শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

মহাসত্যের বিপরীতে, পর্ব ২০

Meeting along the way

‘This sweetly smelling girl,

Fine small white turquoise

Found, then cast away’ _

* Tshangs dbyangs rgya mtsho

Tr. By G.W.Houston

( Wings of the white crane)

কুড়ি

খ্যাং তিসে যত এগিয়ে আসছে গরবের আকর্ষণ যেন তত বেশি বাড়ছে। অন্যদিকে দেচমা যে জন্য এই দীর্ঘযাত্রায় উৎসাহ দিয়েছিল সেই রোমাঞ্ছ কমে এসেছে। সারাদিনে ওরা দুটি খরস্রোতা নদী পার হয়। এই নদী দু’টো সাংপোতে মিশেছে। দুটি নদীতেই কাচা সেতু রয়েছে। দু'পাশে পাথর বসিয়ে কাঠ ও দড়ির সাহায্যে দোলার মতন সেতু। কিন্তু সেগুলি এত পুরনো আর নড়বড়ে যে ঘোড়া নিয়ে পার হওয়া অসম্ভব। সেজন্যে ওদের অনেকটা পথ নদীর পাড় ধরে উজানে গিয়ে সুবিধামতন জায়গা দেখে পার হতে হয়। ওরা নদী পেরিয়ে খচ্চর ও ঘোড়াগুলির পা মুখে ঘি মালিশ করে দেয়। এমনি দ্বিতীয় নদীটি পার হওয়ার পর আধঘণ্টার মধ্যেই ওরা একটা বাড়ি দেখতে পায়। কুকুরগুলি ধেয়ে আসে। যে কোনও তিব্বতি গ্রামে ঢোকার সময়ই এরকম কুকুর ধেয়ে আসে। ওরা অভ্যস্ত, তাই এতে কেউ বিচলিত হয় না। সেগুলির পেছন পেছন দু'টো অল্পবয়সি ছেলে এসে ওদের জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবেন?

এদের এই বন্ধুভাব গরবের বেশ ভাল লাগে। সে বলে, ৎসো মাফাম, খ্যাং তিসে!

গরবের উত্তর শুনে ছেলেগুলো দৌড়ে চলে যায়। তিব্বতি ছেলেমেয়েরা সাধারণত খুব লাজুক। যেচে কথা বলে না। কিন্তু ‘ৎসো মাফাম' ও 'খ্যাং তিসে' — নাম দুটির মধ্যে যেন জাদু ছিল। বাড়িটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বাড়ির ভেতর থেকে আবার বেরিয়ে এসে তারা পথ আগলে দাঁড়ায়, যেমনভাবে প্রথম সাক্ষাতের দিনে দেচমা ওদের পথ আগলে দাঁড়িয়েছিল!

তাদের অনুরোধে ঘরে ঢুকে গরম গরম চা খেতে খেতে কথা বলে বোঝে যে এটা তাদের গ্রাম নয় — খামারবাড়ি। আপাতত চার - পাঁচজন ছেলে ওখানে পাশের কোনও গ্রাম থেকে চড়ুইভাতিতে এসেছে। খিচুড়ির মতন করে গমের সঙ্গে সবজি সেদ্ধ আর ভেড়ার মাংস মিশিয়ে বেশ উপাদেয় খাবার রান্না করা হয়েছে। ওরা বলে, পাশেই একটা উষ্ণপ্রস্রবণ রয়েছে। আপনারা চটপট স্নান করে নিন। তারপর খাওয়াদাওয়ার পর আমরাও আপনাদের সঙ্গে লাদুম পর্যন্ত যাব। এখান থেকে ঘোড়ার পিঠে মাত্র ২০ - ২৫ মিনিট লাগবে!

