শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

​একটি অভিশপ্ত দ্বীপভূমি, সেখানে থাকে এক জার্মান সাদা ভূত --৪


ওই মুহূর্তে কাঁধে বসে থাকা বাজপাখিটা আচমকা ডেকে ওঠে...।সবার দৃষ্টি ওটার দিকে ফিরে যায়। মানুষটি বাজপাখিটাকে হাত দিয়ে আদর করতে থাকে,তারপর বলে, ‘ হ্যাঁ হ্যাঁ বলব বলব, তোর কথা বলব ,তুই তো আমার রাইটহ্যান্ড রে মাই ডার্লিং...’।তারপর আবার বুলটিদের উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,‘তোমরা যে বেঙ্গলি আমার এই রাইটহ্যান্ডও তোমাদের মুখের ভাষা শুনেই বুঝতে পেরেছিল...।’ বলতে বলতে মানুষটি তাঁর পোষা বাজপাখিটাকে আবার আদর করতে থাকে।ওই অবস্থায় মানুষটি বলে চলে, ‘এই ভোলকানো আয়ল্যান্ডের(আগ্নেয়গিরি দ্বীপের)আনাচ-কানাচের দিকে সারাক্ষণ ওর তীক্ষ্ণ নজর,একটা পিঁপড়েও ওর নজর থেকে বেঁচে বেরিয়ে যেতে পারে না...।’

বিট্টুস আর নিজেকে রুখতে পারে না, ‘অউ, ওটা দেখছি আপনার খুব নেওটা,...সত্যি সত্যি আপনার রাইটহ্যান্ড, ওটাকে কি একটু আদর করতে পারি?’

মানুষটা হাসতে হাসতে জবাব দিল , ‘অবশ্যই অবশ্যই, ওর এ ব্যাপারে কোনও অরুচি নেই, ও আদর খেতে খুব ভালোবাসে...।’ বলতে বলতে মুখে হাত চেপে হাসতে থাকে মানুষটা । বিট্টুস আর সময় নষ্ট না করে বাজপাখিটির মাথায়-পিঠে নরম করে হাত বুলোতে থাকে। আদর পেয়ে বাজপাখিটা পাখা ঝাপটাতে শুরু করে।

বুলটি,শিম্মি,ভোম্বল,ডাব্বু-- সবাই ভেতর থেকে অনেকক্ষণ ধরে উশখুশ করছিল এই দেবদূত সদৃশ মানুষটির সঙ্গে কতক্ষণে কথা বলবে।কিন্তু কে যে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছে না। বিট্টুসও আর কিছু বলছে না,ও বাজপাখিটাকে নিয়েই মেতে আছে...। ওই দেবদূতের মতো মানুষটিই আবার মুখ খুলে ওদের এই দোলাচলতা নিরসন করে : ‘কত দূর ভ্রমণ করে এসেছ সোনারা, নিশ্চয় তোমাদের ক্ষুধা পেয়ে গেছে?’ এবার বুলটির সামনের বন্ধ দরজাটি যেন খুলে গেল , আর সময় নষ্ট না করে অনেকটা উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে, ‘খুব খুব ক্ষিদে পেয়েছে দেবদূত দাদু...।’ এরপর ভোম্বল বলে ওঠে, ‘আমরা কী খাবো দেবদূত দাদু?’ ডাব্বু বলে ওঠে, ‘আমি আইসক্রিম খাবো...।’ বিট্টুস বলে ওঠে, ‘দেবদূত দাদু, এখানে আম পাওয়া যায়?’ শিম্মি বলে ওঠে, ‘আমি ফুচকা খাবো, দেবদূত দাদু।’।বুলটি জিজ্ঞেস করে, ‘ পিৎজা পাওয়া যায় নিশ্চয়...’। ওদের এই হট্টগোলে আবার বনের গভীরে কোথা থেকে ভেসে এল সাবধান বাণী ‘...কুল ডাউন...কুল ডাউন...’ (‘শান্ত হও,শান্ত হও...’)। ওরা সবাই চুপ মেরে যায়। দেবদূতদাদু হাসতে হাসতে বলে ওঠেন, ‘ এটি এই দ্বীপের বিশেষ শব্দ সেন্সর-যন্ত্র অর্থাৎ সাবধান করে দেওয়ার যন্ত্র, কারো গলার স্বর চড়ে গেলেই ওই যন্ত্র সজাগ করে দেয় ‘শান্ত হও’ বলে। কারণ, এই দ্বীপের প্রকৃতি, আকাশ-বাতাস চড়া স্বর সহ্য করতে পারে না...’

