শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

বাংলা গানের সেকাল একাল - পর্ব ৯

চলচ্চিত্রের গান

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রতিষ্ঠার পর থিয়েটারে মানুষের ভিড় জমানো বা তার লোকপ্রিয় হবার একটি কারণ ছিল থিয়েটারে গানের প্রয়োগ । দর্শকের মনোরঞ্জনের কথা ভেবে থিয়েটারে একাধিক গান রাখতেই হত । অভিনয়ের খামতি থাকলেও গানের জন্যই অনেক থিয়েটার উতরে যেতো । মোটামুটি সেই পথ ধরেই বাংলা চলচ্চিত্রে সঙ্গীতের ব্যবহার শুরু হয়েছিল চলচ্চিত্র সবাক হওয়ার পর । বাংলা চলচ্চিত্রের বয়স সাকুল্যে মাত্র একশো বছর । ১৯১৯এর নভেম্বর মাসে মুক্তি পেয়েছিল দশ রিলের প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র ‘বিল্বমঙ্গল’ । তখন অবশ্য সিনেমা তার শরীরে শব্দ ধারণ করতে সক্ষম ছিল না । তার কথা বলতে লেগে গেলো আরো একটা যুগ বা ১২টা বছর । বাংলা চলচ্চিত্র কথা বলতে শুরু করলো ১৯৩১এর জুন মাস থেকে ‘জোর বরাত’ ছবির মুক্তির মধ্য দিয়ে । অপর দিকে বিপননযোগ্য বাংলা গানের বয়স চলচ্চিত্র থেকে অন্ত তিরিশ বছর বেশি । তাছাড়া তার সবাক হওয়ার আগে বেতার সম্প্রচারও শুরু হয়ে গিয়েছিল । অতয়েব বাংলা চলচ্চিত্র সবাক হবার সময় সে অনেক পরিণত ও প্রস্তুত সঙ্গীতকার পেয়েছিল, পেয়েছিল নজরুল ইসলামকেও । ১৯৩১এ রাইচাঁদ বড়াল রেডিওর সঙ্গীত বিভাগ ছেড়ে যোগ দিলেন নিউথিয়েটার্সে, কৃষ্ণচন্দ্র দে তখন বাংলা গানের উজ্বল জ্যোতিষ্ক, উঠে এসেছেন পঙ্কজকুমার মল্লিকও ।

১৯৩৫এ রাইচাঁদ বড়াল প্রবর্তন করলেন নেপথ্য সঙ্গীত বা প্লেব্যাক প্রথা । রাইচাঁদ বড়াল সুরারোপিত সঙ্গীতবহুল ছবি ‘বিদ্যাপতি’ (১৯৩৭) সিনেমা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এক মাইলফলক হয়ে আছে । কানন দেবীর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় যে নজরুল ইসলামও যুক্ত ছিলেন বিদ্যাপতির সঙ্গীত রচনায় । বাংলা সিনেমার প্রথম যুগের কন্ঠশিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে, কানন দেবী, কুন্দনলাল সায়গল, পাহাড়ি সান্যাল প্রমুখ । চল্লিশ দশকের গোড়ায় পেলাম সুরকার রবীন চট্টোপাধ্যায়,অনুপম ঘটক,কমল দাশগুপ্ত, গায়ক-নায়ক রবীন মজুমদার প্রমুখকে । ‘সাথী’(১৯৩৮) ছবিতে রাইচাঁদ বড়ালের সুরে কানন দেবী ও কুন্দনলাল সায়গলের দ্বৈত কন্ঠে রাগাশ্রয়ী গান ‘বাবুল মোরা নৈহর ছুটল যায়’, ‘সাপুড়ে’(১৯৩৯) সিনেমায় নজরুলের সুরে কানন দেবীর কন্ঠে ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’ কিংবা ‘গরমিল’ছবিতে রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে রবীন মজুমদারের ‘এই কি গো শেষ দান বিরহ দিয়ে গেলে’আজ আশি বছর পরে আমাদের আবিষ্ট করে ।

