শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

কথাগুলো বলা হলো না, পর্ব -১১

১১

এক মাস হয়ে গেলো বাবা মারা গিয়েছে, বাবা ছিল খুবই সাধারণ আর অন্তর্মুখী স্বভাবের একজন মানুষ যে কী না আর পাঁচজন সাংসারিক মানুষের মত তার পরিবারের মানুষগুলির খাওয়া দাওয়া পোশাক পরিচ্ছদ বা শখ আহ্লাদ পূরণের জন্য নিজের জীবনের শেষ বিন্দু অবধি চেষ্টা করে গিয়েছিল। তাই সমাজে বাবার মৃত্যু সেরকম ছাপ না ফেললেও মা আর আমি কিন্তু বাবার অভাবটা বেশ অনুভব করছি। বাবার মৃত্যুর পর আমাদের সংসারের প্রাত্যহিক রুটিনটাই যেন বদলে গিয়েছে। আগে সকালবেলায় ঘুম ভাঙ্গলে দেখতাম মা সকাল সকাল স্নান সেরে পূজা করে বাবার অফিস যাওয়ার তদারকিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে, সকাল সকাল তখন আমাদের রান্নাঘর থেকে ঘন ঘন বাসনপত্রের আওয়াজ ভেসে আসত, রান্নার ফাঁকে ফাঁকে মা দৌড়ে গিয়ে খাটের ওপর বাবার অফিসের জামাকাপড় বের করে রাখতো, কখনও বা বাবা পেন খুঁজে না পেয়ে চিৎকার জুড়লে মা টেবিল-ক্লথ সরিয়ে বা আগের দিনের পরা শার্টের বুকপকেট থেকে পেনটা ঠিক খুঁজে বের করে দিতো, আর সব শেষে টিফিন-ডাব্বা-জলের বোতল ঠিকঠাক গুছিয়ে একটা ঝোলায় ভরে বাবার হাতে তুলে দিয়ে সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে দু'হাত জড়ো করে দুগ্গা দুগ্গা বলা, না, এই দৃশ্যগুলো আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে এখন। যেমন হারিয়ে গিয়েছে মায়ের নিজের যত্ন আত্তি বা ন্যূনতম ভাবে নিজেকে সাজিয়ে রাখার চেষ্টাটাও। কোনোদিনই মাকে আমি সেরকম রং চংয়ে শাড়ি পরতে দেখিনি, তাই বাবা মারা যাওয়ার পর সরু পাড় সাদা থান পরা মাকে দেখে আমি হয়তো সেভাবে চমকে উঠিনি কিন্তু কলেজ শেষে বাড়ি ফিরে আজকাল যখন দেখি স্নানের পর চুলটাও মা আঁচড়ায়নি বা হারমোনিয়ামটা সামনে রেখে ছাদের দিকে অনির্দিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তখন যেন বড় খারাপ লাগে। সেদিন দেখি দেওয়ালে টাঙানো বাবার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মা সমানে দু'ঠোঁট নেড়ে কী যেন বলে যাচ্ছে, কাছে যাই, ভাবি মাকে জড়িয়ে ধরলে হয়তো মায়ের বুকে জমে থাকা বাষ্পগুলি কান্না হয়ে বেরিয়ে আসবে, আমার হাতের স্পর্শে মা ঘুরে দাঁড়ায় , এক অজানা দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে মা বলে ওঠে, জানিস বাবু, তোর বাবা কিন্তু আমায় ভুল বুঝে চলে গেলো, কী করে তোর বাবাকে এখন বোঝাই বল তো, উনিই ছিলেন আমার একমাত্র ঈশ্বর।

কেন জানি না মায়ের বলা কথাগুলো সেদিন আমার চোখেও কিন্তু জল এনে দিয়েছিল।

ওই যে বলে না চোখের জল অনেক সময় কোনো নিয়ম মানে না, নিজের নিয়মেই সে ভাসিয়ে দেয় আমাদের জীবনের সব অনুভূতিগুলো।



সায়গল সাহেব শেষ অবধি কিন্তু তাঁর ম্যাজিক দেখিয়ে ছাড়লেন , কিভাবে যে রিচার্ডকে বশ করলেন তা ভগবানই জানেন , কিন্তু মোদ্দা কথা হলো আমাদের তিনটে প্রোডাক্টই এক্সিনের স্পেকে স্পেসিফাই হয়ে গিয়েছে আর সেই সুবাদে গত বছরে আমাদের অর্ডার বুকিং টার্গেট ছাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ , ব্রাঞ্চ অ্যাচিভমেন্টের বেশীরভাগ কৃতিত্বটাই অবশ্য মিত্র নিয়ে নিয়েছেন , বছর ঘুরতেই তাই প্রমোশন পেয়ে উনি এখন এ জি এম - সেলস, আমার ভাগ্যেও অবশ্য একটা অপ্রত্যাশিত প্রমোশন জুটেছে , ডেপুটির তকমা হাঁটিয়ে আমি এখন পুরো দস্তুর ম্যানেজার , তবে নতুন ফাইনানসিয়াল ইয়ারে বিজনেসের অবস্থা খুবই খারাপ, অর্ডারপত্র প্রায় নেই বললেই চলে, মিত্রের মুখটা আজকাল বেশীরভাগ সময়ই বাংলার পাঁচের মত হয়ে থাকে , সময় নেই অসময় নেই, ছেলেগুলোকে খালি খিচচ্ছেন , আরে বাবা ছেলেগুলোকে খিচিয়ে কি হবে , বাজারের যা অবস্থা তাতে ছেলেগুলির আর কী দোষ, এখন তো আবার বিশ্বায়নের যুগ, তাই দুনিয়ার যে কোনো প্রান্তে একটা মাছি মরলেও তার এফেক্ট সুনামির মতন বিশ্বের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়ে, টাকার মূল্যও যেন প্রতিদিন হু হু করে নিচে নামছে, পৃথিবীর বড় বড় ব্যাঙ্কগুলি যখন তখন নিজেদের দেউলিয়া বলে ঘোষণা করে দিচ্ছে, ওদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রুডের দাম যেন সি-স-র মতন ওঠানামা করছে , সবকিছু মিলিয়ে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি যেন আর সেই পরিস্থিতিতে কেউ আর গ্যাঁটের টাকা ইনভেস্ট করতে চাইছে না, সবাই অপেক্ষা করছে পরিস্থিতি কোনদিকে টার্ন নেয় তা দেখার জন্য , আমার ভাগ্যটা অবশ্য ভালোই বলতে হবে, এই দুর্দিনের বাজারেও রায়গড়ার প্লান্টটা থেকে আমি একটা বড় অর্ডার পেয়েছি , সৌজন্য সেই সৈকত ব্যানার্জি, সেদিন ওনার কোলকাতার বাড়িতে কবিতার পাণ্ডুলিপিগুলি দিয়ে আসার পর মাস খানেক বাদে ভদ্রলোকের ফোন এসেছিল, কিছুক্ষণ একথা-সেকথার পর আসল কথায় এলেন, প্রকাশক-মশাই নাকি বই ছাপাতে আগে যে পরিমাণ টাকা চেয়েছিলেন তার থেকে এখন বিশ হাজার টাকা বেশী চাইছেন, আমি যদি ব্যাপারটায় একটু মধ্যস্থতা করি, তা মধ্যস্থতায় প্রকাশক-মশাই শেষ অবধি পাঁচ হাজার কমাতে রাজি হলেন, বাকী পনেরো হাজার আমাদের কোম্পানিই দিলো , বই ছাপা হলে উদ্বোধনের দিন ব্যানার্জিবাবু আমাকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন , আর অনুষ্ঠান শেষে ডেকে বললেন, দাদা ইনডেন্ট বানাচ্ছি , মাস খানেকের মধ্যেই অর্ডার পেয়ে যাবেন ।