বলতে বলতে তিনি বুলটিদের আহ্বান জানালেন, ‘এসো, খোকাখুকুরা চলো আমার শিবিরে, ওখানে বিশ্রাম নেবে খাওয়াদাওয়া করবে...’।

দেবদূতদাদু পা চালিয়ে দেন।পেছন পেছন বুলটিরা। যেতে যেতে ওরা দু-পাশে দেখে কত রকমের ফুলের গাছ! নানা রঙের নানা ঢঙের...। দেবদূতদাদু বলে ওঠেন , ‘ আমরা এই যে ফুলের বীথিকা দিয়ে এগোচ্ছি এগুলো সব বিভিন্ন রঙের হেবিস্কাস, তোমরা যেটাকে বলো জবা-- হলুদ,লাল,বেগুনি,সাদা...।এইসব ফুলে কেউ হাত লাগাবার নেই, কেউ দেখবার নেই, দেখে শুধু এই আকাশ এই বাতাস...’, বলতে বলতে তিনি দু-হাত আকাশের দিকে তুলে ধরেন।বুলটিরা অবাক চোখে দেখলো, দেবদূতদাদু যেন তাঁর হাত দুটো ওপরে তুলে একেবারে আকাশ ছুঁয়ে ফেললেন, এমনই লম্বা হয়ে গেল তাঁর হাত দুটি...!

বুলটিরা ফুলগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে।একবার ছুঁলে যেন আরও ছুঁতে ইচ্ছে করে। ওরা বার বার ছোঁয়...। ওদের মনে হচ্ছে এ-ফুলগুলোর ভেতর যেন কী এক জাদু আছে!যা তাদের বাড়ির ফুলগুলিতে নেই।

যেতে যেতে দেবদূতদাদু একটি ছোটোখাটো টাওয়ারের কাছে এসে দাঁড়ালেন।বুলটিরা দেখে টাওয়ারটির মাথায় বন বন করে ঘুরছে একটি মানুষের মূর্তি্‌, মূর্তিটা দেখতে অনেকটা নৌ-সৈনিকের মতো । দেবদূতদাদু বলে ওঠেন, ‘ ওই মূর্তিটিকে বলে ‘সেন্সর ম্যান’, ওটার ভেতর ঢোকানো আছে একটি শব্দ-প্রতিরোধক যন্ত্র , যা এই দ্বীপের নির্জনতাকে নষ্ট করতে দেয় না। নির্দিষ্ট শব্দমাত্রা পার হয়ে গেলেই সে সাবধান করে দেয় ‘শান্ত হও’ বলে।এই যন্ত্রটি তৈরি করেছে আমারই এক সহযাত্রী মাইকেল ল্যান্ড,সে চেয়েছিল এই শান্ত-সুন্দর দ্বীপটিকে শব্দ-দূষণ থেকে রক্ষা করতে। ও কথায় পরে আসছি...।

