শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

তিমির তীর্থ, প্রথম ভাগ

[সদ্য প্রয়াত কথা শিল্পী হোমেন বরগোহাঞির লেখা খুদে উপন্যাসতিমির তীর্থপ্রকাশিত হয় ১৯৭৫-প্রকাশক স্টুডেন্টস-স্টোর্স, গুয়াহাটিএক সাংবাদিকের রক্তাক্ত অন্তর্দ্বন্দ্ব ও আত্মশুদ্ধির কাহিনিলেখক নিজেও ব্যক্তিগত জীবনে সাংবাদিক ছিলেনফলে এর মধ্যে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ছায়াপাত ঘটলেও একে আত্মজৈবনিক উপন্যাস বলা যাবে নাকিন্তু সমকালীন অসমের আর্থ-সামাজিক পরিবেশের একটি রেখাপাত তো ঘটেইছে]

বহুদিন পর প্রহ্লাদ স্ত্রীকে নিয়ে সিনেমা দেখতে বেরোচ্ছিল। দুজনেই পোশাক আসাক পরে বেরুতে যাবে মাত্র, তখনই কাজের ছেলেটি এসে খবর দিল---বাইরে একজন অতিথি এসছে। মুহূর্তেই দুজনের মুখ কালো হয়ে এল। ললিতা হতাশায় ভেঙে ধপ করে বিছানাতে বসে পড়ল। বলল, “ তুমি কিন্তু পাঁচ মিনিটের মধ্যে লোকটাকে বিদেয় দিতে হবে। মরবার জন্যে আর আসবার সময় পেল না। বেছে বেছে আজই এসময়ে এসে হাজির। আমি কিন্তু ঘড়ির কাঁটায় তাকিয়ে বসে থাকব। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ওকে বিদেয় করে না এলে আমিই বাইরে গিয়ে বলে দেব, সিনেমার টিকেট করা আছে। না গেলেই নয়।”

কোনও কথা না বলে সান্ত্বনার ছলে প্রহ্লাদ স্ত্রীর মুখে হাতটা বুলিয়ে দিল, তারপর গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গেল।

পাঁচ মিনিটের ঠাঁই দশ মিনিট চলে গেল, কিন্তু প্রহ্লাদের ভেতরে আসবার নামই নেই। ললিতা যদিও নিজেই গিয়ে অতিথি বিদেয় করবার হুমকি দিয়েছিল, তাই বলে মুখের সব কথা কি আর কাজে পরিণত করা যায় ? সে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে বসবার ঘরের দরজার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে স্বামী আর অতিথির কথা শুনবার চেষ্টা করল। কিন্তু লোকটা এত সরু গলাতে কথা বলছিল যে শ্রবণের সব শক্তি ব্যয় করেও একটা শব্দও ভালো করে ধরতে পারল না। লোকটাই শুধু কথা বলছে। প্রহ্লাদের মুখে রা নেই। পর্দা সামান্য ফাঁক করে খুব সতর্কতার সঙ্গে ললিতা দু-জনকে দেখবার চেষ্টা করল। অতিথিটি একটু মোটাসোটা যত্নে পেটা লোক, পরনে খদ্দরের ধুতি আর পাঞ্জাবি। একবার দেখলেই বোঝা যায় রাজনীতির লোক। লোকটার মুখের কথাগুলো ললিতা ধরতে পারল না বটে, ভাবভঙ্গী দেখে এটা আঁচ করল যে খুবই বড় বা জরুরি কোনো কথা সে স্বামীকে বলছে। সে তার দৃষ্টি লোকটার মুখের থেকে সরিয়ে এনে স্বামীর মুখের উপরে ফেলল। তার মুখের ভাব দেখে বেশ অবাক হল। সাধারণত মানুষের সঙ্গ সে বড় ভালোবাসে না। ঘরে কখনও কেউ এলেও সে মুখে এমন এক শুকনো আর নির্বিকার ভাব ফুটিয়ে তুলবে যে সেই ব্যক্তি গেলেই যেন রক্ষা পায়। কিন্তু আজ ললিতা দেখে অবাক হল এই দেখে যে লোকটার দিকে শরীর হেলিয়ে এত মনোযোগের সঙ্গে সে লোকটার কথা শুনছে যেন এই কথা ক’টির উপরেই তার গোটা ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।তার চোখে বিস্ময়, বিমূঢ়তা আর নিবিষ্টতা সব ভাব একসঙ্গে ফুটে উঠেছে।প্রহ্লাদের মুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ললিতা উপলব্ধি করল যে সিনেমা দেখার আশা এখানেই ছেড়ে দেওয়া ভালো। প্রহ্লাদের মন থেকে সিনেমাতে যাবার চিন্তা বোধহয় হাজার মাইল দূরে সরে গেছে। দাঁতে দাঁত চেপে সে ভেতর ঘরের দিকে পা বাড়াল। কাপড়চোপড় খুলে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ঘরে পরা কাপড় পরে ঘোর সন্ধ্যায় বিছানায় গা এলিয়ে দিল।

