বুধবার, এপ্রিল ২৪, ২০২৪

সুপ্ত মনের জাগর ধ্যান

জামিলুর রহমান একটি বড় অফিসের ছোট কর্মকর্তা। ছোট দুটো বোনের বিয়ে দিয়ে মাকে নিয়ে মা-বাবার কেনা ফ্ল্যাটে শান্তিনগর থাকে। জামিল বিয়ে করবে না করবে না বলে বয়স বত্রিশ ছুঁয়েছে। বোন দুটির বিয়ের পর পরিবারের অবশিষ্ট কোনো দায়-দায়িত্ব ছেলের জন্য ছিলো না। তাই মা-বাবা একসাথে তাকে বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করতে করতে মাত্র ছ’মাস হলো কোনো জটিল রোগ-বালাই ছাড়াই অকস্মাৎ বাবা গত হয়েছেন।

এর ভেতর একসন্ধ্যায় জামিল অফিস থেকে ফিরেই মাকে বললো, আমি একজনকে পছন্দ করেছি। এবার বিয়ে করবো। ‘বত্রিশ পেরুনো, চাকরিজীবী, তার ওপর মায়ের একমাত্র ছেলে বিয়ে করবে, মায়ের প্রাণ আনন্দে ভরে যাওয়ার কথা। কিন্তু ছেলে যেভাবে বললো, তাতে একজন সাধারণ স্কুল শিক্ষিকা, মধ্যবিত্ত পরিবারের আটপৌরে মা খায়রুন্নাহার অবদমিতই হয়ে গেলেন। যেন ছেলের বিয়েতে পাত্রী সম্পর্কে মায়ের মতামত, দেখাশোনার মতোও কোনো ভূমিকা থাকতে নেই।

সেদিন ছেলের এই কথার পর থেকে মা এ-বিষয়ে আর কোনো কথা বলেন না। এভাবে ছেলের সাথে কেটে যায় এক সপ্তাহ। কিন্তু খায়রুন্নাহার ছেলের বিয়ের বিষয়ে ছেলের সাথে কথা না বললেও ফোনে ফোনে তার মনের ভাব জাহির করতে থাকেন দু’দিকে দুই মেয়ের কাছে। বলেন, আমার একমাত্র ছেলে বিয়ে করবে এ তো আমার জন্য সবচেয়ে সুখের কথা। ছেলের বউ দেখতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে তোমাদের বাবাকে গত হতে হলো। কিন্তু আমাকে তো জামিল মেয়ের পরিবারের বিষয়ে আগে সবকথা খুলে বলবে, কেমন কি। আমার তো মনে হচ্ছে আমাদের কারো মতামতের কোনো অবকাশ না রেখেই ও একা ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে! প্রতিদিন সে মেয়ের সাথে দেখাও করছে বলে মনে হয়।

দুটি বোনই জামিলের ছোট। বড়টির নাম হেনা। ছোটটি হাসনা। জামিলের বোন দুটি একই রকম করে মাকে বোঝায়, ‘মা, বিষয়টা এত ভারী করে তুলো না তো! ভাইয়া বিয়ে করে একা বউ বাড়িতে নিয়ে এলে সেটা আমাদের জন্য আরো ভালো। কারণ আমরা ঠিক করলে দেখা যেতো ভাইয়া কখন মাঝপথে সটকে পড়ে আমাদের বিপদে ফেলেছে। মনে নেই তোমার, বাবা মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে পাত্রীর বাড়িতে গিয়ে আলোচনার দিন সে পালিয়েছিলো। আমাদের আগে যেতে বলে সে যায়নি। তারপর পাত্রীপক্ষ আমাদের কেমন ধোলাইটা দিলো। বাবাকে বলেছিলো, আপনারা ছেলের মতামত না নিয়ে এতদূর এগিয়েছেন কেন? এই নিয়ে তো তোমার জামাইদের কাছেও আমরা দু’বোন মুখ খুলতে পারি না!’

এক সপ্তাহ পরে একদিন জামিল একটি আংটি কিনে মাকে বললো, ‘হেনাকে এবং হাসনাকে আগামীকাল ছুটির দিন আসতে বলেছি। ওরা যার যার হাজবেন্ডকে নিয়ে আসবে। দুপুরে আমাদের এখানে খাবে। বিকেল নাগাদ আমরা তাসরিনদের বাসায় যাবো। তুমি আংটি পরিয়ে বিয়ের দিন ঠিক করে আসবে।’

খায়রুন্নাহারের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। মনে মনে ভাবলেন, যাক, ছেলে এটুকু দায়ভাগ না দিলেও তার করার কিছু ছিলো না। পরদিন সবাই হৈচৈ করেই পাত্রী দেখতে গেলো। পাত্রী জাহির করার মতো সুন্দরী না হলেও সবারই পছন্দ হলো। তাসরিনের বাবা-মা দু’জনেই ব্যাংকের উঁচুপদে চাকরি করেন। তিন বোন তারা। এটা দ্বিতীয়। ইডেন থেকে মাস্টার্স করে চাকরির চেষ্টা করছে। বিসিএসের জন্যও প্রস্তুতি চলছে। আপাতত একটি বেসরকারি কলেজে পড়াতে ঢুকেছে। ছোট মেয়ে মাহরিন হলিক্রসে থার্ড ইয়ারে পড়ছে। বড় মেয়ে শারমিন একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করছে। সেখান থেকেই কলিগকে পছন্দ করে বিয়ে করেছে।

