শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪

বাংলা গানের সেকাল একাল : পর্ব – ১৭

গানের একাল : গানের আকাল

আধুনিক বাংলা গানের ধারণা গত শতকের তিরিশের দশকে তৈরি হয়েছিল, যার প্রবল জোয়ারে এসেছিল বাংলা গানের স্বর্নসময় ১৯৩০ পরবর্তী সময়কালে, তার ক্ষয় শুরু হল সত্তর দশকে পৌঁছে । ১৯২৭শে বেতার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর কীর্তন, ভক্তিগীতি, নজরুলগীতি ইত্যাদি গানের বাইরে কলকাতা বেতার অন্য ধারার যেসব গান প্রচার করতো সেগুলিকে বলা হত ভাবগীতি ও কাব্যগীতি । ১৯৩০এ ঢাকা বেতার এই শ্রেণীর গানের নাম দিল ‘আধুনিক বাংলা গান’ । সেই থেকে এই অভিধাটিই মান্যতা পেল, যদিও এই নামকরণে বিস্তর প্রশ্ন আছে । রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, নজরুলের গানকে তবে কি আধুনিক বলব না ! শচিন দেব বর্মন, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের রাগাশ্রয়ী গানগুলি কেন আধুনিক নয়, এমন সব প্রশ্নের উত্তর কোন দিনই পাওয়া যায়নি । তো সেই আধুনিক বাংলা গানের জোয়ারে আমরা ভেসেছিলাম গত শতকের তিরিশ থেকে ষাট দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত । সত্তরের মধ্যভাগ থেকে সেইস্বর্ণ সময়ের ক্ষয়ের শুরু হল ।

শচীন দেববর্মন ১৯৬৯এ তাঁর শেষ গানের রেকর্ড করে চলে গেলেন ১৯৭৫এ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া গ্রামফোনের বেসিক ডিস্কে আধুনিক গান রেকর্ড করা বন্ধ করে দিলেন,সুরকার নচিকেতা ঘোষ চলে গেলেন অক্টোবর ৭৬এ, জুলাই ১৯৭৪এ প্রায় আট হাজার গানের সুরকার ঢাকায় কমল দাশগুপ্ত নিতান্ত অনাদরে বিদায় হন গানের ভুবন থেকে । চলে গেলেন সুরকার রবীন চট্টোপাধ্যায়ও, গীতিকার শৈলেন রায়(জুলাই ৬৩) ও প্রণব রায় চলে গেলেন অগস্ট ৭৫’এ, গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার তাঁর সৃষ্টি ক্ষমতার প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছেন এই সময়ে । মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় আশ্রয় খুজেছেন নজরুল গীতিতে, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য শ্যামা সঙ্গীতে । এই সময় প্রকট হল আধুনিক বাংলা গানের ভাষা ও সুরের দৈন্যতা । ফলে রেকর্ড কোম্পানি তাদের লোকসান সামাল দিতে পুরাতন লোকপ্রিয় গানের প্রকাশ করতে শুরু করলো । এবং রুচিশীল বাঙালি স্রোতা প্রবলভাবে ঝুঁকলেন রবীন্দ্রগানের দিকে যার প্রধান কারণ আধুনিক বাংলা গানের ভাষা ও সুরের দৈন্যতা । আধুনিক বাংলা গানের এই ক্ষয় নিয়ে পৌছালাম আশির দশকে ।

