শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

হলদে পাখি বাও ধান খায়, পর্ব -৩ ও ৪

তিন

সেদিন দুপুরবেলা রসেশ্বরদের উনুনে হাড়ি চড়ল না। ছেলে মেয়েদের পাশের বাড়িগুলি থেকে ভাত খাইয়ে আনল। রসেশ্বরের স্ত্রী ডম্বরুদের ঘরে শুয়ে পড়ল।রসেশ্বর হাত-পা ধোয়ার কথা বাদ দিয়ে মাঠ থেকে কাদায় মাখামাখি হয়ে এসে সেই অবস্থাতেই বারান্দায় গাছের গুড়ির মতো মাথা নিচু করে বসে রইল।

বেলা দশটা থেকে বিকেল পর্যন্ত একই জায়গায় বসে রইল। তখন তার স্ত্রী ডম্বরুদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তার সামনে দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল,আর গিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে ডম্বরুর স্ত্রীও রসেশ্বরের উঠোনে এসে দাঁড়িয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বলল-‘মানুষটার কেঁপে কেঁপে খুব জ্বর এসেছে। আজ তুমি তাকে যেভাবে মেরেছ মানুষ গরু ছাগলকেও এভাবে মারে না। ডাক্তার কবিরাজ একজন ডেকে এনে দেখিয়ে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা কর না হলে কিন্তু ও বাঁচবে না। তোমাকেও তখন ফাঁসিতে ঝুলতে হবে।’

রসেশ্বর মুখে কিছু না বলে আরও কিছুক্ষণ নিশ্চল হয়ে বসে রইল। তারপরে সে কিছু একটা সিদ্ধান্ত নেবার মতো মুখের ভাব করে উঠে দাঁড়াল এবং ঘরের বাইরের বারান্দা দিয়ে পেছন দিকের কুয়োয় গিয়ে ভালোভাবে হাত মুখ ধুয়ে নিল। ভেতরে এসে পরনের কাপড়টা বদলে নিল। তারপর সে শোবারঘরে ঢুকে গেল। বিকেলেই ঘরটা রাতের মতো অন্ধকার। আড়চোখে সে স্ত্রীর দিকে তাকালো। গায়ের চাদর দিয়ে ঢেকে হাঁটু দুটো বুকের কাছে লাগিয়ে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। মুখে কোনোরকম কাতরোক্তি নেই, শ্বাস-প্রশ্বাসেরও কোনো শব্দ নেই। সে যেন সমস্ত সংসারের প্রতি বিরাট অভিমানে নিজের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ গোপন এবং নিশ্চিহ্ন করার জন্য চেষ্টা করছে।স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তের মতো রসেশ্বর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। স্ত্রীর প্রতি অপরিসীম সহানুভূতি এবং মমতায় তার মনটা সম্পূর্ণভাবে গলে গেল, তার গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করার ইচ্ছা হল কিন্তু লজ্জায় সেই সব কিছুই করতে পারল না। বিছানাটার মাথার দিকে থাকা বাক্সটা থেকে নতুন তৈরি একটা এন্ডির চাদর বের করল এবং নিঃশব্দে বাইরে বেরিয়ে এল। বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে করুণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ কাপড়টার দিকে তাকিয়ে রইল।রসেশ্বরের স্ত্রী সেই কাপড় বিক্রি করে তার টাকা দিয়ে একটা ছাগল কিনবে বলে অনেকদিন থেকেই আশা করেছিল।রসেশ্বর হঠাৎ তার চোখ দুটো ভিজে উঠেছে বলে অনুভব করল। গামছা দিয়ে সে দ্রুত মুখটা মুছে এণ্ডিরকাপড়টা বেঁধে নিল। তারপর সে ডিম্বেশ্বর মন্ডলের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল।

রসেশ্বরের বাড়ি থেকে ডিম্বেশ্বর মন্ডলের বাড়ি প্রায় তিন মাইল পথ। সে মন্ডলের বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যে হবার উপক্রম হল।মন্ডল গোঁসাই ঘরে সন্ধ্যেবেলা ঠাকুরের নাম গান করছিল। বেরিয়ে এসে রসেশ্বরকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে খুব অবাক হওয়ার মতো ভাব করে বলল-‘কী ব্যাপার?কোনোদিনই না আসা মানুষটা আজ কী মনে করে এলে?’

