বুধবার, এপ্রিল ২৪, ২০২৪

আকনবিন্ধীর সোনাপোকা,প্রথম অধ্যায় - ৩

লেখক পরিচিতি – ১৯৬২ সনে শিবসাগরের গড়গাঁওয়ে বন্তি শেনচোয়ার জন্ম হয়। শিলঙের উত্তর পূর্ব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী।বর্তমানে গুয়াহাটির রাধা গোবিন্দ কলেজের ইংরেজি বিভাগ থেকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা। প্রকৃতিপ্রমিক এই লেখিকার প্রকাশিত গল্প গ্রন্থ যথাক্রমে ‘নিষাদ গান্ধার’,’সরলা আরু সুন্দর’,’দুপুরের পার চরাই’এবং ‘মৌ-সরা’। সম্প্রতি প্রকাশিত উপন্যাস ‘আকনবিন্ধীর সোণপরুয়া’। উপন্যাসটির পটভূমি শিলঙের উত্তর পূর্ব বিশ্ববিদ্যালয়। উপন্যাসটিতে নেহুর প্টভুমিকায় সমগ্র উত্তরপূর্বের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চিত্র ফুটে উঠেছে ।


(খ)

ড:যুয়ানিতা য়ার সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠে এসেছে।বুকে এক গাদা বই। এত লাফিয়ে হাঁটছেন যে দুটো সিঁড়ি একসাথে টপকে পার হচ্ছেন। সামার হাউসের সকালেই ঝুমুর য়ারকে দেখলেন।বনশ্রীকে দেখালেন।কাল বিলম্ব না করে বনশ্রী সামার হাউসের ঘূর্ণ্যমান বেঞ্চের আড়ালে লুকিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসল।য়ার যদি কোনোভাবে বনশ্রীকে দেখতে পায় হুঁ হুঁ করে কথা বলতে বসবে।

কিছুদিন থেকে বনশ্রীর সঙ্গে কথা বলে মানুষটা খুব মজা পেয়েছে। শব্দের উৎসের খোঁজ করা,আকার-প্রকারের ভেদ করার শখ মানুষটার।শুধু সখ নয়,এক ধরনের অসুখ বলা যেতে পারে। নিজে তো ব্যস্ত থাকেই,বনশ্রীদের ও টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে বেড়ায় এই ধরনের কাজে।

চ’হরার পাশে দুটো খাসি গ্রামে সম্প্রসারণ শিক্ষার অধীনস্থ পরিকল্পনার কাজে ডঃ য়ার ব্যস্ত ছিলেন। সেখানে গিয়ে গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে এসেছেন।

গ্রামের মানুষেরা যে মুহূর্তে জানতে পেরেছেন ডঃ য়ার ইংরেজির বিখ্যাত অধ্যাপিকা,তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে খাসি ভাষায় কথা বলার সময় শব্দগুলির শেষে এস এইচ (Sh) জুড়ে দিলেন।খাসি শব্দের এংলিসাইজড (ইংরেজিকরণ) করার কায়দা দেখে ডঃ য়ার হাসবেন না কাঁদবেন ঠিক করতে পারলেন না । খাসি ভাষা শুদ্ধ ভাবে বলা মানুষের সংখ্যা ক্রমশ নাই হয়ে যাচ্ছে। কেউ শব্দের উচ্চারণের প্রতি নজর দেয় না। যারা ইংরেজি জানে না তাঁরাই খাসি ভাষার বিশুদ্ধ রূপটিকে বাঁচিয়ে রাখবে বলে মনে হয়। কিন্তু রোগ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। খাসি শব্দের শেষে সুযোগ পেলেই নাকি এস এইচ যোগ করে ভাষার মহিমা বাড়ায়। এই পরিণতি কোনো ভাষার হয়েছে কি?

