ্গে একদিন বসা দরকার, ওকে বোঝানো দরকার যে একজন মা হিসেবে ছেলের জন্য যা যা করার শী হ্যজ ডান এভরিথিং, আর আমি নিশ্চিত যে উজান অন্তত জীবনে কখনো তার মায়ের বিরুদ্ধে এমন কোনও কথা বলবে না যে যেখানে শুভ্রার দায়িত্ববোধ নিয়ে কথা উঠবে, কথা ঘোরাতে বলি, এই শোনো না, উজানকে ফোন করে বলে দাও যে ওর আসার ডেটটা ফিক্স করে আগে-ভাগে যেন টিকিটটা বুক করে নেয়, আজকাল কিন্তু ট্রেনের টিকিটের খুব মারামারি চলছে।

কফির পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে শুভ্রা পেপার ন্যাপকিনে নিজের ঠোঁট দুটো মুছে নেয়, মাসীমাকে কেমন দেখলেন কাল?



ছবির মুখ থেকে কথাটা শোনার পর কাল প্রথমে খুব অভিমান হয়েছিল, মা হরিদ্বারে চলে যাচ্ছে, কই আমায় তো কিছু জানায়নি, একবার ভেবেছিলাম, যাই, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে মাকে গিয়ে কথাটা জিজ্ঞাসা করি, মাকে বলি আমি কি তোমার এত পর হয়ে গেছি যে তুমি হরিদ্বারে চলে যাচ্ছ আর সেটা আমায় একবার জানানোরও প্রয়োজন বোধ করোনি, কিন্তু শেষ অবধি আর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠা হয়নি, সত্যি তো মা কেন আমাকে তার সব কথা জানাবে, ছেলে হিসেবে আমি কোন কর্তব্যটা পালন করেছি, ভরন পোষণের কথা ছেড়েই দিলাম, ভরন পোষণের জন্য মা কোনদিনই আমার ওপর নির্ভরশীল ছিল না, উলটে বাবার মৃত্যুর পর যতদিন আমার চাকরি-বাকরি হয়নি মা-ই আমায় খাইয়েছে, পরিয়েছে, আমার পড়াশুনার খরচ চালিয়েছে, তবে মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের অনেক ইমোশনাল টাচও থাকে, সেখানেও কিন্তু আমি শুধু রিসিভারের ভূমিকাই পালন করে গিয়েছি, ছোটবেলা থেকে বার কয়েক মায়ের বুকে মুখ গুজে কান্না ছাড়া কখনো কি আমি সে অর্থে মায়ের পাশে থাকতে পেরেছি, না পারিনি, আর তাই মাথা উঁচু করে কখনো দুনিয়ার মানুষগুলোকে বলতে পারিনি, তোমরা যা-ই বলো আমি জানি আমার মা আকাশের মতন নির্মল, সূর্যের মতন সে পবিত্র, দিনের পর দিন বাবা যখন এক অদৃশ্য সম্পর্কের জের টেনে মাকে নানা রকম উলটোপালটা কথা বলে গিয়েছে একদিনের জন্যও মিস্টার বিশ্বনাথ করকে ডেকে বলতে পারিনি বাবা, প্লিজ, স্টপ ইট, এভাবে মাকে তুমি মিছিমিছি অ্যাকুইজ করতে পারো না, ঠিক আছে বিশ্বনাথ কর না হয় আমার জন্মদাতা পিতা ছিলেন, তাই হয়তো তার মুখের দিকে তাকিয়ে কোনদিন এসব কথা বলতে পারিনি, কিন্তু উর্মি, সে তো আমার স্ত্রী, তাকে কেন বলতে পারিনি, এই যে তুমি কথায় কথায় আমার মাকে বিদ্রূপ করো, আমার মাকে নিয়ে অশ্লীল ইঙ্গিত করো, এসব এবার বন্ধ করো, সত্যিই আমি আসলে ভেজা বারুদ যা নিজের বা অন্যের সম্মান রক্ষার্থে কখনোই এ জীবনে জ্বলে উঠতে পারেনি বা ভবিষ্যতেও পারবে না।

আজকাল আমদের বাড়িটায় সব সময় যেন এক শ্মশানের নিস্তব্ধতা বিরাজ করে, সকাল থেকে উর্মি নিঃশব্দে সংসারের সব কাজ করে যায়, ঝিনুকও যতক্ষণ বাড়িতে থাকে চুপচাপই থাকে, বিশেষ কথাবার্তা বলে না, পড়াশোনা না থাকলে গল্পের বই বা ড্রয়িং খাতা নিয়ে চুপ করে বসে থাকে, ঘরের দেওয়ালগুলি থেকে উর্মি পাপানের সব ফটো খুলে নিয়েছে, পাপানের ব্যবহৃত জিনিসপত্রও কোথায় যেন প্যাক করে ঢুকিয়ে দিয়েছে, কিন্তু স্মৃতি তো শুধুমাত্র ছবি বা জিনিসপত্রে বাঁধা থাকে না, তাই উর্মির বুকের মধ্যে যে অবিরাম রক্তক্ষরণ হয়ে চলছে তা আমি বুঝতে পারি, ভাবি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াই, ভাগ করে নেই ওর মনের ব্যথা, কিন্তু উর্মি আমায় সেই সুযোগ দেয় না, প্রয়োজন ছাড়া আজকাল ও আমার সঙ্গে কথা বলে না, রাতে বিছানায় শুয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকে, ডাকলেও সারা দেয় না, জোড় করে চোখের জল মোছাতে গেলে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বসে থাকে।



চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়েও সেদিন যখন মায়ের জ্ঞান ফিরলো না তখন সুদীপজেঠুই দৌড়ে গিয়ে পাড়ার মোড় থেকে রুনু হালদারকে ডেকে নিয়ে এসে ছিলেন, গুহজেঠুর মারা যাওয়ার পর এই রুনু ডাক্তারই এখন আমাদের এখানকার সবাকার ভরসা, ডাক্তারবাবু মাকে পরীক্ষা করে বললেন যে মাইল্ড স্ট্রোক মতন হয়েছে, তবে ভয়ের কিছু নেই, কিছুদিন ওষুধপত্র খেলে আর বেডরেস্ট নিলে মা সুস্থ হয়ে উঠবে, যাওয়ার আগে উনি আমায় ডেকে বললেন, কুশল তোমাদের বাড়ির এখন যা অবস্থা তাতে ওনার বোধহয় কিছুদিন নার্সিংহোমে গিয়ে থাকাটাই ঠিক হবে, আমারও মনে হলো ডাক্তারবাবু ঠিক কথাই বলেছেন, উর্মির মনের এই অবস্থায় ওর পক্ষে মায়ের দেখাশোনা করা ... হরিদেবপুরের মোড়ে যে নতুন নার্সিংহোমটা হয়েছে ওদেরকে ফোন করলাম, অ্যাম্বুলেন্সে করে মাকে নার্সিংহোমে যেতে যেতে মায়ের শরীরটা আবার খারাপ হলো, ভাগ্যিস পথে সেরকম ট্রাফিক ছিল না, অ্যাডমিট করানোর পর নার্সিংহোমের ডাক্তার দেখে জানালেন যে আসবার পথে নাকি মায়ের দ্বিতীয় স্ট্রোকটাও হয়ে গিয়েছে, তবে ভগবানের কৃপায় এবারও স্ট্রোকটা মাইল্ডই ছিল।

প্রায় সাতদিন হলো মা নার্সিংহোমে রয়েছে, ডাক্তারবাবু জানিয়েছেন যে দিনদিন নাকি মায়ের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যাচ্ছে, হার্ট আর লিভারের প্রবলেম তো আগেই ছিল, এখন কিডনিও ঠিক মত কাজ করছে না, অফিস থেকে ফেরার পথে প্রতিদিন নার্সিংহোমে গিয়ে মায়ের কাছে কিছুক্ষণ বসে থাকি, মা এটা-ওটা জিজ্ঞাসা করে, অন্য দিকে তাকিয়ে উত্তর দেই, সরাসরি মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারি না, কেমন যেন কুণ্ঠা হয়, ভিতরে ভিতরে একটা অপরাধ বোধ কাজ করে যেন, সুদীপ জেঠু-জেঠিমা নিয়ম করে রোজ বিকেলের দিকে একবার করে আসেন, সেনগিন্নিও তার সংসারের কাজের ফাঁকে এসে মাকে দেখে যান, গত রবিবার বিকেলে ঝিনুককে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম, ঝিনুকের হাতটা ধরে মা খুব কাঁদছিল, ঝিনুকের চোখ দিয়েও দেখলাম টপ টপ করে জল পড়ছে, আসলে দুজনাই ওরা দুজনকে খুব ভালবাসে, উর্মি একদিনের জন্যও আসেনি, আমিও জোরাজুরি করিনি, থাক, উর্মির ভিতরের ক্ষতটা শুকাক, ওর বুকের ক্ষতটা যতদিন না শুকবে ততদিন আমাদের সংসারটা স্বাভাবিক হবে না, অলোককাকু সকাল-বিকেল দুবেলা করে এসে মাকে দেখে যান, চুপ করে মায়ের মাথার কাছে রাখা টুলটার ওপর বসে থাকেন, যাওয়ার আগে ডাক্তার বা মেট্রনের কাছ থেকে জেনে নেন মায়ের শরীরের হাল হকিকত, মায়ের একটা রক্ত পরীক্ষা করানো দরকার, পরীক্ষাটা এই নার্সিংহোমে হয় না, বাইরের কিছু নির্দিষ্ট ল্যাবেই শুধু হয়, মেট্রন দেখলাম অলোককাকুকে ডেকে সব কিছু বুঝিয়ে দিলেন।

অপরিচিত মানুষের কাছে কত সহজেই না আমরা ধরা পরে যাই, মেট্রন ঠিকই বুঝেছেন যে মিসেস কাজল করের ব্যাপারে তার ছেলের থেকেও এই অলোক বলে ভদ্রলোকটি অনেক বেশী কনসার্নড।

মায়ের নার্সিংহোমে ভর্তি হওয়ার দিন সন্ধ্যায় বাকিরা এক সময় সব বাড়ি ফিরে গেলেও আমি আর অলোককাকু তখনও মায়ের কেবিনে বসে, ঘুমের ওষুধ দিয়ে মাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে, নিস্তব্ধ ঘরটায় আমি আর কাকু চুপ করে বসে রয়েছি, কাকুই শেষ অবধি সেই নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলেন, আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, বিকেলে আসার সময় উর্মিকে কেমন দেখে এসেছি?

কাকু, প্লিজ উর্মির কথায় আপনি কিছু মনে করবেন না, বুঝতেই পারছেন উর্মির মনের এখন অবস্থাটা ...

অলোককাকু আমায় কথাটা শেষ করতে দেন না, আরে না, না, আমি কিছু মনে করিনি, বৌমার মনের অবস্থাটা সত্যিই এখন খুব অস্থির, তুমি বরঞ্চ বৌদি সুস্থ হলে সবাইকে নিয়ে কটাদিন বাইরে থেকে কোথাও ঘুরে এসো, তাতে দেখবে সবার মনটাই একটু ভালো হবে।



ডাক্তারবাবু কালই জানিয়েছিলেন যে আজ বিকেলে মায়ের ছুটি হয়ে যাবে, সকালে আমি তখন অফিসে, কাকুর মোবাইল থেকে মায়ের ফোন এলো, বিকেলে নার্সিংহোমে আসার সময় আমি যেন মনে করে মায়ের চেকবইটা সঙ্গে করে নিয়ে আসি, এও বলে দিল যে আলমারির লকারের বাঁদিকে চেকবইটা রাখা রয়েছে।