ললিতার ছেলেমেয়েরা—মানিক আর মুনমুন দিনের খেলা শেষে ঘরে ফিরে এল। এসময়ে মাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হল। দুটিতেই এক সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, “মা, খিদে পেয়েছে। কিছু খেতে দাও!” ললিতা মৃদু ধমকে বলল, “ আমাকে জ্বালাবি না। রান্না ঘরে গিয়ে কী পাস দেখ গে যা! খেয়ে ভালোয় ভালোয় পড়তে বস!”

মানিক আর মুনমুন বুঝল যে আজ খবর আছে। বেশি আহ্লাদ করলে মায়ের থেকে আজ ধমক, চাই কি কিলও জুটতে পারে। বেশি বাক্য ব্যয় না করে ওরা মনে মনে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকে পড়ল।

ইতিমধ্যে বোধহয় এক ঘণ্টা সময় পেরিয়ে গেছে। ললিতার রাগটাও একটু হাল্কা হয়ে এসেছে। প্রহ্লাদ এখনও ভেতরে এল না বলে সে বেশ অবাক হল। আজ অব্দি ঘরে আসা কারও সঙ্গে প্রহ্লাদের এতটা সময় কাটানো ললিতার মনে পড়ে না। অল্প আগেও বাইরের ঘরে কথা পেতে থাকবার গুনগুন শব্দ একটা ওর কানে আসছিল। কিন্তু এখন তাও নেই। এত নীরবে লোক দুটি করছে কী? মনের কৌতূহল দমাতে না পেরে সে বিছানার থেকে উঠে দাঁড়াল আর বাইরের ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

ওমা! দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে ঘরে এখনও আলো জ্বালানো হয় নি। ঘরটাতে শুধু অন্ধকারই নয়, সম্পূর্ণ নীরবতা বিরাজ করছে। পর্দাটা উঠিয়ে ভেতরে উঁকি দিল সে। অন্ধকারে প্রথমে কিছুই নজরে পড়েনি। কিন্তু তারপরেই মনে হল ঘরটিতে শুধু একটিই লোকরয়েছে। তার মানে অতিথি সেই কখন চলে গেছে। সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে দিল।

আলো জ্বলবার সঙ্গে সঙ্গে প্রহ্লাদ চমকে উঠে নড়ে চড়ে বসল। অপ্রস্তুত হয়ে ললিতার মুখের দিকে তাকিয়ে সে শুধু বলল, “অহো , তুমি।”

ললিতা মুখে একটাও কিছু না বলে স্বামীর মুখে স্থির দৃষ্টি ফেলে কাছে এগিয়ে গেল এবং সামনের চেয়ারটাতে বসল। তারপর প্রহ্লাদের চোখে চোখ রেখে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল , “তোমার আজ হয়েছে কী? কোনও বড় ঘটনা নিশ্চয়। না হলে তুমি এমন কর না। কী হয়েছে , আমাকে বলবে?”

