শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

কটন কলেজ, পর্ব -৪

।।চার।।

মাসের শেষ সপ্তাহের রবিবার।রবিবারগুলি কটন হোস্টেলের জন্য খুব ব্যস্ততাপূর্ণ।যদিও ছুটির দিন তবু দিনটি নিষ্ক্রর্মা নয়। বরং প্রোগ্রামের সংখ্যা অনেক বেশি। সেজন্যই দিনটিকে কেউ বৃথা যেতে দিতে চায় না।সময় রুটিন মিলিয়ে বাঁধা থাকে।

রবিবার বলে দেরিতে উঠা হয়।মুখ ধুয়ে চা খেয়ে প্রথম কাজ দাড়ি কামানো।তারপর স্নান করে বা না করে বেরিয়ে গিয়ে কোনো এক দোকানে চা খেয়ে নেওয়া।তারপরে সিনেমা হল,হয়তো মর্নিং শো দেখা,নয়তো ম্যাটিনি শোয়ের জন্য টিকেট কাটা।ম্যাটিনি শোয়ের বাইরেও অন্য শোতে টিকেট কাটা আজকান মূর্খামি।অবশ্য এটা দেখার কায়দাটা জানা দরকার। কোন হলে ‘হেণ্ডিক’ এবং ‘সি-জি’হোস্টেলের মেয়েদের সমাগম বেশি-সেটা ঠিক করে নিতে না পারলে সবকিছু বৃথা।অবশা প্রোগ্রাম করা থাকলে এসব ভাবার প্রয়োজন হয় না।

মর্নিং শো দেখে এসে অথবা ম্যাটিনি শোয়ের টিকেট কাটার পরে কিছুটা ঘোরাঘুরি করে হোস্টেলে হোস্টেলে আড্ডা মেরে বারোটার দিকে ফিরে আসা হয়।ভাত খেয়ে কিছুটা রেস্ট।তারপরে ম্যাটিনির টিকেট থাকলে হলে যাবার তাড়া।ম্যাটিনির টিকেট না থাকলে অবশ্য কিছুটা বিশ্রাম নেওয়া যায়। তিনটে বাজার সঙ্গে সঙ্গে ড্রেস করতে হয়। সি-জি,ছাত্রীবাড়ি,হেণ্ডিক,ইউ্নিভার্সিটি ইত্যাদি সবগুলি গার্লস হোস্টেলেরই ভিজিটিং ডে।কোথাও না কোথাও মক্কেল পাওয়া যাবেই।নিজের না থাকলেও কারও সঙ্গী হয়ে সহজেই যেতে পারবে।কেবল হোস্টেলে যেতে অনেকেই অস্বস্তি অনুভব করে। সেইজন্যই রবিবার আমার বন্ধুর অভাব হয় না। আশ্চর্যজনক ভাবে প্রায় সমস্ত হোস্টেলেই আমার সম্বন্ধীয় মেয়ে থাকাটা ইতিমধ্যে ফ্রেণ্ড সার্কেলে রাষ্ট্র হয়ে গেছে।

ছোট কাকার কুড়ি টাকার মানি অর্ডারটা কাল পেয়েছি যদিও চুপ করে রয়েছি। গতানুগতিকভাবে চা খেয়ে উঠে দাড়ি কামালাম।ড্রেস করা দেখলেই ধারের খোঁজে আসা ছেলেরা ঘিরে ধরবে।পয়সা চাইলে হাতে থাকলে না দিয়ে পারি না,কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পয়সা দিতে অসুবিধা না হলেও সিনেমা দেখার জন্য ধার দেবার মতো বাজে কাজ আর নেই। পয়সা ফিরে চাওয়াও মুশকিল।তাছাড়া আমার ক্ষেত্রে বিপদটা আরও বেশি কারণ পয়সার বদলে যদি সিনেমা দেখিয়ে দেয় তাহলে মাসিক বাজেটে আবার টানাটানি পড়বে।কোনো সিদ্ধান্তে পৌছাতে না পেরে Organic Chemistry র বইটা খুলে নিয়ে বসলাম।রবিবার দিন সকাল থেকেই হোস্টেলে পড়াশোনার পরিবেশ থাকে না।চারপাশে শুধু হুলুস্থূল।‘টু ডে ইজ সান ডে ইউ সি’।আমি বইটা মেলে ধরতেই রমেন বিছানা থেকে রবিবারের সম্ভাষণ জানাল। ঘুম ভেঙ্গেছে যদিও ও উঠেনি।মাসের শেষ রবিবার তাড়াতাড়ি না উঠাই ভালো। কেউ পয়সা দেবে বললে আর রক্ষা নেই,ধার দিতেই হবে।খোলা বইটা আবার বন্ধ করে রাখলাম।

‘এই উঠ,উঠ,আটটা বেজে গেছে।’—আমি রমেনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললাম।

‘কী করব উঠে,পয়সা আছে?’

‘পয়সা কীসের জন্য?ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই পয়সার চিন্তা কিসের জন্য?’

‘আরে পয়সা না থাকলে রবিবার সকালে উঠে কী করব?আচ্ছা পাঁচ পয়সা আছে যদি দে কাউকে পাঠিয়ে একটা ‘পানামা’আনতে পাঠাই,চা খেয়ে উঠে খেতে না পেলে ভালো লাগবে না।’

‘এখন চা কোথায় পাবি?অন্য কোনোদিন হলে ভাত খাবার সময় হয়েছে বলা যেত।তোর জন্য এই অসময়ে কে চা বানিয়ে দেবে?’

