শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

উত্তরকথা, প্রান্ত কথা... পর্ব ৮

‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’...


কবেকার কোন রাত্রিদিন থেকে নতুনতর হয়ে গড়িয়ে নামতে থাকা রাত্রিদিবস সকল যেন মজা ও ম্যাজিক ছড়াতে থাকলেও গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নচিহ্নের সমস্বরে দূর থেকে ভেসে আসা মহরমের বাজনায় তাজিয়ার বর্ণবহুলতায় উন্মুখ হয়ে উঠতে উঠতে বাল্যস্মৃতি জেগে উঠতে থাকলেও তাকে প্রশ্নাতীতভাবেই বলরামপুরের মাঠখেতপ্রান্তর উজিয়ে হাটগঞ্জ উজিয়ে ডম্ফ বাজনার স্বরশ্রুতির নিবিড়ত্বে আটকে পড়তে হয়। বলরামপুরের বাড়িঘর থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়েও তাকে কিন্তু সম্পৃক্ত থাকতে হয় আত্মপরিচয়ের গূঢ়সত্যেই যে সে জাফর জোতদারের জোতজমির অংশ হয়ে উঠেছে শেষাবধি।আর পূর্বের কালজানি নদী, নদীপারের কুলঝোপ,নদী পেরিয়ে তুফানগঞ্জ বন্দর,দোতরাবাঁশির ভিতর জেগে থাকা বেঁচে থাকা,বেঁচেবর্তে থাকতে থাকতে কখন কিভাবে বলরামপুরই বুঝি আত্মপরিচয় খসিয়ে ফেলতে থাকে।তখন আব্বাস তার চোখের সারল্যে বয়ন করতে থাকে দিনযাপনের টুকরোটাকরা। যেন কাড়ানাকাড়া বাজে।সানাইবাদ্যে ভরে ওঠে ঘর গেরস্থালী।এত এত যাপনের ভিতর চুপ করে বসেও থাকা যায় না।কেননা যাপন দিয়েই তো মেপে নেয়া হয় জীবনযাপন। বলরামপুরের ওপর নেমে আসতে থাকে আদ্যন্ত বলরামপুর। গঞ্জ বল গাও বল হাটগঞ্জ বল সবেরই দিকে ছুটে আসতে আসতে আব্বাসকে প্রাণপণ জীবনের কুহকেই গিয়ে পড়তে হয়। আর চলেই যেতে হয় গ্রাম্য গীদালের বাঁশি দোতরার টানে আদ্যন্ত এক বলরামপুরের দিকেই যেখানে মাঠফসলের পরিপক্কতায় বিমূঢ় হয়ে থাকতে হয় আদিমধ্যঅন্তহীন এক যাপনপর্বের বহুরৈখিকতায়।

‘ও কি ও বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে’

কালজানি নদীর বিস্তৃতির সামনে এসে দাঁড়ালেও বিস্তারহারানো নদীর প্রেক্ষাপটকে অস্বীকার করবার উপায়ন্তর না দেখে তুমুল ফিরে আসা কালজানির শিথানে। প্রান্ত থেকে প্রান্তকথা থেকে জীবনমরণময়তায় শষ্যভূমির ভিতর খেলে বেড়ানো হাওয়াবাতাসে মিশে যেতে থাকে পাগারু বুড়ার দোতরার গান। পাগা্রু বুড়ার গানে গানে স্মৃতিকাতরতা এসে পড়লেও আদ্যন্ত এক বলরামপুর দানাফসলের দেশ হয়ে আকাশের নীলে নীলে ভূটান পাহাড়ের দিকে উড়ে যাওয়া পাখিদল ফিরে আসতেই চায় কালজানির পাড়ে পাড়ে গো-মহিষের গালার ঘান্টির মত। কালজানি উজিয়ে কখন চলে যাওয়া জাফর জোতদারের ইজারা নেওয়া হাটের অন্দরে অন্দরে। রাতের স্মৃতিতে রাত্রিকালের স্মৃতিতামাসায় গরুর গাড়ির নিচে দুলতে থাকা লণ্ঠণ আলোয় ঝমঝম করে ওঠে গানগুলি-

‘ও রে আগা নাওয়ে ডুবু ডুবু

পাছা নাওয়ে বইসো’

গান তো রক্তের ভিতর মিশে যাওয়া পরিণতির মত। সে তো নিমেষেই কন্ঠে তুলে আনতে পারে চাষি-কিষাণ-মৈষাল মাহুতের কন্ঠের সুর। সে তো গানের ভিতর গান হয়ে নাচের ভিতর নাচ হয়ে নাচগানের পর নাচগান অতিক্রম করতে করতে জনপদ-জনজঙ্গল খেতিবাড়ি বন্দরে বন্দরে টাড়িতে টাড়িতে আবহমানের জীবনের গল্প বহন করতে থাকে। কালজানির ঢেও কালজানির বয়ে চলা কালজানিতে বাইচ খেলা ধনীবাড়িতে সত্যপীরের গানের আসরে নিমজ্জিত হতে হতেই তার বেড়ে ওঠা বেঁচেবর্তে থাকা। দিগন্তপ্রসারী মাঠে মাঠে হারিয়ে যেতে যেতে আধিয়ারি প্রজাদের গানগুলি দিনকালগুলির ওপর ঝুঁকে পড়ে। হাল বাইতে বাইতে পাট নিড়াতে নিড়াতে জীবনের দর্শনকে খুঁজে পাবার মরিয়া প্রয়াসটাই জোরালো হতে থাকে। জীবন গনগণে আঁচে দাউ দাউ হয়ে ওঠে। আব্বাজান জাফর জোতদারের প্রশ্রয়ে প্রশ্রয়ে আস্ত এক জীবন নিয়ে সে জীবনের প্রকৃত জীবনযাপন হয়ে উঠবার দিকেই নিবেদিত করে তুলতে প্রস্তুতিপর্বই শুরু করে দেয়। পাথারবাড়ির দিকে কচুবনের দিকে বলরামপুরের কুঞ্জ পালের দোকানের দিকে সে আস্ত এক স্বপ্নবৃত্তান্তই রচনা করে ফেলে-

‘আজি নদী না যাইও বৈদ

নদীর ঘোলা রে ঘোলা পানি’

কোচবিহারের রাজার শিকারযাত্রার মিছিলের বাদ্যে বাদ্যে সে তুলে আনতে থাকে কেবল গান আর গান;আর আব্বাস আমার ভিতর আমি হয়ে চলে আসে,আমার পরিক্রমণের ভিতরেই সে তুমুল মিশে যেতেই থাকে,আমার বয়ানে বয়ানে আত্মগত হয়ে উঠতেই থাকে-

‘মুখকোনা তোর ডিব ডিব রে

ভাওজি গুয়া কোনটে খালু’


ক্রমশ ...।