সেই সময় সিনেমার আর্থিক সাফল্যের একটা সহজ রসায়ন ছিল তা হল,হাসি-কান্না নির্ভর মধ্যবিত্ত জীবনের সংবেদনশীল কাহিনী,নায়ক-নায়িকার রোমান্টিক অভিনয় এবং মন-ছোঁয়া গান ।গত শতকের পঞ্চাশের দশকে যেন সাফল্যের এই রসায়ন বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে দিল ।এই সময় সঙ্গীতপ্রধান চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রবণতা এসেছিল । আমরা পেয়েছি অনেক সফল সঙ্গীতপ্রধান সিনেমা যেমন কবি, ঢুলি(১৯৫৪), যদুভট্ট(১৯৫৪) রাইকমল(১৯৫৫), বসন্তবাহার, এন্টনি ফিরিঙ্গী(১৯৬২) ইত্যাদি । কিন্তু সিনেমা-সঙ্গীত এক নতুন মাত্রা পেল ১৯৫৫’য় হেমন্ত মুখোপাপাধ্যায় সুরারোপিত ‘শাপমোচন’ মুক্তির পর । রোমান্টিক অভিনয়ের সঙ্গে গানের মেলবন্ধন যেন সিনেমায় গানের প্রয়োগের নতুনতর দিক-নির্দেশ পেল । পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরে সিনেমার গানগুলি লোকের মুখেমুখে ফিরত । অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪), শিল্পী(১৯৫৫), সাগরিকা(১৯৫৫), পথে হল দেরি (১৯৫৬), হারানো সুর (১৯৫৬), ইন্দ্রাণী (১৯৫৭), মরুতীর্থ হিংলাজ (১৯৫৯), সপ্তপদী (১৯৬০), দেয়া-নেয়া (১৯৬৩), এন্টোনি ফিরিঙ্গী (১৯৬৭), অদ্বিতীয়া (১৯৬৮), স্ত্রী (১৯৭০), মণিহার এবং আরো অনেক ছবির গানগুলি পুরানো হবার নয় । অনেক ছায়াছবি দুর্বল কাহিনী ও অভিনয়ের জন্য তেমন সাফল্য পায়নি কিন্তু সেইসব ছবির গানগুলি স্মরণীয় হয়েছে । ১৯৬০এ নির্মিত ‘কুহক’ ছায়াছবিটির প্রিন্ট নষ্ট হয়ে গেছে, আর্থিক সাফল্যও তেমন পায়নি, কিন্তু ছবিটির একটি গান হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গীত ‘বিষ্ণুপ্রিয়া গো, আমি চলে যাই’ অমরত্ব পেয়ে গেছে ।

প্রয়াত মৃণাল সেন তাঁর চলচ্চিত্রকর্মের বৃত্তান্তে কোনদিন নীল আকাশের নীচে সিনেমাটির কথা উল্লেখ করেননি, কিন্তু সিনেমাটির হেমন্ত গীত গানদুটি ‘ও নদী রে’ এবং ‘নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী’ অমর হয়ে আছে । এ কথায় বিতর্কের যায়গা নেই যে ১৯৫০ থেকে ১৯৮০র দশক পর্যন্ত চলচ্চিত্রের গানে সুর রচনা ও গায়নের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রন্য নাম হেমন্ত মুখোপাধ্যায় । এ ছাড়াও চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনায় যে নামগুলি স্মরণীয় হয়ে আছে তাঁরা হলেন অনুপম ঘটক, রবীন চট্টোপাধ্যায়, রাজেন সরকার, কালিপদ সেন, গোপেন মল্লিক, অনিল বাগচী প্রমুখ । বাংলা গানের স্বর্ণ সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রের গানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আরো একটি নামকে আমরা মনে রাখি, তিনি মান্না দে । বাংলা চলচ্চিত্র মান্নাকে তেমনভাবে ব্যবহার করেনি, ১৯৬৬র আগে পর্যন্ত । ১৯৫৮তে ডাক হরকরা ছবিতে গেয়েছিলেন ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায় আমি বসে আছি’ । নেপথ্যে ভেসে আসা গান, আর রোমান্টিক ছবিও ছিল না সেটা, তখন বাংলা সিনেমায় নায়ক-নায়িকার রোমান্টিক ছবিরই কদর । অতয়েব মান্নাকে অপেক্ষা করতে হল আরো আট বছর । ১৯৬৬তে প্রথম ‘শঙ্খবেলা’ ছবিতে সুধীন দাশগুপ্তর উত্তমকুমারের লিপে গান গাইলেন ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ । এর পরেই বাংলা সিনেমার গানে মান্নার লোকপ্রিয়তার সূচনা । তারপর এন্টনি ফিরিঙ্গী, ধন্যি মেয়ে সহ আরো অনেক ছবির গানে মান্না দে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠলেন । বাংলা গানের স্বর্ণসময় শুধু গ্রামফোন রেকর্ডে ধৃত গানের জন্য আসেনি, সঙ্গী ছিল চলচ্চিত্র ও তার গানও ।

