বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ১৮, ২০২৪

কথাগুলো বলা হলো না, পর্ব -১৫

১৫

মুসলিমদের কী একটা পরব আছে যেন, অনেক অফিস তাই আজ ছুটি, স্কুল কলেজও কিছু বন্ধ, আমাদের অফিস অবশ্য খোলা, ঝিনুকেরও স্কুল আছে, তবে পাপানের আজ ছুটি, আর তাই পাপান আমার সঙ্গে এখন বিছানায় গড়াগড়িখাচ্ছে, নইলে অন্যদিন তো বেচারিকে এর মধ্যে স্কুলে বেরিয়ে যেতে হতো , ঝিনুক অবশ্য অন্য দিনের মতই আজও ছ’টায় উঠে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে ওর স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতির টের পাচ্ছি, উর্মিরও প্রতিদিনকার ছোটাছুটি শুরু হয়ে গিয়েছে , হলঘর-বেডরুম-কিচেন, চরকির মত পাক খাচ্ছে, রান্নাঘরে কড়াইতে তেল ঢেলে ঝিনুককে তাড়া দিলো, খাসনি এখনো, তাড়াতাড়ি খেয়ে জুতোটা পরে নে, নইলে আজ কিন্তু বাস মিস হয়ে যাবে, আর বাস মিস হলে ক্লাস টেস্টও দেওয়া হবে না, মেয়েকে মৃদু ধমক দিয়েই আমার চায়ের কাপটা শোওয়ার ঘরের টেবিলের ওপর নামিয়ে উর্মি বললো ছেলের সঙ্গে বুট বুট না করে ঝিনুককে তো একটু বাসস্টপে ছেড়েও আসতে পারো , মায়ের গলা পেয়েই পাপান ঘুম থেকে ওঠা অবধি আজ যে কথাটা বারবার বলছে সেটা রিপিট করলো, বাবা – অফিস – বাবা পচা, ঝি-ই-ই – স্কুল – ঝি পচা, পাপান – ছুটি – পাপান গুড, বুঝতে পারছি না, পাপান কাকে পচা বলছে, ঝিনুক আর আমাকে নাকি আমাদের স্কুল আর অফিসকে , ঝিনুককে বাসস্টপে ছাড়তে যাব, ছেলে বায়না ধরলো , আমাদের সঙ্গে যাবে, এক একদিন এরকম হয় , সকাল থেকেই কারোর না কারোর লেজুড় হয়ে যায় একদম, আজ যেমন আমার গায়ে লেপটে রয়েছে, ঝিনুককে বাসে তুলে দিয়ে আসার পরও কোল থেকে নামতে চাইছিল না, যত বলি, ওরে নাম, আমার অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে, পাপান কিছুতেই কথা শুনছিল না।

ব্রেকফাস্ট সেরে অফিসে বেরুবে বলে সোফায় বসে জুতোর ফিতে বাঁধছি, কামালের ছেলেটা এসে দরজায় বেল বাজালো, কাল থেকে ছাদের রেলিংয়ের কাজটা শুরু হয়েছে, কাল যেখানে যেখানে গাঁথনি আলগা হয়ে গিয়েছিল সেখানকার গাঁথনি সব ভেঙ্গে দিয়েছে কামাল, আজ ঐ পরশনগুলোতে নতুন করে ইট গাঁথার কথা। এই জন্যই এই লোকগুলোর ওপর বিরক্তি লাগে, ছেলেকে দিয়ে কামাল বলে পাঠিয়েছে যে আজ ও কাজে আসতে পারবে না, বৌয়ের নাকি শরীর খারাপ, বৌকে ডাক্তারখানায় নিয়ে যেতে হবে , ঠিক আছে, তোর বৌয়ের শরীর খারাপ, তাকে নিয়ে তোর ডাক্তারখানায় যাওয়াটা নিশ্চয়ই জরুরী, কিন্তু তোর কাছে তো আরো অনেক মিস্ত্রি আছে, তাদের কাউকে পাঠিয়ে দে, তা না, ছেলেকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছে যে কাল নিজে এসে কাজটা করবে । ঈশ, এই জানলে কালকেই ওকে দিয়ে কাজটা শেষ করিয়ে রাখতাম, ছাদটার দুটো জায়গা একদম ন্যাড়া হয়ে রয়েছে।

কামালের ছেলেটা চলে যেতেই পাপান ঘরের ভিতর থেকে দৌড়ে এলো, হাতে ড্রয়িং খাতা।

বা-ব্বা, ফ্লাওয়ার, বুঝলাম কাল স্কুলে ফুল আঁকা শিখিয়েছে, ঈষৎ বাঁকানো একটা লাইনের মাথায় ছোট ছোট কতগুলো বৃত্ত, তাতে কালার পেন্সিল দিয়ে লাল-নীল বিভিন্ন রং করা।

খাতাটা হাতে নিয়ে বললাম, ভেরি গুড, ছেলে অবশ্য আমার অ্যাপ্রেসিয়েসনের তেমন তোয়াক্কা করলো না , সে ততক্ষণে বলতে শুরু করেছে, জানো বাব্বা, কাল আন্টি আমাকে আর সুমনকেই শুধু গুড বলেছে, এই মহার্ঘ খবরটা শেয়ার করেই পাপান বলে উঠলো , বা-ব্বা, আমি অফিস যাব । এত মিষ্টি করে কথাটা বললো যে আমি আর উর্মি দুজনাই ওর কথা শুনে হেসে ফেললাম , আমার কোল থেকে পাপানকে নামিয়ে উর্মি ওকে বোঝাতে শুরু করলো , বোকা ছেলে, ছোটরা কি অফিসে যায়, তুমি বড় হও, তারপর তুমিও বাবার মত অফিসে যাবে।

আমি কবে বড় হব ? শিশুর অবোধ জিজ্ঞাসা।

শূন্যে ডান হাতটা ওপরের দিকে তুলে উর্মি পাপানকে বোঝাতে চেষ্টা করলো যে সে অতখানি লম্বা হলেই তাকে বড় বলে গণ্য করা হবে।

বেরবো বলে সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি, উর্মি নিচু স্বরে বললো, দুপুরে পাপানকে রাখার ব্যাপারটা যেন মা-কে আরেকবার মনে করিয়ে দেই। আজ দুপুরে উর্মিদের কিটি পার্টি আছে, পাপানের স্কুলের বন্ধুদের মায়েরা মিলে এই কিটি পার্টিটা চালু করেছেন, প্রতি মাসের একটা বিশেষ দিনে মহিলারা তিন-চার ঘণ্টার জন্য নিজেদের মত করে আড্ডা মারেন , দিন-দিন এই কিটি পার্ট ব্যাপারটা কিন্তু মহিলাদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে , সেদিন পেপারে একটা আর্টিকেল পড়ছিলাম, পয়সাওয়ালা ঘরের মহিলারা নাকি আজকাল এই কিটি পার্টিটাকে আর নিছক খাওয়া-দাওয়া আর গল্প-গুজবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছেন না, এক-এক মাসে পার্টির সঙ্গে তারা এক-এক রকম ইভেন্টও জুড়ে দিচ্ছেন, নাচ, গান, ম্যাজিক, ফ্যাশন শো , কোনো কিছুই বাদ যাচ্ছে না, কিছুদিন আগে দিল্লির এরকম একটা পার্টিতে নাকি ভাড়া করা পুরুষ মডেল আনিয়ে মহিলারা মেল-স্ট্রিপজিংয়ের মজাও নিয়েছিলেন !

