শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

উত্তরকথাঃপ্রান্তকথা, পর্ব -১

লেখক পরিচিতি -- কবি সুবীর সরকার. জন্ম ১৯৭০এ. বাংলা কবিতায় নয়ের দশকে লিখতে আসেন. কবি উত্তরের লোকজীবনের সাথে জড়িয়ে আছেন তীব্র ভাবে, ত্রিশ বছরের বেশী সময় ধরে কবিতা গদ্য সহ বিভিন্ন ধারায় অনায়াস যাতায়াত করেছেন. উল্লেখযোগ্য বহু কাজের স্রষ্টা । এ কবি তরুণ কবিদের পরম বন্ধু, বাংলা ভাষার প্রায় সব কাগজে নিয়মিত লেখালিখি করেছেন, করছেন । ১৯৯৬ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই 'যাপনচিত্র', প্রকাশিত হয় কবিতা পাক্ষিক থেকে । ২০১৯ -এ সাম্প্রতিক কবিতা বইটি আলোপৃথিবী প্রকাশনীর 'লোকসংগীত শুনি'. গুরুত্বপূর্ণ কবিতা ও গদ্যের বইগুলো - 'ধানবাড়ি গানবাড়ি', 'মাহুত বন্ধু রে', 'নির্বাচিত কবিতা', 'বিবাহ বাজনা', 'নাচঘর', 'উত্তরজনপদবৃত্তান্ত', 'মাতব্বর বৃত্তান্ত', 'ভাঙা সেতুর গান'। কবির কিছু বই অনুবাদেও পেয়েছেন পাঠ। পেশায় শিক্ষক কবি ভালবাসেন রবিশস্যের খামার বাড়ি, সাদা ঘোড়া আর যৌথ যাপনে চাঁদের আলোয় কবিতা আড্ডা, লোকগানের আমেজ...

হামার দ্যাশত বড় বাঘের ভয় রে সোনা রায়

এক

মেন্দাবাড়ির মেলা থেকে ফিরতে বেশ দেরী হয়ে গেল বাবুলালের।সারা মেলা ঘুরে,নাগরদোলায় চেপে,বন্দুক ফুটিয়ে বেশ মজা লুটে কিভাবে যে সময় গড়িয়ে গেল,তা মালুমই হল না।আসলে শীতের বেলা দ্রুত ফুরিয়ে যায়।সে সুরুজ ওঠার সময় কাকার সাথে বাঁশবাড়ি লাইন থেকে রওনা দিয়েছিল।তারপর হেঁটে হেঁটে মথুরা বাগান পেরিয়ে,চিলাপাতার জঙ্গল দিয়ে মাঝবেলায় এসে পৌঁছনো মেন্দাবাড়ির রংবেরঙ্গের এই মেলার ভিতরে।তখন মেলার মাঠে ধামসা মাদলের তালে তালে আদিবাসী নাচ। কোমর দুলিয়ে বাবুলালকে চলে যেতে হল মোরগলড়াইয়ের দিকে।মেলাভরতি নাচ মেলাভরতি গান নিয়ে এইভাবে মেলা কিভাবে কখন যেন আস্ত এক জমজমাট মেলাবাড়িই হয়ে উঠলো।কিন্তু এখন,এই বিকেলডোবার ক্ষণে কুয়াশাশীতের ভিতরে এই জঙ্গলভূমি কি ভাবে পেরোবে এই চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়লো কিন্দুস কাকার।সবচেয়ে বড় ভয় চিলাপাতার হাতি আর বাইসনের পালের।বিকেলের পরপরেই গোটা জঙ্গলতল্লাট তো তাদেরই দখলে চলে যায়।হায় যিশু!হায় বাবা মহাকাল!যদিও বাবুলালের কোন ভয়,কোন হেলদোল নেই।তার ভারি মজা যে সে রাতের,সাঁঝের জঙ্গলের মধ্যি দিয়ে হেঁটে বাড়ি যাবে।কত কত পাখির ডাক,জঙ্গলের ঘান্টিপোকার গান, ঝিঁঝিঁর গুঞ্জন,দুরে কাছে ফেউয়ের হাসি এসব তাকে ভারি খুশি খুশি করে দেয়।সে কাকাকে তাড়া দেয়।তারপরে তাদের যাত্রা শুরু।তখন প্রায় আন্ধার নেমে গেছে চারপাশের জঙ্গলে।