সহজ হবার চেষ্টা করে প্রহ্লাদ। মুখে হাসি একটা এনে বলে,“হবার কী আছে? কিছু হয় নি। এমনিতেই এটা ওটা ভেবে বসে ছিলাম।”

ললিতা মুখের গম্ভীর ভাব বজায় রেখে বলল, “জীবনে আগে কখনও এমনটি করেছ বলে তোমার মনে পড়ে কি? কোনদিনই বা ঘরে আসা মানুষের সাথে বসে বসে এক ঘণ্টা কথা বলেছিলে?--- ঐ লোকটা কে ছিল? আগে তো কোনও দিন একে আসতে দেখিনি।”

প্রহ্লাদ উঠে দাঁড়াল।পকেট থেকে চারমিনার একটা বের করে জ্বালিয়ে বলল,“ তুমি ঠিকই ধরেছ। লোকটা আমাদের ঘরে আগে কখনও আসে নি। এই প্রথম এসছে। আমি অবশ্য লোকটাকে আগেই চিনি। জগন্নাথ চৌধুরী। কংগ্রেসি এম এল এ। ... আমার আজ সত্যিই খারাপ লাগছে ললিতা। আজ প্রায় এক বছর পর এত হ্যাপার পর সিনেমাটা দেখব বলে বেরুচ্ছিলাম। অসময়ে লোকটা এসে সব নষ্ট করে দিল। কাল নিশ্চয়ই যাব---ভূকম্প হোক আর প্রলয় আসুক। এখন ওঠো। এক কাপ চা দাও আমাকে। কথা বলে বলে গলাটা শুকিয়ে গেছে।”

প্রহ্লাদ ভেতর ঘরের দিকে পা বাড়াল।

ললিতা বসে রইল। গম্ভীর অথচ চড়া গলাতে বলল, “আমার কাছে কোনও কথা গোপন করবার থাকে তবে আর কিছু বলতে হবে না। আমি তোমাকে জোর করব না। এম এল এ লোকটা তোমাকে এমন কি কথা বলল যে তুমি স্থান কাল ভুলে পাথরের মূর্তির মতো একই জায়গাতে বসে ছিলে? নিশ্চয়ই সে তার মেয়েরবিয়েতে ডাকে নি?”

প্রহ্লাদ ঘুরে তাকিয়ে বলল,“তা বটে,মেয়ের বিয়ের নেমতন্ন নয়। কিন্তু সে শুধু আমাকেই ডেকে রাজভোগ খাওয়াবার মতো ব্যাপার বটে। ... জানোই তো,খবরের কাগজের লোকের কাছে কত লোক আসে কত কথা নিয়ে। কোনও একটা কথা না থাকলে এম এল এ-র মতো মানুষ আমার ঘরে আসতে যাবে কেন?... এসো এসো , সময়ে তোমাকে সবই বলব। এখন আগে চা এক কাপ আমাকে দাও”

ললিতা কিছু বলার অপেক্ষা না করে সে ভেতরে চলে গেল।

কিছুক্ষণ ললিতা সেখানেই ঠায় বসে রইল। ওর মনে নিশ্চিত ধারণা হল যে আজকে প্রহ্লাদ ওর থেকে কিছু একটা লুকোবার চেষ্টা করছে। সাধারণত সে এমনটা কখনও করে না।যেখানে যা ঘটে বা শুনে প্রতিটি কথা তার ললিতাকে বলা চাইই। তার কোনো বন্ধুবান্ধব নেই।ললিতাই একমাত্র বন্ধু।ললিতার সঙ্গে কথা বলাই তার একমাত্র বিলাস,একমাত্র সান্ত্বনা,একমাত্র বিনোদন। ঘরেই বা বাইরে --- কার সঙ্গে কী আলাপ হল---তার সব কটা শব্দও বাদ না দিয়ে ললিতাকে সে বলে শোনায়। আজই তার ব্যতিক্রম হল।ওর মনে নানা দুশ্চিন্তা ঠাঁই নিন।চিন্তার দোহায় যেন দেহটা হেলে পড়ছে।এমনই এক ভঙ্গীতে সে বসার থেকে উঠল আর ধীরে ধীরে রান্নাঘরে পা বাড়াল।

খানিকক্ষণ পরে তৈরি চা এক কাপ ললিতা প্রহ্লাদ বসে থাকা কোঠায় ঢুকতে যাবে ঢুকতে যাবে--- কানে এল মানিক আর মুনমুনের সঙ্গে খুব আড্ডা জমিয়েছে। মুনমুন বলছে,“জানো বাবা, মা না ভীষণ খারাপ। আজ আমাদের উপর শুধু শুধু রাগ করেছে।” মাণিক সঙ্গে জুড়ল,“দেখো তো বাবা, খেলার থেকে এসে মাকে কিছু খাবার দিতে বললাম। মা রাগ করে বলে কি না ---রান্না ঘরে যা পাবি গে খা। আমরা এসে দুটো শুকনো রুটিই শুধু পেলাম। আর কিচ্ছুটি নেই। গরুর ছালের মত দুটো শুকনো রুটি। সেগুলো কি খাওয়া যায়? আজ আমরা কিছুই খাইনি বাবা।”

বেদনায় ভেজা স্বর নিয়ে প্রহ্লাদ জিজ্ঞেস করল , “আজ খেলার থেকে এসে তোমরা কিছু খাও নি?”

