বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ১৮, ২০২৪

মহাসত্যের বিপরীতে তৃতীয়খণ্ড #১১শঅধ্যায়

‘প্রতিমাসে শ্রেষ্ঠ দিন পূর্ণিমা/ একমাস পর চাঁদের বুকে ধার্মিক শশককে দেখা যায়!’ - ৎসাংইয়াং গ্যাৎসো( ৬ষ্ঠ দলাই লামা)

এইধার্মিক খরগোশটি একজন বৌদ্ধ জাতক। কথিত আছে, তাঁর পবিত্রতায় মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্র তাঁকে স্বর্গে নিয়ে গিয়ে পবিত্রতার প্রতীকরূপে দেবতা ও মানুষকে দেখানোর জন্যে চাঁদের গায়ে স্থাপন করেন। আমরা প্রতিমাসে পূর্ণিমারাতে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে দেখি, তিব্বতের আবালবৃদ্ধবণিতা দেখে।পৃথিবীর অন্য যে কোনও জায়গা থেকে তিব্বতে চাঁদকে বড়ো দেখায়। কথাটা যে সত্যি তা আমি ভারতে আসার পর টের পেয়েছি! তিব্বতি জনগণের জীবনে চাঁদের গুরুত্বও বেশি।

তিব্বতের ক্যালেন্ডার অত্যন্ত জটিল,চান্দ্রমাসের হিসেবে রচিত হয়।তাছাড়া একশো বছরের শতবর্ষের জায়গায় আমরা ষাটবছরের একটি চক্রকে মানি, যার প্রত্যেকটি বছর পৃথিবী, বায়ু, আগুন, জল এবং লোহা–এইপাঁচটি উপাদানের একটির সঙ্গে এবং ইঁদুর, বল, চিতা, খরগোশ, ড্রাগন, সাপ, ঘোড়া, ভেড়া, বানর, পাখি, কুকুর এবং শুয়োর - এইবারোটি প্রাণীরমধ্যে একটির সঙ্গে ক্রমান্বয়ে সংযুক্তথাকে।প্রত্যেকউপাদান দু’বার করে আসে, প্রথমেপুরুষরূপে, তারপর স্ত্রীরূপে।এইভাবে, তাদের চক্রটি দশবছরে শেষ হয়।তারপরে প্রথম উপাদানটি একাদশ এবং দ্বাদশপ্রাণীর সঙ্গে যুক্ত হয়, দ্বিতীয়টি ত্রয়োদশ এবং চৌদ্দতম প্রাণীর সঙ্গে এবং একই ক্রমে বছরগুলি ঘুরে ঘুরে আসে। উদাহরণস্বরূপ, তিব্বতী ক্যালেন্ডার অনুসারে ২০০০সালটিকে লোহা এবং ড্রাগনের বছর বলা হবে।

তিব্বতে চীনা আগ্রাসনের বহু শতাব্দী আগে থেকেই ঋতুগুলি, অগুণতি উৎসব অনুষ্ঠান অসংখ্য দিবসের সঙ্গে যুক্ত ছিল।এগুলির ধর্মীয় তাত্পর্য রয়েছে, সমস্ত ভিক্ষু ও সাধারণ মানুষ এগুলি পালন করেন। এই উত্সবগুলিতে জমিয়ে পছন্দ মতন খাওয়া দাওয়া, নাচ-গান, গ্রাম্য ক্রীড়া চলে, সমবেত প্রার্থনাও হয়।এগুলির মধ্যে লোসারবানব বর্ষবরণ উৎসব খুব উল্লেখযোগ্য। পাশ্চাত্য ক্যালেন্ডার অনুসারে এটি ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাসে পড়ে। আমার জন্য এটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে কারণ এই দিনে আমাকে প্রতিবছর প্রথানুসারে রাজ্যের দিব্যবক্তা নেচুংগের সঙ্গে দেখা করতে হয়। এই সাক্ষাৎ নিয়ে পরে বিস্তারীত লিখবো। এখানে এটুকু বলি যে, এই সাক্ষাতের মাধ্যমে আমি এবং আমার সরকার, একটি মাধ্যম বা 'কুতেন' এর সাহায্যে, পরের বছরের জন্য তিব্বতের রক্ষক দেবতা দোর্জে দ্রাগদেনের পরামর্শ পাই।

আরেকটি উত্সব নিয়ে আমার মিশ্র স্মৃতি রয়েছে। মোনলাম - যার অর্থ মহান প্রার্থনা উত্সব - লোসারের পরেই শুরু হয়। সেজন্যে যখন খুব ছোট ছিলাম তখনও আমাকে এর মূল আচারে অংশ নিতে হতোআর তারপরেই আমার প্রতিবছর জাঁকিয়ে জ্বর আসতো। খুব কষ্ট পেতাম। আজও যখনই বুদ্ধ গয়া তীর্থযাত্রায় যাই, সেখানকার ধুলোবালির কারণে আমার জাঁকিয়ে জ্বর আসে।কিন্তু শৈশবে জ্বর আসার কারণ হয়তো তখন জোখাং মন্দিরে গিয়ে থাকার বাধ্যবাধকতা,আমার শোবার ঘরের তুলনায় অনেক শীতল, অনেক এবড়োখেবড়ো মেঝেতে পাতা বিছানায় শোয়ার ব্যবস্থা।

এই আনুষ্ঠানিকতা, এই পূজাকে আমি খুব ভয় পেতাম, 'মোনলাম'-এর প্রথম সপ্তাহ শেষ হওয়ার পরে প্রতিদিন বিকেলেই অনুষ্ঠান শুরু হতো, এবং তারপরে চুপচাপ বসে শাক্যমুনি বুদ্ধের জীবন নিয়ে রিজেন্টের দীর্ঘ ব্যাখ্যা শুনতে হতো।পূজাটিও চারঘন্টা ধরে চলতো, আর তারপর আমাকে জনসমক্ষে স্মৃতি থেকে শাস্ত্রের একটি দীর্ঘ এবং কঠিন অংশ আবৃত্তি করতে হতো।সেই সময় আমি এতটাই ঘাবড়ে যেতাম যে দীর্ঘদিন অভ্যাস করে ঝরঝরে মুখস্ত করা কথাগুলি মনে করতে পারতাম না। আমার বরিষ্ঠ শিক্ষক, রিজেন্ট, কনিষ্ঠ শিক্ষক, আচার অনুষ্ঠানের কর্মকর্তাএবংপোশাক ওখাদ্য আধিকারিক - সবাই খুব উদ্বিগ্ন থাকতেন, কারণ পুরো সময়টি আমাকে খুব উঁচু আসনে বসে থাকতে হতো! স্তোত্র ভুলে গেলে সেখানে উঠে কারোও পক্ষে মনে করানোর উপায় ছিল না।

তবে এটি ছিল আমার সমস্যার অর্ধেক অংশ। অনুষ্ঠানটি অনেকক্ষণ চলতো বলে ভয় হতো যে এতক্ষণ ধরে হিসি আটকে রাখতেপারবো কি না!তবে কিভাবে যেন প্রত্যেকবারইসবকিছু ঠিকঠাক উৎরে দিয়েছি - প্রথমবার যখন খুব ছোট ছিলাম তখনও। কিন্তু মনে আছে,প্রতিবারই ভয়ে কাঁপতাম। শুধু তাই নয়,ইন্দ্রিয়গুলিএত অবশ হয়ে যেত যে বুঝতেই পারতাম না চারপাশে কী ঘটছে! এমনকি মন্দিরের ভেতর চারপাশে ওড়াওড়ি করা পায়রাদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনতে পেতাম না, দেখতেও পেতাম না। ওরা দ্রুত উড়ে এসে আরাধ্য প্রতিমার সামনে রাখা থালাগুলি থেকে খাবার ছোঁ মেরে নিয়ে যেত।কিন্তু কিছুক্ষণ সফলভাবে আবৃত্তি করার পর আমার মধ্যে দলাই লামা জেগে উঠতো।কান খুলে যেত,আবার তাদের বকবকম ও ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ পেতাম, আত্মবিশ্বাসও প্রবল হতো, আওয়াজে প্রত্যয় অনুভব করে অভিভাবকদের মুখে হাসি ফুটতো। শ্রোতারা প্রতিটি উচ্চারণ উপভোগ করতো।

এবং অনুষ্ঠানটি শেষ হলে আমি আনন্দে বিভোর হয়ে উঠতাম। প্রথমতঃ,এই ভয়ানক কর্মসূচি থেকে আবার বারোমাসের জন্য মুক্তি, দ্বিতীয়তঃএর পরে যথাস্থানে তলপেট হালকা করে শহরের পথে ঘুরে বেড়াতে পারি – এবং মহানন্দে পথের দুপাশে মাখন দিয়ে তৈরি বড়ো-বড়োআকারের থোরমা বা নানারঙের বুদ্ধমূর্তির নানা সাজ দেখতে পেতাম।এইসময় সামরিক ব্যান্ড বাজানো হতো, পুতুলখেলা দেখানো হতো; মহানন্দে নাচ-গান উপভোগ করতাম।