সম্প্রসারণ শিক্ষার পরিকল্পনার কাজ শেষ করে একদিন সি আই ই এফ এল এর লাইব্রেরিতে বসে তাঁর ছাত্র ছাত্রীদের ডঃ য়ার এই অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। অবিবাহিতা চল্লিশোর্ধের এই মহিলা সাধারণ থেকে অতি সাধারণ কথাও সম্ভব হলে ছাত্রীদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চান।

অসমিয়া ভাষারও একই দশা।

বনশ্রী অসমিয়া শব্দের কীভাবে ইংরাজিকরণ হয় ডঃ য়ারকে তার দুটো উদাহরণ দিল।

অঢেল বোঝানোর জন্য ‘এভেলভেল’(ইংরেজি এভেইলেব্যল)গ্রামাঞ্চলে খুবই ঘরোয়া এবং বহু প্রচলিত শব্দ। সাইকেল শুধু গ্রামেই নয় শহরাঞ্চলেও পাম্পচার (ইংরেজি পাংচার) হয়। এমনকি ডঃ য়ার শুনে আসার মতো অসমিয়া শব্দকেও ইংরেজিগন্ধী করা হয়। ইংরেজিতে যদি সারপ্রাইজ সারপ্রাইজড হয় তাহলে অসমিয়া অবাক অবাকটেড হবে না কেন। ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেওয়ায় ডঃ য়ারের উৎসাহ বেড়ে গেল।

সেদিন থেকে ডঃ য়ার বনশ্রীকে দেখলেই অবাকটেড হন। ক্লাসরুমেও অসমিয়া ছাত্র ছাত্রী রয়েছে জানতে পারলে অবাকটেড হন। এভাবে যখন তখন অবাকটেড হয়ে উঠে তিনি ‘বনশ্রী এণ্ড কোম্পানি’কে অবাকটেড করার জন্য কৃত্রিম ক্রোধ প্রদর্শন করেন।

যুয়ানিতা য়ারকে দেখে আজ বনশ্রী মোটেই আগ্রহী হল না। য়ারকে ডাকলে দল পাকাবেই,তা করলে তাঁর কাজটাই হবে না। আজ সে ভি সির সঙ্গে সম্ভব হলে দেখা করার চেষ্টা করবে। ডঃ ঝুনঝাপ্পার

‘ক্ষুদ্র ভারতবর্ষে’তার ধৈর্যের বাঁধ গত রাতেই ছিঁড়ে গেছে।আর সম্ভব নয়।বিনা কারনে সে ‘পাঁচগুটি’ খেলার গুটি হয়ে থাকতে পারবে না।তার রুমমেট,সম্প্রতি রুমমেট তেজীমালা বলেছে-এখন ভি সি শেষ আশ্রয়। মানুষটার সঙ্গে দেখা করলে বনশ্রী নিশ্চয় সদুত্তর পাবে।অন্যায়কে মেনে নেওয়াও অন্যায়।

এক নম্বর চৌহদ থেকে য়ারিকের প্রশাসনীয় ভবনে যাওয়ার সংক্ষিপ্ত পথটা যেহেতু অনুমানের,তার সব সময় ভুল হয়।ক্যাবগুলির ভাড়া নিয়ে উল্টোপাল্টা বা সমতলের অটোচালকদের দাম্ভিকতা এবং ঠগবাজি নেই ঠিকই,কিন্তু মুখে এমন কি জিজ্ঞেস করলেও একটা শব্দ দিয়েও সাহায্য করে না।ভাবটা অনেকটা এরকম কোথায় যাবে বল এবং চুপ করে বসে থাক।যখন ঠিক পৌছে যাবে জানই তখন মিছামিছি কেন কথা বলতে যাব।

বনশ্রী একটা ক্লাস শেষ হতেই বিভাগ থেকে পালাল।সামার হাউসে কেউ যদি থেকে থাকে ভালোই হবে।

ঝুমুর দেবকেও একবার বলে দেখা যেতে পারে।

ঝুমুরকে বলার সঙ্গে সঙ্গে সে দ্বিতীয়বার ভেবে দেখল না।সে যাবে।এই সুযোগে দুটো ক্লাস থেকে রেহাই পাবে।ঝুমুরের নাকি পড়াশোনায় মোটেই মন নেই।কিন্তু পড়াশোনা না করে বাড়িতে কীভাবে বসে থাকবে?তাই পিজির ক্লাস ফাঁকি দিয়েছে নাকি?তার মধ্যে বাড়ি বসে থাকলে তাঁর ওজন বেড়ে যাবে।ওজন বাড়া মানেই পাত্র খুঁজে পেতে সমস্যা হবে।সারাটা রাস্তা ঝুমুর কেবল এসবই বলে গেল।বনশ্রী কেবল হুঁ হাঁ করার সুযোগ পেল।মেয়েটা এত কথা বলতে পারে!

