শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

কথাগুলো বলা হলো না,পর্ব -৪

"একদিন সে এসে পড়েছিল এই ভুল মানুষের অরণ্যে কিন্তু জরা জটিল অরণ্যে তার ঠাঁই হলো না, ঠাঁই হলো না তার ভালবাসার আকাশেও, তাই সে নেমে পড়লো মাঝপথের অজস্র শূন্যের মাঝখানে, নিঃসীম নিঃসঙ্গ শূন্যে সে কেঁপে কেঁপে উঠল তার হৃদয় নিয়ে, বাদুড়ের মত রাত্রি তাকে ঘিরে নিঃশব্দে দুলতে থাকল… আর রাতের অন্ধকার চিরে বাতাসে ভেসে এলো অরণ্যের মুঢ় গর্জন, তাকে ঢেকে দাও ... তাকে ঢেকে দাও বলে চীৎকার ভেসে গেলো অরণ্যের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে, খসে পড়া নক্ষত্রের মত আকাশ থেকে পড়তে পড়তে সে এক সময় বিঁধে গেলো বুকের ঠিক মাঝখানটায়, তাকে চোখ দাও ... তাকে চোখ দাও বলতে বলতে সীমানা হীন ভয়ে সে তার চোখ ঢাকল দু হাত দিয়ে ... তুমি, যে তুমি অপমান আর বর্জনের নিত্য পাওয়া নিয়ে তবু আমায় মুঠোয় করে ধরে রেখেছিলে সেই তুমি আজ আমার অন্ধ দু চোখ খুলে দাও, আমি যেন সইতে পারি পৃথুলা এই পৃথিবীকে ..."

কুশল!

বিছানা ছেড়ে উঠে বসি, কে যেন ডাকছে আমায়, আধো অন্ধকারে এদিক ওদিক তাকাই, না, কোথাও তো কেউ নেই, চার দেওয়াল, ছাদ আর ঘরের কিছু আসবাবের মাঝে আমি তো একাই, ডাকটা কিন্তু আবার ফিরে এলো, এই যে কুশল, আমি এখানে, তোমার ডানদিকে তাকাও।

অদৃশ্য মানুষকে উদ্দেশ্য করে এবার আমি বলে উঠলাম, কে তুমি, কেন ডাকছ আমায়, কী চাই, আর আমি তোমায় দেখতে পাচ্ছি না কেন, আর ইউ ইনিভিজিবল, তুমি কি অদৃশ্য কেউ?

ইনভিজিবল! হো হো করে হেসে ওঠে যেন সেই অদৃশ্য মানুষ, ওয়েল সেইড কুশল! সত্যিই আমি এক অদৃশ্য মানব যাকে তুমি ছাড়া আর কেউ দেখতে পাও না, অন্যদের কাছে আমি তো অস্তিত্বহীন এক অবয়ব মাত্র।

কিন্তু আমিও তো তোমায় দেখতে পাচ্ছি না, সত্যি করে বলো তো তুমি কে?

আরে বাবা এত উতলা হচ্ছ কেন, এক কাজ করো, তোমার ঘরে যে আয়নাটা আছে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াও এন্ড লুক এট দ্য মিরর।

আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কী হবে! সেখানে তো আমার ছায়াই ফুটে উঠবে!

ইয়েস, ইউ আর রাইট, আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে মানুষের নিজের ছায়াই ফুটে ওঠে আর আমি হচ্ছি গিয়ে তোমার সেই ছায়া, আন এডিটেড, আন সেনসরড ট্রু এন্ড রিয়েল ইমেজ, কোনও মেকআপ নেই... কোনও মেক ওভার নেই ... অরিজিনাল, একদম অরিজিনাল প্রতিচ্ছবি।

ঠিক আছে, তা না হয় বুঝলাম কিন্তু একটা কথা বলো তো, হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট ফ্রম মি?

নাথিং, ইনফ্যাক্ট তোমার আমার মধ্যে চাওয়া-পাওয়ার কোনও সম্পর্কই গড়ে উঠতে পারে না, আমরা দুজনা হচ্ছি গিয়ে পরস্পরের পরিপূরক যাকে বলে কি না ছায়া আর কায়া, আমি শুধু তোমায় এটা মনে করিয়ে দিতে এলাম যে এতক্ষণ ধরে তুমি যা ভাবছিলে সেটা কিন্তু একটা অলীক কল্পনা মাত্র।

আমি এতক্ষণ ধরে ভাবছিলাম! আর ইউ শিওর, আমি সত্যিই কিছু ভাবছিলাম?

ইয়েস, তুমি ভাবছিলে, ইনফ্যাক্ট ইউ ওয়ার গোয়িং থ্রু এ ডিপ থট, কিন্তু একটা কথা বলো তো আজকাল তুমি এরকম ভুলোমন হয়ে যাচ্ছ কেন, এবার কিন্তু সিরিয়াসলি আমার মনে হচ্ছে যে তোমার বয়স হচ্ছে, ইউ আর গ্রোয়িং ওল্ড।

বয়স তো হচ্ছেই, ইনফ্যাক্ট এই পৃথিবীতে আমাদের সবারই একটু একটু করে বয়স হয় বা হচ্ছে, ইটস আ ন্যাচারাল এন্ড ইনএভিটেবল প্রসেস, এতে এত অবাক হওয়ার কী আছে, যাক গে ছাড়ো এসব কথা, এখন বলো আমি কী ভাবছিলাম ?

