বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ১৮, ২০২৪

বুকের ব্যথা, মূল অসমিয়া

(লেখক পরিচিতি -১৯৪৮ সনে বন্দিতা ফুকনের জন্ম হয়।বিজ্ঞান এবং কল্পবিজ্ঞান লেখিকা,ঔপন্যাসিক,জীবনী লেখক এবং শিশু সাহিত্যিক বন্দিতা ফুকনের শতাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।‘নিবিড় মায়ার পৃথিবী’,’আপোনজন’,’মই আমি ইত্যাদি’লেখিকার উপন্যাস।এছাড়া বেশ কয়েকটি গল্প সংকলন রয়েছে।সাহিত্য অকাদেমির ‘বাল সাহিত্য প্রাপক’।ইংরেজি ভাষায় রচিত ‘জয়মতী’বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রশংসা লাভ করেছে। )

আমার এই ঘরের জানালা দিয়ে বিশেষ কিছু দেখা যায় না।কারণ ঘরের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইটের পাকা দেওয়াল,ঠিক তার পরেই আরম্ভ হয়েছে আমাদের প্রতিবেশী চৌধুরীর দোতালা বাড়িটা।আমাদের বিছানা থেকে জানালা দিয়ে চৌধুরীর বাড়ির ওপাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা তিনটি নারকেল গাছ দেখা যায়।ফাগুনের বাতাস বয়ে যাবার জন্যই ওদের সূঁচলো পাতাগুলির ফাঁকে ফাঁকে রোদ আসা যাওয়া করছে।এইমাত্র সবচেয়ে উঁচু,মাঝখানের নারকেল গাছটার,আকাশের দিকে সোজা উঠে যাওয়া সবচেয়ে উঁচু পাতাটিতে একটা পাখি বসেছিল।অনেক দূর থেকে দেখা বলেই হয়তো আমার চোখে পাখিটার রঙ কালো বলে মনে হল।সেই সুউচ্চ ডালে বসে পাখিটা এক মিনিটের মতো নিচের পৃ্থিবীর দিকে তাকাল এবং একটা সময়ে ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে গেল।আমার মনে হল যেন আমিও সেই পাখিটার মতো উঁচু ডালটিতে বসে নিচের পৃ্থিবী থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখব।

দুপুরে ভাত খাওয়ার পরে কিছুক্ষণ বিশ্রামের জন্য এই ঘরের পাশের বিছানায় শুয়ে থাকা মাধবীর শরীরটা নড়াচড়া করে উঠল।আমি জানি,-মাধবী শোবার চেষ্টা করছে।কিন্তু ঘুমোতে পারছে না।আজ একমাস ধরে মাধবী কেন,আমিও শান্তিতে ঘুমোতে পারছি না।

পাশের ঘরে থাকা মামণি এই সময় কি করছে,একবার নিজের চোখে দেখে আসার আমার প্রবল ইচ্ছা হল।মাধবী যেন টের না পায় সেজন্য আমি নিঃশব্দে বিছানা থেকে উঠলাম এবং ধীর পায়ে মামণির ঘরের কাছে এসে দাঁড়ালাম।আসলে এই ষাট বছর বয়সেও,অনেক দুধর্ষ ছাত্র ছাত্রীকে শাসন করার অভিজ্ঞতায় পুষ্ট হওয়ার পরেও আমার,নিজে জন্ম দেওয়া মেয়ে মামণিকে নিয়ে এক অদ্ভুত ভয়ে ভুগছি।এমন কি মাধবীর কাছ থেকেও মামণির বিষয়ে খবর নেওয়ার সাহস হারিয়ে ফেলেছি।

