শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

কটন কলেজ, পর্ব ২

অসমীয়া ঔপন্যাসিক নবীন বরুয়ার উপন্যাসের বঙ্গানুবাদ বাসুদেব দাস

।।দুই।।

‘কনগ্রাচুলেশন বরুয়া।’

‘মানে?’

‘মানে কনগ্রচুলেশন বললে ‘থ্যাঙ্ক ইউ বলতে হয়,সেটা ভদ্রতা।’

করবী চলিহা হাসতে হাসতে আমার পাশে এসে দাঁড়াল।

ইনি করবী চলিহা।আমার সহপাঠী।একজন কম কথা বলা ভাবুক মেয়ে।কেমিস্ট্রিতে অনার্স।আমাদের মধ্যে,মানে ক্লাসের ছেলেদের মধ্যে ‘ফিলোসোফি’নামেই বেশি পরিচিত।ফিলোসোফি বিষয় নেওয়া অনেক ছাত্রী আছে।কিন্তু কেমিস্ট্রি অনার্সের মেয়েটির নাম কবে থেকে ‘ফিলোসোফি’হয়ে গেল তা আমি জানি না।

সাধারণ একটি সাদা মেখেলা,বাড়িতে বোনা একটি চাদর এবং একজোড়া পঞ্চাশ সনের মডেলের স্যাণ্ডেল।এরকম একটি সাদামাটা পোশাকেই করবী চলিহাকে ক্লাসে আসা-যাওয়া করতে দেখেছি।কটন কলেজের জন্য করবী চলিহা হয়তো একটি ব্যতিক্রম।সেইজন্যই করবী চলিহার নাম ‘ফিলোসোফি’।এরকম একটি পোশাকে করবী চলিহাকে পেয়ে ছেলেরা যেমন হতাশ হয়েছে,সঙ্গে্র মেয়েদের অনেকেই হয়েছে আল্লাদিত।করবী সাধারণ মেয়েদের চেয়ে একটু বেশি সুন্দরী।কলেজের ফাংশনে করবীর গান অপরিহার্য।

বাড়িতে দুটো গাড়ি থাকা করবীকে কেউ কোনোদিন কলেজে গাড়ি করে আসা-যাওয়া করতে দেখেনি।হয়তো পায়ে হেঁটে,নয়তো সিটিবাসেই আসা-যাওয়া করে।সঙ্গের মেয়েদের অবশ্য এর অন্যরকম ব্যাখ্যা করতে শোনা যায়।তাঁদের মতে পায়ে হেঁটে আসায় অনেক আরাম আছে।বডিগার্ডের মতো আসা ড্রাইভার অথবা আদর করে নিজেই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে আসা দাদার কাছ থেকে এক ধরনের রেহাই পাওয়া যায়,তাছাড়া রাস্তাঘাটে অপেক্ষা করতে থাকা বন্ধুদের ও অভাব নেই।

সিটিবাসের মাদকতা আরও বেশি।সকাল নয়টা থেকে দশটায় বাসে ভিড় হয়।ভিড়ের মধ্যে আসার একটা আলাদা মাদকতা রয়েছে।মহিলা দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সিট ছেড়ে দেবার ধৈর্য সিটিবাসে তখন কারও থাকে না। গায়ে গা লাগিয়ে ধাক্কা-ধাক্কি করে আসার যে আরাম তা কি আর নিঃসঙ্গভাবে পেছনের সিটে গাড়িতে বসে আসা আরামের সমান হতে পারে?

এই সুবিধাটুকু নাকি করবী চলিহা সুন্দর ভাবে গ্রহণ করে।অন্যেরা যে যাই বলুক না কেন,করবী চলিহার প্রতি আমার একটা অহৈতুক শ্রদ্ধা আছে।কম কথা বলা,প্রয়োজন ছাড়া কথা না বলা এই মেয়েটি আগে কখনও আমার সঙ্গে কথা বলেছে বলে মনে পড়ে না।এরকম একটি মেয়ের এই অস্বাভাবিক কৌ্তুকের কারণ আমি খুঁজে পেলাম না।

‘আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।কনগ্রাচুলেশন জানানোর মতো সেরকম কোনো ঘটনা আমার জীবনে ঘটেনি।’

‘আচ্ছা,কাল ‘লিটারেরি সেমিনার’এ কবিতা পাঠ করে এতগুলি হাততালি কে কুড়িয়েছে?’

