শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

বাংলা গানের সেকাল একাল – পর্ব ১৪

বাংলা গানের স্বর্ণসময় : সোনার দিন শোনার দিন

১৯৩৪এ রেকর্ড করা যূথিকা রায়ের দুটি গান ‘আমি ভোরের যূথিকা’ এবং ‘সাঁঝের তারকা আমি পথ হারায়ে’ আধুনিক বাংলা গানের সরণীতে একটা মাইলফলক,সঙ্গীত গবেষকরা একথা বলেন। বিক্রি হয়েছিল গানটির ষাট হাজার রেকর্ড প্রথম তিন মাসে । গীতিকার প্রণব রায়ের লেখা ‘আমি ভোরের যূথিকা’ গানটির প্রথম স্তবকটি ছিল –

আমি ভোরের যূথিকা।

রাতের শেষে সাজিয়ে রাখি,

কানন বীথিকা।

কে যেন গো হাওয়ার সনে,

ডাক দিয়েছে আমার মনে।

আকাশে আজ কে পাঠাল,

আলোর গীতিকা

কাব্যিক সুষমাই যে আধুনিক বাংলা গানের প্রাণ হয়ে উঠবে এটাই জানিয়ে দিল যুথিকা রায়ের এই গানটির অভূতপূর্ব বিপণন সাফল্য । ইতিমধ্যে কৃষ্ণচন্দ্রে দে, ইন্দুবালা, আঙুরবালা, কমলা ঝরিয়া পঙ্কজ মল্লিকদের পরের প্রজন্ম উঠে এসেছেন জগ্নময় মিত্র, শচীন দেব বর্মন, সুধীরলাল চক্রবর্তী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, গৌরীকেদার ভট্টাচার্য, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সত্য চৌধুরীরা । পরের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এলেন আরো এক ঝাঁক শিল্পী – সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, অখিলবন্ধু ঘোষ শ্যামল মিত্র, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, প্রতীমা বন্দ্যোপাধ্যায় মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, গীতা দত্ত, সুপ্রীতি ঘোষ, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সনৎ সিংহ, পান্নালাল ভট্টাচার্য, সুবীর সেন, তালাত মামুদ, মান্না দে, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, গায়ত্রী বসু, শিপ্রা বসু, ইলা বসু, সবিতা চৌধুরী, মৃণাল চক্রবর্তী, আরতী মুখোপাধ্যায়, বাণী সরকার, নির্মলা মিশ্র, অংশুমান রায়এবং আরো কত শিল্পী সুরকা্র আধুনিক বাংলাগানের ভুবনকে ঐশ্বর্যমন্ডিত করে গিয়েছেন । এদের গান আমাদের জানান দিল, শব্দের সঙ্গে সুরের সার্থক সংযোজনে কি অবিস্মরণীয় মহিমার সৃষ্টি হয়, আমরা অনুভব করলাম সুর ছাড়া মানব হৃদয়ের অন্ধকার অভ্যন্তরে প্রবেশের আর কোন পথ খোলা থাকে না । বস্তুত, বাংলা সাহিত্য-শিল্প সৃজনের ক্ষেত্রে এতো বড় রোমান্টিক আন্দোলন আর হয়নি !