তিব্বতেজোখং মন্দিরটিকে সবচেয়ে পবিত্র বিবেচনা করা হতো। সপ্তম শতাব্দীতে রাজাসোগৎসেন গাম্পোর রাজত্বকালে তাঁর রানি,নেপালের রাজা অংশুরিয়া রূয়মের কন্যা ভূকুটী দেবীর সঙ্গে আনা এইবুদ্ধমূর্তিটি স্থাপনের লক্ষ্যে এই মন্দির নির্মিত হয়েছিল . সোগৎসেন গ্যাম্পোর আরও চার রানি ছিলেন,তিনজন তিব্বতি এবং একজন চীনা, তাং রাজবংশের দ্বিতীয় সম্রাটের মেয়ে রাজকুমারী বেঙ্গচেন কংজো। পরবর্তীকয়েক শতাব্দী ধরে বিভিন্ন রাজার আমলে মন্দিরটি প্রসারিত হতে থাকে। এই মন্দিরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশটি প্রবেশ পথের পাথরের স্তম্ভ,যা তিব্বতের প্রাচীন ইতিহাস এবং তার শক্তির প্রতীক।এর গায়ে শিলালিপিতে তিব্বতি ও মান্দারিন লিপিতে খ্রিষ্টিয় ৮২১-২২ সালে দীর্ঘআলোচনার মাধ্যমে গড়ে ওঠা স্থায়ী চুক্তিটি বিশদে খোদাই করে লেখা আছে।এটি নিম্নরূপ:

তিব্বতের মহারাজা, অলৌকিক দৈবী প্রভূ তথা চীনের মহারাজা, শাসক হোওয়াং-তি মধ্যে কাকা- ভাইপো সম্পর্ক রয়েছে। উভয়ের মধ্যে তাঁদের সাম্রাজ্যের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারীত আলোচনা হয়েছে। উভয় দেশের নাগরিকদের স্বার্থে তাঁদের মধ্যে একটি মহান চুক্তি সম্পাদন এবং তার নিশ্চিতকরণ হয়েছে। সমস্ত দেবতা এবং মানুষ এটি জানেন এবং এর সাক্ষী। এর কখনও পরিবর্তন হবে না;এই চুক্তিটি বিশদভাবে এই প্রস্তরস্তম্ভটিতে খোদিত হচ্ছে যাতে ভবিষ্যত প্রজন্মও এটি সম্পর্কে জানতে পারে।

অলৌকিক দৈবীপ্রভূ ত্রিসোংদ্রেৎ সেন এবং চীনের মহারাজা, শাসকহোওয়াং-তি, ভাইপো এবং কাকা তাঁদের দুই দেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সামগ্রিক স্বার্থের জন্য তাদের দূরদর্শী বুদ্ধি দিয়ে উভয়ের সমান উপকারের জন্য এই চুক্তি করেছেন।সবার শান্তি ও জনস্বার্থের একক কামনা নিয়ে সকলের চিরস্থায়ী স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য এই মহান চুক্তিতে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, উভয় দেশের প্রাচীন বন্ধুত্ব, সম্প্রীতি এবং প্রতিবেশীসুলভ সহযোগিতাকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন।

তিব্বত এবং চীন তাদের বর্তমান সীমানাকে সম্মান করবে। মহান চীন দেশের সীমান্তের পূর্বের সমস্ত অঞ্চল সন্দেহাতীত ভাবেই মহান তিব্বত দেশের অংশ বলে মান্য করা হবে। এই চুক্তির পর উভয় পক্ষই পরস্পরকে আক্রমণ করবে না এবং একে অপরের এলাকা দখল করবে না।যদি কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে এরকম সন্দেহ জাগে তাহলে তাকে বন্দী করা হবে,তাঁর কৃতকর্মের তদন্ত করে দেখা হবে এবং তাঁকে ফেরত পাঠানো হবে।

এখন যেহেতু উভয় দেশ এই চুক্তির মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে,তাই কাকা ও ভাইপো দেশের সৌহার্দ্য সুনিশ্চিত করতে নিয়মিত প্রাচীন রাষ্ট্রপথে উভয় দেশে শান্তিদূতদের অবশ্যই প্রেরণ করতে হবে। প্রাচীন রীতি অনুসারে, তিব্বত ও চীন সীমান্তে চিয়াং চুন পাহাড়ের পাদদেশে গিরিপথে ঘোড়ার আদান-প্রদান হবে। সুইইয়ুংপাহাড়ে চীন সরকারের প্রতিনিধিরা তিব্বতি দূতদের স্বাগত জানাবেন আর বরণ করে নিয়ে তাঁদের পরবর্তী পথে এগিয়ে যাওয়ার সমস্ত আয়োজন করবেন। উভয় পক্ষের মধ্যে ভাইপো এবং কাকার মতন আন্তরিক সৌহার্দ্য বজায় রেখে প্রয়োজনীয় পারস্পরিকসম্মান প্রদর্শন করা হবে।

দু’দেশের সম্পর্কের মধ্যে কোনও ধোঁয়া বা ধুলো থাকবে না। হঠাৎ কোনও বিপদের ঘন্টা বেজে উঠবে না এবং ‘শত্রু’ শব্দটি উচ্চারণও করা হবে না।সীমান্তরক্ষীরা অপর পক্ষের কাউকে ভয় পাবেন না, এবং তাঁদের ভূমির নিরাপত্তা এবং বিছানার আরাম সুনিশ্চিত থাকবে।সমস্ত মানুষ শান্তিতে বসবাস করবে এবং দশ হাজার বছর ধরে সুখের ফল পাবে। এর খ্যাতি সূর্য ও চাঁদের আলোর মতো দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে।

এই পবিত্র চুক্তি দিয়ে সেই মহান যুগের সূচনা হলো, যখন তিব্বতের জনগণ তাঁদের দেশে এবং চীনের মানুষ তাঁদের দেশে সুখে বসবাস করবে।এই চুক্তিটি কখনই পরিবর্তন করা উচিত নয়, এই উদ্দেশ্যে ধর্মের তিনটি বহুমূল্য রত্ন, সাধুমণ্ডলী, সূর্য ও চাঁদ,আকাশের গ্রহ এবং তারাদের সাক্ষী হিসাবে আবাহন করা হয়েছে, পবিত্র মন্ত্রোচ্চারণ এবং পশুবলি দিয়ে শপথ গ্রহণ করে এবং এই চুক্তিকে সুনিশ্চিত করা হয়েছে।

এই চুক্তির শর্তগুলি উভয় পক্ষের যে কেউ পালন না করলে তাকে চুক্তি-লঙ্ঘন হিসাবে বিবেচিত হবে। তিব্বত এবং চীনের সম্রাট এবং মন্ত্রীরাএই উদ্দেশ্যে একটি নির্দিষ্ট শপথ নিয়েছেন, আর লিখিতভাবেও তা প্রস্তুত করা হয়েছে, যার ভিত্তিতে উভয় সম্রাট নিজস্ব মোহরের ছাপ দিয়েছেন। এই সন্ধির জন্য উভয় দেশের যে মন্ত্রীরা দীর্ঘ আলোচনা করে সম্রাটদের পরামর্শ দিয়েছেন,লিপিবদ্ধ করেছেন সেই মন্ত্রীরাও এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন, এর একটিকরে প্রতিলিপি এবং একাধিক অনুলিপি উভয় পক্ষের রাজ্য কার্যালয়ে রাখা হয়েছে।

জোখাং মন্দিরে আমার কামরাটি ছিল দ্বিতীয় তলায় অর্থাৎ মন্দিরের সমতল ছাদে। সেখান থেকে মন্দিরের ভেতরের অংশছাড়াও বাইরের বাজারের দৃশ্যও দেখাযেত।দক্ষিণ দিকের জানালা দিয়ে আমি মন্দিরের মূল অংশটি দেখতে পেতাম যেখানে ভিক্ষুরা সমস্ত সময় জপ করতেন। এই ভিক্ষুদের আচরণ খুবইনম্র আর তারা তাদের দপ্তরের কাজেও খুব দক্ষ ছিল।

কিন্তু পূর্ব দিকের জানালা দিয়ে দৃশ্যটি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা।যে উঠোনটি দেখতে পেতাম সেখানে আমার মতন নবীন ভিক্ষুরা সমবেত হত। প্রায়ই তাদেরকে নিজেদের মধ্যে লড়াই-ঝগড়া করতে দেখতাম। যখন খুব ছোট ছিলাম, তাঁদেরকে কাছ থেকে দেখার জন্যে নীচে নামতাম। তখন যা দেখতাম এবং শুনতাম তা বিশ্বাস করতে পারতাম না। তাছাড়া, তারা যেভাবে ভুলভাল মন্ত্র উচ্চারণকরতো তা প্রত্যাশা করিনি। আবারকেউ কেউ তো এমনভাবে উচ্চারণ করতো যেন মুখ খোলার সমস্যা আছে। অনেককে তো এমনকিঠোঁট নাড়াতে দেখিনি, তারা শুধু খেলায় মগ্ন থাকতো। খেলতে খেলতেই তাদের মধ্যে বার বারলড়াই শুরু হতো।কেউ বা তার কাঠের বাটি নিয়ে একে অপরের মাথায় মারতে শুরু করতো।এসব দেখে আমার মনে এক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হয়।প্রথমত, এই বালক ভিক্ষুরা খুব বোকা।দ্বিতীয়ত, ঈর্ষা হয়।দেখে মনে হতো যেন বিশ্বের কোনও কিছু নিয়েতাদের মনে কোনও চিন্তা নেই। কিন্তু তাদের লড়াই যখন মারপিটে পরিণত হতো,তখন ভয়ে পালিয়ে আসতাম।