‘কালকের কবিতা কালকের হাততালিতেই শেষ।কার ও যে কালকের কথাগুলি মনে থাকতে পারে তা আমার বিশ্বাস হয় না।’

‘আমি কবিতা কম বুঝি।তবু আপনার কবিতাটি আমার কিছুটা ভালো লেগেছিল,সেইজন্যই আমার এই স্পেশাল কনগ্রাচুলেশন।’

আমরা দুজনে কথা বলতে বলতে হাঁটছিলাম।শেষের দিকের ক্লাস,এই ক্লাসে ছাত্র ছাত্রীর উপস্থিতির সংখ্যা কম থাকে।প্রফেসর ও প্রতিদিন থাকেন না।

ইউনিয়ন বিল্ডিংয়ের সামনে যেতেই দেখি জ্যোৎস্না আডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিংয়ের ওদিক থেকে দ্রুত নেমে আসছে।জ্যোৎস্নাকে দেখে করবী দাঁড়িয়ে পড়ল। দুজনেরই বাড়ি একইদিকে।যাবার পথে সঙ্গী হতে পারবে।

‘বা বা,কবিতা-দর্শন দেখছি একই সঙ্গে। আমি তোর সঙ্গে কীভাবে যাব করবী,তুই এগিয়ে যা।

‘কেন? কী হয়েছে?আমাদের সঙ্গে না যাবার তো কোনো কারণ নেই।’

‘যেতে পারব,তবে সন্ধ্যা,ললিতা- কাবাব মে হাড্ডি হব না তো?’

‘বা বা তুই দেখছি একেবারে সাহিত্যের গাড়িতে উঠে পড়েছিস। রাজনীতির মানুষও দেখছি সাহিত্য করতে পারে।’

‘পলিটিকেল সায়েন্সে অনার্স রয়েছে যদিও তোদের মতো দার্শনিক কবির সঙ্গে্কথা বলার জন্য অসম বাণী,অসমিয়া বাতরিতে প্রকাশিত গল্পগুলি থেকে দুই একটি লাইন মুখস্থ করে রেখেছি,না হলে তোরা আবার আনকালচার্ড বলে হাসি ঠাট্টা করবি।’

‘আচ্ছা,জ্যোৎস্না,গতকাল বরুয়ার কবিতাটা খুব সুন্দর ছিল না কি?’প্রসঙ্গটা বদলে করবী বলল।

‘জানি।কিছু মনে করবেন না বরুয়া,আমি কবিতা নামে জিনিসটা একেবারেই বুঝতে পারি না।নোটস পড়ে কোনোরকমে পাস মার্কটা তুলে নিই।তবে গতকাল অবশ্য আমি খুব ক্ল্যাপ দিয়েছিলাম।’

‘না বুঝে কেন ক্ল্যাপ দিয়েছিলি?করবী বলল।

‘সেটা ভদ্রতা।তাতে আবার বরুয়া আমাদের বন্ধু,কেন দেব না,কী বলুন বরুয়া?’

আমি কোনো উত্তর দিই নি।দুজনকেই ইচ্ছামতো কথা বলার সুযোগ দিয়ে এক ধরনের মজা অনুভব করছিলাম।

‘করবী তোর কেন ভালো লাগল?’জ্যোৎস্না পুনরায় জিজ্ঞেস করল,তুই তো কখন ও পেট দেখানো ব্লাউজ পরিস না।কী বরুয়া,আমাদের ছোট ব্লাউজগুলি সম্পর্কে ঠাট্টা করে কিছু লিখেছিলেন নাকি?সেইসময় ছেলেরা এত বেশি হাল্লা করছিল যে কিছুই বুঝতে পারিনি।’

‘ব্লাউজ?’

করবী আর আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকালাম।মেয়েদের পেট দেখানো ব্লাউজের কথাতো আমার কবিতায় ছিল না।আমাদের বিস্মিত চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে কিছু না বলা কথা বলে ফেলার মতো জ্যোৎস্না থতমত খেয়ে গেল।

‘কে জানে,আপনারা কবি দার্শনিকরা কী ভাবেন,কী লেখেন।আপনি তাহলে কী লিখেছিলেন?’