‘কেন দেবে না?আলবৎ দেবে।জে-বিতে ছিলাম,এডমান্সে ছিলাম,এই কটনে ফর দি সেকেণ্ড টাইম,তুমি ছোট ছেলে বাছা,মায়ের কোল ছেড়ে প্রথম হোস্টেলে এসেছ,তুমি কিছুই জান না।তুমি আমাদের সঙ্গে থেকে শিখে নাও বাছা,কিছুদিনের মধ্যে তোমাকে ওস্তাদ বানিয়ে দেব,একটু ধৈর্য ধর।

কথা বলতে বলতে রমেন বেরিয়ে গেল।হাতে টুথ ব্রাশ আর গায়ে টাওয়েল।বেরিয়ে যাবার সময় এমনিতেই একবার আওয়াজ দিয়ে গেল, ‘এই চা নিয়ে আয়।’

কিছুক্ষণ পরে শুনি কিচেনে গণ্ডগোল শুরু হয়েছে।আমি বুঝতে পারলাম-এই গণ্ডগোল রমেনই সৃষ্টি করেছে।

‘কী,চা নেই বললে হবে নাকি?নেই যদি বানিয়ে হলেও দিতে হবে,এইসব হোস্টেলের নিয়ম আমার সঙ্গে চলবে না।এবার মেস ম্যানেজার কে তাকে ডাক ।‘

চিৎকার করতে করতে রমেন এসে ঘরে ঢুক্ল।‘এই এত চিৎকার করছিস কেন?’আমি বললাম।

‘চিৎকার করব না ?কেন চিৎকার করব না? চিৎকার না করলে এসব কোনোদিনই ঠিক হবে না বুঝতে পেরেছিস।’

সে বিছানা ঠিক করতে লাগল। ঠিক তখনই একটা ছেলে চা নিয়ে এল।

‘ওকে পাঁচ পয়সা দিয়ে দে’-রমেন আমার দিকে তাকিয়ে বলল।

‘পাঁচ পয়সা বিছানার নিচ থেকে বের করে দিলাম।’

‘শোন পানামা আনবি।পানামা না পেলে চারমিনার আনবি।বোকার মতো নাম্বার টেন আনবি না বুঝেছিস।’

ছেলেটি বেরিয়ে গেল।রমেন ও রবিবারের স্পেসিয়াল ডিমটা খেয়ে নিল।তারপর চায়ের গ্লাসে মুখ দিয়েই ‘ড্যাম ইট’বলে জানালা দিয়ে ফেলে দিল।

আমি বুঝতে পারলাম ঠাকুর পুরোনো চায়ের জলটাকেই ফুটিয়ে দুধ মিশিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে।

‘এই তুই যদি নাই খাবি তাহলে এত চিৎকার করছিলি কেন?আমি বললাম।

‘খাওয়া না-খাওয়া আমার ব্যাপার,আমাদের প্রাপ্যটা ওরা দেবে না কেন?’এদের আস্কারা দিলেই মাথায় উঠে যায়।‘আমার কথা শুনে রমেন আরও রেগে গেল।

আমি কোনো উত্তর দিলাম না।আমি জানি,তার সঙ্গে তর্ক করা বৃথা।তার রাগ কমানোর জন্য আমি বললাম-‘চল চল বর্মনের ওখানে যাই।আমার ও এক কাপ চা খেতে ইচ্ছা করছে।ওখানেই গিয়ে রবিবারটা সেলিব্রেট করি।পয়সা না থাকলে কী আর করা যাবে?’

‘চল শালা,ওখানে বসে থাকলে যদি কোনো মক্কেল ধরা যায়।একটা সিনেমা দেখতে পারলে ভালো হত।তখনই ছেলেটা এসে ‘পানামা’সিগারেটটা রমেনকে দিল।ঘরের ভেতর গিয়ে কারও দেশলাই জ্বালিয়ে আনল।

আমরা দুজন বর্মন কেবিনের দিকে বেরিয়ে গেলাম।বর্মনের ওখানে নিশ্চিত,পয়সা চাইবে না।লিখে রেখে আসলেই হল।হোস্টেলের প্রত্যেকের নামে অ্যাকাউন্ট আছে।ওখানে কেউ কারোকে খাওয়াতে হয় না।

গেটের সামনে যেতেই দেখি গার্লস হোস্টেলের চৌকিদার আসছে।আমি প্রথমে লক্ষ্য করিনি।রমেন বলায় দেখলাম।

‘দাঁড়া,একে প্রথমে চার্জ করা যাক কার জন্য কী এনেছে।যার জন্য যাই আনুক না কেন আমি অন্তত সিনেমার খরচটা বের করে নিতে পারব।’রমেন বলল।

রমেন তার দিকে এগিয়ে যেতেই চৌকিদার জিজ্ঞেস করল,‘নিরঞ্জন বরুয়া কে?আমার নাম শুনে থমকে গেলাম।রমেন আমার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।চৌকিদার আমার দিকে একটা এনভেলপ এগিয়ে দিয়ে বলল-‘কুন্তল দিদি দিয়েছেন।’

আমি খোলার আগেই রমেন এনভেলপটা টান মেরে নিয়ে নিল।খোলা এনভেলপ থেকে একটা দশ টাকার নোট বেরিয়ে পড়ল।সঙ্গে একটা ছোট চিঠি।

নীরেন,

দশ টাকা পাঠালাম।তোমার সঙ্গে পাঁচটা সিনেমার টিকেট কাটবে,V.I.P দেখতে যাব।স্পেশিয়াল ক্লাসে করলেই হবে।

ভালোবাসা সহ

কুন্তলা

চিঠি পড়ে শেষ করার আগেই রমেন চিৎকার করে উঠলঃথ্রি চিয়ারস ফর নিরঞ্জন কুমার,হিপ হিপ হুররে,হিপ হিপ হুররে

এই এভাবে চিৎকার করছিস কেন,অন্যেরা শুনলে কী বলবে’-আমি তাকে রাগের সঙ্গে বললাম।

‘কেন চিৎকার করব না?আলবৎ চিৎকার করব।স্পেশিয়াল ক্লাস।মানে ওয়ান এইট্টি ওয়ান তার মানে পাঁচটা টিকিটে হল গিয়ে নয় টাকা পাঁচ পয়সা,তাইতো?

তার মানে?

‘তার মানে নাইনটি ফাইভের সঙ্গে এইট্টি ওয়ান প্লাস ফাইভ তাই তো?মানে এইট্টি সিক্স,অর্থাৎ আমার এক টাকা হলেই হয়ে যাবে।বাকি পয়সায় যেভাবেই হোক একটা মার্কপল নিতে হবে,আজ অন্য কোনো সিগারেট খেলে প্রেস্টিজ থাকবে না,সুন্দর সুন্দর গন্ধ,বাঃ ।

এক নিঃশ্বাসে সে কথাগুলি শেষ করল।

‘বাকি পয়সাটা ফিরিয়ে দিতে হবে’,আমি বেশ গম্ভীরভাবে বললাম।একটা টিকেট ফ্রি,বাকি পয়সাটা নেওয়া ঠিক হবে না।‘

‘কী ঠিক হবে না?আমাদের মতো দুটো সুদর্শন পুরুষকে দুপাশে পাবে,ওদের আমারটাও দিতে হবে।‘

‘ছিঃ কুন্তলা সম্পর্কে আমার দিদি হয় তুই কি জানিস না?’

