শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

মহাসত্যের বিপরীতে,# তৃতীয় খণ্ড # প্রথম অধ্যায়

# তৃতীয় খণ্ড # প্রথম অধ্যায়

‘নির্জনতা আত্মার উন্নতির একটি প্রধান উপায়। নিম্নজগতের কোনও প্রভাব এই উত্তুংগ জনহীন পর্বতচূড়ায় এদের (সাধুদের) দেহমন স্পর্শ করে না। নির্জনতায় এরা শক্তি অর্জন করেন। - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়


অলক ভাবে, বিভূতিবাবুর এই অনুভব একটি আপেক্ষিক সত্য। গরবের জীবন নিয়ে ভাবতে ভাবতে অলক এই আপেক্ষিকতা অনুভব করে।

সারারাত অবিরাম হাঁটতে হাঁটতে একসময় এক অপূর্ব ভোরের আকাশের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে গরব। উত্তর তিব্বতের পূর্বপ্রান্তে বিস্তৃত শুষ্ক তৃণভূমিকে বিশাল তিব্বতের মালভূমি থেকে স্বতন্ত্র করে রেখেছে একটি উঁচু পর্বতমালা।

এক মিষ্টি ভোরের আলোয় স্ফটিকের মতো দেখতে এই পর্বত ধীরে ধীরে সূর্যের আলোয় সোনালি হয়ে উঠছে। প্রথমে অনগ ও পরে রামের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের ফলে সে সো-সা-লিং এর ভৌগোলিক অবস্থান ঠাহর করেছে। সেজন্যে গরব জানে, এই অঞ্চলের পশুপালকরা কেউ কেউ সমীহ করে এই পর্বতকে অ্যামনে ম্যাৎচেন আর অন্যরা ম্যাৎচেন পুমরা নামে ডাকতে ভালবাসে।

মানুষের বিশ্বাস, এই পাহাড় তাদের রক্ষাকর্তা ঈশ্বরের আবাসস্থল। সেখান থেকে যত বাতাস আসে সারাবছর তাতে কমবেশি মিশে থাকে স্বর্ণাভ জলকণা। এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গটি সারা বছর বরফে ঢাকা থাকে। আর সামনেই সারিবদ্ধ অতন্দ্র রক্ষীর মতো অনেককটা বিশাল কালো পাথুরে পাহাড় সটান দাঁড়িয়ে পর্বতের পাদদেশের সোনালি আস্তরণ ও সোনার ফাটলগুলিকে আড়াল করে পাহারা দেয়। স্বর্ণাভ জলকণা মিশ্রিত হিমেল বাতাস সেই আড়ালগুলিকে সিক্ত করে পাশ কাটিয়ে আসে। এর ঝাপটা মুখে লাগলে মানুষ নাকি ক্রমে নির্লোভ নির্মোহ হয়ে ওঠে।

তিব্বতের জাতীয় মহাকাব্য ‘লিং এর গেসার’-এর নায়ক তাঁর যৌবনে এই পাহাড়ের পাদদেশে থাকত। মহাকাব্যে তাঁর যে মহামূল্যবান ধনসম্পদের কথা বলা হয়েছে তাঁর সবই এই অ্যামনে ম্যাৎচেন এর সোনা। নিজের প্রাচুর্যের সময় গরবও এই পর্বতমালার পাদদেশে উঁচুনিচু চারণভূমিগুলিতে তার পশুগুলিকে পাঠাতো। তারপর একদিন দলবলসহ ওই চারণভূমির প্রান্তে একটি পাহাড়ি ঝোরার পাশে গরব একটি গ্রাম পত্তন করেছিল। দাম্ভিক এবং দামাল দস্যুসর্দার এই পাহাড়গুলির নানা গিরিপথ ও দুর্গম গিরিসংকট পার হয়ে শুষ্ক তৃণভূমি থেকে পশ্চিমে তিব্বতের মালভূমিতে ঘোড়া ছুটিয়ে অভিযানে গেছে অসংখ্যবার। এমনি এক পশ্চিমমুখী অভিযানেই দেখা হয়েছিল তার প্রিয়তমা দেচমার সঙ্গে।

