শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

​বাংলা গানের সেকাল একাল : পর্ব ২০ (শেষ পর্ব)

শিকড়ের গান : লোকগান

এই দীর্ঘ ধারাবাহিকের প্রথম পর্বে ‘গান তুমি কোথা হইতে আসিয়াছো’ পর্যায়ে বলেছিলাম প্রকৃতির সৃষ্টির মধ্য থেকে, নদীর তরঙ্গ থেকে, ঝড়ের গর্জন থেকে, পাখির কলতান থেকে, মানুষ তার নিজের সুর সৃষ্টি করেছে । শিক্ষিত সমাজ লিখিত সাহিত্য সাধনার মধ্য দিয়ে তার সাহিত্যের রূপ-বৈচিত্রের প্রকাশ ঘটিয়েছে একথা যেমন সত্য, তেমনই নিরক্ষর গ্রামীণ সমাজের মৌখিক সাহিত্য উৎসারিত হয়েছে লোকসঙ্গীত ধারার মধ্য দিয়ে যুগে যুগে । আধুনিক যুগের শিক্ষিত সমাজের পরিশীলিত গীতিকাব্যের বীজ সেই মৌখিক সাহিত্য-সঙ্গীত ধারার মধ্যেই রয়েছে । মানব-জীবনের, পল্লী-মানুষের যাপনের সব বৃত্তান্তই রয়েছে আমাদের লোকসঙ্গীতে । জগৎ সম্পর্কে তাদের ভাবনা, তাদের লোকাচার, আধ্যাত্ম ভাবনা, তাদের বিশ্বাস, সংস্কার এবং জীবনযুদ্ধ আর তার চলার ছন্দ, সব কিছুরই আশ্রয় তার গানে – আমাদের লোকসঙ্গীতে । জীবনের এমন কোন পর্যায় নেই যা আমাদের লোকসঙ্গীতে ধরা পড়েনি । লোকসঙ্গীতের অনন্য বৈশিষ্ট্য এই যে কোন দেশে কোন কালেই লোকসঙ্গীত অনুশীলনের কোন বিধিবদ্ধ প্রণালি নেই । প্রবহমানতার মধ্যেই থাক লোকসঙ্গীতের প্রাণশক্তি ।

বাংলার লোকসঙ্গীত ধারাটি বৈচিত্রময় । কিছু একক কন্ঠে গীত আবার কিছু গান সমবেত কন্ঠে গীত হয় । বাউল, ভাটিয়ালি, দেহতত্বের গান, মুর্শিদি একক কন্ঠের গান আবার গম্ভীরা, আলকাপ, কবিগান ভাদু, টুসু, সারিগান যুথবদ্ধভাবে গীত হয় । তেমনই কিছু গান আঞ্চলিক ও কিছু গান সর্বাঞ্চলীয় । লোকগানের নানান ধারা উপধারার অনেক আঞ্চলিক গান লুপ্ত হয়ে গেছে বা লুপ্ত হবার পথে, লোকসঙ্গীত গবেষকরা সেইসব গান উদ্ধার করছেন । সেই সমস্ত বৃত্তান্ত বলার সুযোগ এই প্রবন্ধে নেই ।

আধুনিক যুগে গানের পণ্যমূল্য বিচার করে বিনোদনের উপাচার হয়ে ওঠার পরে লোকসঙ্গীতের সুরের ঐশ্বর্য আত্মস্থ করে নিয়েছে এযুগের পরিশীলিত গায়ন শিল্পীরা । এমনই বহু পরিচিত কিছু লোক-সঙ্গীত ধারার গানের পরিচিতি দেওয়া যেতে পারে, যেমন ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাউল, ঝুমুর, গম্ভীরা, আলকাপ, ভাদু, সারি গান, টুসুগান । গ্রামফোন রেকর্ড ও ক্যাসেট ব্যবস্থা চালু হবার পর, ব্যবসায়িক ভাবে এই সব লোকধারার গান মানুষের ঘরে ঘরে পৌছেছে । বেতার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর লোকধারার গানের প্রসার শুরু হয় । রেডিওতে তখন বলা হত ‘পল্লীগীতি’ । গ্রামফোন রেকর্ড ও বেতার ব্যবস্থা চালু হবার পর নিভৃত পল্লীর সঙ্গীত সম্পদ শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালির সঙ্গীত রুচিতে স্থায়ী যায়গা করে নেয়, বহু শিল্পী লোকধারার গানে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন । নবীন প্রজন্মের শিল্পীরাও নানা ধারার লোকসঙ্গীত পরিবেশন করে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছেন । তাদের সকলের নাম উল্লেখ করার সুযোগ এ প্রবন্ধে নেই । কিন্তু যাদের গান শুনে নানান ধারার লোকসঙ্গীত সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ তৈরি হয়েছে, আমাদের লোকসঙ্গীত ধারণা সমৃদ্ধ হয়েছে এমন তিন অনন্য শিল্পীর নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন, তাঁর হলেন গত শতকের তিরিশ ও চল্লিশ দশকের কিংবদন্তী ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমেদ (১৯০১-১৯৫৮), পঞ্চাশ ও ষাট দশকে বাংলা গানের স্বর্ণ সময়ের শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরী(১৯২২-১৯৮১) ও লোকসঙ্গীত গবেষক ও গায়ক অকালপ্রয়াত কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য (১৯৭১-২০১৬) ।