‘জানি জানি,ওই মেয়েটি তোর মামা না পিসির মেয়ে,কিন্তু বাকি তিনজন?’

‘ধ্যাৎ,এসব কথা বাদ দে তো, এখন কী করবি বল। টিকেট কাটতে যাবার সময় হয়ে গেছে।তার মধ্যে আবার রবিবার।‘

‘চল চল প্রথমে ড্রেস করে আসি।তারপরে চা খাব। আমাকে তো টাকা চাইতেই হবে।‘

আমরা দুজনে আবার ফিরে এলাম।আমি ড্রেস করতে লাগলাম।ও রুমে রুমে ঘুরে পয়সার খোঁজ করতে লাগল।মাসের শেষ,কার ও হাতে থাকলেও দিতে চায় না। তারমধ্যে রমেনকে টাকা ধার দিতে অনেকেই চায় না। পারলে সে লোকের ওপরে লাঠি নিয়ে আক্রমণ করে। রমেন প্রত্যেক রুমে রুমে গিয়ে এভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে সে একটা টাকা না পেলে তার যেন সারা জীবনটাই বরবাদ হয়ে যাবে। কিসের জন্য প্রয়োজন তা বলছে না যদিও আমার ভয় হল। তার তো মুখের কোনো ঠিক নেই। কোথায় গিয়ে কী বা করে। আমি তাকে ডেকে আনলাম।

‘চল,আমি দেব টাকা্টা।এভাবে চেঁচামিচি করার কোনো দরকার নেই।‘

‘থ্যাঙ্ক ইউ,হাত মেলা।‘ হাত মেলানো অবশ্য হল না।আমরা দুজনেই দ্রুত বেরিয়ে গেলাম।দেরি করলে টিকেট পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে।রবিবারের দিন ‘রামভক্ত হনুমানই’ হোক বা ‘দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ’ই হোক,প্রতিটি হলেই হাউস-ফুল হবে।তাতে আবার ভিআইপি রিচার্ড বার্টন এবং এলিজাবেথ টেইলর। কোনো কথা নেই,ইতিমধ্যে কিউ তে লোকজন দাঁড়িয়ে পড়েছে,যদিও টিকেট দশটার সময় দেবে।

রমেন টিকেট নিয়ে গণ্ডগোল বাধিয়েছিল যদিও আমি থাকায় বেশি কিছু হল না। সহজেই টিকেট পেয়ে গেলাম। আমরা হোস্টেলে গিয়ে স্নান করে খাওয়া-দাওয়া করে তৈ্রি হতে একটা বেজে গেল।যাবার সময় হয়ে গেল,দুজনে ড্রেস করতে লাগলাম।

সিনেমা শুরু হওয়ার পনেরো মিনিট আগে আমরা হলে উপস্থিত হলাম।কুন্তলারা আসেনি।মিছামিছি এত তাড়াহুড়ো করলাম। টিকেটগুলি আমাদের সঙ্গে থাকায় কুন্তলাদের আগে এলে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ভেবেই আগে চলে এলাম।

রমেন বলল-দেখ,আমি আগেই বলেছিলাম ওরা এত তাড়াতাড়ি আসবে না। আমার কথা শুনলি না,আই অ্যাম ওয়েলএক্মপিরিয়েন্স মাই বয়।আরম্ভ হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই এভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে ঢুকবে যে মনে হবে প্লেন থেকে নেমে সোজা সিনেমা হলে চলে এসেছে। তোকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে এভাবে ঘড়ির দিকে তাকাবে যেন আধ মিনিট দেরি হওয়ার জন্য অত্যন্ত দুঃখিত।‘

আমি রমেনের কথার কোনো উত্তর দিলাম না। কেবল হলের পোস্টারগুলির দিকে তাকিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালাম। দুজন এসে নিজেদের অজান্তে সামনের গুমটিটার পাশে দাঁড়ালাম। রমেন একটা মার্কাপল সিগারেট নিয়ে আমার দিকে তাকাতে আমার হুঁশ ফিরে এল।তার চাহনির অর্থ বুঝে আমি একান্ত বাধ্য ছাত্রের মতো পয়সাটা বের করে দিলাম।

‘সিগারেটটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসে যাবে’রমেন বলল,’তুই টিকেটটা আমাকে দে।ওরা এসে গেলে তুই তোর দিদিকে কিছু একটা বুঝিয়ে বলে দিবি।আমি এগিয়ে যাব।ব্যস হয়ে যাবে।‘

‘কী হয়ে যাবে? আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

‘দেখবি বাছা,সব দেখতে পাবি,একটু ধৈর্য ধর।দেখবি নির্মালী হাজরিকা আমার পাশের সিটে বসে রয়েছে।‘

‘নির্মালী আসবে না আশীর্বাদই আসবে তা বলতে পারব না। তুই আবার নির্মালী হাজরিকাকে পাশে বসানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছিস।‘

‘আমাকে জিজ্ঞেস কর কে আসবে’রমেন নিশ্চিতভাবে বলল-নির্মালী যদি না আসে আমি তাহলে আজ সিনেমাই দেখব না।‘

‘নির্মালী কে যে সে না এলে তুই একেবারে সিনেমা দেখবি না,তোর সঙ্গে কিছু রয়েছে নাকি?’

কিছু যদি থেকেই থাকে তাহলে এত প্লেন করে মরলাম কেন। সেই যে হিমালয় না কাঞ্চনজঙ্ঘা চিনতে না পারা মেয়েটি।তোর দিদি না কে তার রুমমেট।‘

‘আমি কিছুই বললাম না।বেশি বললে তার মুখের লাগাম আরও ঢিলা হয়ে যাবে। আমার কেমন অস্বস্তি হতে লাগল।সিনেমা আরম্ভ হতে চলেছে,কুন্তলারা এখনও এসে পৌছল না। রমেন নির্বিকার যেন কিছুই হয়নি।

ফাইন্যাল বেল বাজল।ভেতরে নিউজ রীল আরম্ভ হয়েছে।ঠিক তখনই কুন্তলারা ব্যস্তভাবে রিক্মা থেকে নামল,সেই নির্মালি নামের মেয়েটিও এসেছে।রমেন গৌ্রবের হাসি হেসে আমার দিকে তাকাল।

‘ইস দেরি হয়ে গেল না?’আমি কিছু বলার আগেই কুন্তলা বলে উঠল।আমাকে উত্তর দিতে হল না,কুন্তলাও উত্তর আশা করেনি,এটা সাধারণ লৌকিকতা মাত্র।রমেন ডানহাতে সিগারেটটা নিয়ে বাঁ হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চোখদুটি নির্মালীর চোখের সঙ্গে এমন একটি অ্যাঙ্গেলে মিলিয়ে দিল যে নির্মালীও বলতে বাধ্য হল,দেরি হয়ে গেল না?’