গোছানো ড্রয়িং রুমের দরজা গলিয়ে যতদূর দৃষ্টি যেতে পারে, আত্মীয়-স্বজন সম্পর্কে যা শুনে চলেছেন, পুরোটা ভালো লাগছে খায়রুন্নাহারের। কিন্তু খাবার মুখে তুলে তিনি টের পেলেন সব বিস্বাদ লাগছে এবং ক্রমে এও টের পেলেন তার ভেতরটা দমে আসছে। আর তার কারণ এই বিয়ের যিনি ঘটক, ছেলের ইমিডিয়েট বস সাব্বির আদনান। সাব্বির সম্পর্কে কনের বাড়ির কেউ নন। সে কলেজে পড়াকালীন সময় থেকে ওদের তিন বোনকে পড়াতো। পড়াতে পড়াতে সে তাদের বড় ভাইয়ের স্থান অধিকার করে আছে। বাড়ির ছেলের মতোই তার বাড়িময় অবাধ যাতায়াত। কনের মা-বাবা দু’জনই এখনো সাব্বির সম্পর্কে খুবই স্নেহপ্রবণ বুঝলেন খায়রুন্নাহার। তাদের দু’জনেরই যখন অফিস ট্যুর করতে হয়েছে, তখন সাব্বিরই নাকি রাতে এসে এদের বাসায় থেকেছে। মোট কথা সাব্বির তাদের মেয়েদের বড় ভাইয়ের স্থান জুড়ে আছে। আর এই কথাগুলো পাত্রপক্ষের কাছে বলতে তাসরিনের মা-বাবা দুজনেই খুব আত্মপ্রসাদ বোধ করছিলেন। বলেছিলেন, একটা সময় থেকে তাদের মনে হয় না, সাব্বির তাদের ছেলে নয়!

খায়রুন্নাহার আড়চোখে দেখছেন রসুইঘর থেকে নাস্তা টেনে আনা থেকে পরিবেশন করতেও সাব্বিরই বেশি তৎপর। চৌকশ কর্মকর্তা হিসাবে অফিসেও সাব্বির আদনানের অনেক সুনাম। জামিলের কাছে খায়রুন্নাহার অনেকবার তার নাম শুনেছেন। জামিলকে সাব্বির আদনান পছন্দ করেন খুব। তাই নিশ্চিন্তে ভগ্নিতুল্য তাসরিনের জন্য তাকে মনে ধরেছে।

কিন্তু খেতে খেতে টেবিলের সব সাবাড় হয়ে এলেও খায়রুন্নাহার ছেলের মা হিসাবে তাসরিন বা তার মা-বাবাকে কোনো প্রশ্নই করছেন না। বিয়ে সংক্রান্ত কোনো প্রসঙ্গও তুলছেন না। আর এতে তার দুই মেয়েসহ জামাইয়েরাও বিব্রত বোধ করতে শুরু করলো। যেন তারা খেতেই আসছে। জামিলের তো ধৈর্য বাঁধে এসে ঠেকেছে। কিন্তু মাকে তা বলতে পারছে না কারণ, মায়ের প্রতি তার আচরণের ধরণ দেখে আবার যদি বিয়ে ভেঙে যায়। যদি তাসরিনের মা-বাবা মনে করেন, জামিল একটা বেয়াদব!

সবার খাওয়া শেষ হলে কিছুক্ষণ পর খায়রুন্নাহার তার ভ্যানিটি ব্যাগ খুললেন। এতে সবাই ভেবেছিলো, তিনি আংটি বের করছেন। কিন্তু আংটি নয়, তিনি পাঁচ হাজার টাকা তার ব্যাগ থেকে বের করে, আরেক হাতে একটি প্যাকেট খুঁজে বের করে, সবার সামনেই তাতে টাকাটা পুরে সামনে বসা তাসরিনের হাতে দিয়ে, তার মা-বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমরা আজকে যাই। আরেকদিন আপনার মেয়েকে আংটি পরাতে আসবো’ বলে কাউকে কিছু না বলে খায়রুন্নাহার একাই উঠে পড়লেন। দুইপক্ষের সবার এতক্ষণের উৎফুল্ল মুখ ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া হয়ে গেলো। জামিল একটু সরে দাঁড়িয়ে মাকে ইশারা দিলো তার কাছে যেতে। মা তাকে ঝাড়া কণ্ঠে বললেন, আমরা দুদিন পরে আসি!