জিজ্ঞাসা করলাম, কেন, চেকবই দিয়ে কী হবে।

মা সরাসরি উত্তর দিলো না, দরকার আছে, তুই মনে করে কিন্তু চেকবইটা নিয়ে আসিস।

নার্সিংহোমের বিল মা নিজেই মেটালো, নিজের বিল নিজে পেমেন্ট করাটা যদি বিকেলের প্রথম চমক হয় তাহলে দ্বিতীয় চমকটা হলো যখন অলোককাকু ওনার সঙ্গে করে নিয়ে আসা মেয়েটিকে দেখিয়ে বললেন, বাবু, এর নাম ছবি, আমাদের অফিসের দারোয়ানের চেনাশোনা, মেয়েটিকে আড়াল করে কাকু আমায় বললেন যে মেয়েটার নিজের বলতে কেউ নেই, দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের সংসারে ঝ্যাঁটা লাথি খেয়ে পড়ে আছে, তাই মায়ের সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টার হেল্পিং হ্যান্ড হয়ে থাকতে হবে শুনে মেয়েটির অভিভাবকরা এক কথায় রাজী হয়ে গেছে। নার্সিংহোম থেকে আমাদের তিনজনকে বাড়ির সামনে নামিয়ে কাকু চলে গেলেন, অনেক করে আসতে বললাম, কাকু শুনলেন না, জানালেন কাজ আছে, পরে আসবেন, কাকুর কথাটা শুনে এই পরিস্থিতেও আমার হাসি পেয়ে গেলো, সত্যি এরা ভাবে আমি এখনো বাচ্চা, বড়দের রাগ অভিমান বোঝার মত বয়স হয়নি, যাওয়ার আগে ছবিকে উদ্দেশ্য করে কাকু বলে গেলেন যে সে যেন মায়ের ঠিক মত দেখাশোনা করে, ছবির হাতে একটা কম দামী পুরনো মোবাইল, গাড়ি থেকে নামিয়ে মাকে ধরে ছবি যখন বাড়ির গেটের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল কাকু ওকে ডেকে বললেন যে কোনও অসুবিধা হলে ছবি যেন যেমন করে শিখিয়েছেন তেমন করে ফোনের বোতাম টিপে কথা বলে নেয়, ছবি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলাতে কাকু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে গাড়িতে স্টার্ট দিলেন।

ছবিকে বললাম সে যেন মাকে ধরে ধরে সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে নিয়ে আসে, আমি দৌড়ে গিয়ে ঘরের কলিংবেল বাজালাম, ছবি ওপরে ওঠার আগেই উর্মিকে মেয়েটার ব্যাপারে জানানো দরকার, বুঝতে পারছি না উর্মি কীভাবে নেবে ব্যাপারটা, কোনও ভরসা নেই, হয়তো মেয়েটাকে ঘরে ঢুকতেই দেবে না, দরজা দিয়েই হয়তো বিদেয় করে দেবে, দরজায় পৌঁছে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি মায়েরা তখনো একতলা পার হতে পারেনি, উর্মি দরজা খুলতেই ওকে খুব দ্রুত এবং সংক্ষেপে ব্যাপারটা জানালাম, সত্যিই যে আমি মেয়েটার ব্যাপারে কিছুই জানতাম না সেটা প্রাণপণে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ছবির কথা শুনে বা ওকে দেখে উর্মির চোখেমুখে কিন্তু কোনও ভাবান্তর হলো না, নিঃশব্দে আমাদের পাশ কাটিয়ে ও রান্নাঘরে চলে গেলো।



আজ রবিবার, বাজার থেকে ফিরে আজ আর ক্লাবে যাওয়া হলো না, ঝিনুক বললো যে ওর স্কুলের একটা প্রজেক্ট ওয়ার্ক আছে, ওকে হেল্প করতে হবে, ঝিনুকের সঙ্গে ওর স্কুলের প্রজেক্ট ওয়ার্ক নিয়ে বসেছি, উর্মি শোওয়ার ঘরের বিছানা তুলছে, মা নিজের ঘরে, প্রায় মাস খানেক হলো নার্সিংহোম থেকে মা ফিরে এসেছে, ছবির পরিচর্যায় আর ওষুধের গুণে তাড়াতাড়িই রিকভারি করছে, ওঘর থেকে টুক-টাক কথাবার্তার আওয়াজ ভেসে আসছে, ছবি মনে হয় ঘরদোর গোছগাছ করছে, বারবার আলমারি খোলার বা মেঝেতে সুটকেস টানার শব্দ হচ্ছে, আজকাল আমাদের বাড়িতে শব্দের যেন বড় আকাল, দিনের বেশীরভাগ সময়ই এই বাড়ির মানুষগুলো আসবাবপত্রের মত বোবা হয়ে থাকে, কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলে না, ঝিনুককে নিয়ে উর্মি এই সংসারটার মধ্যেই আরো একটা যেন সংসার বানিয়ে নিয়েছে, সেখানে আমার বা মায়ের কোনও প্রবেশ অধিকার নেই, প্রয়োজন ছাড়া উর্মি আজকাল আমাদের সঙ্গে একটাও কথা বলে না, মা আর ছবি এই সংসারেরই যেন আরেকটা দ্বীপ, ছবি মেয়েটা কিন্তু কাজের, চটপটে, বুদ্ধিটাও একেবারে ভোঁতা নয়, প্রথমদিকে মায়ের নির্দেশে সংসারের কাজে উর্মিকে হেল্প করতে গেলেও কিছুদিনের মধ্যেই উর্মির শীতল ব্যবহারে বুঝে গিয়েছে যে বৌদির থেকে দূরে থাকাই ভালো, তাই পারতপক্ষে আজকাল আর উর্মির ছায়া মাড়ায় না, নিজের কাজকর্ম সারা হলে মায়ের ঘরে বসে টিভি দেখে বা মায়ের সঙ্গে গল্প করে।

আর এই দুই শিবিরের মাঝে আমি যেন এক পথহারা পথিক, অফিস থেকে আজকাল আর বাড়ি ফিরতে মন চায় না, কী হবে বাড়ি ফিরে, লোকে বাড়ি ফেরে সংসারের টানে, সংসার বলতে আমার তো আজ আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, তবু দিনের শেষে এক সময় ঘরে ফিরতেই হয়, যেদিন তাড়াতাড়ি ফিরি সেদিন বাড়ি ফিরে হাত-পা ধুয়ে ঝিনুকের পড়ার ঘরে এসে বসি, ঝিনুককে পড়ানো হয়ে গেলে যতক্ষণ না রাতের খাওয়ারের সময় হচ্ছে ততক্ষণ টিভিটার সামনে বসে এলোমেলো ভাবে চ্যানেল ঘোরাতে থাকি, ভালো লাগে না, টিভি বন্ধ করে এক সময় আঙুলের ফাঁকে সিগারেট নিয়ে রাতের অন্ধকারে ছাদে এসে দাঁড়াই, চেয়ে থাকি রেলিংটার দিকে, ঈশ, প্রথমেই যদি কামালকে দিয়ে আর একটু উঁচু আর পোক্ত করে রেলিংটা গাঁথিয়ে নিতাম ...