-আমাদের দেশে স্ত্রীশিক্ষা আরম্ভ করা মানুষটার কথা কোন বইয়ে আছে,বনশ্রী।আমাকে এনে দিবি।বাদ দে,বইটা আবার পড়তে হবে তাহলে,নামটা জানলেই হবে।তুই আমাকে নামটা জানালেই হবে।

-নাম দিয়ে কী করবি?মালা গেঁথে জপ করবি?

-আমাকে কি পাগলা কুকুর কামড়েছে যে মালা জপ করব?মানুষটা তো নেই,নামটাকেই শাপ শাপান্ত করব।সেই একটা মানুষের জন্যই আজ আমার মতো মেয়ের এত দুর্দশা।ইচ্ছা না হলেও পড়াশোনা করতে হচ্ছে।

-তুই চুপ কর,ঝুমুর।তুই মহা ভণ্ড।পড়াশোনা করতে যদি একদমই ভালো না লাগে,সেমিস্টারের রেজাল্ট এত ভালো করলি কীভাবে?গ্রেজুয়েশনের রেজাল্টও এত ভালো তোর।

-আই সুইয়ার।গ্রেজুয়েশনের রেজাল্ট দেখে যদি কোনো ছেলে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসে সেই ভেবে পরীক্ষায় মনপ্রাণ সঁপে দিয়েছিলাম।যাঃকেউ এগিয়ে এল না।কী সুইসাইডাল কাজটা যে করলাম,দেখলি তো।রেজাল্ট দেখে কোনো ছেলেই এগিয়ে এল না,আমাকে আবার পিজি করতে হচ্ছে।

-রিজাল্টে্র জন্য তোর সমস্যাই হল, তাই না?পাগলি কোথাকার।আসল কথাটা বলি?তুই অনেক বাজে কথা বলতে পারিস।পিজি ও তুই এভাবেই নিরাসক্ত হয়ে টপ করবি।ভণ্ড কোথাকার।

-বনশ্রী তুই যে আমার বন্ধু তাতে আমার সন্দেহ আছে।তোর মতে তো আমি কেবল খারাপের ভাণ্ডার।দেখ,আজ ক্লাসে না গিয়ে কে তোর সঙ্গ দিচ্ছে? আমি নয় কি?সেইসব দেখছিস না।

এতক্ষণ অসমিয়া-বাঙালির খিচুরি পাকিয়ে ঝুমুর এবার ইংরেজির শরণাপন্ন হল।

-ব্ল্যাকমেলিং করছিস কিন্তু ঝুমুর।এদিকে বলছিস তোর নাকি ক্লাস করার ইচ্ছা নেই।আমি তোর উপকার করলাম না তুই আমাকে সাহায্য করলি কথাটা ভেবে দেখতে হচ্ছে।ঠিক আছে,আমাকে সঙ্গ দেবার জন্য আজ আমি তোকে যা ইচ্ছা করে তাই খাওয়াব।কোথায় খাবি বল?পুলিশ বাজার যাবি না লাইমুখরাতে খাবি।

-লাইমুতে খাবার কী দরকার।পুলিশ বাজারে যাব।পি বির রিগ্যালে গিয়ে খাব।

প্রশাসনীয় ভবনের বাইরে থেকে দুজনেই দেখল –বাগিচার পাশের সিঁড়িতে লাজুক কবি বিকেন শর্মাকে ঘিরে তাপসী,ডঃনাওমি বুয়ান থেকে শুরু করে ওয়াই ডব্লিউ সি এর ফুলটাইম সমাজকর্মী এবং পার্ট টাইম ছাত্রীরা কোলাহল করছে।ওদের দেখতে পেয়েই ঝুমুর আনন্দে ডগমগ হয়ে উঠল।সঙ্গে যে বনশ্রী রয়েছে সেকথা ভুলেই গেল।