রসেশ্বর মন্ডলের পা ছুয়ে যেন সেবা করবে এভাবে ঝুকে প্রণাম করে বলল-‘দাদা, আমার সর্বনাশ হয়েছে। আপনি রক্ষা না করলে আমি ছেলে বউ সবাইকে কেটে ব্রহ্মপুত্রের জলে ভাসিয়ে দিয়ে নিজেও ব্রম্মপুত্রেঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী হব।বড় বিপদে পড়ে আপনার কাছে ছুটে এসেছি।’

মন্ডল বসে নিয়ে বলল-‘এই ভর সন্ধ্যা বেলা কি অমঙ্গুলে কথাগুলি মুখে আনছ।এরকম কথা মুখে আনতে নেই। বল, তোমার কী হয়েছে বল। আমি কিছু করতে পারলে নিশ্চয় করব।’

মন্ডলের কোমল কন্ঠের কথা শুনে রসেশ্বর মরা দেহে প্রাণ ফিরে এল বলে অনুভব করল। গামছা দিয়ে এমনিতেই দুবার করে মুখটা মুছে লম্বা করে শ্বাস ফেলল। তারপরে সে বলতে আরম্ভ করল-‘দাদা, আপনাকে আমি আর কী বলব? বলার মতো কিছুই আমার মুখে আসছে না। আমার সর্বনাশ হয়েছে, দাদা আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। এখন আপনি রক্ষা না করলে আমাকে রক্ষা করার মতো আর কেউ নেই। আপনি তো জানেন দাদা, সাতোলার বাগানের কোণের সেইরূপিত জমিটা, সংসারে জমি বলতে আমার ওই ততটুকুই। সেই জমির ওপরে ছয় সাতটি ছেলে মেয়ের সঙ্গে আমার সম্পূর্ণ পরিবারেরজীবন নির্ভর করছে। আমার বাপ-দাদার আমল থেকে সেই জমি আমি নিজে হাতে চাষ করছি। গত দু'মাসে কী ভীষণ খরা গেল, এবার আবার জমিতে লাঙ্গল দেবার জন্য সুযোগ পাব বলে ভাবতে পারিনি।অবশেষে যেন ঈশ্বর চোখ মেলে তাকালেন।গতরাতে এক ঝাঁক বৃষ্টি হল। সকাল বেলা লাঙ্গল আর জোয়াল নিয়ে মাঠে বেড়িয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ চাষ করেছি মাত্র, তখনই দেখি সনাতন ঠিকাদার আমার জমিতে গিয়ে হাজির হলেন। তিনি আমাকে কী বললেন জানেন দাদা ? পুবের সূর্য পশ্চিমে উদিত হলেও আপনি বিশ্বাস করবেন। কিন্তু সনাতন চৌকিদার আমাকে যে কথা বলল আপনি বিশ্বাস করবেন না। তিনি আমাকে বললেন, আমার নাকি জমিতে হাল বন্ধ করা উচিত। কারণ সেইজমি নাকি তার, আমার নয়।কোনো কথা নেই বার্তা নেই আমার ঘরে এসে কেউ যদি বলে-‘ এই যে রসেশ্বর, তুই যে মহিলাকে নিয়ে আজ কুড়ি বছর ধরে ঘর করছিস, ছেলে মেয়ের জন্ম দিয়েছিস সেই মহিলা আসলে তোর নয়, আমার,তখন আমার মনের কী অবস্থা হতে পারে আপনি বলুন তো দাদা। সনাতনের কথা শুনে আমার ঠিক সেরকমই মনে হল। দাদা, তিনি এখন দাবী করছেন যে জমিটার নাকি তার নামে পাট্টা রয়েছে। আপনি সাক্ষাৎ থাকতে এরকম একটা দিনকেরাত করার মতো কথা হতে পারে কি? আমি আপনার পায়ে ধরছিদাদা,আপনি আমার পাট্টাটা দেখে দিন, আমার প্রাণটা রক্ষা করুন। আজ পুরোটা দিন আমি এক ফোঁটা জলও মুখে দিই নি। ‘উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে’র মতো সনাতনের ওপরে থাকা ক্রোধের বশে স্ত্রীকে গরুর মতো পিটিয়ে আধমরা করে এসেছি…।’