ঝিনুকের পড়ার ঘরের দরজায় কার ছায়া এসে পড়লো, তাকিয়ে দেখি ছবি, ওর পরনের শাড়িটা দেখে মনে হচ্ছে বাইরে যাওয়ার আছে, মুখ-চোখেও দেখলাম হালকা প্রসাধনের ছাপ, দাদাবাবু, আপনাকে আর বৌদিকে মাসীমা একবার ওনার ঘরে ডাকছেন।

একটু চমকে উঠি, মা আমাকে ডাকছে সেটা ঠিক আছে, কিন্তু উর্মিকেও! আসলে এই একমাসে উর্মি আর মা সম্ভবত নিজেদের মধ্যে একবারের জন্যও বাক্যালাপ করেনি, অন্তত আমার চোখে তো সেরকম কিছু পড়েনি, ঝিনুকও দেখি ছবির কথায় অবাক, আসলে ওর শিশু-চোখেও আজকাল এসব ব্যাপার খুব সহজেই ধরা পড়ে, পড়ার ঘর থেকে বেডরুমে উর্মিকে ডাকতে যাওয়ার সময় দেখলাম মায়ের ঘরের দরজা ভেজানো, উর্মি বেডরুমে কাবার্ডের মধ্যে কী যেন খুঁজছে, এই শোনো, মা তোমায় একটু ডাকছে। আমার কথায় উর্মির কপালের দুই ভ্রুর মাঝখানের ফাঁকটা মুহূর্তে কুঁচকে তা আবার মিলিয়ে গেলো, মুখে কিছু বললো না, আমি জানি উর্মি মনে মনে কী ভাবছে, নিশ্চয়ই ভাবছে, আমার সঙ্গে ঐ ভদ্রমহিলার আবার কী দরকার, ওনার সঙ্গে তো আমার সব সম্পর্কই মিটে গিয়েছে, একটা সম্পর্ক যা হয়তো কখনো বা ছিল তা তো আজ ইতিহাস মাত্র, অচেনা-অপরিচিত দুটো মানুষ এখন আমরা পরিস্থিতির নিরিখে বাধ্য হচ্ছি একই প্লাটফর্ম শেয়ার করতে, আর অপেক্ষায় আছি কখন বিপরীতমুখী দুটো ট্রেন আসবে তার প্রতীক্ষায়, তারপরই আমরা তীরের মত ছুটে যাব নিজেদের নিজেদের আলাদা ঠিকানায়, কোনোদিন হয়তো আর মিলিত হব না।

যেন কৈফিয়ত দিচ্ছি সেভাবেই বললাম, বুঝতে পারছি না, ছবি এসে বললো যে মা নাকি তোমাকে আর আমাকে দুজনকেই একসঙ্গে ডাকছে। আসছি, সংক্ষিপ্ত জবাব উর্মির, জবাব দিয়ে উর্মি আবার তার কাজে মন দিলো, জিনিস খোঁজা নয় বুঝতে পারছি উর্মি মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে, খুব সম্ভবত আমার মতই ও-ও বুঝতে পারছে না যে মা কেন আমাদের দুজনকে একসঙ্গে ডেকে পাঠিয়েছে, উর্মিকে ওর মানসিক প্রস্তুতির সুযোগটুকু দিতে আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম।

এভরিথিং ইজ হ্যাপেনিং বেয়ন্ড মাই কন্ট্রোল, সো, বেটার, লেটস ইট হ্যাপেন অন ইটস ওন, ঘটনা যখন ঘটবেই আর সেখানে যখন আমার কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকবে না তখন আর এত ভেবে কী হবে, তার থেকে ঘটনাকে ঘটনার মতই ঘটে যেতে দেওয়া ভালো, দেখাই যাক না শেষ অবধি কী হয়, সিগারেটে টান দিয়ে বুক ভর্তি ধোঁয়া তাই বৃত্তাকারে শূন্যে ভাসিয়ে দিতে থাকলাম।



উজানের জন্য দুটো পুলওভার, একটা হাতকাটা সোয়েট জ্যাকেট আর নিজের জন্য টুকিটাকি কিছু কেনাকাটা সেরে শুভ্রা এবার আমায় নিয়ে ঢুকলো ছেলেদের জামাকাপড়ের একটা দোকানে, কুশলদা, একটা টি-শার্ট পছন্দ করুন তো, সামনে দাঁড়ানো সেলসম্যান ততক্ষণে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, বলুন ম্যাম, আমি কি আপনাদের কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?

আমার দিকে তাকিয়ে ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে শুভ্রা বলে ওঠে, এনার সাইজের টি-শার্ট দেখান তো।

বারণ করা স্বত্বেও শুভ্রা শুনলো না, টি-শার্টের প্যাকেটটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, কালারটা কিন্তু আপনার গায়ের রঙের সঙ্গে দারুণ ম্যাচ করবে।

শুভ্রাকে কিছু বলতে পারি না, মেয়েটা যেন ক্রমশই ঋণের দায়ে আমায় দায়বদ্ধ করে যাচ্ছে, নিজেই হয়তো ও জানে না যে আজকাল আমি ওর মধ্যে আমার আশ্রয় খুঁজে পাই, যখন কিছু ভালো লাগে না, বিক্ষিপ্ত মনটা এলোমেলো ভাবে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াতে চায় তখন নিজের অজান্তেই আজকাল শুভ্রার মুখটা আমার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে, ওর সান্নিধ্যে তখন সময় কাটাতে চায় মন, কালোমেয়ে বলে এরই নাম নাকি প্রেম, আমি নাকি শুভ্রার প্রেমে পড়ে গিয়েছি, না কালোমেয়ে তুমি মনে হয় ঠিক বলো না, কারণ আমি জানি শুভ্রা আমার প্রেম নয়, বরঞ্চ ও আমার জীবনের মরুভূমিতে একটা ছোট্ট মরূদ্যান যেখানে আমি আমার শান্তির খোঁজে বারবার ফিরে আসতে চাই ...