-তোদের সবাইকে আজ খুব মিস করেছি।এই বনশ্রী একটা মহা বোর।রিগ্যালে খাওয়াতে নিয়ে যাবে লোভ দেখিয়ে সারাটা দিন আমাকে ছেঁচড়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।বনশ্রী মুখ খুলতে যাচ্ছিল।ডঃনাওমি এগিয়ে এসে কোমরে হাত রেখে ঝুমুরের দিকে তাকাল।যেন এই প্রথম দেখছে।

-তোর এত বড় শরীরটাকে ছেঁচড়ে নিয়ে বেড়াতে বনশ্রীর কম জোর লাগবে না। বা ড’ মন্তব্য করল।ঝুমুর তাকে মারার জন্য দৌড়ে গেল।বিকেন শর্মারা বনশ্রীকে ওদের সারিতে বসার জন্য আহ্বান জানাল।সে সবাইকে সম্ভাষণ জানাল।ওদের সঙ্গে দলে বসলে তার এখানে আসার আসল উদ্দেশ্য সফল হবে না।ঝুমুরকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়াও কঠিন হবে।তাকে এদের সঙ্গ ছাড়তেই হবে।বনশ্রী ওদের কাছ থেকে দূরে সরে যাবার সুযোগের অপেক্ষা করছিল।

-হাই ইউ।‘শাড়ি ক্লেড’আসামিজ বিউটি।তোকে আজ এত বিমর্ষ দেখাচ্ছে।কারণটা কি?-বা ড’ই কাটা কাটা জয়ন্তীয়া ইংরেজি উচ্চারণে বনশ্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

-বন্ধু!সকাল থেকে তোকে আজ দেখতেই পাইনি যে,সেইজন্যই মন খারাপ করে বসে আছি।

বনশ্রীর তাৎক্ষণিক উত্তর শুনে সবাই জোরে হেসে উঠল।হাসতে হাসতেই বা ড’ই বিষম খেল। বিকেন ব্যস্ত হয়ে পড়ল।দৌড়ে গিয়ে কঙের রান্না চালার নিচে থেকে জলের কেটলিটা তুলে আনল। জল খাবার পরে বা ড’র বিষম খাওয়া কমল। সুস্থির হয়ে সে পুনরায় বনশ্রীকে খ্যাপাতে লাগল।

-দেখলি তো? দেখতে দেখতে আমাকে তোর রুপের শহীদ ঘোষণা করতে হত।

বনশ্রী হাত দিয়ে নিজের গায়ে বাতাস করে জাপানি রূপসিদের মতো চোখ পিট পিট করে আত্মপ্রসাদ প্রকাশ করে দেখাল।

-বনশ্রী জান কি বিকেনের কবিতার বিষয়ে ম্যাগাজিনের সাহিত্য পৃষ্ঠায় আজ চর্চা হয়েছে। সেই উপলক্ষে বিকেন আজ ট্রিট দেবে।শ্বালোনি বলল।

-আমরা তোমাকে নিয়ে গৌরবান্বিত হে।রিফ্লেকক্টেড গ্লোরিতে গৌরবান্বিত।সবাই বনশ্রীর কথায় সায় দিল।

গবেষক শিক্ষক হলেও দুটি সেমিস্টারের ছাত্র ছাত্রীরাই বিকেনকে শিক্ষকের চেয়ে বন্ধু হিসেবেই বেশি দেখে।অনায়াসে বিকেন বলে নামধরে ডাকে।শুধু কি নাম ধরে ডাকা? শান্ত এবং সহজলভ্য বিকেনের গায়ে মাথায় বেয়ে বেড়ায় এই দুটি হাস্যোজ্জ্বল মেয়ে।এসব নিয়ে বিকেনের কোনো বিকার নেই।ছোট ছেলের মতো হাবভাব। সুন্দর কবি।

-একে নিয়ে আর কী গৌরব করব?একে একটা গন-কেস বলা যেতে পারে।দেখছ না মানুষটা কীভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে।যেন সমালোচনা করেনি,সমালোচক তাঁর ফাঁসির আদেশ দিয়েছে।কেউ একজন চিৎকার করে বলল।

-কী? কী? অপরাধ বিকেনের? সমালোচক কী বলেন?

-বিকেনের কবিতায় নাকি মাটির গন্ধ নেই?

-হায়!এই সামান্য কথাতেই এতটা কাবু হয়ে পড়েছে নাকি কবি?