তুমি ভাবছিলে যদি এই জীবনটা আবার নতুন করে শুরু করা যায় তাহলে ফেলে আসা জীবনের কোন কোন জায়গাগুলি তুমি অ্যামেন্ড করবে।

ইয়েস! ইউ আর অ্যাবসোলিউটলি রাইট, আই ওয়াজ রিয়েলি থিঙ্কিং ইট ... কিন্তু একটা কথা বলো তো, তুমি কি ইচ্ছে করলেই যে কোনও মানুষের মনের মধ্যে ঢুকে তার ভাবনার কথা জেনে যেতে পারো?

না, আমি সবার মনের মধ্যে ঢুকতে পারি না, আমি শুধু তোমার মনের মধ্যেই ঢুকতে পারি, ঐ যে বললাম না আমি হচ্ছি গিয়ে তোমার পরছাঁইয়া, তাই তোমার সব কিছুতেই আমার অ্যাকসেসিবিলিটি বা প্রবেশ অধিকার আছে, যাইহোক যা বলছিলাম, আমাদের এই জীবনটা কিন্তু আসলে জলের মত, নিজের মত করে বইতে দিলে জীবন এবং জল শুধু এক দিকেই বয়, তবে জলের ক্ষেত্রে এই প্রবাহটা হচ্ছে ওপর থেকে নীচ আর জীবনের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে জন্ম থেকে মৃত্যু, এর কোনও রিভারস ফ্লো হয় না!

দাঁড়াও, দাঁড়াও, তুমি ঠিক কী বলতে চাইছ একটু বুঝিয়ে বলো তো।

আমি বলতে চাইছি জীবনের ফেলে আসা দিনগুলি কখনই কিন্তু আর ফেরত আসবে না, হিস্ট্রি ওয়ান্স ক্রিয়েটেড রিমেইনস অ্যাজ হিস্ট্রি অলওয়েজ, তার চেয়ে বরঞ্চ এক কাজ করো, সময়ের অবসরে মনের সিঁড়ি ধরে হাঁটতে শুরু করো, দেখবে স্মৃতি কিন্তু সব সময় শুধুই দুঃখ দেয় না।

রাইট, ইউ আর অ্যাবসোলিউটলি রাইট। জানো, আজকাল মাঝে মাঝেই আমি জীবনের ফেলে আসা স্মৃতিতে হারিয়ে যাই, আই সি দেয়র আর সো মেনি কার্ভস ইন মাই লাইফ, সো মেনি, স্টারটেড উইথ দ্য ডে হোয়েন উই শিফটেড ফ্রম বোড়াল টু টালিগঞ্জ...

হ্যাঁ, বোড়াল থেকে তোমরা টালিগঞ্জে শিফট হলে কারণ তোমাদের বোড়ালের বাড়ি থেকে তোমার মায়ের গানের স্কুলটা অনেক দূর হয়ে যাচ্ছিল।

নো নো, দ্যট ওয়াজ নট দ্য ওনলি রিজন, বোড়ালের বাড়ি থেকে বাবার অফিস যাতায়াতেও বেশ ধকল হচ্ছিল আর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবা রোজকারের সেই ধকলটা আর নিতে পারছিল না।

আর তার সাথে সাথে তোমার পড়াশুনা নিয়েও তোমার বাবার মনে দিন-দিন চিন্তা বাড়ছিল, যাই বলো, তোমাদের সেই হরি মাধব বিদ্যামন্দিরের পড়াশুনার স্টার্ন্ডাটটা কিন্তু মোটেও ভালো ছিল না, তাই টালিগঞ্জের কাছে পঞ্চানন তলায় বাড়ি বিক্রির খবর আছে জানতে পেরে তোমার বাবা বোড়ালের বাড়িটা বিক্রি করে আর প্রফিডেন্ডফান্ড থেকে লোন নিয়ে নতুন বাড়িটা কিনেই ফেললেন। কদিন ধরেই ভোর রাতের দিকে এ এক নতুন তামাশা শুরু হয়েছে, রোজ এই তিনটে চারটে নাগাদ পাওয়ার চলে যায় আর ঘণ্টা খানেকের আগে ফেরার নাম নেয় না। বিছানায় শুয়ে ঘামে জবজব হওয়ার কোনও মানে নেই, উর্মিকে টপকে বিছানা থেকে নেমে আসি, অন্ধকারে খাটের পাশে রাখা টেবিলের মাথা থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাইটা হাতড়াতে থাকি।



মনের মধ্যে একটা খুঁতখুঁতানি ছিলই, শুভঙ্করের অফিসে গিয়ে ওর কাছে উদয়পুরের প্রজেক্টটার ব্যাপারে জানতে চাইলে ছেলেটা অহেতুক নিজের ভাও বাড়ানোর সুযোগ পেয়ে যাবে, কিন্তু ভাগ্যটা ভালই বলতে হবে, লর্ডসের মোড়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ক্যামাকস্ট্রীটে পৌঁছে দেখি ইন্ডাস্ট্রি হাউসের ঠিক নিচেই শুভঙ্কর কারোর সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। অন্যদিক করে মুখ ফিরিয়ে রাস্তাটা পার হয়ে ঠিক ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াই, ভাবখানা এমন, কোনও কাজে এদিকে এসেছিলাম আর হঠাৎ করেই শুভঙ্করের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো।

আরে কুশলদা, আমাকে হঠাৎ করে ওর সামনে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে শুভঙ্কর বাস্তবিকই অবাক ।

আমিও শুভঙ্করকে দেখে চমকে ওঠার ভাণ করি, আরে শুভঙ্কর! হোয়াট এ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ!