বাবার থেকে সহানুভূতি পেয়ে ঝরনা দুটোর বাঁধা মুখ খুলে গেল যেন।একসাথেই ওরা ঢের কীসব এটা-ওটা বলতে শুরু করে দিল। মানিক বোনকে মাঝে ধমকে থামাবার চেষ্টা করে বলল,“ দাঁড়া না! আমি বাবাকে কথাটা বুঝিয়ে বলি।জানো বাবা,আমাদের সঙ্গে রানা আর নান্টুরা খেলা শেষ করে ঘরে গিয়ে পড়তে বসবার আগে রোজ এক গ্লাস হরলিক্স খায়।রুটি মাখন এগুলো তো খায়ই।আমাদেরই রোজ মুড়ির নাড়ু,নইলে রুটির সঙ্গে ঠাণ্ডা জল এক গ্লাস খেতে হয়। আমাদের জন্য তুমি হরলিক্স আনো না কেন,বাবা? খেতে যা ভাল্লাগে। আমি একদিন রানাদের ঘরে খেয়েছিলাম।”

“আমিও খেয়েছিলাম।” মুনমুন গর্বের সঙ্গে কথায় কথা জুড়ল।

প্রহ্লাদ দু-জনের দুই গালে চুমো খেয়ে বলল,“আনব,আনব আমার সোনারা!আমিও তোমাদের জন্যে নিশ্চয় একদিন হরলিক্স আনব।হরলিক্স আনব,ওভালটিন আনব,জাম-জেলি আনব...।”

আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে শিশু দুটি এক সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল,“আর কী কী আনবে বাবা? বল না, আর কী কী আনবে?”

পর্দা ঠেলে ললিতা ভেতরে এল। মানিক ও মুনমুনের চোখের দিকে তাকিয়ে সে বলল,“ তোরা পড়া শুরু করিস না কেন?খালি খেলা আর গল্প,গল্প আর খেলা!পড়বি কখন?” প্রহ্লাদের দিকে তাকিয়ে বলল,“তুমি তোমার ঘরে এসো।ওদের পড়তে দাও।হাওয়া মিঠাই খাইয়ে এদের আর পাগল না করলেও চলবে।”

বাতাসে বাতি নেভার মতো তিনেরই মুখের হাসি নিভে মুহূর্তে আঁধার নেমে এল।মানিক মুনমুন মুখ কাঁচুমাচু করে বই মেলে ধরল।

নীরবে চা-কাপ খেয়ে শেষ করলে ললিতা প্রহ্লাদকে বলল,“তুমি বিছানায় অল্প শোও ।আমি মাথাটা একটু টিপে দিই।”

প্রহ্লাদ অবাক হয়ে বলল,“কেন? আমি তো তোমাকে মাথাব্যথা করছে বলে বলিনি।”

