বুধবার, এপ্রিল ২৪, ২০২৪

আপনার আর আমার বাংলা ভাষাটা

* মে মাসটায় বড্ড চাপ থাকে।

সপ্তাহ শুরু হতেই রবীন্দ্রনাথ কে নিয়ে ব্যস্ততা। আজকাল আবার কবিপক্ষ বলে একটা শব্দ আছে। তারফলে, পুরো মাসটা জুড়েই রবীন্দ্রনাথ থাকেন। তারপর "ঊনিশে মে" একটা উল্লেখযোগ্য দিন। এই সময়টা খুব আবেগিক ।

"আ মরি বাংলাভাষা" নিয়ে প্রচুর দরদ ভরা পোস্টে সামাজিক মাধ্যম ভরে ওঠে। বাংলা মাধ্যমের স্কুল গুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে থেকে শুরু করে মাতৃভাষায় চিন্তা চর্চা অবধি কমে যাচ্ছে এসব নিয়ে প্রচুর দুশ্চিন্তা ... প্রতিজ্ঞা এবং শপথ নেয়ার মাস এটা।

কিন্তু... বাকি সময়টা ... একটি বহুজাতিক দেশ। ইংরেজি, হিন্দি না জানলে, দু কদম পিছিয়ে পড়তে হয়। সুতরাং মাতৃভাষার বাইরে এই দুটি মাস্ট। তারমধ্যে, যারা আবার প্রবাসী, তাদের স্থানীয় ভাষা না জানাটা রীতিমত অপরাধের মধ্যে গণ্য হয়। সুতরাং মিনিমাম চারটে ভাষায় "লেখাপড়ির গেয়ান" না থাকলেই নয়। সত্যি কথা বটে,অনেকগুলো ভাষাই স্বীকৃত সংবিধানে। কিন্তু যা লেখা থাকে, তা সবসময় ব্যবহৃত হয় না। ব্যবহার করা যায় না। এই দেশে অধিকাংশ সরকারি নথি হয় ইংরেজি, অথবা হিন্দি অথবা এই দুটোতেই ছাপা হয়। উপায় নেই।

যদি সব ভাষাকে সমান মান্যতা দিয়ে ছাপতে হয়, তাহলে সাধারণ একটা ফর্ম অন্তত তিরিশ পাতার কমে দাঁড়াবে না। সব রাজ্যেই বহু ভাষাভাষী মানুষ থাকেন। বিশ্বায়নের যুগে, মানুষের ডানা গজিয়েছে। সে হরদম এই শহর থেকে ওই শহরে দৌড়াচ্ছে। একটি সার্বগ্রাহ্য ভাষা না থাকলে, সে অসহায় বোধ করে । এখনো পড়াশুনার বেশিরভাগ বই ইংরেজিতে। প্রশ্ন তোলা খুব সহজ এগুলো প্রাদেশিক ভাষায় অনুবাদ করিয়ে পড়ার সুযোগ করতে অসুবিধা কোথায়? অনেকে রাশান ভাষার দোহাই দেন। শুনেছি, রাশিয়ায় পড়তে গেলে প্রথম দুবছর ডাক্তারী ছাত্রদের রাশান ভাষা শিখতে হয়। তারপর পড়া শুরু। ধরা যাক সেই একই ফর্মুলা এখানেও লাগু করা হলো।

