শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

তিমির তীর্থ ভাগ-৫

অতীতের কথাগুলো আজ নতুন করে প্রহ্লাদের মনে পড়ছে।একই মা-বাবার দুটো সন্তান—অথচ তাদের আদর্শ ও অভীপ্সা ছিল কত আলাদা।প্রদ্যুৎ চাইছিল শুধু ধন,মান,ক্ষমতা,বিলাস সম্ভোগ।যেমনটি চায় লোকে তেমনটি সব কি আর পায়? প্রদ্যুৎ কিন্তু পেয়েছে। সে পুলিশের বড় সাহেব।বিরাট তার ঘর।উপচে পড়া বিলাস সামগ্রী।সুন্দরী পত্নী।কী নেই তার!আঙুলের মৃদুতম সংকেতে দশ-বারোটা সেপাই গৃহ ভৃত্যের মতো তার সেবা করবার জন্য তৈরি।প্রহ্লাদ সেসব কিছুই চায় নি।সে শুধু চাইছিল জীবনের কোনও এক মহৎ আদর্শের সাধনায় পুরো জীবন উৎসর্গ করতে।আর যেহেতু ত্যাগ ছাড়া কেউই আদর্শের সাধনা করতে পারে না সে জন্য সম্ভবপর সমস্ত ত্যাগ করতেও সে তৈরি ছিল।ত্যাগ নিশ্চয়ই সে করেছে।নিজের প্রতিভাকে কেবল বৈষয়িক স্বার্থের জন্যে কোনোদিন সে প্রয়োগ করেনি।নিজে বেছে নেওয়া পথে সে তাকে সমাজের কাজেই লাগিয়েছে। পৈত্রিক সম্পত্তির উপর সে সারাজীবন বসে খেতে পারত,কিন্তু সেটুকুও ত্যাগ করে সে দারিদ্র্যে আর দুঃখ বরণ করে নিয়েছে। কিন্তু সারা যৌবন আদর্শের সাধনাতে অতিবাহিত করে আর তার কী উপলব্ধি হচ্ছে?আর তার মনে কেন ক্লান্তি এসেছে? কেন আজ সে জগন্নাথ চৌধুরীর ফাঁদে নিজেই ধরা দিতে যাচ্ছে?

প্রদ্যুৎ জীবনে যা চেয়েছিল তাই পেয়েছে।সে সম্পূর্ণ!পরিতৃপ্ত।কিন্তু প্রহ্লাদ জীবনে যা চাইছিল,তাই পেয়েছে কি? আদর্শের সাধনা তাকে অবিমিশ্র আনন্দ দিতে পারল কি? কখনও কোনও মুহূর্তে সে অন্য এক জীবনের প্রতি প্রলুব্ধ হয় নি?

নিজেকে পরীক্ষা করে দেখার এক বড় সুযোগ প্রহ্লাদের হয়েছিল। প্রদ্যুৎ তখন যোরহাটের পুলিশ সুপার।প্রায় পাঁচ বছর দু-জনের মধ্যে দেখাদেখি দূরের কথা পত্রালাপ পর্যন্ত ছিল না।হঠাৎই একদিন প্রহ্লাদ প্রদ্যুতেরথেকে একটা চিঠি পেল, “তোদের অনেকদিন দেখিনি।একবার দেখতে মন যাচ্ছে।আগামী জানুয়ারির ২১শে বাবার বাৎসরিক শ্রাদ্ধের দিন।তোরা সবাই আমাদের ঘরে কদিন থাকবি বলে আসবি। শ্রাদ্ধটা এক সাথে করব।”

প্রহ্লাদ কখনও মা-বাবার শ্রাদ্ধ করে না।কারণ সেসব সংস্কারে তার বিশ্বাস নেই।কিন্তু প্রদ্যুতকে দেখার খুব ইচ্ছে তার হল।হাজার হোক সহোদর ভাই।ললিতাও কোনও আপত্তি করেনি।সে বলল,“আর কিছু না হলেও দুদিনের জন্যে তুমি বিশ্রাম পাবে।দুবেলা দুটো খাবার জোটাতে যে অমানুষিক পরিশ্রম করছ,কোনোদিন না অসুখ করে বিছানায় পড় সেই চিন্তায় আমার ঘুম গেছে।”