কী হলো চুপ করে গেলেন কেন, শুভ্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।

আচ্ছা একটা কথা বলো তো, আমার কি আর এখন সেই বয়স আছে আর যে এত রংচঙে টি-শার্ট পরে ঘুরে বেড়াবো।

ঘুরে বেড়াতে হবে কে বলল, স্মৃতি করে রেখে দেবেন, যখন আমি থাকব না তখন এই ছোট্ট স্মৃতিটা আমার কথা আপনাকে মনে করিয়ে দেবে।

যতই হাল্কা করে কথাটা বলুক আমার বুকের ভিতরটা কেমন যেন শিরশির করে উঠলো, শুভ্রার ডান হাতটা নিজের হাতের তালুর সঙ্গে চেপে ধরি।

তুমি তো সব সময়ই আমার সঙ্গে আছ, স্মৃতির কথা তবে আসছে কোথা থেকে?



মলের মেন দরজাটার দিকে হাঁটছি আমরা, শুভ্রার হাতটা এখনও আমার হাতে ধরা, কুশলদা, আমার কী মনে হয় জানেন, আমাদের এই জীবনটা আসলে একটা টিপিক্যাল সাবজেক্ট, কেউ আমরা জানি না যে হোয়াট উইল হ্যাপেন টুমরো, কেউ নয়, আমি, আপনি, আমাদের চারপাশে এই যে এত মানুষ দেখছেন, কেউই আমরা জানি না যে জীবন কাল আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে... শুভ্রা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই প্যাসেজের পাশের শোরুমের কাঁচের দরজাটা ঠেলে এক মাঝবয়সী ভদ্রমহিলার পিছু পিছু যে পুরুষ মানুষটি বেরিয়ে এলেন তিনি আমাদের দুজনকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন।

শুভ্রার হাতটা নিজের হাত থেকে ছাড়ানোর আগেই সমুদ্র আমাদের উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো, হাই, হোয়াট এ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ !



সিগারেটটা শেষ করে মায়ের ঘরের দরজায় এসে নক করি।

ভিতর থেকে মায়ের গলা ভেসে এলো, ছবি দরজাটা খুলে দে, বাবু এসেছে।

মায়ের ঘরের মেঝের ওপর বড় বড় দুটো সুটকেস জিনিসপত্রে ভরে রাখা, ছবি সুটকেসগুলোর ডালা বন্ধ করছে, মাকেও দেখছি ছবির মতই বাইরে যাওয়ার শাড়ি পরা, তার মানে মা আর ছবি কোথাও যাচ্ছে, উর্মি এরমধ্যেই আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, খোলা দরজায় উর্মিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মা বলে উঠলো, ওখানে কেন, ভিতরে এসো।

উর্মি কিন্তু দরজাতেই দাঁড়িয়ে রইলো, মা কিছু বলতে যাচ্ছিল, ছবির হাতে ধরা মোবাইলটা তখনই হঠাৎ করে বেজে উঠলো, হ্যাঁ মেশোমশাই ... আচ্ছা, আপনি এসে গিয়েছেন ... হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা রেডি ... এই তো মাসীমা দাদাবাবু আর বৌদির সঙ্গে কথা বলছেন ... চোখের ইশারায় ছবিকে ফোনটা দিতে বললো মা, হ্যাঁ অলোক, পাঁচ মিনিট, আসছি আমরা ... অলোককাকু ফোনের অপর প্রান্তে কিছু একটা বললেন আর তা শুনে মা বলে উঠলো, এ বাবা ... তাহলে ওরা কখন আসবে ... না, না, আপনি ওদের সঙ্গে বরঞ্চ একবার কথা বলে সময়টা জানান ... আমি সেই মত বাবুকে বলে রাখব ... হ্যাঁ, হ্যাঁ দুজনাই আমরা রেডি ... আসছি ... ফোনটা ডিসকানেক্ট করে দেয় মা।

অলোককাকু নিচে এসে দাঁড়িয়েছেন, কাকুও তাহলে যাবেন মায়েদের সঙ্গে, কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে পারছি না যে এত বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে মা আর ছবি চললো কোথায়? আমার ভাবনার মাঝেই টেবিলের ওপর পড়ে থাকা কাগজের একটা বান্ডিল মা আমার দিকে এগিয়ে দিলো, বাবু এই কাগজগুলো যত্ন করে...

আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারলাম না, জিজ্ঞাসা করলাম কিসের কাগজ এগুলো, আর এটা তো বলো এতসব বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে চললে কোথায়?

মা কাগজগুলো আমার হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে বললো, যত্ন করে রাখিস কিন্তু, বাড়ির দানপত্র এটা।

বাড়ির দানপত্র মানে?

মায়ের ঠোঁটের কোনে এক টুকরো হাসি যেন, ধুর বাবা, বাড়ির দানপত্র কী সেটা তুই জানিস না!

জানব না কেন, কিন্তু বুঝতে পারছি না যে বাড়ির দানপত্রটা তুমি হঠাৎ আমায় দিতে যাচ্ছ কেন, আমি এটা নিয়ে কী করব?