অথচ গরব ছোটবেলায় ভাল ছাত্র ছিল। গৃহশিক্ষক তাকে খুব ভালবাসত, আর ওর আগ্রহ দেখে পড়ার বাইরে গিয়েও গল্পের মতো তিব্বতের ইতিহাস পড়িয়েছেন। কিন্তু তারপর সময়ের স্রোতে নানা ঘাত প্রতিঘাত তার জীবনকে এলোমেলো করে দিয়েছে। অনেক অনেক পেয়েছে, আবার হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে।

এভাবে মাসের পর মাস পায়ে হেঁটে হেঁটে অনেক জনপদ পেরিয়ে আজ পরিণত বয়সে অ্যামনে ম্যাৎচেনে দোর্দজি মিগ্যুর সান্নিধ্যে এসে নতুনভাবে অনেককিছু জানে সে।

হয়তো এগুলি মানুষের জ্ঞান বা যুক্তির অতীত, রহস্যময় সংযোগ, হয়তো কোনও আহত শ্বাপদের গুহায় ফিরে আসা কিম্বা আহত পশুদের খোঁয়াড়ে ফেরার মতন কিছু। আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে প্রণয়ী বিচ্ছেদের দুঃখ, প্রিয় ঘোড়া নাগপোকে হারানোর কষ্ট এবং প্রিয়তম বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে সামান্য ভুলে নিজের হাতে মেরে ফেলার মতন বেদনার ভারে ন্যুব্জ গরব অবশেষে সেই অ্যামনে ম্যাৎচেনের গুহাবাসী সন্ন্যাসী দোর্দজি মিগ্যুরের কাছে এসে সে নিজের সমস্ত পাপের কথা বলে কিছুটা হাল্কা হয়।

দোর্দজি মিগ্যুরের প্রজ্ঞা ও অনাড়ম্বর সংযমী স্বভাবের কথা দূর দূরান্তের ভক্তরা জানেন! তিনি নাকি দৈবশক্তির অধিকারী। অনেকেই দূরদূরান্ত থেকে তাঁর দীক্ষা নিতে আসেন। কিন্তু তিনি তাঁদের সবাইকেই সবিনয়ে ফিরিয়ে দেন। কাউকে খুব পছন্দ হলে বড়জোর কয়েকসপ্তাহ বা কয়েকমাস তাঁর আশ্রমে থাকতে দিতেন।

এহেন সন্ন্যাসী বিন্দুমাত্র অবিচলিত না হয়ে ধৈর্য ধরে গরবের দীর্ঘ অপরাধ-স্বীকার শোনেন। তারপর শান্তভাবে তাকে কিছু সহজ ধর্মীয় আচার শিখিয়ে সেগুলির মন দিয়ে নিয়মিত অভ্যাস করতে বলেন। কী মনে করে তাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য নিকটবর্তী একটি গুহায় থাকার অনুমতি দেন। ওই গুহাটিতে এতদিন দূরদূরান্তের নানা অঞ্চল থেকে শ্রদ্ধাভরে অর্ঘ্য নিয়ে আসা বা ধর্মীয় উপদেশ নিতে আসা ভক্তদেরই এক রাতের জন্যে থাকতে দেওয়া হতো।

তিনি গরবকে একটি বই পড়তে দেন যাতে গৌতম বুদ্ধের জীবন ও বানী সহজ তিব্বতি ভাষায় লেখা রয়েছে। গরব মনোযোগ দিয়ে সেটি পড়ে শেষ করে। তারপরই তিনি গরবকে পড়তে দেন তিব্বতের ইতিহাস।

