শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

মহাসত্যের বিপরীতে # তৃতীয় খণ্ড # চতুর্দশ পর্ব

5efd6b45752ea.jpg

‘মেরুপর্বত যদি সত্যি দাঁড়িয়ে থাকে,

এবং সূর্য ও চন্দ্র মহাকাশে ঘূর্ণায়মান,

এই ভাবনাও হয়তো মিথ্যে নয়’।

- ৎসাংইয়াং গ্যাৎসো( ৬ষ্ঠ দলাই লামা)


মাও শৃসানের ডাইরি –৩

চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবে তিব্বতকে যুক্ত করার আগে চু তেহ’র সঙ্গে আলোচনা করে আমার মন্ত্রীপরিষদ এবং পার্টির কমরেডদের তিব্বতের সংস্কৃতি এবং বৌদ্ধদর্শন নিয়ে পড়াশুনা করতে, এবং ভালোভাবে বুঝে তারপর পা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলাম।

চু তেহ বলেন, ঠিকই তো, কমিউনিস্টদের পড়াশুনা করতে হবে!

আমি বলি, বাস্তববাদী হতে হলে ভাববাদকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। নাহলে তিব্বত কেন, চীনের জনগণের মনেও সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে চাপিয়ে দেওয়া হবে। আর সেখান থেকেই শুরু হবে চীনে মার্ক্সবাদ প্রয়োগের ক্ষেত্রে অবক্ষয়!

দুটি প্রশ্ন ছোটোবেলা থেকেই আমার মাথায় ঘুরপাক খেত, এক, জগত কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে, আর দুই, এর সৃষ্টিকর্তা কি কেউ আছে? আমার এযাবৎ শেখা পুঁথিগত ও পদগত বিদ্যা বিশ্লেষণ করে অনুভব করেছি, জগতে এমন কোনও বস্তু নেই যার উত্থান হয় না, অগ্রগতি হয় না এবং বিলুপ্ত হয় না। জগতে রূপান্তরও ঘটে, কোনকিছুই চিরন্তন নয়!...পৃথিবীর নিশ্চয়ই বিলোপ হবে, সূর্যও শীতল হয়ে আসবে!...আদিরূপে পৃথিবী ছিল মৃত, না ছিল বৃক্ষ-গুল্ম, না ছিল জল ও বায়ু। পৃথিবীর তাপ এত বেশি ছিল যে জলের অস্তিত্ব সম্ভব ছিল না। কত লক্ষ বছর পর জানিনা হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের নির্দিষ্ট আনুপাতিক মিশ্রণে জল হয়। অনেক পরে জলের মধ্যেই জীবন – প্রাণী ও উদ্ভিদের সৃষ্টি। ধীরে ধীরে বিবর্তনের মাধ্যমে এককোষী থেকে বহুকোষী, মাছ থেকে মানুষ এসেছে। নারীর ভ্রূণ মাছের মতন বৃদ্ধি পাওয়ার কাল বিভাগ আছে।

... প্রত্যেক স্বতন্ত্র ব্যক্তিবিশেষে বস্তুর উত্থান, প্রগতি - বৃদ্ধি এবং ধ্বংস হয়। প্রত্যেক মানুষেরই মৃত্যু হবে, কারণ ঘটনাক্রমে তার উদ্ভব হয়েছে; সুতরাং বিনাশও হবে!

... আমরা যখন বলি মনুষ্যজগতের বিনাশ, জগতের বিনাশ হবে, এর অর্থ খ্রিষ্ট ধর্মের ‘শেষবিচারের দিন’ তত্ত্ব নয়। আমরা যখন মনুষ্যজগৎ ও বিশ্বজগৎ বিনাশের কথা বলি, তার অর্থ হল, বর্তমান মনুষ্য জগতের পরিবর্তে আবির্ভাব হবে আরও অগ্রসর জগৎ, সব বস্তুরই আরও উচ্চপর্যায়ের অগ্রগতি হবে।

... সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে সবচেয়ে প্রাচীন চীনা দার্শনিক চিন্তাভাবনা খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে রচিত ‘হুয়াইনানজি’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। এই গ্রন্থের মতে, আকাশ ও মাটি রূপ গ্রহণের আগে ছিল শূন্যতা এবং কোনও নির্দিষ্ট আকারবিহীন। এই অবস্থাকে বলা হয় বৃহৎ সূত্রপাত। শূন্যতা সৃষ্টি করে জগৎ। তারপর জগৎ সৃষ্টি করে ‘ছি’, যার ক্ষমতা ছিল সীমিত। এই চীনা শব্দ ‘ছি’র নানারকম ব্যাখ্যা আছে, যেমন আদিভৌতিক শক্তি, প্রাণ, জীবজন্তুর শ্বাস-প্রশ্বাস, বায়ুর ঈথার। এসবই সৃষ্টির মূল সারবত্তা। ‘ছি’র সীমানা থেকে যে অংশ ছিল স্বচ্ছ এবং হাল্কা, তা ভাঙতে ভাঙতে ক্রমশঃ পরিণত হয় আকাশে, আর যে অংশ ছিল ভারী এবং পঙ্কিল তা ঘন হয়ে পৃথিবী হয়। আকাশ এবং পৃথিবীর মিলিত নির্যাস ‘ইন’ এবং ‘ইয়াং’ এ পরিণত হয়। কাল অতিক্রান্ত হতে হতে পরিণামে ‘ইয়াং’এর কেন্দ্রীভূত তাপশক্তি উৎপন্ন করে অগ্নি, আর তাপশক্তির উপাদান সূর্যে, আর ‘ইন’ এর কেন্দ্রীভূত শৈত্যশক্তি জলে পরিণত হয়। জলশক্তির উপাদান চন্দ্রে পরিণত হয়। সূর্য ও চন্দ্রের অতিরিক্ত উপাদানের শক্তি তারকা ও গ্রহে পরিণত হয়।