তা ব্যানার্জিবাবুর দেওয়া সেই অর্ডারে আমার ওপর প্রেশারটা এখন একটু কম কিন্তু বাকী ছেলেগুলির অবস্থা খুবই করুণ, অর্ডার বুকিংয়ের প্রো-রাটা সবারই প্রায় বিশ-পঁচিশের ঘরে , তবে এই দুরবস্থা শুধু আমাদের ব্রাঞ্চেরই নয়, বাকি ব্রাঞ্চগুলোর অবস্থাও প্রায় একই রকম, এসবের মাঝে আবার যোগ দিয়েছে এদিক-সেদিক থেকে উড়ে আসা উড়ো খবরের টেনশন, গত দু’মাস ধরে নাকি বিভিন্ন ব্রাঞ্চে একটা দুটো করে উইকেট পড়ছে , উইকেট পড়া মানে চাকরি ছেড়ে দেওয়া, অনেকেই বলছেন যারা রিজাইন করছেন তারা নাকি নিজের ইচ্ছেয় চাকরি ছাড়েন-নি , দে ওয়ার আস্কড টু রিজাইন, কথাগুলো কতখানি সত্য বা মিথ্যা তা জানি না, মিত্রকে আজকাল এসব নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে উনি আর আগের মত খোলাখুলি আলোচনা করেন না, হাবভাবে বুঝিয়ে দেন যে এ জি এম হওয়ার পর উনি এখন ম্যানেজমেন্টের লোক , তাই ওনার পক্ষে আর এসব নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব নয়, তবে লোক তাড়ানোর ব্যাপারটা মনে হয় সত্যি নয়, কই আমাদের ব্রাঞ্চের কাউকে তো হেড অফিস থেকে এখনও রেজিগিনেশন দেওয়ার কথা বলেনি, তবে ম্যানেজমেন্ট না বললেও আমাদের ব্রাঞ্চেও কিন্তু একটা উইকেট পড়েছে, দু’সপ্তাহ আগে নিলয় তার পেপার সাবমিট করেছে, সবাইকে বলে বেরাচ্ছে যে ওর রেজিগনেশন লেটার পেয়ে মিত্র নাকি মাইনে আর ডেজিগনেশন দুটোই বাড়িয়ে দিতে চাইছিলেন , বাট হি ডিডন্ট এগ্রি, মুখে যাই বলুক আমরা সবাই জানি যে নিলয়কে নিয়ে মিত্রের ইদানীং মোহভঙ্গ হয়েছিল , আসলে গত বছরের শেষের দিকে ওর ভুলেই কোম্পানি দু-দুটো বড় অর্ডার লুজ করেছে আর তার জন্য সায়গল সাহেবের কাছে বসকে অনেক কথাও শুনতে হয়েছে , তবে গত বছরের অর্ডার বুকিং ভালো থাকায় ব্যাপারটা আর বেশী দূর গড়ায়নি , আজকের পরিস্থিতিতে যদি এরকম ভুল হতো তাহলে যে কী হতো তা কে জানে ... আমাদের অফিসে রামন বলে একজন সাউথ ইন্ডিয়ান নন-টেকনিক্যাল স্টাফ আছে, ছেলেটির বয়স এই তিরিশের মত, ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় খুব সুন্দর কথা বলে আর স্বভাবটাও খুব মিষ্টি , কাজের ফাঁকে ঘুরতে ঘুরতে রামন আজ আমার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো, দাদা, কীসব শুনছি বলুন তো?

ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে বললাম , কী আবার শুনলে?

ঐ যে সবাই বলছে কোম্পানি নাকি অনেককেই দু’মাসের মাইনে হাতে ধরিয়ে গুডবাই করে দিচ্ছে, কথাটা কি সত্যি?

কিছুদিন আগে রবিবারের কাগজে সুবোধ সরকারের একটা কবিতা পড়ছিলাম, আজ এই মুহূর্তে রামনের মুখের দিকে তাকিয়ে সেই কবিতার কয়েকটা লাইন হঠাৎ করে মনে পড়ে গেলো

... গতকাল শুনলাম

মাল্টি-ন্যাশনালে চাকরি করতেন অংশুমান রায়

কী ভাল, তার অফিস তাকে সপরিবারে

মরিশাস পাঠাল বেড়াতে।

দশদিন বাদে ফিরে এসে দেখল

তার চেয়ারে বসে আছে তার থেকে একটু ফর্সা

তার থেকে একটু লম্বা

তার চেয়ে একটু ঘন চুল অন্য এক

অংশুমান রায়।

রামন নিজের সিটের দিকে পা বাড়ালে আমি আবার ল্যাপটপে মন দিলাম , ফোনটা বেজে উঠলো, শুভ্রার ফোন , ও জানালো যে সাত দিনের জন্য উজানের কাছে যাচ্ছে।