-হোস্টেলে বিকেনের রুম একেবারে ওপরের তলায়,বন্ধুগণ!সেখানে বসে কবিতা লেখে।মাটির গন্ধ সেখানে না পৌছানোরই কথা।

সবাই মিলে মজা করে জোরে জোরে হেসে উঠলেও বিকেন শর্মা আগের মতোই গম্ভীর হয়ে বসে রইল। ঘোড়ার ফালের মতো কপালের ছোট চুলগুলি ঝাঁকিয়ে লাফিয়ে এসে তপতী তার গলায় বাদুড়ের মতো ঝুলে পড়ল।

-দেখ,বিকেন।ক্রিটিককে সুখ দেবার জন্য লিখতে চাস যদি আমি তোকে একটা বুদ্ধি দিই।এবার থেকে কবিতা লিখতে বসার সময় প্রথমে তুই কং রিম্বাইর উনুনের কাছের কিছুটা মাটি তোর কলমে লেপে নিবি। তাহলে দেখবি কবিতায় মাটি মাটি গন্ধ করছে।দরকার হলে তোর সমস্ত কলম আমরা পাইন গাছের গোড়া খুঁড়ে মাটি দিয়ে লেপে রাখব।মোটের ওপর সমালোচনা পড়ে তুই এভাবে মন খারাপ করে থাকিস না।

-তুই মন খারাপ করে থাকলে আমরা সবাই সন্ন্যাস নিতে যাব কিন্তু।

-আমিওতো একটি উপন্যাস লিখছি।আমার যেভাবে লিখতে ভালো লাগে সেভাবেই লিখছি।ক্রিটিক খারাপ পেলেই বা আমার কী করার আছে!আমি লিখে যে আনন্দ পেয়েছি সেটাই আমার কাছে বড় কথা।

-সত্যি শ্বালোনী?দেখেছ বন্ধুরা।আমাদের শ্বালোনী কত গভীর জলের মাছ।শ্বালোনী যে এমন একটা কাজ করতে পারে কেউ তার আভাসই কোনোদিন পায়নি। কতটা এগিয়েছিস শ্বালোনী?

বা ড’ই তার কৌ্তূহলের জেরে শ্বালোনীর কাছে চলে এল।ও মাধ্যাকর্ষণের শক্তিকে হার মানানোর মতোই দুরন্ত মেয়ে ।সে ও লেখালিখি করতে শুরু করল!অথচ শৈশবে বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে লিখতে শুরু করা জয়ন্তীয়া পাহাড়ের বা ড’সেখানেই থেমে গেল।সরল কৌ্তূহলে সে পুনরায় শ্বালোনীকে উপন্যাসের কথা জিজ্ঞেস করল।সে পরে থাকা জ্যাকেটের ভেতরে নিজের ডানহাতটা ভরিয়ে চ্যাপ্টা পেটটা থপথপিয়ে শোনাল।

-এখানে,এতটুকু পর্যন্ত এসেছে,ছাপা পর্যন্ত হয়েছে।

-যাঃএ দেখছি কোনো কথাতেই সিরিয়াস নয়।

-বা ড’!তোর যে একেবারেই বাস্তব বুদ্ধি নেই এটাই তার প্রমাণ করে।শ্বালোনী কি লেখার মানুষ! ও একটা রঙিণ প্রজাপতি।বিকেন শর্মার মতো কলম কামড়াতে যাবে কোন দুঃখে।ঝুমুর যথারীতি তার বকবকানি শুরু করে দিল।

ভি সির অফিসের বিশাল করিডরের বিস্তৃত কার্পেটের ওপরে পা রাখতেই বনশ্রী দেখল ওপাশ থেকে প্রশান্ত বরুয়া আসছে।প্রশান্ত তার দাদা অরুণের বন্ধু।শহরে এসেই তাকে প্রশান্ত বরুয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।প্রশান্ত যে ভি সি অফিসে রয়েছে,এতদিন তা সে ভুলেই গিয়েছিল।একজন আপনজনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বলে মনে হল তার।