একটা কথা আসলে তোকে বলা হয়নি, একটু থামে মা, আমি আর ছবি এই বাড়ি ছেড়ে আজ চলে যাচ্ছি আর যাওয়ার আগে বাড়িটা তাই আমি ঝিনুকের নামে লিখে দিয়েছি।

কী বললে! তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছ! মানে! কোথায় যাচ্ছ তুমি? এতক্ষণে যেন সকাল সকাল মায়ের আর ছবির ভাল কাপড় পরা, সুটকেস নামিয়ে তাতে জিনিসপত্র ভরা, এসব আমার কাছে পরিষ্কার হতে শুরু করলো।

উপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে রেখেছে মা, মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝাই যাচ্ছে যে নাও শী ইজ গেটিং রেডি টু ডেলিভার এ হার্ড ট্রুথ, উত্তর কোলকাতায় সিঁথি বলে একটা জায়গা আছে না, ওখানে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছি ... তোর অলোককাকুই দেখে দিয়েছেন, ওনার চেনাশোনা কারোর বাড়ি, ঘরে যেন পিন পতনের নিস্তব্ধতা, আর সেই নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে মা আরো কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু মাকে সেই সুযোগ না দিয়ে আমি চিৎকার করে উঠলাম, বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছ, কী বলতে চাইছ তুমি ! পাগল হয়ে গেছ নাকি, নিজের অজান্তেই আমার গলা যেন চড়তে শুরু করলো, আর আমার সেই চড়া গলার আওয়াজে ঝিনুক ওর ঘর থেকে উর্মির পাশে এসে দাঁড়ালো, এখনও ও ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারেনি, তাই উর্মিকে নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করলো, কী হয়েছে গো মা?

উত্তরে উর্মি চোখ পাকিয়ে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি পড়া ছেড়ে বড়দের কথার মাঝে এসে দাঁড়িয়েছ কেন, যাও, গিয়ে পড়তে বসো, ঝিনুক অবশ্য গেল না, মেয়েটা মনে হয় বুঝতে পেরেছে যে আজ আমাদের সংসারের নোনাধরা দেওয়ালগুলির আর একটা দেওয়াল খসে পড়বার সময় হয়েছে, আর সেই দুঃসময়ের সাক্ষী হয়ে থাকার জন্য ঝিনুক উর্মির গা ঘেঁসেই দাঁড়িয়ে রইলো।

ওরে বোকাছেলে, অত চিৎকার করছিস কেন, শরীর খারাপ করবে তো, ঠাণ্ডা হয়ে বস, আচ্ছা বল, মানুষ কি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে না।

কেন থাকবে না, আমার গলা এখনও উচ্চগ্রামেই বাজছে, মানুষ ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে বা থাকতে পারে কিন্তু তার সঙ্গে তোমার ঘর ভাড়া নিয়ে থাকার কী সম্পর্ক, তুমি কেন ঘর ভাড়া নিয়ে থাকবে সেটাই তো আমি জানতে চাই।

আরে বাবা সব কাজ কি আর অত নিয়ম কানুন মেনে করা যায় বা করা সম্ভব, তুই এখন তাড়াতাড়ি দরকারি কথাগুলো শুনে নে তো, না হলে কোনটা হয়তো আবার বলতে ভুলে যাব কে জানে, মা যেন কথা ঘোরাতে চায়।

কীসের কথা, বললাম না আমার কোনও কথা শোনার দরকার নেই, এখন তুমি আমার কথা শোনো, তোমায় একটা কথা স্পষ্ট করে বলছি মা, এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও তুমি এক পা-ও যাবে না, ছবি, কোথায় তুই?

মেয়েটা মনে হয় সামনের ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, আমার চিৎকার শুনে তাড়াতাড়ি করে ঘরে ফিরে এলো।

বলুন দাদাবাবু।

বলুন দাদাবাবু! এত বড় একটা ধিঙ্গি মেয়ে, তোর বুদ্ধিশুদ্ধি বলে কিছু কি নেই ! মা বললো আর অমনি তুই জিনিসপত্র গুছিয়ে বাক্সে ভরতে শুরু করলি, একবার আমায় জিজ্ঞাসা করারও প্রয়োজন মনে করলি না, মায়ের ওপরের রাগটা যেন ছবির ওপরে বেরিয়ে আসতে চাইছে, মেয়েটা মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে, শোন, বাক্সের জিনিসপত্র এখনই সব নামিয়ে আবার আলমারিতে গুছিয়ে রাখ, আমার গলায় আদেশের সুর।

শোন বাবু, আঙ্গুলের ইশারায় আমায় বিছানায় বসতে বলে ছবির দিকে তাকিয়ে মা বললো সে যেন ঘরের বাইরে যায়।

ছবি বেরিয়ে গেলে মা বলতে শুরু করলো, শোন বাবু, জীবনের কিছু না ধর্ম আছে, আর সেই ধর্মে কখনো কখনো জানবি দূরত্ব কিন্তু আমাদের সম্পর্কগুলি অনেক সুস্থ আর স্বাভাবিক ভাবে বাঁচিয়ে রাখে, আর তাছাড়া সিঁথির বাড়িটার জন্য আমি একমাসের ভাড়াও অ্যাডভানস করে দিয়েছি।

অ্যাডভানস করে দিয়েছ তো কী হয়েছে, বাড়ীওয়ালার নাম ঠিকানা দাও, এখুনি গিয়ে আমি অ্যাডভানস ফেরত নিয়ে আসছি।

তুই না একদম ছোটই রয়ে গেলি, অ্যাডভানস নিলে কেউ কি আর তা ফেরত দেয় !

না দিলে না দেবে, তাতে কী এসে যায়, এক মাসের বাড়িভাড়ার ঐ কটা টাকা ফেরত না পেলে তুমি কি না খেয়ে মরবে!

মেঝে থেকে উঠে মা এবার আমার হাতটা চেপে ধরে, মাথা গরম করিস না, আমার কথাটা ভালো করে শোন। ক'দিন এখন আমায় অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে দে, বারণ করিস না।

কেন? কীসের জন্য তোমায় অন্য জায়গায় গিয়ে থাকতে হবে সেটাই তো আমার মাথায় ঢুকছে না!