ভেবেছিলাম যে তাড়াতাড়ি কাজগুলো সেরে দেখব যে দু-একদিন আগেই ট্যুর থেকে বাড়ি ফিরে আসা যায় কি না কিন্তু ফিরতে ফিরতে সেই শনিবারই হয়ে গেলো, আসলে শুভ্রার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিল, বাপের বাড়ি শ্বশুর বাড়ি দু'বাড়ি থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে মেয়েটা এখন বিয়ের পর ভীষণই একলা হয়ে পড়েছে, তার ওপর বাচ্চা অ্যাব্রট করার ব্যাপারটা ও আবার সমুদ্রকে জানাতে চাইছে না, বৃহস্পতিবার মানে অপারেশনের দিন শেষ পর্যন্ত ওর সেই বন্ধু কী যেন সেদিন নাম বলছিল সে সঙ্গে গেলো কী না কে জানে, সমস্যাটা হচ্ছে শুভ্রার সঙ্গে দূর থেকে যোগাযোগ করার কোনো উপায় নেই, খুব ভুল হয়ে গিয়েছে, যেদিন শুভ্রাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম সেদিন শুভ্রাকে জিজ্ঞাসা করা উচিৎ ছিল যে কণাদি মানে ওদের সেই বাড়িওয়ালীর ঘরে টেলিফোন আছে কি না।

ট্রেন লেট হয়ে শনিবার বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেলো, ভাবলাম পরেরদিন রবিবার, বিকেলের দিকে একবার ঘুরে আসব শুভ্রাদের ওখানে থেকে, কিন্তু রবিবার দুপুর থেকেই মায়ের শরীরটা আবার খারাপ, তাই আর বেরনো হলো না।

আজ সোমবার অফিসে পৌঁছতেই বসের তলব , যাদবপুরে ইন্ডিয়ান প্রজেক্ট বলে যে কোম্পানিটা আছে সেখানে একবার যেতে হবে , একটা পেমেন্ট নাকি অনেকদিন ধরে পড়ে আছে, ভালোই হলো, যাদবপুরে কাজ সেরে তাহলে শুভ্রার ওখান থেকে মানে সন্তোষপুর থেকেও একবার ঘুরে আসা যাবে, খুব চিন্তা হচ্ছে মেয়েটার জন্য, কে জানে কেমন আছে।

যাদবপুর এইট বি বাস স্ট্যান্ডের ঠিক পাশেই ইন্ডিয়ান প্রজেক্টের অফিস, বছর দুয়েক আগে এদের একটা প্রজেক্টে আমরা কিছু জিনিসপত্র সাপ্লাই করেছিলাম, অর্ধেক পেমেন্ট সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিলেও বাকী অর্ধেক আজও দেয়নি , দোতলা বাড়িটার পুরো দোতলা জুড়ে ইন্ডিয়ান প্রজেক্টের অফিস, সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতেই সরাসরি রিসেপশনের দরজা, খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে কাউকে অবশ্য সেখানে দেখতে পেলাম না, রিসেপশনের ইউ শেপের শূন্য টেবিলটার বাঁদিক করে দেওয়াল ঘেঁসে একটা আধ ভাঙ্গা থ্রি সিটার সোফা পাতা, সোফার পাশ দিয়ে নাইলনের দড়ি বিছানো কাঠের দুটো চেয়ারও রয়েছে, একটা চেয়ারের নাইলনের দড়ির বাঁধন আলগা হয়ে মাঝখানে বেশ বড় একটা গর্ত, বুঝতে পারছি না যে এখানেই অপেক্ষা করা ঠিক না কি সামনের সুইং ডোরটা ঠেলে ভিতরে ঢুকে যাব, দোনোমনা করতে করতে শেষ অবধি সুইং ডোর ঠেলে ভিতরেই ঢুকে পড়লাম , ভিতরে লম্বা মত একটা হলঘর , ছড়িয়ে ছিটিয়ে সেখানে অনেক মানুষ বসে রয়েছেন, তবে হলঘরটার অবস্থাও অনেকটা রিশেপশনের মতই, মেঝেতে ইঞ্চি খানেকের মত ধুলো, দেওয়ালগুলোতে পানের পিকের আঁকিবুঁকি , দেওয়ালের কোনে কোনে মাকড়শার জাল যেন রহস্য তৈরি করে রেখেছে , সিলিংয়ে টাঙ্গানো আদ্যিকালের ফ্যানগুলি ঘটাং ঘটাং করে ঘুরে চলেছে , হলঘর জুড়ে বিড়ী আর সিগারেটের গন্ধ , আমাকে হলের ভিতর ঢুকতে দেখে পিছনের দিকে বসে তাস খেলতে থাকার দলটার কেউ কেউ একবার চোখ তুলে তাকালো, কানে এলো তাসখেলার সঙ্গে সেখানে চলছে কালকের সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া ট্রেন দুর্ঘটনার ময়না তদন্ত, আসানসোলের কাছাকাছি কাল দ্রুতগামী একটা ট্রেন লাইন পেরতে থাকা একটা লড়িকে ধাক্কা মেরে নিজেও লাইন-চ্যুত হয়েছে, বেশ কয়েকজন যাত্রী হতাহত, শালা, ভাবতে পারিস, ফাটকের লোকটা নাকি ডিউটির সময় গেট বন্ধ না করে মাল টানতে গিয়েছিল, হাতে তাস আর ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট গুঁজে একজন কথাগুলি বলে উঠলেন , হাতে ধরা তাসগুলিকে মেলে ধরতে ধরতে পাশের লোকটি তার কথার উত্তরে বললেন , এই সব কাজে ফাঁকি দেওয়া … বাচ্চাগুলোর একটাই শাস্তি হওয়া দরকার, লোহার রডটা গরম করে তার ঠাণ্ডা দিকটা পিছনে ঢুকিয়ে দাও, ভদ্রলোকের কথায় হলের অনেকেই হো হো করে হেসে উঠলেন, সত্যিই তো, রডটার ঠাণ্ডা দিক ঢুকিয়ে দিলে বেচারি গরম দিকটা ধরে টানতেও পারবে না!