আশির দশকের শুরুতেই সব রকমের গ্রামফোন রেকর্ডের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, শুরু হয় ক্যাসেটের উৎপাত । ১৯৮৫তে বনেদি গ্রামফোন কোম্পানি অধিগ্রহন করলো গোয়েঙ্কারা (আরপিজি) । বিখ্যাত সেই কুকুর মার্কা ‘হিস মাষ্টার্স ভয়েস’ বিলুপ্ত হয়ে এল ‘সারেগামা’ । আরো অনেক ক্যাসেট উৎপাদক কোম্পানি এলো, এলেন অনেক নবীন গায়ক, সুরকার, গীতিকার । আধুনিক বাংলা গানের পরিমানগত বৃদ্ধি হয়তো হল, কিন্তু গুণগত মান তলানির দিকেই ধেয়ে চললো । এই সময় থেকেই পন্যায়নের প্রভাবে মধ্যবিত্ত বাঙালির জনরুচির লক্ষ্যণীয় বদল ঘটতে শুরু করেছে । মধ্য-আশিতে পৌছে আমাদের শিল্প-সাহিত্যে সৃষ্টির ভান্ডারের মত গানের ভূবনেও নেমে এলো চোখে পড়ার মত শূন্যতা । সুধাকন্ঠ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর ৫৪ বছরের সঙ্গীত-সফর শেষ করে চলে গেলেন সেপ্টেম্বর ৮৯তে, ৬৯ বছর বয়সে, আশির দশকেই চলে গেলেন, শ্যামল মিত্র (১৯৮৭),অখিলবন্ধু ঘোষ (১৯৮৮), নির্মলেন্দু চৌধুরী(১৯৮১) , গীতিকার গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার (১৯৮৬), সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত(১৯৮২), রবীন চট্টোপাধ্যায়, নব্বইএর দশকে গানের ভূবন থেকে শেষ বিদায় নিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য(১৯৯২), সতিনাথ মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ । এই শূন্যতা এতো শীঘ্র পুরণ হবার ছিল না, হয়ওনি । অতয়েব নব্বইএর দশকে শুরু হল বাংলাগানের ঝোঁক বদল । । একুশ শতকে পা দেবার আগেই বাংলাগানের ভূবনকে শূন্য করে চলে গেলেন সোনার দিনের প্রায় সব শিল্পীরা, শুধু থেকে গেলেন তখন প্রায় গানহীন মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, প্রতীমা বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, মৃণাল চক্রবর্তী, সবিতা চৌধুরী, আরতী মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্ররা । এল গানের আকাল, বদল এলো গানের কথায়, সুর রচনায় । এবং টেলিভিশনের কল্যাণে গান যেন হয়ে গেল শোনার নয় দেখার । ‘গানবাজনা’ শব্দটাকে পালটে দিয়ে কেউকেউ বললেন ‘বাজনাগান’ ।

১৯৯২এ ঈর্ষনীয় কন্ঠসম্পদের অধিকারী সুমন চট্টোপাধ্যায় আধুনিক বাংলা গানের জগতে এলেন, প্রকাশিত হল তাঁর গানের ক্যাসেট ‘তোমাকে চাই’ । ক্যাসেট কোম্পানী ক্যাসেটের লেবেলে নাম দিলেন ‘জীবনমুখী’ গান । প্রায় একই সময়ে নচিকেতা চক্রবর্তী, অঞ্জন দত্ত, শিলাজিৎ প্রমুখ এক ঝাঁক নবীন শিল্পী তথাকথিত জীবনমুখী গানের জগতে হুড়মুড়িয়ে এসে গেলেন । তাঁরা আধুনিক বাংলা গানের একটা নতুন ছাঁচ তৈরি করতে চাইলেন । এদের কেউ কেউ বললেন তাদের শুনে আসা গানের ভাষা ছিল বোকা বোকা জীবনসম্পর্কহীন, তাঁদের এখনকার গানেই নাকি ধরা থাকছে সমকালীন জীবনের আবেগ ইত্যাদি ।