কাল রাতে তো মা বললোই যে দুপুরে পাপানকে রাখবে, উর্মির মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে উঠলাম।

না, মানে, উনি তো আবার বিশেষ বিশেষ সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন , তাই বলছিলাম, তুমি যদি অফিস বেরনোর আগে একবার বলে যাও তাহলে ভালো হয় , আমি জানি উর্মি কেন এ কথা বলছে, সেদিন ওর দাদা-বৌদির বিবাহ বার্ষিকীর দিন দুপুরে মাকে যখন বললাম যে উর্মির মা বিশেষ ভাবে মাকে যেতে বলেছেন তখন মা বলেছিল যে যাবে, কিন্তু বিকেলে বেরনর আগে মা আমায় ডেকে বললো, তোরা ঘুরে আয়, আমার পেটটায় আবার ব্যথা হতে শুরু হয়েছে। উর্মিদের পার্টিটা দুটো নাগাদ, ঘণ্টা দু-তিনেকের মত চলবে, উর্মি অবশ্য বললো যে ও পুরো পার্টিটা অ্যাটেন্ড করবে না, ঝিনুকের স্কুল থেকে ফিরে আসার আগেই বাড়ি ফিরে আসবে, অফিস বেরনর আগে উর্মিকে বললাম, তুমি বরঞ্চ এক কাজ করো , বেরনর আগে পাপানকে ঘুম পাড়িয়ে দিও যাতে বিচ্ছুটা সারা দুপুর মায়ের সঙ্গে হুজ্জতি করতে না পারে ।

দরজা খুলে বেরতে যাচ্ছি, উর্মির হাতের আগল থেকে পাপান বলে উঠলো , বাবা, তুমি পচা। ঝিনুককেও আজ স্কুলে যাওয়ার আগে পাপান বলেছিল, ঝি-ই-ই তুই পচা।



দুপুরে সিকো কর্পোরেশনের জি এম পারচেজের সঙ্গে আজ মিটিং আছে, একটা অফারের ফাইনালাইজেশনের ব্যাপারে উনি ডেকে পাঠিয়েছেন, শুনেছি খুব কড়া নেগোশিয়েটর নাকি উনি, ডিসকাশনের সময় সাপ্লায়ারদের কোনো সুযোগই দেন না, উলটে তাদের থেকে রগড়ে একেবারে ডিসকাউন্ট নেন, এর আগেও অবশ্য আমরা ওনাদের অর্গানাইজেশন থেকে তিন-চারটে অর্ডার পেয়েছি, কিন্তু ঐ অর্ডারগুলির ভ্যালু বেশী ছিল না বলে মিস্টার নাগপাল সেই সব অর্ডারের ফাইনালাইজেশনের সময় ইনভলভড ছিলেন না। আজকের কেসটা বেশ বড়, দেখা যাক মিস্টার নাগপাল কী বলেন, তবে সত্যি কথা বলতে কী, আজকাল আর এসব মিটিং-ফিটিং নিয়ে অত টেনশন হয় না, কেসের গতি প্রকৃতি দেখে আগেভাগেই একটা আন্দাজ হয়ে যায় যে অর্ডারটা পাব কি না, এই যেমন, আমার ক্যালকুলেশন বলছে এই অর্ডারটা শেষ অবধি আমরাই পাবো।

সিকো করপোরেশনের অফিসটা গ্র্যান্ড হোটেলের ঠিক উলটো দিকে, পৌনে দুটো নাগাদ বিল্ডিংয়ের সামনে পৌঁছে একটা সিগারেট ধরালাম, সিগারেটে টান দিতে দিতে আরো একবার মনে মনে হিসেব কষে নিলাম যে ম্যাক্সিমাম কতখানি ডিসকাউন্ট দেওয়া যেতে পারে। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে লিফটে করে নির্দিষ্ট ফ্লোরে পৌঁছে রিসেপশনে বসে থাকা ভদ্রমহিলাকে ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললাম, দুটো থেকে আমার মিস্টার নাগপালের সঙ্গে মিটিং আছে, ভদ্রমহিলা ফোনে কথা বলে জানালেন যে আমি যেন কাঁচের দরজাটা পার করে ডান দিকের শেষ যে কেবিনটা আছে সেখানে যাই, ঐ কেবিনেই মিস্টার নাগপাল আমার জন্য অপেক্ষা করছেন ।

দরজায় নক করে ভিতরে ঢুকি , মাঝ বয়সী মিস্টার নাগপাল ইউ শেপ টেবিলের ও প্রান্তে বসে রয়েছেন, আমাকে বসতে বলে ইনটারকমে উনি দু কাপ কফি চেয়ে পাঠালেন, চেহারাটা একটু ভারিক্কী গোছের ভদ্রলোকের, দেখলেই মনে হয় যেন খুব উঁচু পোস্টে কাজ করেন, পোস্টটা সত্যিই ওনার খুব উঁচু, আজকাল সিকো মানে ওনাদের কোম্পানি এল পি পাইপিংয়ের লাইনে খুব ভালো কাজ করছে, আর সেসব কাজে যা প্রকিওরমেন্ট হয় এই ভদ্রলোকই হচ্ছেন তার ফাইনাল ডিসাইডিং অথরিটি। ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে হঠাৎ মিস্টার নাগপাল আমায় বললেন , মিস্টার কর, আই অ্যাম সরি টু সে আপনারা মনে হয় অর্ডারটার ব্যাপারে সেরকম ইন্টারেস্টেড নন।

বা ! বেশ ভালো বাংলা বলেন তো ভদ্রলোক , অনেকদিন ধরে মনে হয় কোলকাতায় আছেন , কেন স্যর আপনার এরকম মনে হচ্ছে, খুব বিনীত ভাবে জিজ্ঞাসা করলাম।

যা প্রাইস আপনারা কোট করেছেন তা তো আকাশ ছোঁওয়া, ইনফ্যাক্ট আপনাদের প্রাইস অন্যান্যদের তুলনায় অনেক অনেক বেশী।

মনে মনে হাসলাম , তাই যদি হয় তবে আমায় ডেকে পাঠিয়েছেন কেন, আসলে ভদ্রলোক বহু ব্যবহৃত এবং বহু পুরনো একটা স্ট্রাটেজি নিয়ে খেলতে শুরু করেছেন, উনি আমার সামনে এখন এমন একটা আবহাওয়া তৈরি করতে চাইছেন যে অর্ডার পাওয়ার ব্যাপারে আমার কনফিডেন্সটাই যেন চলে যায়, আর তখন উনি আমাকে দমিয়ে বেশী করে ডিসকাউন্ট নেবেন , না মিস্টার নাগপাল, আপনি সত্যিই যদি এরকম ভেবে থাকেন তাহলে খুব ভুল করেছেন , আমারও নয় নয় করে তেইশটা বসন্ত পার হয়ে গেছে এই লাইনে, আমাকে আপনি ওসব বলে ঘাবড়াতে পারবেন না । মুখে বললাম , স্যার কী বলছেন! আমাদের প্রাইস বেশী হতেই পারে না, পার্সোনালি আমি অফারটা বানিয়েছি এন্ড আই হ্যভ কনসিডারড দ্য বেস্ট পসিবল ডিসকাউন্ট হোয়াইল কোটিং।





এই কুশলদা, বলুন না কোন কোম্পানির ওয়াশিং মেশিন ভালো , ফোনের অপর প্রান্তে শুভ্রা , উত্তর না পেয়ে তাড়া লাগালো, আরে বাবা বলবেন তো।

দাঁড়াও, একটু ভাবতে তো দাও।

উঃ, আপনার সব কিছুতেই খালি ভাবা-ভাবি।

সত্যি কথা বলতে কী এই সব জিনিসপত্রের ব্যাপারে আমার সেরকম কোনো আইডিয়াই নেই, বাড়ির যে মেশিনটা আছে সেটা আমি কোনদিন চালিয়ে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না, তাই শুভ্রাকে বললাম দেখো এই সব জিনিসের নামী ব্রান্ডগুলিতে মনে হয় খুব একটা পার্থক্য হয় না, তাই যে কোনো ব্রান্ডের মেশিনই তুমি কিনে নিতে পারো, শুধু দেখে নিও যে বাড়ির কাছাকাছি আফটার সেলস সার্ভিসের সুবিধা আছে কি না, তা হঠাৎ করে ওয়াশিং মেশিন কিনছ যে বড়?