খায়রুন্নাহার গাড়িতে উঠতে উঠতে মেয়ে-জামাইদের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমাদের তো এখান থেকেই যার যার বাসায় ফেরার কথা। কিন্তু আগে আমাদের বাসায় চলো। আমরা এতবড় সিদ্ধান্তটি নেয়ার আগে, সবাই মিলে আরেকটু আলোচনা করি।

অতএব সবাই যখন যে যার গাড়িতে আগে পরে মালীবাগ থেকে শান্তিনগর খায়রুন্নাহারের ফ্ল্যাটে পৌঁছুলো। খায়রুন্নাহার তখন সবাইকে ড্রইংরুমে বসতে বলে দক্ষ রাঁধুনী প্লাস গৃহকর্মীকে বলে এলেন সবার জন্য ডিনারের আয়োজন করতে। এর ভেতর তিনি জামিলের সাথে একই গাড়িতে এলেও পথে একটি কথাও বলেন নি! জামিল অনবরত ফোঁসফোঁস করেছে। বলেছে, ‘এইজন্য তোমাকে আগে থেকে বলিনি। তুমি আম্মা খুব ঝামেলার মানুষ!’ ছেলের এত বড় অভিযোগের পরেও খায়রুন্নাহার চুপ করেই ছিলেন।

খায়রুন্নাহার নিজেই চা এনে টেবিলে রেখে বললেন, এই গল্পটা তোমাদের কাছে এভাবে করতে হবে, এই এমন দিন আমার জীবনে আসবে আমি তা কখনো ভাবিনি! বিষয়টা ভুলেও গিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে মনে হলো, ধীরে ধীরে পর্দা সরে নাটকের দৃশ্যের মতো চোখের সামনে পুরনো একটি গল্প ভাসতে লাগলো।

জামিল মাকে ধমকে উঠলো, যা বলতে চাও খোলাশা করে বলো তো আম্মা! এত ভূমিকা করো না!

খায়রুন্নাহার জানেন ছেলের রগচটা স্বভাব। তাই তার কথায় যেন কর্ণপাত করলেন না, এমন ভাবধরে চুপ হয়েই থাকলেন।

কিন্তু বহু পুরনো সে গল্পটা যেন টেপ রেকর্ডার ছেড়ে নিজে আবার শুনছেন। গল্পটা তার স্বামী একরামকে শুনিয়েছিলো তারই একজন বুজম ফ্রেন্ড। খায়রুন্নাহারও বিয়ের আগে একরামুল হকের বন্ধু ছিলেন। একসাথে তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন। আজীবনই তাদের সম্পর্কটা বন্ধুর মতো করেই দু’জন রেখেছিলেন। তাই স্বামীর বন্ধুদের অনেকেই খায়রুন্নাহারের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। এর ভেতর আনোয়ার ছিলেন কলেজজীবন থেকে একরামুলের বেশি ঘনিষ্ঠ। আনোয়ার দারুণ চৌকশ, দারুণ রোমান্টিক ছিলেন দেখতে। একদিন তিনি একটু বেশিই প্রগলভ হয়ে খাবার টেবিলে খায়রুন্নাহারের সামনে নিজের অতীত জীবনের এক গল্প বলতে শুরু করেছিলেন। গল্পটি এরকম-

কলেজে পড়ার সময় একবাড়ির তিন মেয়েকে পড়াতাম। দীর্ঘদিন পড়াতে পড়াতে ওই বাড়ির ছেলের মতো হয়ে যাই আমি।

মেয়ে তিনটির মা-বাবাও একসময় আমাকে ছেলের মতো দেখতে লাগলেন। কাউকে কোথাও নিয়ে যেতে হলে গার্জিয়ান হিসাবে আমিই যেতাম। বড় মেয়েটার চেহারা অত ভালো ছিলো না। তিন বোনের ভেতর দ্বিতীয়জনকে আমার খুব ভালো লাগতো। আলোতে আঁধার এসে মেশা এক সন্ধ্যায় তাকে তার রুমে একা দেখে আমি ছুটে গিয়ে পিছন থেকে জাপটে ধরলাম। ভাবছিলাম সে ছোটার জন্য ছটফট করবে। এজন্য একটু বেশিই জোরে ধরেছিলাম। কিন্তু সে আমার মুখের দিকে মুখ উঁচু করে আবেশ জড়ানো কণ্ঠে বললো, ‘এতদিনে বুঝলে?’ সে কথা বলাতে বুঝতে পারলাম, মারাত্মক ভুল করেছি। ও দ্বিতীয় নয়। বড়জন!

একরামুল হক কিছু বলেন নি, খায়রুন্নাহারই গায়ে কাঁটা নিয়ে বলেছিলেন, তারপর?

আনোয়ার বলেছিলেন, তারপর আর কি! ধরেছি যখন ছেড়ে তো দিতে পারি না! তাহলে তাকেই আশাহত করা হয়। তারপর একদিন সময় এলো দ্বিতীয়টাকে কব্জার ভেতর পাওয়ার। সেও কোনো বাঁধা দিলো। কিন্তু একটা মুশকিল হয়ে গেলো সেদিন।

আনোয়ার থামলে এবারও খায়রুন্নাহার বললেন, কি মুশকিল হলো?