আব্বাসউদ্দীনের কোন প্রথাগত সঙ্গীতশিক্ষা ছিল না, কারো কাছে তালিমও নেননি । বাল্যকাল থেকেই কোচবিহারের মাঠেঘাটে, রাখালদের সঙ্গে, মাঝিমাল্লাদের সঙ্গে আর নানা আসরে লোকজীবনের গান গাইতেন । প্রাণের আনন্দে যারা গানের সঙ্গে থাকেন তাঁদের কোন তালিমের দরকার হয় না । আব্বাসউদ্দীনের কন্ঠস্বর ও সুরে ছিল যেন ঐশ্বরিক ঝিলিক । প্রথাগত তালিম না থাকলেও লোকজীবনের গানের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা ও একাগ্রতা আব্বাসউদ্দিনকে পল্লী সঙ্গীত গায়নে কিংবদন্তীর মান্যতা দিয়েছে । বস্তুত শহুরে স্রোতাদের পল্লীর গানের বৈচিত্র্য ও বৈভবের সঙ্গে শহুরে স্রোতাদের প্রথম পরিচিতি ঘটালেন আব্বাসউদ্দীন আহমেদই । তাঁর ‘আল্লা মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তুই’ , ‘নাও ছাড়িয়া দে পাল উড়াইয়া দে’ র মত অনেক কালজয়ী গান এখনও গীত হয় এ যুগের শিল্পীদের কন্ঠে ।

পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় বাংলা গানের স্বর্ণ সময়ে এসেছিলেন উদাত্ত কন্ঠের নির্মলেন্দু চৌধুরী । শুধু গ্রামফোন রেকর্ডের গান দিয়ে লোকসঙ্গীতের কিংবদন্তী শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরীকে কিছুই জানা হয় না । গ্রামফোন রেকর্ডে কটা গানই বা গেয়েছেন তিনি, খুব বেশি হলে একশো ! ১০৫৬ তে প্রথম গানের রেকর্ড করেন এইচএমভি থেকে । রেকর্ডের গানে নয়, নির্মলেন্দুকে জানতে হবে তাঁর জন্মভূমি সিলেটের গণ আন্দোলনে গান, গণসঙ্গীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানের দলের মধ্যমণি হয়ে গাওয়া গান, বিশ্বের নানা শহরে ভারতের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি হয়ে গাওয়া তাঁর উদাত্ত কন্ঠের গানে, কলকাতার থিয়েটারে ও সিনেমায়, জলসায় গাওয়া তাঁর গানের মধ্য দিয়ে । চল্লিশের দশকে গণনাট্য আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান পরিবেশন করে সিলেটের গণনাট্য আন্দোলনের মধ্যমণি হয়ে উঠেছিলেন নির্মলেন্দু । ১৯৪৮এ কম্যুনিষ্ট পার্টি বে আইনী ঘোষিত হওয়ার পর পঞ্চাশ দশকের গোড়ায় চলে আসেন কলকাতায়। বিভিন্ন আসরে লোকসঙ্গীত পরিবেশনের জন্য ডাক পড়তে থাকে নির্মলেন্দুর । ১৯৫৫তে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলেনে সিলেটের লোকসঙ্গীত পরিবেশন করে কলকাতার সঙ্গীতপ্রেমিদের নজর কাড়েন নির্মলেন্দু । তার আগে ১৯৫৩তে ভারতের সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হয়ে ইউরোপের কয়েকটি দেশে লোকসঙ্গীত পরিবেশন করেন । ১৯৫৫তে সোভিয়েত রাশিয়ার বিশ্বখ্যাত বলশয় থিয়েটারে লোকসঙ্গীত পরিবেশন করে স্বররণপদক লাভ করেছিলেন । পোল্যান্দে আয়োজত আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক অর্জন করে এশিয়ার শ্রেষ্ঠ লোকসঙ্গীত শিল্পী নির্বাচত হয়েছিলেন নির্মলেন্দু । ইউরোপের প্রায় সব শহর ছাড়াও জাপান, চিন, নিজিল্যান্ড ও আমেরিকার বিভিন্ন শহরে গান গেয়েছেন । বাংলার মাটির গানকে বিশ্বলোকে ছড়িয়ে দিতে স্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন নির্মলেন্দু । নির্মলেন্দু সহজ সরল লোক সঙ্গীতের গায়নে একটা নিজস্ব শৈলী জিড়ে দিতেন, অনেক গানে সংযোজন করতেন ভিন্নধর্মী সুরের মিশ্রণ । মাটির গানের প্রতি তাঁর দরদ ও নিজের আবেগ অনুভুতিকে গানের সঙ্গে যুক্ত করে এক অত্যাশ্চর্য গায়কীর নির্মাণ করেছিলেন নির্মলেন্দু আর এখানেই ছিল তাঁর সাফল্যের সূত্র । মনে পড়ে কোন জলসায় তিনি যখন ধরতেন তাঁর প্রিয় ভাটিয়ালি সুরের গান ‘আমায় ডুবাইলি রে, আমায় ভাসাইলি রে, অকুল দরিয়ায় বুঝি কুল নাই রে’ তখন তাঁর কন্ঠস্বর কোন মাত্রায় পৌছাতো তা সঙ্গীতবেত্তারাও ঠাওর করতে পারতেন না । তিনি উৎপল দত্তর সঙ্গে অঙ্গার, ফেরারি ফৌজ ও তিতাস একটি নদীর নাম নাটকে অভিনয় করেছেম । ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নাটকের সঙ্গীত পরিচালনাও ছিল নির্মলেন্দু চৌধুরীর । এছাড়া গোটা তিনেক ছায়াছবিতেও অভিনয় করেছেন । মাত্র ৫৯ বছরের আয়ুকাল ছিল তাঁর । ১৯৮১এ ১৮ই এপ্রিল গানের জগত থেকে বিদায় নেন লোকসঙ্গীতের কিংবদন্তী নির্মলেন্দু চৌধুরী ।