এতোদিন আধুনিক গান ছিল একটা সমবায়িক শিল্প - গীতিকার, সুরকার ও গায়কের সমবায়িক প্রয়াস আর তারা নিয়ে এলেন ‘ওয়ান পার্শন মিউজিক’ বা একক ব্যক্তির সঙ্গীত, গানের কথা সুর ও গায়ন একই ব্যক্তির এমনকি গলায় ঝোলানো তারযন্ত্রের বাদ্যসংগতও তাঁরই । এই ‘ওয়ান পার্শন মিউজিক’ কোন নতুন উদ্ভাবন নয়, আমাদের বাউল গানও একক ব্যক্তির সঙ্গীতই । তফাত এই যে সেই গানে মাটির স্পর্শ আর এদের গানে টুংটাং গীটারের শব্দ সহযোগে গলার শির ফুলিয়ে একটানা গেয়ে যাওয়া, গানের মুখড়া,অন্তরা, সঞ্চারীর কোন বালাই না রেখে । কাব্যের লাবণ্য সেইসব গানের আশ্রয় ছিল না । কলেজ কমনরুম ও রকের আড্ডার হালকা ভাষাতে মোড়া সেইসব গান । আমাদের আধুনিক বাংলা গানের যে ধারণা বা কনসেপ্টে এবং সোনার দিনের যে সব গান আমরা শুনেছি, তাতে গানের ভাষা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু গানের সুরটিই কানে লেগে থাকতো বেশি । তাই রবীন্দ্রনাথের গান বা জনপ্রিয় আধুনিক গানের সুর যন্ত্রসঙ্গীতে বাজানো যায় কিন্তু জীবনমুখী গানের তকমা দিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করে যা চালানো হল তাতে এমন হবার নয় । সে গানে এলোমেলো কথা অনেক আছে কিন্তু সুর গুরুত্বপূর্ণ নয় । গানের কথা ও সুরের যে সমন্বয় একটা গানকে কালোত্তীর্ণ করে, তা তথাকথিত জীবনমুখী গানে ছিল না । এসব গানের ক্যাসেট,সিডি বিক্রি হল দেদার কিন্তু বেশিরভাগই হারিয়ে গেল । কোন নভৃত মুহুর্তে গুনগুন করে এসব গান গাইল না কেউ । একটা টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রতি প্রায় একবছর ধরে ‘সারেগামাপা’ নামে এলটা অনুষ্ঠান করল, উদ্দেশ্য গানের প্রতিভা অন্বেষণ । সেখানে বাংলা গান যে সামান্য কজন গাইলেন তারাও সেই পুরনো দিনের গানই গাইলেন । তাদের কন্ঠে শোনা গেল না অঞ্জন দত্ত, নচিকেতা বা একালের অনুপম রায়ের গান । কেন ?

ফল যা হওয়ার তাই হোল, অনেক সম্ভাব্য তরুণ, তাঁদের প্রতিভার অপচয় ঘটিয়ে হারিয়ে গেলেন, দশ বছরের মধ্যে ‘জীবনমুখী’ গান মুখ থুবড়ে পড়ল । এসে গেলো বাংলা ব্যান্ড । এও বিদেশ থেকে আমদানি করা ব্যাপার । হরেক কিসিমের যন্ত্রের জগঝম্প, কোমর দোলানো গান । গান যেন শোনার নয়, দেখার । গানের তো একটা সর্বজনীন দিক আছে গানের সুরে মানুষ ডুবতে চায়, স্নিগ্ধতায় অবগাহন করতে চায় । গানের ভেতর দিয়ে মানুষ তার স্নায়ুকে শান্ত করতে চায়, তার কর্মের ক্লান্তি অপনোদন করতে চায় । কিন্তু সে সব গানের কাব্যের লাবণ্যহীন বাণী আর গায়কের শিরা ফোলানো চিৎকার শ্রোতাদের ক্লান্তি নিয়ে এলো । ব্যান্ডের গানের জগতে কিছু পরে আসা সদ্যপ্রয়াত কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যর ‘দোহার’ অবশ্য ভিন্নতার স্বাদ এনেছে চিরায়ত লোকজীবনের গানকে অবলম্বন করার কারণে এখনো লোকপ্রিয়তার সঙ্গে টিকে আছে সেই জন্যই । একসময় বাংলা গান লোকের মুখে মুখে ফিরতো চলচ্চিত্রে এর সার্থক প্রয়োগ ও সুর বৈচিত্রের জন্য, এখন চলচ্চিত্রের গানও আর মানুষকে টানতে পারছে না কথা ও সুরের দৈন্যতায় ।

