বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪

জমাট বাঁধা রক্ত, পর্ব -শেষ পর্ব

আট

প্রথমে খবরটা দিল যোগেশ্বর। অনিমেষ যাবার পরেই পবিত্র অন্যান্য দিনের মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল না। পরের দিন সকাল সাতটার সময় এসে যোগেশ্বর উপস্থিত হওয়ায় পবিত্র মোটামুটি অবাকই হল।

যোগেশ্বর চুপি চুপি তাকে বলল-' গতকাল মৌজাদারের মেজো ছেলে তার কোনো এক বন্ধুর সঙ্গে মোটরসাইকেলে উঠে এসে একটা খবর দিয়ে গেল । খবরটা শুনে মানুষগুলি বড় উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। মৌজাদারের ছেলে বলল-' মন্টুদের ওখানকার মানুষগুলি নাকি একটি বাঙালি স্কুল খুলতে চাইছে। ছবিলাল মহাজনের কাছ থেকে হাজার টাকা চাঁদা এনেছে। শহর থেকে, লামডিং থেকে অনেক টাকা পয়সা এনেছে। সেদিন নাকি কালীবাড়িতে গোপন মিটিং হয়ে গেছে।

পবিত্র আগের দিন মন্টু দিয়ে যাওয়া খবরটা গোপন করে বলল -'এই সমস্ত উড়োখবরে বিশ্বাস করে লাভ নেই । মৌজাদেরের ছেলে কী মতলবে এই সমস্ত খবর ছড়াচ্ছে কে জানে। তার ও কিছু মতলব থাকতে পারে।

'সেগুলিতোঠিক' যোগেশ্বর বলল, 'কিন্তু এত যে উড়ো খবর বেরিয়েছে, কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যা কিছুই বুঝতে পারছিনা ।'

তারপরে কিছুক্ষণ সময় অপেক্ষা করে আস্তে আস্তে যোগেশ্বর আরও একটা কথা বললঃ কেউ একজন দশরথকে বুদ্ধি দিয়েছে, এই সুযোগে যদি মন্ন্টুদেরঅঞ্চলটা জ্বালিয়ে দিতে পারে তাহলে ওরা এখান থেকে দূরে চলে যাবে, সরকার গ্ৰেজিং ভেঙ্গে খেত করতে দেবে না,নতুন জমি নেই, তাই এভাবে তাড়িয়ে দিতে পারলে সেই ওদের মাটি গুলি তাদের হয়ে যাবে …' ।

যোগেশ্বরের কথায় পবিত্র একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। কথাটা যে এতদুর পৌঁছাতে পারে পবিত্র কল্পনাই করতে পারেনি।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে পবিত্র বললঃ আগুন হাত পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে হবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির খবর বাতাসের চেয়েও জোরে বয়, তাই আমাদের কিছু একটা করতে হবে।

'কী করবি ?'

আমাদেরকে একটি গ্রামে জনগনের সভা ডাকতে হবে। মন্টুদের আশেপাশের সবাইকে ডাকতে হবে - আমাদের এদিকের যুবক বৃদ্ধ সবাইকে ডাকতে হবে- দেরি করে লাভ নেই, চল আমরা দুজন বেরিয়ে যাই, যদি দরকার হয় আমাদের শান্তি- সম্প্রীতির জন্য একটি শান্তি কমিটি গঠন করতে হবে।'

পবিত্র এবং যোগেশ্বর প্রথমে গিয়ে মন্টুদের অঞ্চলে উপস্থিত হল। দু'জনকেই এত সকালে দেখে সবাইঅবাক হল। প্রত্যেকের মনে যেন কিছু একটা সন্দেহের বীজ । মন্টুকে ওদের আসার উদ্দেশ্যটা বলল। মন্টু বলল,' কিছু একটা করার কথা আমিও ভাবছি - কিন্তু কী করতে পারি কিছুই ঠিক করতে পারছিলাম না। তোরা এসে যাওয়ায় খুব ভালো হল।

এরপরে ওরা একজন দুজন করে একত্রিত ভাবে গ্রামের প্রতিটি মানুষের বাড়িতে গেল । জনগণকে বিকেলে দুটো অঞ্চলের মধ্যে থাকা প্রাইমারি স্কুল ফিল্ডে সবাইকে এক সঙ্গে মিলিত হয়ে আলোচনা করার কথা বলল। কীসের আলোচনা কী কথা সেটা কাউকে খুলে বলল না। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে বেলা দুপুর হয়ে গেল। অবশেষে পবিত্র সঙ্গীদের সামনে একটা প্রস্তাব দিল যে সভায় অঞ্জনা বিশ্বাসকেও ডাকা হোক।

অঞ্জনা বিশ্বাসকে কেন ? যোগেশ্বররা জিজ্ঞেস করল ,' এরা সব বাইরের মানুষ , গ্রামের কথা বাইরের মানুষের কাছে কেন যেতে দেওয়া হবে ? তার মধ্যে তুই ওকে মাস্টারনী করে আনতে চাইছিস। এই সমস্ত দেখলে কি মাস্টার হতে চাইবে ?'