এবার বরাকভেলির ছাত্র পড়তে গেছে তামিলনাড়ু আর তামিলনাড়ুর ছেলে ডাক্তারি পড়তে এসেছে শিলচর মেডিক্যাল কলেজে। দুজনকেই দুবছর সেই রাজ্যের সরকারি ভাষা শিক্ষার জন্য ব্যয় করতে হবে। অবশ্য যেতে না হলে হতো না।কিন্তু প্রতিটি প্রদেশের ছেলেমেয়ে একমাত্র সেই প্রদেশেই তাহলে পড়তে হয়। অঞ্চলভেদে ভাষা পাল্টে যায়। সুতরাং প্রতিটি অঞ্চলের জন্যে শুধু সেই অঞ্চলের লোকদের দ্বারাই যাবতীয় ব্যাপার সামলানো...এই হাস্যকর চিন্তাভাবনা নিয়ে আর বিশেষ কিছু লেখার মানে হয় না। ভাবুন আইন আদালতের কথা। সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল জবাব চলে ইংরেজিতে। এবার বাংলায় আইনের বই পড়া উকিল বাবু বক্তব্য রাখছেন বাংলায়, আর তামিল বিচারককে তা অনুবাদ করে শোনানো হচ্ছে। দক্ষিণ এর রাজ্যগুলোয় বেরামের চিকিৎসা করাতে যাওয়া একটি নিয়মিত অভ্যাস। সেখানে ডাক্তারবাবু নিজের মাতৃ ভাষায় লেখেন, সেটা অনুবাদ করিয়ে আনবেন কার কাছ থেকে? আজকাল খুব জোর দেওয়া হচ্ছে হিন্দির উপর। কেন, কিভাবে এসব প্রশ্ন করার মানে হয় না। মাতৃভাষার সরকারি স্কুল গুলোতে, সেই স্কুলের মাস্টারমশাইরা নিজের বাচ্চাদেরই ভর্তি করাতে চান না। বইগুলোর মান সম্পর্কে কিছু বলা উচিত নয়। রাজ্যের গড়পড়তা মধ্যবিত্তরা বেছে নিচ্ছেন কেন্দ্রীয় শিক্ষা বোর্ডের আওতায় থাকা স্কুলগুলো। কেমন যেন মন্ত্রবলে, সেখানে পরীক্ষায় একশো শতাংশ মার্কস ওঠে। এমনকি ভাষার পেপারেও । সেইসব স্কুলে অবশ্য হিন্দি ছাড়া অন্য ভাষা নেয়ার সুবিধে নেই। থাকলেও একশো শতাংশ পেতে হলে হিন্দিই সম্বল। ফলতং, নিজেদের চেনা ইয়ং ইন্ডিয়া, চেনা পরিচিত শিক্ষিত সমাজ অনায়াসে এই ভাষাটি ব্যবহার করছে। করতে পারছে। অনুঘটক হিসেবে চোখ জুড়ানো হিন্দি ছায়াছবি তো আছেই। স্বাভাবিক ভাবেই, এই দ্রুত বদলে যাওয়া সময়, আমাদের সাংস্কৃতিক ভাবনা চিন্তার মধ্যে প্রচুর পরিবর্তন, স্থান করে নিচ্ছে। ধুতি পাঞ্জাবির কথা ছেড়ে দিন, বিয়েতে "সংগীত" বলে একটা অনুষ্ঠান, হিন্দি ছায়াছবির অনুকরণে কিভাবে আজকাল যেন মধ্যবিত্ত বিয়ের একটি আবশ্যক অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে । এই সব বাড়ির বাচ্চারা জন্মের পর থেকে একসময় টিভিতে হিন্দি বা ইংরেজি সিরিয়াল, সিনেমা দেখতো। কিছু কিছু ভয়ঙ্কর রকমের ঝোলানো বাংলা সিরিয়ালও দেখতো। আজকাল মোবাইলে কিসব করতে থাকে। সেটা আর যাই হোক বাংলায় নয়। একটা অদ্ভুত সঙ্কর সংস্কৃতি এসে, এতোদিনকার বিভিন্ন প্রাদেশিক সংস্কৃতি গুলো খেয়ে ফেলছে। পুরোনো ভাষা, সংস্কৃতি বেকডেটেড বলে পরিত্যাগ করছে নতুন প্রজন্মের সিংহভাগ। সবচেয়ে ভয়ংকর অবস্থা, চাকরি ঈশ্বর, চাকরিই ধর্ম ইত্যাদি ভাবা জনগোষ্ঠীর জন্যে। ব্যবসাপত্তর ব্যাপারটা বাঙালির খুব জমে নি কখনো। চাকরি বাকরি, জীবিকার সন্ধানে দেশান্তরে পাড়ি দিতে বাধ্য মধ্যবিত্ত পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের কাছে জীবিকার খোঁজে নিশ্চিন্ত শহর প্রাপ্তি, বড্ড কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে দিন কে দিন। আপাতত তার কাছে বাংলা ভাষা শেখা, সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার দায় খুব আবশ্যকীয় নয়।

এমন অবস্থায়, আগামী দশ বছর পরই, এই সব মধ্যবিত্ত পরিবার গুলোয় বাংলা ভাষার অস্তিত্ব কতখানি বেঁচে থাকবে, সেটা নিয়েই সন্দেহ জাগে। বাংলা ভাষা বেঁচে থাকবে। শুধু জনসংখ্যা হিসেব করলেই দেখা যাবে, বিশ্বে হয়তো বাঙালিরা প্রথম দশটি জাতির মধ্যে থাকবে। ভাষা থাকবে, গল্প কবিতা, আলোচনার সংগে বইও বেরুবে। শুধু, আমার, আমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো থেকে আগামী প্রজন্মের কেউ কেউ হয়তো ইংরেজি অনুবাদে , সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার গল্প গুলো পড়বে, হয়তো একমাত্র সেভাবেই পড়তে পারবে।