পা টিপে টিপে আমি মামণির ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।দেখলাম,-ওর ঘরের দরজা খোলা।খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে আমি দেখতে পেলাম,-মামণি তার পড়ার টেবিলে বসে রয়েছে।তার সামনে খোলা বই রয়েছে,হাতের মুঠিতে থাকা কলমটা দিয়ে সে মাঝেমধ্যে খাতাটায় কীসব লিখছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে সে মনোযোগের সঙ্গে পড়াশোনা করছে।ওর আইনের ফাইন্যাল পরীক্ষার আর এক মাসও বাকি নেই।এই পরীক্ষায় পাশ করাটা হয়তো তার খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।তানাহলে এতটা ধকলের পরেও সে এভাবে পড়াশোনা করতে পারত না।এদিকে তাকা মামণি,তুই যাতে খুব ভালোভাবে পরীক্ষাটায় পাশ করিস,তার জন্য আমি মাথার চুল ছিঁড়ে আশির্বাদ করছি।আশীর্বাদ দেওয়া ছাড়া তোর ভালোর জন্য অন্য কিছু করার মতো আমার মতো বৃদ্ধের শরীরে ক্ষমতা নেই।

বছরগুলি দ্রুত পার হয়ে গেল।আমাদের বড় ছেলে অরবিন্দ কখন যে বীমা কোম্পানির ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হল,একটা দুই বছরের ছেলের বাবা হল,ছোট ছেলে অর্ণব কবে ডাক্তার হল,বছরের পর বছর ধরে একদল ছেলেমেয়ের ভবিষ্যত সম্পর্কে ব্যস্ত থাকা আমার স্থানীয় হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের চাকরিটার মেয়াদ কবে অতিক্রম করে গেল কিছুই যেন জানতে পারলাম না।মামণির জন্মদিনটা তো আমার স্পষ্ট মনে রয়েছে।সেই রোদ ঝলমলে গ্রীষ্মকালের বিকেল,দুধের মতো সাদা পোশাক পরা নার্স দৌড়ে এসে আমাকে বলেছিল,’আপনাদের একটি মেয়ে হয়েছে।‘

অধীর আগ্রহে প্রায় দৌড়ে গিয়েছিলাম হাসপাতালের একটি ঘরে একটি রেলিঙ দেওয়া বিছানায় ছোট্ট একটি প্রাণকে জন্ম দেওয়ার ক্লান্তিতে ক্লান্ত হয়ে এক গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন হয়ে রয়েছে।দুটি ছেলের জন্মের সুদীর্ঘ আট বছর পরে আমাদের ঘরে একটি মেয়ে এসেছে।এই মেয়েকে আমি আমার বুকের সমস্ত উষ্ণতা আর ভালোবাসা দিয়ে বড় করে তুলব।ছেলে দুটির মতোই আমি তাকে আমার সাধ্য অনুসারে পড়াশোনা শেখাব,তারপর একদিন সাজিয়ে গুছিয়ে অন্য বাড়িতে বিদায় করে দেব।এক পলকে আমার চোখের সামনে সেই ছোট্ট প্রাণীটা,এক লজ্জাবতী কন্যায় রূপান্তরিত হল-এ যেন নতুন পরিবারে যাবার আগে,আমার পায়ে হাত দিয়ে সে সেবা করতে এসেছে। ‘মামণি’আমার অজান্তেই আমার মুখ থেকে অস্ফুটভাবে শব্দটা বেরিয়ে এসেছিল।ঘরটির বিশাল বিছানাটায় শুয়ে থাকা মাধবী বোধহয় এতক্ষণ আমাকেই লক্ষ্য করছিল।

‘ওর নাম রাখলেই নাকি?

‘হ্যাঁ মাধবী,আমি ওর নাম মামণি রাখলাম।নামটা তোমার পছন্দ হয়েছে তো?’

মাথা নেড়ে,হাসিমুখে মাধবী সম্মতি জানাল।আমি জানি,আমার মতো আজ বহুদিন ধরে মাধবীও মেয়ের মা হওয়ার স্বপ্ন দেখে আসছিল।