হঠাৎ আমার হো হো করে হাসি পেয়ে গেল।

‘কী হল হাসছ যে?’জ্যোৎস্না জিজ্ঞেস করল।

‘এমনিতেই।

ঠিক তখনই সিটিবাস এল।করবী এবং জ্যোৎস্না বাস দেখে স্টপেজের দিকে দ্রুত এগিয়ে গেল।বাস থামার সঙ্গে সঙ্গে জ্যোৎস্না ‘বরুয়া যাই’বলে লাফ দিয়ে বাসে উঠল।করবী মুখে কিছু বলল না যদিও চোখের ইশারায় বিদায় নিল। আমিও ইশারাতেই প্রত্যুত্তর জানালাম।

দীঘলিপুকুর পার হতে হতে জ্যোৎস্নাদের বাসটা চোখের আড়ালে চলে গেল।আমি অপ্রত্যাশিতভাবে এত কথা বলা মেয়ে দুটির কথা ভাবতে ভাবতে হোস্টেলের দিকে এগিয়ে গেলাম।

জ্যোৎস্নার সঙ্গে আমি আগেও কথা বলেছি।অনেক কথা বলেছি। সহপাঠী হিসেবে মজা করেছি।সে ওসবকিছু সহজ ভাবে নিয়েছে।আমিও নিয়েছি। কোনো নতুনত্ব নেই,কটন কলেজের একটা দৈনন্দিন ঘটনা। কিন্তু করবীকে কেন জানি আমি বারবার চেষ্টা করেও সহজভাবে নিতে পারছি না। কোনোদিনই কথা না বলা এই মেয়েটিকে আজ আমার যেন এক ব্যতিক্রম বলে মনে হল।

জ্যোৎস্নার কথা পুনরায় মনে পড়ে যাওয়ায় আমার হাসি পেল।ওর কবিতার ব্যাখ্যা শুনে আমার মনে করুণা জন্মায়নি।এটা জ্যোৎস্নার ভুল নয়,অনেকেই ভুল করেছে।

কালকেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম কতজন আমার কবিতাকে গুরুত্ব দিয়েছে। শেষের দিকের ছেলেদের হাততালিই আমার কবিতার মূল্য নিরুপণ করে দিল।তারজন্য আমি অনুতপ্ত হইনি। সেই সমস্ত ছেলেদেরও করুণার চোখের দৃষ্টিতে দেখার ধৃষ্টতা আমার নেই।

কাল সন্ধ্যেবেলা লিটারেরি সেক্রেটারি ও বলেছিলেন-‘বুঝেছেন বরুয়া,আপনার কবিতাটা শুনে কয়েকজন প্রফেসর আমার কাছে আপত্তি জানিয়েছে। তাদের মতে পাবলিকলি এই ধরনের কবিতা পাঠ করা উচিত নয়,বিশেষ করে অনেক মেয়েই এবং বয়োবৃদ্ধ অধ্যাপকরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

আমি কোনো উত্তর দিইনি।অধ্যাপকদের শালীনতা বোধে আঘাত করায় মানসিক আঘাত পেয়েছিল যদিও আমি অনুতপ্ত হতে পারিনি। সেক্রেটারি কোন কথায় অনেকের শালীনতা বোধকে আঘাত করেছিল বলেননি। আমিও জিজ্ঞেস করিনি।আমার কবিতার সেই পঙক্তিটা মনে পড়ল যে পঙক্তি আমার কবিতাটিকে বালিশের নিচের সাহিত্যে পরিণত করেছেঃ-

একবিঘা ব্লাউজে ঢেকে রাখা এই পৃথিবীর

সভ্যতার ব্যবসা বহন করা স্তনযুগলের মধ্য দিয়ে

আমার মন দৌড়ানোর সময়

সভ্যতার হাড় চুষে চুষে

বেঁচে থাকা একজন নারী

আমার সামনে দাঁড়িয়ে

একটা,মলিন ছেঁড়া কাপড়ে

তার শুষ্ক স্তনগুলি ঢাকতে চেয়ে

বারবার ব্যর্থ হয়ে

আমাকে বলেছিল

আমার চাই কেবল এক বিঘা কাপড়

তুমি কি দিতে পারবে?