গরব ভাবে, এর থেকে ভাল প্রস্তাব আর কী হতে পারে! গরব দেচমার চোখে তাকিয়ে পুলকের ছোঁয়া পায়। প্রথমে ৎসোণ্ডু আর গোরিং স্নানে যায়। তারপর গরব ও দেচমা। শীতল প্রকৃতির বুকে এহেন উষ্ণপ্রস্রবণগুলি একেকটি বিস্ময়। এই প্রথম ওরা খোলা আকাশের নিচে পরস্পরকে এভাবে জলের মধ্যে পেয়ে অবাক। দেচমা রাজহংসীর মতন ডানা মেলে গরবের গ্রীবা ও ঠোঁটে চুমু খায়। গরব ওকে এভাবে পেয়ে ক্রমে দৃঢ় ও স্পন্দিত আবেগে জাপটে ধরে। ওর হাতদুটি অবলীলায় দেচমার সারা শরীরে খেলা করতে থাকে। তারপর আলতো করে দেচমাকে নিজের কোলে গেঁথে নিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয়। উষ্ণপ্রস্রবণের উদ্দাম প্রগলভ অনবরত বুদবুদ দুজনের অস্তিত্বকে একসময় স্ফুটনাঙ্কে পৌঁছে দেয়। দেচমা ওর ঝাঁকড়া চুল টেনে ধরে শীৎকারে শীৎকারে আচ্ছন্ন করে তোলে। গরব ভাবে, এই মেয়ে কোনও মানুষী হতে পারে না। নির্ঘাত সিনদোংমা। এখন ওকে নিয়ে খেলছে। একদিন খেলা শেষ হলে তাকে খেয়ে ফেলবে ! সে দেচমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু দেচমা তার কান্ডে শক্ত লতার মতন আঁকড়ে ধরে থাকে।

দেচমার কাছে এ যেন এক সারা জীবন ভুলতে না পারা মুহূর্তমালা। গরব তাকে আদর করতে করতে একসময় ধাক্কা দিলে দেচমা বোঝে যে এটি ডাকাত সর্দারের অভিনব এক ব্রীড়ার প্রকাশ। সে ভাবে, কি জানি এরপর জীবনে এরকম মুহূর্ত আর আসবে কি না! সে প্রতিটি অনুপল উপভোগ করতে থাকে। গরবের চোখে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে তাঁর বুকে চুমু খায়। গরব তাকে আবার ধাক্কা দিতে গিয়েও পারে না। দেচমার চুম্বনে সে কেমন অবশ হয়ে আসে। নিজেও তার কপালে চুমু খায়।

ছেলেগুলির সঙ্গে খেতে বসে কথায় কথায় ওরা শোনে যে ত্রাদুম থেকে ঘোড়ার পিঠে মাত্র দিন তিনেকের মধ্যেই ওরা ৎসো মাফাম পৌঁছে যাবে। সেখান থেকে খ্যাং তিসে পৌঁছতে আর একদিন লাগবে। একথা শুনে ওদের খুব আনন্দ হয়। চারপাশে কিন্তু বিশেষ করে ৎসোণ্ডু ও গোরিং এর সামনে তাদের দস্যু দলেরসর্দারের এই উচ্ছ্বাস শোভা পায় না। সে সংযত থাকে।

খাওয়া শেষ হলে বনভোজনের সামগ্রী গুটিয়ে একটি খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে ওরা ঘোড়ায় চাপে। আকাশে নবমীর চাঁদ । দলের সামনে স্থানীয় ছেলেদের ঘোড়া আর পেছন পেছন ওরা একজন একজন করে সারিবদ্ধভাবে ঘোড়া চালিয়ে কিছুক্ষণ পরই প্রথম গ্রামের আলো দেখতে পায়। গ্রামে ঢুকে কিছুক্ষণ চলার পর একটি মঠের সামনে ওদেরকে রাত্রিবাসের জন্যে পৌঁছে দিয়ে স্থানীয় ছেলেরা চলে যায়। যাওয়ার সময় একটি ছেলে বলে, ভেতরটা খুব সুন্দর, বাইরের লামারা এবং অন্য পর্যটকরা এখানেই রাত কাটান।