###

আসলে বাবুলালের তেমন কোন হাতি বা বাইসন ভীতি নেই।সে তো জন্মভর এই নদী নালা হাতি বাইসন দোতরার গান ধামসা মাদল চা বাগান বাগানীয়া হাট মোরগলড়াই কুলিকামিনের জঙ্গল জঙ্গলের এক অনুপম পৃথিবীতেই বেঁচে আছে,বেঁচেবর্তে আছে।নানীর কাছে কত কতবার তাকে শুনতে হয়েছে সেই বুড়া বাঘের গল্প।শিলতোর্ষায় কবেকার জংলী হাতির চোরাবালিতে একা একা ডুবে যাবার কিসসাকহন।আর গ্রামের মুরুব্বীদের সঙ্গে ধানখেত পাহারা দিতে গিয়ে কতবার বুনো হাতির পাল তাড়াতে হয়েছে।জঙ্গলে গরু আনতে গিয়ে বাঘে খাওয়া গরুর লাশ দেখতে হয়েছে।দুরে দাঁড়ানো বাইসনের পাল দেখে তার কিন্তু ভয়ও করেছে।কিন্তু সে এটা তো বুঝেই গিয়েছে যে এই তার জন্মমরণের জন্মজন্মান্তরের বাসভূমি;বেঁচে থাকবার চিরকালীন দুনিয়া।সে কেবল গলা ছেড়ে গান গেয়ে উঠেছে-‘হাওয়া লাগাই দে সাইয়া/হাওয়া লাগাই দে’...

তার একা একা বেঁচে থাকাকে সে বেশ উপভোগই করে।তার কত কত বন্ধু।পাড়ার বন্ধু,ইস্কুলের বন্ধু,মার্বেল খেলার বন্ধু।কিন্তু সবার সঙ্গে থেকেও মাঝে মাঝেই সে এক হয়ে যায়,উদাস হয়ে যায়।একা একাই চলে যায় খয়েরবাড়ির গীর্জায়।ফাদারের কাছে গল্প শুনতে।বানিয়া নদীতে পা ডুবিয়ে মাছেদের খেলা দেখে সে।কখনো চকোয়াখেতি বস্তিতে সাধুচরণ কাকার কাছে দোতরার গান শুনতে যায়।কাকি তাকে দেয় চালের পায়েস,ভাপা পিঠা।আর সাধু কাকা দোতরায় গান তোলে-

  • ওরে বাচ্চা বাপই সোনার চান

গরু দুইটা আইলত বান্ধ

হামার বাড়িত মাগুর

মাছের গান

সাধুকাকা পুরোন দিনের কথা শোনান।কোচবিহার রাজার বোনের বিয়ের জাঁকজমকের কথা বলেন।তেভাগার লড়াইয়ের গল্প শোনান।পাতলাখাওয়া ফরেষ্টের বিবাগী গণ্ডার ‘শম্ভু,র কিংবদন্তির সাথে মিশিয়ে দেন ‘সোনা রায়ের’ গানও-

  • 'হামার দেশত বড় বাঘের ভয়

রে সোনা রায়

ফান্দে পড়িয়া বুড়া বাঘা কান্দে

রে সোনা রায়’

বাবুলাল বেড়ে ওঠে এইভাবে।অগ্রহায়ণের শুনা মাঠে মাঠে সে খুঁজে ফেরে ইঁদুরের গর্ত আর গর্তের থাক দিয়ে সাজানো ধানের গুচ্ছ।

###

কিন্দুস এক্কা মানে কিন্দুস কাকার পিছে পিছে চলতে চলতে বাবুলাল দেখে জঙ্গলের পথে গাছের ডাল ভাঙবার চিহ্ন।তবে কি হাতির পাল আছে কাছেপিঠেই!এই তো সামনেই বানিয়ার ছড়া,নল রাজার গড়।হাতিদের ডেরা।জলপানের জায়গা।তার কোন ভয় নেই।সে তো আন্দু বস্তিতে একবার শুনতে গিয়েছিল পার্বতী বড়ুয়ার হাতি বিষয়ক নানান কথা।যা শুনে সে বুঝেছিল হাতি খুব বুঝদার জীব বটে।সে নিজে থেকে কাউকে আক্রমণ করে না।মানুষের লোভেই হাতিদের চলাফেরার রাস্তায় বাড়িবসতখেতখেতি গড়ে উঠেছে,জঙ্গল চুরি হয়ে যাচ্ছে।খাবার নেই হাতিদের।তা এই অবলা জীবেরা তবে যাবে কোথায়!সত্য বটে।এই পার্বতী বুড়ি তো আর যে সে কেউ নয়।অসমের গৌরীপুরের রাজার বিটি।লালজি রাজা ছিলেন হাতিধরায় বিখ্যাত মানুষ।লালজির আর এক মেয়ের গান তো রেডিওতে সে শুনেছেও।প্রতিমা বড়ুয়ার গান।পরে শুনেছে মস্ত নামিক্কার শিল্পী।হাতির গান গায়।মাহুত বন্ধুর গান গায়।বাপ রে বাপ।সে বড় হয়ে সাধু কাকার সঙ্গে একবার যাবে গৌরীপুরের রাজবাড়ি দেখতে।সেখানে নাকি লালজি রাজার প্রিয় হাতি ‘প্রতাপ সিং’ –এর সমাধি আছে।ওরে বাব্বা।হাতির আবার সমাধি!ভারি তাজ্জব বাত তো।