চল্লিশের দশকে আধুনিক বাংলা গান কথা সুর ও গায়কী নজরুলগীতির প্রভাব মুক্ত হয়ে তৈরি করলো নতুন স্টাইল । আধুনিক বাংলা গান আংশিক রাগাশ্রয়ী পোষাক ছেড়ে কাব্যময়তার দিকে ঝুঁকে পড়লো । সাধারণ মানুষের কল্পনা শক্ত ও মেজাজের সঙ্গে মিলে যাওয়া ছিল সেই সময়ের আধুনিক বাংলা গানের জনপ্রিয়তার প্রধান । চল্লিশ দশকের শুরুতে বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর ও রাজনৈতিক আন্দোলনের ঢেউ আধুনিক গানের গীতিকারদের প্রভাবিত করেছিলএই সময় বাংলা গানে্র গায়কীতে রোমান্টিকতার ছোঁয়া নিয়ে এলেন জগন্ময় মিত্র । মিলন ও বিরহের গান সমান দক্ষতায় গাইলেন জগন্ময় তাঁর নিজস্ব কন্ঠ ও মেজাজে । ১৯৪২এ ‘সাতটি বছর আগে’, ৪৩এ ‘মেনেছি গো হার মেনেছি’আর তারপর ১৯৪৮এ দু খন্ডের ‘চিঠি’- ‘তুমি আজ কত দূরে’ হয়তো এখনও স্রোতাদের আনমনা করে দেয় । বিরহ-বেদনার কাব্যভাষ্য ছিল তাঁর গানে । ১৯৪৬এ কমল দাশগুপ্তর সুরে ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারী করেছে, তোমারে করেছে রাণী’, ঐ বছরেই কমল দাশগুপ্তর সুরে ‘আমি ‘দূরন্ত বৈশাখী ঝড় তুমি যে বহ্ণি শিখা’ যেন আধুনিক বাংলা গানের জয়যাত্রাকে দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করলো ।

সমকালেইপ্রতিষ্ঠা পেলেন দুই শিল্পী সুধীরলাল চক্রবর্তী ও সত্য চৌধুরী । সুধীরলালের ১৯৫১তে প্রণব রায়ের কথায় ও নিজের সুরে রেকর্ড করা‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের বুকে ঝরে’ গানটি অমর হয়ে আছে । রেকর্ডের অন্য পিঠে ছিল ‘ও তোর জীবন বীণা আপনি বাজে’ । জানি না এটি সুধীরলালের শেষ রেকর্ড করা গান কি না । কারণ ১৯৫২র ২০শে এপ্রিল সুধীরলালের জীবনবীণা স্তব্ধ হয়ে যায় মাত্র ৩৬ বছর বয়সে । মৃত্যুর আগে তিনমাস শয্যাশায়ী ছিলেন কঠিন লিভার সিরোসিস রোগে । সুধীরলালের রেকর্ড করা গান ১৯৪৩এ অনুপম ঘটকের সুরে ‘গান গেয়ে মোর’, ১৯৪৮এ পবিত্র মিত্র কথায় নিজের সুরে ‘খেলাঘর মোর ভেঙে গেছে আজ’, ‘এ জীবনে মোর যত কিছু চাওয়া’ ১৯৫০এ ‘তুমি আজ কত দূরে’ গানগুলি বাংলা আধুনিক গানের ভান্ডারে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে । পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের প্রতিষ্ঠিত শিল্পী উৎপলা সেন, শ্যামল মিত্র, গায়ত্রী বসু, নীতা সেন প্রমুখ সুধীরলালের কাছে তালিম নিয়েছিলেন । আধুনিক বাংলা গানের রোমান্টিক ধারার গানে জগন্ম মিত্র, সুধীরলাল চক্রবর্তীর সাথে আর একজন ছিলেন সত্য চৌধুরী । এই ধারার গানে সত্য চৌধুরীর দুটি গান কলজয়ী হয়ে আছে – ১৯৪৫এ মোহিনী চৌধুরীর কথা ও কমল দাশগুপ্তর সুরে ‘পৃথিবী আমারে চায় রেখো না বেঁধে আমায়, খুলে দাও প্রিয়া খুলে দাও বাহুডোর’ এবং প্রণর রায়ের কথায় ‘যেথা গাম থেমে যায়’ ।

ত্রিশের দশকে ত্রিপুরার রাজপরিবারের বিলাস-বৈভব ছেড়ে গানের ভুবনকে বেছে নিলেন আর বাংলা আধুনিক গানের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন । বাংলা গানের গায়কী ঠিক করে দিলেন অনেকটাই শচীন দেববর্মণ । শচীন দেববর্মণ নিয়ে এলেন আধুনিক বাংলা গানে অনন্য আভিজাত্য ।