আনোয়ার তেমনি ফুরফুরে মেজাজে বলে যেতে লাগলেন, দ্বিতীয়টির সাথে যা করেছি, ছোটটা হঠাৎ রুমে এসে দেখে ফেলে। এতে দ্বিতীয় খুব ভয় পেয়ে যায়। সে আমাকে বলে তুমি ওকে বোঝাও ও যেন মা-বাবা, আপা কাউকে এই ঘটনা না বলে! আমি নিজেও খুব ভড়কে গিয়েছিলাম। একটু থিতু হয়ে দোকান থেকে চকলেট এনে ছোটটাকে ডেকে ছাদে নিয়ে গেলাম। তারপর একথা সেকথা বলে তার হাতে চকলেটের আস্ত প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে বলতে লাগলাম, যা দেখেছো, তা কাউকে বলবে না কেমন? কিন্তু বারো-তেরো বছরের ছোট তখন আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, ‘বলবো না। তবে ছোট আপাকে যা করেছো, আমার সাথেও তোমার তাই করতে হবে!’

তখন মাত্র বছর দুয়েক হয় খায়রুন্নাহারের বিয়ে হয়েছে। যিনি গল্প করছেন, যে দু’জন শুনছেন, সবাই তারা সমবয়সী। আর তাদেরই একজন নিজের জীবনের এমন নিষিদ্ধ বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা কি এক বেঘোরে শোনাচ্ছেন, মানব মনের সব অন্ধি-সন্ধির জট সেদিন আবার নতুন করে কেমন আগলা হয়ে উঠছিলো খায়রুন্নাহারের কাছে। তিনি এতক্ষণ যা রুদ্ধশ্বাসে শুনছিলেন, এবার দম ছেড়ে দিয়ে বললেন, তারপর আপনি কী করলেন?

আনোয়ার হো হো করে হেসে বললেন, তাকেও করলাম! জানো, সেই থেকে আমার নেশা চেপে আছে কোনোখানে মা ও মেয়েকে একসাথে...! এই অভিজ্ঞতাটা আমার হয়নি কখনো!

খায়রুন্নাহার পরে বুঝেছেন, আনোয়ার নামের জানোয়ারটাকে তখনই ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে বের করে দেয়া উচিত ছিলো। কিন্তু তখনই পিটিয়ে না বের করলেও, সেই ডাইনিং টেবিল থেকেই একরামুল ওকে এমন শীতল মনোভাব দেখালেন, যে সেখান থেকেই তিনি উঠে যেতে বাধ্য হলেন। জীবনেও আর তার নাম তারা দু’জন মুখেও আনেননি। কিন্তু আনোয়ার যদি নিজে সেদিন তার ওইসব কথা না বলতেন, তাহলে জানাই হতো না এমন এক হারামজাদা মানুষ ভদ্র বেশে ওদের বন্ধু হয়ে আছেন। আনোয়ার চলে যাওয়া মাত্র একরামুল স্ত্রীকে ধমকে বলেছিলেন, তুমি কেন ওকে থামিয়ে না দিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে আরো উসকে দিয়েছো?

খায়রুন্নাহার বলেছিলেন, এটা মানুষের প্রবণতা। তুমি কি মনে করো সুযোগ পেলে তোমার এই আনোয়ারের মতো অন্য কেউও তার সদ্ব্যবহার করবে না? প্রায় সব মানুষই ভালো থাকে সুযোগের অভাবে।

একরামুল হক বললেন, দেখেছো, ব্যভিচারের প্রভাব? মানুষ একের পর এক যাচ্ছেতাই বিয়ে করেও সে প্রহসনের বউয়ের সাথেও কতকিছু করে, কিন্তু সে ক্ষেত্রে বিছানার গল্প কিন্তু কেউ অন্য কারো সাথে করে না। অথচ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে বলতে কারো ক্লান্তি নেই। লজ্জা নেই। একের পর এক তিন তিনটি মেয়ে ছাড়াও তাদের মা পর্যন্ত সে ভেবেছে! আমি অন্তত এ-গল্প পছন্দ করবো না জেনেও আনোয়ারের রিপু তাকে দিয়ে কী বিচ্ছিরি সত্যিটাকে সেই আমাদের দু’জনের কাছেই প্রকাশ করিয়ে নিলো। আমার এত দিনের বন্ধু। অথচ জানাই ছিলো না ও এমন একটা জানোয়ার। একসময় জানতাম ও দীর্ঘদিন ধরে একবাড়িতে টিউশনি করে, তারা ওকে ছেলের মতো ভালবাসে। ওকে তারা দামি কাপড় চোপড় কিনে দেয়া ছাড়াও যখন তখন এমনি এমনি বেশ কিছু করে টাকাও দেয়। মফস্বল শহর থেকে আসা ওর ঢাকাতে নিজের ঘনিষ্ঠ কোনো আত্মীয় ছিলো না। ভালোই হলো আজ ও নিজের মুখে এই গল্প বলে, এ বাড়িতে তার আসা বন্ধ হলো।