চীনা দর্শন অনুযায়ী ‘ইন’ ও ‘ইয়াং’ তত্ত্বে ‘ইন’ নেতিবাচক, আর ‘ইয়াং’ ইতিবাচক শক্তি। বৌদ্ধধর্মের মাধ্যমে যে ভারতীয় দর্শন জেনেছি, সেখানে ‘পুরুষ’ ও ‘প্রকৃতি’ তত্ত্ব চীনের তত্ত্বের চেয়েও প্রাচীন।

‘হুয়াইনানজি’ র কয়েক শতাব্দী আগেই ভারতীয় দর্শনে সৃষ্টিতত্ত্ব এবং সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে বিবরণ পাওয়া যায়। ঋগ্বেদের সৃষ্টি স্তবে একটি শ্লোকে এই তত্ত্ব উচ্চারিত হয়েছে। আর একটি স্তবে প্রজাপতিকে সৃষ্টিকর্তা রূপে স্তুতি করা হয়েছে। বৈদিক দর্শন অনুযায়ী জগতের সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন উপাদানের সমন্বয়ে; যেমন জল, অগ্নি, বায়ু, মাটি এবং আকাশ। এগুলিকে একসঙ্গে বলে পঞ্চভূত। জল আগে সৃষ্টি হয়েছে, নাকি আগুন, নাকি দুটোই একসঙ্গে – তা নিয়ে বিতর্ক আছে।

ভারতীয় দর্শনে সৃষ্টি, স্থিতি, ও লয়ের উল্লেখ আছে । গৌতম বুদ্ধ নিজে সৃষ্টিকর্তা বা আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু তাঁর নির্বাণলাভ না হওয়া পর্যন্ত জন্মান্তর তত্ত্ব থেকে গড়ে ওঠে আত্মার দেহ থেকে দেহান্তরে প্রবেশের মাধ্যমে পুনর্জন্ম ও জাতক তত্ত্ব। চীনদেশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা গোড়া থেকেই আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস ও প্রচার করে আসছেন।

বৌদ্ধধর্ম বিশ্বাস করে, মানুষকে নতুন পথ দেখাতে ভবিষ্যতে আবির্ভাব হবে মৈত্রেয় বুদ্ধের। এই ভবিষ্যত বুদ্ধ বা মৈত্রেয় বুদ্ধকে চীনাভাষায় বলা হয় মিলোফা। আমি মনে করি, বর্তমান মানবজাতি ধ্বংস হয়ে ভবিষ্যত বুদ্ধের মতন জন্ম নেবে আরও অগ্রসর মানবজাতি। … মার্কসবাদের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। শুনতে হয়তো উদ্ভট বলে মনে হবে। কিন্তু মার্ক্সবাদ যখন বলে – প্রত্যেক জিনিসেরই যেমন উত্থান আছে তেমন ধ্বংসও আছে, একথা কি মার্ক্সবাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে না? আমরা যদি বলি এর ধ্বংস হবে না তাহলে তা হবে অধিবিদ্যার সামিল। তবে, ধ্বংসপ্রাপ্ত মার্ক্সবাদের পরিবর্তে আসবে আরও উন্নত একটি তত্ত্ব বা সত্ত্বা।

যদি জন্ম ও মৃত্যুতে পারস্পরিক রূপান্তর না ঘটে তাহলে অনুগ্রহ করে বলুন, কোথা থেকে আসে জীব পদার্থ? আদিতে পৃথিবীতে ছিল শুধু নির্জীব পদার্থ, জীবিত পদার্থের অস্তিত্ব শুরু অনেক পরের ঘটনা। সমস্ত পদার্থ ও জীবকে রাসায়নিক রূপান্তরের পর্যায়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হয় – এর উপাদান হয়, সংজনন এবং ধ্বংস হয়। জীবন এগিয়ে যেতে থাকলে জন্ম ও মৃত্যু অবিরাম সংগ্রাম করে চলে, এবং একে অন্যতে রূপান্তরিত হতে থাকে।