ততক্ষণে ও আমার হাতদুটো ধরে ফেলেছে, কেমন আছ দাদা, কতদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা হলো, আফটার এ লং লং ইন্টারভেল, আচ্ছা, তুমি কি এখনো আগের ঐ কোম্পানিতেই আছ নাকি চেঞ্জ করেছ ?

নিজের কুশল বার্তা জানিয়ে ওকে জানালাম যে আমি এখনো পুরনো কোম্পানিতেই আছি, এরপর নিখুঁত অভিনয় করে ওর কাছে জানতে চাইলাম যে ও এখন কোথায় আছে, ওর অফিস কি ক্যামাকস্ট্রীটেই ? জানা কথাগুলিই আবার ওর মুখ থেকে শুনলাম, কথাগুলি বলতে বলতে ও বললো, দাদা, এই বিল্ডিংয়েরই সাততলাতে আমাদের অফিস, চলো না অফিসে গিয়ে কফি খেতে খেতে একটু আড্ডা মারা যাবে।

মনে মনে নিজেকে বললাম, গুড কুশল, শুরুটা কিন্তু ভালোই হয়েছে।

আচ্ছা শুভঙ্কর তোমাদের কোম্পানিটা কী ধরনের কাজ করে? কফি খেতে খেতে চলছে আমাদের আড্ডা।

অ্যাকচুয়ালি আমরা টার্ণকি কনট্রাকটরের কাজ করি এবং আমাদের কাজগুলি হয় মেইনলি পাওয়ার সেক্টরে … শুভঙ্কর ওর কোম্পানির ব্যাপারে বলে যাচ্ছে আর আমিও ওর মুখের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে আছি, সত্যিই যেন আমি ওদের কোম্পানির ব্যাপারে কিছু জানি না, কথায় কথায় নিজেই ও উদয়পুরের প্রজেক্টটার কথা তুললো , কুশলদা শোনো না, রিসেন্টলি আমরা একটা সোলার প্লান্টের কাজ পেয়েছি আর ঐ প্রজেক্টটায় আমাদের যে কোর গ্রুপ তৈরি হয়েছে সেখানে আমি মেকানিক্যাল টিমটা রিপ্রেজেন্ট করছি , ইনফ্যাক্ট, তোমাদের কোম্পানি যেসব জিনিসপত্র বানায় তা কিন্তু আমাদের প্রচুর পরিমাণে এই প্রজেক্টে কিনতে হবে, তুমি বরঞ্চ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের এখানে তোমাদের কোম্পানির একটা প্রডাক্ট প্রেজেন্টেশনের ব্যবস্থা করো, একটানা কথাগুলি বলে শুভঙ্কর একটু থামে।

সাড়ে চারটে নাগাদ শুভঙ্করদের অফিস থেকে বেরিয়ে আসি, এখন আমার কাছে উদয়পুরের প্রজেক্টটার অনেক খবর, একটা সিগারেট ধরিয়ে ভাবছি এর মধ্যে কতখানি মিত্রের সঙ্গে শেয়ার করব, আসলে খবরগুলি পেলেই উনি সঙ্গে-সঙ্গে তা এমন ভাবে সায়গলকে জানাবেন যে জুতোর শুকতাল খুইয়ে উনিই এই ইনফরমেশনগুলো জোগাড় করেছেন। না, মিত্রকে ফালতু মাইলেজ দিয়ে আমার কোনও লাভ নেই, তার চাইতে খবরগুলো থ্রটেল করেই দেব।

ইউ হ্যভ এ নিউ মেসেজ, হাতে ধরা মোবাইলে এস এম এস আসার টোন, শুভ্রার মেসেজ, কী করছেন ?



আচ্ছা কুশলদা উপপাদ্য শিখে সাধারণ মানুষের কী লাভ হয় বলুন তো!

শুভ্রা হচ্ছে গিয়ে আমার বন্ধু তপনের কাজিন সিস্টার, তখন ওর ক্লাস টেন আর আমার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সেকেন্ড ইয়ার , পাড়ায় ততদিনে পিওর সায়েন্সের টিচার হিসেবে আমার একটু আধটু নামডাক হয়েছে , একদিন আড্ডায় এসে তপন বললো যে রানিকুঠিতে ওর যে পিসি থাকেন তাদের মেয়ে এবার ক্লাস টেনে উঠেছে, অ্যাসেম্বলি অফ গড চার্চে পড়ে, ওর পিসি নাকি মেয়ের জন্য একজন সায়েন্সের প্রাইভেট টিউটর খুঁজছেন, তপন জিজ্ঞাসা করলো আমি পড়াবো কি না ?

রানিকুঠি তো অনেক দূর হয়ে যাবে রে!

ধুর, দূর আর কোথায়, সাইকেলে যাবি-আসবি, দেখবি পনের মিনিটও লাগছে না, তপনের সঙ্গে পরের শনিবার ওর পিসির বাড়িতে গিয়ে টিউশনের ব্যাপারে পাকা কথা বলে এলাম । শুভ্রাকে পড়ানোর সময় মাঝেমাঝেই ও এরকম অদ্ভুত অদ্ভুত সব প্রশ্ন করে আর প্রশ্নগুলো শুনে আমি নিজেকে খুব গম্ভীর করে ফেলি, এই তোমায় না কতদিন বলেছি যে পড়াশুনার সময় একদম ফালতু কথা বলবে না।

উত্তর দেবেন না, সেটা আলাদা কথা, কিন্তু তা বলে আমার প্রশ্নগুলো কিন্তু মোটেই ফালতু নয় ।