নিজের জীবনকথায় শচীনদেব লিখেছেন--

  • “১৯৩০ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত এই ৩৬ বছরে লোকসঙ্গীত ও ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের সংমিশ্রণে নিজস্ব ধরণের সুর রচনা করলাম, যা অন্য কারো সঙ্গে মিলল না । এইভাবে আমি নিজস্ব গায়কী সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলাম” (তথ্যসূত্র : শচীন কর্তা / পান্নালাল রায় ) ।


গানের তো তিনটি উপাদান বাণী, সুর আর গায়কের কন্ঠ মাধুর্য । ত্রিশ দশকে আধুনিক বাংলা গানে সঙ্গীত রচনায় ও সঙ্গীত প্রশিক্ষণে অলিখিত সম্রাট ছিলেন নজরুল ইশলাম । সমকালেই এবং কিছু পরে উঠে এসেছিলেন সুরসাগর হিমাংশু দত্ত (১৯০৮-১৯৪৪), কমল দাশগুপ্ত (১৯১২-১৯৭৪), সলিল চৌধুরী(১৮২১-১৯৯৫), রবীন চট্টোপাধ্যায়, প্রবীর মজুমদার, নচিকেতা ঘোষ ( ১৯২৫-১৯৭৬), অনিল বাগচী, সুধীন দাশগুপ্ত, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ । শচীনদেব আধুনিক বাংলা গানের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন এবং নিয়ে এলেন এক নতুনতর গায়নশৈলী, তার পেছনে আরো দুজনের নাম সমান মর্যাদায় উল্লেখ করতে হবে, এরা হলেন শচীনদেবের কুমিল্লার দুই সাথী, সুরসাগর হিমাংশু দত্ত ও গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য । এই তিনজনের যুগলবন্দিতেই এসেছিল আধুনিক বাংলা গানের নতুন আভিজাত্য এবং আধুনিক বাংলাগানে শচিনদেবের গৌরবময় প্রতিষ্ঠা । বাংলা রেকর্ড সঙ্গীতে তখন নজরুল ইশলামের প্রবল উপস্থিতি ।

সঙ্গীত রচনায় নজরুল প্রভাব বলয়ের বাইরে এসে আধুনিক বাংলা গানের সুর রচনায় নতুন রোমান্টিক ধারার সূচনা করলেন সুরসাগর হিমাংশু দত্ত । সঙ্গীতবেত্তা ও গবেষক রাজ্যেশ্বর মিত্র লিখেছেন --

  • -“শচীনকর্তাকে যথার্থ গৌরব প্রদান করেছিলেন একজন অসামান্য সুরকার, কুমিল্লার হিমাংশুকুমার দত্ত । তখনকার দিনেও গান ছিল নটীমহলে কেন্দ্রীভূত । নজরুল তাঁদের দিয়েই রেকর্ড করাতেন অধিক ক্ষেত্রে, কিন্তু হিমাংশুকুমার ছিলেন ভিন্ন প্রকৃতির কম্পোজার ...। যাদের গলায় পেশাদারি ভালগারিটি ওতপ্রোতভাবে নিহিত ছিল তাঁদের দ্বারস্থ তিনি কোনকালেই হননি, তাঁদের প্রচুর জনপ্রিয়তা সত্তেও । তিনি বাংলাগানকে সেই সমাজ থেকে মুক্ত করে পরিমার্জিত রুচিশীল শিল্পীমহলে প্রতিষ্ঠিত করলেন” ।

শচীনদেবকে বাংলা সিনেমার ডাক পাননি তেমনভাবে । প্রবল অভিমানে ১৯৪৪এ তিনি মুম্বাইয়ে চলে গেলেন স্থায়ীভাবে আর হিন্দি সিনেমা-সঙ্গীতকে নিয়ে গেলেন অনন্য উচ্চতায় । মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মৃত্যু হয় হিমাংশুকুমারের । ফলে শচীনদেববর্মণ পরবর্তী প্রজন্ম সুরসাগরকে পেলোই না । সুধীরলাল চক্রবর্তীও চলে যান মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ।