কার কাছে পেমেন্টের খোঁজ করবো সেটা ভাবতে ভাবতে সামনের টেবিলে যে ভদ্রমহিলা ফাইলের স্তূপে প্রায় ঢাকা পড়ে এক মনে সোয়েটার বুনে যাচ্ছিলেন ওনাকেই কথাটা জিজ্ঞাসা করলাম , দিদি, দয়া করে বলবেন পেমেন্টের ব্যাপারে কার সঙ্গে কথা বলব?

উল বোনা থামিয়ে ভদ্রমহিলা একবার আমার আপাদ মস্তক দেখে নিয়ে জানালেন যে অ্যাকাউন্টের বড়বাবু এখন ছুটিতে আছেন, আমি যেন পরে আসি।

পরে মানে কবে ?

ভদ্রমহিলা খুবই দয়ালু , না হলে অফিস আওয়ার্সে উল বোনার মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছেড়ে আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতেন না, ওনার মেয়ের বিয়ে , দু’সপ্তাহ এখন উনি ছুটিতে।

দু সপ্তাহ! গলায় যতদূর সম্ভব কাতরতা ফুটিয়ে বলে উঠি , দিদি, আসলে কী জানেন , আমাদের এই পেমেন্টটা না অনেকদিন ধরে পড়ে আছে, হেড অফিস থেকে ভীষণ চাপ দিচ্ছে, দয়া করে যদি বলেন অ্যাকাউন্ট ডিপারমেন্টে অন্য কার সঙ্গে কথা বললে কাজটা হবে তাহলে বড় উপকার হয়।

তাস খেলতে থাকা দলটার দিকে তাকিয়ে ভদ্রমহিলা এবার একটা হাঁক দিলেন , খোকন, একটু এদিকে এসো তো , এক ভদ্রলোক একটা পেমেন্টের ব্যাপারে খোঁজ করছেন।

খোকন বলে সেই ভদ্রলোক মুখ না তুলেই জবাব দিলেন, সুলতাদি, বলো দাও ব্যস্ত আছি, এখন কথা বলতে পারব না, পরে যেন আবার ফোন করে।

এবার ভদ্রমহিলা দৃশ্যতই অপ্রস্তুত, খোকন, উনি ফোনে নন, আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।

এইট বি বাসস্টান্ড থেকে সন্তোষপুরে যাওয়ার অটোটা পেয়ে গেলাম , সেই তখন থেকে গা-টা রাগে রি-রি করছে, খোকন বলে ঐ ভদ্রলোককে পেমেন্টের কথা বলা মাত্র উনি সরাসরি একদম মুখের ওপর ঘুষ চেয়ে বসলেন , দশ হাজার টাকা দিতে হবে, তবে এ-ও জানালেন যে টাকাটা পুরো ওনার পকেটে যাবে না, বড়বাবু থেকে শুরু করে বিভাগের আর সবাই এর থেকে কম বেশী ভাগ পাবেন। মন্দিরের উল্টোদিকের মোড়ের সেই চায়ের দোকানটায় এখন দু’জন বয়স্ক মানুষ বসে চা খাচ্ছেন , ওনাদের চা খেতে দেখে আমারও যেন হঠাৎ করে চা খেতে খুব ইচ্ছে হলো , আর চা খেতে খেতেই ভাবলাম শুভ্রার জন্য আমার মনে হয় হাতে করে কিছু একটা নিয়ে যাওয়া উচিৎ, এ-ধরনের সার্জারিতে শরীরের ওপর অনেক ধকল পড়ে শুনেছি, হরলিকস জাতীয় কিছু একটা নিয়ে গেলে ভালো হয়, আশেপাশে তাকিয়ে দেখি এদিককার সব দোকানগুলিই এখ দুপুরে বন্ধ , বড্ড ভুল হয়ে গেছে , যাদবপুরের মোড় থেকেই হরলিকসটা কিনে নিলে ভালো হতো , চা খেয়ে পয়সা মিটিয়ে দোকানের বুড়োটাকেই জিজ্ঞাসা করলাম , ধারে-কাছে হরলিকস-ফরলিকস পাওয়া যাবে এমন কোনো দোকান এখন খোলা আছে কি না, ভদ্রলোক জানালেনয যে একটু এগিয়ে গেলে কৃষ্ণা ভ্যারাইটিস বলে একটা দোকান আছে যেটা দুপুরবেলাতেও খোলা থাকে।

একটা হরলিকস, কিছু শুকনো কেক, কয়েকটা বিস্কিটের প্যাকেট আর তার সঙ্গে একটা ক্যাডবেরির বড় বারও নিয়ে নিলাম, পড়ানোর সময় দেখতাম অংক করার ফাঁকে ফাঁকে শুভ্রা মিল্ক-বারের ছোট ছোট প্যাকেটগুলো খুলে তাতে কুটুস কুটুস করে কামড় দিতে থাকত। সিগারেটের বাটটা এক টোকায় নর্দমায় ফেলে বাই লেনটায় ঢুকি, এখানেই সেদিন সমুদ্রের সঙ্গে দেখা হয়েছিল , আজ কিন্তু গলিটা একদম সুনসান , শুভ্রাদের বাড়ির সদরেও কাউকে বসে থাকতে দেখলাম না, খোলা দরজা পার করে ভিতরে ঢুকছি পিছন থেকে কণাদির গলা ভেসে এলো , উনি যে কখন আমাকে বাড়ির ভিতর ঢুকতে দেখে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন তা খেয়াল করিনি।

ও মা, তুমি যে! আমাকে দেখে ভদ্রমহিলার চোখেমুখে যেন বিস্ময়।

একটু অবাকই হলাম, আমাকে দেখে এমন বিস্মিত হওয়ার কারণটা ঠিক কী সেটা বুঝে উঠতে পারলাম না, মুখে তাই একটু হাসি টেনে বললাম, অফিসের একটা কাজে এদিকে এসেছিলাম, ভাবলাম শুভ্রার সঙ্গে মানে বোনের সঙ্গে একটু দেখা করে যাই।

ও মা বোনের সঙ্গে দেখা করবে কী করে গো, তুমি জানো না, ওরা এ বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে!