অবশেষে দেবদূতদাদু এসে পৌঁছুলেন তাঁর বাসস্থানে অর্থাৎ শিবিরে। বুলটিরা মোহিত হয়ে দেখে দেবদূতদাদুর শিবিরটা আকারে অনেকটা উল্টানো ছোটোখাটো বাটির মতো।আয়তনে (পরিমাপে) দুশো বর্গফুটের কাছাকাছি ।বানানো হয়েছে প্যারাসুটের কাপড়ের চেয়েও মোটা কাপড় দিয়ে।বিট্টুস ওর ব্যগ্রতা রুখতে পারে না, ‘ দেবদূতদাদু আপনার ঘরটা এমন কেন?’ হাসতে হাসতে জবাব দেন দেবদূতদাদু, ‘ঝড়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য, এখানে মাঝে মাঝে ঝড় ওঠে তো , সামুদ্রিক ঝড়, ওই ঝড় আমার এই ক্যাম্পের ওপর দিয়ে পিছলে চলে যায়, ধাক্কা আর দিতে পারে না...’, বলতে বলতে হাসতে থাকেন তিনি।

ঘরটার ভেতরে ঢোকার জন্য একটি চেরা ফাঁক আছে, ভেতরে ঢোকার পর ওটা আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যায়, ওটাকে ঠিক দরজাও বলা যায় না। দেবদূতদাদুর পেছন পেছন বুলটিরাও ভেতরে ঢুকে পড়ে। ভেতরে ঢুকে খুলে যায় দেবদূতদাদুর সংসার। সবই আছে,বড় বড় দুটো বিছানা, পড়ার টেবিল, বইপত্র, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, হিটার-কুকার, বড় বড় দু-তিনটে বাক্স ইত্যাদি। তবে সবই অগোছালো ভাবে আছে ।মনে হয় বহুদিন ওতে হাত পরেনি কারো। বিশেষ করে বইপত্র আর বিছানা।ওদের মনে হল এগুলো যেন অনেক দিন ধরেই এ ভাবে পড়ে আছে...।

বুলটি আর শিম্মি স্থির থাকতে পারে না । ওরা দুজন লেগে পড়ে দেবদূত দাদুর বইপত্র আর বিছানা দুটো গুছিয়ে দিতে। ঘরের অন্যান্য জিনিসপত্রগুলোও ভোম্বলের সাহায্য নিয়ে জায়গা মতো সাজিয়ে রাখে।বিট্টুস আর ডাব্বু আরাম কেদারায় শুয়ে শুয়ে ফেসবুক ঘাটতে মগ্ন হয়ে পড়ে...।বিট্টুস কান্না কান্না গলায় বলে ওঠে, ‘ এই তোরা শোন , ফেস-বুক,হোয়াটসঅ্যাপ কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না ,কোনও লিংক নেই বাকি পৃথিবীর সঙ্গে...!’ ডাব্বুও ভয়ে ভয়ে বলে ওঠে, ‘ আমিও বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি অনেকক্ষণ ধরে লিঙ্ক পাচ্ছি না, কোনও শব্দই নেই , যেন ডেড...’!বুলটি বলে ওঠে, ‘ ঘাবড়ে গেলে চলবে না বন্ধুরা ,আমরা তো সেভাবেই মানসিক ভাবে তৈরি হয়ে এসেছি, আমরা পাঁচজনই পাঁচজনের সাহায্যকারী, অন্য কাউকে তো ভাবতে পারি না,সুতরাং যে যার মোবাইল পকেটেই রেখে দে ...।’

অনেকক্ষণ ধরে দেবদূতদাদুকে দেখা যায় না।বুলটি বলে ওঠে, ‘আরে,দেবদূত দাদু কোথায় গেলেন?’বুলটির এই কথায় বাকিরাও সচকিত হয়ে ওঠে। শিম্মি বলে ওঠে , ‘হ্যাঁ তাই তো,উনি কোথায় গেলেন?’ওরা সবাই দেবদূতদাদুকে খুঁজতে শুরু করে। শিবিরের ভেতরে কোনায় কোনায় ওঁকে খোঁজে।কিন্তু কোথাও পাওয়া যায় না! ওই মুহূর্তে একটা দমকা হাওয়া বোয়ে যায় শিবিরের ভেতরে। হঠাৎ যেন ওই হাওয়ার ভেতর থেকেই উদয় হলেন বেবদুতদাদু! হাতে তাঁর বড় একটি তামার থালায় সাজানো বিভিন্ন রকমের কাঁটা ফল আর আরেক হাতে এক জামবাটি আনাজ অর্থাৎ সবজি। ওই সবজি থেকে বেরোচ্ছে ধোঁয়া...।

বুলটিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে দেবদূতদাদুর দিকে! ওই অবস্থায় বুলটির মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে অধীর প্রশ্ন, ‘আরে দাদু তুমি কোথায় গিয়েছিলে?’ বিট্টুসের গলায়ও প্রখর জিজ্ঞাসা, ‘এই খাবারগুলোই বা কোথা থেকে আনলে?’

দেবদূতদাদু হাসতে জবাব দিলেন, ‘ আমি আবার কোথায় যাব, তোমাদের কাছেই তো আছি,এই খাবারগুলো তোমাদের জন্য বানিয়েছি আমি নিজে...এবার নাও ছোট্ট সোনা বন্ধুরা, খেয়ে নাও , তোমাদের তো বেশ ক্ষুধা পেয়েছে...।’ তিনি কাছের ডাইনিং টেবিলটার ওপর পাত্র দুটো রাখলেন।

খাবারগুলোকে দেখে বিট্টুস যেন আঁতকে ওঠে, ‘ও মাই গড,এগুলো আমাদের খেতে হবে দেবদূত দাদু!’ বিট্টুসের এই আচরণে বুলটি ধমকিয়ে ওঠে, ‘ এই বিট্টুস এ-সব কি বলছিস,দেবদূত দাদু খারাপ পাবেন না, ছিঃ,উনি যা দিয়েছেন তাই খাবো...’ ‘সরি...সরি দাদু,সরি...’,বিট্টুস অনুশোচনায় মাথা হেঁট করে।

দেবদুত দাদু হাসতে হাসতে বলে ওঠেন, ‘না না আমি খারাপ পাইনি, তুমি কথাটা বলেছ শিশু সরল মন থেকেই, কিন্ত আমি আর আমার সহযোগী বন্ধুরা তো এই খাবারই খেয়েছি... এর বাইরে অন্য কিছু খাবার পাওয়া যার না এখানে, নো রাইস,নো ব্রেড নো মিট,নো ফিশ, অনলি ফ্রুটস এন্ড বয়েলড ভেজিটেবল(সেদ্ধ করা সবজি) খেতে হয় এখানে... শরীর আর মন দুটোই চনমনে থাকে...’।বলে একটু থামলেন তিনি।তারপর মুখে একটা মুচকি হাসি মেখে আবার বলে ওঠেন, ‘এইসব ফল কিন্তু এই দ্বীপভূমিতে হয়, এই যেমন— গুয়ানাবানা(এক ধরনের নরম আপেল),গুয়াভা(পেয়ারা),লিচি(লেচু), পাপায়া(পেঁপে),ম্যাঙ্গোসটিন( এক ধরনের গন্ধযুক্ত রসালো ফল), টমেটো...।’বলে আবার একটু থামলেন তিনি।তারপর আবার হাসি ফুটিয়ে বলা শুরু করেন, ‘তবে সবজি কিন্তু আমি নিজে চাষ করি। এই যেমন-- ক্যাবেজ(বাঁধাকপি),ক্যারট (গাজর),ব্ল্যাক পিপার (গোলমরিচ),মাস্টারড সিড(সরষে),মামে সাপট(এক ধরনের মিষ্টি আলু), পার্সলে(পুষ্টিকর শাকবিশেষ)...। আগে আমার সঙ্গে থাকত আমার চার সহযোগী, এখন আমি একা...।’ বুলটি বলে ওঠে, ‘ দেবদূতদাদু ওদের তো দেখছি না!?’ দেবদূতদাদু জবাব দেন, ‘ সে অন্য গল্প, পরে বলবখন অন্য কোনও এক সময়ে...তোমরা এখন খেয়ে নাও...তারপর একে একে চান করে ফেলো সবাই ,পাশেই বাথরুম,জল গরম করার জন্য গিজারও রয়েছে...।’