তারপরে বাংলা রোমান্টিক গানে শুরু হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-যুগ । সংশয় নেই, হেমন্তই একমাত্র শিল্পী যিনি তাঁর ঐশ্বরিক কন্ঠমাধুর্য আর অনুকরণীয় গায়কীর গুনে রবীন্দ্রগান, সিনেমার গান ও বেসিক রেকর্ডের গানে গায়ন ও সুর রচনায় অনন্য লোকপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন । হেমন্তর সঙ্গে আর একজন শিল্পীর কথা বলতে হয়, তিনি মান্না দে । মান্না দে বেসিক ডিস্কে গান করেছেন অনেক পরে, ১৯৫৩তে । সেটাও কিছুটা আকস্মিক । মুম্বাইতে লতা মুঙ্গেশকরের গান রেকর্ড করার জন্য সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন কিন্তু লতা এলেন না । গান রেকর্ড না হলে শব্দযন্ত্রীদের ফিরে যেতে হবে, অনেক ক্ষতি হবে স্টুডিও ভাড়া ইত্যাদির জন্য । বিরক্ত মান্না ঠিক করলেন নিজের গান রেকর্ড করবেন । রেকর্ড করলেন বেসিক ডিস্কে তাঁর প্রথম গান গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় নিজের সুরে ‘কত দূরে আর নিয়ে যাবে বলো এবং ‘হায় হায় গো রাত যায় গো’ । কাকা কৃষনচন্দ্র দের সঙ্গে মুম্বাই চলে যান ১৯৪২এ, কৃষ্ণচন্দ্র দের সহকারী সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে কাজ শুরু করেছিলেন, দু একটি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনাও করেছিলেন কিন্তু সাফল্য পাননি ।

কাব্যের লাবণ্যই বাংলাগানের আশ্রয়, আমরা জানি ।

আমরা একথাও জানি, বাংলা গানের স্বর্ণ সময় কোন একক প্রয়াসে আসেনি, এসেছিল গায়ক, গীতিকার ও সুরকারের সম্মিলিত প্রয়াসে ।

গায়কের কন্ঠমাধুর্যে, সুরের স্নিগ্ধতায় আমরা অবগাহন করছি, কিন্তু নেপথ্যে থেকে যান গীতিকার ।

বাংলা গানের স্বর্ণসময়েপ্রথিতযশা কবি-সাহিত্যিকদের অনেক কবিতার সার্থক সঙ্গীতায়ন হয়েছে যেগুলি বাংলাগানের ভুবনে ‘লিজেন্ড’ হয়ে আছে । সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর কবিতা ‘ছিপখান তিন দাঁড়, তিনজন মাল্লা দেয় দূর পাল্লা’ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে গেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র । কে ভুলবে কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর লেখা ও সুধীন দাশগুপ্তর সঙ্গীতায়ন আর প্রতীমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠে সেই গানটির কথা ‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ / মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই (১৯৫৫), কিংবা সন্ধ্যা মুখার্জীর কন্ঠে সলিল চৌধুরীর সুরে কবি বিমল ঘোষের ‘উজ্বল এক ঝাঁক পায়রা’ (১৯৫৩), বাণী ঘোষালের কন্ঠে সলিল চৌধুরির সুরে অন্নদাশংকর রায়ের ছড়া ‘তেলের শিশি ভাংলো বলে খুকুর পরে রাগ করো’ (১৯৫৫), ১৯৬০এ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে ও সুধীন দাশগুপ্তের সঙ্গীতায়নে, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবিতা ‘সাগর থেকে ফেরা’ (‘সবুজের ছোঁয়া কি না তা বুঝি না’) । এবং সলিল চৌধুরী-হেমন্তর যুগলবন্দী সুকান্ত ভট্টাচার্যর রাণার, অবাক পৃথিবী, ঠিকানা আর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর ‘পালকি চলে’ – এই সব প্রবাদপ্রতীম গানগুলির কাছেই আমরা বারবার ফিরে আসি, এসব গানের বয়স বাড়ে না । ‘আধুনিক বাংলা’ তকমা লাগা গানের বাইরে কত বিচিত্র ধারার গান ঐ সময়ে আমরা বারবার শুনেছি, সেই স্বর্ণসময়ে গানের ভান্ডারে সঞ্চিত আছে সেইসব গান । আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, বাণী ঘোষাল, সনৎ সিংহ, জপমালা ঘোষের ছড়ার গান, আব্বাসুদ্দীন আহমেদ, নির্মলেন্দু চৌধুরী,অংশুমান রায়ের পল্লীগীতি, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, চিন্ময় লাহিড়ী, তারাপদ চক্রবর্তী, বেগম আখতার, দীপালী নাগের রাগপ্রধান গান, রঞ্জিত রায়ের হাসির গান, মিন্টূ দাশগুপ্তর প্যারোডি গান,পূর্ণ দাস ও মঞ্জু দাসের বাউল । ভোলা যায় না ।