প্রশান্ত তাকে আগ্রহ সহকারে পর্যবেক্ষণ করল।বনশ্রী তার তাকানোর ধরন দেখে হাসতে হাসতে করিডরের একপাশে দাঁড়াল।বনশ্রীর পরনে একটা লম্বা হাতার গলা বন্ধ সোয়েটার।লাল সোয়েটারটার ওপরে জরির কাজ করা রিহা ঘিরে রয়েছে। ঠাণ্ডায় জরিগুলি কুঁচকে গিয়ে তার শরীরে এঁটে আছে। ডান কাঁধে বাঁকা হয়ে পড়ে রয়েছে খুব সাধারণভাবে বাঁধা খোঁপাটা। পরিবেশটায়,আবহাওয়ায় এই সাজ পোশাক খুব ব্যতিক্রম বলেই বোধহয় বনশ্রীকে খুব সহজেই চোখে পড়ে।বিচিত্র বর্ণের রিহাটা সে এবার সচেতনভাবে টেনেটুনে নেয়।

-তোমাকে কিন্তু বেশ দেখাচ্ছে!

-নিন্দা না প্রশংসা?

-নিন্দা করে আমি মরব নাকি?অনেক আগেই এখানে এসেছ নাকি?আমার একজন সহকর্মী ওপর থেকে তোমার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল,’শারি ক্লেড’কোনো একজন এসেছে।নিশ্চয় অসমিয়া।তাই আমি হয়তো চিনতে পারি।তখনই দেখলাম –তুমি।

-‘শারি-ক্লেড’ই হলাম গিয়ে?এদেরকে যতই বোঝাই না কেন শারি এবং মেখেলা-চাদরের পার্থক্য বোঝে না,নয়কি?

-কিছু একটা বোঝে। নাহলে এখানে এতগুলি শারি ক্লেড থাকলেও ওদেরকে শারি-ক্লেড বলে না কেন,ভেবে দেখ,চাদর পরে যারা তাদেরকেই বলে।

-কিন্তু ক্লাস যখন পূর্ণোদ্যমে চলছে তখন আমি কেন ভি সি অফিসে এসেছি কেউ সেকথা জিজ্ঞেস করবে কি?

-ভক্তের মতো সম্বোধন করতে থাকলে আমরা জিজ্ঞেস করব না।আমি কেবল ভাবছি তুমি আমাকে আপনিও বলছ না তুমিও বলছ না।আমি দাদার বন্ধু,এত জড়তা কিসের?

-এসব ক্ষেত্রে ইংরেজিই ভালো।একটাই মাত্র ‘ইউ’।আমাদেরই অসংখ্য মাছের ভিড়ে বক কানা হওয়ার অবস্থা।

-ইংরেজির গুণ গান করতেই থাকবে না,এই সৌজন্যের সম্বোধনের ইতি ঘটিয়ে মীমাংসায় আসবে?

-ঠিক আছে প্রশান্তদা।তুমিই বলব।

-সুন্দর।এখন বল শ্রী,এখানে কেন এসেছ ?

-পাখনায় ধরে কেন ডাকছ।আমি কি মাছ নাকি?

-আরে বোকা,নামটা যতই সংক্ষিপ্ত হবে,কাছাকাছি যাবার পথটা ততই সংক্ষিপ্ত হবে।

-কাছে আসার কী দরকার?পর্বত দূর থেকেই সুন্দর দেখায়।

-সেই অজুহাতে পর্বতকে কাছে থেকে না দেখেই থেকে যাবে?

-আমি দেখতে চাইনি,সেটাই আসল কথা।

-কোনো কোনো পর্বত খুব সুন্দর। কাছ থেকেও।

-ও।কোনো কোনো পর্বতের তাঁর মানে অসীম আত্মবিশ্বাস।

-সত্য এবং সুন্দর এরকমই।প্রত্যয়ে ভরপুর।

- শিলং কিন্ত সী লং ।দূর থেকে দেখতেই সুন্দর।

-সেটা একটি বিশেষ নাম।সরলীকরণ এবং সাধারণীকরণ,এটিও ষোলো আনা শুদ্ধ প্রক্রিয়া নয়।কিন্তু শিলঙের ‘সী লং’ব্যখ্যা শুনলে ওরা কিন্তু তোমাকে এখান থেকে তাড়াবে।