তারা পেরিয়ে গেল বানিয়ার পুল।এর পরেই তো টেরিয়া পুল!প্রভু হে!আন্ধারিয়া রাত।সামনে কিচ্চু দেখা যায় না।শুধু জোনাই জ্বলে।এখানে ওখানে বাদরের হিপ হিপ।কোথাও ময়ূর ডাকে।রাতচরা পাখিরা ডানায় ঝাপট তোলে।বানিয়ার জলের স্রোতের একটানা শব্দ।সারা শরীর জুড়ে বাবুলালের কেমন কেমন যেন!না,ভয় নয়।অন্য কিছু।কিন্দুস এক্কা জড়িয়ে ধরলো বাবুলালকে।সামনে কালো কালো পাহাড় যেন বা এগিয়ে আসছে তাদের দিকে মনে হয়।চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো কিন্দুস বাউলালকে বুকে জাপটেই।নিঃশব্দেই।এতটাই শব্দহীন সেই দাঁড়িয়ে থাকাটা যে গায়ে মশারা ছেঁকে ধরলেও কিচ্ছুটি করার জো নেই।আর এতসবের মধ্যে কখন কিভাবে যেন রাজ্যির ঘুম নেমে আসতে থাকে বাবুলালের শরীরের কোষে কোষে।

###

অনেক অনেক বছর পরে সেই ছোট্ট বাবুলাল হয়ে উঠেছিলেন চা-শ্রমিক আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব বাবুলাল এক্কা।তার প্রয়াণের পরে তার জীবন নিয়ে কলকাতা থেকে ডকুমেন্টারী ছবি করবার জন্য তার গ্রামে এসেছিলেন চিত্র পরিচালক সুখেন্দু নন্দী।তিনি শুনেছিলেন মেন্দাবাড়ির মেলা থেকে ফেরার পথের সেই অসমাপ্ত গল্পকথাটি।সেই রাতে বাবুলাল ঘুমিয়ে পড়বার পরে ভয়ার্ত কিন্দুস এক্কা বাবুলালকে রাস্তার পাশে শুইয়ে রেখে ডানদিকের জঙ্গলে দৌড়ে পালিএছিলেন।তিনি ভোরের আলো ফুটতেই গ্রামের সবাইকে নিয়ে বাবুলালকে জীবিত কিংবা মৃত খুঁজতে,উদ্ধার করতে এসে অবাক বিষ্ময়ে দেখলেন,সবচেয়ে বড় দাঁতাল হাতির পিঠে মহানন্দে বসে আছে বাবুলাল।আর সেই দাঁতাল হাতিকে ঘিরে আরো ৩০/৩২ টি হাতির দঙ্গল।আর বাবুলালের গলায় চিকন সুরে প্রবাহিত হচ্ছে গান,যে গান তাকে দিয়েছিল সাধুচরণ কাকা,--

  • ‘হাতি রে তুই দমিয়া দমিয়া

নাচেক রে

মধুমালার হাতি রে

হাতি রে তোর কুলার মতন

মাথা রে

চিলাপাতার হাতি রে

হাতি রে তর মূলার মতন

দাঁত রে

মেন্দাবাড়ির হাতি রে’...


বলাবাহুল্য চিত্র পরিচালক সুখেন্দু নন্দী তার তথ্যচিত্রটিতে ভরে দিয়েছিলেন হাজার হাজার দাঁতাল হাতির ছবি এবং পার্বতী বড়ুয়ার মিনিট তিনেকের কথাবার্তা দিয়ে।


চলবে ...