বড় হতে চলার সঙ্গে সঙ্গে মামণি আমাদের প্রত্যেকের মন জুড়ে বসল।সেই দেড় বছর বয়স থেকেই আমি স্কুল থেকে আসার পরে,দৌড়ে আমার স্যাণ্ডেল জোড়া সামনে এগিয়ে দিয়েছে,আর ও একটু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জলের গ্লাস থেকে শুরু করে আমার এবং আমার সঙ্গে মাধবীর ও খাওয়া-দাওয়া-পরা,আমাদের প্রতিটি প্রয়োজনীয় জিনিস,প্রতিটি কাজের দায়িত্ব অজান্তে মামণি নিয়ে নিল।এমন কি দুই দাদার ও শার্টে বোতাম লাগানো থেকে শুরু করে ইস্ত্রি করা পর্যন্তে,বিছানা পেতে দেওয়া থেকে ভিজে গামছা শুকোতে দেওয়া পর্যন্ত সমস্ত কাজই সে নিজের কর্তব্য বলে ধরে নিয়েছিল।কতদিন আমাকে,মাধবীকে বা দাদাদের,গেটের সামনে থেকে কাপড় বদলানোর জন্য ফিরিয়ে এনেছে।

‘বাবা যে কি!এভাবে ইস্ত্রি ছাড়া শার্ট পড়ে কেউ সভা-সমিতিতে যায়?’মায়েই বা কীভাবে এই চাদরটা পরে বাইরে যাচ্ছে?আমি বলেছিলাম না এটার রঙ জ্বলে গেছে,তাই বাইরে না পরে বাড়ির ভেতরে পরবে।’

‘বড় দাদা,তোমার দেখছি শার্টের সেই বোতামটা নেই,আমাকে বললে তো লাগিয়ে দিতে পারতাম।’

‘কিছু হবে না,বুড়ো মানুষ,চলে যাবে।’

‘কিছু হবে না,তপনের কাছেই তো যাব।’

না,হবে না।মামণিকে আমরা কোনোমতেই ঠেকাতে পারলাম না।অথচ নিজের ব্যাপারে তার কোনো লক্ষ্যই নেই।কত দিন বিয়ে-সাদি,জন্মদিন উপলক্ষে নিমন্ত্রণে যাবার সময় তার পরার কাপড়্গুলি মাকেই পছন্দ করে দিতে হয়েছে।যুবতি হয়ে উঠার পরেও অন্যান্য মেয়েদের মতো মামণি আমাদের কোনো সমস্যায় ফেলল না।এমনকি মনে পড়ে,মামনি কলেজে ভর্তি হওয়ার সময়,দীপক নামে একটি ছেলে,আমাদের বাড়িতে দুবার এসেছিল।তাতে মা একদিন মৃদু আপত্তি করেছিল,-আমি তোর বাবে ভাবার মতো সমাজ তো আর সবকিছু ভালো চোখে দেখে না।’

এতটুকুই কথা।তারপর দীপক এলে মামণি ঘর থেকে বের হত না।মাকে বলতে শিখিয়ে দিল ‘মা মণি আড়ি নেই।‘ধীরে ধীরে দীপক নিজে থেকেই আসা বন্ধ করে দিল।মামণির বিয়ের পাত্র খোঁজার ব্যাপারেও আমাদের কথাই মেনে নিল।ছেলেটি মান-সম্মানে,অবস্থার দিক দিয়ে খুবই ভালো।ছেলেটিও দেখতে উঁচু লম্বা,স্বাস্থ্যবান,-সুপুরুষ বলা যেতে পারে।চা-বাগানের ডাক্তার।ছোটো কাকীমাই দিগন্তকে মামণির জন্য পছন্দ করেছিল।প্রথমে কথাটা শুনে মামণি অবশ্য ঠিক না বলেনি।মাকে কেবল বলেছিল যে সামনেই আইনের ফাইন্যাল পরীক্ষা রয়েছে,এই সময় বিয়ের আয়োজন করলে তার পড়াশোনায় ব্যাঘাত হতে পারে। তার কথা শুনে মাধবী বলেছিল,-‘কিছু হবে না।তুইতো বিএ পাশ করেছিস।আইনের ও বাকি পরীক্ষাগুলি পাশ করে নিয়েছিস।ফাইন্যাল পরীক্ষাটা বিয়ের পরেও দিতে পারবি।

মামণি কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রিল।তারপর সে ধীরেধীরে বলল,তোরা যা ভালো বুঝিস কর।’