আরে আর বলবেন না , আজকাল এমন কুড়ে হয়ে গিয়েছি না যে থুপিয়ে থুপিয়ে জামাকাপড় কাঁচতে আর ইচ্ছে করে না ।

গুড, তা ওয়াশিং মেশিন কেনার পার্টিটা কবে দিচ্ছ?

হু বাবা! কিনছি তো একটা ওয়াশিং মেশিন, তার জন্য আবার পার্টি! ঠিক আছে, যে কোনো ছুটির দিন বৌদি আর ঝিনুককে নিয়ে চলে আসুন, ওদের সঙ্গে সেদিন তাহলে আলাপটাও হয়ে যাবে আর আপনার পার্টিটাও মিটিয়ে দেওয়া যাবে ।

শুভ্রাকে বলি, ঠিক আছে একদিন সময় করে বৌ আর মেয়েকে নিয়ে আসব ওর বাড়ি , মনে মনে বলি, পাগল, উর্মিকে নিয়ে তোমার বাড়ি যাই আর আমার জীবনের যেটুকু শান্তি অবশিষ্ট আছে সেটুকুও ধ্বংস হয়ে যাক , এমনিতেই উর্মি সব সময় আমার চারপাশে হাজারো অশরীরী প্রেমিকাকে ঘুরে বেড়াতে দেখে, তারা নাকি দিনরাত আমার সঙ্গে ফষ্টি-নষ্টি করে, একদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে একটু দেরী হলে বা কোনো ছুটির দিন কোনো কাজে বেরলে উর্মি অমনি বলে ওঠে , থাক, থাক, অত আর বানিয়ে বানিয়ে কৈফিয়ত দিতে হবে না, যাচ্ছ তো গার্ল-ফ্রেন্ডকে নিয়ে সিনেমা দেখতে, সেটা বললেই হয়, না শুভ্রা, তোমার কথা বাড়িতে বলে বা উর্মিকে তোমার বাড়িতে নিয়ে এসে আমি আমার জীবনের অবশিষ্ট শান্তিটুকু আর হারাতে চাই না।


মিটিং শেষ, মিস্টার নাগপালদের অফিস থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাই , মনটা খুশীতে এখন ডগমগ করছে, ভদ্রলোকের সঙ্গে ডিসকাশন শুরু হওয়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই কে যেন ভিতর থেকে বলতে শুরু করেছিল , কুশল, এই ভদ্রলোক কিন্তু আজ তোমায় প্রাইস কমানোর জন্য ডাকেন-নি , হি নিডস সামথিং এলস, একটু খেলাও, দেখবে নিজেই উনি তোমার জালে এসে ধরা দেবেন , টোটাল ডিসকাউন্টটা তাই জিজ্ঞাসা করা মাত্র দুম করে দিয়ে বসলাম না, থ্রটেল করে আড়াই থেকে শুরু করলাম, ভদ্রলোক আড়াই শুনে চোখমুখ এমন করে উঠলেন যে অর্ডারটা যেন তক্ষুনি উনি অন্য কাউকে দিয়ে দিচ্ছেন , মুখে একটা বুদ্ধ মার্কা হাসি নিয়ে ওনার মুখের দিকে চেয়ে বসে থাকলাম , বেয়ারা এসে আরো এক কাপ কফি রেখে গেলো , কফির কাপে চুমুক দিয়ে ডিসকাউন্টটা বাড়িয়ে এবার চারে তুললাম , সঙ্গে সঙ্গে কথার ভাজে জানালাম , স্যার, এসব ডিসকাউন্ট ফিসকাউন্ট নিয়ে পারসোনালি আপনার কি কোনো লাভ আছে, তার চেয়ে বলুন না, কত দিতে হবে, নাগপাল সাহেব বেশ পোড় খাওয়া খেলোয়াড়, আমার ইঙ্গিতটা ধরতে তাই ওনার দেরী হলো না, কিছুক্ষণ নেগোশিয়েট করে ঠিক হলো অফিসিয়ালি আমরা ওনাদের কোম্পানিকে তিন পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট দেব আর টোটাল অর্ডার ভ্যালুর দু পার্সেন্ট উনি পার্সোনালি নেবেন।

ট্যাক্সিটা অফিস বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়ালে ভাড়া মিটিয়ে লিফটে করে চারতলায় উঠে আসি , যাই, মিত্রকে গিয়ে খবরটা দেই, ক্যারল যেন আমার অপেক্ষাতেই ছিলেন, রিসেপশনের দরজা ঠেলে আমায় ভিতরে ঢুকতে দেখেই বলে উঠলেন, কুশল, প্লিজ তোমার বাড়িতে এখুনি কন্টাক্ট করো , দে আর ডেসপারেটলি লুকিং ফর ইউ ।

কেন, কী হয়েছে , ডিড দে টেল ইউ এনিথিং?

ক্যারল মাথা নেড়ে জানালো, নো, নো, দে ডিডন্ট টেল মি এনিথিং, বাট আই থিং ইটস ভেরি আর্জেন্ট , তাড়াতাড়ি তুমি বাড়িতে ফোন করো। বাড়ির ফোনে রিং হয়ে যাচ্ছে, কেউ তুলছে না, নিচে সুদীপজেঠুদের ঘরেও কেউ ফোন তুললেন না, কী হলো রে বাবা , গেলো কোথায় সব, ক্যারলকে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললাম , বুঝতে পারছি না, কেউ ফোন তুলছে না।

তাহলে তুমি বরঞ্চ এখুনি বাড়ি চলে যাও।


বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থেকে নেমে দেখি রোজ বিকেলের মুখে আমাদের পাড়াটা যেরকম শান্ত থাকে আজও সে রকম, রাস্তায় এখন লোকজন নেই বললেই চলে, আমাদের বাড়ি থেকেও কোনো আওয়াজ ভেসে আসছে না, সিঁড়িতে ওঠার মুখে দেখলাম সুদীপ জেঠুদের গ্রিলে তালা , দোতলায় সেনবাবুদের দরজাও বন্ধ, তিনতলায় আমাদের গ্রিলের দরজাটা অবশ্য হাঁ করে খোলা, জনশূন্য হলঘরটায় সব যেন কেমন অগোছালো হয়ে পড়ে রয়েছে, কিছুক্ষণ আগে যেন এখানে একটা ঝড় বয়ে গিয়েছে আর ঝড় শেষে সবাই যেন এখন কোথাও গা ঢাকা দিয়েছে, বেডরুম শূন্য, ঝিনুকের পড়ার ঘরেও কেউ নেই, উর্মিকে ডাকছি, কোনো সারা নেই , মাকে ডাকছি, কোনো জবাব নেই, মায়ের ঘরের দরজাটা অবশ্য খোলা , উঁকি মেরে দেখি মা ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে স্থির হয়ে বসে রয়েছে , চোখ বন্ধ, মায়ের সামনে গিয়ে ডাকলাম , কোনো সাড়া নেই, মায়ের শরীরটা ধরে এবার একটা ঝাঁকুনি দিলাম , ঝাঁকুনিটা খেয়ে মা যেন সম্বিত ফিরে পেলো আর চোখ খুলে আমায় দেখে কোনক্রমে বলে উঠলো বাবু, পাপান... মা কথাটা শেষ করতে পারলো না , তার আগেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো , ও মা পাপানের কী হয়েছে, মাকে তুলে বসানোর চেষ্টা করি, পারি না, মা মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে , চোখেমুখে একটু জল দেওয়া দরকার, কিন্তু জল পাই কোথায়, হাতের কাছে কোথাও জলের জগ বা বোতল দেখছি না, ধুর ছাই, মাকে ফেলে কিচেনের দিকে দৌড়ই , সিঁড়িতে চটির শব্দ, রান্নাঘর থেকে জল নিয়ে বেরিয়ে দেখি দোতলার মিসেস সেন আমাদের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন, ওনার চোখ মুখ কেমন যেন উদভ্রান্ত , চুলগুলোও অবিন্যস্ত, ভদ্রমহিলা এই ভাবে কোথায় গিয়েছিলেন?