আমার প্রস্তাব হল, ৫০ বছরের উর্ধ্বে হলেই প্রত্যেক মানুষের মৃত্যু হোক, আর তার জন্যে একটি উৎসব পালিত হোক, কারণ এটি অনিবার্য যে মানুষের মৃত্যু হবেই, এটাই প্রকৃতির নিয়ম। হা হা হা…! এই প্রস্তাবকে পাঠক সিরিয়াসলি নেবেন না! প্রকৃতির নিয়মেই এই প্রস্তাব কখনও গৃহীত হবে না।

এক বস্তু অন্য বস্তুকে ধ্বংস করে; বস্তুর উৎপত্তি, অগ্রগতি ও ধ্বংস সব ক্ষেত্রেই হয়, যদি কোনও বস্তু অন্য বস্তুর দ্বারা ধ্বংস না হয়, তাহলে নিজে থেকেই তা ধ্বংস হয়।

মানুষের মৃত্যু কেন হয়?

এটাই প্রকৃতির নিয়ম। অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদ মানুষের চেয়েও বেশিদিন বাঁচতে পারে; কিন্তু তাঁদের অস্তিত্বও অবিনশ্বর নয়। সেজন্যেই আগে মজা করে লিখেছিলাম, মানুষের মৃত্যু হলে ন্যায়শাস্ত্রের জয় বলে উৎসব পালন করতে হবে, পুরাতনের ধ্বংসের জন্য উৎসব পালন করতে হবে। এটা ঠিক যে একদিন সমাজতন্ত্রের বিলোপ হবে, না হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়; কারণ তাহলে সাম্যবাদ আসবে না!

আমাদের প্রত্যেকের একটি অধ্যয়নের পরিবেশ সৃষ্টি করা উচিত। আমি নিজেও আরও পড়াশোনা করতে চাই। নাহলে মার্ক্সের সঙ্গে দেখা হলে খুব অপ্রস্তুত বোধ করবো। তিনি যদি আমাকে কোনও প্রশ্ন করেন, আর আমি উত্তর না দিতে পারি তখন কী করবো? তিনি নিশ্চয়ই চীন বিপ্লবের সব দিক জানতে আগ্রহী হবেন!

১৯৬১ র সেপ্টেম্বর মাসে ফিল্ড মার্শাল মন্টগোমারি উহান সফরে এসে আমার সঙ্গে দেখা করেন। তিনি আমাকে বলেন, স্পষ্টতই আপনার এখানে অনেক কিছু করার আছে। আপনি শরীরের প্রতি যত্ন নেবেন। আপনার দেশ ও জনগণের কাছে আপনার প্রয়োজন আছে। আশা করি, আপনি সুস্বাস্থ্য ও সবল থেকে দেশের নেতৃত্ব দেবেন!

আমি মাথা নেড়ে জবাব দিই, চীনে একটি প্রবাদ আছে, তোমার বয়স যখন ৭৩ কিম্বা ৮৪, তখনও যদি যমরাজের ডাক না পাও, তাহলে নিজে থেকেই যাবে; আর যদি কেউ সুস্থ থেকে এই দুই গিরিপথ অতিক্রম করতে পারে, তাহলে সে ১০০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। আমি এত বছর বেঁচে থাকতে চাই না, বড় জোর ৭৩ বছর, অর্থাৎ আরও চার বছর।

জবাবে মন্টগোমারি বলেন, কেন? আপনি ৮৪ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারেন। আপনার এরকম ভাবনা দুঃখবাদ!

আমি বলি, না, আমি আমার ভগবানের সঙ্গে দেখা করতে যেতে চাই। আমার ভগবান হলেন মার্ক্স। তার সঙ্গে আমার অনেক কিছু আলোচনা করা জরুরি!

তখন মন্টগোমারি একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ওহ, আমি যদি জানতাম মার্ক্স কোথায় আছেন, তাহলে আমি নিশ্চয়ই তাঁর সঙ্গে দেখা করে এ বিষয়ে আলোচনা করতাম, আর বলতাম যে আপনাকে ছাড়া চীন চলতে পারে না!

নয়া চীন প্রতিষ্ঠার আগে ও পরে আমার নানা রচনা ও বক্তৃতায় নিজের বক্তব্যকে যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলতে এমন কিছু রূপক বা কাহিনি উল্লেখ করতাম, যেগুলি আমি বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ, নিবন্ধ, টীকা বা বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কিত রচনায় পড়েছি। যেমনঃ

১। ‘মাথার উপর নেই একখানা টালি, পায়ের তলায় না আছে একফালি জমি’। এই রূপকটি পেয়েছি বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ‘উতং হুইইউয়ান’ -এ। ঐ বইয়ে দুই ভিক্ষু তাঁদের গুরুকে প্রশ্ন করেন, ‘মাথার উপর না আছে টালি, না আছে যষ্ঠি স্থাপনের একটু জমি’- একথার অর্থ কী?

উত্তরে গুরু বলেন, ‘হতদরিদ্র অবস্থা আর কি’!