রসেশ্বর আর কিছুই বলতে পারলনা, ছোট ছেলের মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।

মন্ডল কিছুক্ষণের জন্য নীরব হয়ে রইল।আজ বিকেলের দিকে এসে সনাতন শর্মা তাকে একশো টাকা এবং পাঁচ কেজি চিনি উপহার দিয়ে গেছে। তিনি সনাতন কে সব রকম ভাবে সাহায্য করবেন বলে কথা দিয়েছেন।দুর্‍্যোধন এবং অর্জুন দুজনেই এসে শ্রীকৃষ্ণের কাছে সাহায্য চেয়েছিল। কিন্তুশ্রীকৃষ্ণ যেহেতুপ্রথম অর্জুনের মুখ দেখেছিলেন সেই জন্য তিনি প্রথমে অর্জুনকে কথা দিলেন। কিন্তু দুর্যোধনকে কি তিনি খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে পারলেন? দুজনকেই তাকে অক্ষৌহিণী সেনা দিতে হল। কিছুক্ষণ পরে নীরবতা ভঙ্গ করে মন্ডল ভেতরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন-‘এই যে, কে কোথায় আছিস, পানের বাটাটা দিয়ে যা’। আজ কোনোদিনই না আসা মানুষ আমাদের বাড়িতে এসেছে।’ তারপর রসেশ্বরের দিকে তাকিয়ে তিনি কন্ঠে মধু ঢেলে দিয়ে বললেন-‘তুমি মরা সাপকে ডিঙিয়ে না যাওয়া ঠান্ডা মানুষ। তোমার এই ধরনের বিপদ হয়েছে শুনে আমার খুব দুঃখ হচ্ছে।কী আর করবে,আজকাল সংসার ধর্ম বলে কোনো কথাই নেই, চারপাশে কেবল ‘জোর যার মুলুক তার’ নীতি। আমরা হলাম সামান্য চাকরিজীবী,নিয়মের দাস। নিয়ম যা বলে আমরা তাই করতে পারি। আজ সনাতন ঠিকাদারও আমার কাছে এসেছিল। জমির পাট্টাটা আমাকে দেখে দিতে বলল। আমি বললাম,পাট্টা কেন দেখতে হবে, সেই জমি বহু পুরুষ থেকে রসেশ্বরের জমি এ কথা সবাই জানে।কিন্তু তিনি ছাড়লেন না। খুব জোর করায় জমি সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখে আমি তো অবাক। হায় ভগবান, তোমার বাপ দাদার দিনের জমিতে দেখছি এবারের সেটেলমেন্টেসত্যি সত্যিই সনাতন শর্মার নাম উঠেছে। কেউ কেউ বলছে জমিটা নাকি তোমার পিতা সনাতনের কাছে বন্ধক রেখেছিল, বন্ধক ছাড়ানো হয়নি,তা নাহলে কাগজপত্র ঠিক করে রাখা হয়নি। কিন্তু নিয়ম, নিয়মই। সাতোলার বাগানের কোণের বিয়াল্লিশ নম্বর মেয়াদি পাট্টার উনপঞ্চাশ নম্বর দাগের জমির মালিক এখন শ্রীসনাতন শর্মা,পিতা স্বর্গীয় দিগম্বর শর্মা নামে পাট্টায় উঠেছে। এখন তুমি যা করার কর।‘