গত শতকের নব্বইএর দশকে আধুনিক বাংলা গানের ক্ষেত্রে এক শূন্যতা নেমে আসে, প্রকট হয়ে পড়ে আধুনিক বাংলা গানের কতজা ও সুরের বৈচিত্রহীনতা । এই সময় থেকে গানপ্রিয় বাঙ্গালির লোকগানের কাছে আসার ঝোঁক দেখা দেয় নবীন প্রজন্মের অনেকেই আকৃষ্ট হলেন লোকগানের প্রতি । এই শতকের একদম শুরুতে একটি লোকসঙ্গীত গানের দল ‘দোহার’ যার প্রাণপুরুষ ছিলেন লোকসঙ্গীত গবেষক, সংগ্রাহক ও গায়ক কালিকা প্রসাদ অট্টাচার্য । বরাক উপত্যকার শিলচরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা কালিকাপ্রসাদ পরিণত হয়েছিলেন গণশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান শুনে । তাঁর নিজের কথায় “ছোট বেলা থেকেই মন ছুটত টুসু,ভাদু,ভাওয়াইয়ায়। ভাটিয়ালি সুরের উজান বাওয়া গান শুনতে শুনতে একসময় মনে হল জোট বাধা দরকার। তৈরি হল দোহার। কলকতায় ১৯৯৯ সালের ৭ই অগস্ট দোহার পথচলা শুরু করল । কালিকাপ্রসাদ শুধু নিজে দরদি গায়ক আর দোহারের প্রাণপুরুষই ছিলেন না । ছিলেন বাংলার শিকড়ের গানের সংগ্রাহক ও গবেষক । কালিকা ও তাঁর গানের দলের বন্ধুরা নিজেদের সিলেটি সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী মনে করতেন । লাকিকার সুরসাধনায় ছিল সিলেট। সিলেট লোকসংস্কৃতি, বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের বাউল ও মরমি গানকে তিনি গণমানুষের খুব কাছে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি লালন, শাহ আবদুল করিম, হাসন রাজা সহ আরো কত দুই বাংলার বাউল-ফকিরদের গান খুঁজে খুঁজে বের করে তাঁদের গানের সঙ্গে আমাদের পরিচিতি ঘটিয়েছেন । আমাদের দুর্ভাগ্য মাত্র ৪৭ বছর বয়সে এক নির্মম পথ দুর্ঘটনায় নিহত হয়ে চলে গেলেন কতকিছু অপূর্ণ রেখে । শিকড়ের কাছে পৌছে গিয়ে বাংলার মাটির গানকে তুলে আনার অসামান্য কাজ করছিলেন কালিকাপ্রসাদ। তাঁর কাজটা থেমে গেল সত্য, কিন্তু কালিকাপ্রসাদ চিরকাল জড়িয়ে থাকবেন বাংলার লোকায়ত গানের সঙ্গে ।