যখন ধনী কৃষকেরা কোনও কৃষক সমিতিতে যোগ দিতে চাইতো না বা ইতস্তত করতো তখন তাঁদের গরিব কৃষকদের উদ্দেশ্যে শ্লেষের সুরে এই প্রবাদটি বলতে শুনেছি। ১৯২৭ সালে ‘হুনানে কৃষি আন্দোলন সমীক্ষার রিপোর্ট’- নামক প্রবন্ধে এর উল্লেখ করেছি।

২। ‘উতং হুইইউয়ান’ গ্রন্থেই এক ভিক্ষু তাঁর গুরুকে জিজ্ঞেস করেন, ‘এক ঘোড়ায় এক সৈনিক’ প্রবাদটির অর্থ কী?

গুরু বলেন, ‘এক হাতে লড়াই’!

আমি ‘জাপ-সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে রণকৌশল’ প্রবন্ধে প্রথম এই রূপকটি ব্যবহার করি। এক ব্যাপকতর জাতীয় বিপ্লবী যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব দিয়ে লিখি, ‘আমাদের সাহসিকতার সঙ্গে সবরকম রূদ্ধদ্বারবাদ ত্যাগ করতে হবে, ব্যাপক যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে হবে এবং হঠকারিতার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে...যুক্তফ্রন্ট রণনীতিতে প্রয়োগ হল শত্রুপক্ষকে ঘেরাও ও উৎখাত করার জন্য বহুসংখ্যক সেনা, আর রুদ্ধদ্বার রণনীতির অর্থ হল, দুর্দান্ত শত্রুর বিরুদ্ধে মরণ-বাঁচন যুদ্ধে ‘এক ঘোড়ায় এক সৈনিক’ বা এক হাতে লড়াই।

৩। ‘উতং হুইইউয়ান’ গ্রন্থের আরেকটি রূপক হল,-‘যশমকে আকর্ষণ করতে ইঁটের প্রয়াস’। কোনও বৌদ্ধ পুরোহিত বা পণ্ডিত ধর্মব্যাখ্যা করার আগে বিনয়ের সুরে বলেন, আমার ব্যাখ্যা মূল্যহীন, যশমকে আকর্ষণ করতে ইঁটের প্রয়াস বলে মনে করবেন!

এই শিক্ষা নিয়ে আমিও তেমনি ‘নয়া গণতন্ত্র প্রসঙ্গে’ শীর্ষক প্রবন্ধে নিজেকে সাংস্কৃতিক বিষয়কে অনভিজ্ঞ ও নিতান্তই সাধারণ বলে বর্ণনা করে লিখেছি, ‘আমার এই অমার্জিত ও কষ্টকল্পিত ভাষা নাট্যগুরুর প্রারম্ভিক গীতের অনুরূপ’, আর ‘আমার মন্তব্যে জাতির অগ্রসর সাংস্কৃতিক কর্মীদের জন্য এক কণা সত্য থাকতে পারে, তাদের কাজ হবে যেন যশমকে আকর্ষণ করতে ইঁটের প্রয়াস’ – সেই রকম!

৪। ‘অশোকদান সূত্র’ নামক বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে একটি রূপককাহিনিতে বলা হয়েছে, এক সাধারণ যুবক দেশের রাজকুমারীকে বিয়ে করার কল্পনা করতে করতে দিন কাটাতো। শেষ পর্যন্ত সে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। এমন চিন্তাকে বলা হয় – আকাশকুসুম কল্পনা। ১৯৩৫ সালে লাল ফৌজ বিদ্যায়তনে ‘চীনের বিপ্লবী যুদ্ধ’ শীর্ষক বক্তৃতায় রণনীতি নিয়ে বলতে গিয়ে আমি বলেছিলাম, ‘এক অসতর্ক সামরিক ব্যক্তি যখন যেটা পাওয়া সম্ভব নয় সেটা পাওয়ার আকাঙ্খায় সামরিক পরিকল্পনা করে, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়ে ওঠে আকাশকুসুম কল্পনা, যা বাস্তবের সঙ্গে সংগতিহীন।

৫। দুই ধরণের জ্ঞানী আছেন। এদের কারো আছে প্রত্যক্ষ বা নিজের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান, অন্যদের আছে প্রবন্ধ-রচনা পাঠ এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের ব্যাপক বিষয়গুলি সম্পর্কে অর্জিত বাহ্যজ্ঞান। জগতে সবচেয়ে হাস্যকর ব্যক্তি হলেন যিনি ‘সবজান্তা, এমন মানুষেরা জনশ্রুতি থেকে অর্জিত ভাসা-ভাসা জ্ঞান পেয়ে নিজেদের ‘পৃথিবীর একনম্বর পণ্ডিত’ বলে জাহির করেন, এতে প্রমাণিত হয় যে তাঁরা নিজেদের সম্পূর্ণ মূল্যায়ন করতে পারেননি। তাঁরা – আধা-জ্ঞানী সর্বজ্ঞ’। এই রূপকটির আদিরূপ হল, ‘জ্ঞানের আছে দু’টি দিক’। কালক্রমে মূল উক্তিটি ‘আধা-জ্ঞানী সর্বজ্ঞ’ তে পরিণত হয়।