: জানো, আমার আব্বা আমাদেরকে এতো শাসন করতেন, তখন তাকে খুব অত্যাচারী মনে হতো। কিন্তু বড় হতে হতে বুঝেছি খুব কড়া শাসন না হলেও, মেপে চলা একটা ধারণার ভেতর না থাকলে জীবনের স্বাদটাই নষ্ট হয়ে যায়। কোনো ইচ্ছেতেই আর লাগাম থাকে না। শেষে নিজেকে আর কোনো ছকে বাঁধা যায় না। হিতাহিত জ্ঞান অর্জন না হওয়ায় শেষে সবটাকেই প্রগতির ধ্বজা মনে হয়। শুনলে তো আনোয়ারের শেষের কথাটা! তাও তিনি আবার একজন মহিলা কলেজের শিক্ষক। কৃতকর্মের জন্য এতদিনে তার একটু অনুশোচনা পর্যন্ত হয়নি!

: আমাদের বাবা-চাচাকে নিজেদের ছেলে-ভাইদের উদ্দেশ্যে বলতে শুনেছি, যেখানেই বিয়ে ঠিক করবে, খেয়াল করবে সে বাড়ির মেয়েরা মা-বাবা আর নিজের ভাই ছাড়া অন্য কোনো সাথে সিনেমা দেখতে বা বেড়াতে যায় কি না। এমন কি ভগ্নিপতিদের সাথেও চলাফেরা করে কি না। একা একা বা দলবেঁধে চলাফেরাটা কোনো দোষের নয় এবং দেখো তাদের ভেতর বাড়িতে ভাগ্নে-ভাস্তেদের গতি কতদূর! আর এটা শুধু মেয়েদের বেলায়ই একাই বা প্রযোজ্য হতে হবে কেন? ছেলেদেরও একটা সীমা বোঝানো উচিত। মূল্যবোধ কি তাদেরও দরকার নয়!

: একটা বাড়িতে দু’জন নরনারী ঘোষণা দিয়ে লিভটুগেদার করুক, সেটা দোষের নয়। কিন্তু জনসমক্ষে মামা-চাচা ডেকে একই ছাদের নিচে থাকা মানুষেরা সমাজ কলুষিত করে এবং যে মা-বাবা এরকম সোমত্ত মেয়েদের ভেতর বাইরের ছেলে ঘুরঘুর করতে দেয় বা রক্ষক হিসাবে রাখে, এদের মা-বাবা হওয়ার যোগ্যতাই নেই! এটা যারা করে, বাঁধা গরুকে ঘাস খাওয়ানোর মতো কাজ করে।

সবার কাপের চা শেষ হয়ে গেলেও খায়রুন্নাহারের মুখে কোনো কথা নেই! একসময় ছোট জামাই বলে উঠলো, ‘আম্মা, আপনি আরেক দফা আমাদের ডাকলেন কি ভুরিভোজন করাতে? আমার অনেক কাজ রেখে চলে এসেছি, শুধু আপনি কী বলেন শুনতে।’

বড় জামাই বললো, ‘আমাদেরও তো একসয় আপনার মতো ভূমিকা নিতে হতে পারে, আমাদেরও ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে। তাই আমি এলাম, কী বলেন তার থেকে শিক্ষা নিতে।’

হেনা-হাসনা উসখুস করতে লাগলো। আর জামিল তো মাতৃহত্যার দায়ে এখন ফাঁসিতে ঝুলতে হলেও জানতে আগ্রহী, কেন মা এমন খামখেয়ালি আচরণ করলেন। কিন্তু খায়রুন্নাহার আনোয়ারের মুখ থেকে হুবহু যা তার জীবনের কাহিনী শুনেছিলেন, সে কথা তিনি নিজের ছেলেমেয়ে-জামাইয়ের কাছে বলতে গিয়ে পারলেন না। তার গলায় কাঁটার মতো আটকে থাকলো। তিনি একসময় খালি এটুকুই বললেন, এই বিয়েতে আমার সম্পূর্ণ অমত। তার কারণ ওই সাব্বির আদনান।

সবাই একসাথে বলে উঠলো, সাব্বির আদনান আবার কী করলেন? আপনি কি আগে থেকে চিনতেন তাকে?

খায়রুন্নাহার বললেন, ‘মা-বাবা বাসায় নেই অথচ ছোটবড় তিনটি সোমত্ত মেয়ের ভেতর একটি উঠতি বয়সী ছেলে সারাবাড়ি বিচরণ করছে! দীর্ঘদিন অবাধে বাড়িটিতে থেকেছে।’

হেনা, হাসনা একসাথে বলে উঠলো, মা তুমি স্কুলে শিক্ষকতা করে এইসব কূপমণ্ডুকতা আঁকড়ে থাকলে চলবে?