রসেশ্বর এতক্ষণ কান্নাটা সম্বরণ করেছিল,এখন মন্ডলের কথা শুনে লাজ লজ্জার কথা ভুলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।কাঁদতে কাঁদতে এবার সে সত্যিই মণ্ডলের পা জড়িয়ে ধরে বলল-‘দাদা,দাদা আমি আপনাকে ভগবানের নামে শপথ করে বলছি সাতটা ছেলেমেয়ে বধের ভাগী হবেন না। সেই কবে থেকে আপনি এই লাটের মন্ডল। আপনি ভালো করে জানেন আমার স্ত্রী যেমন আমার,তেমনই এই জমিটাও আমার। সনাতন ঠিকাদার কোনোদিন জমিতে পা রাখেনি,খাজনা দেয়নি, জমির চার সীমার কথা জিজ্ঞেস করলেও সে হয়তো বলতে পারবেনা।আপনি থাকতে সেটেলমেন্টের খাতায় তার নামটা কীভাবে উঠল ? মন্ডল এবার একটু বিরক্তির ভাব দেখিয়ে বলল-‘তোমাকে তো বললামই চুতিয়া,আমরা যা করি সমস্ত সরকারি নিয়ম মতে করি।আমার জানামতে জমিটা তোমারই।কিন্তু সনাতন তার মধ্যে একটা পয়েন্ট বের করেছে। তোমার পিতা যে জমিটা তার কাছে বন্ধক দিয়েছিল সেই বন্ধকছাড়িয়ে নেওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। তাই খরিদ্দার সূত্রে এবারের সেটেলমেন্টেসনাতন শর্মার নাম নথিভুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে তুমি আমার দোষটা কোথায় দেখতে পেলে ?

রসেশ্বর গামছার বাঁধনটা খুলে এন্ডির চাদরটা বের করল,তারপরে কাপড়টা মন্ডলের পায়ের কাছে রেখে হাতজোড় করে নমস্কার করে সে বলল-‘দাদা, যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে, আমারই ভাগ্যের লিখন।কিন্তু এখন আপনি কিছু একটা উপায় বের করে আমার মতো অভাগা কে উদ্ধার করুন।আপনি বুদ্ধিতে বৃহস্পতি বলে এই মৌজার সবাই জানে। আপনি আমাকে কিছু একটা বুদ্ধি না দিলে আর কে দেবে বলুন? এখন আমাকে কী করতে হবে বলুন?

ডিম্বেশ্বর মন্ডল আড়চোখেকাপড়টার দিকে একবার তাকিয়েই পরের মুহূর্তেমুখে একটা নির্বিকার ভাব আনতে চেষ্টা করল। বাক্স থেকে বের করে আনা নতুন কাপড়ের গন্ধ তার নাকে এসে লাগল।চোখ দুটো বুজে তিনি কিছুক্ষণ গন্ধটা উপভোগ করতে লাগলেন।রসেশ্বর ভাবল,মন্ডল তার জন্য কিছু একটা উপায় বের করার চেষ্টা করছে।এতক্ষণে দুশ্চিন্তা এবং উত্তেজনায় টনটন করতে থাকা তার দুর্বলতা এবার কিছুটা স্বস্তির ভাবে শিথিল হয়ে এল। সে একটা পান মুখে নিল এবং সেটা চিবুতে চিবুতে পরম আশায় মন্ডলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।এদিকে মন্ডলের মনে রসেশ্বরের চাদরটা এবং সনাতনের দেওয়া একশো টাকার মধ্যে টানা হেঁচড়া চলতে শুরু করেছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে মন্ডল বলে উঠল-‘তুমি আমাকে খুব চিন্তায় ফেলে দিলে চুতিয়া।একদিকে আইন, অন্যদিকে মানুষের স্নেহ ভালোবাসা। আইন রাখতে গেলে আমি তোমাকে কীভাবে ভালোবাসা দেখাই? তোমাকে ভালোবাসা দেখাতে গেলে আইন আমাকে ছেড়ে দেবে না কি? ছি কী যে করি এখন? বড় চিন্তায় ফেলে দিলে আমাকে।…অনেক ভেবে চিন্তে একটাই মাত্র উপায় আমি খুঁজে পেয়েছি। তুমি আধি বোর্ডে একটা মামলা কর।অবশ্য সেই মামলা করতে হলে তুমি যে আধিয়ার,জমির মালিক নও সে কথাটা মেনে নিতে হবে। তার বাইরে আর কোনো উপায় নেই। শাস্ত্রে রয়েছে-‘সর্বনাশে সমুৎপন্নে অর্ধং তজ্যতি পন্ডিতাঃ। এখন যা অবস্থা দেখা যাচ্ছে,আইন সনাতনের দিকে, তার সঙ্গে লড়াই করে তুমি জমিতে লাঙ্গল দিতে পারবে না। কিন্তু আধি বোর্ডে মামলা করে জিততে পারলে জমিতে চাষ করার অধিকার তোমারই থাকবে,সনাতন সেইজমিকে তোমার থেকে কেড়ে নিয়ে অন্যকে দিতে পারবে না।আগের থেকে তফাৎটা এই হবে যে তোমাকে এক বিঘা জমির ধান সনাতনকে দিতে হবে। কিন্তু কী করবে, অবস্থা দেখে ব্যবস্থা।বললামই না-সর্বনাশে সমুৎপন্নে…মন্ডলের মুখে সংস্কৃত শ্লোক শোনার জন্য রসেশ্বরের ধৈর্য্য ছিল না,সে পুনরায় হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে সে বলতে লাগল-‘এসব আপনার মুখে কী কথা দাদা ? এই ধরনের অন্যায় অধর্মের কথা কে কোথায় শুনেছে ? যে জমি আমার পুরুষানুক্রমে ভোগ্য সম্পত্তি সেই জমিতে আমাকে এখন আধিয়ার হতে হবে ? করব না দাদা,এই মামলা-মোকদ্দমা আমি করব না। আমাকে আমার সাত পুরুষের জমিতে হাল বাইতে কীভাবে আমাকে বাধা দেয় দেখে নেব। রাম দা’য়েরএক কোপে দুই টুকরো করে দেব। তারপর যা হয় হবে। আমার জেল,ফাঁসি যাহয় হবে,তবুও এই ধরনের অন্যায় কখনও সহ্য করতে পারবনা।’