তপনের পিসেমশায় আর পিসিমা দুজনাই খুব খুশী, মাধ্যমিকে মেয়ে অঙ্কে আটানব্বই আর ফিজিক্যাল সায়েন্সে পঁচানব্বই পেয়েছে, সুতরাং শুভ্রাকে পড়ানোর মেয়াদ আমার আরও দু বছরের জন্য বৃদ্ধি পেলো।

প্রশ্নগুলো শুনে ভাববার জন্য কিন্তু একটুকুও সময় পাবেন না, চটকরে মাথায় যা আসবে তাই উত্তর দেবেন । আজ মেয়েটা কিছুতেই পড়তে চাইছে না, যতবারই বলছি পড়ায় মন দাও ততবারই উলটোপালটা কিছু না কিছু নিয়ে বকবক শুরু করে দিচ্ছে, আরে বাবা রোজই তো পড়ি, একদিন না পড়লে মহাভারত এমন কিছু অশুদ্ধ হয়ে যাবে না, তার চেয়ে আসুন আজ র‍্যাপিড ফায়ারিং খেলি, বলুন আলো না অন্ধকার?

জানি না।

ওকে, নেক্সট কোয়েশ্চেন, পথ না পথ হারানো?

তুমি পড়বে নাহলে আমি কিন্তু চললাম।

যাবেন তো বটেই কিন্তু যাওয়ার আগে খেলাটা তো শেষ করে যান, জানেন, র‍্যাপিড ফায়ারিংয়ে একটা মানুষকে কিন্তু খুব সহজেই তার অজান্তে চিনে ফেলা যায়, বলুন, পাওয়া না হারানো? মেয়েটা যেন দিন-দিন কেমন বদলে যাচ্ছে, আগে আমায় একটু আধটু ভয় পেত , এখন সত্যি কথা বলতে কী শুভ্রাকে আমি যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, এক-একদিন পড়ানোর সময় একটাও কথা বলে না, মাথা নিচু করে অংক করে যায়, আবার এক-একদিন ওর মাথায় যে কি হয় কে জানে, কিছুতেই পড়তে চায় না, সমানে উলটো পালটা বকতে থাকে, ভীষণ আন-প্রেডিকটেবল মেয়ে, দুম করে এমন এক একটা কথা বলে যে তার মাথামুণ্ডু আমি কিছু বুঝে উঠতে পারি না, তবু শুভ্রাকে পড়াতে আমার ভালো লাগে, নিঃসন্দেহে ও-ই আমার বেস্ট স্টুডেন্ট।

ওর করা র‍্যাপিড ফায়ারিংয়ের একটাও প্রশ্নের উত্তর দিতে না দেখে শুভ্রা এক সময় বিরক্তই হয়ে উঠলো, ধুর মশাই, আপনি কিচ্ছু জানেন না, ছোটবেলা থেকে শুধু যোগবিয়োগই শিখেছেন।

না, মেয়েটা আজ আর পড়বে না, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াই , ঘর ছেড়ে বেরনোর জন্য দরজার ভেজানো পাল্লায় হাত রাখি, শুভ্রা চট করে খাট থেকে নেমে পড়ে , এক মিনিট, একটাও প্রশ্নের উত্তর তো দিলেন না, অন্তত শেষ প্রশ্নটার উত্তর দিয়ে যান ।



ঠাকুমা, আজ কিন্তু তোমায় খুব সুন্দর দেখাচ্ছ, যাকে বলে কী না একদম মাঞ্জা দেওয়া!

ধুর মাঞ্জা আবার কোথায় দিলাম!

কেন এই যে নতুন শাড়ি পরেছ, তারপর চুলে তেল লাগিয়ে সুন্দর করে খোঁপা বেঁধেছে এগুলিকে কি মাঞ্জা দেওয়া নয়?

আরে বাবা শাড়িটা নতুন না রে, এটা তোর বাবা গত বছরের আগের বছর পূজোয় কিনে দিয়েছিল ।

ঠিক আছে শাড়িটা নয় নতুন নয়, কিন্তু এই যে এত সুন্দর করে খোঁপা বেধেছ, এটাকেও কি মাঞ্জা দেওয়া বলে না!

এত বড় একটা অনুষ্ঠান, সেখানে কত গণ্যিমান্যি মানুষ আসবেন আর আমি কি ওখানে পাগলের মত চুল খুলে যাব!

আজ টালিগঞ্জ ট্রামডিপোর কাছে সংগীত একাডেমী বলে গানের যে ইন্সটিটিউশনটা আছে সেখানে রাগ সংগীতের একটা বিশেষ অনুষ্ঠান আছে, অনুষ্ঠানের আয়োজকরা পণ্ডিত দাদুর বিশেষ পরিচিত, তাই দাদুকে ওনারা আজকের সভায় উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করেছেন, আর শুধু উপস্থিত থাকাই নয়, দাদুকে বলেছেন উনি যেন ওনার দুই শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থীকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন, উদীয়মান শিল্পী হিসেবে তাদের আজ গান গাইবার সুযোগ দেওয়া হবে। বাবা হাফ ছুটি নিয়ে তিনটের সময় বাড়ি চলে এসেছে, সবাই আমরা এখন রেডি, মায়ের শাড়ি পরা হলেই রওনা দেব , মা অবশ্য প্রথমে কিছুতেই গাইতে রাজী হচ্ছিল না, পন্ডিতদাদুকে বারবার বলছিল, না, না মাস্টারমশাই, আপনি আমায় বাদ দিন, হল ভর্তি দর্শকের সামনে গান গাইতে গিয়ে কোথায় কী ভুল করে ফেলব, তার চেয়ে বরঞ্চ আপনি অন্য কাউকে নিয়ে যান ।

শেষ অবধি অলোককাকু আর ঠাকুমাই মাকে রাজী করায়। শোনো বৌদি , একটা কথা কেন বুঝতে পারছ না, সময়ের সাথে সাথে কাকু এখন আমাদের ঘরেরই একজন হয়ে উঠেছেন, বাবা আর মাকে উনি এখন তুমি করেই কথা বলেন, মা-বাবাও কাকুকে নাম ধরে ডাকে, শুধু আমাদের মত দু-চারজনকে গান গেয়ে শোনাবে বলেই কি তুমি দিনের পর দিন এই রেওয়াজ করে যাচ্ছ?