রমেন ব্যস্ততার সঙ্গে টিকেটগুলি গেট কীপারকে দিয়ে নির্মালীর চোখের দিকে তাকিয়ে যেভাবে চোখের ইশারায় ডাকল নির্মালী রমেনের পেছন পেছন যেতে বাধ্য হল। কয়েকজন মেয়ে দেখে আমি কিছুটা নার্ভাস অনুভব করছিলাম ,সেইজন্যই আমি বোধহয় কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিলাম। ফলে নির্মালীর পেছন পেছন বাকি দুজন,তারপরে কুন্তলা এবং সবার শেষে আমি অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ঢুকে গেলাম।

ইন্টারভ্যালের সময় দেখলাম রমেনের কথাই ঠিক।একেবারে মাথায় রমেন,পাশে নির্মালী,তারপরে বাকি দুটি মেয়ে,কুন্তলা আর শেষে আমি একই সারিতে বসে রয়েছি।রমেন আর নির্মালীকে দেখে মনে হল যে ওরা দুজন সিনেমা দেখতে এসেছে,আমরা আসিনি।দুজনেই কথায় মশগুল।

আমি রমেনের দিকে তাকাতে দেখে বেশ কিছুটা জোরেই রমেন ্লল—‘হাজরিকার ব্যাগটা দেখছি সবচেয়ে বড়,অনেক পয়সা এনেছে। যা তো নীরেন,টফি নিয়ে আয়,হাজরিকা পয়সা দেবে বোধহয়।‘

নির্মালী বেগটা খুলে হেসে একটা টাকা এগিয়ে দিল।আমি নিতে কিছুটা ইতস্তত করলাম বলে রমেন পুনরায় বলে উঠল-‘যা যা হাজরিকার কাছ থেকে পয়সা নিতে লজ্জা করতে হবে না,ফ্রেণ্ড সার্কলে আবার এসব কি? পয়সা খরচ করে যদি খাওয়াতে চাস,অনেক মেয়ে পাবি,এদের না খাওয়ালেও হবে বুঝেছিস?’

তার কথায় আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম।জোরে না হাসলেও প্রত্যেকেই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। আমি নির্মালীর হাত থেকে এক টাকার নোটটা নিয়ে পালিয়ে যাবার মতোই বেরিয়ে গেলাম।

আট আনার টফি কিনলাম।দু আনায় তিনটা করে বারোটা পেলেম।বাকি পয়সা আট আনার সঙ্গে টফির পুঁটলিটা এনে নির্মালীর দিকে এগিয়ে দিলাম।নির্মালী হাত মেলে নেবার আগে রমেন পয়সার সঙ্গে টফির পুঁটলিটা নিয়ে নিল। নিজে কিনে খাওয়ানোর মতো সবাইকে একটা একটা করে এগিয়ে দিলাম।

ইতিমধ্যে পুনরায় সিনেমা আরম্ভ হল। কিছুক্ষণ পরে আমার হাতে কেউ একজন টফি গুজে দিল।অন্ধকারে কার হাত বুঝতে না পারলেও সেটা রমেনের হাত নয় সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।বাকি ছয়টা টফি অন্ধকারেই বিলানো হয়ে গিয়েছিল।সিনেমা শেষ হওয়ার পরে আমরা বেরিয়ে এলাম।কুন্তলারা দুটো রিক্মায় উঠল।আমরা অন্যদিকে যাব বলে ফাঁকি দিয়ে বিদায় নিলাম।কারণ সঙ্গে গেলে একটা রিক্মা ভাড়া করে তো দেখাতে হবে।

রিক্মাটা চলতে শুরু করতেই রমেন খুব ব্যস্তভাবে নির্মালী উঠা রিক্মার দিকে এগিয়ে গেল।তার শেষ দুষ্কার্যটা দেখার জন্য আমার চোখদুটি নিজে থেকেই সেদিকে এগিয়ে গেল।

‘দাঁড়ান,দাঁড়ান হাজরিকা আপনার বাকি পয়সাটা নিয়ে যান,আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। একথা বলে খুব ব্যস্তভাবে পকেটে হাত দিয়ে পয়সা খুঁজতে লাগল।ইতিমধ্যে রিক্মাটা মানুষের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল।নির্মালী কেবল আস্তে করে বলল—‘থাকুক।’

‘আট আনা,বাকিটা পরে দেব।আজকেই কিছু একটা করে দেব,এখন ও অনেক সময় আছে।’

হাসতে হাসতে বলা রমেনের কথা শুনে আমার রাগ হল।তার কাণ্ড কারখানা দেখে হাসি পাচ্ছিল,বিস্মিত ও হয়েছিলাম।

‘তোকে আর পয়সা ঘুরিয়ে দিয়ে পুণ্য কামাতে হবে না।’ আমি রাগ করে বলেছিলাম।

আমাকে রাগতে দেখে সে হেসে বলল—‘শিখে নে বাছা শিখে নে,কটন কলেজে পড়তে এসেছিস,মেয়েদের পেছনে পয়সা খরচ করতে শুরু করলে শেষ পর্যন্ত পরনের জামা কাপড়টাও খুলে দিয়ে যেতে হবে।রমেন বরুয়া অনেক দুষ্কার্য করেছে,একটাই করেনি আর সেটা হল মেয়েদের পেছনে খরচ করা বুঝেছিস।’

হোস্টেলে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে অমলরা হুলুস্থূল লাগিয়ে দিল।ইতিমধ্যে আমরা দুজন যে চারজন মেয়ের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম সেই খবরটা হোস্টেলে প্রচার হয়ে গেছে।কুন্তলা যে আমার আত্মীয় সেকথা অনেকে জানলেও অনেকে আবার জানে না।সিনেমা দেখতে যাওয়া অন্য হোস্টেলের ছেলেরা এসে আমাদের আগেই খবরটা জানিয়ে গেছে।তাছাড়া কোনো খবর না দিয়ে আমরা দুজন সারাদিন না থাকায় বাকি রুমমেট দুজন ও আমাদের খোঁজ খবর করেছে।