শুভ্রারা এ বাড়ি মানে আপনাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে! নিজের অজান্তেই কথাগুলি যেন বলে উঠলাম , আমি যে ভদ্রমহিলার কথাগুলো ঠিক মত বিশ্বাস করতে পারছি না সেটা মনে হয় আমার মৌখিক এক্সপ্রেশনে ধরা পড়ে গিয়েছিল, তাই ভদ্রমহিলা এবার ডিটেলে বলতে শুরু করলেন, হ্যাঁ, গো, তোমার বোনরা তো এই শনিবারই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো , তারপর উনি যেন নিজের মনেই বলতে থাকলেন, ছোড়াটার মনে হয় ভালো চাকরি বাকরি হয়েছে, যাওয়ার আগে আমাদের পাওনাগণ্ডা তো সব মিটিয়ে দিয়ে গেলো।

ইতস্তত করে শেষ অবধি কথাটা জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম , মাসীমা, আপনি কি জানেন , ওরা কোথায় গিয়েছে , মানে ওদের নতুন বাড়ির ঠিকানা কি আপনার কাছে আছে ?

আরে ওটাই তো মস্ত বড় ভুল হয়ে গিয়েছে, যাওয়ার আগে এমন তাড়াহুড়ো করলো যে জিজ্ঞাসা করব করব করেও শেষ মুহূর্তে আর জিজ্ঞাসা করা হয়নি ।

পলি-ব্যাগ ভর্তি জিনিসগুলি হাতে নিয়ে বড় রাস্তায় এসে রিকশায় চাপলাম।

কোথায় গেল শুভ্রা?



আজ সকালে অফিসে ঢুকতেই ক্যারল জানালেন যে কাল লাঞ্চের পর আমি যখন অফিস থেকে বেরিয়েছিলাম তখন শুভ্রা বলে এক ভদ্রমহিলা ফোন করেছিলেন , ক্যারলকে জিজ্ঞাসা করলাম, উনি কি কোনো কন্টাক্ট নম্বর দিয়েছেন ?

না, কোনো কন্টাক্ট নম্বর দেননি , বলেছেন পরে আবার ফোন করবেন।




অফিস ফেরত কলিং বেল বাজাতে উর্মি দরজা খুলে দিলো আর ও দরজা খুলতেই ঘরের ভিতর থেকে পাপান দৌড়ে এসে বা-ব্বা-আ বলে আমায় জড়িয়ে ধরলো , ল্যাপটপের ব্যাগটা উর্মির হাতে দিয়ে পাপানকে কোলে তুলে নেই ।

এই তোমাকে কতদিন না বলেছি যে অফিস থেকে ফিরে আগে হাত-পা ধোবে, তারপর পাপানকে কোলে নেবে, উর্মির চোখেমুখে শাসন, আমি বা পাপান অবশ্য উর্মির এই শাসনের পরোয়া করলাম না , ছেলেকে কোলে নিয়ে সোজা হলঘরের সোফায় এসে বসি, উর্মি তখনও নিজের মত করে বলে যাচ্ছে , তোমায় আর এসব বলে কী লাভ, তুমি কি কোনোদিন আমার কথা শোনো , আমাকে শাসন করতে না পেরে উর্মি এবার ছেলেকে নিয়ে পড়লো, পাপান বাবার কোল থেকে এখুনি নেমে এসো , না হলে আমি কিন্তু খুব বকবো, বাবা হাত-পা ধুয়ে আসুক, তারপর তুমি বাবার কোলে উঠবে, পাপান অবশ্য থোড়াই এত কিছু বোঝে বা বুঝলেও তার কেয়ার করে , সে এখন আমার কোলে চড়ে ড্যাব ড্যাব করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে আর মাঝে মাঝে আমার নাকটাকে ওর কচি কচি আঙ্গুলগুলি দিয়ে খিমচি কাটছে । জুতো খুলে পাপানকে নিয়ে শোওয়ার ঘরে আসি, অফিস ফেরত আমার এখন অনেকটাই সময় কেটে যায় পাপানের সঙ্গে, ছেলেকে খাটের ওপর বসিয়ে বলি , তুই একটু বস, আমি চট করে হাত-পা ধুয়ে আসি, নইলে তোর মা আমাকে পিট্টি দেবে , পাপান আমার কথার উত্তরে আরেকবার বা-ব্বা-আ বলে ডেকে আমাকে যেন হাত-পা ধোয়ার পারমিশন দিলো ।

পাপান, তুমি কত বড় হয়েছ, মুড ভালো থাকলে ছেলে এ কথা শুনে নিজের কচি কচি হাত দুটোর মাঝে যতদূর সম্ভব ব্যবধান সৃষ্টি করা যায় তা সৃষ্টি করে বোঝাতে চায় যে সে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে, আমাদের আরো অনেক খেলা আছে, দিদি কোথায় জিজ্ঞাসা করলে পাপান ওপর আর নিচের পাটির দাঁতগুলো চেপে ধরে বলবে , ঝি-ই-ই ইক্কুল , মানে ঝিনুক স্কুলে গিয়েছে , ভাইয়ের মুখে নিজের নামের অমন বিকৃত উচ্চারণ শুনে ঝিনুক খুব ক্ষেপে যায়, ঈশ্, আমি মোটেও ঝি নই । ঠাম্মার সঙ্গেও পাপানের খুব ভাব, মা যখন রোজ রেওয়াজে বসে তখন ও চুপ করে মায়ের পাশে এসে বসে, পাপানকে যদি বলি , আচ্ছা পাপান দেখাও তো ঠাম্মা কেমন করে গান গায় ছেলে অমনি মায়ের মত পা ভাঁজ করে আ-আ-আ করে গাইতে শুরু করে দেয়। তবে ছেলে যত বড় হচ্ছে ততই যেন দুষ্টু হয়ে উঠছে, ঝিনুক কিন্তু ওর বয়সে এত দুষ্টু ছিল না, মা অবশ্য বলে যেসব বাচ্চারা ছোটবেলায় দুষ্টু হয় তারা নাকি বড় হয়ে শান্ত হয়ে যায়, কে জানে, বড় হয়ে পাপান কী হবে, তবে উর্মির খুব চিন্তা ছেলেকে নিয়ে , চিন্তার অবশ্য একটা কারণও আছে, উর্মিদের যে গুরুদেব আছেন তিনি পাপানের জন্ম কুষ্ঠি দেখে দুশ্চিন্তা করার মতই একটা ভবিষ্যৎ বানী করেছেন।