তারপর থেকেই দেখে আসছি,মামণির বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হলে ওর দিক থেকে এই উত্তরটাই আসে।পরের সপ্তাহে দিগন্তের মা-বোনেরা এসে মামণিকে আঙটি পরিয়ে দিয়ে গেল। আঙটি পরানো নয়,চারটা গাড়ি নিয়ে এসে তাঁরা যেন একেবারে মামণিকে মঙ্গলাচরণের আশীর্বাদ করতে এসেছিল।সঙ্গের মেয়েরা,দুই একজন আত্মীয় স্বজন,প্রতিবেশীরা খ্যাপাল,-‘কপালগুণে এরকম ছেলে পেয়েছিস।বিয়ের পরে কিন্তু আমাদের ভুলে যাস না।’

উত্তরে মামণি শান্ত হাসি হেসেছিল। সেই হাসি দেখে আমি শুধু একটাই কথা ভেবেছিলাম,-সেদিনের হাসপাতালে দেখা ছোটো পুঁটলিটা এত দ্রুত বড়ো হয়ে গেল।সত্যিই মামণি যে খুব শীঘ্রই কনে হতে চলেছে।

আঙটি পরানোর পরে দিগন্ত একবার নয়,তিনবার এই বাড়িতে এসেছিল।প্রতিবারই মা মামণির সাজ-পোশাক বেছে দিয়েছিল।

‘যা,ওই নীল শাড়িটা পরে নে।মুখে কিছু একটা ঘষে নিবি।কপালে ফোঁটাটা দিতে ভুলে যাস না।‘

প্রতিবারই মামণি মা দুঃখ পাবে ভেবে বিন্দুমাত্র আপত্তি না করে মায়ের শেখানো মতে সাজগোজ করে দিগন্তের কাছে যেত।

প্রথমে কয়েকটি ছেলে আমাদের খবরটা দিতে এসেছিল।আসলে সন্ধ্যে সাতটা থেকেই আমার আর মাধবীর মধ্যে অস্থিরতা শুরু হয়ে গিয়েছিল।সাধারণত কোথাও গেলেও মামণি এতটা দেরি করে না।খবর দিতে আসা ছেলেদের মধ্য থেকে কেউ একজন বলেছিল,-শীতের সন্ধ্যে,খুব তাড়াতাড়ি নির্জন হয়ে যাওয়া স্থানীয় খেলার মাঠটিতে থাকা একটা অশ্বত্থ গাছের কাছে মামণি পড়েছিল। কেউ একজন সেদিক দিয়ে যাবার সময় মামণির কাতরোক্তি শুনে কয়েকজন লোককে ডেকে নিয়ে আসে।তার অবস্থা দেখে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়াটা ঠিক হবে বলে মনে করে।হাসপাতালের কোনো একজন মামণিকে চিনতে পারে।তাই ছেলেগুলি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে খবর দিতে এসেছে।

আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মামণির জীবন রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসা ছেলেগুলির দিকে তাকালাম।ঠিক এরকমই অন্য কিছু ছেলেদের পাশবিকতার বলি হল মামণি,-যার জন্য সমগ্র জীবন জুড়ে মামণিকে বহন করে যেতে হবে এক দুর্বহ গভীর লজ্জা এবং অপমানের বোঝা।মাথাটা চক্রাকারে ঘুরতে লাগল।মূর্ছিত হয়ে পড়ে থাকা মাধবীকে কারও হাতে তুলে দিয়ে,যন্ত্রবৎ গতিতে ছেলেগুলির নির্দেশমতো আমি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললাম।

হাসপাতালের বিছানায় মামণির চেতনাহীন দেহটার দিকে তাকিয়ে মনে হল,এই নিরপরাধ,শান্ত,মা-বাবার একান্ত বাধ্য মে্য়েটিকে কী অপরাধে এত বড় শাস্তি মাথা পেতে নিতে হল।তার জন্মদিনে তাকে আমার বুকের উষ্ণতার মধ্যে লালন পালন করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম,সেই প্রতিশ্রুতি কি আমি রাখতে পেরেছি?শৈশবে মামণির ওপরে আমি,মাধবী এবং দাদারা জারি করা-‘মেয়েদের এটা করা উচিত নয়,ওটা করা উচিত নয়’-এই ধরনের হাজার অনুশাসন যেন মামণির চেতনাহীন দেহটা দেখে অট্টহাস্য করে উঠল।এবার আমিও হাসপাতালের মেঝেতে মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেলাম।