৬। অনেকেই হয়তো জানেন না যে বিশ্বের প্রথম উপন্যাসটির নাম হল ‘উ ছেং এন’ বা ‘পশ্চিম অভিমুখী তীর্থযাত্রী’। রচনাকাল ১৫০০-১৫৮২ খ্রিস্টাব্দ। হিউয়েন সাঙ-এর ভারত যাত্রার পটভূমিতে লেখা এই বিখ্যাত উপন্যাসটির লেখকের নাম জানা যায় না। লেখকের কল্পনায় এই চীনা পরিব্রাজকের পক্ষে দুঃসাধ্য এবং বিপদসঙ্কুল দীর্ঘপথ অতিক্রম করে ভারতে যাওয়া অসম্ভব ছিল, যদি না এক অলৌকিক শক্তি তাঁকে সবসময় বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করতো! এই রক্ষাকারী হিসেবে লেখক একটি বানররূপী চরিত্র সৃষ্টি করেন, আর তাঁর বৌদ্ধ নাম দেন – সুন উখুং। এই সুন উখুং একটি বানর রাজ্যের রাজা, সর্বশক্তিমান এবং সর্বত্র বিরাজমান। নিজেকে বাহাত্তরটি রূপে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা ছিল তাঁর। উপন্যাসের ষোড়শ পরিচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে সুন উখুং-এর সঙ্গে হিউ য়েন সাঙ এর অদ্ভূত অভিজ্ঞতার কল্পিত বর্ণনা। যাত্রাপথে একদিন তাঁরা একটি বৌদ্ধমঠে আশ্রয় নিতে যান। হিউয়েন সাঙ যখন মঠের মূল মন্দিরে বুদ্ধমূর্তির সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছিলেন, তখন এক ভিক্ষু মন্দিরের ঘণ্টা বাজাতে গেলে তাঁর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে সুন উখুং নিজেই একনাগাড়ে ঘণ্টা বাজাতে শুরু করেন, আর বাজিয়েই যান। কখনও দ্রুত, কখনও ধীরলয়ে। একসময় ভিক্ষু, তাঁকে থামানোর জন্যে বলেন, আপনি বাজানো বন্ধ করুন, থামাচ্ছেন না কেন?

বানর রাজা উত্তরে বলেন, তুমি একটি মূর্খ, তাই না? জানো না, যতদিন যে থাকবে ভিক্ষু, ততদিন সারাদিন বাজিয়ে চলে ঘণ্টা! – আমি হলাম তাই!

৭। এই উপন্যাসের ষোড়শ পরিচ্ছেদের আরেকটি প্রবাদ আমার খুব প্রিয় – একটি স্ফুলিঙ্গই সৃষ্টি করতে পারে দাবানল! ১৯৩০ সালের জানুয়ারিতে লিন পিয়াওকে লেখা একটি চিঠিতে পার্টিতে কিছু নেতিবাচক মনোভাবের সমালোচনা করেছিলাম। এই চিঠির লক্ষ্য ছিল সেই কমরেডরা, যাঁরা বিপ্লবী আবেগের রোগে ভুগছিলেন আর আত্মবাদী শক্তিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে কম গুরুত্ব দিচ্ছিলেন। সেই চিঠিতে লিখেছিলাম, এক্ষেত্রে আমরা প্রাচীন চীনা প্রবাদ প্রয়োগ করতে পারি, ‘একটি স্ফুলিঙ্গই সৃষ্টি করতে পারে দাবানল!’, অর্থাৎ আমাদের সেনাশক্তি বর্তমানে কম হলেও দ্রুত বৃদ্ধি পাবে!

৮।জাপ-সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নিয়ে লেখা ‘দীর্ঘায়ত যুদ্ধ প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধে আমি ‘আপস-মীমাংসা না প্রতিরোধ’, আর ‘দুর্নীতি না অগ্রগতি’ এই দুটি প্রশ্নের উত্তরে লিখেছিলাম, ‘আপস–মীমাংসা ফলপ্রসূ হবে না। জাপান বিষয়গত দিক থেকে চীনা জনগণের কাছ থেকে এমন কি খাদ্যশদ্য ও বস্ত্র লুট করছে; আর আধ্যাত্মিক দিক থেকে চীনের জাতীয় চেতনাকে ধ্বংস করার কাজে লিপ্ত’। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি জাপানের মন্ত্রীসভার ঘোষণা চীনের সর্বস্তরের মানুষের মনে ক্রোধ উৎপন্ন করেছে। এই রাগ প্রতিক্রিয়াশীল ও বর্বর যুদ্ধের জন্য তার ‘কল্প থেকে পরিত্রাণ নেই’। বৌদ্ধ দর্শনে ‘কল্প’ হল জগৎ সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টির অন্তঃবর্তী সময় পর্ব। বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাস যে এই কল্প থেকে মানুষ রেহাই পেতে পারে না, এবং তা সবারই ভাগ্য; অর্থাৎ পূর্বনির্দিষ্ট ভাগ্য।