আপনি এসে গিয়েছেন, ভালো হয়েছে, অনেকবার আপনাকে ফোন করা হয়েছিল কিন্তু আপনি অফিসে ছিলেন না, আমি ফিরে এলাম, ঝিনুক তো এখন স্কুল থেকে ফিরবে, তাই। ওরা সবাই হাসপাতালেই আছে … ভদ্রমহিলা এরকম খাপছাড়া ভাবে কথা বলছেন কেন , ওনাকে দেখে মুহূর্তের জন্য মায়ের কথাটা যেন ভুলে গিয়েছিলাম, মনে পড়তেই মায়ের ঘরের দিকে দৌড় লাগালাম , কী হয়েছে, আপনি ওভাবে দৌড়চ্ছেন কেন, মাসীমার কিছু হয়েছে নাকি , আমার পিছন পিছন মায়ের ঘরের দিকে যেতে যেতে ভদ্রমহিলা কথাগুলি বলে উঠলেন।

দেখুন না, মা হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।

ও মা! তাই নাকি! ভদ্রমহিলা আমার হাত থেকে জলের জগটা নিয়ে মায়ের মুখে জল ছিটতে ছিটতে বলে উঠলেন , একেই বলে বিপদের ওপর বিপদ, আমি মাসীমাকে দেখছি, আপনি বরঞ্চ তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে যান, আর দেরী করবেন না ।

এর আগেও উনি একবার হাসপাতালের কথাটা বলেছিলেন , কিন্তু হাসপাতালে যাব কেন ! কার আবার কী হলো, কিছুই বুঝতে পারছি না, খট করে মনে পড়লো মা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে পাপানের নামে কিছু বলছিল, তবে কি পাপানের … ভদ্রমহিলা আমার কথাটা শুনে কেমন যেন একটু থতমত খেয়ে গেলেন , না মানে, আপনি জানেন না যে পাপানের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে!

পাপানের অ্যাকসিডেন্ট! কী বলছেন ভদ্রমহিলা! কী হয়েছে পাপানের, কোথায় এখন ও , কোন হাসপাতালে পাপানকে নিয়ে গিয়েছে এরা, আমার প্রশ্নের তোড় সামলে ভদ্রমহিলা কোনোরকমে বলে উঠলেন, আজ দুপুরবেলায় পাপান ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছে, নিচের ঘরের সুদীপবাবু, ওনার স্ত্রী আর পাড়ার দু-তিনজন মিলে সঙ্গে সঙ্গে পাপানকে বাঙ্গুর হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে , ঘণ্টা খানেক আগে উর্মিও বাড়ি ফিরে পাগলের মত দৌড়িয়েছে হাসপাতালের দিকে ।

দিদি সত্যি করে বলুন তো পাপানের মারাত্মক কিছু হয়নি তো?

ভদ্রমহিলা যেন আমার প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিলেন না, জানালেন পাপান এমার্জেন্সিতে রয়েছে , উদভ্রান্তের মত রাস্তায় নেমে করুণাময়ীর মোড়ের দিকে দৌড়চ্ছি, ওখানে না গেলে ট্যাক্সি পাব না, ক্লাবের সামনে দেখি কুণাল স্কুটার নিয়ে কোথা থেকে যেন ফিরছে, আমাকে দেখেই বলে উঠলো , দাদা, আপনি এসে গিয়েছেন, আমি তো আপনার খোঁজেই আপনার বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম , কথা বলতে বলতে ও স্কুটারটা ঘুরিয়ে নিলো , বসুন তাড়াতাড়ি , স্কুটার চালাতে চালাতে কুণাল বলে যাচ্ছে , ঘাবড়াবেন না দাদা, বড় ডাক্তারকে খবর দেওয়া হয়েছে, এতক্ষণে মনে হয় এসেও গিয়েছেন, আসলে অনেকখানি রক্ত বেড়িয়ে গিয়েছে তো, তাই জ্ঞানটা ফিরতে দেরী হচ্ছে, কুণালের মুখেই শুনলাম উর্মি বেরিয়ে যাওয়ার পর প্রতিদিনকার মত কাজের মেয়েটি এসে দুপুরের এঁটো বাসনগুলি মাজছিল , পাপান তখন ঠাকুমার সঙ্গে শুয়ে শুয়ে খেলছিল, বাসন মাজার পর মেয়েটি মায়ের ঘর ঝাড় দিতে এসে দেখে মা বিছানায় পেট চেপে বসে আছে, মাকে ওভাবে পেট চেপে বসে থাকতে দেখে মেয়েটি জিজ্ঞাসা করে, কী গো মাসী, তোমার পেটে আবার ব্যথা শুরু হলো নাকি, মা ইশারায় মেয়েটিকে জানায় যে পেটে খুব ব্যথা হচ্ছে ।

তাহলে ঐ ব্যথা কমার ওষুধটা একটা খাও না ।

কোনোক্রমে মা মেয়েটিকে বলে যে ওষুধের বাক্সে পেন-কিলারের স্ট্রিপটা খুঁজে পাচ্ছে না।

ও মা! তাহলে কী হবে ! তুমি বরঞ্চ ওষুধের নামটা লিখে দাও , আমি এক দৌড়ে সামনের দোকান থেকে ওষুধটা নিয়ে আসি। মা ওষুধের নামটা লিখে দিলে মেয়েটি ঘরের দরজা খোলা রেখেই বেরিয়ে যায়, মা বা কাজের মেয়ে কেউই খেয়াল করেনি যে দরজা খোলা পেয়ে পাপানও মেয়েটির পিছু পিছু ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল আর তার কিছুক্ষণ পরেই সুদীপজেঠুরা বাড়ির সামনের রাস্তায় ঝপ করে ওপর থেকে কিছু একটা পড়ার শব্দ পান, সঙ্গে পাপানের মা-গো বলে চিৎকার, জেঠুরা ঘর থেকে বেরিয়ে দেখেন পাপান রাস্তায় পড়ে রয়েছে আর ওর শরীরটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে, কুণালের কথাগুলো আমার কানে ঢুকছে না, বাবা পচা, ঝি-ই-ই তুইও পচা, সকাল থেকে বলা পাপানের কথাগুলো খালি আমার মনের মধ্যে ভেসে উঠছে, হে ভগবান, তুমি এত নিষ্ঠুর হয়ো না , প্লিজ পাপানের কোনো ক্ষতি তুমি করো না, কুণালকে বলি, ভাই, আরো একটু জোড়ে চালাও।



এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ঢোকবার আগেই বাতাসে ভেসে এলো উর্মির চিৎকার, ওগো, তোমরা কেউ আমার পাপানকে ফিরিয়ে এনে দাও।

একজন ভদ্রলোক ওয়ার্ডের দরজা দিয়ে বেরচ্ছিলেন , ওনাকে প্রায় ধাক্কা মেরে ভিতরে ঢুকলাম , কিন্তু আসতে আমার দেরি হয়ে গিয়েছে, হলের ডানদিকের দ্বিতীয় বেডটার সামনে সুদীপজেঠুরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন আর উর্মি বিছানার ওপর শুয়ে থাকা পাপানের রক্তাক্ত শরীরটাকে বুকে জড়িয়ে পাগলের মত কাঁদছে।


সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে যাব, হঠাৎ খেয়াল হলো, আজ তো বাড়ির দোরগোড়ায় চেক-চেক লুঙ্গী পরা সেই ভদ্রলোককে দেখলাম না , একবার পিছন ফিরে তাকাই , না, আশেপাশেও কোথাও দেখছি না, মানুষের মন যেন বড় অদ্ভুত, রোজ লোকটাকে জুল জুল করে বুক পকেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনটা বিরক্তিতে ভরে ওঠে , আর আজ ওনাকে না দেখেও মনটা যেন ঠিক স্বস্তি হচ্ছে না , কোথাও যেন একটা কিচকিচানি শুরু হয়েছে, সত্যি এই জীবনে কত মানুষকেই না আমরা অপ্রয়োজনে এবং নিজের অজান্তেই মনে মনে বয়ে চলি, যাই হোক সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দেখি মায়ের ঘরের দরজা খোলা আর মা বিছানায় বসে রয়েছে, ছবি মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে শোয়া, আমাকে দেখে তাড়াতাড়ি করে উঠে বসলো মেয়েটা, ছবিকে পাশ কাটিয়ে মায়ের বিছানায় এসে বসি , কতদিন বাদে মাকে আজ আবার হাসতে দেখছি , মনটা খুশীতে ভরে উঠলো, ছবি জল নিয়ে এসেছে, কেমন আছ মা, জলের শূন্য গ্লাসটা ছবিকে ফেরত দিয়ে মায়ের আরো কাছে গিয়ে বসলাম , আমার কথার উত্তর না দিয়ে মা এক দৃষ্টে আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে, বাবু, তুই কিন্তু খুব রোগা হয়ে গেছিস, খাওয়া-দাওয়া ঠিক মত করিস না নাকি ?

ও মা খাব না কেন, তোমার বৌমা তো বলে দিন দিন নাকি আমার খাওয়া বেড়ে যাচ্ছে, কথাটা বলেই মনে হলো উর্মির প্রসঙ্গটা এসময় না তুললেই হতো, আসলে অনেকদিন বাদে মাকে আজ বেশ সুস্থ লাগছে, তাই এই মুহূর্তে উর্মিকে আমাদের আলোচনার মাঝে নিয়ে আসাটা মনে হয় ঠিক হলো না , উর্মি এখন এমনই এক প্রসঙ্গ যে তা আমার আর মায়ের মধ্যে একটা অস্বস্তির সৃষ্টি করে, অস্বস্তিটা অবশ্য মায়ের দিক থেকে নয়, মা কখনই উর্মির নামে নালিশ বা অভিযোগ করে না , বরঞ্চ আমার কাছ থেকে জানতে চায় যে ও কেমন আছে , শরীর স্বাস্থ্য ঠিক আছে কি না, আমি বলি , ছাড়ো না ওসব কথা , মা কিন্তু আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ছাড়ব কেন রে, তুই যেমন আমার ছেলে উর্মিও তো তেমনি আমার মেয়ে , আমি মাথা নিচু করে বসে থাকি, কী জানিস বাবু, আমার মনে হয় মেয়েটাকে তুই ভুল বুঝিস, মাকে কিছু বলতে যাই, মা আমায় থামিয়ে দেয়, একটা কথা কখনো ভেবে দেখেছিস, একার হাতে মেয়েটাকে সংসারের কত দিক সামলাতে হয়, ঘরের কাজ, ঝিনুকের দেখাশোনা, তারপর তোর মত একটা পাগলকে নিয়ে ঘর করা, একার হাতে এত কিছু করা কি চাট্টিখানি কথা নাকি !

আমি কিছু বলি না , এক দৃষ্টে চেয়ে থাকি মায়ের মুখের দিকে , আচ্ছা, মা তুমি যখন এই কথাগুলি বলো তখন কি সত্যিই তুমি এই কথাগুলি বলতে চাও , কে জানে, আজকাল সব কিছুতেই আমার কেমন যেন সন্দেহ হয়, একটা অবিশ্বাসের অদৃশ্য পর্দা যেন সব সময় আমার চোখের সামনে আজকাল উড়তে থাকে ।



কুণাল সঞ্জু ওরা সব বাড়ির নীচ অবধি এসেছিল, যাওয়ার সময় কুণাল আমার হাতটা ধরে বলে গেলো, কী আর বলবো দাদা, শুধু এটুকু বলছি, আমরা সবাই কিন্তু আপনাদের পাশে আছি, কোনো প্রয়োজন হলেই ডাকতে দ্বিধা করবেন না, এক একটা করে সিঁড়ি ভাঙছি আর মনে হচ্ছে যেন এক একটা যুগ পার করে আসছি, সত্যি এখনো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না যে পাপান আর কোনদিন বা ব্বা বলে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে না, ঈশ, কেন আমি কাল ছুটি নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কামালকে দিয়ে ছাদের রেলিংয়ের কাজটা শেষ করিয়ে রাখলাম না, দোষটা আসলে আমারই, আমিই দায়ী, আমার ভুলের জন্যই আমার ফুটফুটে ছেলেটা আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেলো।

সিঁড়িতে আমাদের পায়ের শব্দ পেয়ে দোতলার মিসেস সেন এসে নিঃশব্দে দরজা খুলে দিলেন, মাকে আর ঝিনুককে নিয়ে উনি বাড়িতেই ছিলেন, শ্মশানে যাননি, সবার হাতে একটা করে নিমপাতা দিয়ে বললেন আমরা যেন পাতাটা চিবিয়ে খেয়ে নেই, তারপর আমাদেরকে ঘরে ঢোকানোর আগে মোমবাতি জ্বালিয়ে একটা লোহার শিক গরম করে আমাদের সবার শরীরে শিকটা ছুঁইয়েও নিলেন।

বিক্ষিপ্ত ভাবে হলঘরের চারদিকে সবাই আমরা বসে রয়েছি, কারো মুখে কোনো শব্দ নেই, একটা অখণ্ড নিস্তব্ধতা যেন হলঘর জুড়ে, শুধু ঘড়ির কাটা নিয়ম মেনে টিকটিক করে বেজে চলেছে, মিসেস সেন নিজেকে অদ্ভুত ভাবে শক্ত রেখেছেন, কাউকে কিছু না বলে ভদ্রমহিলা মেঝে থেকে উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলেন, দেখতে পাচ্ছি গ্যাস ওভেন জ্বালিয়ে চায়ের জল চাপালেন , খেয়াল করিনি মা কখন যেন নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে হলঘরের এক কোনে দেওয়াল ধরে এসে দাঁড়িয়েছে, দূর থেকেও বুঝতে পারছি মায়ের চোখ দিয়ে সমানে জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে, ঠোটটাও যেন মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে, কিন্তু কী বলছে সেটা দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না।

বাড়ি ফেরার পর সুদীপজেঠিমা উর্মিকে ধরে সোফায় বসিয়ে দিয়েছিলেন , উর্মি সেই থেকে একই ভাবে দেওয়ালের দিকে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে সোফায় বসে রয়েছে, একদম শূন্য দৃষ্টি, এই ঘরের কারো উপস্থিতি বা কোনো ঘটনাই যেন উর্মিকে ছুঁয়ে যাচ্ছে না, ঝিনুক পায়ে পায়ে এসে উর্মির কোলে মুখ গুঁজলো , থেকে থেকে মেয়েটার পিঠটা কেঁপে উঠছে , বুঝতে পারছি ঝিনুক কাঁদছে, কাঁদুক, আমাদের বুকগুলো তো সব পাথর হয়ে গিয়েছে, মেয়েটা যদি সেই পাথরটাকে সরিয়ে একটু কাঁদতে পারে তাহলে ও কাঁদুক, কেঁদে একটু হালকা হোক, বড় ভালবাসতো ভাইকে, ভাই-বোনের ছদ্ম লড়াইয়ে সব সময় আঘাতটুকু নিজের বুকেই টেনে নিত, কখনো তা নিয়ে আমাদের কাছে নালিশও করত না, কখনো এসে বলত না, ভাই এই করেছে , ভাই ঐ করেছে , বরঞ্চ দু পাঁচ টাকা কখনো পেলে আমায় এসে বলত, যাও না বাবা, দুটো চকোলেট নিয়ে এসো , একটা ভাইয়ের, আর একটা আমার, মেয়েটা কাঁদছে , কাঁদুক, ঝিনুকের কান্নায় না হয় এই অসহ্য নিস্তব্ধতাটা একটু ভেঙ্গে যাক, আমি আর এই নিস্তব্ধতা সহ্য করতে পারছি না, উর্মির বৌদি ঝিনুককে ওর মায়ের কোল থেকে তুলে বললো, এদিকে আয় মা, কাঁদিস না , তুই কাঁদলে মাকে কে দেখবে বল তো।