লোকসঙ্গীত ধারায় ভাটিয়ালি সুরই প্রাচীনতম বলে মনে করা হয়, নদীমাতৃক বাংলায় ভাটিয়ালির সুরকে লোকগান ধারায় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপাও দেন তাঁরা । 'ভাটিয়ালি'সঙ্গীত শাস্ত্রের একটি রাগিণীরও নাম। পন্ডিত দীনেশচন্দ্র সেন তার ‘বৃহৎবঙ্গ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন …” এই সুর হিন্দি মনসামঙ্গলে বাঙ্গাল রাগ বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে । ইহা আমাদের চিরপরিচিত ভাটিয়াল রাগ । এই সুর কোন প্রচলিত রাগ-রাগিনীর ধার ধারে না, উহা খাঁটি পল্লীহৃদয়ের সমস্ত করুণ রস নিংড়াইয়া লইয়া আত্মপ্রকাশ করিত । এই সুর পদ্মা, ধলেশ্বরী, ভৈরব, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি নদ-নদীর গর্ভে যিনি শুনিয়াছেন, তিনি বুঝিবেন এই নদীমাতৃক দেশের উহা নিজস্ব সুর” ।

নদীতে ভাটির স্রোতের সঙ্গে নৌকা ভাসিয়ে মাঝি-মাল্লারা যে গান করেন সেগুলোই ভাটিয়ালি গান। লোকসাহিত্য গবেষক আশুতোষ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন “ভাটিয়ালি' পূর্ববঙ্গের ঢাকা, ময়মনসিংহ এবং সিলেট ও ত্রিপুরার পশ্চিমাংশের অর্থাৎ ভাটি অঞ্চল নামে পরিচিত বিশেষ অঞ্চলের গান। '...একদিকে নদী কিংবা জলাভূমির বিস্তার আর এক দিক দিয়া উহার অলস মন্থর গতি, এই উভয়ের সহযোগেই ভাটিয়ালির উদ্ভব হইয়া থাকে; এই অবস্থার মধ্য দিয়াই মাঝি কর্মে যথার্থ অবসর লাভ করিতে পারে, এই অবসরের মুহূর্তই ভাটিয়ালির পক্ষে অনুকূল মুহূর্ত। সেই জন্য নদীর ভাটিতে নৌকা ছাড়িয়া দিয়া অলস বৈঠাটি এক হাতে স্থির ধরিয়া রাখিয়া মাঝি এই গান গাহে বলিয়াই ইহা ভাটিয়ালি গান”। ভাটিয়ালি গানের মুখ্য বিষয় প্রেম-বিরহ। এ ছাড়াও মাঝি-মাল্লাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ভালোবাসা, প্রকৃতি ও তাদের হতাসা-নৈরাশ্বের প্রতিচ্ছবিও উঠে আসে এই গানে । লৌকিক চেতনা ও আধ্যাত্মিক ভাবনা এই দুইই প্রতিফলিত হয় ভাটিয়ালি গানে । লোক-সাহিত্য গবেষক আশুতোষ ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন “অন্তরের সুগভীর ভাব ও সূক্ষ্মতম অনুভূতি প্রকাশ করিবার ভাটিয়ালির যে শক্তি,তাহা বাংলার আর কোন লোকসঙ্গীতে নাই। জীবন-দর্শনের সুগভীর বিষয়সমূহ অতি সহজেই ইহার মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে...” ।(বাংলার লোক-সাহিত্য ২য় খন্ড ) ।

ভাটিয়ালির মত সারিগানও আবহমান কালের কর্মকালীন গান বা শ্রমসঙ্গীত । ভাটিয়ালি্র মত মাঝি-মাল্লারা এ গান গায়, তবে ভাটিয়ালি যেমন এককের গান, ‘সারি’ তেমন নয় । ‘সারি’ যুথবদ্ধ শ্রমজীবির গান । মাঝি-মাল্লারা যুথবদ্ধভাবে নদীতে যাওয়ার সময় এ গান গায় । কর্মজীবি মানুষ দলবদ্ধভাবে ছাদ পেটানো, ফসল কাটা, ফসল তোলা, ক্ষেত নিড়ান গাছ কাটা ইত্যাদি শ্রমনির্ভর কাজের সময় এ গান গায় । শ্রমজীবি মানুষের কাছে সারিগানের বিশেষ মূল্য রয়েছে । এই গানের মধ্যে তারা কর্মর শক্তি ও উদ্যম অর্জন করে তেমনই কর্মের ক্লান্তিও দূর করে । সারি পূর্ব ও নিম্নবঙ্গের ভাটি অঞ্চলের গান । সিলেট, ময়মনসিংহ,পাবনা,রাজশাহী রংপুর,ফরিদপুর, দিনাজপুর,যশোর,খুলনা,বরিশাল প্রভৃতি অঞ্চলেও সারিগান বিশেষ জনপ্রিয়।