বাংলা গানের আধুনিক হয়ে ওঠা এবং তার স্বর্ণসময়ের নির্মাণে চলচ্চিত্রের ভূমিকার একটি তাৎপর্যপূর্ন দিক হল চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রয়োগ । এ বিষয়ে পথিকৃতের মর্যাদা পান পঙ্কজকুমার মল্লিক । সমকালেই রাইচাঁদ বড়াল ছায়াছবিতে রবীন্দ্র-গানের সার্থক প্রয়োগ করেছিলেন । তারপর পঞ্চাশ-ষাট ও সত্তর দশকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন এই বিষয়ে অগ্রণী । ১৯৩৭এ বাংলা চলচ্চিত্রের বয়স তখন সবে ছয় বছর, প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত ‘মুক্তি’ ছায়াছবিতে পঙ্কজকুমার মল্লিক প্রথম চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহার করলেন । কাননদেবীর কন্ঠে ‘আমার বিদায় বেলার মালাখানি’ এবং আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে’ । আর পঙ্কজকুমার খেয়া কাব্যগ্রন্থের কবিতায় সুর সংযোগ করইয়, রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন নিয়ে গেয়েছিলেন ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ । রবীন্দ্র-কাহিনী নয় এমন চলচ্চিত্রে সেই প্রথম রবীন্দ্রগান ব্যবহৃত হল । এবং কানন দেবী হলেন সিনেমায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম রবীন্দ্রনাথের গানের শিল্পী । তারপর ১৯৪১ পর্যন্ত আরো দশটি ছায়াছবিতে রবীন্দ্রনাথের গান সুপ্রযুক্ত হয়েছিল ।

এই সময়টাকে বলা যায় চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রগান ব্যবহারের প্রথম পর্ব । প্রথম পর্বটি আরো উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে, তখন রবীন্দ্রনাথের জীবিত কালে গ্রামফোনের বেসিক ডিস্কে খুব বেশি রবিগানের প্রকাশ হয়নি । সিনেমাই ছিল রবিগানের সফল প্রচারক । এই পর্বে সব গানই গেয়েছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক, কানন দেবী ও কুন্দনলাল সায়গল ।

তাঁদের কন্ঠে আমরা মনে রাখার মত যে গানগুলি পেয়েছি – পঙ্কজকুমার মল্লিকের কন্ঠে ‘দিনগুলি মোর সোনার খাচায়’, ‘ওরে সাবধানী পথিক (অভিজ্ঞান/১৯৩৮), ‘এমনদিনে তারে বলা যায়’, মরণের মুখে রেখে’ (অধিকার/১৯৩৯), ‘কি পাইনি তার হিসাব মিলাতে’(ডাক্তার/১৯৪০), আমার ভুবন তো আজ হল কাঙ্গাল’ (আলোছায়া/১৯৪০), কানন দেবীর কন্ঠে ‘প্রাণ চায় চক্ষ না চায়’, ‘বারে বারে পেয়েছি যে তারে (পরাজয়/১৯৪০), ‘তোমার সুরের ধারা’, ‘সেই ভালো সেই ভালো’, আমার বেলা যে যায়’, ‘আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের’ (পরিচয়/১৯৪১) । এই পর্বে আমরা পেয়েছিলাম কুন্দনলাল সায়গলকে । রবীন্দ্র পরিমন্ডলের বাইরের একজন শিল্পী আগে যার রবিগান গাওয়ার কোন অভিজ্ঞতা ছিল না সেই কুন্দনলাল সায়গল তাঁর অনুকরণীয় কন্ঠে পঙ্কজকুমার মল্লিকের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘জীবন মরণ’(১৯৩৯) ছায়াছবিতে গাইলেন দুটি গান ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান’ও ‘তোমার বীনায় গান ছিল’ । কোন অবাঙালী শিল্পীর কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান সেই প্রথম আমরা শুনলাম । রবীন্দ্রনাথ তখন জীবিত । সায়গলের গান তাঁকে তৃপ্তি দিয়েছিল । তারপর পরিচয় (১৯৪১) ছবিতে ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো’,’একটুকু ছোঁয়া লাগে’, ‘আজ খেলা ভাঙার খেলা’, ‘আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে’ গানগুলি সে কালে প্রবল লোকপ্রিয় হয়েছিল ।

চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের গান প্রয়োগের দ্বিতীয় পর্বে প্যারালাল সিনেমা পর্বের সিনেমায় রবি-গানকে আর লোকপ্রিয় করার তাগিদ ছিল না, তখন গান এসেছে চবির নাটকের মুড অনুযায়ী, কখনোবা আংশিক ব্যবহার হয়েছে গানের কয়েকটি কলি । সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’(১৯৬২) সিনেমায়’এ পরবাসে রবে কে’ গানটির চারটি পংক্তি্র অসামান্য প্রয়োগ করেছিলেন । ঋত্বিক ঘটকের ‘মেখে ঢাকা তারা’য় (১৯৬২) ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ গানটির প্রয়োগগুণে ছবির নায়িকা নীতার হৃদয়ছেড়া কান্না একাকার হয়ে যায় দর্শক সেই মুহুর্তটিকে মনে রাখেন । আবার এই একই গানের ভিন্নতর প্রয়োগ পেয়েছিলাম তপন সিংহ র ‘ক্ষুধিত পাষাণ’(১৯৫৯) চলচ্চিত্রে । মূল স্রোতের সিনেমায় অনেক ছবিতে রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহার করেছেন তাঁর সিনেমার বানিজ্যক সাফল্যের জন্য এবং তা পেয়েছেনও । এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য তাঁর পরিচালিত ‘দাদার কীর্তি’(১৯৮০), ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’(১৯৮৫) এবং ‘আলো’(২০০৩) আরো অনেক পরিচালক অপর্ণা সেন, গৌতম ঘোষ, ঋতুপর্ণ সেনগুপ্ত প্রমুখ তাঁদের সেনেমায় রবীন্দ্রগানের শৈল্পিক প্রয়োগ করেছেন । কিন্তু মৃণাল সেন তাঁর কোন ছবিতেই রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহার করেননি । আজ পর্যন্ত কতগুলি ছায়াছবিতে কত রবীন্দ্রগানের ব্যহার হয়েছে, সেই সংখ্যাটা নিছিতভাবে বলা যায় না । তবে চলচ্চিত্র গবেষক স্বপন সোম তাঁর একটি লেখায় বলেছেন “... সংখ্যাটা নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও মোটামুটি হিসেব এইরকম :প্রায় ২৫০ রবীন্ঙ্গীসংগীত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রায় ২০০টি বাংলা চলচ্চিত্রে” । (পশ্চিমবঙ্গ/রবীন্দ্র সংখ্যা মে-২০০৩)।

বাংলা গানের পথচলায়, তার পণ্যমূল্য তৈরি হওয়ার পর চলচ্চিত্রের গানের বিশেষ অবদান রয়েছে । শূন্য থেকে শুরু করে সিনেমা-সঙ্গীতের সূচনাপর্বে যারা গান গেয়েছিলেন তাঁরা চিরকাল স্মরণযোগ্য । বাংলা সিনেমা-সঙ্গীতের এমনই দুই অগ্রপথিক – কানন দেবী ও কুন্দনলাল সায়গল । তাদের কথা আগামী পর্বে ।


(আগামী সংখ্যায় সিনেমাসঙ্গীতের দুই প্রবাদ-প্রতীম শিল্পী কানন দেবী ও কুন্দনলাল সায়গল)