প্রদ্যুতের ঘরে গিয়ে বিলাস সম্ভোগের আতিশয্যে তাদের দিশেহারা হবার উপক্রম হল।প্রদ্যুৎ ভোগী মানুষ।বিচিত্র সুখাদ্য তার জন্যে জীবনের আনন্দের এক প্রধান উৎস।দাসদাসী ঘেরা নবাবের মতো তার আরাম পুষ্ট জীবন।এমনি যেপায়ের জুতা দুটোও তার নিজেকে খুলতে হয় না।পুরো ঘরটাতে এক ক্লান্তিহর মধুর নীরবতা।ঘরে ঘরে দামী কোমল কার্পেট পায়ে হাঁটার মৃদুতম শব্দটাকেও শোষণ করে নেয়।সন্ধ্যাবেলা স্কচ-হুইস্কির গ্লাস হাতে নিয়ে প্রদ্যুৎ আরাম করতে বসে। রেডিওগ্রামে তখন বাজতে থাকে মোজার্টের সিম্ফনি বা রবীন্দ্রসঙ্গীত।প্রদ্যুতের স্ত্রীর দামী শাড়িতে আবৃত সুন্দর সোনালি শরীর প্রতি মুহূর্তে বিচ্ছুরণ করে মদির সুরভি।সৌন্দর্যের দীপ।ইন্দ্রিয় সঞ্জাত উত্তেজনার অতীন্দ্রিয় উত্তাপ—“Beautiful idle woman blossoming before him like flower of flesh.”

এক সপ্তাহ প্রদ্যুতের ঘরে থেকে প্রহ্লাদরা আবার নিজের দারিদ্র্যের মাঝে ঘুরে এল।

ঘরে যেদিন এল সেই সন্ধ্যায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে প্রহ্লাদ কিছু একটা ভাবনায় তন্ময় হয়ে আছে দেখে ললিতা জিজ্ঞেস করল,“এত অন্যমনস্ক হয়ে কী ভাবছ?দুবার ডাকলাম,কানেই গেল না যে? দাদাদের বাসাতে এক সপ্তা ভোগ বিলাসের মধ্যে কাটিয়ে এসে এখন নিশ্চয়ই তুমি অনুতাপ করছ?ভাবছ যে তোমার জীবনটা বৃথাই গেল? ইচ্ছে করলে তুমিও তো এমন এক সুখী বিলাসী জীবন পেতে পারতে। হ্যাঁ কি না?”

“সে প্রশ্নটা আমি তোমাকেই করব বলে ঘরে ফিরে আসা অব্দি অপেক্ষা করছিলাম।” প্রহ্লাদ সস্নেহ দৃষ্টিতে ললিতার মুখে তাকিয়ে বলল,“দাদাদের বাসায় থাকার সময় বৌদি আমার মুখের সামনেই বলে ফেলেছিল,‘প্রহ্লাদ তুমি ললিতার অবস্থাটা কী করেছো দেখেছ?এ যুবতি বয়সে ওর যে হাড় মাস ক’টা গুনা যাচ্ছে।তার উপর যে কাপড় পরে আমাদের ঘরে এসেছে, সে তো আমাদের ঘরে কাজ করা বিহারি মেয়ে লোকটাও পরে না।”ললিতা আমি দেখছি শুধু শুধুই এক আদর্শের নামে এই দারিদ্র্য বরণ করে নিয়েছি।অহংকারের বেদীতে নিজের জীবনটা উৎসর্গ করেছি।কিন্তু তুমি নিজে কী পেলে?তোমার দিদিদের মতো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারকে বিয়ে করলে না বলে আজ তোমার অনুতাপ হয় না?”