অলোক, কথাটা সেটা নয়...

কথাটা কী সেটাই তো আমরা জানতে চাইছি।

আপনারা কেন বুঝতে চাইছেন না, এত বড় একটা অনুষ্ঠান, সেখানে নিশ্চয়ই সঙ্গীত জগতের অনেক বড় বড় মানুষ আসবেন আর সবার সামনে গান গাইতে গিয়ে আমি যদি কোনো ভুল করে ফেলি তাহলে শেষ পর্যন্ত কার সম্মানটা নষ্ট হবে, এটা ভেবে দেখেছেন?

বৌদি, তুমি না বড় অদ্ভুত! মাঝে মাঝে আমার কী মনে হয় জানো, বুদ্ধিশুদ্ধি বলে কোনও বস্তুই ভগবান তোমার মাথায় দেয়নি, একটা কথা বলো তো, তোমার কি মনে হয়, নিজের মান সম্মানের ব্যাপারে গুরুজির নিজের কোনও চিন্তা নেই, আরে বাবা তোমাকে আর জুবেনকে উনি যোগ্য বলে মনে করেছেন বলেই আজকের অনুষ্ঠানে তোমাদেরকে উনি সিলেক্ট করেছেন। কাকুর এফোর্ট তো ছিলই, শেষমেশ ঠাকুমাও যখন বারবার করে মাকে আজকের এই অনুষ্ঠানে গান গাইতে বললো তখন মা আর রাজী না হয়ে পারলো না।

করুণাময়ী থেকে রিকশ নিয়ে সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ আমরা সংগীত একাডেমির গটে এসে পৌঁছই, জুবেন আঙ্কলের সঙ্গে রিসেপশনেই দেখা হয়ে গেল, কাকুর সঙ্গে আমার আগেই আলাপ ছিল, ঠাকুমা আর বাবার সঙ্গে কাকুর পরিচয় করিয়ে দিলো মা, কাকু এমনিতেই খুব সুন্দর দেখতে, প্রায় ছ ফুটের মত লম্বা, মানানসই চেহারা, মুখে আবার সব সময় একটা হালকা চাপ দাড়ি রাখেন যেটা ওনার চেহারা বা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে দারুণ ম্যাচ করে যায়, আজ জুবেন আঙ্কলের পরনে শ্যাওলা রঙের পাঞ্জাবী আর সাদা চোস্ত, পাঞ্জাবীর কালারটা ওনার গায়ের রঙের সঙ্গে দারুণ ম্যাচ করে গিয়েছে, মাকেও আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে, মেরুন পার সাদা সিল্কের শাড়ি, খোঁপায় বেলফুলের মালা, কপালে তেকোনা টিপ, হাতে-গলায় পোড়া মাটির গয়না , পরশু মাকে আর আমাকে গড়িয়া হাটে নিয়ে গিয়ে অলোক কাকু এই গয়নাগুলি কিনে দিয়েছেন , মা বাড়ন করছিল , কাকু কিন্তু শুনলেন না , বুঝলে বৌদি , একটা কথা সব সময় মনে রাখবে, এই দুনিয়ায় পহলে কিন্তু দর্শনদারী হতে হয়, নইলে অনেক সময় কিন্তু গুনের সঠিক বিচার হয় না।

কতক্ষণ এসেছ, বাবা আর ঠাকুমার সঙ্গে আলাপ পর্ব শেষ হলে জুবেন আঙ্কলকে উদ্দেশ্য করে মা কথাটা জিজ্ঞাসা করল।

এই তো দিদি, মিনিট দশেকের মত হবে।

মাস্টারমশাই এসেছেন?

না আসেননি, তবে এখুনি এসে পড়বেন।



হলঘরের সামনের দিকের কিছুটা জায়গা খালি রেখে বাকি অংশে প্রায় দুশোর মত চেয়ার পাতা , চেয়ারগুলির ফাঁক দিয়ে ইংরেজি টি অক্ষরের মত আলপথ চলে গিয়েছে, আলপথগুলির প্রান্ত গিয়ে শেষ হয়েছে এনট্রান্স বা একজিট লেখা দরজাগুলিতে , মোলায়েম নীল আলোয় হলঘরটা এখন ছেয়ে আছে, সামনের দিকে যে নিচু ডায়াসটা রয়েছে সেখানে অবশ্য দুদিক দিয়ে হ্যালোজেনের উজ্জ্বল ফোকাস, ডায়াসের পিছনে যে সাদা স্ক্রিন সেখানে সময়ের সাথে সাথে সাথে এখন বিভিন্ন মানুষের অবয়ব ভেসে উঠছে, অলোককাকু এক-এককরে আমায় চিনিয়ে দিচ্ছেন , ঐ দেখ বাবু, উনি হচ্ছেন গিয়ে পণ্ডিত রবিশঙ্কর, আর এই এখন যাঁর ছবি ভেসে উঠল ওনার নাম পণ্ডিত ভীমসেন যোশি।