প্রশান্তের সঙ্গে দেখা হওয়ায় বনশ্রীর কাজ অনেকটা সহজ হয়ে এল।যা করার সেই করবে।বনশ্রী নিশ্চিন্ত মনে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল।ঝুমুররা এতক্ষণ পর্যন্ত কঙের রান্নাঘরের চারপাশ ঘিরে আড্ডা মারছে।বনশ্রীকে দেখেই ঝুমুর পুলিশ বাজারের রীগ্যালে খাওয়ার পরিকল্পনাটা বাতিল বলে ঘোষণা করে দিল।তার পরিবর্তে ওরা কঙের দোকানের শুয়োরের মাংস ভাজা আর ভাত খাবে।রীগ্যালের কফির পরিবর্তে কঙের হাতের টলটলে চা খাবে।সবাইকে খাওয়াতে হবে।তাই বিলটা ঝুমুরের রীগ্যালে একা খাবার বিলের সমানই হবে।

বনশ্রী খুশিমনে ওদের সঙ্গে গিয়ে বসল।কোয়ার্টার প্লেট একটিতে দুই মুঠো সাদা ভাতের ওপরে এক হাতা মাংসভাজা এবং ঝোল দিয়ে থালাগুলি হাতে হাতে এগিয়ে দিল কঙ।বেশ তৃপ্তির সঙ্গে তাঁরা সবাই দুপুরের খাওয়া শেষ করল।বিল দেবার সময় বনশ্রীর কাছে বিকেন শর্মার সঙ্গে স্যামন ডাউলাগাপু এগিয়ে এলেন।বিকেন কে সে নিষেধ করল,কিন্তু ডাউলাগাপু নাছোরবান্দা। তিনি দেবেনই।এই ছোট্ট মেয়েটির হাত খরচের টাকা থেকে খেয়ে নিলে তার নাকি হজমই হবে না।

-আমি কিন্তু মোটেই ছোট নই।বনশ্রী ডাইলাগাপুর পাশে দাঁড়িয়ে উচ্চতা দেখিয়ে বলল।

-এক পুঁটলি ‘কুয়াই’ (পান) নিলাম,বনশ্রী।তুই যদি বড়ই হয়ে থাকিস তাহলে আমার কুয়াইয়ের দামটাও কঙকে দিয়ে যাবি।বা ড’ই ইতিমধ্যে একটা পান তামোল মুখে ভরিয়ে বনশ্রীকে বলল।

-তুই তো একটা বুড়ো শকুন।তোর মানুষটার কথা ভেবে আমার কষ্ট হয়।তোর মতো শকুনের সঙ্গে বেচারা এতদিন ধরে কীভাবে যে ঘর করছে,তা তুইই জানিস।

বনশ্রীর গালির উত্তরে বা ড’ই শুধু কোঁ কোঁ শব্দ করে হাসল।

নাওমি বুয়ান বনশ্রীর দিকে এগিয়ে এল।গায়ে অর্ধেক ভুটিয়া আর অর্ধেক সিমলার সাজ। রিস্ট ব্যাণ্ড বাঁধা হাতটা দিয়ে সে বনশ্রীকে এক পাশে টেনে নিল।শীর্ণ হাতে আর কী টানবে,বনশ্রী ইঙ্গিতেই বুঝতে পারল নাওমি তাকে একা কিছু বলতে চায়। পেন্সিল হিলজোড়ার ওপরে নাওমি বুয়ানকে আজ আরও কাঠির মতো রোগা লাগছে।মুখটা কাগজের মতো নিস্তেজ সাদা।বনশ্রী অবাক হল।সামনে না আছে পরীক্ষা,না আছে এসাইনমেন্টের ঝামেলা। নাওমি সাধারণত এইসব কারণেই বনশ্রীর কাছে আসে...


চলবে ...


অনুবাদক পরিচিতি -১৯৫৮ সনে অসমের নগাঁও জেলার যমুনামুখে বাসুদেব দাসের জন্ম হয়।শৈশব কেটেছে গুয়াহাটি শহরে। ১৯৮২ সনে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও ভাষা তত্ত্বে এম এ করেন। আজ পর্যন্ত অসমিয়া অনূদিত গল্পের সংখ্যা চারশো পঞ্চাশটির ও বেশি।NEINAD এর পক্ষ থেকে অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য Distinguished Life Membership এর দ্বারা সম্মানিত করা হয়।মোট প্রকাশিত বই আঠারোটি।