: এটা কূপমণ্ডুকতা নয়। এটুকু সীমা লঙ্ঘনই প্রগতির অন্তরায়। বাইরে ছেলেদের সাথে দৌড়-ঝাঁপ, মিটিং-মিছিল, মেধার প্রতিযোগিতায় নামো, শক্তি চর্চায় নামো তাতে অভিনন্দন। কিন্তু সেটা বাড়ির ভেতরে অন্যের ছেলেকে অবাধে থাকতে দেয়া প্রগতির অংশ নয়। এমন কি মা-বাবা দু’জনের কেউই যখন বাসায় নেই, তখন তো আরো নয়। ‘পৃথিবীতে সব অঘটনগুলো সুন্দর ঘেরাটোপের নিচেই ঘটে’ বলে তিনি স্বামীর বন্ধু অনোয়ারের গল্পটি একটু একটু করে রয়েসয়ে ছেলেমেয়ের কাছে বললেন।

জামিল বেশ চটেই মাকে প্রশ্ন করে, তাই বলে, তুমি আমার বসকে আনোয়ার সাহেবের মতো ওইরকম ধুরন্ধর ভাববে?

খায়রুন্নাহার চটলেন না। তিনি শান্তস্বরে বললেন, ভাবছিলাম কই? আনোয়াকে দেখতে সাব্বিরের চেয়ে ইনোসেন্ট লাগতো। এসব কথা নিজে না বললে, পৃথিবীতে অন্য কেউই জানে না! তোমার বস নয়, মনে করো তুমিই ওই তিনটি মেয়ের ভেতর অবাধে বিচরণ করার সুযোগ পেয়েছো একেবারে উঠতি বয়স থেকে। ওদের মা-বাবা ট্যুরে গেলে তুমি তাদের গার্জিয়ান সেজে ওই বাড়িতে থেকেছো। তারপরও কি তুমি তাদের নেহায়েত একজন ভাই হয়েই থাকতে পারবে? এখন বড় হয়েও যদি এসব বিষয় না বোঝো, মা হয়ে মর্মে ঘা দিয়ে হলেও আমার এটা বোঝানো দায়িত্ব বলে আমি মনে করি।

জামিল কিছু বলতে যাচ্ছিলো। খায়রুন্নাহার তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, না, অযথা কথা কাটাকাটি করো না। আর এখনি কোনো উত্তরও দিতে হবে না। সাতদিন তোমরা সবাই ভাবো। ভেবে যা হয়, করো। তবে আমি এর ভেতর আর নেই। আর শোনো, হজরত আয়েশা (রাঃ) তার পিতা হজরত আবু বক্কর (রাঃ)-এর সাথে নিরালায় কথা বলছিলেন। রাসুলুল্লাহ সেখানে গিয়ে তা দেখে বললেন, ‘যদিও আপনারা পিতা এবং পুত্রী, তবু আপনাদের ভেতর আরেকজন থাকা উচিত ছিলো।’ তাই ক্ষেত্র বিশেষে কিছুটা ধর্মীয় অনুশাসনও মানতে হবে। কারণ সেগুলোও মানুষের কল্যাণের জন্য তৈরি। এমনকি সব দেশে রাস্তার পাবলিক টয়লেটগুলো নারী-পুরুষের জন্য আলাদা! যে সব দেশে মেয়েরা ছেলেদের সাথে বিকিনি পরে সমুদ্রে নামে। হাফপ্যান্ট আর ছোট জামা পরে রাস্তায় চলাফেরা করে তাদের দেশেও। তার মানে একটা পর্যায়ে পরস্পরের কাছে গোপনীয়তা বজায় থাকতে হবে। নাহলে সীমারেখা বলতে কিচ্ছুটি থাকলো না। তখন কার বাবা কে সে সার্টিফিকেট গলায় ঝুলিয়ে চলতে হতো।

সাতদিন পর কেউ আর জামিলের বিয়ের বিষয়টি নিয়ে একত্র হলো না। তবে খায়রুন্নাহারের কথা সবাই টায়টায় মানতে না পারলেও, তাদের সবারই মর্মচক্ষুর পর্দায় কমবেশি টান পড়েছে। অবশ্য এর ভেতর একদিন জামিল মায়ের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে, আমার বস সাব্বির যদি ওদের কারো প্রতি দুর্বল থাকতো, তাহলে, ওদের কাউকে বিয়ে করতো না?

খায়রুন্নাহার বললেন, এর উত্তর দু’টি। সাব্বির যদি আনোয়ারের মতো সব সয়লাব করে ফেলে, তাহলে কাকে বিয়ে করবে? আর সে বয়স অনুসারে বড়মেয়েটিকে বিয়ে করতে পারতো। তাসরিনের মা-বাবা হয়তো সব মিলিয়ে তাকে পাত্র হিসাবে পছন্দ করেননি। অথবা সেই হয়ত কাউকে বিয়ে করতে চায়নি। এসব ক্ষেত্রে তাই হয়।