ভাটিয়ালির মত ‘ভাওয়াইয়া’ মাঝি-মাল্লাদের গান নয় । উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, পশ্চিম দিনাজপুর, অসমের গোয়ালপাড়া ও ধুবড়ি জেলার বিস্তীর্ণ জনপদে রাজবংশী ও কামরূপি ভাষায় গীত সঙ্গীতধারাই ভাওয়াইয়া নামে পরিচিত । হলকর্ষণরত চাষী, রাখাল বালক, মোষপালকদের কন্ঠে স্বতোৎসারিত গানই ভাওয়াইয়া সঙ্গীত ।

ঝুমুর বাংলার রাঢ় অঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন লোকসঙ্গীত ধারা । আদিবাসি লোকজীবন ঝুমুর গানের উৎস, চন্ডিদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’এ ঝুমুর গানের উল্লেখ পাওয়া যায় । নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আদিবাসী জনজাতির এই প্রাচীন কর্মসঙ্গীতধারা এখন শহুরে শিক্ষিত সঙ্গীতপ্রেমিদের কাছেও লোকপ্রিয় হয়ে উঠেছে । আদিবাসী সঙ্গীতধারা ঝুমুরের বিবর্তন প্রসঙ্গে লোকসাহিত্য গবেষক আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর বাঙ্গালার লোকসাহিত্য (২য় খন্ড) গ্রন্থে আঞ্চলিক সঙ্গীত প্রসঙ্গে লিখেছেন “ছোটনাগপুর হইতে আরম্ভ করিয়া সমগ্র মধ্যভারত ব্যাপিয়া গুজরাট সীমান্ত পর্যন্ত যে আদিবাসী বসতি-সীমা তাহার সর্বত্র যে আদিবাসী সঙ্গীত প্রচলিত আছে তাহা সাধারণ ভাবে ঝুমুর নামে পরিচিত । ... ক্রমে বাংলাভাষার সান্নিধ্যে আসিয়া আদিবাসীর ঝুমুর বাংলাভাষায় রূপান্তরিত হইতে আরম্ভ করিয়াছে । ... ভাষার পরিবর্তন হইলেও আঙ্গিকের দিক হইতে তাহার কোন পরিবর্তন হয় নাই। ক্রমে বাঙালির বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত এবং উচ্চতর সঙ্গীতের প্রভাব তাহার উপর বিস্তার লাভ করিবার ফলে তাহার রূপ, সুর ও ভাব পরিবর্তীত হইয়াছে” । লোক সংগীতের সাধারণ ধর্ম অনুসারে এই যুগের ঝুমুরে মানবিক আকুতিরই প্রাধান্য ঘটেছে এবং বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে সমাজভূমির জীবন সংগীতের গৌরব লাভ করেছে । রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলাম সহ অনেক সুরকারই ঝুমুর সঙ্গীতের সুর আত্মীকরণ করে অনেক গানের সুর রচনা করেছেন । গ্রামফোন রেকর্ড যুগের আদি পর্বে গায়িকা কমলা ঝরিয়া রেকর্ডে ঝুমুর গান গেয়েছিলেন । ঝুমুর পালা-পার্বণেও গীত হয়, তেমনই ভাদু ও টুসুগানও পালা-পার্বণের গান ।