হলের মাঝামাঝি একটা রোতে আমরা সবাই পাশাপাশি বসা। আমি, বাবা, ঠাকুমা আর অলোককাকু। পণ্ডিত দাদু অবশ্য গিয়ে বসেছেন সামনের ভি আই পি সিটে। ব্যাকগ্রাউন্ডে সেতারের একটা হালকা সুর বেজে চলেছে, অলোককাকু বললেন , ভালো করে শোন, দেখবি সেতারের শব্দে কত আলাদা আলাদা সুর মিশে থাকে, মূল আওয়াজটা হচ্ছে গিয়ে মা সা পা এই তিনটে সুরকে ঘিরে, কাকু জানালেন এই তিনটে সুরের জন্য সেতারের তিনটে তার নাকি নির্দিষ্ট করা থাকে, এ ছাড়াও দেখবি আরও একটা তার কিন্তু মাঝে-মাঝেই সা সা করে বেজে উঠছে, ঐ চতুর্থ তারটাকে বলে খরজের তার, আর সুরটা যখন চরমে গিয়ে রিপিটেডলি সা সা গা বলে ওঠানামা করছে তখন যে তারগুলি বাজছে তাকে বলে চিকারি, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক শেষ হলো এক সময় আর সঙ্গে সঙ্গেই পাজামা পাঞ্জাবী পরিহিত এক ভদ্রলোক স্টেজে উঠে ঘোষণা করলেন , এবার আমাদের মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে, দয়া করে আপনারা শিল্পীদের সঙ্গীত পরিবেশনের সময় নিজেদের মধ্যে কথা বলবেন না, ওনার ঘোষণা শেষ হলে শিল্পীরা এক-এককরে স্টেজে উঠতে শুরু করলেন আর তাঁদের গান শেষ হলে হল ভর্তি দর্শক তালি বাজিয়ে তাদেরকে উৎসাহিত করতে লাগলেন , মনে মনে আমি এখন সরস্বতী ঠাকুরকে ডেকে যাচ্ছি, ঠাকুর তুমি কিন্তু আজ আবার মায়ের গলার ভিতরে ঢুকে যেও, মা যেন আজ আবার হলঘরের সমস্ত দর্শককে গান শুনিয়ে একদম চুপ করিয়ে দিতে পারে ।

মা নয়, জুবেন আঙ্কলই প্রথমে স্টেজে উঠলেন, স র গ ঘ প ধ ন স্বরগুলিতে সামান্য পরিবর্তন করতে করতে কাকু যখন আলাপ শুরু করলো অলোককাকু আমায় ফিসফিসিয়ে বললেন, মল্লার ধরছে জুবেন, জানিস তো তানসেন, বৈজু বাঁওরা এঁনারা নাকি এই সুরে গান গেয়ে বৃষ্টি নামিয়ে দিতেন, কাকু যখন কথাগুলো বলছিলেন ততক্ষণে জুবেনকাকু প্রাথমিক আলাপ সেরে ধরে ফেললেন

গরজত বরসত শাওন আয়ো রে/ গরজত বরসত শাওন আয়ো রে/ পল পল চিন চিন পওন ঝাঁকরে / পল পল চিন চিন পওন ঝাঁকরে/ পল পল চিন চিন পওন ঝাঁকরে / লাগে তন পর তীর সমান – তীর সমান / সখী লাগে তন পর তীর সমান / গরজত বরসত শাওন আয়ো রে ......... মায়ের মতই কাকুও চোখ বন্ধ করে গান করেন নইলে ঠিক দেখতে পেতেন যে এই মুহূর্তে হলের সমস্ত দর্শক নির্বাক হয়ে ওনার মুখের দিকে চেয়ে রয়েছেন, পন্ডিতদাদু স্টেজের ওপরে কাকুর পাশে বসা এখন, এত দূর থেকেও আমি যেন দেখতে পাচ্ছি দাদুর দুচোখে এখন মল্লারের সুরে ভেসে আসা বৃষ্টির ফোঁটা । অফুরন্ত হাততালির মাঝে কাকু এক সময় স্টেজ থেকে নেমে এলে ঘোষক মশাই স্টেজে উঠে ঘোষণা করলেন , মঞ্চে এবার আমরা ডেকে নিচ্ছি পন্ডিতজির অপর স্টুডেন্ট শ্রীমতী কাজল করকে, ভদ্রলোকের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকের মধ্যে কেউ যেন গুড়গুড় করে দামামা বাজিয়ে দিলো, কী ভীষণ লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা আমার, পারবে তো মা জুবেনকাকুর মত সবাইকে একেবারে নির্বাক করে দিতে?