--এ ঠাণ্ডায় কে চান করবে উফ...’ ভোম্বল থালা থেকে এক টুকরো গুয়ানাবানা মুখে নিতে নিতে এই মন্তব্য করে বসে ।

দেবদূতদাদু বলে ওঠেন, ‘না ছোট্ট বন্ধুরা, তোমরা বাইরে থেকে এসেছ, আজ তোমাদের সব্বাইকে ভালো করে চান করতেই হবে, নয়তো এই শান্ত সুন্দর দ্বীপভূমিতে জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে...।’

ডাব্বু মিনমিনিয়ে জানতে চায়, ‘ তাহলে দেবদূতদাদু অন্যদিন আমাদের চান করতে হবে না?’

দেবদূতদাদু হাসতে হাসতে জবাব দেন , ‘ সে তোমাদের ইচ্ছে,করতে পারো নাও করতে পার, আমি তো মাসে একবার চান করতাম, কারণ এই দ্বীপে কোনও ধুলোবালি নেই, ঘাম হয় না, এ দ্বীপে যে নির্মল বাতাস বয় সেটাই আমাদের শুদ্ধ রাখে...’।

সিম্মি কৌতূহলী হয়ে ওঠে, ‘আচ্ছা দাদু, তুমি চান করতাম বলছ কেন, এখন কি চান কর না?’

জবাবে দেবদূতদাদু আমতা আমতা করতে থাকেন ‘এই এই এই আর কি...মানে মানে...।’

ভোম্বল নিচু স্বরে সিম্মির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ‘দেবদূতদাদুর বোধ হয় বিট্টুসের মতো ঠাণ্ডার ধাঁচ আছে...।’

সিম্মি ফিক করে হেসে ফেলে। ভোম্বলের মনে হল দেবদূতদাদুও হাসলেন। মনে মনে সে ভড়কে গেল। এতো নিচু গলায় কথা বলেও দেবদূতদাদুর কানে পৌঁছে যায়!

বুলটি হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসে, ‘আচ্ছা দাদু তুমি চান–খাওয়ার জন্য জল কোথা থেকে পাও, সাগর থেকে?

দেবদূতদাদু বুলটির চিবুকে একটু আদর মাখিয়ে বলে ওঠেন, ‘ধুর বোকা, সাগরের জল খাওয়া যায় নাকি, বরফের জল, বরফের জল, এই দ্বীপে সারা রাত বরফ পড়ে, ওই বরফের জলই আমি খাই, চাষবাস করি ওই বরফের জল দিয়েই, মাটি কেটে জলাধার বানিয়ে ওখানেই বরফের জল সঞ্চয় করি...।’

এভাবেই কথায় কথায় এক সময় সাঁঝ নেমে আসে। দেবদূতদাদু ভেতরের সৌরশক্তি চালিত বাতিগুলো জ্বালিয়ে দেন। বুলটিরা সবাই বাইরে এসে দেখে শিবিরের চারপাশেও ওই সৌরশক্তি চালিত বাতি জ্বলছে...।বাইরে শিশিরও পড়ছে।ভারী ভারী শিশির। এই শিশিরের ভেতর বাতিগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেন ভিজছে...। আর এর বাইরের প্রকৃতি— বন-জঙ্গল, টিলা-টাব্বা আর ওই আগ্নেয়গিরিটাও দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে।এখন শুধু দূর থেকে বাতাসে ভেসে আসে একটি হা...হা রব আর ফুলের সুমধুর ঘ্রাণ। বাতাসের শীতলতা ক্রমশ বাড়ছে , দিনের বেলা যা ছিল তার দ্বিগুণ...। সহ্য করা যায় না...। যেন শরীর পাথর হয়ে যাবে। বুলটিরা সবাই শিবিরের ভেতরে ঢুকে পড়ে।

কিন্তু ঢুকে দেবদূতদাদুকে দেখতে পায় না ওরা।ভেতরের চারপাশে চোখ ঘুরিয়েও দেখতে পায় না।ডাব্বুর গলায় জিজ্ঞাসার ঝোঁক, ‘এই হাড় ফাটানো ঠাণ্ডায় দেবদূত দাদু আবার কোথায় গেলেন, তাজ্জব তো!’

দেবদূতদাদুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া ওদের করার আর কিছুই থাকে না। অপেক্ষার পর অপেক্ষা। হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা দমকা হাওয়া এসে ভেতরে ঢোকে...। মনে হল কে যেন এলো। এসেই হিটারটা জ্বালিয়ে দিল। ওরা টের পেল ভেতরটা আস্তে আস্তে গরম হচ্ছে।ঠাণ্ডার কামড়টা আগের মতো নেই। তবে ঠাণ্ডার দাপট রয়েছে। ওরা এবার হকচকিয়ে দেখে দেবদূতদাদু যেন একটা ছায়ার মতো বসে আছেন তার টেবিলে। বসে বসে কাজ করছেন ল্যাপ-টপে। নীরবে ।

তিনি সারাদিন কাজ করেন, কখনো ল্যাপটপ নিয়ে টাইপ করেন,কখনো বই পড়ায় ডুবে যান, কখনো গুনগুন করে তার নিজের ভাষার গীত গান।কখনো হোম থিয়েটারে নিচু ভলিউমে(স্বরে) বিভিন্ন ভাষার গান চালিয়ে দেন...রবীন্দ্রসঙ্গীতও বাজান...নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাশাপাশি...তা তা থৈ থৈ ..., কখনো সারা ঘরে স্প্রে করেন...।সবই করেন ওই ছায়ার মতো হয়েই...পরে আছেন শুধু ওই একটি মাত্র সাদা আলখাল্লা ।ঠাণ্ডায় উ আ করছেন না বুলটিদের মতো। ওরা তো সবাই মোটা কম্বলের নীচে আশ্রয় নিয়েছে।ডাব্বু কম্বলের নীচ থেকেই বিট্টুসকে শঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘দেবদূতদাদু সত্যই কি আমাদের মতো মানুষ না অন্য কেউ...?’

বিট্টুস কিছু বলার আগেই দেবদূতদাদু যেন কোথা থেকে ভেসে এলেন। কাপে করে ওদের জন্য নিয়ে এলেন এক ধরনের পানীয়।সঙ্গে একটি বড় পাত্রে কাটা ফল। ওরা দেখল ওই পানীয় থেকে ধোঁয়া উঠছে। দেবদূতদাদু বলে উঠলেন, ‘ আমি রোজ সন্ধে বেলা এই ক্যাকটাস ফলটির সঙ্গে পানীয়টি খাই,পানীয়টি সুইট গ্রানাডিলা ফলের রস, একটু গরম করে নিলে স্বাদ আরও দারুণ হয়, শরীরও গরম রাখে আর এই ফলটি খেলে রাতে আর কিছু খেতে হয় না ... বলতে বলতে তিনি যেন অনেকটা ভেসে গিয়েই কম্পিউটারে গিয়ে বসলেন।

বিট্টুস আর ভোম্বল কম্বলের নীচে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে, ‘ কী বুঝলি বুলটি? রাতে আর খাওয়া হবে না আমাদের, দেবদূতদাদু শুনিয়ে রাখলেন !’