খচ্চর ও ঘোড়াগুলিকে পশমি কাপড়ে আচ্ছাদিত করে ওরা মঠের ভারী দরজা ঠেলে ঢুকে দেখে দেওয়ালের কোণে একটা কুলুঙ্গির মধ্যে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে। গোরিং দরজাটা বন্ধ করে দিলে গরব এগিয়ে প্রদীপটা হাতে নিতে গিয়ে দেখে যে সেটা চারিদিকের ঘিয়ের আঠায়। আটকে রয়েছে , সম্ভবত কয়েক’শো বছরের ঘি পড়ে পড়ে বিরাট প্রদীপটির প্রায় অর্ধেকটাই জমাট কালো কালির মতন ঘিয়ের মধ্যে ডুবে গেছে। তা হোক, তবু তো সেটা আলো। আধার বিশ্লেষণে তার কাজ কি? দস্যু সর্দারের জীবনে আপাতত আলোটাই দরকার।

সামনেই প্রধান বেদি, তার সামনে হাজার প্রদীপের বেদি, এই প্রদীপগুলি কতদিন কেউ জ্বালায়নি কে জানে। তারাও সেগুলি জ্বালানোর কোনও চেষ্টা করে না। কাছেই প্রার্থনা বেদিতে গদি পাতা। সেখানেই দু 'পাশে কম্বল পেতে একদিকে গোরিং এবং ৎসোণ্ড, আর অন্যদিকে গরব ওদেচমা কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু বেশ কনকনে ঠান্ডায় ওরা প্রত্যেকেই ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে। গরব ও দেচমা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে উত্তাপ সংগ্রহের চেষ্টা করে। একই ঘরে ৎসোণ্ড আর গোরিং শুয়ে আছে । ওরা এখন কী করছে কে জানে ?