আমি কিছু বলার আগেই রমেন গম্ভীরভাবে বলল-‘না না সেসব কিছু না।সকালবেলা আমরা দুজন রাস্তায় বেরোতেই নির্মালী হাজরিকা আর ওর দিদির সঙ্গে দেখা হল।কথাপ্রসঙ্গে সিনেমার কথা উঠল।দেখার ইচ্ছা ছিল না,বাধ্য হয়ে যেতে হল। জানিস তো মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া মানেই একগাদা খরচ।’

কিন্তু কথাগুলি বলতে গিয়ে রমেন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গম্ভীর হয়ে পড়েছিল।আমি তাকে কথা বলার পূর্ণ সুযোগ দিয়ে দূরে সরে এসেছিলাম।কোনো একজনকে বলতে শুনলাম—‘তোদেরই মজা।বাড়ি থেকে চেয়ে পাঠালেই পয়সা পেয়ে যাস,তোরাই লাইফটাকে এনজয় করছিস।আমাদের পক্ষে নিজেদের সিনেমার টিকেট জোগাড় করাই শক্ত,তার মধ্যে আবার চার-পাঁচ জন মেয়েকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া ,ভাবতেই পারি না।

পরের কথাগুলি শোনার আমার আর ধৈর্য ছিল না।কুন্তলা কেবল আজই নয়,অনেকদিন আমাকে সিনেমা দেখিয়েছে।ও আমার বাড়ির অবস্থা ভালো করেই জানে।সেজন্য যাব না বললেও আমাকে জোর করে সিনেমায় নিয়ে যায়।

আমি জানি সব সময় ওর ওপর নির্ভর করে সিনেমা দেখা উচিত নয়।কিন্তু একদিন ওকে দেখাতে গেলে নগদ পাঁচ টাকা খরচ।রিক্মায় আসা-যাওয়ার খরচ এক টাকা,বাকি চার টাকা টিকেট।কিন্তু সেই পাঁচ টাকা খরচ করার সামর্থ্য আমার নেই।কিন্তু ছেলেগুলির মন্তব্য এবং রমেনের বাহাদুরির আমি প্রতিবাদ করতে পারলাম না।আমি জানি,আমি আমার প্রকৃত অবস্থাটা কাউকে বলা মানে আমাকে কেউ যে সাহায্য করবে তা নয়,করুণা করবে।বর্তমান ফ্রেণ্ড সার্কলে যে পজিশন আছে সেই পজিশন আর ফ্রেণ্ড সার্কলে পাব না।পৃথিবীটা টাকার,পয়সা না থাকলে পড়তে এসেছ কেন? প্রত্যেকেরই হয়তো একটাই প্রশ্ন হবে,যার উত্তর আমি নিজেই এতদিন খুঁজে পাইনি।

তথাপি কুন্তলার ভালোবাসার মধ্যে যেন সেই করুণা দেখতে পাইনা। আমার চেয়ে এক বছরের বড়। পিসির মেয়ে,মানে বাবার বোনের মেয়ে।এই মেয়েটি প্রথমে আমাদের বাড়িতে থেকেই নতুন পৃথিবীর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল।শৈশবেই বাবা ওকে আমাদের বাড়ি নিয়ে এসেছিল।ওদের গ্রামে শিক্ষা-দীক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আমাদের বাড়িতে থেকে কুন্তলা ক্লাস সিক্ম পর্যন্ত পড়েছিল।ইতিমধ্যে নগরে ওর কাকা বাড়ি তৈরি করে ওর কাকিমার একজন সঙ্গী হবে ভেবে আমাদের বাড়ি থেকে কুন্তলাকে নিয়ে গিয়েছিল।

কাকুর বাড়িতে একবছর থাকার পরে সেখানে কেন আর থাকল না বলতে পারি না। তারপরে কোথায় কোথায় থাকল,কীভাবে পড়াশোনা করল তা জানি না। এতদিন পরে আবার ওর সঙ্গে কটন কলেজে দেখা হল।

আমার চেয়ে এক বছরের সিনিয়র। আগে এক সঙ্গে খেলাধুলা করেছি।শৈশবের কথাগুলি মনে পড়লে ভালো লাগে এবং লজ্জাও হয়।এখন অবশ্য আমার সঙ্গে ওর সম্পর্ক অন্য ধরনের।কুন্তলা মেয়েদের মধ্যে আমাকে ‘ভাই’বলে পরিচয় দেয় এবং আগের মতোই নাম ধরে ডাকে।এখন আর আগের মতো হাসি-ঠাট্টা,ছোটখাট ভুল করার সাহস আর আমার নেই। কুন্তলা হয়তো আমার করা উৎপাতগুলি এতদিনে ভুলে গেছে নয়তো শৈশবের দুষ্টুমি বলে ছেড়ে দিয়েছে।

দিদির ভালোবাসা আমি জানি না।নিজের দিদি তো নেই।তবুও এই মেয়েটির ভালোবাসা যেন সেই না থাকাটাকেই ভুলিয়ে দিয়েছে।

।।পাঁচ।।

আজ কটন কলেজে ইউনিয়নের ইলেকশন। ভোট দিতে যাওয়া ছাড়া সারাটা দিন হোস্টেলে বসে রয়েছি।একজন ও রুমমেট নেই। আজকের মতো একটা সুন্দর দিন কেউ বৃথায় যেতে দিতে চায় না। আজ প্রায় এক মাস ধরে ছেলে-মেয়ে দেখলেই ভয় পাচ্ছি। তার মধ্যে হোস্টেলে থাকা ছেলের ক্ষেত্রে আরও বেশি অসুবিধা। সকালে ঘুম থেকে উঠার আগেই ক্যানভাসিঙের জন্য ছেলে এসে যায়।

ছেলে এলে আপত্তি নেই,কিন্তু মেয়েরা এলে সারাটা দিন ভোটের কাজে উৎপাতের মধ্যে একটা ‘অ্যামিউজমেন্ট’ হয় যদিও কিছু সমস্যা বেড়ে যায়। গার্লস হোস্টেলের মেয়েদের রুমে ছেলে প্রবেশ করার অধিকার নেই,কিন্তু ছেলেদের হোস্টেলে মেয়েরা নির্বিঘ্নে আসতে পারে। তাই ঘুম থেকে উঠেই রুমটাকে ঠিক-ঠাক করায় লেগে পড়ি।আমার কাছে সেরকম কোনো খবর থাকে না যদিও রমেন এই সব ব্যাপারে বড় পার্টিকুলার।