আজ একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে পৌঁছে আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণ সময়কে ফিরে দেখতে গিয়ে কত স্মরণীয় শিল্পী আর তাঁদের গানের কথা মনে পড়ে, তাঁদের সকলের কথা, তাদের স্মরণীয় গানের কথা এই পরিসরে বলা সম্ভব নয় । শুধু স্মৃতি উসকে দেওয়ার জন্য কয়েকটি স্মরণীয় গানের কথা উল্লেখ করি । (১) ‘আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ’/ রবীন মজুমদার (২) ‘বন হরিণী চকিত চপল আখি’/শচীন গুপ্ত (৩)বাসরের দীপ আর আকাশের তারাগুলি’/ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য (৪) মাটিতে জন্ম নিলাম/ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য (৫)পিয়াল শাখার ফাঁকে ওঠে/ অখিলবন্ধু ঘোষ (৬) ও দয়াল বিচার করো/অখিলবন্ধু (৭)শ্যামল বরণী ওগো কন্যা/ দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় (৮) কপালে সিঁদুর সিঁদুর টিপ পরেছো/দ্বিজেন (৯) পাষাণের বুকে লিখো না আমার নাম / সতীনাথ মুখোপাধ্যায় (১০) এখনো আকাশে চাদ’/সতীনাথ (১১) চাঁদের এত আলো/ তালাত মামুদ(১২) প্রান্তরের গান আমার/উৎপলা সেন (১৩) আমি এতো যে তোমায় ভালো বেসেছি/মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় (১৪) কাজল নদী জলে / তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৫) ঠুংঠাং ঠুংঠাং চুড়ির তালে/মৃণাল চক্রবর্তী । এখনো এইসব গানের রি-মেক হয়, কারণ এই গান আমরা শুনতে চাই, এইসব গানের কাছেই ফিরে আসি ।

আর এক অসামান্য সংগীত প্রতিভা যার অনন্য প্রতিভার ছটায় বাংলা কাব্যসঙ্গীতের ভুবন আবহমান কালের জন্য উদ্ভাসিত হতে পারতো, তিনি দিলীপকুমার রায় । এই প্রজন্মের কাছে তিনি বাংলা গানের এক ভুলে যাওয়া মুখ । বস্তুত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপকুমার রায়ের নাম বাংলা গানের ক্ষেত্রে তাঁর পিতা এবং অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তর সঙ্গে একই বন্ধনীতে উচ্চারিত হতে পারতো । ১৯৪০ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত দিলীপকুমার বাংলার রুচিশীল সাংস্কৃতিক ও সাংগীতিক পরিমন্ডলে জ্যোতিষ্কের ঔজ্বল্যে বিদ্যমান ছিলেন । বেতারে বা কলের গানের রেকর্ডে তাঁর নিজ কন্ঠে কিংবা সাহানা দেবী, উমা বসু, মঞ্জু গুপ্ত, ডক্টর গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়, এম এস শুভলক্ষীর কন্ঠে দিলীপকুমারের গান বাংলা গানে এক অন্যতর মাত্রা সংযোজন করেছিল ।