গামছা দিয়ে সে চোখের জল মুছতে লাগল।

ম্নন্ডল পায়ের কাছে মাটিতে পড়ে থাকা এন্ডির চাদরটা বাটায় তুলে নিয়ে ভেতরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল-ও,আইকণ,আইকণ,এই বাটাটা ভেেতরে নিয়ে যা।’ চুতিয়া এতক্ষণ বসে রইল, এক কাপ চা ও দিলিনা। যা হল, হল। এখন দুটো পান সুপুড়ি দিয়ে যা।’ তারপরে রসেশ্বরের দিকে তাকিয়ে মন্ডল বোঝানোর সুরে বলতে লাগল-‘ক্রোধ হল চন্ডাল, মানুষ ক্রোধের বশে কিছু করা উচিত নয়। পারে না বা পড়ার মনের কথা ভুলে গেলি এই জমির সীমানা জন্যই ঝগড়া করে বল বাহাদুর ছাত্রীকে কেটে সে আজ 5 বছর ধরে জেলে করছে এদিকে তার ঘর বাড়ির অবস্থা কি হয়েছে সমস্ত পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে আমি তোকে যে বুদ্ধি দিয়েছি সেটা তোর ভালোর জন্যই এর চেয়ে ভাল বুদ্ধি তোকে কেউ দেবে না দিতে পারে না আগামীকাল তুই আমার কাছে আরেকবার আসিস মামলাটা কোথায় করতে হবে কিভাবে করতে হবে কাকে কাকে দেখা করতে হবে সমস্ত কিছু আমি তোকে ভালোভাবে শিখিয়ে দেবো এই কথাগুলি মন্ডল তখন রসের কে শিখিয়ে দিতে পারতেন কিন্তু তিনি বড় হিসেবী মানুষ সবকিছু ভালোভাবে না দেখেশুনে হিসেব না করে তিনি কোন কথা বলেন না তিনি জানেন যে দর্শক শ্রোতার ঘরে আবার আসবে খালি হাতে কখনো আসবে না আর কিছু না হলেও দুধ বা বাগানের শাকসবজি হাতে নিয়ে হলেও আসবে জিনিসপত্র আসন রাস্তাটা সে এখনই কেন বন্ধ করে দেবে?