ঝিনুক আর নিজেকে সামলাতে পারলো না, মায়ের কোল ছেড়ে মামির কোলে ভাই-ই-ই বলে গিয়ে আছড়ে পড়লো ।

আমিও আর পারছি না , বুকের ভিতরটা কেমন যেন দমবন্ধ দমবন্ধ লাগছে, ইচ্ছে করছে সবার অলক্ষ্যে গিয়ে ঝিনুকের মত আমিও একটু কাঁদি, একটা অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে বুকের মধ্যে, একটা ভার ভার, কিছুতেই সেই ভারটাকে আমি যেন ঠেলে সরাতে পারছি না , পাপান আর নেই, এ কথাটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, মনে হচ্ছে প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পর যেভাবে ও এসে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ত সেভাবে এখনই ঝিনুকের ঘর থেকে বের হয়ে দৌড়ে আসবে, দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার বুকের ওপর, বা-ব্বা বলে আমার নাকটা খামছে ধরবে , তারপর ঝিনুককে দেখে বলে উঠবে, ঝি-ই-ই তু-ই-ই প-চা-চা , উর্মি চোখ বড় বড় করে শাসন করতে গেলে মুহূর্তের জন্য শান্ত হয়ে মায়ের কোলে গিয়ে উঠে বসবে, তারপর চোখের নিমেষে উর্মির কোল ছেড়ে সোফায় উঠে সুইচ বোর্ডের সব সুইচগুলি অন করে দেবে, পাপান যত ঘর তছনছ করতে থাকবে উর্মির গলা তত উচ্চ স্বরে বাজতে থাকবে, কিন্তু আজ কী হলো, কই এতক্ষণ হয়ে গেলো, পাপান তো এখনো এসে আমার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল না, আমায় ডেকে বললো না , বা-ব্বা-আ কো--লে।

জেঠিমা আর বসে থাকতে পারছিলেন না, সুদীপজেঠু তাই জেঠিমাকে নিয়ে নিচে নেমে গেলেন, যাওয়ার আগে বাইরে ডেকে জেঠু আমায় বললেন উর্মির এভাবে পাথরের মত বসে থাকাটা ঠিক নয়, যেভাবেই হোক আমাদের সবাইকে চেষ্টা করতে হবে যাতে উর্মির বুকের ভিতরে জমে থাকা বাষ্পটা কান্না হয়ে বেরিয়ে আসে।



শোক সব কিছু স্তব্ধ করে দিতে পারে , আমাদের চারপাশের জীবনকে সে কিছুক্ষণের জন্য হলেও অনড় করে দিতে পারে, কিন্তু সময়কে সে দমিয়ে রাখতে পারে না, তাই সকাল পার করে ঘড়ির কাটা একটার ঘর ছুঁই ছুঁই এখন, সকাল থেকেই আজ পাড়ার অনেকেই আমাদের বাড়িতে এসেছেন, দু দণ্ড চুপ করে বসে থেকে সমবেদনা জানিয়ে চলে গিয়েছেন, বেলা যত গড়িয়েছে ভিড়টা তত হালকা হতে শুরু করেছে , উর্মির দাদা এই কিছুক্ষণ হলো বাড়ি ফিরে গেলেন, বলে গেলেন বিকেলের দিকে বৌদি আর শাশুড়িকে নিয়ে আবার আসবেন। সেনভদ্রমহিলা একটু আগে ঝিনুককে নিজেদের ঘরে নিয়ে গিয়ে জোড় করে দু-একদলা ভাত ওর মুখে ঠেসে দিয়েছেন, সুদীপজেঠু বারবার করে আমাদের সবাইকে বলছেন, তোমরা এভাবে কতক্ষণ আর খালি পেটে বসে থাকবে, যা হোক একটা কিছু মুখে দাও, নইলে তোমরা যে এবার সবাই অসুস্থ হয়ে পড়বে, জেঠিমাকে ডেকে উনি বললেন, দেখো তো, বৌমাকে যদি জোড় করে কিছু খাওয়াতে পারো।

ঝিনুককে খাইয়ে সেনগিন্নী আবার ওপরে উঠে এলেন, কাল থেকে ভদ্রমহিলা যন্ত্রের মত কাজ করে চলেছেন, সত্যিই অদ্ভুত মানসিক জোড় ওনার, জেঠু আর জেঠিমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি বরঞ্চ মাসীমার হাড়িতেই দুটো ভাতে-ভাত বসিয়ে দেই , তাহলে মাসীমাও এনাদের সঙ্গে একবারেই খেয়ে নিতে পারবেন।

কাল থেকে মা একটাও কথা বলেনি, সারারাত হলঘরের কোনে চুপ করে বসেছিল, আজও সকাল থেকে ঐ একই ভাবে বসে রয়েছে, সেনগিন্নী মায়ের কাছে গিয়ে বললেন, মাসীমা, রান্নার বাসনগুলি আমায় একটু দেখিয়ে দিন, তাহলে ভাতটা বসিয়ে দিতে পারি। হরিহরদাদু এসেছিলেন, খুব কষ্ট পেয়েছেন দাদু, বসে বসে সমানে কাঁদছিলেন, যাওয়ার সময় নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলছিলেন, হে ভগবান, যে মানুষটা যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে রয়েছে তাকে তুমি চেয়েও দেখো না আর যে ফুলটা সদ্য এই পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছিল তাকে তুমি এমন নিষ্ঠুরের মত কেড়ে নিলে, বুঝি না বাপু, এ তোমার কেমন বিচার!

দাদু বেরিয়ে গেলে আমি বারান্দায় এসে একটা সিগারেট ধরাই। কতক্ষণ বারান্দায় চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম খেয়াল নেই, হঠাৎ মেঝেতে থালা ছিটকে পড়ার ঝনঝন আওয়াজে আর তার সঙ্গে উর্মির চিৎকারে চমকে উঠলাম।

দূর হয়ে যান আমার চোখের সামনে থেকে।

দৌড়ে ঘরে ঢুকে দেখি বিছানায় বসে উর্মি আগুণ-পানা দৃষ্টি নিয়ে মায়ের দিকে চেয়ে রয়েছে, সারা মেঝেতে ভাত ছড়ানো, কাঁসার থালাটা মেঝেয় পড়ে এখনও তিরতির করে কাঁপছে। উর্মিকে দেখে মনে হচ্ছে যেন ফণা তোলা সাপ আর সেই ফণাটা যে কোনো মূহুর্ত্তে মেঝের দিকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের মাথার ওপর নেমে আসবে। উর্মির চিৎকারে আর থালা পড়ার আওয়াজে এর মধ্যে হলঘর থেকে সুদীপ জেঠু-জেঠিমা, অলোককাকু সবাই দৌড়ে বেডরুমে চলে এসেছেন, ঝিনুক খুব ভয় পেয়ে গিয়েছে , খাটের কোনে মেয়েটা জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সত্যি বলছি উর্মিকে দেখলে এখন ভয় পাওয়ারই কথা , উসকো-খুসকো চুল, চোখদুটো কেঁদে কেঁদে জবাফুলের মত লাল, বোঝা যাচ্ছে ওর মাথা থেকে পা অবধি এখন ক্রোধের একটা হলকা দ্রুত ওঠানামা করছে , আর সেই ওঠানামায় ওর পুরো শরীরটা যেন থরথর করে কাঁপছে।

কী হলো, ঘরে ঢুকে মাকে আর উর্মিকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলি বলে উঠলাম।