একে রহস্যময় সংযোগ ছাড়া আর কী বলা যাবে! সো সা লিং এ থাকার সময় প্রথমে অনগ ও পরে রামের সঙ্গে বন্ধুত্ব, বন চিকিৎসকবৃন্দ, সেবাইতরা এবং মঠাধ্যক্ষের নানা আচরণ, শেষের সেই ভয়ংকর রাত, নারকীয় শৈলান্তরীপ, জীবন বাজি রেখে ভারতীয় সাধু আয়ুর্বেদ চিকিৎসক রামকে উদ্ধার আর অবশেষে রামের মৃত্যুজনিত শোক এতদিন তাঁকে বিহ্বল করে রেখেছিল! দেচমাকে নিয়ে বেশি ভাবার অবকাশই পায়নি। মাঝেমধ্যে মনে পড়লেও ঘটনাপ্রবাহের তোড়ে অথবা ক্লান্তির কারণে দ্রুত অন্যদিকে বিক্ষিপ্ত হয়েছে। এবার অ্যামনে ম্যাৎচেনের শান্ত নিরুদ্বেগ পরিবেশে পাহাড়ি ঝোরা থেকে জল আনা আর রান্না করা ছাড়া প্রায় কর্মহীন একা একা থাকতে থাকতে সহজ ভাষায় লেখা বুদ্ধের জীবন ও বাণী কিম্বা তিব্বতের ইতিহাসের পাতা মাঝেমধ্যেই স্মৃতিতাড়িত হয়ে ঝাপসা হয়ে ওঠে। তার আবার দেচমার কথা মনে পড়ে।

সেই একই উত্তরপূর্বের তৃণভূমি, চেনা পরিবেশ তার স্মৃতিকে উস্কে দেয়, সজীব করে তোলে। ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনরাত, মাসের পর মাস পাশাপাশি ঘোড়া চালিয়ে রাজধানী লাহসা যাওয়া আবার সেখান থেকে দীর্ঘ বন্ধুর পথ পেরিয়ে মহাতীর্থ খ্যাং তিসে যাওয়া, বারবার পরস্পরকে তীব্র আশ্লেষে কাছে টেনে নেওয়া আর নানা আসনে স্বর্গীয় আনন্দে ডুবে যাওয়ার স্মৃতি দিনের পর দিন ওর মধ্যে প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠতে থাকে। রাতের পর রাত খোলা আকাশের নিচে তারার আলোয় মিলন-মুহূর্তগুলি কিম্বা জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাওয়া পৃথিবীর ছাদের বুকে সারারাত পাশাপাশি ঘোড়া চালানোর স্মৃতি ওকে পাগল করে তোলে। সফল যৌনতা যে শুধুই পাশবিক তৃপ্তি নয়, পরস্পরকে আরও আরও নিবিড়ভাবে পাওয়ার আনন্দে প্রতিটি মিলনে এক নতুন আবিষ্কারের স্বর্গীয় অনুভূতি, এই অনুভব গরবের দস্যু মনকে প্রেমিকে পরিণত করেছে।

সো সা লিং এ দীর্ঘ বিশ্রাম ও নিয়মিত শরীরচর্চার ফলে সে যে দেখতে আরও সুন্দর ও সুঠাম হয়েছে – তা সে প্রতিদিন জল আনতে গিয়ে ঝর্ণার জলে নিজের প্রতিফলন দেখে বুঝতে পারে।

শুধুমাত্র শেষ কয়েকদিনের বিভীষিকা বাদ দিলে অনগ ও রামের সাহচর্যে দিনগুলি তার খারাপ কাটেনি। তার সুঠাম চেহারা, অনেকটা ভারতীয়দের মতন উঁচু নাক ও আয়ত চোখ দেখে গত এক বছরের পদব্রজে যেখানে যেখানে সে রাতে আশ্রয় নিয়েছে, অনেক মহিলাই তাকে বেশ খাতির করেছে। দু একজন তো প্রেম নিবেদনও করেছে। আগে হলে ওদের প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গেই শারীরিক সম্পর্ক হয়ে যেত। কিন্তু গরব এখনও নিজেকে দেচমার সম্পত্তি ভাবে। অবশ্য কাউকে দেখে ওর মনে কোনও অনুভূতি হয় না, শরীর জেগে ওঠে না বললে ভুল হবে। কিন্তু প্রত্যেককেই সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে। সে যে এক মুহূর্তের জন্যেও দেচমাকে ভুলতে পারে না।