কড়ি মা হচ্ছে গিয়ে ইমনের একমাত্র অশুদ্ধ স্বর, তবু কী জানিস বাবু এই স্বরই কিন্তু ইমনকে দেয় তার ধ্যানী রূপের প্রকাশ, অলোককাকু আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে চুপিচুপি কথাগুলো বলে যাচ্ছেন , ধুর, আমি অত কিছু বুঝি নাকি, আমি তো এখন এক দৃষ্টিতে মঞ্চের ওপর বসে থাকা আমার মায়ের দিকে চেয়ে রয়েছি, এক একটা সুরে মা যেন গোটা হলঘরটায় এখন বিষাদের ছায়া এঁকে দিচ্ছে আর সেই ছায়ায় হল ভর্তি লোক যেন নির্বাক হয়ে চেয়ে রয়েছে মঞ্চের দিকে, আজ হাম আপনি দুঁয়া কা আসার দেখেঙ্গে ... তির – এ – নজর দেখেঙ্গে, জখম – এ – জিগর দেখেঙ্গে ... সাদা শাড়ি পরা মাকে দেখে এখন আর আমার সরস্বতী ঠাকুর বলে মনে হচ্ছে না, বরঞ্চ মনে হচ্ছে আমাদের ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে সেই আশ্রম কন্যা আজ নেমে এসেছে এই মঞ্চের ওপর আর তার কোলে পড়ে থাকা ফুলের রাশি থেকে এক-এক করে ফুল তুলে নিয়ে সুরের মালা গেঁথে চলেছে , আজ হাম আপনি দুঁয়া কা আসার দেখেঙ্গে ... তীর – এ – নজর দেখেঙ্গে, জখম – এ – জিগর দেখেঙ্গে ... সঞ্চালকের নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে হলের ভিতরে চাপা ফিসফাস এখন, আমাদের সামনের সারিতে যে দম্পতি বসে আছেন দেখলাম ভদ্রমহিলা ওনার স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, কে গো ভদ্রমহিলা, আগে তো কখনো ওনার গান শুনিনি , ভদ্রলোক জবাবে বললেন, দারুণ গলা, দেখো ছোট ছোট মিড়গুলি যখন টানছেন তখন যেন মনে হচ্ছে শবনম বিবি, আমি এই শবনম বিবির কথা জানি, পণ্ডিত দাদুর ঘরের দেওয়ালে ওনার ফটোও দেখেছি, লক্ষনৌয়ের বিখ্যাত সঙ্গীত সাধিকা, মহিনুদ্দিন চাচা যিনি কিনা পন্ডিতদাদুর ওখানে মায়েদের সঙ্গে তবলা বাজান উনি এখন মায়ের ডানদিকে সমকোণে বসে তবলার বোল তুলছেন, এতদূর থেকেও আমি বুঝতে পারছি মঞ্চে মা আর চাচার একটা ছায়া যুদ্ধ চলছে যেন, কেউ কাউকে ওরা এক বিন্দু জমি ছাড়তে নারাজ, চাচার আঙ্গুলগুলি বিদ্যুতের বেগে তবলার বুকে বোল তুললো, +ধা গে তে টে / ০না ক ধি না/ ধা গে তে টে/ না ক ধি না, মাও যেন আজ ছাড়বার পাত্রী নন, রাগিণীর মূর্ছনায় চাচার তবলার বোল শেষ হলেই মা তাই গেয়ে উঠলো, সা রে গ, ম প, ধ, নি সা ... কাহারবা ছেড়ে চাচা চলে এলেন ত্রিতালে ... +ধা ধিন ধিন ধা ...ধা ধিন ধিন ধা ... ০না তিন তিন না .... তেটে ধিন ধিন ধা .... মায়ের বিনীত প্রত্যুত্তর ... সা নি ধ, প, ম, গ, রে, র্সা ... নি, রে, গ, রে, প, ম, গ, রে, সা... হলের সমস্ত দর্শকও এখন যেন দুই শিবিরে নিজেদের ভাগ করে নিয়েছেন, মন্ত্রমুগ্ধের মত তারা উপভোগ করছেন মা আর চাচার এই ছায়া-যুদ্ধ...

আপ তো আঁখ মিলাতে হুয়ে শরমাতে হ্যায়/ আপ তো দিল কে ধরকনে সে ভি ডর যাতে হ্যায়/ ফির ভি এ জিদ হ্যায় কে হাম জখম-এ-জিগর দেখেঙ্গে / তির – এ – নজর দেখেঙ্গে, জখম – এ – জিগর দেখেঙ্গে ... তেওরার বোল তুলে চাচা তবলায় শেষ চাটিটা মারলেন ... ধিন ধা ত্রেকে/ ধিন ধা ত্রেকে/ ধিন ধা কৎ তা ধা ... আর ওনার বোল শেষ হলে মা জখম – এ – জিগর দেখেঙ্গে বলে শেষ টানটা দিলো, এতক্ষণ ধরে ক্রমাগত ওপর নীচ করতে থাকা মায়ের কণ্ঠমণিটা এবার ধীরে ধীরে আবার নিজের জায়গায় ফিরে আসছে, আলতো করে মুখের ওপর এসে পড়া চুলের গোছাটাকে সরিয়ে মা এবার তার বিনীত দৃষ্টি মেলে ধরলো দর্শকাশনের দিকে, হলে পিন পড়লেও এখন তার শব্দ পাওয়া যাবে যেন , আর সেই নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে পণ্ডিত দাদুই মাথা নাড়তে নাড়তে প্রথম উঠে দাঁড়ালেন, ওনার ডান হাতটা মায়ের চিবুকে রেখে বা হাতটা রাখলেন মায়ের মাথার ওপর আর সঙ্গে সঙ্গে গোটা হলঘরটা হাততালিতে যেন ভেঙ্গে পড়লো, গা বেটী, দিল খুলে আর একবার শেষ লাইন দুটো গা,

ফির ভি এ জিদ হ্যায় কে হাম জখম-এ-জিগর দেখেঙ্গে

তির – এ – নজর দেখেঙ্গে, জখম – এ – জিগর দেখেঙ্গে

দাদুর পায়ে হাত রেখে মা প্রণাম করলে দাদু মাকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলো, গুরু শিষ্যা দুজনার চোখেই এখন জল , আশেপাশে তাকিয়ে দেখি গুরু-শিষ্যার চোখের জল তাঁদের চোখেও যেন প্লাবনের ডাক দিয়েছে, আমার কিন্তু ভীষণ গর্ব হচ্ছে এখন, ভীষণ ইচ্ছে করছে এক দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে গোটা পৃথিবীটাকে ডেকে বলি , দেখো, এই হচ্ছে গিয়ে আমার মা, মিসেস কাজল কর, দেখবে একদিন আমার মায়ের গলার সুরে সারা পৃথিবীটা কেমন দুলে দুলে উঠবে ।