মা মেঝের দিকে তাকিয়েই জবাব দিলো, কাল থেকে তো কুটোটাও মুখে নাড়েনি, তাই ভাবলাম ... কথাটা শেষ করতে পারলো না মা, একদলা কান্না যেন মায়ের গলাটা চেপে ধরলো।

আর মায়ের সেই অস্ফুট বাক্যের মাঝেই উর্মি চিৎকার করে উঠলো, এখনো আপনি এখানে দাঁড়িয়ে, বলছি না, দূর হয়ে যান, হাঁপাতে হাঁপাতে উর্মি বলে চলেছে। কাল থেকে কুটোটাও মুখে নাড়েনি ! মায়ের বলা কিছুক্ষণ আগের কথাগুলি বিকৃত করে উর্মি বলে উঠলো, ঈশ কী দরদ! শুনুন, আপনাকে আর ঐ দরদ দেখাতে হবে না, তার চেয়ে নিজে গিয়ে গিলুন গিয়ে, ক্রোধে উর্মির চোখদুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে, পাপানকে খেয়েও যদি আপনার খিদে মিটে না থেকে তাহলে বলুন আমি নিজে গিয়ে আপনার জন্য ভাত বেড়ে দিচ্ছি, গিলতে থাকুন আপনি, যতক্ষণ না এই সংসারের সব কিছু গিলে আপনি শেষ করে দিচ্ছেন ততক্ষণ ... হাঁপাতে থাকে উর্মি।

বোন, চুপ করো, মাথা গরম করো না, উনি গুরুজন, গুরুজনদের সঙ্গে এভাবে কথা বলাটা ঠিক নয়, সেনগিন্নী দৌড়ে এসে উর্মিকে জড়িয়ে ধরলেন।

গুরুজন ! কীসের গুরুজন! ওরকম গুরুজনের মুখে আমি … বুঝতে পারছি উর্মিকে থামানো দরকার , ক্রোধে ওর বিচার-বুদ্ধি সব যেন লোপ পেয়ে যাচ্ছে, মুখে যা আসছে তাই বলছে ।

আপনারা ওনাকে গুরুজন বলেন, শুনুন তাহলে আপনাদের এই গুরুজনের কীর্তি কলাপ, আপনাদের এই গুরুজনের জন্যই কিন্তু আজ আমার ছেলেটা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো , একটু থামে উর্মি, খুব জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিতে থাকে, জানেন আপনারা, আপনাদের এই গুরুজন দিনের পর দিন এই ঘরে বসে পর পুরুষের সঙ্গে কী সব নোংরা কাজ করে গিয়েছে … আর সেই নোংরা কাজের পাপে আজ আমার ছেলেটা ...

হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে উর্মি ... আপনারা বলুন, ভগবান কি কখনো এত পাপ সহ্য করতে পারে …

উর্মিকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে সেনগিন্নী আবার বলে ওঠেন, থামো বোন , একটু শান্ত হও, এখন এসব বলা ঠিক নয় …

কীসের ঠিক নয়, কেন আমি চুপ করে থাকব, এতদিন তো আমি চুপ করেই ছিলাম, কখনো দেখেছেন কিছু বলেছি, কিন্তু আজ যখন আমার ছেলেকেই উনি কেড়ে নিলেন তখন কীসের জন্য আমি চুপ করে থাকব, শুনুন তাহলে, এই বুড়ি আমার সব শেষ করে দিয়েছে ... আমার সুখ , আনন্দ সবকিছু একদম জ্বালিয়ে ছারখার করে দিয়েছে … দেখবেন, দেখবেন আপনারা, দেখুন আমার বুকের ভিতরে কেমন আগুন জ্বলছে… একটানে উর্মি ওর বুকের কাপড়টা সরিয়ে ফেলে … ও যেন ভুলেই গিয়েছে যে এই মুহূর্তে এই ঘরে অলোককাকু বা সুদীপজেঠুরা দাঁড়িয়ে আছেন , দেখুন আপনারা, আমার বুকের ভিতরটা একবার দেখুন, দাউদাউ করে সেখানে কেমন আগুন জ্বলছে … আর সেই আগুনে জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে আমার ছেলেটা … এরপরেও আপনারা চুপ করে থাকতে বলবেন …

সেনগিন্নী এখনো জড়িয়ে রয়েছেন উর্মিকে, তোমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি বোন , কিন্তু একটা কথা তো মানবে, তোমার মত অতখানি না হলেও আমরা সবাই কিন্তু পাপানকে ভালবাসতাম, আমাদেরও কিন্তু আজ খুব কষ্ট হচ্ছে, বিশ্বাস করো তুমি, এই ঘরের প্রত্যেকটা মানুষের বুক কিন্তু আজ কান্নায় ফেটে যাচ্ছে, কথাগুলো বলতে বলতে ভদ্রমহিলা নিজেই কেঁদে ফেললেন , কোনক্রমে বললেন, কিন্তু কী করবে বলো, যা হওয়ার তা তো হয়ে গিয়েছে , পাপান তো আর ফিরে আসবে না, তাই এখন এসব বলে কী লাভ, তার চাইতে আমাদেরকে নিজেদেরই এখন সান্ত্বনা দিতে হবে … অন্তত ঝিনুকের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে তোমায় … মুখে আঁচল চাপা দিলেন মিসেস সেন ।

উর্মি কিন্তু সেনগিন্নীর কথাগুলো যেন শুনতেই পায় না, অস্থির চোখে ও এখন ঘরের ভিড়ে কাউকে যেন খুঁজছে, আর সেই খোঁজা শেষ হলে উর্মির দৃষ্টিটা গিয়ে স্থির হলো আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অলোককাকুর ওপর, এই যে মশাই শুনুন , হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি , শোক দুঃখ ভুলে উর্মির গলায় তীব্র বিদ্বেষ এখন, একটা কথা বলুন তো , আপনার কি লাজ লজ্জা বলে কিছু নেই … এত ঘটনার পরেও এখনো এখানে নির্লজ্জের মত দাঁড়িয়ে আছেন … আর দাঁড়াবেনই বা না কেন, পাপানকে খাওয়ার পর ঐ মহিলার সঙ্গে বসে আপনাকে এখন পরামর্শ করতে হবে না যে এরপর কাকে খাবেন ... চুপ করে আছেন কেন, বলুন, কাকে খাবেন এবার ... ঝিনুককে … তাই না ... কী ভেবেছেন আপনারা... আমি আপনাদের মতলব বুঝি না ... ঘরের সবাই চুপ, উর্মির কথাগুলোই শুধু তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের মত ঘরের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, আমরা কেউই কল্পনা করতে পারিনি যে এক ঘর লোকের সামনে উর্মি এভাবে অলোককাকুকে অপমান করবে, উর্মি অবশ্য আমাদেরকে হতবাক করে সমানে বলে যাচ্ছে ... খবরদার বলছি ... ঝিনুকের দিকে একদম চোখ তুলে তাকাবেন না, তাহলে ঐ চোখ কিন্তু আমি গেলে দেব ...