পশ্চিমের জানালা দিয়ে বাজার দেখতে পেতাম। এই বাজারের দৃশ্যসবথেকে বেশিভাল লাগতো,যদিও এই দৃশ্যআমাকেলুকিয়েদেখতে হতো যাতে বাজারের কেউ আমাকে দেখতে না পান। মানুষ আমাকে দেখতে পেলেই দৌড়ে এসে আমার সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানাতে শুয়ে পড়তো। আমি শুধু কোনও অপরাধীর মতো পর্দার পেছনথেকে উঁকি দিয়ে দেখতাম। আমার মনে পড়ে, যখন সাত ও আট বছর বয়সে প্রথমবার জোখাং-এযাই তখন আমার ব্যবহারও খুব খারাপ ছিল। নীচে মানুষের ভিড় দেখে বিরক্ত হতাম এবং পর্দা থেকে মাথা বের করে বাইরে দেখতাম। আর তারপর এক সময়ে আরও বিরক্ত হয়ে তাঁদের দিকে থুথুর বুদবুদ ওড়াতে শুরু করতাম।তারা আমার দিকে তাকাতেন এবং সঙ্গে সঙ্গে মাথা নীচু করে শুয়ে পড়তেন। আমার থুতুর ফোঁটা তাঁদের মাথায় পড়তো। কিন্তু কিছুদিন পরেই আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরে সেই শৈশবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছি।

কিন্তু সময় পেলেই পশ্চিমের জানালা দিয়ে নীচের বাজার দোকান দেখতাম। একদিনদেখি, একটি দোকানে একটি ছোট কাঠের বন্দুক সাজানো রয়েছে। তক্ষুণি একজনকে সেটি কিনতে পাঠাই। আমাকে ভক্তরা যে প্রণামী দিতেনতা থেকে সেই বন্দুক কেনার টাকা দিয়েছিলাম। কখনও কখনও আমি সেই টাকা থেকে খরচ করতাম। কিন্তু, নিয়ম অনুসারে,এই অর্থের সঙ্গে আমার কোনও সংযোগ থাকার অনুমতি ছিল না, এটাসত্য যে আজ অবধি আমার সঙ্গে টাকার কোনও সম্পর্ক নেই।আমার ব্যক্তিগত কার্যালয়ই আমার সমস্ত আয় এবং ব্যয়ের বিষয়টা দেখে।

জোখাং-এ আমার থাকার সময় সেখানকার সাফাইকর্মীদের অনেকের সঙ্গে নতুন বন্ধুত্ব গড়ে ওঠায় আমি তাঁদের সঙ্গ খুব উপভোগ করতাম। প্রতিবার সেখান থেকে ফিরে আসার সময় আমাদের সবার চোখ ছলছল করতো,ফিরে এসে আমি যত দুঃখ পেতাম, তাঁরাও ততটাই দুঃখ পেতেন। আমার মনে আছে , একবার সেখানে গিয়ে দেখি,আগের বছর আমার বন্ধু হওয়া ব্যক্তিদের কেউই তখন সেখানে নেই।আমি অবাক হই, কষ্টও পাই,কারণ আমি তাঁদের সঙ্গে দেখা করার কল্পনা করেগিয়েছি। শুধু একজন পুরনো পরিচিত সেবককে দেখতে পেয়ে তাদের কথা জিজ্ঞেস করি।তিনি বলেন, চুরির দায়ে দশ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আমি চলে যাওয়ার পরে, তারা চুপিচুপি সিলিং দিয়ে বন্ধঘরে নেমে এসে সোনার প্রদীপ এবং অন্যান্য জিনিসপত্র চুরি করেছিল। এমনই ছিল আমার বন্ধুরা!

‘মোনলাম’উত্সবের শেষ দিনটি সার্বজনিক সমারোহের জন্য নির্ধারিত ছিল। সবার আগেভবিষ্যতেযিনিজন্মনেবেন, সেই মৈত্রেয় বুদ্ধের বিশাল মূর্তি সামনে রেখে একটি শোভাযাত্রা বের করা হতো, যেটি পুরনো শহরের চারদিকে ঘুরতো।এই বিশেষ পরিক্রমা পথের নাম ‘লিঙ্গখোর’। আমাকে বলা হয়েছে যে, এখনরাজধানীর চীনা উন্নয়ন পরিকল্পনার কারণে এই পরিক্রমাপথটি ধ্বংস হয়ে গেছে,শুধু জোখংমন্দিরেরচারদিকেরপ্রদক্ষিণপথটি এখনও রয়ে গেছে।প্রাচীনকালে তীর্থযাত্রীরা মাটিতে শুয়ে ঊঠে দণ্ডি কেটে আবার শুয়ে-উঠে এই‘লিঙ্গখোর’পার করতেন।

পরিক্রমা শেষ হওয়ার পরক্রীড়া কর্মসূচি শুরু হতো।দৌড় প্রতিযোগিতা এবং ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা হতো। ‘মোনলাম’ উত্সবেরএই ঘোড়দৌড়প্রতিযোগিতাছিল অন্যান্য প্রতিযোগিতা থেকে ভিন্ন, এতে ঘোড়ার পিঠে কোনও সওয়ার থাকতো না।বাছাই করা তেজি ঘোড়াগুলিকে দ্রেপাং মঠের সামনে থেকে লাহসার পথে ছেড়ে দেওয়া হতো, প্রতিটি ঘোড়ার সহিস এবং দর্শকরা তাদের পথ দেখাতেন। ঘোড়াগুলি পূর্বনির্ধারিত স্থানে পৌঁছানোর সাথে সাথে নবীন ধাবকরা দৌড় শুরু করে শহরের কেন্দ্রের দিকে ছুটতেন। সবাই প্রায় একসঙ্গে লক্ষ্যে পৌঁছুতেন,দর্শকরা উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতেন, নিজের পছন্দসই প্রতিযোগী ও ঘোড়াকে সমর্থন করে মজা পেতেন। কিন্তু একবার একটি ঘটনা ঘটে, কিছু ধাবক ঘোড়ার লেজ ধরে তাদের দৌড় শেষ করেন। দৌড় শেষ হতেইআধিকারিকরাদোষীদের ধরেন। জানতে পারি, এরা সবাই আমার পরিচিত এবং এদের দণ্ডিত করা হবে। শুনে খুব কষ্ট হয়। তখন আমি হস্তক্ষেপ করে ওদের বাঁচাতে সক্ষম হই।

মোনলাম উৎসবের কয়েকটি বিষয় লাহসার সমস্ত নাগরিককে গভীরভাবে প্রভাবিত করতো। প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে,উৎসবচলাকালীন সময়েনগরী পরিচালনার দায়িত্ব দ্রেপুং মঠের প্রধান ভিক্ষুকে হস্তান্তর করা হতো। এই সময়ে মঠাধ্যক্ষ মঠের ভিক্ষুদের মধ্য থেকেই সিপাহী এবং আধিকারিকনিয়োগ করেনগরেরআইন-শৃংখলাবজায়রাখারদায়িত্ব তাদের হাতে তুলে দিতেন। ওই সময় ভিক্ষুরা কঠোরভাবে আইন-শৃঙ্খলা প্রয়োগ করতেন, যারা তা লঙ্ঘন করতেন, তাদের উপর ভারী জরিমানা চাপানো হতো।মঠাধ্যক্ষযে দিকে সবচাইতে বেশি জোর দিতেন তা হল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা।তখন শহরের সমস্ত বাড়ি চুনকাম করা হতো,রাস্তাগুলি আলোকিত করা হতো।

শৈশবে নববর্ষের আরেকটি আকর্ষণ ছিল খাবসে বা লোসারের ডাবল রোটি এবং পেস্ট্রি তৈরির ঐতিহ্য।প্রতি বছর এই উপলক্ষেআমার রন্ধনশালার পাচকরা নানা আকারের, বিভিন্ন ধরণের সুস্বাদু প্যাস্ট্রি তৈরি করতেন। একবছর আমি নিজেও এই কাজেঅংশগ্রহণ করার কথা ভাবি। আর এতে সাফল্যও পাই। নিজের কাজ দেখে এত খুশি হই যে রন্ধনশালারকর্মকর্তাকে বলি, আগামিকাল আবার প্যাস্ট্রি তৈরি করতে আসবো!

কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, পরদিন আমার ব্যবহারের জন্য খুবই তাজা তেল আনা হয়েছিল তা ছিল এবং প্রয়োজন অনুসারে আগে ফুটিয়ে রাখা ছিলো না।আমি প্যানে ময়দা ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে ওঠে।আমার ডান হাতে ফুটন্ত তেলে পড়ে এবং একটি বড়ো ফোসকা পড়ে। যদিও, এই ঘটনার কথা আমার বিস্তারীত মনে নেই,আমার শুধু মনে পড়ে সেই পাচকের কথা, যার ঘ্রাণশক্তিপ্রবল ছিল, যিনি আমার চিৎকার আর হাতে ফোস্কা দেখে ঘাবড়ে যাননি।দ্রুত আমার হাতে বরফ লাগিয়ে দেন, কিন্তআমি যখন হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পাগলের মতো রন্ধনশালার এদিক থেকে ওদিকে ছুটে বেড়াচ্ছিলাম, তিনিও পেছন পেছন ছুটে আমার হাতে কোনও মলম লাগিয়ে যেতে থাকেন। এমনিতে তিনি খুব হাসিখুশি মানুষ ছিলেন, কিন্তু আমার অবস্থা দেখে তিনিও ক্রমে অস্থির হয়ে পড়েন। আজও আমার স্মৃতিতে তাঁর বসন্তের দাগভরা মুখটি উজ্জ্বল, সেই গভীর দাগগুলি বেরুনো ঘামের বিন্দুগুলি আর নাকের জল একাকার, কপালের শিরাগুলি ফুলে ওঠায় সব মিলিয়ে হাস্যকর দেখাচ্ছিল।

বছরের সমস্ত উৎসবগুলির মধ্যে আমার সবচাইতে বেশি ভালো লাগতো সপ্তম মাসে উদযাপিত অপেরা নৃত্যউত্সবটি, যাএক সপ্তাহ ধরে চলতো। এতে তিব্বতের বিভিন্ন অংশের নৃত্যশিল্পী, গায়ক এবং অভিনেতাদের দল অংশ নিতো।এই কর্মসূচিগুলি বিশেষভাবে নির্মিত মাঠে হলুদ রঙ করা দেওয়ালের প্রেক্ষিতে আয়োজিত হতো। সেই অনুষ্ঠান দেখার জন্যে একজনের বাড়ির পাকা ছাদে শামিয়ানা টাঙিয়ে আমার জন্যে অস্থায়ী ব্যবস্থা করা হতো। সমস্ত সরকারি উচ্চ-আধিকারিকরা আসতেন, সঙ্গে তাঁদের স্ত্রীরা এই অনুষ্ঠানের সুযোগে একে অন্যের থেকে ঝলমলে পোশাক এবং ভারী গহনা প্রদর্শনের জন্যও আসতেন!

এই প্রতিযোগিতা শুধু মহিলাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। নরবুলিংকার সাফাই কর্মচারিরাও যথেষ্ট সময় এবং অর্থ ব্যয় করে জমকালো পোশাক বানিয়ে তা পরে কুচকাওয়াজে অংশ নিতেন –অনেকে ভাড়া করা জড়ির পোশাক পরতেন। তাঁরা প্রতিযোগিতার জন্য হাতে করে বিভিন্ন ধরণের ফুলের টুকরি নিয়ে বিচারকদের সামনে দিয়ে যেতেন।

এদের মধ্যে একজনকে আমি কখনও ভুলতে পারি নি যিনি মাথায় বিশেষ ধরণের টুপি পরে প্যারেডে অংশ নিতেন। টুপিটির জন্য তিনি যে খুব গর্বিত, তা বোঝা যেত, টুপিটিতে লাল রঙের একটি দীর্ঘ ফিতা ছিল, সেটিকে নানারকম গিট ও ভাজের মাধ্যমে নিজের গলায় ও কাঁধে সাজাতেন। সরকারী আধিকারিক ও অভিজাত নাগরিকদের মতো বসার কোনও বিশেষ ব্যবস্থা না থাকলেও সাধারণ মানুষ বিপুল সংখ্যায় এই অনুষ্ঠানটি দেখতে আসতেন। অনুষ্ঠান ছাড়াও তাঁরা উচ্চ পদাধিকারীদের পোশাক এবং চালচলন দেখতে ভালবাসতেন। তাঁরা হলুদ দেওয়ালের চারপাশে ঘুরে ঘুরে - হাতের প্রার্থনা - চক্র ঘোরাতে ঘোরাতে মুখ দিয়ে অবিরাম মন্ত্র জপ করে যেতেন।

লাহসার বাইরের লোকেরাও আসতেন: পূর্ব থেকে দীর্ঘদেহী বলিষ্ঠখাম্পারা, যাঁদের লম্বা চুলে লাল ফিতে বাঁধা বেপরোয়া মানুষেরা দলবেঁধে চলাফেরা করতেন। দক্ষিণ থেকে নেপাল এবং সিকিমি ব্যবসায়ীএবং গ্রামগুলি থেকে বেঁটেখাটো কিন্তু গাট্টাগোট্টা যাযাবর কৃষকরা আসতেন। তাঁরা সকলেই একসাথে মিলেমিশে অনেক মজা করতেন, আর তিব্বতিরা মজা করার ক্ষেত্রে সবসময় এক-পা এগিয়েই থাকেন। তিব্বতিরা সাধারণতঃসহজ সরল স্বভাবের হন, প্রদর্শন এবং খেলাধুলো খুবই পছন্দ করেন। এসব আয়োজনে মঠের ভিক্ষুদের ধর্মীয়ভাবেনিষিদ্ধথাকায় তাঁদের মধ্যে আগ্রহীরা ছদ্মবেশে অংশগ্রহণ করেন।

এই উৎসব সাধারণ মানুষের জীবনকে অনেক উৎসাহ উদ্দীপনায় ভরিয়ে তুলতো! মানুষ গোল হয়ে বসে নানারকম প্রদর্শন নিয়ে আলোচনা করতো, কোনটা ভালও লেগেছে, কোনটা অসাধারণ, তারা প্রতিটি গান এবং নাচ এবং প্রতিটি ঘটনা নিজেদের মতন করে বিশ্লেষণ করতো, তর্ক জুড়তো। প্রত্যেকে তাদের সঙ্গে খাদ্য, পানীয়, চা এবং ছাং নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নানা প্রদর্শন দেখতে ঘুরে বেড়াত।যুবতি মায়েরা তাঁদের বুকের দুধ খাওয়া বাচ্চাদের কাপড় দিয়ে বুকে বেঁধেনিয়ে ঘুরতেন, যাতে ওদের খিদে পেলে সহজেইবাচ্চাদের খাওয়াতেন এবং হাসতে হাসতে দৌড়াদৌড়ি করতেন - ঠিক যখন কোনও নতুন অভিনেতা রঙিন পোশাকে মঞ্চে উপস্থিত হতেন,তাঁরা ক্ষনিকের জন্য থামতেন আর বড়ো বড়ো চোখ করে গোগ্রাসে তাঁদের অদ্ভূত বেশভূষা, সেগুলির ঙ্কশা দেখতেন, তারপর হরিণীর মতো অন্য কোথাও ছুটে পালাতেন।এই সময়ে তাঁদের এই উচ্ছ্বলতা এমনকি একা একানিঃশব্দে বসে থাকা বৃদ্ধদেরও সচকিত করে তুলতো এবং কিছুক্ষণের জন্যতাঁদের আড্ডাও থেমে যেত।তারপর আবার সবকিছু আগের মতন চলতো, এই সময়,শীতল পাহাড়ি বাতাসের মধ্যে ঝলমলে সূর্য আলো পৌঁছে দিত।

সবাই চুপ হয়ে যেত শুধু ব্যঙ্গ নাটক শুরু হলে। তখন অভিনেতারা এমনকি দেশের গণ্যমান্য উচ্চপদস্থ আধিকারিক এবং ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন বক্তাদের কথা বলার ঢং, মূদ্রাদোষ ইত্যাদি নিয়েও জনসাধারণের সামনে মজাদার ঠাট্টা করতেন।

বছরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পরবগুলির মধ্যে একটি হল মহাকালের উৎসব। এটি তৃতীয় মাসের অষ্টম দিনে উদযাপিত হত। সেদিন থেকে গ্রীষ্মকাল শুরু হত। সরকারি কর্মকর্তারাও সেদিন থেকেশীতের পোশাক ছেড়ে গ্রীষ্মের পোশাক পরা শুরু করতেন।প্রতিবছর এই দিনে আমি পোটালা থেকে শোভাযাত্রা করে এসে নরবুলিংকায় থাকতে শুরু করতাম।