ঝুমুরের মত ভাদু গানও বাংলার রাঢ় অঞ্চলের গান । ভাদুগান আদিবাসী জনজাতির বর্ষাকালীন সঙ্গীত। মানভুম অঞ্চল, বাঁকুড়া, পশ্চিম বর্ধমান ও বীরভুম পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভাদ্রমাস ব্যাপি ভাদু গান গীত হয় । প্রধাণত কুমারী মেয়েদের মধ্যেই এ গান সীমাবদ্ধ । ভাদু কুমারী মেয়েদের জীবনের গান, তাদের জীবন-স্বপ্ন এ গানের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়। এ গানে ধর্মের কথা থাকে না, থাকে কুমারী জীবনের আশা-আকাঙ্খার কথা, তাদের অভিজ্ঞতা আর বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করার আগে সে সম্পর্কে তাদের আশা-আকাঙ্খ্যার কথা । ভাদ্রমাসের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত প্রতি রাত্রে পরিবারের কুমারী মেয়েরা সমবেত হয়ে ভাদু গান গেয়ে থাকে । গানের পর গান মুখে মুখে বেঁধে ফেলে মেয়েরা কোন নিয়ম-শৃঙ্খলা থাকে না, থাকে কুমারী হৃদয়ের নানান টুকরো টুকরো স্বপ্ন । ঝুমুর গানের মত ভাদু গানের ক্ষেত্রেও পুরুরিলায় পঞ্চকোট রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা সুবিদিত । এ সম্পর্কে একটি লোককথা প্রচলিত আছে । রাঢ় বাংলার ভাদু গানে পূজিত ‘ভাদুমণি’ নাকি ছিলেন পঞ্চকোট রাজা নীলমণি সিংদেবের তৃতীয়া কন্যা ভদ্রাবতী । বিবাহের পূর্বে ভাবী স্বামীর মৃত্যুতে মানসিক আঘাত পেয়ে ভদ্রাবতী আত্মহত্যা করেন । সেই থেকেই ভাদু গানের উদ্ভব, যে গানে কুমারী নারীর প্রেমের কথা, তার বারোমাস্যা ব্যক্ত করেন এমনই লোককথা প্রচলিত । লোকসঙ্গীত গবেষকরা অবশ্য বলেন ভাদু গানের উদ্ভবের সঙ্গে এই লোককথার সম্পর্ক নেই, কারণ এর অনেক আগে থেকেই রাঢ় বাংলাইয় ব্যাপকভাবে ভাদু গানের প্রচলন ছিল । তারা বলেন, ভাদ্রমাস ব্যাপি এই গান গীত হয় বলেই এর নাম ভাদু । ভাদ্রের ভরা বর্ষার প্রকৃতিকে এক কুমারী নারী রূপের কল্পনা করে তাকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিজীবনের নানান সুখ-দুঃখের কাহিনী এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ হয় । ভাদু ব্যক্তি বিশেষের স্মৃতি সঙ্গীত নয় । লোকসঙ্গীত গবেষক আশুতোষ ভট্টাচার্যর মতে “ইহার মধ্যে ধর্মের কথা যেমন নাই, ব্যক্তি বিশেষের জীবন-কথাও প্রাধান্য লাভ করিতে পারে নাই”।

ভাদুর পাশাপাশি টুসু যেন যমজ বোন । ভাদুর মত এটিও বাংলার রাঢ় অঞ্চলের গান। ভাদু কুমারী মেয়েদের বর্ষাকালীন পার্বনের গান আর টুসু শস্যোৎসবের গান । অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে ধান পাকার পর যখন কৃষকের ঘরে শস্য ওঠে, তখনই শুরু হয় টুসু পার্বণ । টুসুগানের সুর ভাদু গানের মতোই, কোনকোন অঞ্চলে সুরে সামান্য আঞ্চলিক ভিন্নতাও দেখা যায় । ভাদুগানের অবলম্বন কুমারী হৃদয়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা আর টুসুগানে প্রতিফলিত হয় সমগ্র সমাজের ছবি, এমনকি সমকালীন রাজনীতির কথাও উঠে আসে টুসু গানে ।

বাংলার লোকসঙ্গীতে এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের দাবি করে মুর্শিদি গান । মুর্শিদি আধ্যাত্মিক লোকসঙ্গীত । সুফি সাধকদের দ্বারা এ গানের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে । মুর্শিদ হলেন ভক্তের আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা বা পথপ্রদর্শক । হিন্দুর আধ্যাত্মিক যোগ সাধনায় গুরুর যে স্থান মুর্শিদ তেমনই এমনই তাদের বিশ্বাস । দয়াল মুর্শিদের কাছে আত্মসমর্পন ও তাঁর আশ্রয় কামনাই মুর্শিদি গানের ভাবতত্ব । তিনি জগৎ ও জীবনের মোহবন্ধনে আবদ্ধ ভক্তকে মুক্তির পথ দেখান । মুর্শিদি গানে তাই ভক্তহৃদয়ের আকুতির সুর প্রকাশ পায় । ভক্তের দুঃখ-বেদনার কথা, তার হৃদয়ের আর্তি ফুটে ওঠে মুর্শিদি গানে । দয়াল মুর্শিদির স্তুতি, ভক্তিভাব ও প্রেম ছাড়া এগানে অন্য কোন জটিল তত্ব থাকে না । তবে মুর্শিদি গানে যে করুণ কান্নাভরা সুর (যা এ গানের বৈশিষ্ট্য) তার উৎস ভক্ত হৃদয়ের অক্ষমতা, অজ্ঞানতা ও অপ্রাপ্তির বেদনা ।