ঐ যে বললাম না দূরত্ব কখনো কখনো জীবনে দরকার, তাতে সবারই ভালো হয়, আর তুই এই ব্যাপারটা নিয়ে এত ভাবছিস কেন, আমি কি খুব দূরে চলে যাচ্ছি, মন ভালো না লাগলে বাসে উঠে বসবি, দেখবি এক ঘণ্টাও লাগবে না পৌঁছতে, মুখে একটা কৃত্রিম হাসি জুড়ে মা বলে যায়, এত ভাবিস না, হয়তো দেখবি আমিও তোদের ছেড়ে বেশীদিন থাকতে পারব না, দুদিনেই হয়তো এমন হাঁপিয়ে উঠব যে বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে তখন আবার এসে হাজির হব এখানে।

আমার দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে এখন, না মা, তুমি এসব বলে আমায় ভোলাতে পারবে না, আমি জানি, খুব ভালো করেই জানি, এ বাড়ি ছেড়ে একবার চলে গেলে তুমি আর কোনদিন ফেরত আসবে না, কেউ বুঝুক আর না বুঝুক আমি জানি এটা তোমার একদিনের সিদ্ধান্ত নয়, একটু একটু করে নদীর বুকে যেমন শিলার সৃষ্টি হয় তেমনি তোমার বুকেও অনেকদিন ধরে আমাদের সবার অজান্তে অনেক দুঃখের পলি জমেছে আর উর্মির সেদিনের কথাগুলোতে ...

গলার স্বরটা আমার নিজের অজান্তেই যেন বদলে যায়, না, আর রাগ ঢাক করে কোনও লাভ নেই, মায়ের অভিমানের মূলটা ধরেই না হয় এবার নাড়া দেই, তাতে হয়তো মায়ের সিদ্ধান্ত বদলাতেও পারে, মানছি, উর্মি সেদিন সবার সামনে তোমায় যেসব কথা বলেছে সেগুলো ওর বলা উচিৎ হয়নি, কথাগুলো তোমায় ভীষণই হার্ট করেছে, কিন্তু তা বলে তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, এটা তো হতে পারে না, ভুল কে না করে, উর্মিও হয়তো সেদিন আবেগের মাথায় তোমায় এমন সব কথা বলে ফেলেছে যেগুলি ওর বলা ঠিক হয়নি কিন্তু তোমারও তো ভেবে দেখা দরকার যে সেদিন কী মারাত্মক মনের অবস্থায় ছিল ও …

আরে বাবা তুই তো দেখছি নিজের মতই করে সব কিছু বলে যাচ্ছিস, কখন আমি বললাম যে বৌমার কথায় আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি, হ্যাঁ এটা সত্যি যে বৌমার বলা কথাগুলি সেদিন সাময়িক ভাবে হয়তো আমায় আঘাত করেছিল, আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পরে যখন ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখেছি তখন আমার মনে হয়েছে বৌমা কিন্তু সেদিন কোনও অন্যায় বা অন্যায্য কথা বলেনি...

তাহলে ...

দাঁড়া, আগে আমায় কথা শোন, উর্মির দিকে ঘুরে মা এবার বলতে থাকে, শোনো বৌমা, আমি এটা মন থেকেই বলছি কিন্তু, সত্যিই সেদিনের ঘটনায় আমি কিছু মনে করিনি, তুমি আসলে সেদিন খুব স্বাভাবিক আর অবশ্যম্ভাবী একটা প্রশ্ন তুলেছিলে, এ প্রশ্নটা যে কেউই যে কোনদিন তুলতে পারতো বা পারে, এমনকি বাবুর মনেও কখনো এই প্রশ্নটা আসতে পারে, সেটা কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয় ...

মাকে তার কথার মাঝে থামিয়ে বলি, চুপ করো তো, কে তোমায় এত কথা বলতে বলেছে, কে বলেছে আমার মনে তোমায় নিয়ে প্রশ্ন আছে বা উঠেছে, তুমি জানো না, এই দুনিয়ার সবার সামনে দাঁড়িয়ে আমি জোর গলায় বলতে পারি যে তোমায় নিয়ে আমার মনে কোনও দ্বিধা নেই, আর সত্যি সত্যি যদি কোনোদিন দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব আসে তাহলে সেদিন সবার আগে আমি তোমায় গিয়ে তা জিজ্ঞাসা করব।

সে তুই জিজ্ঞাসা করতেই পারিস বা আমিও চাইব যে আর কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগে আমাকেই তুই কথাটা জিজ্ঞাসা করবি, কিন্তু ঘটনাটা কী জানিস, জীবনটা আমাদের বড়ই অনিশ্চিত, তাই ভবিষ্যতে যেদিন তোর মনে প্রশ্নটা উঠবে সেদিন হয়তো আমি বেঁচে নাও থাকতে পারি, তখন বাকি জীবনটা কিন্তু তোকে একটা খিচখিচ নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে, একটা শ্বাস নেয় মা, আমি জানি অলোক আর আমাকে নিয়ে শুধু বৌমার মনেই কেন, আরো অনেকের মনেই অনেক রকম প্রশ্ন বা ধারনা আছে, আর সেটা থাকাটাই খুব স্বাভাবিক, কারণ একটা মানুষ যার সঙ্গে আমাদের কোনও রক্তের সম্পর্ক নেই, আত্মীয়তা নেই, সে দিনের পর দিন আমাদের বাড়িতে আসা যাওয়া করে সুতরাং সেটা নিয়ে সমাজে কোনও প্রশ্ন উঠবে না, না, আমাদের সমাজটাকে আমি এতখানি উত্তাপহীন বলে মনে করি না।

ঠিক আছে, যাদের মনে এসব প্রশ্ন বা কুট-কাঁচালি আছে বা হচ্ছে তাদেরকে তা নিয়ে থাকতে দাও না, কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে এসব ফালতু ব্যাপারে তুমি কেন এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে? আমার গলায় স্পষ্টতই যেন অসহিষ্ণুতা।