গতকাল আমাদের হোস্টেলে একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল। কথাটা মনে পড়তেই পুনরায় হাসি পেয়ে গেল। দেরি করে এলে দেখা হবে না ভেবে উত্তরা বরুয়াদের পার্টিটা নয়টার সময়েই এসে পড়ল। আমার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক নেই যদিও একেই ক্লাসের বলে প্রথমেই আমাদের রুমে এল। বাধ্য হয়ে উত্তরাদের নিয়ে রুমে রুমে যেতে হল।অবশ্য রুমমেট হিসেবে রমেনই এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করল।

অনেক ছেলে ঘুম থেকে উঠেই নি।জানে সকালে উঠে লাভ নেই,এই কয়দিন কারও পড়াশোনা হয় না। ভোট,ভোট আর ভোট। না কারুর জন্য বলতে হবে,নয়তো কারও জন্য শুনতে হবে। রুমে রুমে কার্ড আর কার্ড,বিভিন্ন রঙের আর বিভিন্ন কথা।রমেন গতকাল একটা বড় কাগজ আমাদের রুমের সামনে ঝুলিয়ে রেখেছে—

‘তুমি কেবল ভোট চাও

আমি কেবল দিয়ে যাই

তার মধ্যে থাকে যেন

‘ডিলাইট’নিয়ে সময়।‘

আমি খুলে দিতে চেয়েছিলাম,সে দিল না। কবি বসবাস করা রুম,মানে আমি থাকা,তাই সবাইকে কাব্যিক হতে হবে। এটাই তার যুক্তি।

আমরা গিয়ে বলিনদের রুমে ঢুকলাম।বলিন উঠেই নি। মাথায় কাপড় মুড়ে শুয়ে আছে। আমি ‘উঠ উঠ’বলে তার পুরো শরীর মুড়ে থাকা কাপড়টা টান মেরে খুলে দিলাম।তবে রমেনের প্রেজেন্স অফ মাইণ্ড সত্যি প্রশংসনীয়।চোখের পলক ফেলার আগেই বেড কভারটা টান মেরে নিয়ে তাকে ঢেকে দিল।

লজ্জায় আমি রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম।পাশে দাঁড়িয়ে থাকা উত্তরার চোখে চোখ পড়ায় আমার লজ্জা আরও বেড়ে গেল। বাকি রুমগুলিতে রমেনই ঘুরিয়ে দিল। যাবার সময় কেবল উত্তরা আমাকে বলে গেল।উত্তরারা যাবার পরে আমি রমেনকে বলেছিলাম ,--‘বলিনের কি কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। এই সকাল সাতটা পর্যন্ত কেউ এভাবে শুয়ে থাকে,আমার খুব লজ্জা করছিল।‘

‘তোর চোখ আছে বলে লজ্জা পেয়েছিস।আমি অবশ্য সে চোখ মেলার আগেই কাপড়টা দিয়ে তার শরীরটা ঢেকে দিয়েছিলাম।‘

‘তবু

‘দেয়ার ইজ ওনলি ওয়ান ট্রুথ ইন দি ডার্কনেস’—সে হো হো করে হেসে উঠল।আমি আর তার সঙ্গে কথা বাড়াতে ইচ্ছা করলাম না।

একা একা বিরক্ত বোধ করতে লাগলাম।কাপড়-চোপড় পরে বেরিয়ে গেলাম।জানি এখন আর ভোটের উপদ্রব নেই। সবারই একটা মাত্র উৎকণ্ঠা,কে জিতেছে।ইউনিয়ন হলে তীব্র গতিতে কাউন্টিং চলছে।

এই কয়েকটা দিন ভোটের উপদ্রব আমাদের ওপর বেশ ভালোভাবেই চলল।তার কারণ অবশ্য রুমমেটরা। ওরা খুব সাবধানে প্রচার করে দিয়েছে যে গার্লস হোস্টেল গুলিতে আমার প্রতিপত্তি খুব বেশি।ওরা এটাও বলেছিল যে কয়েকটি ইনফ্লুয়েন্সিয়েল মেয়ে আমাকে জেনারেল সেক্রেটারির জন্য কন্টেস্ট করতে বলেছিল।

এর অবশ্য একটা অর্থ ও রয়েছে। জেনারেল সেক্রেটারির জন্য প্রথমে দুজন কনটেস্ট করার কথা ছিল।তার মধ্যে জ্যোতির্ময়কে সমস্ত মেয়েরা ভোট দেবে বলে এক রকম ঠিক করে রেখেছিল।কিন্তু ফ্রেসমেন সোসিয়েলের দিন বক্তৃতা দেবার সময় অপ্রিয় সত্য কথা বলার জন্য সমস্ত মেয়েরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসল।জ্যোতির্ময়ের সঙ্গে দীপক কনটেস্ট করছিল।দীপক ছেলেটি সবদিক থেকে ভালো ছিল। কটন কলেজের মতো একটা কলেজের প্রতিনিধিত্ব করার তার ক্ষমতা রয়েছে কিন্তু নাই মাত্র একটা জিনিস,সেটা হল চেহারা।প্রয়োজনের চেয়ে পেট আর মাথাটা বড়,চুলগুলি বিশৃঙ্খ্ল,গায়ের রঙটি রাতের বেলা হলে অন্ধকারের সঙ্গে মিলে থাকে।এরকম একটি ছেলে এফিসিয়েন্ট হলেও মেয়েরা প্রতিনিধি করে পাঠাতে পারে না।নেহেরুর মতো ব্যক্তিও যখন রাষ্ট্রদূতের চেয়ে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করায় রাষ্ট্রদূতের পত্নীর ওপরে গুরুত্ব আরোপ করে গেছেন,সেরকম ক্ষেত্রে কটন কলেজের মেয়েদের আর দোষ কি? হাজার না হোক,ড্রেইন পাইপ বলে ঠাট্ট করলেও ড্রেইন পাইপের প্রতি মেয়েদের আকর্ষণই বেশি।