প্রথম রাতের মিলন মুহূর্তে গরব মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করেছিল, দেচমার মধ্যে এমন কী আছে যা তাকে অন্য সবার থেকে আলাদা ও চরম আকর্ষক করে তোলে? তার মনে এসেছিল রূপকথার গল্প, রাক্ষুসী সিনদোংমার কথা, যে সুন্দর পুরুষদের দেখলে তাঁদের প্রেমের ছলাকলায় ভুলিয়ে দেয়। কিন্তু পরে দেচমার সারল্য, আন্তরিকতা ও ভালবাসায় ধীরে ধীরে তার মন থেকে সমস্ত প্রশ্ন মুছে গেছিল। তারপর দীর্ঘ দীর্ঘ যাত্রা ও প্রলম্বিত মধুচন্দ্রিমায় সে ডুবে ছিল যতদিন না খ্যাং তিসের অশরীরী, তার নিজেরই পিতার অতৃপ্ত আত্মা এসে ছন্দপতন ঘটায়।

হায়! দেচমা আর বেঁচে নেই। গরব তাকে খরস্রোতে ভেসে যেতে দেখেছে। কিন্তু তবুও মন মানে না। ভেতর থেকে কেউ বলে, মৃতদেহ তো দেখোনি! ভেসে যাওয়ার পরও আবার লাফিয়ে সে দুটো হাত শূণ্যে তুলেছিল! প্রজাপতির মতন আঙুলগুলি! তারপর গরব আর অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাওনি!

কোনওভাবে যদি বেঁচে গিয়ে থাকে, হে ঈশ্বর, এমনটাই যেন হয়, দেচমা যেন বেঁচে থাকে! এই আস্তিক আকুতি ও একটা ক্ষীণ আশা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এখনও দেচমার কথা মনে পড়লেই ওর হৃৎস্পন্দন বাড়ে, হাত-পা এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় নিশপিশ করতে থাকে। নিজের উত্তেজনাকে প্রশমিত করতে সে সন্ন্যাসীর শেখানো মন্ত্র জপ করতে থাকে, রামের শেখানো অন্যান্য আসনও করতে থাকে। এ ছাড়া আশ্রমের জন্য কাছের ঝর্ণা থেকে খাওয়ার জল বয়ে আনা, পাহাড়ে ঘাস খেতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে মরে যাওয়া ছাগল কিম্বা ভেড়ার মাংস কেটে শুকিয়ে শুকনো খাবার প্রক্রিয়াকরণ, এই সব কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখে, কাজ করতে করতেও মন্ত্র আওড়াতে থাকে। এই মন্ত্রের মাধ্যমে বোধিসত্ত্বের সদাশয়তা, বদান্যতা, পরোপকারের ইচ্ছা এবং সমস্ত জীবের যাতনা উপশমের ব্রতে নিজেকে উৎসর্গ করার মিনতিপূর্ণ আহবান ওকে প্রেরণা জোগায়।

অলকের মনে হয়, এই চিন্তাশীল, ধ্যানাভিমুখী দার্শনিক জীবনের সঙ্গে গরবের শারীরিক ও মানসিক ধাত, অভিমানী ও মেজাজী স্বভাব একদমই খাপ খায়না! তখন গরবের বয়স মাত্র বত্রিশ। অলকের বয়সও এখন বত্রিশ। একজন বত্রিশের দামাল যুবকের শারীরিক বা মানসিক ধাত, তার আত্মাভিমান ও মেজাজ, বিশেষ করে দেচমার মতন ডানাকাটা পরী যার সঙ্গিনী ছিল, সেই যুবকের প্রবল রিরংসা নিয়ন্ত্রণে আশ্রমের কাজ আর সর্বক্ষণ মন্ত্র জপ অব্দি মানা গেলেও সবসময় বোধিসত্ত্বের প্রেরণা নিয়ে জীবের সেবায় সীমাবদ্ধ – এতটা সে মানতে পারছে না!