সু্মন যে বছর ‘তোমাকে চাই’ ক্যাসেট নিয়ে সাময়িক হৈচৈ ফেললেন, তার পরের বছর ১৯৯৩তে রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমির বার্ষিক কার্যবিবরণী তে বলা হয়েছিল “আধুনিক বাংলা গানের বাণীর দুর্বলতা বিষয়ে সভা উদ্বেগ প্রকাশ করে । সুর ও বাণীর মেলবন্ধনের অভাবে বাংলা আধুনিক গান তার আসন হারাচ্ছে । এদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন” । (তথ্যসূত্র : ‘অন্দরমহলের ছবি : বাংলা গান’/শোভন সোম - ‘দেশ’ পত্রিকা-এপ্রিল ২০০১) বাংলা গানের দুর্গতি মোচনের জন্য একটি উপ-সমতিও নাকি হয়েছিল । তারপরও অনেক পঁচিশ পেরিয়ে গেল, প্রতি বছর মহা ধুমধাম করে সঙ্গীত মেলা হয়, কিন্তু বাংলা গানের দুর্গতি মোচনের কোন সংকেত পাওয়া গেল না ।

গত পনেরো-কুড়ি বছরে শ্রীকান্ত আচার্য, ইন্দ্রনীল সেন, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়, লোপামুদ্রা মিত্র, চন্দ্রাবলী দত্ত রুদ্র, স্বাগতালক্ষী দাশগুপ্ত, ইন্দ্রাণী সেন, মনোময় ভট্টাচার্য, রূপঙ্করের মত একঝাঁক সুকন্ঠ গায়ক উঠে এসেছেন সত্য, কিন্তু এদের একজনও নিজস্ব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আধুনিক বাংলা গানকে শাসন করতে পারেন এমন বলা যাচ্ছে না । তাদের কেউ কেউ ৫০/৬০ দশকের জনপ্রিয় আধুনিক গানগুলির রিমেইক বা পুনর্নির্মাণ করে শিল্পীর দায় মেটাতে চাইলেন, কেউবা আশ্রয় নিলেন রবীন্দ্র–দ্বিজেন্দ্রলাল-রজনীকান্তর গানে । ইন্দ্রনীল – শ্রীকান্ত - ইন্দ্রাণীরা কেন নিজস্ব সৃষ্টি করতে পারলেন না, এ বড় বিস্ময় । সৈকৎ মিত্র পিতা শ্যামল মিত্রের ছায়া থেকে বেরোতেই পারলেন না । পিতার জনপ্রিয় গানগুলিই হল তার আশ্রয় । রেকর্ড কোম্পানী (ক্যাসেট ও সিডি) এদের নিজস্ব সৃষ্টির ওপর ভরসা না রেখে ক্রমাগত অতীত দিনের গানের পুণর্নির্মাণ করালেন, তারা প্রভুত উপার্জন করলেন, কিন্তু আধুনিক বাংলা গানের সৃজনভূমিতে জোয়ার আনতে পারলেন না । কোথায় যেন পড়েছিলাম রবীন্দ্রনাথের কথা ‘প্রত্যেক যুগের মধ্যেই একটা কান্না আছে, সে কান্নাটা হল সৃষ্ট চাই’। আশির পর থেকে তো গানপ্রিয় বাঙালি এই কান্নাই তো কেঁদে চলেছে ! সৃষ্টি চাই, নবীন কালে নবীন শিল্পীর নবীন গান । অতয়েব গান শোনা বাঙালির হাতে রইল পেন্সিলই – মানে রবীন্দ্র-নজরুল- দ্বীজেন্দ্রলাল-রজনীকান্তর গান আর চিরন্তন লোক জীবনের গান । রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন বাঙালিকে চিরদিন সুখে দুঃখে তাঁর গান গাইতেই হবে । বিশ শতকের শেষ প্রান্তে পৌঁছে আমরা সেই বিশ্বাসের সত্যতা অনুভব করেছি, করে চলেছি এখনো । গানহীনতার কান্না থেকে বাঙালি উদ্ধার পেয়েছে রবীন্দ্রগানের মধ্য দিয়ে ।


আগামী পর্বে রবিগান : সুরের ঝর্ণাধারা