“তুমি তর্ক না করে বিছানায় শুয়ে পড়।” ললিতা কড়া হুকুম দিল। সুইচ টিপে আলোটা নিভিয়ে দিল। দীর্ঘ একটা শ্বাস টেনে আত্মসমর্পণের ভঙ্গীতে প্রহ্লাদ সটান বিছানায়শুয়ে পড়ল।বিছানাতে পড়েই শুধু সে অনুভব করল সত্যিই তার হাত পা মেলে আরাম করবার প্রয়োজন ছিল।তার মাথার কাছে বসে ললিতা কপালে হাত বুলাতে শুরু করল।অপরিসীম আরামে প্রহ্লাদের সারা শরীরে শিহরণ খেলে গেল।কিছুক্ষণ চিৎ হয়ে শুয়ে সে ডানদিকে কাত হয়ে শুল আর ছোটো ছেলে মাকে যেমন করে---দুই হাতে ললিতার কোমর জড়িয়ে ধরে মুখটা তার কোলে গুঁজে দিল।মুখে একটাও কথা না বলে ললিতা তার সারা মাথা মালিশ করে দিল। মাথা মালিশ হলে গলা হাত পিঠও মালিশ করে দিল। ললিতা কিছু না বললেও প্রহ্লাদ অনুভব করল--- ওর আঙুলগুলো যেন আবেগে জড়িয়ে এসে বহু কথা বলতে শুরু করেছে। ওর হৃদয়ের সমস্ত মমতা যেন আঙুলগুলোর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। জ্যা-বদ্ধ ধনুর মতো টান হয়ে থাকা তার শরীরের স্নায়ুর জটিল বন্ধনগুলো ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে এল। এক অপরিসীম আরাম আর মাধুর্যের আবেশে তার চেতনা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে এল।সে আরো জোরে কোমরটা জড়িয়ে ধরে কোলের আরও গভীরে ডুব দিল।ওর কাপড়ে দিনের কাজের গন্ধ, ঘামের গন্ধ, রান্নাঘরের নানা মশলা তেল হলদির গন্ধ। কিন্তু প্রহ্লাদের মনে হল পৃথিবীর দুর্মূল্যতম সুরভির নির্যাস থেকেও ললিতার শাড়ির এই গন্ধটা বেশি মধুর। আঁধার ঘরটিতে নিশ্ছিদ্র নীরবতাটি এক সর্বক্লান্তিহর মধুর সুরের মতো তার কানে বাজতে শুরু করল। আর কোনও এক সময়ে গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল।

রাতে ভাত খাবার জন্য ললিতাকে বেশ বেগ পেতে হল।দিন জুড়ে খেলাধুলোর পর ক্লান্ত হয়ে দিনের শেষে শুয়ে পড়া শিশুর মতো প্রহ্লাদ কিছুতেই আর উঠতে চায় না।বহু কষ্টে ললিতা তাকে ভাতের টেবিল অব্দি টেনে আনল।কিন্তু সেই টেবিলে শুরু হল আরও এক যুদ্ধ।ভাতের থালাতে হা না দিয়েই গর্জে উঠল প্রহ্লাদ,“এই গরুর দানাগুলো আর কত খাওয়াবে? দিনের পরে দিন গোটা জীবনটাতেই আমার অরুচি ধরে গেছে।”

মানিক আর মুনমুন এর মধ্যেই ভাত খাওয়া সেরেইছিল। বাবার কথায় তারাও থালা দুখানা ঠেলে দিয়ে বলল,“এই গরুর দানাগুলো আমরাও খেতে চাইনে বাবা!কিন্তু না খেলে মা আমাদের মেরে আধমরা করে দেবে।আমাদের জোরে খাওয়াচ্ছে।”

ললিতা প্রথম গ্রাসটা মুখে নিচ্ছিল মাত্র। কিন্তু স্বামী আর সন্তান দুটোর কীর্তি দেখে আধোপথ থেকে হাতটা আবার থালায় নামিয়ে আনল।শান্ত দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল,“ ডায়োজিনিসের গল্প তুমিই আমাকে একদিন শিখিয়েছিলে---নিজের আদর্শ বিসর্জন না দিয়ে বা কারও পায়ে তেল না দিয়ে জীবন কাটাতে হলে শাক-পাতা খেয়েই জীবন কাটানো শিখতে হবে। আজ যদি নতুন করে ভাবছ যে সে শিক্ষা মূল্যহীন,তবে যাও না!কারও হাতে পায়ে ধরে ভালো চাকরি একটা নিলেই হল। আমার কী! তুমি থলি ভরে টানা এনে দিলেই আমি রোজ মাছ মাংস রেঁধে দেব।”