কিছুক্ষণ পরেই আশ্চর্যজনক ভাবে সেই ঠান্ডা কমে যায়। তবে কি এরই মধ্যে ভোর হয়ে গিয়ে ঘরে সূর্যের আলো ঢুকেছে? কষ্টের রাতগুলো সাধারণত তাড়াতাড়ি ফুরোতে চায় না। সেজন্যে কিছুতেই এই উষ্ণতা বিশ্বাস হচ্ছে না। সে কম্বলের বাইরে মাথা বের করে চোখ মেলে দেখে অবাক কাণ্ড। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সূর্যের আলো নয় , গরবের ঠিক পাশে গদির কাছে বসে আছেন একজন সন্ন্যাসী, তাঁর সামনে কড়াইয়ে লাল টকটক করছে কাঠকয়লার আগুন। গরব সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসেতাঁর পা ছুঁয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে। আগুন! আঃ, এই মুহুর্তে ঘরটা যেন স্বর্গ। গরব, দেচমা ও অন্য দুই সাথীকে ডাকতে গেলে সন্ন্যাসী ইশারায় মানা করেন। তিনিও নিশ্চয়ই ওদের মতন মহাতীর্থের যাত্রী। সে হাসিমুখে বিনীত হয়ে মনে মনে সন্ন্যাসীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। বেশ কিছুক্ষণ আগুন পোহানোর পর ওর চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসতে থাকে। গরব বসে বসে ঝিমোতে শুরু করলে সন্ন্যাসী তাকে ইশারায় শুয়ে পড়তে বলেন। চোখ বন্ধ করেও ওই লম্বা দাড়ি আর লম্বা চুলওয়ালা ভারতীয় সন্ন্যাসীর চেহারা ওর চোখে ভাসতে থাকে। আর সে অকাতরে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালবেলা গ্রামের ছেলেরা এসে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ওদের ঘুম ভাঙায়। তাদের সঙ্গেই ওরা গতকাল এখানে এসেছে। সকালে ছেলেগুলির সঙ্গে দুটি মেয়েও এসেছে — সম্ভবত দেচমার কথা ভেবে। তাছাড়া মেয়েরা তাদের জন্য কিছু খাবার এনেছে। শক্ত মাখন, ভারী হাতে বেলা রুটি আর গুড়। এই দেশে অতিথি সৎকারের জন্য এর চেয়ে ভাল খাবার আর কিছু হতে পারে না। অবশ্য গতকাল বিকেলে ছেলেরা যে বনভোজনের খিচুড়ি খাইয়েছিল সেটাও যেন অমৃত। তখনও ওদের মুখে তার স্বাদ লেগে রয়েছে। কিন্তু গরব রাতের সেই সন্ন্যাসীকে কোথাও দেখতে পেল না। মনে হয় তিনি খুব ভোরে উঠে চলে গেছেন। খোলা দরজা দিয়ে দিনের আলো এসে পড়েছে। রাতের রহস্যটা উদ্ঘাটন করার জন্য গরব দরজার পাশে দেখা সেই প্রদীপটার দিকে এগিয়ে যায়। আর অবাক হয়ে দেখে, চর্বির উপর বসানো সেই ঘিয়ের প্রদীপটার চিহ্নমাত্র নেই, এমনকী সেই দেওয়ালের খোপটিও নেই। সে কি স্বপ্ন দেখেছে? রহস্যই বটে! গ্রামের ছেলেমেয়েরা সবাই ওদেরকে দেখছে। তাই রাতের রহস্যটা রহস্যই থেকে যায়। ওই ছেলেমেয়েরা ওদেরকে একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের বৈঠকখানায় নিয়ে যায়। বাড়ির উঠোনে কয়েকটি টাট্টুঘোড়া আর চমরিগাই বাঁধা রয়েছে। তাদের পাশ কাটিয়ে ওরা একটি কাঠের বারান্দা হয়ে বৈঠকখানায় ঢোকে। পুরো বাড়িটাই কাঠের। দরজা – জানলা, থামগুলি, চৌকাঠ ও কড়িবরগায় অতি সুন্দর ও সূক্ষ্ম কারুকার্য খোদাই করা।তাঁর মানে এটি অত্যন্ত প্রাচীন জনপদ। কিছুক্ষণ পর বাড়ির ভেতর থেকে সবাই ছুটে এসে জিভ বের করে মাথা নিচু করে প্রণাম করে সসম্ভ্রমে দাঁড়াতে থাকে। যেন ওরা কোনও ধর্মগুরু কিংবা লামা। সবশেষে এলেন এক ভদ্রমহিলা। কুঁচকানো তোবড়া গালের ভাঁজে ভাঁজে প্রকাশ পাচ্ছে তাঁর সহজ ও পবিত্র চরিত্রের অভিব্যক্তি। মহিলাকে দেখে দেচমার নিজের দিদার কথা মনে পড়ে। মনের মধ্যে কেমন একটা আকুলি-বিকুলি শুরু হয়। গরবের কেন জানি মনে হয় দেচমা বুড়ি হলে এরকমই দেখতে হবে। বৃদ্ধা দেচমাকে একটা নতুন কাঁথা দিয়ে অভ্যর্থনা করে। দেচমা বৃদ্ধাকে প্রণাম জানায়।

ওরা একবাটি করে ৎসাম্পা খেয়ে সবার কাছে বিদায় নিয়ে ঘোড়ায় চেপে বসে। ঘোড়ায় চেপে ৎসোণ্ডু বেশ সহজেই সশব্দে বলে, ঈশ্বর, তুমি এদের শান্তি ও সুখের পথ দেখাও, এদের সহজ ও সরল মনে তোমার কৃপাবর্ষণ হোক!

গোরিং বলে, ৎসোণ্ডু যে একেবারে লামাদের ভাষায় কথা বলছিস রে!