দিলীপকুমার সঙ্গীতের রূপ ও রসের অন্বেষণ এবং সঠিক পথের অনুসন্ধান করতে অনেকগুলি বছর ব্যয় করেছিলেন, সারা ভারত, ইউরোপ আমেরিকা পর্যটন করেছিলেন, গায়কের স্বাধীনতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তর্কালাপ চালিয়েছিলেন । দিলীপকুমার মনে করতেন যে সুরকারের দেওয়া সুর গায়ক মর্জিমতো একটুআধটু বদলাতে,অলঙ্কার প্রয়োগ করতে পারেন,এতে দোষের কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথ সে মত সমর্থন করতেন না । রবীন্দ্রনাথ চাইতেন না যে দিলীপকুমার তাঁর গান করেন । ১৯২৫এ প্রথম গ্রামফোন রেকর্ডে দুটি গান গেয়েছিলেন দিলীপকুমার, গিরিশচন্দ্র ঘোশের রচনা ‘রাঙা জবা কে দিল তোর পায় মুঠো মুঠো’ এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচিত ‘ছিল বসি কুসুম বনে’ । ১৯২৮এ ৩১ বছর বয়সে দিলীপকুমার সংসার ত্যাগ করে পন্ডীচেরির অরবিন্দ আশ্রমে গিয়ে আধ্যাত্ম সাধনায় প্রবেশ করেন ।

মান্দালয় জেল থেকে দেশনায়ক সুভাষচন্দ্র তার সুহৃদ দিলীপকুমারকে এক পত্রে লিখেছিলেন

“বন্ধু, সারা দেশকে সংগীতের বন্যায় প্লাবিত করে দাও, আর যে সহজ আনন্দ আমরা হারিয়ে বসেছি তা আবার জীবনে ফিরিয়ে আনো...সংগীতের মত এমন সহজ আনন্দ আর কিসে দিতে পারো” ?

সুভাষচন্দ্র পারেননি তাকে ফিরিয়ে আনতে । ১৯৩৭এ আবার তিনি মাঝে মধ্যে কলকাতায় আসতে শুরু করলেন । এই সময় দিলীপ সন্ধান পান এক অনন্য কন্ঠ গায়িকা উমা বসুকে । উমাকে তাঁর সঙ্গীতের ভান্ডার উজাড় করে দেন তিনি । ১৯৪২এ উমার অকাল মৃত্যুতে দিলীপকুমার আবার থমকে যান ।

অতুলপ্রসাদ সেনের অধিকাংশ গানের স্বরলিপি করেছিলেন দিলীপকুমার, গ্রামফোন ডিস্কে অতুলপ্রসাদের অনেক গানও গেয়েছিলেন । তিনি নিজে বিপুল সংখ্যক গান লিখেছিলেন ও সুর রচনা করেছিলেন তার সামান্য অংশমাত্রই সঞ্চিত হয়ছে বাংলা সঙ্গীত ভান্ডারে । সাহানা দেবী, মঞ্জু গুপ্ত, উমা বসু, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়,ডক্টর গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায় ছাড়া কেই বা গাইলেন তাঁর গান ! এঁদের পর তাঁর গানের গায়ন বা প্রচারের কোন বৃত্ত তৈরি হয়নি । দিলীপকুমারের গানের কথা সহজ ছিল না, গায়নশৈলীতে তাঁর কন্ঠের কারুকার্য গায়কদের পক্ষে আয়ত্ব করা সহজ ছিল না । দিলীপকুমারের একান্ত নিজস্ব গায়নশৈলী আয়ত্ব করা সহজ ছিল না । সুতরাং কথার ভার, সুরের জটিলতা ও তাঁর গায়নশৈলীর কারণে দিলীপকুমার রায়ের গান হারিয়েই গেল ।

(আগামী পর্বে স্বর্ণযুগ নির্মাণের দুই রূপকার : শচীন দেব বর্মন ও সুধাকন্ঠ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় )