পঞ্চম মাসের পঞ্চদশ দিবসে জৈমলিঙ্গ চিসাং বা বিশ্ব প্রার্থনা দিবস পালন করা হতো। সেদিন সপ্তাহব্যাপী ছুটি শুরু হতো, ভিক্ষু - ভিক্ষুনী এবং সরকারি আধিকারিক ও কর্মচারি ছাড়া লাহসার সমস্ত মানুষ সপরিবারে শহর ছেড়ে গিয়ে সমভূমিতে তাঁবু খাটিয়ে বসবাস করত এবং পিকনিক করতো।আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যাদের অনুমতি ছিল না, তাঁদের মধ্যেও অনেকে ছদ্মবেশে সাতদিনের তাঁবুবাস ও পিকনিকে যোগ দিতেন। তারপর,দশম মাসের পঁচিশতম দিনে, তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের মহান সংস্কারক এবং গেলুগপা ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠাতা স্তোনকপা প্রয়াত হয়েছিলেন, তাঁর স্মৃতিতে প্রতিবছর বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। রাতে মশাল হাতে নিয়ে মানুষ দলে দলে শোভাযাত্রায় হাঁটেন।গোটা তিব্বতে সকলের বাড়িতে এবং মঠগুলিতে হাজার হাজার মাখনেরপ্রদীপ জ্বালানো হয়। সেদিনটিকে শীতকালের প্রথম দিন মানা হয়। সরকারি কর্মচারিরা আবার গ্রীষ্মের পোশাক তুলে রেখে সেদিন থেকে শীতের পোশাক পরা শুরু করেন। আমাকেও প্রতিবছর সেদিন অনিচ্ছায় পোটালা ফিরতে হতো।আমি ভাবতাম,কবে পূর্বসূরীর মতন এত বড় হবো, যখন তাঁর মতো মিছিলে অংশ নিয়ে আবার নরবুলিংকায় ফিরে যেতে পারবো - তিনিও এই জায়গাটি বেশি পছন্দ করতেন।

এগুলি ছাড়াও তিব্বতে লৌকিক গুরুত্বসম্পন্ন অনেকউৎসব আছে, যেমন প্রথম মাসেই হতোঘোড়া মেলা। একইভাবে,শরত্কালে একদিন যাযাবররা কসাইদের কাছে চমরীগাই বিক্রি করতেন। এটি আমার জন্য অত্যন্ত দুঃখের সময় হত।আমি তাদের বিক্রি করে মেরে ফেলার ব্যাপারটি মেনে নিতে পারতাম না।সেজন্যে যখনই কাউকে নরবুলিংকার সামনে দিয়ে বাজারে চমরী গাই নিয়ে যেতে দেখতাম, কাউকে পাঠিয়ে সেগুলি কিনে এনে বাঁচানোর চেষ্টা করেছি।আমি মনে হয় যে নিজের জীবনে আমি প্রায় দশ হাজার চমরী গাইকে এভাবে রক্ষা করতে পেরেছি, বেশিও হতে পারে! একথা ভেবে খুশি হই যে,এই দুষ্টু শিশুটিও অবশ্যই ভাল কিছু করেছে!

তিব্বত আক্রমণ

১৯৫০ সালের গ্রীষ্মে অপেরা উত্সবের একদিন আগের রাতে নরবুলিংকাপ্রাসাদের বাথরুম থেকে বের হওয়ার সময় হঠাৎ মেঝেতে প্রবল কম্পন অনুভব করি। ঘুমাতে যাওয়ার আগে হাত ধুতে ধুতে আমার এক সেবকের সঙ্গে কথা বলছিলাম। সেই সময় আমার বাথরুমটি ছিল আমার বাসস্থান থেকে কয়েক গজ দূরে একটি ছোট্ট বাড়িতে।প্রথমে আমার মনে হয় ভূমিকম্প। তিব্বতে প্রায়ই ভূমিকম্প হয়। মূল বাড়িতে ফিরে দেখি ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ফটোগুলি ত্যাড়াবাঁকাহয়ে গেছে। ঠিক সেই সময়, বাইরে থেকে একটি চিৎকার শোনা যায়। আমি ছুটে বাইরে যাই, আমার সহায়করা এবং প্রাসাদের সাফাইকর্মীরাও আমার সঙ্গে বেরিয়ে আসে। আকাশের দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভূত দৃশ্য দেখতে পাই। বার বার বাজ পড়ার মতন বিস্ফোরণ, আলোর ঝলকানি আর ভয়ানক বুম বুম শব্দ। প্রাসাদের সাফাইকর্মীদের নেতা, যিনি আগে সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন, তিনি বলেন, কেউ ভয় পাবেন না, এটি আমাদের সেনাবাহিনীর সামরিক মহড়া! যান, সবাই ঘুমিয়ে পড়ুন।

সে-রাতে মোট তিরিশ-চল্লিশটি বিস্ফোরণ হয়েছিল। পরদিন সকালে জানতে পারি,কোনও সামরিক অনুশীলন নয়, এটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই ছিল। অনেকে বলেন যে তাঁরা বিস্ফোরণের আওয়াজের পাশাপাশি সেদিক থেকে একটি বিশেষ লাল আলো দেখেছেন।বিকেলের দিকে জানতে পারি যে সারা দেশের মানুষই এই দৃশ্য দেখেছে ও শুনেছে, এমনকি লাহসা থেকে ৪০০ মাইল পূর্বে চামডো এবং ৩০০মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত সাক্যর জনগণওএসব দেখেছেন।পরে শুনেছি, এমনকি ভারতের শহর কলকাতার মানুষও সেরাতে এই দৃশ্য দেখেছেন। এই ঘটনা আমাদের সবার মনে গভীর প্রভাবফেলে। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে এটি কোনও ভূমিকম্প নয়,একটি অমঙ্গলের সংকেত।

ছোটবেলা থেকেই আমার বিজ্ঞানের প্রতি বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। তাই এই আশ্চর্যজনক ঘটনার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নিয়ে পড়াশুনা শুরু করি। কিছুদিন পর হেনরিখ হ্যাররের সঙ্গে দেখা হলে আমি তাঁকেও জিজ্ঞাসা করি। তিনি ভেবে বলেন, সম্ভবতঃ,কোনও প্রাকৃতিক কারণে হঠাৎ করে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে পর্বতমালা উপরে উঠে আসায় এই প্রবল আলো এবং শব্দ সৃষ্টি হয়েছে।

তাঁর এই বিশ্লেষণ সঠিক হলেও অসম্ভব বলে মনে হয়। কিন্তু রহস্য যাই হোক না কেন, সেরাতের পর থেকে তিব্বতের পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি ঘটে। অপেরা উত্সব শুরু হওয়ার দু'দিন পর থেকেই যেন এই অশুভ ঘটনার প্রভাব টের পেতে শুরু করি। সন্ধ্যে সময় যখন অনুষ্ঠান চলছে একজন রানার আমার দিকে ছুটে আসেন। আমার বাসভবনের কাছে পৌঁছুতেই তাঁকে তক্ষুণি তাথাগ রিনপোচের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি প্রাসাদের অন্য অংশে থাকতেন। আমি অনুভব করি, নিশ্চয়ই কোনও খারাপ খবর! সাধারণ পরিস্থিতিতে,অপেরাউৎসবের এক সপ্তাহ পর সরকারি কার্যকলাপ শুরু করা হত,তাই এই তৎপরতা দেখে স্বাভাবিকভাবেই আমার কৌতূহল বেড়ে যায়। এর অর্থ কী হতে পারে?নিশ্চয়ই বিপজ্জনক কিছু ঘটেছে?

তবে বয়সে নাবালক এবং তখনও আমার উপর শাসন-ক্ষমতা ন্যস্ত না হওয়ার ফলে,তাথাগ রিনপোচে নিজে যতক্ষণ না বলেন, ততক্ষণ আমাকে অপেক্ষা করতে হয়। অবশ্য, এরকম পরিস্থিতিতেও আমি মনে মনে একটি ধারণা তৈরি করি। আমাদের দু’জনের কামরার মধ্যে দেয়ালের উপরে একটি ছোট জানালা ছিল, তার নীচে আমি একটি বাক্স রেখে তার উপরে দাঁড়িয়ে অন্যপাশে উঁকি দিয়ে দেখতে পারি। সেই সন্ধ্যায় রানার তাথাগের কামরার ভিতরে যেতেই আমি বাক্সটি সেখানে রেখে তার উপর উঠে দাঁড়িয়ে গুপ্তচরবৃত্তি শুরু করি। চিঠিটি পড়ার সময় আমি রিজেন্টের মুখের রঙ দ্রুত বদলে যেতে দেখি। স্পষ্ট বুঝতে পারি যে তিনি খুব রেগে গেছেন। আমার বুক ঢিপঢিপ করতে থাকে। কয়েক মিনিট পরই শুনি যে তিনি বাইরে বেরিয়ে কাউকে ডেকে কাশাগ-এর বৈঠক ডাকার আদেশ দেন।