৯। বৌদ্ধ ধ্যান সম্প্রদায়ের যে সব মানুষ বাস্তবকে অবজ্ঞা করে আসার কথা বলতেন, তাঁদের সম্পর্কে বলা হতো – মুখেই ধ্যান জপ! ১৯৪০ সালে, কুওমিনতাং –এর উদ্দেশ্যে যে দশ দফা দাবির তারবার্তা পাঠানো হয় তাতে ওয়াং চিংওয়েই এবং তাঁর অনুগামীদের সমালোচনা করে লিখেছিলাম, এ ধরণের লোকেরা শুধু মুখেই ধ্যান জপ করার মতো তিন গণনীতির কথা বলেন; কিন্তু যাঁরা আন্তরিকতার সঙ্গে সেগুলি বাস্তবায়িত করতে চান তাঁদের পরিহাস করেন কিম্বা কঠিন শাস্তি দেন!

১০। হান রাজবংশের রাজত্বের শেষের দিকে মৌজি নামে এক ভদ্রলোক কনফুসিয়াস ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধধর্ম নিয়েছিলেন। তিনি ধর্মপ্রচার করার সময় প্রায়ই একটি প্রবাদ বলতেন, ষাঁড়ের সামনে বীণার ঝংকার! যারা তাঁর সমালোচনা করতেন, তাঁদের তিনি ষাঁড়ের সঙ্গে তুলনা করে বলতেন, ষাঁড়ের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ যদি বীণা বাজায় তাহলে বীণার ঝংকারে ষাঁড়ের মধ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না; কিন্তু যদি মশার গুঞ্জন শোনানো যায় তাহলে ষাঁড় তার কান দুটি নেড়ে সারা দেবে। ছকবাঁধা অষ্টপদী রচনার সমালোচনা করতে গিয়ে লিখেছিলাম, অনেকে মনে করেন যে তাঁরা যা লেখেন বা বলেন – সবই অনিবার্য এবং সকলের বোধগম্য। একথা আদৌ ঠিক নয়। তাঁদের রচনা বা কথা অনেক সময়ই যেন - ষাঁড়ের সামনে বীণার ঝংকার!

১১। ১৯৪২ এ শিল্প ও সাহিত্য নিয়ে বক্তৃতায় বলেছিলাম, জনগণের মধ্যে শিল্প ও সাহিত্যকে জনপ্রিয় করার জন্য শিল্পী ও সাহিত্যিকেরা যেন প্রচারকর্মী কমরেডদের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে উপজীব্য সংগ্রহ করে নিজেদের সমৃদ্ধ করেন যাতে তাঁদের জনগণ এবং বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘শূন্যে অট্টালিকা’ তৈরির চেষ্টা না করতে হয়। তাঁরা যেন ‘গজদন্ত মিনারে’ বাস না করেন।

এই ‘শূন্যে অট্টালিকা’ প্রবাদটি ‘অবদানশতকসূত্র’ গ্রন্থের একটি রূপক কাহিনিতে পেয়েছি। একজন ধনী মানুষ এক রাজমিস্ত্রিকে একটি তিনতলা মনোরম বাড়ি তৈরির দায়িত্ব দিয়েছিলেন। রাজমিস্ত্রি মাটি খুঁড়ে গাঁথুনি শুরু করলে ধনী মানুষটি তাঁকে বলেন, তাঁর শুধু তিনতলার ঘর দরকার। উত্তরে রাজমিস্ত্রি বলেন যে নীচের দু’টি তলা তৈরি না করলে তিনতলার ঘর বানানো সম্ভব নয়। কিন্তু ধনী মানুষটি নাছোড়বান্দার মতন নিজের দাবিতেই অনড় থাকেন। পরিণামে তিনি গ্রামের মানুষদের কাছে হাস্যাস্পদ হন। এই কাহিনির মূল বক্তব্য হল, যাঁরা বৌদ্ধধর্ম উপলব্ধি করতে চান, তাঁদের প্রথমে একটি ভিত্তি স্থাপন করতে হবে, তাহলেই তাঁরা সত্যিকার জ্ঞানলাভ করতে পারবেন।

১২। একবার শিল্পী-সাহিত্যিকদের সম্মেলনে আমি একটি রূপক ব্যবহার করেছিলাম – বন্ধ ঘরে গাড়ি তৈরি! ধ্যান সম্প্রদায়ের একটি গ্রন্থে আমি এই রূপকটি পড়েছিলাম, এখন নাম মনে করতে পারছি না! কিন্তু সেই সম্মেলনে বিপ্লবে দক্ষ ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের উদ্দেশ্যে বলেছিলাম, তাঁদের কর্তব্য হল জনগনের মতামত সংগ্রহ করে, তা পরিমার্জন করে আবার জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া! তারপর তাঁরা তা বাস্তবে প্রয়োগ করবে। তাঁরা অভিজাত ব্যক্তিদের মতন দক্ষ নন, যারা বন্ধ ঘরে গাড়ি তৈরি করেন আর অসার কল্পনা করেন যেন জ্ঞানের একচেটিয়া অধিকারী তাঁরাই!