কিন্তু করবী তো কবিতাটা শুনেছিল । করবী তো কবিতাটিতে কোনো ধরনের অশ্লীলতা দেখতে পায়নি। করবীর কনগ্রাচুলেশনে কি ব্যঙ্গ মিশ্রিত ছিল? করবীর মতো মেয়ের চোখে হয়তো এটা নিষিদ্ধ কোনো কিছুর আবেদন নিয়ে এসেছিল।

কিন্তু করবীর চোখ দুটিতে তো সেই ব্যঙ্গ নেই।এই মেয়েটির সঙ্গে আজ প্রথম কথা বলেছি। কোনোদিনই তো এই মেয়েটিকে কাউকে ব্যঙ্গ করে কথা বলতে শুনিনি। তাহলে কবিতাটা করবী শুনেছিল কি?কবিতা যে কেউ অন্তর থেকে শুনে সেকথা আমার বিশ্বাস হয় না। আমি পাঠ করেছিলাম একমাত্র ‘লিটারেরি সেমিনারের’সেক্রেটারির অনুরোধে। কবিতা পাঠ করে বাহ বাহ শোনার বাসনা আমার কোনোদিনই ছিল না।

ধীরে ধীরে আমার মন ভরে এল করবী নামের সেই অবুঝ চোখের ভাষা না বোঝা মেয়েটির মুখ।‘ফিলোসোফি’নামে বিখ্যাত মেয়েটিকে আজ আমার নতুন ভাবে দেখতে ইচ্ছা হল। হরিণের চঞ্চলতা নেই,চোখ ধাঁধানো তীব্রতাও নেই।নানা রঙের রঙ মেখে মুখটাকে অপরূপা করে তোলার উদ্দেশ্যে এই মেয়েটি কোনোদিনই হয়তো আত্মহারা হয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে থাকেনি।বিখ্যাত ব্যবসায়ী বিনন্দ চলিহার একমাত্র কন্যা না হলে একবাক্যে তথাকথিত সভ্যতার চোখে ‘আনকালচার্ড’বলে নিন্দা কুড়োনোর মতো মেয়ে।

এই আপাততঃ কিছুই না থাকা মেয়েটির মধ্যে কেন জানি আমি অনেক কিছু খুঁজে পেয়েছি যা আমি নিজেই এখনও বুঝে উঠতে পারিনি।আমার কবিতাকে প্রশংসা করার জন্য এটা আমার স্বার্থান্ধ কৃতজ্ঞতা নয়তো?

আমি এই প্রশ্নের সমাধান বারবার চেষ্টা করেও করতে পারিনি।হোস্টেলে না পৌছানো পর্যন্ত এই একটাই প্রশ্ন আমি নিজেকে বারবার জিজ্ঞেস করেছি।

চলবে ...


লেখক পরিচিতি -১৯৪৫ সনের ৭ নভেম্বর নবীন বরুয়ার জন্ম হয়।শ্রী বরুয়া একজন ঔপন্যাসিক,প্রকাশক এবং খবরের কাগজের কলাম লেখক।১৯৬৫ সনে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘কটন কলেজ’হোমেন বরগোহাঞি সম্পাদিত ষান্মাষিক পত্রিকা ‘নীলাচল’এ প্রকাশিত হয় (১৯৬৯) ।১৯৭০ সনে উপন্যাসটি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়।গত পঞ্চাশ ধরে উপন্যাসটির পাঠকদের কাছে চাহিদা এক অভিলেখ সৃষ্টি করেছে।ভারতীয় ভাষায় লেখা এটিই প্রথম ক্যাম্পাস নভেল।শ্রী বরুয়ার অন্যান্য উপন্যাসগুলি হল ‘মন অজন্তা’,’প্রেমিকা’,’অমোঘ নিবিড় অন্ধকার’,’ফিনিক্স পাখির গান’ইত্যাদি।একমাত্র গল্প সঙ্কলন ‘একান্ত ব্যক্তিগত’।১৯৮৩ সনে সরকারি চাকরি ছেড়ে পূর্বাঞ্চল প্রকাশ নামে প্রকাশন সংস্থা গড়ে তোলেন। তিনি নর্থ ইস্ট বুক ফেয়ারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।