'এই মাধ্যম সমস্যাটা আমাদের গ্রামের সমস্যা নয় ,সমস্যাটা আমাদের মতো কলেজে পড়া ছেলেমেয়েদের। আমি ছাড়া এই অঞ্চলে কলেজে পড়েছে অঞ্জনা। আমি যা বলব তারচেয়ে মন্টুদের অঞ্চলের মানুষগুলো হয়তো আজকের পরিস্থিতিতে অঞ্জনাকে বেশি বিশ্বাস করবে।'

' তোর কথাটা সত্যি' মন্টু বলল,' আমাদের কোনো ছেলেমেয়ে হাই স্কুলের মুখই দেখেনি। সেই ক্ষেত্রে একজন কলেজে পড়া মেয়ে দেখলে হয়তো কথাগুলি একটু আলাদা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু কথা হল এই ধরনের কথায় বা কি হয়…?'

' সেই বিষয়ের তোদের চিন্তা করতে হবে না' পবিত্র বলল,' আমি মেয়েটিকে জানি, যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে, পড়াশোনা করা মেয়ে। মেয়েটির সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি নেই…'

' তুই যা ভাল বুঝিস তাই কর' সবাই বলল, মোটকথা আমাদের গ্রামটা যেন ভাগ ভাগ না হয়।'

পবিত্র যত জোরে পারে সাইকেল মারতে লাগল। সময় বেশি নেই। অঞ্জনা এলে চার মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে আসতে হবে।

পবিত্রের মনে হাজারো উৎকণ্ঠা। সবাইকে বলে এসেছে অঞ্জনাকে নিয়ে আসবে। কিন্তু অঞ্জনা যদি না আসে, মা-বাবা যদি আসতে না দেয়, ফিরে গিয়ে সে সবাইকে কী বলবে? পুরো ব্যাপারটাতে যেন তার আত্মসম্মান, তার অহংকার এই সমস্ত কিছু জড়িত হয়ে রয়েছে ।

' কী হল, এভাবে হন্তদন্ত হয়ে এসেছ কেন? অঞ্জনা পবিত্রের আসার ধরনটা দেখে প্রশ্ন করল, তোমাকে দেখে এরকম মনে হচ্ছে যেন তুমি বহুদূর থেকে ঘুরে ফিরে এসেছ।'

' ঠিকই কথা বলেছ অঞ্জনা, আমি একটা বড় বিপদে পড়ে তোমার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছি। আমাকে কথা দাও অঞ্জনা, তুমি আমার সঙ্গে যাবে।'

' তোমার সঙ্গে?' অবাক হয়ে অঞ্জনা জিজ্ঞেস করল,' আমি বুঝতে পারছি না তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাইছ, সবকিছু খুলে বল…'

পবিত্র অঞ্জনাকে স্কুল আরম্ভ করার সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত হওয়া সমস্ত কথা এক এক করে বলে গেল। সমস্ত কথা শেষ করার পরে বলল,' তুমি কথা দাও অঞ্জনা ,আমার সঙ্গে যাবে?'

' আমি যাব' অঞ্জনা বলল, অবশ্য আমি তোমাকে কতটা সাহায্য করতে পারব সে কথা হয়তো বলতে পারব না। পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা আমার নেই। আমি বড় নিঃসঙ্গতার মধ্যে বড় হয়েছি।... আচ্ছা বাদ দাও এই সমস্ত কথা বার্তা, বাবা এবং মাকে বলব তোমাদের গ্রামে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছ বলে। এসব কথা বল না, মিছামিছি চিন্তা বাড়ানো হবে।'

' বলবনা' পবিত্র বলল,' তুমি তাড়াতাড়ি বেরোও। যাবার সময় পায়ে হেঁটে যেতে হবে। ফেরার পথে একটা গরুর গাড়ির বন্দোবস্ত করব। আসার সময় গরুর গাড়ি পেলাম না, সবাই মাঠে গিয়েছে,গোরু ও ছেড়ে দিয়েছে…'