পরে জানতে পারি যে সেটি কোনও চিঠি ছিল না,চামডোর গভর্নরের পাঠানো টেলিগ্রাম ছিল। তিনি জানিয়েছেন, চীনা সেনারা তিব্বতী সীমান্তচৌকি আক্রমণ করে আমাদের সেনা অফিসারকে মেরে ফেলেছে। আগের বসন্তেও চীনা কমিউনিস্টরা এভাবে সীমান্তে হামলা চালিয়ে বলেছিল যে তারা তিব্বতকে সাম্রাজ্যবাদী হানাদারদের কবল থেকে মুক্ত করতে চায়! আমার সরকার এই মনোভাবের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ১৯৪৯ সালে, লাহসায় বসবাসকারী চীনা আধিকারিকদের তিব্বত থেকে বহিষ্কার করেছিল।

এখন এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে চীনারা জোর খাটাচ্ছে। তাই তিব্বতের অবস্থা সঙ্কটজনক হয়ে পড়ে। তখন ০আমাদের সেনাবাহিনীতে সৈন্যসংখ্যা মাত্র ৮,৫০০জন। চীনা লিবারেশন আর্মির সামনে এই সংখ্যা কিছুই নয়। এই ভয়ানক বিপদের ঘনঘটা আমাকে এতই বিপন্ন করে তোলে যে সে বছরের অপেরা উত্সবের কোনও স্মৃতি আজ আমার মনে নেই। এতই মন খারাপ ছিল যে বাজনার হালকা তালে ঝলমলে পোশাকপরিহিত অভিনেতাদের নাচ কিম্বা কঙ্কালের হাড্ডি সেলাই করা কালোপোশাক পরিহিত অভিনেতাদের নাচগুলিও আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি।

দু’মাস পর অক্টোবরে লাহসায় খবর আসে চামডোর পূর্বদিকে চীনা লিবারেশন আর্মির আশি হাজার সৈন্য দ্রিছুনদী পেরিয়ে এসেছে।চীনা রেডিওতে ঘোষণা করা হয়েছে যে চীনে ক্ষমতা দখলের প্রথম বার্ষিকীতে কমিউনিস্ট সরকার তিব্বতে ‘শান্তিপূর্ণ মুক্তি –অভিযান’ শুরু হয়েছে।

সুতরাং, আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়হয়ে পড়ি। বুঝতে পারি, এবার ঘাড়ে কুড়ালটি পড়লো বলে;অতি শীঘ্রই লাহসার পতন হতে চলেছে! আমরা এই কঠিন আক্রমণের মুখোমুখি হতে পারব না।তিব্বতি সেনাবাহিনী সংখ্যায় অল্প, সঙ্গে আধুনিক অস্ত্র নেই, আধুনিকযুদ্ধের প্রশিক্ষণও নেই! রিজেন্সি সর্বদা এই বিষয়টি উপেক্ষা করে গেছে। তিব্বতের মানুষ তাঁদের একটি পরাক্রমী ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও সুদীর্ঘকাল ধরে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে একটি শান্তিপূর্ণ জীবনকে ভালবাসেন এবং সামরিক জীবনকে জীবনের সর্বনিম্ন রূপ বলে বিবেচনা করেন: তাঁরা সৈন্যদের কসাই হিসাবে বিবেচনা করেন।তবুও তিব্বতের অনেক অঞ্চল থেকে তাত্ক্ষণিক যুদ্ধের জন্য বেশ কয়েকটি রেজিমেন্ট পাঠানো হয়। একটি নতুন রেজিমেন্টও গঠন করা হয়, কিন্তু উন্নত প্রশিক্ষণের অভাবে তাঁদের সকলের তেমন ক্ষমতা ছিল না।

এসব না হলে কী হত তা নিয়ে এখন আলোচনা করার কোনও মানে হয় না! তবে এটাও ঠিক যে এই অভিযানে তিব্বতিদের থেকে অনেক বেশি চীনা সৈন্য মারা যায়।কয়েকটি জায়গায় ভয়ঙ্কর প্রতিরোধের ফলে তাঁরা পালিয়ে বাঁচে। সরাসরি যুদ্ধে মৃত্যুর চাইতে রসদের অভাবে এবং অতিপ্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে মৃত্যু অনেক বেশি ছিল। অনেকে খিদেয়, আর বেশিরভাগই হাই অল্টিচিউডে শ্বাস আটকে কিম্বা ফুসফুসের ফ্লুইড জমে বরফ হওয়ার কারণে মারা গিয়েছিলেন।তবে ওই যুদ্ধে তিব্বতি সেনাবাহিনী যদি অনেকবিশাল, প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ হতো তবু তাঁদের সমস্ত প্রচেষ্টা নিষ্ফল হতো।কারণ, এমনকি সেই সময়েও চীনের জনসংখ্যা আমাদের জনসংখ্যার চেয়ে শতগুণ বেশি ছিল।

তিব্বতের স্বাধীনতা ভাল রাখার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি বিশ্বজুড়ে মনোযোগ আকর্ষন করে। ভারত সরকার, ব্রিটিশ সরকারের সমর্থনসহ নতুন চীনা সরকারের বিরোধিতা করে বিবৃতি দেয়, এই আক্রমণ শান্তির স্বার্থে নয়। ১৯৫০সালের ৭ নভেম্বর কাশাগ এবং তিব্বত সরকার রাস্ট্রসংঘকে হস্তক্ষেপ করার আবেদন জানায়। তবে দুঃখের বিষয়, রিজেন্টদের ‘শান্তিপূর্ণ বিচ্ছিন্নতা’ নীতির কারণে তিব্বত আগে কখনও রাষ্ট্রসংঘের সদস্য হওয়ার কথা ভাবেনি, ফলে এই আবেদন ফলপ্রসূ হয়নি - বছরের শেষে রাষ্ট্রসংঘকে আরেকটি জরুরি টেলিগ্রাম পাঠানো হয়, কিন্তু সম্ভবতঃ একই কারণেকেউ সেটিকে গুরুত্ব দেয়নি।

জাঁকিয়ে শীত পড়তেই সীমান্ত থেকে উভয়পক্ষের অনেক বেশি মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। পাশাপাশি লাহসার সম্ভ্রান্ত মানুষদের মধ্যে দালাই লামাকে দ্রুত প্রাপ্তবয়স্কর অধিকার প্রদানের দাবি উঠতে শুরু করে। কিন্তু সাবালক হতে আমার তখনও দু’বছর বাকি! আমার সাফাইকর্মীদের কাছে শুনি যে রাজধানী লাহসার বাইরেও সাধারণ মানুষ সরকারের নিন্দা করছে এবং আমাকে কার্যকরী শাসন ক্ষমতা প্রদানের দাবি জানিয়ে পোস্টার সাঁটা হয়েছে, কবিরা এই বিষয়ে গান বেঁধেছেন। গায়করা ছাড়াও অনেক মানুষ হাটেবাজারে এই গান গাইছে।

এই সময়ে তিব্বতের জনগণ দুটি ভিন্নমত পোষণ করতেন: একদল এই সঙ্কটে নেতৃত্বের জন্য আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, অন্যরা ভাবতেন যে আমি এই দায়িত্ব পালনের জন্যখুবই কমবয়সী। আমি নিজেও দ্বিতীয় মত পোষণ করতাম, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাকে কখনোই এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করা হয়নি।সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে এই সমস্যাটি দৈববক্তার কাছে উপস্থাপন করা হবে!

অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন হয়। অনেকক্ষণ ধ্যানমগ্ন থেকে হঠাৎ চোখ খুলে দিব্যবক্তা ‘কুটেন’ উঠে দাঁড়ান। প্রথামাফিক ভারী টুপি পরিহিত মানুষটি টলমলো পায়ে থপ থপ করে এগিয়ে সোজা আমার সামনে এসে একটি সাদা রেশমের ‘কাতা’ খুলে আমার কোলে রাখেন,যার উপরে লেখা ছিল: ‘থু - লা বাপ’, মানে, ‘এঁর সময় এসে গেছে’। এটি ছিল দোর্জে দ্রাকদেনের বাণী। ক্ষমতাসীন রিজেন্ট তাথাগ রিনপোচে তত্ক্ষণাৎ পদত্যাগ করার প্রস্তুতি নেন, কিন্তু তিনি আমার প্রধান শিক্ষকের পদে থেকে যান। এখন রাজ্যের জ্যোতিষীদের আমার ক্ষমতাসীন হওয়ার তারিখটি বেছে নিতে হবে। তাঁরা গণনা করে সবচেয়ে শুভ দিন হিসাবে ১৯৫০সালের ১৫ নভেম্বর তারিখটি ঘোষণা করেন।কিন্তু আমি এই দ্রুত পরিস্থিতি বদলে নিজেকে অপ্রস্তুত অনুভব করতে থাকি। এক মাস আগেও আমি বার্ষিক অপেরা অনুষ্ঠানের অপেক্ষায় দিন গুণতাম,সমস্ত ধরণের উদ্বেগ থেকে মুক্ত কিশোর ছিলাম। এখন হঠাৎই যুদ্ধের প্রস্তুতিতে আমাকে দেশের নেতৃত্ব দিতে হচ্ছিল। এখন স্মৃতি হাৎড়ালে অনুভব করি,‘কুটেন’-এর এই আকস্মিক সিদ্ধান্তে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না! বিগত কয়েক বছর ধরেই ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি কুটেন ঘৃণা প্রকাশ করে আসছিলেন, আর আমার প্রতি তাঁর মনোভাব ছিল অত্যন্ত নম্র!