আমি অবশ্য এই সব গুরু-ফুরুতে তেমন বিশ্বাস করি না, সত্যি কথা বলতে কী এনাদের থেকে আমি একটু দূরেই থাকি, কেন জানি আমার মনে হয় এই সব ভবিষ্যৎ বলে দেওয়া মানুষগুলি আসলে সব ভণ্ড, ছোটবেলায় ঠাকুমাকে বলতে শুনতাম , মানুষের বর্তমান বা ভবিষ্যৎ তার নিজের হাতেই, যে যেমন কাজ করবে বা করছে তার ভবিষ্যৎও সেভাবেই রচনা হয়েছে বা হবে, পূজা আর্চায় ঠাকুমা যদিও দিনের অনেকটাই ব্যয় করত কিন্তু মুনি ঋষিতে একদম ভক্তি ছিল না, একদিন এ নিয়ে ঠাকুমাকে প্রশ্নও করেছিলাম, আচ্ছা তুমি তো বলো পূজা-আর্চায় নয় , মানুষের ভাগ্য তার কর্মফলেই নির্ধারিত হয়, তাহলে তুমি কেন রোজ-রোজ সকাল সন্ধ্যায় এসে ঠাকুরের সামনে বসো?

ঠাকুমা আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলেছিল, বন্দুকের গুলি দেখেছিস?

ঠাকুমার কথায় আমি যেন একটু থতমত খেয়ে যাই, বুঝতে পারি না আমার প্রশ্নের সঙ্গে বন্দুকের গুলির কী সম্পর্ক, আর আমার থতমত খাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে ঠাকুমা বলতে থাকে, আসলে কী জানিস, আমাদের মনটা কিন্তু অনেকটা ঐ বন্দুকের গুলির মত, বন্দুক থেকে যখন গুলি বেরয় তখন তার কী শক্তি , কারোর গায়ে লাগলে তৎক্ষণাৎ তার মৃত্যুও হতে পারে, অথচ সেই গুলিই যখন বন্দুকের নলের বদলে কারো হাতে করে কারোর দিকে ছুড়ে মারা হয় তখন কিন্তু তার কোনো শক্তি থাকে না, তার মানে গুলির শক্তির পরিপূর্ণতা তখনই আসে যখন তাকে তাকে ট্রিগার দিয়ে টিপে একটা নলের মধ্য দিয়ে ছুড়ে মারা হয় , আমাদের মনকেও যদি আমরা কোনো কাজ বা জীবনের কোনো দর্শনে বাঁধতে চাই তখন তার জন্য কিন্তু একটা নল আর একটা ট্রিগারের খুব প্রয়োজন। পূজোর ঘর বা মন্দির হলো গিয়ে আসলে সেই নল যেখানে আশেপাশের সব কিছু থেকে মনটাকে আমরা আলাদা করে নিতে পারি আর যখন চোখ বুজে ঠাকুরকে আমরা ডাকি তখন মনের ট্রিগারে আসলে আমরা আঙুল রাখি, প্রতিদিন তাই ঠাকুরঘরে বসে নিজেকে একটা কথাই বলি, ঠাকুর, আজকের দিনটাও আমি যেন নিজেকে শুদ্ধ করে পার করে দিতে পারি।

শাশুড়ি ঠাকুরণ এর মধ্যে একদিন উর্মি আর পাপানকে নিয়ে ওনার সেই গুরুদেবের আশ্রমে গিয়েছিলেন, পাপানের কুষ্ঠি দেখে ভদ্রলোক বলেছেন জাতকের শৈশবে খুব বড় একটা ফাঁড়া আছে, তবে সেই ফাড়াটা একবার উৎরে গেলে জাতক জীবনে অনেক দূর এগিয়ে যাবে । গুরুদেবের ভবিষ্যৎবাণীর জন্য নয় তবে পাপান দিনদিন যেমন দুরন্ত হয়ে উঠছে তা দেখে আমার একটু ভয়ই লাগে , কেউ শেখায়নি, নিজে-নিজেই ঘসে ঘসে বিছানায় ওঠা-নামা করতে শিখে গিয়েছে , এই ওঠানামা করতে গিয়ে দু-একবার স্লিপ করে পড়েওছে , কিন্তু ছেলের তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই , খাট থেকে ওঠা-নামাই শুধু নয়, ইদানীং পাপান নতুন একটা স্বভাবও পেয়েছে, হাতের কাছে যা পায় তাই নিয়ে টানাটানি করতে থাকে, এই তো সেদিন মায়ের ঘরে গিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখা তানপুরাটা নিয়ে টানাটানি করছিল , ভাগ্যিস ঝিনুক ওর পড়ার ঘর থেকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসেছিল, পাপানের এই সব দৌরাত্ম দেখে আমার ভীষণ ভয় লাগে, উর্মিকে বলি, ছেলেটা দিন-দিন যা দস্যি হচ্ছে তুমি কিন্তু সব সময় ওকে একেবারে চোখে-চোখে রেখো ।

হ্যাঁ, সে তো রাখতেই হবে, আমার ছেলে, সুতরাং দায় তো আমারই।

এভাবে কথা বলছ কেন, আমি আর কতক্ষণ বাড়ি থাকি যে পাপানের দেখভাল করব?

কেন, তুমি ছাড়াও তো এ বাড়িতে আরো কেউ থাকেন , এখন আর অস্পষ্ট নয়, উর্মির আক্রমণের তিরটা মায়ের দিকে।

তুমি কি মায়ের কথা বলছ?

আর কার কথা বলব, তুমি আমি ঝিনুক আর পাপান ছাড়া মানুষ বলতে তো উনিই এ বাড়িতে থাকেন।

তার মানে তুমি কি বলতে চাও যে মা পাপানের দেখভাল করে না বা মা পাপানকে ভালবাসে না!