চার

রসেশ্বর রাতে বাড়ি ফিরে দেখে সমগ্র ঘরটা অন্ধকার এবং নীরব নিস্তব্ধ। একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে সে কেরোসিন তেলের প্রদীপটা ধরিয়ে নেয় এবং শোবার ঘরে প্রবেশ করে। ছেলেমেয়েরা মায়ের সঙ্গে বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। সে ফিরে এসেছে জানতে পেরেও কেউ বিন্দুমাত্র সাড়া শব্দ না করে মরার মতো পড়ে রয়েছে। দৃশ্যটা দেখে সে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তার গলায় কিছু একটা আটকে আছে বলে মনে হল। কান্নার বেগটা সামলে নিয়ে সে বলল ‘সোনা ও সোনা এই বিকেলবেলা যে সবাই শুয়ে রইলি,ভাত খেয়েছিস কি?’

কেউ তার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সে গামছা এবং শার্ট নিয়ে কুয়োর পারে গেল এবং স্নান করে নিজেই রান্নাঘরে ঢুকল।অনেকদিন পরে সে আজ রান্নাঘরে ঢুকল। কোথায় কী আছে সে কিছুই ভালো করে জানে না। ভাতের হাড়িটা সে উনুনে বসিয়ে দিয়ে আলোর খোঁজে এদিকে ওদিকে তাকাতে লাগল।বাড়িতে একটিও আলো নেই। রান্নাঘরে সামনে বাইরের দিকে বেড়ার কোণে এক মুঠো ঢেঁকি শাক তার চোখে পড়ল। বোধহয় দুপুরবেলা রান্না করার জন্য তার স্ত্রী এনেছিল। রাতে শাক খাওয়া নিষেধ জেনেও নিরুপায় হয়ে সে ঢেঁকি শাকের মুঠোটা বাছতে লাগল। শুধু মাত্র তেল নুন দিয়ে সে ছেলে মেয়েদের সামনে কীভাবে ভাতের থালা এগিয়ে দেয় ? ভাত হওয়ার পরে সে নামমাত্র তেল দিয়ে ঢেঁকি শাক কোনোরকমে ভেজে স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের জাগানোর জন্য বাইরে বেরিয়ে আসে।

বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে অপরাধীর মতো করুণ এবং সংকুচিত কন্ঠে সে এবার প্রথমে স্ত্রীকে ডাকে-‘এইযে শুনছো, একটু ভাত খেয়ে নাও দুপুর থেকে উপোস করে আছ, কালকে বিছানা থেকে উঠতে পারবে না।‘ তারপরে সে ছেলেমেয়েদের এক এক করে গায়ে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগাতে লাগল-‘এই যে বাবা,মা আমার,তোরা উঠ,এই ভরা বিকেলে এভাবে ঘুমানো ঠিক না।’ সে চিৎকার করল, কিন্তু মা বা ছেলে মেয়ে কারও উঠার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। সে স্পষ্ট অনুভব করল যে ওরা কেউ ঘুমোচ্ছে না, কিন্তু প্রত্যেকেই এমনকি তিন বছরের শিশুটিও ভিডিও ঘুমের ভান করে তার বিরুদ্ধে নীরব বিদ্রোহ ঘোষণা করছে । পুনরায় একবার সে সবাইকে তোলার চেষ্টা করল কিন্তু সমস্ত চেষ্টাই মিথ্যা হল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সে বিছানার কাছে কিছুসময় দাঁড়িয়ে রইল। তারপরে রান্না ঘরে গিয়ে উনুনের আগুনটা এবং প্রদীপটা নিভিয়ে সে নিজেও এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