সে ভেবেছিল একথা শুনে গরব হেসে উঠবে। কিন্তু একবার মুচকি হেসে নরম স্নেহমিশ্রিত দৃষ্টিতে ওদের দু'জনের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে যায় গরব। গোরিং ভাবে, সর্দারের একি পরিবর্তন? এগুলি কি দীর্ঘ তীর্থযাত্রার প্রভাব?

ত্রাদুম থেকে বেরিয়ে সাংপোর ধারেই একটি বড় গুম্ফা। এখানকার রীতি অনুযায়ী যাওয়ার পথে তীর্থযাত্রীদের গুম্ফার বড় লামাকে প্রণাম করে যেতে হয়। গরব ও তার সঙ্গীরা সে পথে না গিয়ে হাতজোড় করে ওই গুম্ফার অদেখা বড় লামাকে মনে মনে শ্রদ্ধা জানিয়ে নিজেদের পথে এগিয়ে যায়। তিব্বতের এই শীতল মরুভূমি অঞ্চলে জনবসতি প্রায় নেই বললেই চলে। আশপাশে কোনও বিরাট পাহাড় নেই। একদিকে সাংপো নদ আর তার বালি কাকরে ভরা তীর আর অন্যদিকে কোনও উপত্যকার মতন সমতল পাথুরে জমি। দক্ষিণে দূরে হিমালয়ের উত্তুঙ্গ শৃঙ্গগুলি দেখা যায় আর উত্তরে ধু - ধু করছে ন্যাড়া কুনলুন পর্বতমালা।

গরব বোঝে, ওরা তখন চ্যাং - ত্যাং এর রুক্ষ মরুভূমির পথে ঘোড়া চালিয়ে যাচ্ছে। মাঝে দু-একটি যাযাবরদের তাঁবু সে দেখেছে কিন্তু ওদিকে এগোয়নি। তারা দেখলেই ভিখিরির মতন ছুটে আসবে। গরব লক্ষ করে আজ আর কাশি হচ্ছে না। চারজনেরই কাশি সেরে গেছে। লাহসা ছাড়ার দু’দিন পর থেকে ওদের প্রত্যেকেরই কাশি হয়েছিল। গতকাল উষ্ণপ্রস্রবণে স্নান করে সারারাত ঘুমানোর পর আজ প্রত্যেকেই অনেক বেশি সুস্থ বোধ করছে । খচ্চর ও ঘোড়াগুলিও অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশি বিশ্রাম, পর্যাপ্ত খাদ্য ও পানীয় পেয়ে বেশ টগবগে। একরকম দ্রুতগতিতে ঘোড়া চালিয়েই ওরা সন্ধের মধ্যে গীয়াবুনাক পেরিয়ে যায়। সেদিন পূর্ণিমার রাত। চাঁদ ওঠার আগেই ডানদিক থেকে এসে সাংপোর বুকে ঝাপিয়ে পড়া একটি খরস্রোতার উজানে গিয়ে ওরা নদী পেরিয়ে খচ্চর ও ঘোড়াগুলির পা মুখে ঘি মালিশ করে দেয়।

তারপর জ্যোৎস্নার ফুটফুটে চরাচরে সারারাত লাগাতার ঘোড়া চালিয়ে ভোরবেলা শামসাং গ্রামে পৌঁছায়। সেখানে তখন নদীর ধারে আগুন পোহাচ্ছিল একদল গ্রামবাসী। ওরাও তাদের আহ্বানে সেই আগুনের পাশে গিয়ে উবু হয়ে বসে। গ্রামবাসীদের মধ্যে একজন ওদেরকে দেখে কেটলিতে গরম জল বসায়। গরব উপস্থিত সবাইকে চা খাওয়ানোর পয়সা দেয়। এরকম দরাজ তীর্থযাত্রী পেয়ে খেয়াঘাটের মালিক লোকটি আনন্দে হিহি করে হেসে ওঠে। সে তাদের একটি অব্যবহৃত কুঁড়েঘরে বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিলে ওরা সারাদিন ঘুমিয়ে নেয়। জ্যোৎস্নাধৌত মাঝরাতে ঘুম ভাঙতেই গরব সবাইকে তাড়া দিয়ে আবার চলতে শুরু করে। এবং চলতে চলতে ভোর হয়ে যায়। পরদিন দুপুরের আগেই ওরা পৌছায় পাহাড়ের কোলে থোকচেন শহরে।