ওদের দুজনের এই কথাটা দেবদূতদাদুর কানে ঠিক পৌঁছে গেল।তিনি হেসে ফেললেন কথাটা শুনে। তারপর বললেন, ‘ ঠিক আছে , এই ফল আর পানীয়টা খেয়ে নাও, যদি রাতে ক্ষুধা পায় আমি তোমাদের সবজি সেদ্ধ করে খাওয়াব...।’ বলতে বলতে তিরি কম্পিউটারে মন দিলেন।

বুলটিরা দেবদূতদাদুর নির্দেশ মানল।এবং শুরুতে একটু একটু করে খেতে খেতে পরিশেষে এতোই ভালো লাগলো যে, নিমেষের মধ্যেই ফল আর পানীয়টি ওরা খেয়ে শেষ করে ফেলল। কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা টের পেল শরীরের সব জড়তা উধাও হয়ে গেছে।কাজ করার ইচ্ছে জাগছে মনে,কথা বলার ইচ্ছে জাগছে মনে...ক্ষুধার লেশ মাত্র নেই...

দেবদূতদাদু কম্পিউটারে নিমগ্ন। বুলটিদের মুখ নিসপিস করছে দেবদূত দাদুর সঙ্গে কথা বলার জন্য। এখানে আসার পর থেকে ওঁকে নিয়ে তো অনেক প্রশ্ন জেগে আছে ওদের মনে।শুধানো হয়নি।সে রকম সুযোগও পাওয়া যায়নি। এখন ওই অবসর তৈরি হয়েছে।কিন্তু দেবদূতদাদু তো কম্পিউটারে বেশ গম্ভীর। কীভাবে শুরু করা যায়? বুলটিদের মধ্যে শুরু হয়ে যায় একে অপরকে খোঁচানো । কেউ শুরু করতে সাহস পাচ্ছে না। অবশেষে বিট্টুস আচমকাই ডেকে ওঠে, ‘ দেবদূতদাদু...’। দেবদূতদাদু কম্পিউটারেরে দিকে চোখ রেখেই সাড়া দিলেন, ‘হ্যা,কিছু বলবে?’ প্রত্যুত্তরে বিট্টুস বলে, ‘ হ্যাঁ, আমাদের মনে কিছু প্রশ্ন ছিল ?’

দেবদূতদাদু উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে ওঠেন, ‘হ্যা,তাই তো ভাবছিলাম আমি , তোমাদের মতো এই ছোট্ট খোকা খুকুদের মনে কি কোনও প্রশ্ন নেই? শিশুরা তো প্রশ্নের ভাণ্ডার।ওদের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে বড়োরা তো হিমসিম খেয়ে যায়...’।বলতে বলতে মুখে হাসি ফুটিয়ে কম্পিউটার বন্ধ করে দিলেন তিনি। এই সুযোগে বুলটি যে বিষয়টি ওর মাথায় ঘুরপাঁক খাচ্ছিল সেটি প্রকাশ করে ফেলে, ‘ দেবদূতদাদু আপনি কি সব সময় এই দ্বীপের দেবদূত হয়েই থাকেন, নাকি আমরা এসেছি বলে নেমে এসেছেন?’

দেবদূতদাদুর দুচোখে বিস্ময়, ‘নেমে এসেছি মানে,কোথা থেকে নেমে এসেছি?’বলতে বলতে তিনি টেবিল ছেড়ে বুলটিদের কাছে এসে বসেন।

বিট্টুস চটপট সবজান্তার মতো জবাব দেয়, ‘কেন, প্যারাডাইস থেকে...’।

বিট্টুসের জবাব শুনে দেবদূতদাদু নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলেন না, হো হো করে হেসে উঠলেন।দেবদূতদাদুর এই হাসিটা শুনে ওদের কেমন ভয় ভয় লাগলো!যেন অস্বাভাবিক-অস্বাভাবিক!ওই মুহূর্তে ‘সেন্সর ম্যান’ সাবধান করে ওঠে, ‘শান্ত হও, শান্ত হও...’। দেবদূতদাদু মুখে আঙুল চাপা দিলেন।তারপর বলে ওঠেন, ‘ এই দ্বীপটাই তো আমার প্যারাডাইস রে আমার ছোট্ট বন্ধুরা...’।


চলবে ...