নভেম্বরের গোড়াতেই, অভিষেকের পনের দিন আগে আমার মায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র, আমার বড়দা লহাসায় আসেন। আমি তাঁকে চিনতে পারিনি। তিনি তখন তাক্তসের রিম্পোচে নাম ধারণ করে কুম্বুম মঠের বাসিন্দা। সেই কুম্বুম মঠ যেখানে দলাই লামা হিসেবে চিহ্নিতকরণের পর মাকে ছেড়ে গিয়ে একাকী থাকতে হয়েছিল দীর্ঘ আঠারো মাস। বড়দা এসে আমাকে নিজের পরিচয় দিতেই তাঁর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি যে তিনি অনেক কষ্টে আছেন। গাল ও চোখদুটি দুশ্চিন্তায় কোটরাগত, দীর্ঘ যাত্রাপথের ক্লান্তি,অনিদ্রা ও উত্তেজনায় লাল। তিনি বারবার ঢোঁক গিলতে গিলতে কথাগুলি বলছিলেন।

কুম্বুমমঠও আমার জন্মভূমি আমদো প্রদেশ চীন সীমান্তের কাছেই। সেজন্যে চীনের লালফৌজ সবার আগে কুম্বুমমঠ দখল করে ভিক্ষুদের নজরবন্দী করে তাঁদের সবাইকে কমিউনিস্ট ভাবধারায় শিক্ষিত করার জন্য নিয়মিত ক্লাশ নিতে শুরু করে। প্রায় দশমাস ধরে এই অত্যাচার চলার পর তাঁদের নেতা কোনোভাবে জানতেপারে যে তাক্তসের রিম্পোচে দলাই লামার বড়দা। তখন তাঁকে চাপ দেওয়া হয় লাহসায় গিয়ে দলাই লামাকে চীনা শাসন স্বীকার করতে বাধ্য করতে। যদি দলাই লামা তাঁর কথা না মানে, তাহলে তিনি যেন দলাই লামাকে হত্যা করেন, তাহলে তাঁকে পুরস্কৃত করা হবে।

বড়দা কেমন করে তাঁদের এই অদ্ভূত প্রস্তাব মেনে নিতে পারেন? প্রথমতঃ, একজন বৌদ্ধ-র কাছে কোনও জীবিত প্রাণীকে হত্যার ভাবনাটাই ঘৃণিত বিষয়। সেজন্যে ব্যক্তিগত লাভের জন্য তাক্তসের রিম্পোচে দ্বারা তাঁর মায়েরই সন্তান দলাই লামাকে হত্যার প্রস্তাব থেকেই বোঝা যায়, প্রস্তাবকারী চীনা নেতার তিব্বতিদের সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই।বিগত প্রায় একবছরে চীনারা আমদো প্রদেশ দখল করে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে এমনসব অত্যাচার করেছে যে, বড়দা আমাকে ও তিব্বত সরকারকে সতর্ক করার জন্যে তাঁদের প্রস্তাব গ্রহণ করে তাঁদের সেনাবাহিনীর সাহায্যে সীমান্ত পেরিয়ে তারপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লাহসায় এসে পৌঁছেছেন।

তাঁর কথা শুনে আমার শ্বাসপ্রশ্বাস তীব্র হয়। এতদিন পর্যন্ত আমি চীনাদের সম্পর্কে খুব বেশি জানতাম না, আর কমিউনিস্টদের সম্পর্কে তো একদমই না। শুনেছি আমদোর আগে তাঁরা মঙ্গোলিয়ায় খুব অত্যাচার করেছে। আমেরিকা থেকে ডাকে আসা ‘লাইফ’ পত্রিকায় তাঁদের এই অত্যাচারের কাহিনি পড়েছি। এখন বড়দা বলেন, তাঁরা শুধু অধার্মিক নন, তাঁরা যে কোনও ধর্মের বিরোধী – নাস্তিক!

কিন্তু তাঁদের শীর্ষনেতা মাও জে দঙ যে এরকম ছিলেন না তা আমার সঙ্গে সাক্ষাতের পর কিম্বা ১৯৬১ সালের ২৩ জানুয়ারি তিনি পাঞ্চেন লামাকে যা বলেছেন, তা থেকে বোঝা যায়। তিনি ছিলেন প্রয়োগপন্থী। তিনি পাঞ্চেন লামাকে বলেন, ‘আমার ইচ্ছা , কিছু কমিউনিস্ট সব ধর্মের গ্রন্থগুলি অধ্যয়ন করুক, বৌদ্ধ ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, খ্রিস্ট ধর্ম সংক্রান্ত গ্রন্থগুলি পড়ুক। কারণ, এ হল জনগণের প্রশ্ন, জনগণের এক বিশাল অংশ ধর্মে বিশ্বাসী। জনগণের মধ্যে আমাদের কাজ করতে হয়, অথচ ধর্ম সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ। শুধু লাল হব আর বিশেষজ্ঞ হবো না, তা ঠিক নয়’। ১৯৬৩ সালে ৩০ ডিসেম্বরে তিনি একটি পার্টি দলিলে মন্তব্য করেন, ‘বর্তমানে এক বিশাল জনসংখ্যার মধ্যে বিশ্বের তিনটি প্রধান ধর্মের প্রভাব রয়েছে; অথচ এ বিষয়ে আমাদের জ্ঞানের অভাব;দেশে মার্ক্সবাদীদের নেতৃত্বাধীন কোনও গবেষণা প্রতিষ্ঠান নেই; এ বিষয়ে ভালো পত্রিকারও অভাব’। আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে লিখিত রচনারও অভাব’।

তাক্তসের রিম্পোচে আমার চোখের দিকে কিছুক্ষণ পলকহীন একদৃষ্টে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,আমার মতে আমাদের এখন বিদেশি শক্তির সাহায্য নেওয়া উচিত এবং অস্ত্রবল দিয়েই চীনাদের সঙ্গে লড়াই করা উচিত।

আমার দেওয়ালে একটি টিকটিকি ‘ঠিক, ঠিক’ বলে ওঠে। আমার কাছে টিকটিকি সবসময়ই রূপকথার ড্রাগনের ক্ষুদ্র সংস্করণ - জীবিত প্রতীক!

আমি বলি, কিন্তু ভগবান বুদ্ধ যে হিংসা নিষেধ করেছেন!

তাক্তসেররিনপোচে চোয়াল শক্ত করেন। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন,হিংসা বিশেষ পরিস্থিতিতে ন্যায়সঙ্গত, বর্তমান পরিস্থিতি সেরকমই!

তিনি সেই বিশেষ পরিস্থিতিতে সন্ন্যাস ধর্ম এবং পোশাক ত্যাগ করে তিব্বতের প্রতিনিধি হয়ে বিদেশে যেতে চান, আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করতে চান। তাঁর বিশ্বাস, একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আমেরিকা নিশ্চয়ই স্বাধীন তিব্বতের ধারণাকে সমর্থন করবে!

এই প্রস্তাব শুনে আমি অবাক। আমি কিছু বলার আগেই তিনি আবার বলেন যে আমার লাহসা ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। অন্যান্য অনেকেই আগে আমাকে এই উপদেশ দিয়েছেন, কিন্তু এতটা দৃঢ়তার সঙ্গে নয়। আমার বড়দা হাতজোড় করে অনুরোধ করেন। তিনি বলেন যে বিপদটি অনেক বড় এবং আমার কোনও পরিস্থিতিতেই চীনাদের হাতে পড়া উচিত নয়!

বড়দা তারপর তাথাগ রিনপোচে এবং সরকারের অনেক প্রভাবশালী সদস্যের সঙ্গে দেখা করে এই প্রস্তাব রাখেন,আমার সঙ্গেও দেখা হয়, তিনি আবারও গত বছরের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বলে বোঝান যে এর বাইরে আর কোনও উপায় নেই!

কিন্তু আমাকে তখন নিয়মিত তাথাগের কাছে প্রশাসনিক নানা কাজ শিখতে হচ্ছিলো বলে এই বিষয়ে খুব বেশি মন দিতে পারি নি। কিছুদিন পরেই যে আমার চূড়ান্ত অভিষেক! এই অভিষেককে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে আমি ক্ষমাদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেদিন কারাগারের সমস্ত বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হবে।তার মানে এই দাঁড়ায় যে শোল জেলটি অচিরেই খালি হয়ে যাবে।এই কাজটি করতে পেরে খুব খুশি হই, শৈশবের একটি আকাঙ্ক্ষাপূরণ হল। কিন্তুপাশাপাশি একথা ভেবে আফসোস হয় যে ওদের সঙ্গে আর বন্ধুত্ব করার সুযোগ রইলোনা। এরপর থেকেআমার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরবীণ দিয়ে সেদিকে তাকালে দু-চারটি কুকুর ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেতাম না!