১৩। ১৯৫৭-য় শিল্পী-সাহিত্যিকদের সম্মেলনে ‘উতং হুইইউয়ান’ গ্রন্থের আরেকটি রূপক আমি ব্যবহার করেছি – পায়ে চুলকানি, জুতোতে আঁচড়ানি! শিল্প- সাহিত্য সমালোচকরা তিন শ্রেণির, এক শ্রেণি সঠিক স্থানে চুলকাতে পারেন, মতান্ধ নন এবং দক্ষ; দ্বিতীয় শ্রেণির সমালোচকরা পায়ে চুলকানি হলে জুতোতে আঁচড়ান, লেপা-পোঁছা এবং অতি সরল, তাঁদের রচনা ধর্তব্যের মধ্যে নয়; আর তৃতীয় শ্রেণি হল অন্ধবিশ্বাসী, অন্যকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে ফেলার মতন আঘাত করেন আর শিল্প ও সাহিত্যে সমালোচনা রীতির অগ্রগতি রোধ করেন। ‘উতং হুইইউয়ান’ গ্রন্থে উল্লিখিত এই রূপকের মানে হল, এক ব্যক্তির জ্ঞান হতে হবে গভীর, তাঁকে মুখ্য বিষয়গুলি আয়ত্ত করতে হবে, সঠিক লক্ষ্যে আঘাত করতে হবে; আর যাঁরা যা বলবেন বা লিখবেন তা যেন উদ্দেশ্য সম্পাদনে সক্ষম হয়।

১৪। ১৯৪৯এর ১৪ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে ‘বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিবৃতি’ জারি করা হয়। তাতে আমি কুওমিনতাং সরকারের সমালোচনা করে লিখেছি, এর শাসনাধীন সব জায়গায় প্রতিক্রিয়াশীল নানচিং সরকার শ্রমিক, কৃষক, সেনা, বুদ্ধিজীবী এবং ব্যবসায়ী – ব্যাপক জনগণের অস্থি ভেঙে মজ্জা চুষছে! এই রূপকটি মূলতঃ বলেছিলেন বোধিধর্ম। তিনি ধর্মসূত্র ব্যাখ্যা করার সময় বলেন, যে ধর্ম পালনে কঠিন পরিশ্রম করতে হয় যেন অস্থি ভেঙে মজ্জা চোষার মতন কঠিন কাজ!

১৫। ১৯৪৯ সালের আগস্টে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের ডিন আচিসনের সমালোচনা করে লিখেছি, আচিসনের সিদ্ধান্ত অনেকটা ‘কসাই তাঁর খড়্গ নিক্ষেপ করা মাত্র বুদ্ধত্বপ্রাপ্তি’ গোছের, যেমনটি অনেক হতবুদ্ধি মস্তিষ্কের বুদ্ধিজীবীরা ভাবেন বা বলেন, এ যেন কোনও দস্যুর হৃদয় পরিবর্তন করে সাধু হওয়ার মতন আচরণ। আমরা যখন বলি, ‘সাম্রাজ্যবাদ খুব হিংস্র’, তাঁর অর্থ হল যে তাঁদের চরিত্রের কোনও পরিবর্তন হবে না, সাম্রাজ্যবাদীরা কখনও তাঁদের হাতের ছুরি ফেলে দেবে না, শেষ বিচারের দিন না আসা পর্যন্ত তাঁদের বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি হবে না! বৌদ্ধ ধর্মের নির্বাণসূত্রে একটি কাহিনিতে বর্ণিত হয়েছে, বারাণসী নগরে এক কসাই রোজ অনেক পাঁঠা বলি দিত। একদিন, ঘটনাক্রমে গৌতম বুদ্ধের শিষ্য সারিপুত্তর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় এবং তাঁর প্রতি ভক্তির উদয় হয়। সেদিনই সে ক্সাই বৃত্তি ছেড়ে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নেয় এবং আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ পালনে ব্রতী হয়। এই কাহিনির নীতিকথা হল, কোনও ব্যক্তি দুষ্কর্ম ত্যাগ করে সুকর্ম পালনে ব্রতী হলে সে অচিরেই মোক্ষলাভ করবে। কিন্তু ডিন আচিসনের মতন সাম্রাজ্যবাদীর কাছে আমার এমন কন প্রত্যাশা ছিল না।