মাঝে মধ্যে মানুষেরা খোঁজ খবর নিতে আসতে লাগল।দুয়েকজন আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল -থানায় একটা এজাহার দেবার জন্য।আমি চিৎকার করে উঠলাম-‘কার বিরুদ্ধে এজাহার দেব।‘আমার চিৎকার শুনে লোকগুলি দূরে সরে গিয়েছিল।ধীরে ধীরে ধীরে আমাদের বাড়িতে লোকজন আসা বন্ধ করে দিল।চার রুমের ছোটো বাড়িটাতে আমি,মাধবী আর মামণি,প্রত্যেকেই একে অপরের কাছ থেকে যেন কয়েক যোজন দূরে বাস করতে লাগলাম।

মামণির দুর্যোগের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সপরিবারে অরবিন্দ এবং অর্ণব একা বাড়িতে এসেছিল।অরবিন্দ মামণিকে নিজের কর্মস্থল গুয়াহাটিতে নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিল।গুয়াহাটিতে থাকলে অনেক অসুবিধা,যেমন খবরা খবর করা বা ঘটনাটার কথা জানা মানুষের অভাব,গুয়াহাটি শহর বর্তমানে এত ব্যস্ত এবং যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে যে পাশের বাড়িতে কোনো একজনের মৃত্যু হলেও কথাটা শ্রাদ্ধের দিনই জানতে পারে।‘

মামণি নীরবে সমস্ত কথা শুনল।সেই আগে যেমন মামণি বলত ‘তোরা যা ভালো বুঝিস কর’বাক্যটার পরিবর্তে,তার মুখ থেকে এবার একটা শব্দই উচ্চারিত হল,-যাব না’।

দিগন্তদের বাড়ি থেকেও কোনো একজনকে আমাদের বাড়ি পাঠানো হয়েছিল।তার উদ্দেশ্য ছিল দুটো।প্রথমটি হল মামণিকে সমবেদনা জানানো,আর দ্বিতীয়টি দিগন্ত এবং মামণির একমাসের মধ্যে হতে চলা বিয়েটাকে বাতিল করে দেওয়া।মানুষটা অর্থাৎ দিগন্তের আত্মীয় লোকটি আমাদের বৈঠকখানা ঘরে বসার খবর পেয়েই ,মামণি মাধবীর কাছে এসে দিগন্তের মা পরিয়ে দেওয়া আঙটিটা নিজের হাত থেকে খুলে নীরবে মাধবীর হাতে তুলে দিয়েছিল।সেই সময় ঘরে থাকা অর্ণব ,রাতের ভাতের টেবিলে বসে রাগে ক্ষোভে গজরাতে গজরাতে বলছিল,’লোকগুলি এত তাড়াতাড়ি বিয়েটা ভেঙ্গে দিল।মামণির হয়ে দিগন্ত কিছু তো একটা বলতে পারত।একটা ছোটো শিশুও জানে যে মামণির কোনো দোষ নেই।

নীরব একটা যন্ত্রের মতো ভাত খেতে থাকার মধ্যে মামণি হঠাৎ অর্ণবকে জিজ্ঞেস করে বস্ল,’ছোড়দা,তার আগে তুই নিজেই একবার বলতো ,আমার মতো একটি মেয়েকে বিয়ে করার সাহস তুই নিজে দেখাতে পারতি কি?’

অর্ণবের মুখটা ক্ষণিকের জন্য কালো হয়ে গেল।মামণির এই সোজাসুজি প্রশ্নের উত্তর অর্ণব কেন,প্রায় সমস্ত পুরুষের পক্ষেই দেওয়া প্রায় অসম্ভব। হয়তো লোকগুলি একটা সময়ে মামণির ঘটনাটি্র বিষয়ে কথা বলা বন্ধ করবে,ভুলে যাবার অভিনয় করবে,কিন্তু সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সময়টাতে ,অর্থাৎ মামণির বিয়ের প্রশ্নে ,মামণির সঙ্গে কোনো পুরুষ বন্ধু হৃদয় বিনিময় করার সময় ,সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা পুনরায় সঞ্জীবিত করে তুলবে। মামণির ও ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হওয়া হৃদয়ে কোনোদিন প্রেমের মতো সুকোমল অনুভূতির আর কি পুনরায় জন্ম হবে?এরকম একটি মেয়ে কখন ও বিশ্বাস করবে না যে কোনো পুরুষের দুই বাহুর মধ্যে নারীর জন্য পরম নিরাপত্তা ,আশ্রয় থাকে।