' হয়ে যাবে, হাঁটতে না পারলে তোমার সাইকেলের পেছনে বসে যাব। চালাতে পারবে তো? ' অঞ্জনা হেসে বলল। মায়ের এত দূরের রাস্তায় পাঠানোর ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু অঞ্জনার বাবা উৎসাহ দিল। সঙ্গী সাথী ছাড়া অঞ্জনা এভাবে কতদিন বাড়িতে বসে থাকবে। দু'একদিনের জন্য বেরিয়ে এলে বরং মনটাও ভালো লাগবে।

কিছুক্ষণ দুজনের কারও মুখেই কথা নেই।নির্জনভয়ঙ্কর রাস্তা। স্টেশন থেকে কিছুটা দূরে আসার পরে শুরু হল গভীর জঙ্গল। মাঝেমধ্যে দু'একটি পাখির শব্দ।

' রাস্তার এই জায়গাটা একেবারে নির্জন। পবিত্র বলল স্টেশনে আসার কাজ না থাকলে এদিকে কেউ আসে না তুমি যদি খারাপ না পাও সাইকেলের সামনে বসবে কি ? জঙ্গলটা শেষ হওয়ার পরে গ্রামে পৌঁছানোর আগে গিয়ে আবার হাঁটব।'

'আমার কোনো আপত্তি নেই' অঞ্জনা বলল,' এই ধরনের নির্জন জায়গায় হাঁটতে ভালো লাগছে, একটু ক্লান্ত হয়ে পড়লে তখন বসব, নাকিসাইকেল ঠেলে ঠেলে তোমার ক্লান্ত লাগছে?'

' আমার জন্য চিন্তা করতে হবে না' পবিত্র বলল,' চারমাইল রাস্তা হেঁটে তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছ বলেই বলছি…'

' ঠিক আছে, কিছুটা দূর তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে যাই । তারপরে সামনে বসব। হবে?'

' কথা বলব বলে তুমি দেখছি এতটা পথ কোনো কিছু না বলেই এলে?'

' তুমি বলবে, আমি শুনব বলে পথ চেয়েছিলাম ।'

' আচ্ছা যদি খারাপ না পাও আমি তোমাকে একটা ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই…'

' বল, তোমার কাছে খারাপ পাওয়ার মতো আমার কোনো ব্যক্তিগত কথা নেই....'

' প্রথম যেদিন তোমার সঙ্গে দেখা হয় তুমি জীবনানন্দের কবিতা পড়ছিলে। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম জীবনানন্দ তোমার প্রিয় কবি নাকি? তুমি বললে, জীবনানন্দ তোমার প্রিয় কবি কিনা তুমি জান না, কিন্তু বইটি তোমার অত্যন্ত প্রিয়, এর কারণটা কি ছিল?'

কিছুক্ষণ অঞ্জনা কোনো কথা বলল না। তারপর বললঃ এই বইটি যে আমাকে দিয়েছিল সে আমার জীবনের আদর্শ, প্রেরণা এবং সাধনা ছিল। এই বইটি হাতে নিলে আমি যেন তার স্পর্শ অনুভব করি।'

' মানুষটি কে?' পবিত্র এবার সোজাসুজি জিজ্ঞেস করল,' তোমার প্রেমিক?'

' ঠিক প্রেমিক বললে কী বোঝায় সে কথা আমি জানি না, কিন্তু এই মানুষটি আমাকে একদিন বেঁচে থাকার প্রেরণা জুগিয়েছিল। আমার একটি বড় দুঃখের অতীত আছে- যে অতীতকে ভুলে থাকার জন্য আমি, আমাদের পরিবার আজ এরকম একটা অখ্যাত স্টেশনে জীবন অতিবাহিত করছি…'

' তুমি যদি কিছু মনে না কর- এই বিষয়ে আমাকে কিছু বলবে কি?'