আজ প্রায় পনেরো দিন আগের কথা। সকাল ছয়টায় গিয়ে এন-সি-সির প্যারেড গ্রাউণ্ডে পৌছে গেলাম।আজকাল এন সি সি কম্পালসরি।প্যারেডে আসাই শক্ত,তাতে আবার সেদিন প্রফেসর বরুয়া নিজে প্রত্যেক ক্যাডেটের ড্রেস চেক করতে শুরু ক্রেছেন।প্রত্যেকের কিছু না দোষ ধরা পড়েছে। স্ট্যাণ্ডার্ড সাইজ,তাই পেন্টগুলি ভালোভাবে ফিট না হলে দরজির কাছে দিয়ে ঠিক করে নেবার নির্দেশ দেওয়া আছে। রমেন সুবিধা পেয়ে বোটমটা চৌদ্দ করে নিল।প্রফেসর দেখে গরম।এন সি সির নিয়মানুসারে বোটম সবসময় সতেরো থেকে উনিশের ভেতর হতে হবে।রমেন নির্বিকার,মুখে কিছু না বলে আমাদের থেকে কিছুটা দূরে মাঠের এক পাশে প্যারেড করতে থাকা গার্লস কোম্পানিটার সার্জেন্টের দিকে আঙ্গুলের নির্দেশ করলেন।সার্জেন্ট হওয়ার জন্য সম্ভব তাই নিজেই একটা পেন্ট তৈ্রি করে নিয়েছিল। ঘন খাকি কাপড় না হয়ে পাতলা কিছু হলে পরেছে কিনা এত দূর থেকে বোঝাই যাচ্ছে না। পেন্টটা সে কীভাবে পরে বা খোলে সে-ই জানে।আমি কিছুটা ভেবেও বুঝতে পারলাম না যদিও আর্ট ফর দি সোসাইটি চেক বলে আমার পেণ্টের বোটাম শোলো-সতেরোতে নামিয়ে আনল।

আমরা প্রত্যেকেই জোরে হেসে উঠেছিলাম।প্যারেড গ্রাউণ্ডে এইসব কৌতুক নিষিদ্ধ যদিও ক্রোধী বরুয়া কিছুই বলতে না পেরে সরে গিয়েছিল।মেয়েটিকে পেন্টটার বিষয়ে কিছুই বলতে দেখলাম না,অবশ্য পরের দিন থেকে মেয়েদের প্যারেড জাজ ফিল্ড থেকে সরিয়ে নিয়ে ইউনিয়ন হলের সামনে করা হল। এত বড় একটা ক্ষতি হয়েযাবে বলে সেদিন আমরা ভাবতেই পারিনি।রমেন ও বলেছিল,এর চেয়ে চুপ করে থেকে গালি খাওয়াই ভালো ছিল।

মেয়েদের কিছু বলা যাবে না,অবাধ স্বাধীনতা। আমাদের যিনি শেখান সেই পাঞ্জাবি ইনস্ট্রাকটার ও একদিন বলেছিলেনঃ ছেলেরা না পারলে গায়ে হাত দিয়ে শেখানো যায়,কিন্তু মেয়েরা বারবার ভুল করলেও গায়ে হাত দেওয়া তো বাদেই,তিন ফুটে্র বেশি কাছে গেলেই চাকরি যাবে।সেরকম ক্ষেত্রে এন সি সি পেন্টের বোটাম নিয়ে কে কথা বলতে যাবে?

তাই মেয়েরা যে দীপককে ভোট দেবে সেটা আশা করা বৃথা। মেয়েদের বক্মটাই কটন কলেজ ইউনিয়নের ইলেকশনে ডিসাইডিং বক্ম। তাই মেয়েদের ভোটের আশায় এক দুজন করে কয়েকজন জেনারেল সেক্রেটারির জন্য কনটেস্ট করেছে।

এরকম একটি সুযোগ রুমমেটরা সুন্দরভাবে গ্রহণ করল।তার মধ্যে আমার সম্পর্কিত মেয়ে দুটো হোস্টেলে আছে। সেকথা সুন্দরভাবে ওরা প্রচার করে দিয়েছে। ফলে রাত নয়টার পরে বিশেষ ইন্টারভিউয়ের জন্য অন্যদের অজান্তে আসা পার্টির উৎপাতে রাতে ঘুমোতে এগারোটা বারোটা বেজে যায়।

সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছি যদিও বোঝে না।সবাই ভাবে দাম বাড়াচ্ছি।সম্পর্কীয় ভাই বোনের কথা বাদেই,নিজের বোন হলেও আমার কথানুসারে যে ভোট দেবে না সে তো জানা কথা। মেয়েদের কাছ থেকে ভোট আদায় করার কিছু টেকনিক আছে।সেটা যে ঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারবে,সেই মেয়েদের ভোট পাবে।আমি কারও কথা বলছি না,জানি বলে লাভ নেই।মাত্র কুন্তলাকে বলে রেখেছি আমার কথা বলে যদি কোনো ক্যাণ্ডিডেট ভোটের কথা বলে তাহলে আমি বলেছি বলে দেবার জন্য।

কিন্তু বাকি রুমমেটরা এই কথা নিয়ে আজ পনেরোদিন পয়সা খরচ করেনি।রমেন তো আমাকে নিয়ে ছাত্রীবাড়ি যাওয়ার রিক্মা ভাড়াটা পর্যন্ত অনেকের কাছ থেকে মিথ্যা কথা বলে আদায় করেছে।আমি কোনো আপত্তি করিনি,কিন্তু তার ভাগও রুমমেটদের কাছে চাইনি।যা খুশি করে থাকতে দিয়েছি।

আমরা এসে ইউনিয়ন হলের কাছে পৌছে গেলাম।এদিক থেকে বিশ্বজিৎ মেধিকে আসতে দেখলাম।মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছি,নামটা বিশ্বজিৎ হলেও বিশ্বকে জয় করতে পারেনি।তবু জিজ্ঞেস করলাম –‘কি মেধি খবর কি?’

‘এভাবে বিট্রে করবে ভাবিনি।‘—রাগ আর দুঃখের সঙ্গে বলল।‘কাউকে বিশ্বাস করা যায় না।।‘

‘দুঃখ করবে না মেধি,ইলেকশনে হারজিৎ আছেই।উপযুক্ততা দেখে তো আর কেউ ভোট দেয় না,নাহলে কি আর হারতে হয়?