তাই,আজ একমাস ধরে আমি পিতা হয়েও ,নিজের মেয়ের পেছন পেছন গুপ্তচর বৃত্তির কাজ করছি।প্রতিটি মুহূর্ত আমি তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্ট করছি,আজ এক মাস আগে হারিয়ে যাওয়া আমার মামণিকে আগের মতো সহজ স্বাভাবিক রূপে ফিরিয়ে পাব কি? ইস,সে এক মাস সে আমাদের সামনে এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলে নি,একটাও দীর্ঘশ্বাস ফেলে নি,যন্ত্রের মতো নিজেকে বহন করে নিয়ে চলেছে।এতকিছু হয়ে যাবার পরেও আসন্ন ফাইন্যাল পরীক্ষার জন্য পড়ার টেবিলে বসছে।হয়তো মামণি বড়ো নিষ্ঠুরভাবে অনুভব করতে পেরেছে যে এই সময়ে,তার মা-বাবা,দাদারা,আপন- যদি শৈশবের সেই সরলতা নিয়ে তার মনের যন্ত্রণাগুলির আমাদেরও অংশীদার করতেন। আজ পর মোটকথা কেউ তাকে সুরক্ষা দিতে পারবে না।প্রতিটি মুহূর্ত বেঁচে থাকার জন্য প্রেরণা হিসেবে আইনের ডিগ্রিটাই পরম বন্ধু হয়ে তার পাশে দাঁড়াবে।

ঘরে ঢোকার পরে আমি মাধবীকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম,আজ দীপক এসেছিল?'

দীপক,-মানে সেই ছেলেটি,-যাকে একটা সময়ে সমাজ পাছে কিছু বলে ভেবে আমাদের বাড়িতে আসতে মানা করে দেওয়া হয়েছিল।

আজ দীপক কে দেখে আমার মনে আশা জাগছে-দীপকের মাধ্যমেই হয়তো মামণি একদিন এই সমাজে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার পথ খুঁজে পাবে।

মাধবী আস্তে করে উত্তর দিল,’মামণি দীপকের সঙ্গে দেখা করেনি।'

মামণি কি তাহলে ভাবছে যে দীপকের সঙ্গে দেখা করার জন্য তার আগের দৈহিক বা মানসিক সরলতা ,সুন্দরতা বা কোমল প্রস্তুতিগুলি আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে?ও সেই শৈশব থেকেই আমাদের ওপরে এক ধরনের অভিমান পোষন করে রাখছে না তো? দীপক না এলে ওর খারাপ লাগতে পারে-এই ব্যাপারটাতে আমরা তখন বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দিইনি।অথচ আমরা নিমন্ত্রণ করে আনা দিগন্ত আমাদের বা মামণির ভালোবাসায় কোনো গুরুত্ব না দিয়ে,যে পথে এসেছিল সেই পথেই অত্যন্ত সহজে চলে গেল।

অনেকক্ষণ নীরব থাকার পরে মাধবী ধীরে ধীরে বলল,সেই সময় দীপকের আসা নিয়ে ও আমাকে কেবল একটা কথাই বলেছিল।দীপককে দেখলে ওর বুকে নাকি ব্যথা করে।'

মাধবী হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।

মামণি একটা সময়ে সত্যিই দীপকের বন্ধুত্ব চেয়েছিল নাকি?আমি অনুভব করলাম আমার বুকের কোনো একটি কোণেও ব্যথা শুরু হয়েছে।লোকচক্ষুর সামনে প্রকাশ করতে না পারা সেই ব্যথা যেন প্রচণ্ড জোরে আমার বুকটাকে চেপে ধরেছে।