বাংলা লোকগানের আর এক উল্লেখযোগ্য সঙ্গীত ধারা গম্ভীরা । মালদহ জেলার হিন্দু সমাজে গম্ভীরা গানের উৎপত্তি । পরে দেশ বিভাগের পরে অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহি জেলার কয়েকটি অংশে মুসলমান সমাজের পৃষ্ঠপোষকতায় এ গান জনপ্রিয় হয় এবং তার আঙ্গিকে কিছু পরিবর্তন করে । ‘গম্ভীরা’য় নাট্যের উপাদান থাকে । নানা-নাতির সংলাপ ও গানের মধ্য দিয়ে পরিবেশিত হয় গম্ভীরা । নানা হচ্ছেন শিব, তার কাছে সমাজের নানা অসংগতি তুলে ধরা হয় অভিনয়, কৌতুক ও গানের মধ্য দিয়ে ।

বাংলার লোকগানের একটি বিশেষ ধারা ‘কবিগান’ । বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে প্রচলিত নানান সাঙ্গীতিক ধারার মিলনে কবি গানের জন্ম । এর নিজস্ব কোন সুর নেই, তরজা, পাঁচালি, কীর্তন, খেউড়, আখড়াই, হাফ আখড়াই, কৃষ্ণযাত্রা, টপ্পা প্রভৃতি গানের সুর সুর অবলম্বন করে কবিগান রচনা করা হত মুখে মুখে । উনিশ শতকের শুরুতে যে নতুন বিত্তশালি বাবু শ্রেণীর উদ্ভব হয় সেই সময় তাদের বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে কবিগান ঐতিহাসিক তাৎপর্য লাভ করে । সেই সময় কবিয়াল হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন হরু ঠাকুর , ভোলা ময়রা, রাম বসু, নিতাই বৈরাগী, এন্টনি কবিয়াল প্রমুখ । উনিশ শতকের শেষ থেকেই কলকাতায় কবিগান গুরুত্ব হারাতে শুরু করে ঠিকই, কিন্তু বাংলার গ্রামাঞ্চলে বিশেষত পূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চলে কবিগানের লোকপ্রিয়তা অব্যাহত থাকে । উনিশ শতকের প্রখ্যাত কবিয়াল ছিলেন নিতাই সরকার, রমেশ শীল, শেখ গুমানি দেওয়ান প্রমুখ । লোকসাহিত্য গবেষক ড.সুশীল কুমার দের মতে “এঁরা ছিলেন সমাজের নিচু তলার মানুষ। সমাজের নিচু তলার মানুষদের মধ্যেই ছিল এঁদের জন্ম ও বিচরণ। তাই এই সমাজের চিন্তাভাবনা অনুভূতিগুলি তাঁরা ভালই বুঝতেন। আধুনিক সাহিত্যকার সমাজের যে অংশকে অশিক্ষিত মনে করে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, সেই অংশে এঁদের জনপ্রিয়তা ছিল অবিসংবাদী”।

এইসব নানান ধারার কর্ম-সঙ্গীত ও পার্বনী গান বাংলার মৌখিক সাহিত্যের অনন্য সম্পদ যা আমাদের লোকসঙ্গীত ভান্ডারকে ঐশ্বর্যশালি করেছে । সংশয়ের যায়গা নেই বাংলার লোসঙ্গীত সেই ঐশ্বর্যের মধ্যমনি রূপে বিরাজ করছে ‘বাউল গান’। খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে কীর্তন গানের উদ্ভবের সমকালে বা তারও আগে বাউল সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল । অবশ্য বাউলগান লোকপ্রিয় হয়ে ওঠে লালন শাহ বা লালন ফকিরের সৃষ্টিগুনে । ১৯ শতকের মাঝামাঝি হরিনাথ মজুমদার বা কাঙ্গাল হরিনাথও (১৮৩৩) এই গানের সার্থক প্রচারক ছিলেন । বাউল দর্শন মানবমুখী ও জীবন নির্ভর । বাউলদের সাধনবস্তু হল ‘মনের মানুষ’ । মনের মানুষই পরম সত্য, আবার ব্যক্তিক প্রেমের আধার । বাউলদের মনের মানুষ আছে দেহসীমার মধ্যে, প্রেমের দ্বারা তার সঙ্গে সমন্বিত হতে হবে – এটাই বাউল দর্শনের মূল সত্য । বাউলগানে আছে ধর্মীয় ভেদাভেদহীন এক সর্বজনীনতা । রবীন্দ্রনাথই প্রথম বাউল সঙ্গীতকে শিক্ষিত অভিজাত মহলে তুলে ধরেন । ‘সঙ্গীতচিন্তা’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি এবং অনেক গানে অন্য রাগ-রাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিলন ঘটেছে । ...লোকসাহিত্যে এমন অপূর্বতা আর কোথাও পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস করিনে” । শিলাইদহে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ বাউল গগন হরকরার কাছে বাউল গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তাঁর কাছ থেকে বাউল গান সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছিলেন । শিলাইদহের এক গ্রামীণ ডাকঘরের হরকরা গগন দাস (জন্ম ১৮৪৫) কে লালনের গানই প্রাণিত করেছিল । বাউল সঙ্গীতধারার প্রতি রবীন্দ্রনাথ অনুরক্ত ছিলেন, তাঁর অনেক লেখায় লালনের উল্লেখ আছে । এখন বাউল গান বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে । বিশ্বের ৪৩টি বাক ও বিমূর্ত ঐতিহ্য চিহ্নিত করতে গিয়ে বিশ্ব সংস্থা ইউনেসকো বাংলার বাউল গানকে অসাধারণ সৃষ্টি বলে আখ্যা দিয়ে একে বিশ্ব সভ্যতার সম্পদ বলে ঘোষণা করেছে । বাউল গানকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ’-এর তালিকাভুক্ত করে ইউনেসকো সদর দপ্তর থেকে ২০০৫ সালের ২৭ নভেম্বর এই স্বীকৃতি ঘোষণা করে ।