খায়রুন্নাহার শহরে বড় হলেও তার নানা বাড়ি-দাদাবাড়ি দুই বাড়িই পাশাপাশি দুই গ্রামে। আর ওই দুই বাড়ি গ্রামে হওয়াতে তিনি দুই জায়গাতেই সমানভাবে গিয়েছেন। সবরকমের মানুষ সম্পর্কে টুকরো-টাকরা অনেক অভিজ্ঞতাই তার আছে। শৈশবে গ্রামে বসবাস করা নিজের কাজিনেরা ছাড়াও যে সব ছেলেমেয়েদের সাথে দেখা হতো, এখনো তারা সবাই মনে ছায়ার মতো মায়া হয়ে মিশে আছে। আজো তাদের কথা মনে হলে অন্তরে টান পড়ে। নানার বাড়িতে খায়রুন্নাহারের থেকে একটু বড় তার এক দুঃসম্পর্কের মামাতো বোন ছিলো। নাম পাপিয়া। একদিন খায়রুন্নাহারের নানার উঠোনের কল থেকে পাপিয়া পানি নিতে এসে, খায়রুন্নাহারকে ইশারায় ডেকে আড়ালে নিয়ে উৎফুল্ল হয়ে বলেছিলো, আমার জীবনে একটা ঘটনা ঘটছে! খায়রুন্নাহারের তখন ফাইভ সিক্সে পড়ার বয়স। পাপিয়ার হয়তো ক্লাস সেভেন। তাই জীবন কি তাই তো খায়রুন্নাহার তখন জানতেন না। তার ওপর আবার ঘটনা! তবু খায়রুন্নাহার উদগ্রীব হয়ে বলেছিলেন, কি ঘটনা?

পাপিয়া খায়রুন্নাহারকে তার নানার বাড়ির শেষ কোণায় মসজিদের কাছে টেনে নিয়ে মসজিদের দেয়ালে ওর হাত নিজের হাতে চেপে বললো, এই যে মসজিদ ছুঁয়ে ক, কেওরে কবি না?

খায়রুন্নাহার বলেছিলেন, না বলবো না!

পাপিয়া বললো, বল, আল্লাহার কিরে, খোদার কিরে, নবী-রসুলের কিরে?

খায়রুন্নাহার এইসব কিরা-কসমের ভার কিছুটা বুঝতে শিখে গিয়েছিলেন তখন। তিনি তাই বিবশ মনে পাপিয়ার সাথে আরো অনেকক্ষণ ধরে আরো সব শর্ত বেকসুর গিললেন, খালি তার সেই কথাটি শোনার জন্য। কারণ নিষিদ্ধ সব বিষয়ের টান তারও বুঝি শরীরে মনে ফুটতে শুরু করেছিলো সেই তখন থেকেই। পাপিয়া বলেছিলো, ওর চাচাতো ভাই কাওসার ওকে...করেছে।

খায়রুন্নাহার ভিরমি খেয়ে বলেছিলেন, কীভাবে?

পাপিয়া খিকখিক হেসে বলেছিলো, মাইজে বুজিগে বাড়ি বেড়াতি গেছিলাম, বাড়িতি ফসল উঠতি শুরু করছে। মেলা কাজ বাইড়ে গেছে না! আব্বা কাওসার ভাইরে কলো, ‘সামিয়াগে বাড়িত্তে পাপিয়ারে আইনে দাও। আমি সুমায় পাচ্ছিনে। তারপর আনার পথে পাটক্ষেতের ভিতর।’

খায়রুন্নাহার শুকনো কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘তোর লজ্জা লাগেনি? ব্যথা পাসনি?’

পাপিয়া মুখে হাত চেপে হাসতে হাসতে বলেছিলো, ‘নাহ্। তাহলে কি আর তোরে কতাম!’

এখনো সে গ্রামে কলেজ নেই। কাওসার পাশের জেলা পাবনায় লজিং থেকে পড়তো। উঠতি নায়কের মতো ছিলো তার চাল-চলন। চেহারাও। অবশ্য পাপিয়াও সুন্দরী ছিলো। সে তখন আসন্ন কৈশোর ছোঁয়া বলিষ্ঠ শরীরের একটি মেয়ে। তবু খায়রুন্নাহার এখনো ভাবেন, কাওসার এমন অন্যায় করতে পারলো কী করে। পাপিয়ার ঘটনাটি খায়রুন্নাহারের মনে এখনো গভীর দাগ কেটে রেখেছে। ক্রমে তিনি কাওসার ও পাপিয়াকে মন থেকে ক্ষমা করে দিলেও ক্ষমা করতে পারেননি, পাপিয়ার বাবা আসাদউল্লাহ মামাকে। কোন বিবেচনায় তিনি এমন সোমত্ত ছেলেকে দিয়ে নিজের মেয়েকে আরেক গ্রাম থেকে আনতে পাঠালেন! তা সে মেয়ে যে বয়সেরই হোক। ক’দিন ধরে খায়রুন্নাহার আরো গভীরভাবে ভাবছেন, পাপিয়াদের তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেলেও তখন আরো তিন বোনের বিয়ে হতে বাকি ছিলো। কিন্তু তাদের একজনকেও তো কাওসার বিয়ে করেনি!