তিনশো টাকার মতো খরচ হয়ে গেল। দুই মাস মেসের ডিউজ দিতে পারিনি,তারমধ্যে স্কলারশিপ কাটা গেছে,হোস্টেলে সুপারের দয়ায় থাকতে পারছি। ‘

‘এসব বাদ দিন,আমি কিছুটা সান্ত্বনা দিয়ে বললাম—রাজনীতিতে নামলে এসব থাকবেই,উপযুক্ত মেধাবী ছাত্র দেখলে সরকার ও চাপ সৃষ্টিকরে।জানেনই তো সরকার কাউকে ভয় করে না,করে কেবল স্টুডেন্টকে।‘

সরকার এবং ভোট যারা দেয়নি তাদের গালিগালাজ করতে করতে বিশ্বজিৎ মেধির সঙ্গে হোস্টেলে ফিরে এলাম।বিশ্বজিৎ হেরে যাওয়ায় সত্যি খারাপ লাগল।উপযুক্তের পরাজয় হল বলে নয়,সাধারণ কিছু কৌ্তুক থেকে শেষ পর্যন্ত ছেলেটির এইরকম অবস্থা হওয়ার জন্যই খারাপ লাগল।

আজ প্রায় এক মাস আগের ঘটনা। রমেন,আমি এবং কয়েকটি ছেলে কলেজ থেকে হোস্টেলের দিকে যাচ্ছিলাম।রাস্তায় বিশ্বজিৎ মেধির সঙ্গে দেখা হল। আমাকে দেখে খুব ব্যস্তভাবে আমার পাশে এসে বলল –‘আমি আপনার খোঁজে হোস্টেলে গিয়েছিলাম।‘

‘কেন?’

‘কথাটা হয়তো শুনেছেন যে আমি কটনিয়ান এর এডিটরের জন্য কনটেস্ট করছি।কিন্তু কিছু কিছু ছাত্র ছাত্রী আপনি কনটেস্ট করবেন বলায় আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম।শেষ পর্যন্ত আপনি কনটেস্ট করছেন না জানতে পেরে আপনাদের ভরসায় সাহস করে দাঁড়িয়েছি।‘

আমি জানি,আমি দাঁড়াব বলে তিনি কোথাও শুনেন নি নতুবা এখনও যদি আমি দাঁড়াব বলে শুনেন তাহলে তিনি সরে দাঁড়াবেন না। কটন কলেজে ইলেকশন খেলার সাহস এবং সামর্থ্য আমার নেই,ইলেকশনের নামে তিন-চারশো টাকা খরচ করব কোথা থেকে। তবু বললাম—‘আমার দাঁড়ানো না দাঁড়ানো নিয়ে আপনার কী আসে যায়,যাকে উপযুক্ত ভাববে তাকেই ভোট দেবে,তাই নয়কি?’

‘না না আপনারা কবি সাহিত্যিক মানুষ,আপনাকে ভোট না দিয়ে কি আর আমাকে দেবে? সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ থাকলেও আপনাদের মতো অবদান নেই। ‘

‘ভুল মেধি ভুল,কবিতা লেখা আর ইলেকশন খেলে এডিটর হওয়া দুটো আলাদা জিনিস।‘

আমাদের দুজনের কথা রমেন শুনছিল। চট করে দুজনের কথার মাঝখানে সে জবাব দিল---‘তুই একটা মূর্খ মেধি।‘

‘কী হল? অবাক হয়ে মেধি রমেনের দিকে তাকাল।

‘মূর্খ নয়তো কি,এডিটরের জন্য দাঁড়ানো বা জেনারেল সেক্রেটারির জন্য দাঁড়ানো দুটাই ইলেকশন,তাই দুটিই পলিটিক্স।ইলেকশন আর পলিটিক্স হল টাকার এপিঠ আর ওপিঠ—আমাদের মতো ডেমোক্রেটিক দেশে। তাই তোর কি দেখবে?পলিটিকেল কন্ট্রিবিউশন। আর ও হল কবি,গল্প টল্প লিখতে পারলেও না হয় কথা ছিল। ওর কবিতা কজনই বা পড়ে আর কজনই বা ওকে চিনে?’

আমি ইচ্ছা করেই রমেনের কথায় বেশি করে সায় দিলাম।রমেন ও রেলগাড়ির মতো চালিয়ে গেল—‘তোকে একটা ভালো বুদ্ধি দিচ্ছি শোন।খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ার জন্য অপোজিশন পার্টিগুলি আগামী সোমবার হরতাল পালন করবে,তুই সেদিন পিকেটিং কর।কোনো রাজনৈ্তিক আন্দোলনই স্টুডেন্টস ছাড়া সফল হতে পারে না ,এতে যদি অ্যারেস্ট হস ভালোই হবে,না হলেও দেখবি তোর নাম কলেজের প্রত্যেকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়বে,তাছাড়া এই ভয়াতুর ইউনিয়ন বডির লোকগুলিও কোথাও অ্যারেস্ট হয় বলে ছাত্ররা সক্রিয় অংশগ্রহণ করে না বলে বলে বেড়াচ্ছে।‘

সেদিন আমাদের কথা ওখানেই শেষ করে আমরা হোস্টেলে ফিরে এসেছিলাম।তারপর সেকথা ভুলেই গেছি।কিন্তু সত্যি সত্যিই হরতালের দিন মেধি কোথাও পিকেটিঙ করেছিল,ডি আই রুলে ওকে অ্যারেস্ট করা হল। অবশ্য কটন কলেজের ছাত্র বলে বেশি সময় তাকে আটকে রাখল না।ছোটখাট ব্যাপারে স্টুডেন্ট নেমে পড়লে কন্ট্রোল করা মুশকিল হবে বলে সরকারও জানে। অবশ্য তার নামে একটা রিপোর্ট শিক্ষা বিভাগে পাঠিয়ে দেওয়া হল। ফলে প্রিন্সিপাল কলেজের নিয়ম শৃঙ্খ্লা ভঙ্গের নামে ওপর মহল থেকে রিপোর্ট আসায় তার স্কলারশিপটা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলেন। ভবিষ্যতে এই ধরনের কাজ কখনও করবে না বলে লিখে দেওয়ায় এবং হোস্টেল সুপারিনটেণ্ডের চেষ্টায় সে হোস্টেলে থেকে যেতে পারল।

কিন্তু তার আজকের অবস্থার জন্য সত্যিই খারাপ লাগল।সাধারণ কটনিয়ানের সম্পাদকের পদটার জন্য হেরে যাওয়ার পেছেন আমরা হয়তো কিছুটা দায়ী,কে জানে। একটা নিরীহ ছেলের এরকম অবস্থা হলে কার না খারাপ লাগবে।আমি তো তার বাড়ির অবস্থার কথা জানি না,যদি আমার মতোই হয়ে থাকে।

এই সমস্ত কথা ভেবে ভেবে আমরা এসে হোস্টেলে পৌছলাম।পড়াশোনা করার পরিবেশ আজ নেই।তাড়াতাড়ি ভাত খেয়ে শুয়ে পড়লাম।

চলবে ...