লালন সঙ্গীত রচনা করেছিলেন প্রধানত বাউল সুরের আদর্শে, কিন্তু তিনি বাউল সাধক ছিলেন না। তাঁর সহস্রাধিক সঙ্গীতরচনা ‘লালন-গীতি’ নামে পরিচিত । লালন তাঁর গানে সমকালীন সমাজের নানান কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক বিভেদ ইত্যাদির কথা তুলে ধরেছেন ।লালন তাঁর সমগ্র জীবনচর্যার মধ্য দিয়ে জাত-ধর্মের বিরুদ্ধে তীব্র জেহাদ বজায় রেখেছিলেন তাঁর গানে । লালন ছিলেন ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ রামমোহন রায়ের সমসাময়িক । একই সময়ে দুজনের জন্ম । রামমোহনের আধুনিক চিন্তা আঘাত করেছিল সমাজের অন্ধত্ব, কূ-প্রথা ও কুসংস্কারে । রামমোহন প্রজ্জ্বলিত আলোকবর্তিকা বাংলার নবজাগরণের সেই ঊষালগ্নে গ্রামীণ লোকচিত্তে কি আলোড়ন তুলেছিল তার কোন লেখাজোখা নেই । লালনের বাউলগানে গ্রামীণ লোকচিত্তের আলোড়নের কিছু আভাষ নিশ্চিতভাবেই পাওয়া যায় ।ণ

বিশ শতকের লোকগানের এক খ্যাতকীর্তি সঙ্গীতকার শাহ আবদুল করিম (জন্ম ১৯১৬) লালনের দর্শনের আদর্শে প্রায় দেড় হাজার সঙ্গীত রচনা করেন । শাহ আবদুল করিম শুধু বাউল গানই রচনা করেননি, ভাটিয়ালি, দেহতত্ব, মারফতি, ধামাইল প্রভৃতি লোকধারার এবং অনেক গণচেতনার সঙ্গীতও রচনা করেন । একালের নবীন প্রজন্মের শিল্পীরাও শাহ আবদুল করিমের গান গেয়ে লোকপ্রিয়তা অর্জন করছেন ।

উপসংহারে আবার রবীন্দ্রনাথের কথা “আত্ম প্রকাশের জন্য বাঙালি স্বভাবতই গানকে অত্যন্ত আপন করে চেয়েছে...গানকে ভালোবেসেছে বলেই সে গানকে আপন হাতে,আপন মনের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করতে চেয়েছে” । বিশ শতকের শুরুতে গ্রামফোন বাহিত ধ্বনিবদ্ধ গান বাঙালির ঘরে ঘরে পৌছানো শুরু হয়েছিল যার গালভরা নাম দিয়েছিলাম ‘আধুনিক বাংলা গান,আর বিশ শতকের শেষ পর্বে পৌঁছে তার সব শক্তিরই ক্ষয় দেখছি । কিন্তু এই ক্ষয়ের মধ্যেও আশার আলোকরেখা দেখছি না এমন নয় । নবীন প্রজন্মের শিল্পীরা রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তর গানের কাছে যাচ্ছেন, তাঁরা লালনের গান, শাহ আবদুল করিমের গান গাইছেন প্রচার করছেন,লোকসঙ্গীতের প্রতি আকর্ষিত হচ্ছেন । আমার বিশ্বাস নবীনকালের শিল্পী, সুরকাররা শিকড়ের কাছে ফিরতে চাইছেন । শিকড়ের কাছে – শিকড়ের গানের কাছে গান শোনা বাঙালিকে ফিরতেই হবে ।


সমাপ্ত