পাপানের মৃত্যুতে উর্মির ভিতরে জমে থাকা বহুদিনকার ঘৃণা যেন এখন লাভা-স্রোতের মত বেরিয়ে আসছে, ওর দৃষ্টি অলোককাকুর থেকে সরে গিয়ে ঘরের আর সবার দিকে ঘুরছে এখন, আপনারাও সবাই একটা কথা মন দিয়ে শুনে রাখুন, এক ঝটকায় সেনগিন্নীকে সরিয়ে উর্মি বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায় , ওর কাপড়ের আঁচল মেঝেতে লুটোচ্ছে , কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, পাপানকে আমি এই দুজনার পাপ থেকে বাঁচাতে পারিনি, কিন্তু আপনাদেরকে আমি কথা দিচ্ছি, ঝিনুকের কোনো ক্ষতি হতে আমি দেব না, তার জন্য এই দুটো শয়তানকে যদি খুনও করতে হয় তাও আমি করব, দরকার হলে এদের বুকের রক্ত চিরে খাবো কিন্তু ঝিনুককে আমি এদের নাগালে আসতে দেব না , আর একটা কথা ... আজ থেকে এই বাড়িতে আর কোনো পাপ হবে না, কথাগুলো বলতে বলতে উর্মি টলতে টলতে অলোককাকুর সামনে এসে দাঁড়ায়, উর্মির মাথার চুলগুলি খাড়া খাড়া , মুখের দু’কস বেয়ে ফেনা বেরচ্ছে, আপনাকে বলছি, মেঝের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা অলোককাকুর সামনে দাঁড়িয়ে কাকুর থুতনিটা তুলে ধরে উর্মি , কান খুলে একটা কথা শুনে রাখুন, আজ যে এই বাড়ি ছেড়ে যাবেন ভুলেও আর কোনদিন এ বাড়িমুখো হবেন না, আপনার সোহাগের কাজলের সঙ্গে যদি পীড়িত মাড়াতেই হয় তাহলে এরপর থেকে অন্য কোথাও তার ব্যবস্থা করবেন , এ বাড়ির ত্রিসীমানায় আপনাকে যেন আমি আর না দেখি।

বৌমা!!!!! অশ্রু প্লাবিত চোখে উর্মির মুখের দিকে তাকিয়ে মায়ের মুখ থেকে শব্দটা যেন ছিটকে বেড়িয়ে এলো … কী বলছ তুমি ওনাকে!!!!

কী বলছি! আবার হিসহিসিয়ে ওঠে উর্মি, দেখলেন আপনারা ... দেখলেন! এই ভদ্রলোককে দুটো কথা বলাতে মিসেস কাজল করের গায়ে কেমন লাগলো, আর গায়ে লাগবেই বা না কেন … সত্যি কথা শুনলে সবারই ওরকম গায়ে লাগে … উর্মির চোখের দৃষ্টি সরাসরি এখন মায়ের মুখের দিকে, ভেবেছিলেন কী আপনি, ঐ ঘরে বসে দিনের পর দিন রাসলীলা করে যাবেন আর আমরা কেউ তা টের পাব না, শুনুন, আপনাদের দুজনকেই আবারও বলছি, এতদিন আপনার ছেলের মুখের দিকে চেয়ে কিছু বলিনি, কিন্তু আপনাদের পাপে যখন আজ আমার ছেলে আমার বুক ছেড়ে চলে গেলো তখন এই পৃথিবীর কাউকে কিন্তু আমি আর রেয়াত করব না ...

না, উর্মিকে এবার থামানো দরকার, শোকে মনে হয় ও মেন্টালি কিছুটা আনব্যালেন্সড হয়ে গিয়েছে , ক্ষোভ-দুঃখ-হতাশা, মনের সব অনুভূতিগুলি যেন একসঙ্গে ওর ভিতর থেকে এখন দলা পাকিয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে , যেসব কথা বলার নয় বা যেসব কথার সঙ্গে পাপানের মৃত্যুর কোনো যোগাযোগ নেই সেই সব কথাও ও এখন চিৎকার করে একঘর লোকের সামনে বলে চলেছে, নো, আই মাস্ট স্টপ হার, জেঠুকে দেখলাম চোখের ইশারায় জেঠিমাকে বলছেন ঝিনুককে যেন এ ঘর থেকে নিয়ে যান, উর্মির হাতটা চেপে ধরি , শান্ত হও, মেঝেতে পড়ে থাকা আঁচলটা উঠিয়ে বলি, কেন বুঝছ না, তোমার যেমন কষ্ট হচ্ছে, আমাদের সবারই কিন্তু মানে আমার, মায়ের ...

কী বললে! ক্ষণিকের জন্য চুপ হয়ে যাওয়া উর্মি আবার যেন গর্জে ওঠে, পাপানের জন্য এই মহিলার কষ্ট হচ্ছে! এক গলা গঙ্গা জলে দাঁড়িয়েও তুমি যদি এ কথা বলো তাহলেও আমি তা বিশ্বাস করব না, আরে বাবা ওনার দুঃখ হবে কেন , আমি, পাপান, ঝিনুক আমরা কি কখনো ওনার কাছের মানুষ হতে পেরেছি না উনি আমাদের কখনো নিজের বলে মনে করেছেন, দেখছ না, কাল থেকে কেমন ঘাপটি মেরে বসে রয়েছেন, অপেক্ষা করছেন, একটানা কথাগুলি বলে উর্মি একটা দম নেয়, অপেক্ষা করছেন কখন এই শোকটা একটু কমবে আর উনি আবার আমার সংসারটাকে ছারখার করে দেওয়ার খেলাটা শুরু করবেন, তোমার মা … তোমার মা আসলে হচ্ছে গিয়ে... একটা ডাইনি , একটা রাক্ষসী, উর্মি যেন তেড়ে যেতে চায় মায়ের দিকে, কোনোক্রমে হাতের বেড়াজালে ওকে আটকাই, আমার হাতের আগল থেকেই উর্মি তখনো বলে যাচ্ছে, দেখছ না ডাইনিটা কেমন মিটমিট করে তাকিয়ে রয়েছে … রাক্ষসী কোথাকার … আমার জীবনটাকে তো তছনছ করে দিয়েছেই … আমার দুধের ছেলেটাকেও রাক্ষসীটা এবার খেয়ে নিলো ... আর তাতেও খিধে মেটেনি ওর ... তাই রাক্ষসীটা এখন নজর দিয়েছে আমার মেয়েটার দিকে ...

দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের সারা শরীরটা থরথর করে কাঁপছে।

ঝিনুককে হলঘরে কারোর কাছে রেখে সুদীপ জেঠিমা ইতিমধ্যে ফিরে এসেছেন, আমাকে সরিয়ে উনি এবার উর্মিকে নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন , বৌমা, শান্ত হও , শোকের সময়ে মনটাকে শান্ত রাখাটাই ঠিক কাজ , ওনার স্পর্শে উর্মির ভিতরের জ্বলনটা যেন এবার বৃষ্টির আকার নিলো, কেঁদে উঠলো উর্মি, কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকলো , একটা দিন, একটা মাত্র দিন, তা-ও দু-তিন ঘণ্টার জন্য, ছেলেটাকে একটু রাখতে বলেছিলাম, আর উনি ঐ সময়টুকুও পাপানকে একটু চোখে-চোখে রাখতে পারলেন না, ছেলেটা আমার ... সুদীপ জেঠিমার বুকে মাথা রেখে উর্মি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।



পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অলোককাকু শেষ চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু উনি ধরে ফেলবার আগেই মায়ের শরীরটা টাল খেয়ে আমাদের সবার চোখের সামনে মেঝেতে গড়িয়ে পড়লো।



আটটা বেজে গিয়েছে, না এবার বাড়ি ফিরতে হবে, মায়ের বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়াই, দরজার দিকে এগোই, ছবিকে দেখছি না, মেয়েটাকে দেখলে জিজ্ঞাসা করতাম যে কিছু লাগবে কি না, মাকে জিজ্ঞাসা করে কোনো লাভ নেই, জিজ্ঞাসা করলেই বলবে , সব আছে, আমার জন্য তোর অত চিন্তা করতে হবে না, তুই বরঞ্চ বৌমা আর ঝিনুকের একটু ভালো করে খেয়াল রাখ।

সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসছি, বাড়ির সামনের দোকানটা থেকে ছবি কিছু কিনে বাড়ি ফিরছে, আমাকে দেখে বললো, যাচ্ছেন দাদাবাবু?

মাথা নেড়ে বলি, হ্যাঁ ।

একটা কথা ছিল আপনার সঙ্গে।

ছবির মুখ দেখে মনে হচ্ছে, কথাটা বিশেষ সুবিধার নয়।

মাসিমা কি আপনাকে বলেছে যে উনি হরিদ্বারের আশ্রমে চলে যাচ্ছেন?



ক্রমশ