' এটা শোনার পরে তুমি আমাকে কীভাবে নেবে জানিনা' অঞ্জনা বলতে আরম্ভ করলঃ১৯৬০ সনের ঘটনা। আমি তখন খুবই ছোট। হঠাৎ রাজ্য ভাষা নিয়ে হাঙ্গামা শুরু হল। বাবা তখন তিনসুকিয়া স্টেশনে কাজ করে। কোয়ার্টার না পাওয়ার জন্য আমরা তখন ভাড়া ঘরে ছিলাম। বাবা ডিউটিতে। রাত আটটার সময় প্রায় আট দশটি যুবক আমাদের ঘরের ভেতর চলে এল। মা চেঁচামেচি করার সুযোগ পেল না। মুখে চাপা দিয়ে বেডরুমে নিয়ে গেল। আমাকে তিন-চারটে পশু ধরে টানাহেঁচড়া করল। ফ্রক ইত্যাদি শরীর থেকে ছিঁড়ে ফেলার আগে পর্যন্ত আবার জ্ঞান ছিল, এরপরে আমি যখন প্রথম চোখ মেললাম- তখন আমি ডিব্রুগড়ের মেডিকেল কলেজে। কতদিন মেডিকেল কলেজে ছিলাম আমার মনে নেই। মা এবং আমি দুটি বিছানায়- কিন্তু কেউ কারও দিকে তাকাতে পারিনা। ধীরে ধীরে আমার মুখের কথা বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। আমি অপলক নয়নে কেবল এক দিকে তাকিয়ে থাকি... ঠিক সেই সময়ে মেডিকেল কলেজে একটি নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্র ছিল। কেন কীভাবে জানি আমার প্রতি তার অনুকম্পা হল। ক্লাস না থাকলে আমার কাছে আসে। কথা বলানোর জন্য, হাসানোর জন্য চেষ্টা করে। কখনও কখনও হাতে করে টফি ইত্যাদি নিয়ে আসে.. পরে আমাকে বলেছিল, ক্লাসে নাকি কোনো একজন স্যার আমার কেসটা উল্লেখ করে বলেছিল কীভাবে সাংঘাতিক মানসিক আঘাত পেলে মানুষ চিরদিনের জন্য বোবা হয়ে যেতে পারে। সেদিন সে তার রুম মেটের সঙ্গে জেদ ধরেছিল । একদিন না একদিন আমার মুখে কথা এবং হাসি ফিরিয়ে আনবে... সেই জেদের জন্য অনবরত আমার সঙ্গে লেগেছিল। এভাবে কতদিন পার হয়ে গিয়েছিল আমি জানিনা। যখন সবাই আশা ছেড়ে দিয়েছিল, তখন ও সে লেগেছিল। অবশেষে সে জয়ী হল। ধীরে ধীরে আমি স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেলাম। ইতিমধ্যে বাবা এরকম একটি মানসিক আঘাত ভুলে থাকার জন্য এই ছোট স্টেশনে ট্রান্সফার নিয়েছিল। আমিও স্কুলে নাম লিখিয়ে একটি স্বাভাবিক জীবন আরম্ভ করলাম। সেই ছেলেটির বাড়ি গোলাঘাটে ছিল। বন্ধের সময় আমাদের বাড়িতে আসত। বাবা-মার কাছে সে একেবারে দেবদূত স্বরূপ ছিল। আমার সঙ্গে বয়সের কিছু ব্যবধান থাকলেও আমরা মানসিকভাবে বড় কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। তখনই সে 'পোস্ট গ্রাজুয়েট' করার জন্য দিল্লির 'এইমস'এ চলে গেল। দিল্লিতে সে জীবনের এক নতুন আদর্শের স্বপ্ন দেখল। তারশেষ চিঠিতে আমাকে লিখেছিলঃ' জীবনে একদিন আমার আদর্শ ছিল- বড় হলে ডাক্তার হয়ে গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করব, মানব সেবা করব কিন্তু প্রশ্ন হল আমার মতো একজনের পক্ষে কত রোগীকে আরোগ্য করা সম্ভব...।

' আমাদের দেশটাই একটা বিরাট ঘা হয়ে পেকে গেছে। চারপাশের রক্ত আর পুঁজ- একে ধুয়ে-মুছে সুস্থ করে তুলতে হলে সমগ্র দেশের ঘাটুকু প্রথমে কেটে বাদ দিতে হবে । সময় অপেক্ষা করে থাকে না । আমি এই সময়ের আহ্বান অস্বীকার করতে পারলাম না …'

অঞ্জনা কথা বলতে বলতে কিছু সময় অপেক্ষা করল। পবিত্র অত্যন্ত উৎকণ্ঠারসঙ্গে জিজ্ঞেস করলঃ তারপরে ?