রসেশ্বর বিছানায় কিছুক্ষণ মরার মতো পড়ে রইল। তার দুই চোখ থেকে জলের ধারা গাল বেয়ে ঝরে পড়তে লাগল। যেহেতু ঘরটা সম্পূর্ণ অন্ধকার ছিল তাই সে চোখের জলটুকু মোছার কোনো চেষ্টা করল না। কিছুক্ষণ পরে চোখের জল শুকিয়ে গেল স্ত্রী জেগে আছে ধরে নিয়ে সে বলতে লাগল-‘ভাত যে খেলি না, ভালোই করলি। আর যে কখনও খেতে পাবি তারা আশা করিস না। জমিটা চাষ করে ছ'য়মাস খেয়ে ছয়'মাস আধাপেট খেয়ে কোনো ভাবে মতে দেহের মধ্যে প্রাণটাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। আজ থেকে তারও আর কোনো উপায় রইল না। সাত পুরুষের ভোগ করা জমি নাকি আমাদের নয়, সনাতন ঠিকাদারের। আজ সনাতন নিজে মাঠে গিয়ে আমাকে হাল বাইতে নিষেধ করে দিয়েছে । ডিম্বেশ্বর মণ্ডলের বাড়িতে গেলাম, মন্ডলও বলল-সেই জমিতে নাকি সত্যি সত্যি সনাতনের নামে পাট্টা উঠেছে। আমাকে নাকি এখন আধির জন্য মামলা করতে হবে। আমি সাধারণ একজন মানুষ, ঠিকাদারের সঙ্গে কোন সাহসে মামলা করতে যাব? এদিকে মামলার শেষে জমি না পেলে তো কথাই নেই, পেলেও তো এই বছরের জন্য ভাঁড়ারের ভাত খাওয়ার কোনো আশা রইল না। আমি একা মানুষ মামলার জন্য কাছারিতে উকিল মুহুরির পেছনে ঘোরাঘুরি করব না তোদের লালন পালনের জন্য হাজিরা কাজ করব? কোনো দিকে আমি কোনো উপায় দেখতে পাচ্ছি না। একটাই মাত্র উপায় খুঁজে পেয়েছি বিছানায় শুয়ে থাকার সময়ই একদিন তোদের প্রত্যেককে এক এক করে কেটে পরে নিজেও গলায় দাওয়ের কোপ বসিয়ে সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণার শেষ করব।নয়টি প্রাণীর রক্ত খেয়ে সনাতন ঠিকাদার সংসারের সুখ ভোগ করুক। আমাদের মত মানুষের জন্য এই সংসারে কোনো জায়গা নেই।’

কথাটা বলে রসেশ্বরের এর বুকটা যেন হাল্কা বলে মনে হল। সারাদিনের অনাহার, উত্তেজনা এবং ক্লান্তি এখন তার শরীরে ক্রিয়া করতে শুরু করেছে। ঘুমে তার চোখের পাতা দুটি ভারী হয়ে এল। কিন্তু সে কিছুক্ষণ জোর করে জেগে থাকার চেষ্টা করল।রসেশ্বর আশা করেছিল যে তার স্ত্রী সারা দিনের অদ্ভুত আচরণের অর্থ এখন হৃদয়ঙ্গম করে কিছু একটা কথা নিশ্চয়ই বলবে, তাকে সহানুভূতি দেখাবে,তাদের সামনে এসে পড়া জীবন-মরণ সমস্যার সমাধানের জন্য কিছু একটা উপায় খুঁজে বের করবে। তার মনে হল মুহূর্ত গুলি,অতি যন্ত্রণাদায়ক মুহূর্তগুলিতে কেউ ছেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া বড় একটি পাথর যেন তার ক্লান্ত শরীরের উপর দিয়ে তার চেতনাকে পিষ্ট করে পার হয়ে যেতে লাগল। অন্ধকারে চোখ দুটো বড় করে মেলে সে অপেক্ষা করে রইল, এখনই স্ত্রী নিশ্চয় মুখ খুলবে, কিছু একটা কথা বলব, কথা বললেই সে বুঝতে পারবে যে স্ত্রী তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। স্ত্রী এখন সমস্ত কিছু বুঝতে পেরেছে, আজ রাতের জন্য তার আর কিছুরই প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন মাত্র তার মুখের এতটুকু কথা, তার মুখের একটু কথা শুনতে পেলেই সে আগামীকালের ভয়ঙ্কর এবং অনিশ্চিত দিনটির মুখোমুখি হওয়ার আগে অন্তত আজকের রাতটা কিছু শান্তিতে ঘুমোতে পারবে।

… সে অপেক্ষা করে রইল, তারপরে এক ভয়ঙ্কর নীরবতার মধ্যে সে ধীরে ধীরে বিভীষিকাময় এবং দুঃস্বপ্নে ভরা ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল।


ক্রমশ ...