বত্রিশের যৌবন আর প্রবল পুরুষ গৌরব বোধিসত্ত্বের করুণার দর্শনে প্রভাবিত হয়ে নিজের রিরংসাকে ভোলানোর চেষ্টা করলেও তার সুখস্মৃতিগুলি যে সবসময়ই তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াবে এটাই স্বাভাবিক। অলক তাই আলেকজান্দ্রা ডেভিড নীলের চরিত্রকে এখানে নিজের মতোই গ্রহণ করে। তার দেচমাও এখন সহস্র যোজন দূরে আগরতলায়। নিজের বিরহ দিয়ে মেপে সে বোঝে যে, ওই আশ্রমে গরব যেভাবেই থাকুক না কেন, সে যেহেতু স্বামী বিবেকানন্দের মতন দার্শনিক প্রেক্ষিতে বড় হয়নি, শুধু দোর্দজি মিগ্যুর সান্নিধ্য আর রামের শেখানো যোগাসন সম্বল করে সমস্ত কামনা-বাসনা সে নিশ্চয়ই ত্যাগও করতে পারেনি!

অলক বোঝে, গরবের আত্মাভিমান তাকে যে কোনও শাস্তি মাথা পেতে নিতে পিছপা করবে না। গরবের মন এই ধারণাকে অবজ্ঞা না করেই পোষণ করতে চায়। সেজন্যেই হয়তো সে দর্দজি মিগ্যুরের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে, নাহলে সে নিজের কাছেই কাপুরুষ প্রতিপন্ন হতো! সে যে প্রায়শ্চিত্য করতে চায়।

কিন্তু দর্দজি মিগ্যুর কোনও প্রায়শ্চিত্যের পথ দেখান না। তিনি বলেন, অতীত ভুলে যাও, তুমি কিছু অন্যায় করেছো – এমন চিন্তাই মাথায় এনো না!, প্রায়শ্চিত্য আসলে বিনা বিচারে শাস্তি পাওয়ার অপর নাম। একে প্রশ্রয় দিলে নিজের উপর খামোখা অত্যাচার করা হবে! যা বাস্তবে নেই, তাঁকে গুরুত্ব দেওয়া হবে! সবকিছু যা, আর যা কিছু ঘটে, সেগুলির কারণ বহুবিধ হতে পারে – যা পরস্পরের সঙ্গে সুক্ষ সুতোয় জুড়ে রয়েছে। সাধারণ মানুষের পক্ষে সময়ের ঘন কুয়াশায় ঢুকে সবকিছুর কারণ বোঝা সম্ভব হয় না, বরঞ্চ, তার বিপরীতে একটি কারণহীন কারণ অঙ্কুরিত হয়ে উঠতে পারে! তাই বাছা, তুমি আর তোমার কৃতকর্মের মধ্যে ওই আভ্যন্তরীণ সুতোর জাল ধরে টানাটানি করো না, অযথা সেই টানে আরও অনেক সূত্র জড়িয়ে কখনও না খুলতে পারা গিঁট লেগে থাকে। তোমাদের আক্রমণে যারা কষ্ট পেয়েছেন, তা তাদের কর্মফলেও হতে পারে! তোমার তীর্থযাত্রার হয়রানির সঙ্গে এই অস্তিত্বের সুতোর মালার তুলনা করো, নিজেকে ভবিতব্যের হাতে ছেড়ে দাও, সবকিছু ভোলার জন্যে নিজেকে যথাসম্ভব ব্যস্ত রাখো, হাসিমুখে কায়িক শ্রম করতে থাকো! বোধিসত্ত্বরা এই ইন্দ্রিয়াতীত কারণগুলি দেখা ও শোনার কল্পিত ক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছিলেন, এই অলোক দৃষ্টিই তাঁদেরকে দয়ার অবতার, শিক্ষক, পথপ্রদর্শক ও যারা ঘৃণা ও লোভের বশবর্তী হয়ে নিজেদের উদভ্রান্ত করে তোলে সেসব অজ্ঞান মনের চিকিৎসক করে গড়ে তুলেছিল।

পেছনে তাকানো থামাও বাছা, নিজেকে বোধিসত্ত্বের দাস করে গড়ে তোলার গৌরব অর্জন করো, তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করো, নিজেকে ভুলে যাও, পৃথিবীর মানুষের মনের দুঃখ দূর করে আনন্দ দেওয়ার ব্রতে নিজেকে সমর্পন করো!