১৬। বৌদ্ধগ্রন্থ ‘সৎধর্মপুণ্ডরিকাসূত্র’-এ উল্লিখিত হয়েছে, দুঃখের সাগর সীমাহীন; কেবলমাত্র অনুতাপ করো, তবেই মাথা ফেরালে হাতে ঠেকবে সাগরকুল! অর্থাৎ, দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে ‘আত্ম-সমালোচনা’ প্রশ্ন আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলাম, আত্ম-সমালোচনার পন্থা শুধু জনগণের ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা সম্ভব, সাম্রাজ্যবাদী এবং চীনের প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিদের পক্ষে ‘মাথা ফেরালেই হাতে ঠেকবে সাগরকুল’ সম্ভব নয়, অর্থাৎ, অশুভ পন্থা ত্যাগ করে দয়ালু হৃদয় দেখাতে পারবে না’ ।

১৭। সাম্রাজ্যবাদী এবং চীনের প্রতিক্রিয়াশীলরা আসলে কাগুজে বাঘ। তাঁদের জন্য ভয় পাওয়ার কারণ নেই। প্রত্যেক মানুষকেই দুঃখ ও বেদনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়; শিশুরা মা-বাবার পক্ষপাতিত্বে ভয় পায়, ছাত্ররা পরীক্ষার ভয় পায়, সন্তানদের তিন দুর্দশা অষ্ট ক্লেশ, ৪১ডিগ্রি জ্বর…এসবই অতিক্রম করা যায়। বৌদ্ধ ধর্মমতে চারটি কল্পের মধ্যে একটি হল সম্বত কল্প। তখন আসে তিন ধরণের বিপর্যয়, যেমন প্রবল বন্যা বা প্লাবন, অগ্ন্যূৎপাত, দাবানল ও অগ্নিকাণ্ড, এবং প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝা। অষ্ট ক্লেশ-এ এমন সব দুরবস্থা হয় যখন বুদ্ধদর্শন বা ধর্মপ্রাপ্তি দুরুহ হয়।

১৭। আমি যা যা ভেবেছি, অনেক কিছুই বাস্তবায়িত করতে পারিনি। ১৯৫৭ সালে এক বক্তৃতায় আমার ‘শতফুল বিকশিত হোক, শতমতবাদ মুখরিত হোক’ নীতি সম্পর্কে বলেছিলাম, এই নীতি এক সুদূরপ্রসারী ও মৌলিক নীতি, সাময়িক নয়।... আমরা আরও মুক্ত হতে ভয় পাব না, সমালোচনা এবং বিষগুল্মগুলিকেও ভয় করব না! সঠিক নয় এমন জিনিস সব সময়েই থাকবে, তাতে ভয় পাবার কিছু নেই। সম্প্রতি, মঞ্চে ষাঁড়মুখো দানব আর সরীসৃপ দেহধারী ভগবানদের মঞ্চ থেকে প্রস্থান ঘটবে; আপনারা চাইলেও আর তাঁদের দেখতে পাবেন না। অনেক বৌদ্ধগ্রন্থে নরকরাজ্যের ষাঁড়মুখো দানব আর সরীসৃপ দেহের ভগবান বা রক্ষাপালের বর্ণনা পাওয়া যায়। কিন্তু আমার সঙ্গীরা এই ‘শতফুল বিকশিত হোক, শতমতবাদ মুখরিত হোক’ নীতি বাস্তবায়িত হতে দেননি। এই আক্ষেপের কথা আমি কাকে বলব?

১৮। বৌদ্ধ ধ্যান সম্প্রদায়ের আরেকটি রূপক আমি ব্যবহার করেছি – উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ যায় না মন্দির দর্শনে। অর্থাৎ, মন্দিরে প্রবেশের অর্থ একটি উদ্দেশ্যসাধন। ১৯৫৮ সালের ২২মার্চ, ছেংতু শহরে আমার বক্তৃতার শুরুতেই এই রূপকটি ব্যবহার করে বলেছিলাম, ‘আমার কয়েকটি প্রশ্ন আছে যেগুলি নিয়ে আপনাদের সঙ্গে মত বিনিময় করতে চাই; কথায় বলে, উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ যায় না মন্দির দর্শনে! কারও মনে প্রশ্ন জাগলে অন্যদের কাছে যাওয়া উচিত’।

কিন্তু আজ আমার মনের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার কেউ নেই, আমিই যেন ক্রমে ঈশ্বর হয়ে উঠছি, যে ঈশ্বরের সব ইচ্ছাপূরণ হয় না!

এজন্যেই আমি চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবে তিব্বতকে যুক্ত করার আগে চু তেহর সঙ্গে আলোচনা করে মন্ত্রীপরিষদ এবং পার্টির কমরেডদের তিব্বতের সংস্কৃতি এবং বৌদ্ধদর্শন নিয়ে পড়াশুনা করতে, এবং ভালোভাবে বুঝে তারপর পা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলাম। ক্ষমতার আলোয় কমিউনিস্টদের ঈশ্বর হয়ে ওঠার প্রবণতা আমি কোনোদিন মেনে নিতে পারবো না! মৃত্যুর পর আমার গুরু মার্ক্সকে আমাদের প্রয়োগের সাফল্য ও সঙ্কট নিয়ে কী ব্যাখ্যা দেবো?

--

চলবে ...