ভালবাসবে না কেন, তবে ওনার ভালবাসাটা ঐ যেন ঠিক পাড়া পড়শিদের ভালবাসার মত, ঠোঁটের কোনে এখন বিদ্রূপের ছোঁয়া উর্মির, পাড়া পড়শিদের ভালবাসায় জানো তো বেশীরভাগ সময়ই কিন্তু কোনো দায় দায়িত্ব থাকে না, আর তোমার মায়ের ভালবাসাটাও ঠিক ঐ রকম, দায় দায়িত্বহীন আলগা সোহাগ। আর একটা কথা বলি, শুনলে হয়তো তোমার ভালো লাগবে না, কিন্তু কথাটা কিন্তু সত্যি, নাতি নাতনির প্রতি তুমি তোমার মায়ের ভালবাসার কথা বলছ! আরে নাতি নাতনি তো অনেক দূরের কথা, এই সংসারটার প্রতিই তোমার মায়ের কোনো ভালবাসা নেই, উনি মনে করেন যে এই সংসারটা আসলে একটা ধর্মশালা আর সেই ধর্মশালায় থেকে উনি আমাদের উদ্ধার করছেন।

উর্মিকে বলতে পারতাম মা আজকাল যে পাপানকে আর আগের মতন নিজের কোলে বসিয়ে আদর করে না বা এটা ওটা খাওয়ায় না তার জন্য তো তুমিই আসলে দায়ী, কী দরকার ছিল সেদিন মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ঐ সব কথাগুলি বলবার , বাজার থেকে আমি সেদিন বেশ খানিকটা কাঁচা আম কিনে এনেছিলাম আর বাড়ি ফিরে আমের ব্যাগটা মায়ের হাতে দিয়ে বলেছিলাম, ছোটবেলায় যেমন আমতেল বানাতে তেমন করে একটু আমতেল বানাও তো, কতদিন তোমার হাতের আমতেল মাখা মুড়ি খাইনি। আমতেলের সঙ্গে মা একটা মিষ্টি আঁচারও বানিয়েছিল, আঙ্গুলের মাথায় খুব সামান্য সেই আঁচার নিয়ে মা সেদিন পাপানের ঠোঁটে লাগিয়ে বলেছিল, খেয়ে বলো তো দাদুভাই কেমন হয়েছে, ব্যাপারটা উর্মির নজর এড়ায়-নি , মাকে সঙ্গে সঙ্গে কিছু না বললেও আমি অফিস থেকে ফেরার পর ব্যাপারটা নিয়ে উর্মি তুলকামাল করেছিল, মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে আমাকে বলেছিল হাবিজাবি খেয়ে পাপানের যদি পেট খারাপ হয় তখন তার জন্য যেন আমি ওর কাছে কোনো কৈফিয়ত না চাই , এই টুকুতেই থামেনি উর্মি, আরো অনেক বাঁকা বাঁকা কথা মাকে উদ্দেশ্য করে সেদিন বলেছিল উর্মি আর যা শুনে আমার মনে হচ্ছিল যে ও যেন বোঝাতে চাইছে যে আমার মা আসলে একজন অশিক্ষিতা গেঁয়ো মানুষ আর এই সব অশিক্ষিতা গেঁয়ো মানুষদের ভালোবাসায় বাচ্চাদের আসলে ক্ষতিই হয় ।

উর্মি রান্নাঘর থেকে আমার জন্য চা আর অমলেটের প্লেট নিয়ে এলো, আমার হাতে প্লেট দুটো দিয়ে বললো আমি যেন পাপানকে একটু দেখি, ও ঝিনুককে নাচের স্কুল থেকে আনতে যাচ্ছে। ঝিনুকের নাচের স্কুলটা বাড়ির কাছেই, যাওয়ার সময় ও একাই চলে যায়, ফেরার সময় রাত হয়ে যায় বলে আমরাই ওকে বারণ করেছি একা-একা ফিরতে।

চায়ে একটা চুমুক দিয়ে উর্মিকে বলি, সে যাও কিন্তু একটা কথা বলো তো, তোমার মুখটা আজকে এত গোমড়া দেখাচ্ছে কেন।

মাথায় চিরুনি বোলাতে বোলাতে আয়নার দিকে চেয়ে উর্মি জবাব দেয়, যাক, আমার মুখের দিকে তাকানোর সময় তোমার কাছে আছে তাহলে!

ও মা! তোমার মুখের দিকে তাকানোর সময় থাকবে না কেন , আফটার অল ইউ আর মাই ওয়ান এন্ড ওনলি ওয়াইফ।

উর্মির এখনও চুল আঁচড়ানো হয়নি, কেন! ওয়ান এন্ড ওনলি হওয়াতে খুব যেন আফসোস!

আফসোসের কথা আবার কখন বললাম! উর্মির হাতটা টেনে খাটের ওপর বসাই , এই কী হয়েছে বলো না।

কী আবার হবে, কিছু হয়নি তো।

উহু, কিছু তো একটা হয়েছে , সামথিং ইজ রং, প্লিজ বলো।

হঠাৎ উর্মি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, শুনে কী করবে ?

মুখে একটা বীরপুরুষ মার্কা হাসি লাগিয়ে বলি , একবার বলেই দেখো না তারপর দেখবে মহাদেবের মতন কেমন একটা প্রলয় নাচন শুরু করে দেই ।

থামো , তোমার ওসব প্রলয় নাচন টাচন এই ক'বছরে অনেক বার দেখেছি, আর দেখার ইচ্ছে নেই, তার চেয়ে যেখানে গিয়ে ওসব নাচন দেখালে কিছু হবে সেখানে গিয়ে বরঞ্চ দেখাও, উর্মির ডানহাতের তর্জনীটা সিধে মায়ের ঘরের দিকে। বুঝলাম শাশুড়ি বৌমায় আজ আবার এক প্রস্থ হয়েছে, মুখে যতদূর সম্ভব সহানুভূতি জুড়ে উর্মিকে জিজ্ঞাসা করলাম , মায়ের সঙ্গে আজ আবার বুঝি ঝগড়া হয়েছে?

তোমার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া! না তো!

একটু যেন অধৈর্য হয়ে উঠি, তাহলে! উর্মি, প্লিজ যা বলবার একটু খুলে বলো।

খুলে বলবার কী আছে! ইটস ভেরি সিম্পল, তোমার মা আজকাল নিজে ঝগড়া করেন না, ঝগড়া করার জন্য ওনার ভাড়াকরা লোক আছে, তারাই আজকাল ওনার হয়ে ঝগড়া করে।

আগে উর্মির এসব কথা শুনে আমি খুব সেনসিটিভ হয়ে উঠতাম , এখন সত্যি কথা বলতে কী উর্মির এধরণের কথায় আমি খুব একটা বিচলিত হই না , আসলে প্যানপ্যানানি এমনই একটা বস্তু যা একঘেয়ে হয়ে গেলে তার চিটচিটানি ভাবটাও যেন নষ্ট হয়ে যায়, তবু উর্মির মুখে ভাড়া করা লোক শুনে একটু কৌতূহল হলো , ভাড়া করা লোক মানে তুমি কী বলতে চাইছ!