গরব মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শোনে। তিব্বতীরা বোধিসত্ত্বদের আদর্শ ও তাঁদের দর্শনকে সমীহ করেন, শ্রদ্ধা করেন। গরবও তার ব্যতিক্রম নয়। সে আগেও বেশ কয়েকজন লামার মুখে বোধিসত্ত্বের দর্শন সম্পর্কে শুনেছে, কিন্তু কেউই তাকে দর্দজি মিগ্যুরের মতন প্রভাবিত করেননি। সেজন্যেই হয়তো এই দর্দজি মিগ্যুরের কথামতন প্রাক্তন দস্যুসর্দার গরব নিজেকে বোধিসত্ত্বের দাসে পরিণত করে। মানুষের দুঃখকষ্ট দূর করে আনন্দদানের উপযোগী করে নিজেকে গড়ে তোলার কঠোর ব্রত নিয়ে অ্যামনে ম্যাৎচেনের গুহায় ধার্মিক আচার আচরণ মেনে এই আত্মসংযম!

আর তারপরই, হয়তো দর্দজি মিগ্যুর বর্ণিত কিছু কারণহীন কারণ অঙ্কুরিত হয়ে দুটো এমন ঘটনা ঘটে যা গরবের তথাকথিত মুক্তির পথে চলা থামিয়ে দেয়।

একদিন দর্দজি মিগ্যুরের দুই সাধারণ পশুপালক শিষ্য আশ্রমের জন্য উপঢৌকন নিয়ে আসে। ওরা আগে এলে যে গুহায় রাত কাটিয়ে পরদিন ফিরে যেত সেই গুহায় তখন গরবের বাস। পাহাড়ের উপর সন্ন্যাসীর গুহায় যাওয়ার আগে ওই দুই পশুপালক তাদের কম্বল ইত্যাদি রাখতে গুহায় ঢুকে গরবের মুখোমুখি হয়ে অবাক।

গরবও অবাক। সে ওদের দুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরে। ওরা দুজনেই ছিল গরবের দলের সদস্য, যারা ডাকাতির পর গ্রামে ফিরে গিয়েছিল। সে ওদেরকে শুকনো ফল খেতে দিয়ে জল গরম করে ৎসাম্পা বানাতে থাকে।

গরবকে এখানে দেখে শুরুতে ওরা ভাবে সে বুঝি আত্মগোপন করে আছে। ওরা তাই ধীরে ধীরে বলতে শুরু করে, চীনা মুসলমান সেনাদলের আক্রমণের পর চার বছর পেরিয়ে গেছে। শুনেছি, সেই কুখ্যাত জেনারেল এখন চীনে কৃষক আন্দোলন দমনে ব্যস্ত। কিন্তু ওই কৃষক আন্দোলন চীনের এত বিস্তৃত অংশে ছড়িয়ে পড়েছে যে সম্রাটের সেনাবাহিনী হিমশিম খাচ্ছে। এই অবস্থায় ওই সেনাবাহিনীর আর এদিকে আসার প্রশ্নই ওঠে না! সবাই জানে যে ওই সেনানায়ক তোমার মাথার দাম ঘোষণা করলেও এতদিন পর কেউ বলে দিয়ে সেই টাকা আর পাবে না! তুমি এখন নির্ভয়ে পুরনো জীবিত সহযোগীদের কাছে ফিরে আসতে পার।

আমরা ফিরে গিয়ে আশপাশের সমস্ত বসতিতে ঘুরে ঘুরে সবাইকে খবর দিয়ে দেব। খবর পেলে সবাই ছুটে আসবে, সবাই তোমাকে দেখে খুশি হবে!

গরব ওদের আবেগ টের পায়। তার দুচোখও আবেগে বাষ্পাকুল হয়!

ওদের কথা শুনে বোঝে যে ওরা লজ্জিত, সবাই মানে যে গরবের নির্দেশ না মেনে লোভের বশবর্তী হয়ে ডাকাতি করতে বেরিয়েই আজ সবার এই দশা! গরবকে আবার পেলে তারা সেই অনুশোচনা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে পাবে। গরবকে নেতা পেলে ওরা আবার অভিযানে বেরুবে, আর তার নির্দেশ অমান্য করে এক পাও এদিক ওদিক করবে না! ওরা কথায় কথায় এ কথা জানাতেও ভোলে না যে, গরব এখন দেখতে আরও সুন্দর ও সুঠাম হয়েছে!- যেন সাক্ষাৎ লিং এর গেসার!