'আমি শেষবারের মতো দেখা করার সময় জীবনানন্দের এই কবিতার বইটি উপহার দিয়েছিল। সেদিন থেকে সেই চিঠিটির পরে আর কোনো চিঠি পাইনি। অনেক দিন থেকে আমি অপেক্ষা করছি।‌ সে একদিন ফিরে আসবে। আমি জানি সে আসবে না, পুলিশের সঙ্গে একটি সংঘর্ষে তার মৃত্যু হয়েছে । সে খবর তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমাকে পাঠিয়েছিল। সে কথা আমি মা-বাবার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছি। আমি নিজে এখনও এই সত্যটিকে মেনে নিতে পারিনি ।'

কথা বলতে বলতে হঠাৎ অঞ্জনা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

'ছিঃ কাঁদেনা অঞ্জনা' পবিত্র বলল, এই গাছটার নিচে একটু বসতো…'

পবিত্র সাইকেলটা রেখে জোর করে অঞ্জনাকে একটা গাছের নিচে বসালো। চারপাশে নির্জন নীরবতা।

' আমাকে ক্ষমা করবে অঞ্জনা' পবিত্র বলল, আমি তোমার মনে দুঃখ দিয়েছি, আমাকে ক্ষমা কর…'

' না, তুমি আমার একটা বড় উপকার করেছ, অঞ্জনা বলল,' আমার শৈশবের সেই ঘটনাটির পর থেকে আমি কোনোদিন কাঁদতে পারছিলাম না। এমনকি তার মৃত্যুর খবরটা বহন করে আনা চিঠিটাও আমাকে কাঁদাতে পারে নি... আমাকে একটু কাঁদতে দাও…'

অঞ্জনা একটি ছোট মেয়ের মতো ফোঁপাতে ফোঁপাতে পবিত্রের বুকের মধ্যে ঢুকে পড়ল। পবিত্র ও একটি ছোট মেয়েকে আদর করারমতো অঞ্জনাকে জড়িয়ে ধরল ।

' উঠ অঞ্জনা, অনেক দেরি হয়েছে' পবিত্র বলল, তাছাড়া কেউ এসে আমাদের হঠাৎ এভাবে দেখলে কী ভাববে?'

' আমাকে ক্ষমা কর' অঞ্জনা চট করে উঠে বসে বলল,' আমি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। চল, তোমাদের মিটিংয়ের নিশ্চয় দেরি হয়ে গেছে…'

' মিটিং এর জন্য নয়' পবিত্র বলল,' তোমাকে এত কাছে পেয়ে, তোমার দুঃখের মধ্যে নিজেকে বিলীন করে আমি যেন এক নতুন শক্তি পেয়েছি, এক নতুন স্বপ্ন দেখছি…'

' এসব কথা বাদ দাও' অঞ্জনা বলল, তুমি আমাকে সাইকেলে উঠাবে বলেছিলে না, জঙ্গল শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুমি আমাকে আগে বসিয়ে নাও।'

অঞ্জনা পবিত্রের সাইকেলের সামনের রডটিতে লাফ দিয়ে উঠল এবং কিছুটা হাসার চেষ্টা করে বলল, কীরকম লাগছে, ঠিক হিন্দি সিনেমার নায়িকার মতো?'

পবিত্র পরিবেশটাকে পাতলা করে প্যাডেল মারতে শুরু করে বলল, সিনেমার নায়িকার মতো একটি গানই গাও তাহলে।'

' গান আমি গাইতে পারি না, তবু আজ তোমাকে আমার প্রিয় কবির একটি কবিতা শোনাই। শুনবে?

'কে, জীবনানন্দ?'

' না, নবকান্ত বরুয়ার। দুই একদিন আগে একটি মাগাজিনে পড়েছি….'

' ওদের প্রেমের মুখগুলি ঘৃণায় বিকৃত হতে দেবে না

অনুবাদ করাগালিতে ওদের প্রেমিক কণ্ঠস্বর

রুদ্ধ করে তোলনা

হে রাজনৈতিক মালীরা।

ওদের গোটা রক্তের সার না দিলেও

গোলাপ ফুটবে।।*

কবিতাটি আমার সম্পূর্ণ মনে নেই। কিন্তু এটাই যেন আজ তোমার মিটিংয়ে আমি চিৎকার করে করে বলব- ঠিক তেমনই মনে হচ্ছে।

পবিত্র কোনো উত্তর দিল না।

সে একবার পেছনে একবার সামনে তাকাল। সাপের মতো পড়ে থাকা একটি দীর্ঘ রাস্তা। রাস্তা দুটোর মাথা সে কিছুতেই আন্দাজ করতে পারল না। বুকের মধ্যে অনুভব করল অঞ্জনার শরীরের উত্তাপ এবং কানের মধ্যে বাজতে থাকল সাইকেলের কর্কশ শব্দ।



* ভাষা জননীর চলিলকিঃ নবকান্ত বরুয়া



সমাপ্ত