কাওসারদের থেকে পাপিয়াদের পারিবারিক অবস্থা এবং অবস্থান বেশিই ভালো ছিলো।

দিন পনের পরে একদিন জামিল খায়রুন্নাহারকে বললো, সাব্বির সাহেবের ওয়াইফও তো বড়লোকের সুন্দরী মেয়ে। ভীষণ চটপটে। তার একটা বুটিক সপ আছে। তিনিও আত্মীয়ের মতো তাসরীনদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করেন। থাকেন। তিনি নিশ্চয় বোকা নন। তিনি তো কোনো গলদ দেখেন না, কেবল তুমিই দেখতে পাও!

দেখতে পাই না। তবে অনুমান করি।

: তোমার অনুমানের ওপর নির্ভর করে একটা বিয়ে ভেঙে যাবে?

: এই জন্যই কোনো বিষয়ে কারো অনুমানের অবকাশ রাখতে নেই। ‘স্বচ্ছতা’ বলে একটা শব্দ আছে, তার শুধু অভিধানে থাকার জন্য জন্ম হয়নি! আমার যদি অমন একটি ঘটনা না জানা থাকতো, আমি হয়তো ওই মেয়েটিকে আংটি পরিয়ে কাজী ডেকে ওইদিনই বিয়ের কাজটা সেরে আসতাম। কারণ আমার যে ছেলে বিয়ে করতে রাজিই না, সে বিয়ে করতে চাইছে। এর থেকে আর বেশি কোনো চাওয়া আমার জীবনে নেই!

: সাব্বির স্যার যদি তেমন হবেন, তাহলে উনি আমাকে তাসরিনের জন্য নির্বাচন করবেন কেন? চাকরি শুরুর পর থেকে উনি আমার পিছনে লেগে আছেন। ওনার কি দায়? উনি বিয়ে করে এখন ওদের সাথে যোগাযোগ নাও রাখতে পারতেন!

: ওই যে সেই আনোয়ারের কথাই বলি, যদি তার সাথে সেই বাড়ির কোনো মেয়ের ভালবাসার সম্পর্ক হতো, তাহলে বিয়ে না হলে বিবাদ ঘটতো। ও বাড়িতে তার যাওয়া-আসার পথে কাঁটা পড়তো। কিন্তু তাদের কারো সাথে যদি কিছু হয়ে থাকে, সেটা সুযোগের সদ্ব্যবহার মাত্র। তোমার মামাতো ফুপাতো ভাইদের কখনো দেখেছো তোমার বোনদের রুম পর্যন্ত যায়? তোমার স্কুল-কলেজের সব বন্ধুরা কিন্তু আমাদের বাড়িই বেশি আসতো। তোমরা সারারাত হৈচৈ করেছো, সেও ওই ড্রয়িংরুম পর্যন্তই। জীবনে কিছু বীজমন্ত্র, কিছু মূল্যবোধ থাকতে হয়। মা-বাবাকেই তা সন্তানের প্রাণে গেঁথে দিতে হয়। তা যে মা-বাবার জানা নেই, তারা তাদের সন্তানকে কী শেখাবেন? তোমাদের জীবন পড়ে আছে, তাই জেনে রাখা ভালো, কারো ছেলেমেয়ে নাহলে অন্যের সন্তান পালক নিতেও ইসলাম নিরুৎসাহিত করে। স্পষ্ট করে উপদেশ দেয়া আছে, কেউ মেয়ে পালক নিলে, তার পালক বাবার সামনে যেতে সে মেয়ে অতটাই পর্দা রক্ষা করে যাবে, যতটা পরপুরুষের সামনে যেতে লাগে। আর ছেলে হলে ঠিক মা সে ছেলের সামনে ওই একইরকম পর্দা মেনে চলবে। তাই অতটা কট্টর না হলেও অন্তত কিছুটা অন্তরাল যারা মেনে চলে, সেইসব মানুষেরাই বহুদূর যেতে পারে। তাদের জীবন ও সম্পর্ক অন্যদের চেয়ে বেশি নিষ্কন্টক রাখতে পারে। তোমাকে যদি তোমার কোনো বন্ধু আজ বলে, আমি বাসায় থাকবো না, আমার স্ত্রী একা বাসায় ভূতের ভয় পায়। তুই শুধু আজ রাতে আমাদের ড্রয়িংরুমে থাকিস! তুমি নিশ্চয় থাকতে যাবে না। কারণ তোমার অবচেতন মন সেই মূল্যবোধটি ধারণ করে আছে!

অবশেষে জামিলের বিয়েটি তাসরিনের সাথে হয়নি। তবে মায়ের বাঁধানো খটকা ষোলোআনা তার মনে শেকড় গাড়তে না পারলেও বাকি বিশ্বাসটুকু নিয়ে আর সে আর এগোতে জোর পেলো না এবং জামিল আর বিয়ের জন্য আগ্রহ না দেখালেও খায়রুন্নাহার এতটুকু অনুতপ্তও হলেন না, যে তিনি ভুল করে সম্ভাব্য বিয়েটি ভেঙে সেদিন কনে বাড়ি থেকে একরোখা মনোভাবে চলে এসেছিলেন।