কিছুতেই আজ ঘুম আসছে না, বিছানায় শুয়ে শুয়ে খালি এপাশ-ওপাশ করছি, আসলে মনের মধ্যে একটা টেনশন আছে, কাল স্কুলের অ্যানুয়াল ডে আর এবার অ্যানুয়াল-ডে-র থিম হিসেবে আমরা মানব ফ্ল্যাগ বানাবো ঠিক করেছি, কাল আমাকে গিয়ে দাঁড়াতে হবে ফ্ল্যাগের মাঝে মানে, তাই নীল প্যান্ট নয় কাল আমার সাদা প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরে স্কুল যেতে হবে, ঈশ, মাকে বলতে ভুলে গিয়েছি যে সাদা প্যান্টের একটা বোতাম ছেঁড়া , কাল সকালে উঠে বোতামটা যেন আগে লাগিয়ে দেয়।

কী রে এই রাতে আবার কোথায় চললি, আমাকে বিছানা থেকে নামতে দেখে ঠাকুমা জিজ্ঞাসা করে উঠলো।

ঠাকুমাকে বোতামের কথাটা বললাম, যাই মাকে গিয়ে বলে আসি কাল সকালে উঠেই যেন আগে প্যান্টের বোতামটা লাগিয়ে দেয়।

আরে বাবা, এই কথাটা বলার জন্য তুই এখন গিয়ে ওদের ঘুম ভাঙাবি! কাল সকালে বললে হবে না!

না, কাল সকালে যদি ভুলে যাই তখন কী হবে ! ঠাকুমার বাড়ন না মেনে এক লাফে বিছানা থেকে নেমে পড়লাম, পাশের ঘরের দরজায় গিয়ে মাকে ডাকতে যাব ঠিক তখনই ভিতর থেকে বাবার গলা ভেসে এলো

আমার ছোঁয়া যে এখন আর তোমার ভালো লাগে না, সেটা এত ঘুরিয়ে বলার কী দরকার?

যা বাবা! কখন আবার বললাম যে তোমার ছোঁয়া আমার ভালো লাগে না!

সব কথা কি মুখে বলবার দরকার পড়ে, কিছু কিছু কথা তো মানুষ তার হাবভাবেও বুঝিয়ে দেয় ।

সত্যি বলছি গো আজকে শরীরটা না একদম ভালো লাগছে না , মায়ের গলায় যেন আকুতি ।

শরীর ভালো লাগছে না, না অলোক ক’দিনের জন্য বাইরে গিয়েছে বলে মন ভালো লাগছে না?

দরজার ওপার থেকে কয়েক মুহূর্ত আর কোনও শব্দ ভেসে এলো না আর তারপর সেই নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে এক সময় মায়ের গলা আবার শুনতে পেলাম, তবে মায়ের কণ্ঠস্বরে এখন আর কিছুক্ষণ আগের সেই আকুতিটা নেই, তার জায়গায় সেখানে যেন কঠিন এক দৃঢ়তা, দেখো, তোমায় আগেও বলেছি, আবারও বলছি, অলোক আর আমাকে নিয়ে তোমার মনে যে সন্দেহের বীজটা তৈরি হচ্ছে সেটা প্লিজ দূর করো, একটা কথা বোঝার চেষ্টা করো, তোমার বয়স হচ্ছে কিন্তু, আর এইসব হাবিজাবি ভেবে যদি তোমার কিছু একটা হয়ে যায় তখন কিন্তু আমাদের আর কেউ দেখার থাকবে না।

হাসালে! আমি মরে গেলে তোমায় দেখার কেউ থাকবে না! এটা তুমি বলবে আর আমাকে সেটা বিশ্বাস করতে হবে! বাবার গলায় যেন এখনও বিদ্রূপ লেগে আছে! কী ভাব তুমি আমায় কাজল !

দেখো আমার ভাবায় কিছু আসে যায় না কিন্তু তুমি কী ভাবছ সেটা একবার খোলসা করে বলবে?

যা বাবা! সেটা এখনও খুলে বলতে হবে ! এ কথাটা তো মানবে আজকাল তোমার সঙ্গ পাওয়ার জন্য কত লোক কাজকর্ম লাটে তুলে সারাদিন হাপিত্যেশ করে বসে থাকে আর তুমি কী না বলছ আমি মরে গেলে তোমার মাথার ওপর কেউ থাকবে না, সত্যি বলো তো এটা একটু বাড়াবাড়ি ধরনের ন্যাকামি হয়ে যাচ্ছে না! শোনো কাজল আজকাল তুমি অনেক উপরে উঠে গিয়েছ, আর সেখানে আমার মত বুড়ো স্বামী বাঁচল কী মরলো তাতে তোমার সত্যিই কিচ্ছু আসে যায় না!

নিঃশব্দে আমি ঠাকুমার বিছানায় ফিরে আসি ।

কী রে, বোতাম লাগানোর কথাটা মাকে বললি নাকি ওরা ঘুমিয়ে পরেছে?

ঠাকুমার বুকে মুখ গুঁজি, ও ঠাকুমা বাবা এত তাড়াতাড়ি কেন বুড়ো হয়ে গেল গো?

ক্রমশ