ওদের কথা শুনে গরব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। ওদের আবেগ তাঁকে স্পর্শ করলেও নিজেকে সংযত রাখে। একবার গলাখাকারি দিয়ে ওদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলে, তোদের প্রতিটি শব্দ আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে! কিন্তু আমি কারও ভয়ে এখানে আত্মগোপন করে নেই। তাহলে তো অনায়াসে তিব্বতের মালভূমিতে গিয়েই রাজার হালে থাকতে পারতাম! চীনা সৈন্যরা কোনদিনই দুর্গম অ্যামনে ম্যাৎচেন পার হয়ে তিব্বতের মালভূমিতে যায়নি, আর যাবেও না! কিন্তু আমি অ্যামনে ম্যাৎচেনে এসেছি মহান সন্ন্যাসী দর্দজি মিগ্যুরের শরণাপন্ন হয়ে পবিত্র জীবনযাপন করতে। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী দয়ার সাগর বোধিসত্ত্বদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মানবকল্যাণে আত্মোৎসর্গ করাই এখন আমার একমাত্র লক্ষ্য। আমরা নিজেদের আনন্দের জন্য অভিযানে বেরিয়ে কত লোকের যে সর্বনাশ করেছি! ফলস্বরূপ আমি আমার প্রিয়তমাকে হারিয়েছি, আর একজন অতি ঘনিষ্ট ভারতীয় আয়ুর্বেদ সন্ন্যাসী বন্ধুকে হারিয়েছি-

বলতে বলতে গলা বুজে আসে গরবের। আবেগে ঠোঁট দুটি থরথর করে কাঁপতে থাকে! পশুপালকরাও হতভম্ব! একটা নাম না জানা পাখির তীক্ষ্ণ কর্কশ ডাক সেই নীরবতাকে ফালাফালা করতে থাকে!

গরব মাথা নেড়ে বলে, না ভাই, আমি আর সে পথে যাব না, সম্ভব হলে তোমরাও সেসব ভুলে ধর্মের পথে, সেবার পথে চলে এস, শান্তি পাবে!

পশুপালকরা তাঁদের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এ কী শুনছে তারা, গরবের মুখে করুণার কথা! এই কি সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ দস্যুসর্দার, যার নাম শুনলে পুরো তিব্বত এখনও কাঁপে! অবশ্য ওরা প্রাজ্ঞ লামাদের মুখে এরকম গল্প শুনেছে! বিশেষ করে অঙ্গুলিমালার সন্ন্যাসী হওয়ার গল্প, অঙ্গুলিমালাও গরবের মতন দোর্দণ্ডপ্রতাপ ছিল! সে তার হত্যা করা একহাজার মানুষের কড়ে আঙুলের নখ দিয়ে গাঁথা মালা গলায় দিত। সেই অঙ্গুলিমালা গৌতম বুদ্ধের সংস্পর্শে এসে, তাঁর বাণী শুনে একদিন সব ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়ে পড়েন, এবং ক্রমে পড়াশুনা, ধ্যান ও মানবসেবার মাধ্যমে প্রজ্ঞার শীর্ষে উঠে একজন অরহত হতে পেরেছিলেন।

দুই পশুপালকই এবার মাথা ঝুঁকিয়ে হাঁটু গেড়ে প্রণাম জানায়। তারপর হাত জোড় করে থাকে। এবার গরবের অবাক হবার পালা। সে যে এই দুজনের প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি চেনে! সে অনুভব করে, এই প্রণাম নিছকই আজ্ঞাবাহকের নয়, তার সঙ্গে মিশে রয়েছে ভক্তি ও শ্রদ্ধা। সে কি এসবের যোগ্য?

গরব এগিয়ে গিয়ে দুজনের কপালে চুমু খায়। ওরাও গরবের হাতের পেছনে চুমু খেয়ে শ্রদ্ধেয় সন্ন্যাসী দর্দজি মিগ্যুরের সঙ্গে দেখা করতে যায়।


চলবে ...