গরব জানে, চ্যাং - ল্যাং মরুভূমির একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শহর এই থোকচেন। সে গৃহশিক্ষকের কাছে শুনেছে, প্রত্যেক বছর বুদ্ধপূর্ণিমায় তিব্বতি যাযাবররা এখানে এসে মিলিত হন। সেই সময় এই শহরে পশমের পোশাক পুরনো তৈজসপত্র, ঐতিহাসিক তাংখা, কাঠ ও পাথরের মূর্তি আর বিভিন্ন পাথর ও পুঁথির বিরাট সম্ভার নিয়ে পথের দু'পাশে হাট বসে । ধনী যাযাবর ও ব্যবসায়ীরা সেইসব জিনিস অতি সস্তায় কিনে নিয়ে যায়। নেপাল, ভারত, সিকিম ও ভুটানের সীমান্তবর্তী বাজারগুলিতে সেই সম্ভার সারাবছর পাওয়া যায়।

ওরা খুঁজে খুঁজে একটা সরাইখানায় ওঠে। খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়েবসে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে কাটায় সারা বিকেল। ৎসোণ্ডু, গোরিং আর গরব খচ্চর ও ঘোড়াগুলির পায়ে ডলে ডলে পুরু করে চর্বি মাখায়। সন্ধ্যায় সামান্য মদ্যপান করে খাওয়া - দাওয়া সেরে ওরা আবার ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন সকালের খাবার খেয়ে তরতাজা চার অশ্বারোহী আবার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যায়। এখান থেকে আবার শুরু পাহাড়ি পথ। এই পথটা হিমালয় পর্বতমালার গা ঘেঁষে উত্তর-পশ্চিম দিকে উঠে গেছে। সাংপো এখন ছোট্ট একটি পাহাড়ি ঝোড়া। তবে তার স্রোত ও দাপট এখন আরও বেশি। সশব্দ ও চঞ্চল। প্রতি মুহুর্তে অসংখ্য পাথরের গায়ে ধাক্কা মেরে সৃষ্টি করছে শুভ্র ফেনিল স্পর্ধা। থোকচেন থেকে বেরিয়ে হিমালয়ের এক অনবদ্য দৃশ্য ওদের গতি শ্লথ করে দেয়। অবশ্য শুধুই দৃশ্যের প্রভাবে এই শ্লথগমন নয়, ত্রাদুম থেকেই পশ্চিমমুখী পথটা ক্রমশ এঁকেবেঁকে উপরের দিকে উঠে এসেছে। দেখতে দেখতে ওরা অনেকটাই উঁচুতে উঠে এসেছে। যে সব ঝর্নার স্রোত মিলে সাংপো হয়েছে সেগুলির নাম ওরা জানে না। শুধু শুনেছে, সাংপোর প্রধান ঝর্নাটা আসছে ৎসো মাফাম বা মানস সরোবর থেকে। সেটার নাম মাৎসাং সাংপো।