আরে ব্যাপারটা অত সোজা নয়, আর সেই কারণেই সমাজের কাছে না হোক অন্তত আমার নিজের লোকেদের কাছে আমার অবস্থানটা আজ পরিষ্কার করে দেওয়া দরকার বা পরিষ্কার করে দিতে চাই, দেখ বাবু এই সমাজে আর সবাই কী ভাবলো বা না ভাবলো তা নিয়ে সত্যিই আমার কোনও মাথাব্যথা না-ও থাকতে পারে, কিন্তু আমি চাইব না যে আমার আর অলোককে নিয়ে তোর মনে বা তোদের মনে কোনও দ্বিধা থাকুক, বিশ্বাস কর তোর অলোককাকুকে নিয়ে আমার মনে কিন্তু কোনদিনই কোনও দ্বিচারিতা ছিল না বা আজও নেই, আর যতটুকু জানি তোর অলোককাকুরও আমাকে নিয়ে অন্তত আজ আর কোনও সংশয় নেই, কারণ আমরা দুজনাই জানি বা বুঝি, আমরা পরস্পরের খুব ভালো বন্ধু, কিন্তু সম্পর্কটুকু ঐ-টুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ, সেই বন্ধুত্বের সুযোগে উনিও যেমন কখনো নিজেকে আমার মনে তোর বাবার জায়গায় বসাতে চাননি তেমনি আমিও বিয়ের দিন থেকে একটা কথাই মনে প্রাণে বিশ্বাস করে এসেছি যে তোর বাবাই হচ্ছেন আমার একমাত্র ঈশ্বর, আরও একটা দীর্ঘশ্বাস নেয় মা, কিন্তু মুশকিলটা কী জানিস, আমাদের এই সমাজ এমন ভাবে তৈরি বা বেড়ে উঠেছে যে এখানে আজও একজন অনাত্মীয় নারী আর পুরুষের সম্পর্ক শুধুমাত্র বন্ধুত্বের সম্পর্কে কেউ মেনে নিতে চায় না বা পারে না, তাই নিজেদের মত করে তারা সেই সম্পর্কের একটা মাত্রা বা রূপ দিতে চায়, যাক গে এসব কথা, মা যেন হঠাৎ করে নিজেকে সংবরণ করে নেয়, একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা যেটা অনেকদিন ধরেই অনেক অপমান সহ্য করে মায়ের বুকে বাসা বেঁধে ছিল সেটা যেন আজ বাঁধ ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাইছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে মা তার অর্গল টেনে নিলো, যে বাড়িটায় যাচ্ছি তার ঠিকানাটা এখনও আমার জানা নেই, ওখানে গিয়ে তোকে ফোন করে জানিয়ে দেব, ভালো থাকিস তোরা, উর্মির আর ঝিনুকের খেয়াল রাখিস, আর একটা কথা মনে রাখিস, এই পরিবারের সব মানুষগুলিই কিন্তু তোকে তাদের শেষ আশ্রয় বলে মনে করে।

না মা, নিজের মনের কথা তুমি আমাদের বললে না, আমি জানি, অলোককাকুকে উদ্দেশ্য করে বলা সেদিনের উর্মির কথাগুলি তুমি মন থেকে মেনে নিতে পারনি, আর পারাটা মনে হয় তোমার পক্ষে সম্ভবও ছিল না, যে মানুষটা আজীবন তোমাকে তার অকৃত্রিম বন্ধু বলে মনে করে এসেছে, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে তোমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের হাত, যার জন্য তুমি সঙ্গীত জগতে এত সহজে নিজের পরিচিতি গড়ে তুলতে পেরেছ তাকে জীবন থেকে সম্পূর্ণ দূরে সরিয়ে রাখা ... না মা, আমি বুঝি, তুমি একটা অদ্ভুত দোলচালে দুলছ, একদিকে অলোককাকু আর অন্যদিকে সমাজ মানে তোমাকে ঘিরে থাকা চারপাশের মানুষগুলো, এ এক অদ্ভুত দাঁড়িপাল্লা, যেখানে কখনই দুটো পাল্লা এক সমতলে এসে দাঁড়াতে পারে না বা পারবে না, অথচ তোমার কাছে দুটোই ভীষণ রকম সত্য, তাই...

মা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, বাবার একটা বড় বাঁধানো ফটো বিছানার ওপর পেপার র‍্যাপ করা ছিল, মা সযত্নে সেই পেপার র‍্যাপটা একটা বড় কাপড়ের ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়, আবারও বলছি তোকে, ভুল বুঝিস না, কখনই ভাবিস না যে আমি তোদের ওপর রাগ করে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি, সব সময়ই আমি এটাই বিশ্বাস করে এসেছি যে তোরা হচ্ছিস আমার শরীরের, মনের এক-একটা অংশ, তোরা ছাড়া আমি কখনই পূর্ণ নই, কাছে বা দূরে যেখানেই থাকি না কেন তোদের নিয়েই আমি বেঁচে থাকব আর ভগবানের কাছে সব সময় প্রার্থনা করব যে তোরা যেন ভালো থাকিস ... মায়ের গলাটা ক্রমশ যেন বুজে আসছে, কোনও রকমে কান্নাটাকে চেপে মা ছবিকে ডেকে বললো সুটকেস দুটো নিচে নামাতে, আর হ্যাঁ, আর একটা কথা বাবু, বিকেলের দিকে অলোক টেম্পো দিয়ে দুজন লোক পাঠাবে, ওরা এলে তানপুরা, হারমোনিয়াম আর ঐ কাঠের যে বড় বাক্সটা আছে ওগুলো একটু বের করে দিস ...


ঝিনুক আর তার মায়ের মত পাষাণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না, দৌড়ে গিয়ে মেয়েটা ঝাঁপিয়ে পড়লো ঠাম্মার বুকের ওপর, ও ঠাম্মা, তুমি যাবে না, আমাদের ছেড়ে কোথাও যাবে না, বলো, তুমি আমাদের সঙ্গেই থাকবে।

যন্ত্রের মত মায়ের হাতটা উঠে এলো ঝিনুকের মাথায়, দু’চোখ মায়ের জলেতে ভরা, তবু মুখে হাসি টেনে ঝিনুককে বললো, ধুর পাগলী, বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া মানেই কি তোদের ছেড়ে চলে যাওয়া, শুনলি না কী বললাম, যেখানেই থাকি, তোদের নিয়েই জীবনের বাকী কটা দিন আমি বেঁচে থাকব।

না, মা আর তার মুখের কৃত্রিম হাসিটা ধরে রাখতে পারলো না, ঝিনুককে নিজের দুহাতের বেড়ে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।




ক্রমশ