ললিতা নীরবে খেতে শুরু করে।

ললিতা লক্ষ করে নি,কিন্তু ওর কথাগুলো শোনে সাপে কাটা লোকের মতো প্রহ্লাদের মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে পড়ল। কয়েকটি মুহূর্ত সে স্তব্ধ এবং নিশ্চল হয়ে রইল।তারপর থালা টেনে কাছে এনে খেতে শুরু করল।মানিক মুনমুনও তার অনুসরণ করল।সেদিন তাদের রাতের আহার ছিল মোটা চালের ডাল,অল্প জলের মতো ডাল,আর কয়েক ফোঁটা তেলে ভাজা বেগুন।দুই গ্রাসের মতো খেয়ে প্রহ্লাদ অনুভব করল ভাতগুলো তার গলা দিয়ে যেতে চাইছে না।প্রতি গ্রাস ভাতের সঙ্গে এক এক ঢোক জল খেয়ে ভাতগুলো সে ভেতরে ঠেলে দেবার চেষ্টা করল।খেয়ে শেষ করাটা তার জন্যে এক যন্ত্রণার কাজ হল। তার ইচ্ছে হল আধো ভাত খেয়েই বাকিটাতে জল ঢেলে উঠে চলে যায়।কিন্তু ললিতার দিকে না তাকিয়েও স্পষ্ট অনুভব করল সে তার প্রতিটা গতিবিধি চোরাচোখে লক্ষ করছে।প্রহ্লাদ ঈশ্বর শয়তান রাজা মহারাজা বাঘ ভালুক কিছুতেই ভয় পায় না।সে এক dare-devil বলে সমাজে একটা নামই আছে।কিন্তু অবাক করা কথা হল—ললিতার ভয়ে মনে মনে সে সারাক্ষণ কম্পমান থাকে। এ ভয় অবশ্য অপরাধী যেমন পুলিশ বা বিচারকদের ভয় করে তেমন ভয় নয়।এ হল প্রাণাধিক প্রিয়জনে কোনোভাবে আঘাত পাবে বলে সদা সতর্ক হয়ে থাকার ভয়।ললিতা প্রহ্লাদের উপর মুখ ফুটিয়ে কদাচিৎই রাগ করে,কিন্তু ওর সামান্যতম ভ্রু সংকোচনও তার জন্যে এক নির্দেশ বা সতর্কবাণী।সে তখন সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে নেয় নিশ্চয়ই কোনও ভুল করতে চলছে। খেতে খেতেই বাঁকা চোখে একবার সে ললিতার মুখের দিকে তাকাল। অন্য মনস্ক হয়ে আছে আর সে ভাবনার বেদনার ছাই ওর মুখটাকে কালো আর গম্ভীর করে তুলেছে।প্রহ্লাদ জানে ওর এই গাম্ভীর্য রাগ বা অভিমানের নয়। স্বামী সন্তানেরা যে খেয়ে তৃপ্তি পাচ্ছে না---তেতো ঔষধের বড়ি গেলার মতো অতি কষ্টে গলা দিয়ে পার করছে—এ অনুভূতিই ওর মনে ভীষণ যন্ত্রণা দিতে শুরু করল। ভাত খাওয়াতে আগ্রহ দেখিয়ে গ্রাস একটা চিবিয়ে চিবিয়ে মানিককে বললে,“কী রে মানিক! অনেকদিন পর বেগুন ভাজা। দারুণ লাগছে, না?” “একদম না!” মানিক চড়া গলায় ঘোষণা করল, “ এই জলে ভেজা বেগুন খেয়ে আমার বমি পাচ্ছে।”

প্রহ্লাদ আর টু শব্দটি করল না। কিন্তু সেই মুহূর্তে গলাটা বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসছে যেন অনুভব করল। এই কচিকাঁচা শিশুগুলো! ওদের এখন পুষ্টিকর খাদ্য চাই, কত স্বাদ-সুগন্ধ-রুচিকর খাবার খেতে ওদের আগ্রহ! কিন্তু গরীব বাবার সন্তান হয়ে এদের জন্মের থেকে ডালের জল আর বেগুন পোড়া খেতে হচ্ছে। ইচ্ছে করলে কাল সকাল থেকেই সে ওদের ঘি-দুধ-মাছ-মাংস খাওয়াতে পারে! এদের জীবনের নিম্নতম প্রয়োজন আর সুখ –স্বাচ্ছন্দ্যের থেকে বঞ্চিত করার সত্যি কি তার কোনো নৈতিক অধিকার রয়েছে? জীবনের কোন আদর্শের বেদিতে সে তার সন্তানের কল্যাণ আর আশা আকাঙ্ক্ষা বলি দিচ্ছে?


ক্রমশ ...