“হয় না।” ললিতা প্রহ্লাদের বিছানায় বসে তার চুলে আঙুল বুলিয়ে বললে,“কারণ দিদিরা ভালো খেতে পাচ্ছেন, ভালো পরতে পারছেন,মটর গাড়ি দৌড়চ্ছেন,ছেলেমেয়েকে দুন পাবলিক স্কুলে পড়াচ্ছেন।কিন্তু আমি যে জিনিস পেয়েছি,যা পেলে অন্য সব কিছুই তুচ্ছ হয়ে যায়,যা না পেলে অন্য সব পাওয়া অসার---সেটি তারা পান নি।”

“বাহ! বাহ! আকাশবাণী গুয়াহাটি কেন্দ্রের নাটকে যেন অভিনয় করছ।” প্রহ্লাদ ললিতাকে বুকের মধ্যে টেনে নিল, “আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে মৈত্রেয়ীর মতো বললে না কেন,‘যেনাহাং নামৃতস্যাম,কিমহং তেন কুর্য্যাম?’” সে দেব দুর্লভ বস্তুটি কী জানতে পারি কি?”

ললিতা প্রহ্লাদের বুকে মুখ লুকিয়ে বলল,“ নিশ্চয় পারো।সে বস্তুটা হল তোমার প্রেম। বিয়ের পনেরো বছর পরেও দিদিদের তাদের স্বামীরা দিনে দশবার এমন করে বুকে টেনে নেয় না। সব মানুষই দিনে দিনে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়;প্রতি মুহূর্তে তিলে তিলে তাদের মৃত্যু হয়।যৌবনের আবেগ,আদর্শপরায়ণতার অহংকার—এ সবই একদিন পরিণত হয় অতীতের ফেলে দেওয়া আবর্জনায়।কিন্তু তুমি আমাকে অবাক করে দিয়েছ।প্রতি ভোরেই তুমি নতুন করে জন্ম নাও।বেশিরভাগ লোকেরই জীবনে একবার মাত্র বসন্তকাল আসে।তারা জীবনে Renewal, Refreshment, Rebirth কী বস্তু দ্বিতীয়বার চিনতেই পারে না।কিন্তু তোমার আছে প্রতিদিনই নিজেকে নতুন করে সৃষ্টি করতে পারবার দুর্লভ ক্ষমতা।এইই হল অমৃত।আর যে মানুষ অমৃতের স্বাদ পেয়েছে একবার তার আর কোনও কিছুর প্রতি লোভ থাকে না।

প্রহ্লাদের ঠোঁটের হাসি হঠাৎ মিলিয়ে গেল।ললিতার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে সে গম্ভীর স্বরে বলল,“ললিতা তুমি বোধহয় নিজেকে মোহাবিষ্ট করছ,প্রতারণা করছ।আজ আমার কি মনে হচ্ছে জানো?যে আদর্শে আমি নিজেকে জীবনের সব সুখ –স্বাচ্ছন্দ্যের থেকে বঞ্চিত করেছি,আর তোমার মাথাতেও দারিদ্র্যের দুর্বহ বোঝা তুলে দিয়েছি,সে আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করবার জন্য বাস্তবে আমি কিছুই করি নি।জীবনটা শুরু করেছিলাম মার্ক্সবাদী বিপ্লবী হয়ে।কিন্তু আমার সে বিপ্লবের স্বপ্ন আজ কোথায় গেল? দু-পা এগোতে না এগোতে আমার ক্লান্তি এল।আর আজ যে সংগ্রাম করছি সে শুধু আমার নিজের বেঁচে থাকার সংগ্রাম। যে সংগ্রাম মোটে বা রিকশাওয়ালা একজনও করছে।”

“মিথ্যে বলে অহেতুক নিজেকে শাস্তি কেন দাও?” ললিতা মাঝে ঢুকে বলল,“পৃথিবীর আর কেউ না জানলেও আমি তো অন্তত জানি যে তুমি অন্তত প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ একটা হলেও জ্বালিয়ে রেখেছ।অন্যায়ের সাথে আপোস করতে অস্বীকার করে ন্যায়ের আদর্শের পুজো করছ।আর কিছু না হলেও অন্তত একটা স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রেখেছ।পৃথিবীতে এইটুকুনই বা কজনে করে?হতে পারে বর্ষার ভরা নদীর তুলনায় তুমি বৃষ্টির জলবিন্দু মাত্র।কিন্তু প্রকৃতির বিচারে সে জলবিন্দুও মূল্যহীন নয়।মানুষ কাঠের মূল্য দেয়,ফুলের মূল্য দেয়,ফলের মূল্য দেয়---কিন্তু গাছের পাতা মানুষের চোখে সম্পূর্ণ মূল্যহীন।অথচ হাজারো বছর ধরে এই গাছের পাতাও নিজে পচে মাটিকে উর্বর করে।নতুন জীবনের জন্য জমি তৈরি করে।ইতিহাস তো আর কজন বীরের সৃষ্টি নয়,যদিও তাদের নামই ওখানে লেখা মেলে।নীরবে সবার নজরের অলক্ষে পচা গাছের পাতার মতো কোটি কোটি অনামা নগণ্য মানুষ যদি নিজের নীরব আত্মদান আর সহজ কাজ দিয়ে পৃথিবী উর্বর করে না রাখত, তবে সে কবেই মরুভূমিতে পরিণত হত।জীবনে মানুষের কখনও পুরস্কার,প্রতিদান আর স্বীকৃতির আশাতে কাজ করা উচিত নয়।