শামসাং - এর কাছেই ওরা দেখেছিল সাংপো সেখান থেকে পরিষ্কার দু'ভাগ হয়ে গেছে। তার অপর অংশ আনছে হিমালয়ের বরফগলা জল। থোকচেনের সরাইখানাতেই দোংগল নামে এক হাসিখুশি যুবকের সঙ্গে গরবের পরিচয় হয়। বাবার মৃত্যুর পর সে ও তার মা ওই সরাইখানার মালিক। সে বেশ কয়েক বছর ধরে ৎসো মাফাম আর খ্যাং তিসের পর্যটকদের গাইডের কাজ করছে। তার মতে, ওটাই সাংপোর ঐতিহাসিক বা ভৌগোলিক উৎস। সেদিকেই নেপাল-তিবৃত সীমান্তের আংসি-ইয়ুংদুক, তামচাক-খাম্বাব নামে ছোটো ছোটো পাহাড়ি খরস্রোতাগুলোই সৃষ্টি করেছে মাৎসাং সাংপো। দক্ষিণের এই মাৎসাং সাংপো আর উত্তরের মারিয়াম ৎচু নদী একসঙ্গে মিলেছে শামসাং-এর প্রয়াগে। তিব্বতি তীর্থযাত্রীদের কাছে শামসাং অন্যতম প্রধান প্রয়াগ তীর্থ। উপযুক্ত পথনির্দেশের অভাবে সেই পবিত্র স্থানটি ওরা চিনতে পারেনি। সাংপো ভেবে ওরা উত্তরের যে শাখা নদী ধরে এগিয়ে চলেছে সেটা আসলে মারিয়াম ৎচু নদী।

থোকচেনের কাছ থেকে ওরা যে স্রোতস্বিনীর ধার ধরে এগিয়ে চলেছে তার নাম ৎসামো। ৎসো মাফাম - এর সঙ্গে মারিয়াম ৎচুর সংযোগ রক্ষা করে এই ৎসামো । থোকচেনের উচ্চতা প্রায় পনেরহাজার সাতশো ফিট। থোকচেনের স্থানীয় নাম তাসাম। ঝর্না এখানকার প্রকৃতিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। চারিদিকে অসংখ্য পর্বতশৃঙ্গ। ডানদিকে নন্দাদেবী আর দূরে বাঁদিকে অন্নপূর্ণা। থোকচেন-এ দরিদ্র মানুষদের কাঠের বাড়ি আর কাঠ-পাথরে মেশানো অনেকগুলি সরাইখানা।

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের ঘুম ভাঙে তারপর সূর্যের গতির সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে পাহাড়ের রূপ বদলায়। সকালের দিকটা বড় অদ্ভুত। প্রতি মুহুর্তের রঙে তার রূপের পরিবর্তন ঘটে। গরবদের এত তথ্য দিয়ে দোংগল হয়তো ভেবেছিল যে, গরবরাও বুঝি তাকে গাইড হিসেবে নেবে। সে বার বার বলছিল, পবিত্র ৎসো মাফাম ও খ্যাং তিসের পথে এটাই শেষ গ্রাম। কিন্তু গরব যে রহস্যের সন্ধানে, যে দুর্নিবার আকর্ষণে এগিয়ে চলেছে, কোনও পথপ্রদর্শক তার চাই না। গরব ওকে খুশি করার জন্য দেচমা, ৎসোণ্ডু ও গোরিংকে ডেকে তৈরি হতে বলে দোংগলকে নিয়ে থোকচেনের তাসাম বাজারে বেরিয়ে দলের চারজনের জন্য চারটি উলের সোয়েটার আর চার জোড়া হাত-মোজা কেনে। তারপর ওকে চায়ের দোকানে চা খাইয়ে সবিনয়ে মানা করে।

সরাইখানায় সকালের খাবার খেয়ে ওরা পথে বেরিয়ে পড়ে। এখন পথ আবার অনেক কঠিন; মানুষ, ঘোড়া ও খচ্চর প্রত্যেকের জন্যেই বেশ বন্ধুর। অজস্র ঝর্না আর ছোটো ছোটো নদী বেরিয়ে অসহ্য শীতের মধ্যে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। চলাটাই সমস্ত কষ্টের একমাত্র জবাব। যত দ্রুত চলা যাবে তত শরীরের রক্ত সংবহন স্বাভাবিক থাকবে। নাহলে ঠান্ডায় জমে মরে যেতে হবে।

চলবে ...