সতের তারিখ সকালে ঘন্টাদুয়েক আগেই ঘুম থেকে উঠে তৈরি হতে শুরু করি।তখনও অন্ধকার। স্নান-টান সেরে যখনকাপড় পরতে শুরু করি তখন বস্ত্র আধিকারিক আমাকে কোমরে বাঁধার জন্য একটি সবুজ রঙের স্ট্র্যাপ দেয়।জ্যোতিষীরা এই নির্দেশ দিয়েছেন - তাদের চোখে সবুজ রঙ শুভ।আমি সেদিন প্রাতঃরাশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কারণ এই ধরণের অনুষ্ঠানগুলি অনেকক্ষণধরে চলে। আমি চাই না যে এর মধ্যে কোনও প্রাকৃতিক প্রয়োজন আমার উপর চাপ সৃষ্টি করে।কিন্তু রন্ধনশালা আধিকারিক বলেন, জ্যোতিষীরা নির্দেশ দিয়েছেন যে অনুষ্ঠান শুরুর আগে আমাকে অবশ্যই একটি আপেল খেতে হবে।আমার মনে আছে, সেদিন সেই আপেলটি আমার মুখ থেকে পেট অব্দি নামাতে বেশ কষ্ট হয়েছিল।তারপর আমি অনুষ্ঠানস্থলে চলে যাই।

এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান,তাই এতে অংশ নিতে ধোপদুরস্ত পোশাকে দেশের সকল প্রধান-অপ্রধান কর্মকর্তা ছাড়াও লাহসায় কর্তব্যরত বিদেশি প্রতিনিধিরাও হাজির ছিলেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ সেদিন আকাশ মেঘে ঢাকা থাকায় সভাস্থলে কৃত্রিম আলোয় অনুষ্ঠান সারতে হয়। একই কারণে আমি সমস্ত রীতি রেওয়াজের খুঁটিনাটি বিস্তারিতভাবে দেখতে পাইনি। এই সময় আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমার লৌকিক সত্ত্বার প্রতীকস্বর্ণচক্র প্রদান করা হয়।কিন্তুআমারকিছুইমনেনেই।কারণ,ততক্ষণে অনুষ্ঠানশুরুর আগে জ্যোতিষীদের নির্দেশে খাওয়া আপেল আমার তলপেটে পৌঁছে আমার রেচনতন্ত্রকে এতই সক্রিয় করে তোলে যে, তলপেটে বারবার মোচড় দিয়ে বেগ পেতে থাকে। কাজেই পরবর্তী সমস্ত অনুষ্ঠানে আমি শুধু যন্ত্রের মতন অংশগ্রহণ করেছিলাম।সেজন্যে আমি মনে মনে জ্যোতিষীদের গালি দিচ্ছিলাম। আগেও আমি এদেরকে বেশি বিশ্বাস করতাম না। আর সেদিনের পর থেকে তাঁদেরকে আরও অবিশ্বাস করতে শুরু করি।

আমি বরাবরই অনুভব করেছি যে মানুষের জীবনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিন -জন্ম এবং মৃত্যু যেহেতু জ্যোতিষীদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা যায় না, সেজন্যে অন্যান্য বিষয়েওতাঁদের মতামতের দরকার নেই। তবে এটি আমারব্যক্তিগত মতামত। এর অর্থ এই নয় যে তিব্বতে জ্যোতিষীদের ভূমিকা সমাপ্ত করা উচিত। আমাদের সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে এঁদের গুরুত্ব রয়েছে।

যাই হোক, স্বর্ণচক্রপ্রদানের পর আমার অবস্থা আরও শোচনীয় হতে শুরু করে।আমি ব্যবস্থা আধিকারিককে বার্তা পাঠাই যাতে অনুষ্ঠান তাড়াতাড়ি শেষ করা হয়। কিন্তু আমাদের অনুষ্ঠানগুলি দীর্ঘ এবং জটিল হওয়ায় সংক্ষেপ করার সুযোগ খুবই কম। তখন আমি ভয় পেতে শুরু করি যে এটি শেষ হওয়ার আগেই কোনও অঘটন না ঘটে যায়! মনে মনে জপতে থাকি, ওম মণিপদ্মে হুম, ওম মণিপদ্মে হুম...

অবশেষে অনুষ্ঠানটি যখন শেষ হয় তখন আমি ষাট লক্ষ মানুষের শীর্ষ নেতা হয়ে উঠি - যার সামনে একটি বিশাল ক্ষ্যাপা ড্রাগনের মতন ধারালো দাঁত বের করে গিলতে আসছে যুদ্ধ। আর আমার বয়স তখন পনের বছর মাত্র।এটি আমার জন্য অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতি ছিল,কিন্তু আমি যতটা সম্ভব দেশকে রক্ষাকে করা নিজের দায়িত্ব বলে মনে করেছি। এখন আমার প্রথম কাজ ছিল দু'জন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা।

দু’জন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের কারণ হ’ল আমাদের সরকারের প্রতিটি পদে দু'জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়, যার মধ্যে একজন ভিক্ষু আর অন্যজন সাধারণ মানুষ। এই প্রথা শুরু হয়েছে মহান পঞ্চম দালাই লামার সময়ে,যিনি প্রথমবারের মতন রাষ্ট্রের ধর্মীয় নেতা হওয়ার পাশাপাশি পার্থিব বিষয়গুলির নেতৃত্ব দিতেন।দুর্ভাগ্যক্রমে, এই ব্যবস্থা প্রাচীন যুগে যতটা মসৃণভাবে চলতো, এখন বিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষিতে এই প্রথা মোটেই উপযুক্ত নয়,যেমনটি আমি আগেই বলেছি, প্রায় দুই দশক ধরে রিজেন্টের অধীনে থাকা সরকার একেবারেই দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলো।

এই সময়ের মধ্যে সময়োপযোগী কোনও সংস্কারও করা হয়নি। ত্রয়োদশ দালাই লামা যেসব সময়োপযোগী সংস্কারের চেষ্টা করেছেন, সেগুলির অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ তিনি যেসব পরামর্শ দিতেন, সেগুলি আগে প্রধানমন্ত্রীদের কাছে যেত, তারপর কাশাগে পেশ করা হতো, তারপর এর ওপর কার্যপালিকার প্রত্যেক সদস্যের মতামত নেওয়া হতো, আর সবার শেষে রাস্ট্রীয় পরিষদে পেশ করা হতো। এর মধ্যে যে কেউ বিপক্ষে মত দিলে সেটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন ছিল।

এভাবে রাস্ট্রীয় পরিষদ কোনও প্রস্তাব আনলে সেটি কার্যপালিকায় পেশ করে প্রত্যেক সদস্যের মতামত নেওয়া হতো, তারপর কাশাগের সম্মতিসহ প্রধানমন্ত্রীদের বিবেচনার জন্য যেত, আর তারপর দালাই লামার অনুমোদনের জন্য পেশ করা হতো।দালাই লামা চাইলে এতে সংশোধনও করতে পারতেন। সেক্ষত্রে সংশোধনের অংশটি চর্মপত্রের টুকরোয় লিখে মূল দস্তাবেজের সঙ্গে সংযুক্ত করা হতো। তারপর সেটিকে আবার আগের ক্রমে সকলের কাছে পাঠানো হতো। যে কোনও সংস্কারের ক্ষেত্রে সবচাইতে বড়ো সমস্যা হল ধর্মপ্রাণ মানুষেরা কোনও বিদেশি প্রভাব স্বীকার করতে রাজি হতেন না, কারণ এতে তিব্বতী বৌদ্ধধর্ম ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

আমি লোবসাংগ তাশী নামক ব্যক্তিকে ভিক্ষু প্রধানমন্ত্রী এবং একজন অভিজ্ঞ ব্যবস্থাপক, লুখাংগ্বাকে সাধারণ মানুষ প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করি। তারপর তাঁদের ও কাশাগের পরামর্শ নিয়ে আমেরিকা, গ্রেট ব্রিটেন এবং নেপালে প্রতিনিধি-মণ্ডল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিই। এর কিছুদিন পর, আমাদের পূর্ব সীমান্তে চীন বিপুল সৈন্য-সমাবেশ ঘটালে, আমি প্রশাসনের কয়েকজন বরিষ্ঠ আধিকারিককে সঙ্গে নিয়ে দক্ষিণ তিব্বত সফরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। তাহলে, পরিস্থিতি বেশি খারাপ হলে সহজেই সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে শরণ নিতে পারবো! লোবসাংগ তাশী এবং লুখাংগ্বাকার্যকরী আধিকারিক রূপে লাহসায় থেকে প্রশাসন সামলাবেন। নিরাপত্তার খাতিরে আমার দলের সঙ্গে যাবে তিব্বতের রাজকোষও।


চলবে ...।