ললিতাকে বুকের মাঝে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ প্রহ্লাদ নীরব আর নিশ্চল হয়ে পরে রইল।আবেগের আবেশ নেমে যাবার পর বলল,“তোমার তো খুব অহংকার জীবনে কখনও মিথ্যে বল নি।কিন্তু আজ বললে।আমি নিজেকে কখনও প্রতিদিন সৃষ্টি করিনি। সেটি করে আসছ তুমি। ওয়ার্ডসওয়ার্থ নিশ্চয় তোমার কথা ভেবেই লিখেছিলেন :

A perfect woman nobly planned

To warn, to comfort and command;

And yet a spirit still and bright

With something of angelic light.

বাংলার কবি বুদ্ধদেব বসুও লিখেছেন,‘দিলে তুমি দিতে পারো ঈশ্বরেরও বেশি।’একজন ভালো মহিলা যে এক একটা মানুষের জীবনে কী মিরাকল ঘটাতে পারে,সে কথা আমার মতো এক ভাগ্যবানের বাইরে আর কে বুঝবে?তবুও ললিতা, মাঝে মাঝে আমার মনে প্রচণ্ড অপরাধ বোধ হয়।তুমি আমার তথাকথিত আদর্শের নামে মার্টিয়ারডম বরণ করে নিয়েছ।কিন্তু আমি ভাবি,আমি আসলে চেকভের ‘Uncle Vaniya’ নাটকের সেই লেখক নয় তো?সেই লেখক গোটা জীবন ধরে একটা বই লেখার নামে স্ত্রীর মাথায় দুর্বহ দারিদ্র্য আর দুঃখকষ্টের জীবন তুলে দিয়েছিল।স্ত্রীও ভাবছিল যে প্রতিভাবান স্বামীর সাধনাকে সফল করে তুলবার জন্য এটুকু ত্যাগ স্বীকার তার পবিত্র কর্তব্য। কিন্তু শেষে দেখা গেল মানুষটার অণুমাত্র প্রতিভা ছিল না।পুরো জীবন জুড়ে সে সৃষ্টি করল মাত্র কিছু আবর্জনা।অথচ তার জন্যই এক মহিলার গোটা জীবন নষ্ট হয়ে গেল।তুমি কেমন করে বলতে পারো যে আমিও ঠিক তাই করছি না?”

ললিতা স্বামীর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে বিছানায় বসে বলল,“আমি সবসময়েই বলে আসছি না যে তুমি একটা মেসোকিস্ট। আবোলতাবোল বকা এখন বাদ দাও।আমার রাঁধতে যাবার সময় হল।দাঁড়াও তোমার প্রথম প্রশ্নটা ছিল, “আমরা দাদাদের ঘর থেকে কী শিক্ষা নিয়ে এলাম? তুমি কি বলছ এ নিয়ে?”

প্রহ্লাদ নাটকীয় ভাবে বলল,“দাদার সফলতার চে’ আমি আমার ব্যর্থতাকে বারবার বরণ করে নেব।স্থূল ভোগ আর ঐশ্বর্যের সেই কারাগারে মানুষের স্বপ্ন আর স্বর্গীয় অতৃপ্তির তিলে তিলে মৃত্যু ঘটে।সে ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যায়।আমি মুক্ত পথিকের মৃত্যু বরণ করতে চাই।কারাগারের কয়েদীর মৃত্যু নয়।”

(ক্রমশ...)