উর্মির গলার স্বরটা হঠাৎ করেই যেন বদলে যায় , বেশ একটা কমান্ডিং ভাব এখন ওর গলায়, শোনো, তোমায় একটা কথা বলছি, দোহাই তোমার অলোককাকুকে তুমি বলে দিও যে উনি যেন আমায় অযথা জ্ঞান না দিতে আসেন, আর এ কথাটা তুমি যদি ওনাকে বলতে না পারো তাহলে আমিই কিন্তু এবার ওনার মুখের ওপর বলে দেব, উর্মি যেন নিজের মনেই বলতে থাকে, অদ্ভুত মানুষ! নিজের চরকায় তেল না দিয়ে দিনভর খালি অন্যের সংসারে পোদ্দারি মেরে যাচ্ছেন!

অলোককাকুকে নিয়ে উর্মির অ্যালার্জিটা সেই বিয়ের পর থেকেই , কিছুতেই ও কাকুর এ বাড়িতে যখন তখন আসা বা আমাদের পারিবারিক বিষয়ে ওনার মতামত দেওয়াটা মেনে নিতে পারে না, বিয়ের পর মায়ের আর কাকুর সম্পর্ক নিয়ে অনেকবার আমার সঙ্গে হাসি ঠাট্টাও করেছে, কিন্তু যত দিন যাচ্ছে উর্মির কথা থেকে ঐ হাসি ঠাট্টার মোড়কটা খুলে গিয়ে এখন সেখানে যেন শুধুই শ্লেষ আর বিদ্রূপ।

খাট থেকে নেমে মেঝেতে দাঁড়ায় উর্মি , আমি তো এটাই বুঝি না, একটা বাইরের লোক কিভাবে আমাদের পারিবারিক ব্যাপারে দিনের পর দিন এভাবে নাক গলিয়ে যাচ্ছেন!

দেখো উর্মি, তুমি যদি এভাবে আধা আধা কথা বলো তাহলে কিন্তু আমার পক্ষে তোমার কথার উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়, আমার গলায় যেন সামান্য বিরক্তি।

উত্তর কী দেবে শুনি, আচমকাই যেন আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে উর্মি, এই এতগুলো বছর ধরে কী উত্তর তুমি দিয়েছ বা দিতে পেরেছ, আমি তো তোমাকে বিয়ের পর থেকেই এই একই প্রশ্ন বারবার করে আসছি, এই অলোক বলে ভদ্রলোক আসলে কে হন তোমাদের, কীসের জন্য একটা লোক সারা জীবন বিয়ে শাদী না করে তোমার মায়ের তাঁবেদারি করে যাচ্ছে, আর সব চেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, তোমরা বাপ-ব্যাটা সেই তাঁবেদারিটা দিনের পর দিন কিন্তু সহ্য করে গেছ!

উর্মি ! প্লিজ, কন্ট্রোল ইয়োরসেলফ , আমার মনে হচ্ছে তুমি এবার কিন্তু লিমিট ছাড়াচ্ছ ।

আরে থামো , ওসব লিমিট ফিমিট আমাকে দেখাতে এসো না, ওসব অনেক দেখেছি, সেই বিয়ের পর থেকে তোমাদের এই ঘোমটার নিচে খ্যামটা নাচ দেখে দেখে না আমি থকে গিয়েছি একদম, এখন যদি পারো ওঘরে গিয়ে তোমার মাকে একবার দেখে এসো, তোমার মায়ের শরীরটা মনে হয় খারাপ ।

মায়ের শরীর খারাপ, কী হয়েছে! সবকিছু ভুলে আমার গলায় এখন উদ্বেগ।

ওনার মনে হয় কিডনিতে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে, অলোককাকুকে নিয়ে আজ ডাক্তার দেখিয়ে এসেছেন, ডাক্তার দেখিয়ে ফিরে তোমার অলোককাকু আমায় কী বলেছেন জানো, আমায় ডেকে বললেন, বৌমা , শাশুড়ির একটু খেয়াল রাখো , পেটের ব্যথাটা কিন্তু ওনার অনেকদিন ধরেই হচ্ছে। ভাবো তুমি একবার! প্রশ্রয় পেয়ে পেয়ে মানুষটার অডাসিটি আজ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে! আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকেই কী না অ্যাকুইজ করছে যে আমি নাকি তোমার মায়ের ঠিক মত যত্ন নেই না! আরে বাবা অত যদি দরদ তাহলে তো নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখতে পারে, কই সেই মুরোদ তো নেই! একটা শ্বাস নেয় উর্মি, তবে ওনাকে আর দোষ দিয়ে কী লাভ, আসল সাপ তো নিজের ঘরেই, তোমার মা যদি তার শরীর খারাপের কথা আমাকে বা তোমাকে না জানিয়ে বাইরের একটা লোককে ডেকে বলে সে তো তাহলে অডাসিটি পাবেই ঘরের বৌকে এসব কথা শোনাবার!

কথাগুলি বলে দুমদাম করে ঝিনুককে আনতে চলে গেলো উর্মি , কামাল এসেছে , আজ ওকে কিছু পয়সা দিতে হবে আর তাছাড়া কাল থেকে তিনতলার পার্টিশনের কাজটা শুরু হবে, ওপরে গিয়ে তাই একবার আজ কামালকে ঘরের ডিজাইনগুলিও বুঝিয়ে দিয়ে আসতে হবে।



ঠিক মাস দুয়েকের মাথায় অফিসের ঠিকানায় শুভ্রার চিঠিটা এলো

কুশলদা,

এর মধ্যে আপনার অফিসে অনেকবার ফোন করেছি, কিন্তু কথা হয়নি, আমি আর সমুদ্র এখন বোম্বেতে , পরে ডিটেলে সব কিছু জানিয়ে আপনাকে চিঠি লিখবো ।

ভালো থাকবেন,

শুভ্রা।


ক্রমশ